বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের আগমন ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে হলেও পরে তারা আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। এদের মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যায়। ১৭৫৭ সালে বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে তারা ক্ষমতা দখল করে নেয়। বাংলায় ইংরেজদের শাসন চলে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। এভাবে ১৭৫৭ সালের পরে বাংলায় যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সাধারণত আমরা তাকে ঔপনিবেশিক শাসন বলি। আর ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজ শাসনামলকে ঔপনিবেশিক যুগ বলি ।

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
উপনিবেশ কী তা ব্যাখ্যা করতে পারব;
উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার বিস্তার ও অবসানের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব;
বাংলায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের আগমন ও বাণিজ্য বিস্তার সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব;
বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারব; বাংলায় ইংরেজ শাসনের কার্যক্রম ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করতে পারব;
ইংরেজ কোম্পানি শাসনের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারব;
ইংরেজ কোম্পানি শাসনকালে বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করতে পারব; ইংরেজ কোম্পানি শাসনের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারব;
ব্রিটিশ শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা করতে পারব;
তৎকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করতে
ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব মূল্যায়ন করতে পারব,; বাংলার জাগরণের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব।

Content added || updated By

১৯৭০ সালে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । কিন্তু বিজয়ী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ষড়যন্ত্র শুরু করে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বার বার স্থগিত ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের মার্চের শুরু থেকে অসহযোগ আন্দোলন এবং ৭ই মার্চ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে' তোলার ডাক দেন। ফলে বাঙালির স্বাধীনতার প্রস্তুতি শুরু হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ২৫শে মার্চ বর্বর গণহত্যা শুরু করে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধও মুক্তিযুদ্ধ। মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনায় পরিচালিত নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি বিজয় অর্জন করে ।

একদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি নেয় আর অন্যদিকে তৎকালীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো তা বানচালের জন্য ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তিনি ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন সংকট তৈরি করেন। পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া তীব্র হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে আওয়ামী লীগের সকল কর্মসূচিতে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। বিশেষ করে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। এছাড়া শিক্ষক, পেশাজীবী ও মহিলা সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসে। একাত্তরের মার্চের শুরু থেকে প্রতিদিনের সকল সমাবেশে প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে। ভূট্টোর সাথে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ফলে এই দিন আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠকে সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। জনগণ এবারও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দের। শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের আরেক অধ্যায়-অসহযোগ আন্দোলন।

আওয়ামী লীগ ২রা মার্চ ১৯৭১ ঢাকা শহরে ও ৩রা মার্চ সারা দেশে হরতালের ডাক দেয়। ২রা মার্চ সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশাল সমাবেশে ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নেতৃবৃন্দ দেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এটিই ছিল সর্বসাধারণের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলিত 'স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে এ পতাকা ছিল আমাদের প্রেরণা। ৩রা মার্চ থেকে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন বা ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ওরা মার্চ গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এতে আন্দোলন আরও বেগবান হয় । ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইশতেহার ঘোষণা করে।

এ পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে ইয়াহিয়া খান ৬ই মার্চ এক বেতার ভাষণে ২৫শে মার্চ ঢাকায় পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে ঘোষণায় সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। এ পরিস্থিতিতে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার জন্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জনসভার আয়োজন করা হয়

কাজ : পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে বাঙালির প্রস্তুতির চিত্র তুলে ধরো।

Content added By

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে বিজয়ী দল হিসাবে আওয়ামী লীগের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশ পরিচালনার ঘোষণা দেন। জনগণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সর্বাত্মক অসহযোগিতার নির্দেশ দিয়ে তিনি তাঁর ভাষণে কোর্ট-কাচারি, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। আমরা জানি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালিত হয় জনগণের ট্যাক্স বা খাজনায় । তিনি তাঁর ভাষণে আরও বলেন, “যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততদিন খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো।”

বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ইয়াহিয়া খান ও তার সহযোগী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কর্মকাণ্ড দেখে বুঝেছিলেন এরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই তিনি একদিকে আলোচনা ও অন্যদিকে চূড়ান্ত সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য জাতিকে প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান ৷ প্রয়োজনে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি বলেন, “প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।” বক্তৃতার আর এক জায়গায় তিনি বলেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো । তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” এ কথায় গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মুক্ত করার প্রকাশ্য নির্দেশনা পাওয়া যায়। দশ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে তিনি তাঁর এ বক্তৃতায় ‘বাংলাদেশ' শব্দটি ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ নতুন রাষ্ট্রের নামকরণ চূড়ান্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বাঙালিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত রাখা। বক্তৃতায় শেষ অংশে “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ঘোষণা দিয়ে তিনি স্পষ্টভাবেই স্বাধীনতার ডাক দেন। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ উন্মুক্ত করতে ইয়াহিয়া ঘোষিত ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করার ব্যাপারে ৪টি পূর্বশর্ত ঘোষণা করেন।

১. সামরিক আইন প্রত্যাহার 

২. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর 

৩. সেনাবাহিনীর গণহত্যার তদন্ত 

৪. সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া

এ দাবিগুলো মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তিনি অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক এ দাবিগুলো কখনো মেনে নেয় নি। ফলে বাঙালির আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সারাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। তাদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এ ভাষণ যেন জাদুর স্পর্শে বাঙালি জাতিকে বীরের জাতিতে রূপান্তরিত করেছে। এ ভাষণ বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ইউনেস্কো ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ' হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ভাষণ ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড রেজিষ্টার'-এ গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টারি ঐতিহ্য হিসাবে ইউনেস্কো অন্তর্ভুক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীর একমাত্র অলিখিত ভাষণ হিসাবে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ভাষণের নির্দেশনা অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ জনগণ অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেয় এবং মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী, দেশের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, কল-কারখানা সব বন্ধ হয়ে যায় । বিক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানি বাহিনীকে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ করতে থাকে। খাজনা-ট্যাক্স আদায় বন্ধ হয়ে যায়। সেনানিবাস ব্যতীত সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। গভর্নর হাউস,সেনানিবাস কিংবা সচিবালয় থেকে নয়, সেদিন বাংলাদেশ পরিচালিত হয় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাড়ি (৬৭৭ নম্বর) থেকে। এটাই হয় সরকারের কার্যালয়। আর আওয়ামী লীগের সদর দপ্তরে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের কাজ চালিয়ে যান। অবস্থা উপলব্ধি করে ইয়াহিয়া ১৫ই মার্চ ঢাকা সফরে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেন। ১৬ই মার্চ থেকে আলোচনা শুরু হয়। ২২শে মার্চ জুলফিকার আলী ভূট্টো আলোচনার অংশ নেন। আলোচনা ব্যর্থ করে বাঙালি নিধনের নির্দেশনা দিয়ে ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। আর ওই দিনই মধ্যরাতে তারা বাঙালির উপর চরম আঘাত হানে। ওই কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা অসংখ্য বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করে।

কাজ-১ : মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র ও বাঙালিদের প্রস্তুতি বর্ণনা করো। 

কাজ-২ : শ্রেণিকক্ষে আলোচনার মাধ্যমে একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে তোমার ধারণা সংক্ষেপে লেখ। 

কাজ-৩ : শ্রেণিতে সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে, এ সম্পর্কে তোমার মতামত লেখ।

Content added By

পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে গণহত্যার অভিযান চালিয়েছিল তার নাম দিয়েছিল 'অপারেশন সার্চলাইট। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে এ অপারেশন সংগঠিত হলেও মূলত এর প্রস্তুতি চলতে থাকে মার্চের প্রথম থেকে। ৩রা মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত অস্ত্র ও রসদ বোঝাই এম.ভি. সোয়াত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ই মার্চ থেকে ২৪শে মার্চ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার ভান করে আসলে অভিযানের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করেন ও অপারেশন সার্চলাইট চূড়ান্ত করেন।

অপারেশন সার্চলাইট অনুযায়ী ঢাকা শহরে গণহত্যার মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমেই ঢাকা শহরের পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের নিয়ন্ত্রণভার পাকিস্তানি সেনাদের গ্রহণ করার কথা ছিল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও রেডিও- টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণ, স্টেট ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ, আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার, ঢাকা শহরের যাতায়াত ব্যবস্থাসহ শহর নিয়ন্ত্রণ ছিল হানাদার সৈন্যদের প্রাথমিক দায়িত্ব। অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় রাজশাহী, যশোর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, কুমিল্লায় সেনাবাহিনী, ইপিআর, আনসার, পুলিশের বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করার কথা উল্লেখ ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখলে রাখাও তাদের লক্ষ্য ছিল। ঢাকার বাইরে এ অপারেশনের প্রধান দায়িত্ব পান মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা। সার্বিকভাবে এ পরিকল্পনার তত্ত্বাবধান করেন গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খান । 

পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৫শে মার্চ রাত ১১.৩০ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাস থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এ সময় তাদের প্রথম আক্রমণের শিকার হয় ঢাকার ফার্মগেইট এলাকায় রাস্তায় মিছিলরত মুক্তিকামী বাঙালি। একই সাথে আক্রমণ চালানো হয় পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশলাইন্সে । বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদের পরিকল্পিত আক্রমণ ঠেকানোর মতো অস্ত্র ও প্রস্তুতি ছিল না তাদের। ফলে পাকিস্তানি সেনারা সেই রাতে তাদের অনেককেই নির্মমভাবে হত্যা করে ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আক্রমণ পরিচালিত হয় গভীর রাতে। ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াকত হলে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী হল) ঢুকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে ঘুমন্ত অনেক ছাত্রকে হত্যা করে। ঢাকা হলসহ (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা এবং রোকেয়া হলেও তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। মার্চের এই গণহত্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষকসহ ৩০০ ছাত্র-ছাত্রী ও কর্মচারী নিহত হন। জহুরুল হক হল সংলগ্ন রেলওয়ে বস্তিতে সেনাবাহিনী আগুন দিলে

ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত হয়। শুধু ২৫শে মার্চ রাতেই ঢাকায় ৭ থেকে ৮ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয় ।

ঢাকার বাইরে সারা দেশে সেনানিবাস, ইপিআর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনারা অসংখ্য বাঙালি সেনাকে হত্যা করে। এভাবে আক্রমণের শুরুতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের পুলিশ ও ইপিআর ঘাঁটিগুলোর উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে । এসব এলাকায় বহু নিরীহ লোককে হত্যা করা হয়।

অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২৫শে মার্চ রাত দেড়টায় (২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে) বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেফতার করে। তবে গ্রেফতারের আগেই তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে দেশবাসীকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান ।

কাজ- ১ : অপারেশন সার্চ লাইটের আওতায় সংগঠিত গণহত্যার ঘটনা দলগতভাবে অভিনয় করে দেখাও।

কাজ- ২ : অপারেশন সার্চলাইটের ভয়াবহ রূপ বর্ণনা করো।

Content added By
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তাঁর সেই স্বাধীনতার ঘোষণায় কী বলেছিলেন? তিনি বলেন, 

ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগনকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি  হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওঁ ।

স্বাধীনতার এ ঘোষণা বাংলাদেশের সকল স্থানে তদানীন্তন ইপিআর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃ তা প্রচারে এগিয়ে আসেন। এদিকে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন উৎসাহী দেশপ্রেমিক কর্মী বেতারের কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রকে 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেন। ২৬শে মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান এই বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি প্রচার করেন। ২৭শে মার্চ সন্ধ্যার একই বেতার কেন্দ্র হতে বাঙালি সামরিক অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। বেতারে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রচারিত স্বাধীনতার এই ঘোষণা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। সকলেই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ একটি বাস্তব রূপ লাভ করে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হলেও ক্রমান্বয়ে এটি একটি গণযুদ্ধে রূপ নেয়। এদেশের সর্বস্তরের মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবকদের সঙ্গে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসারে কর্মরত বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ যুদ্ধে অংশ নেয় । 

কাজ- ১: বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতা সম্পর্কিত অন্যান্য ঘোষণা সম্পর্কে শিক্ষকের সহায়তায় সংক্ষেপে লেখ।

Content added By

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। একে কখনো অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার, আবার কখনো প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও বলা হয়। তবে এটি মুজিবনগর সরকার নামে বেশি পরিচিত। এ সরকারের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত ও পরিচালিত হয় এবং বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়।

১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর বা বাংলাদেশ সরকার। ওই দিনই মন্ত্রিসভা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬শে মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করে। তবে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল। শপথ বাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলী।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি (পদাধিকার বলে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক)। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক) এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। অন্য তিন জন মন্ত্রী ছিলেন অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার)-এর কার্যক্রম

মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রমকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়- ক. বেসামরিক কার্যক্রম সামরিক কার্যক্রম।

প্রত্যেক দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এর অধীনে দপ্তর থাকে। মুজিবনগর সরকারেরও তা ছিল। এগুলো হচ্ছে- প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, অর্থ-শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়, সাধারণ প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, যুব ও অভ্যর্থনা শিবিরের নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, সংস্থাপন, আঞ্চলিক প্রশাসন, তথ্য ও বেতার, স্বরাষ্ট্র, সংসদ বিষয়ক, কৃষি ইত্যাদি ।

বাংলাদেশকে ১১টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্য বা আওয়ামী লীগ নেতাদের অঞ্চলগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে আট সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয় । আওয়ামী লীগ নেতা ছাড়াও এর সদস্য ছিলেন প্রবীণ জননেতা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান মণি সিংহ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর আরেক অংশের সভাপতি মোজাফফর আহমদ ও কংগ্রেস নেতা মনোরঞ্জন ধর। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশন ।

কাজ : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার)-এর পরিচয় দাও ৷

 

Content added By