১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় । হাজার মাইলের ভৌগোলিক দূরত্ব, ভাষা ও সংস্কৃতিসহ সকল বিষয়ে অমিল থাকা সত্ত্বেও শুধু ধর্মীয় মিলের কারণে পূর্ব-বাংলাকে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ করা হয়। এই নতুন রাষ্ট্র পূর্ব-বাংলার মানুষের জীবনে কোনো মুক্তির স্বাদ আনতে পারে নি। শাসকের হাত বদল হয়ে পূর্ব-বাংলার জনগণ নতুন আরেকটি ভিনদেশি শাসক দ্বারা শাসিত হতে থাকে। পরবর্তী কালে অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতীক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা পরিপূর্ণভাবে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করি । স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের পথ অনেক ঘটনাবহুল । সপ্তম শ্রেণিতে আমরা ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠন, ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ৭০ এর নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি । এই অধ্যায়ে আমরা ১৯৭০ এর নির্বাচন পরবর্তী সময় ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানব ।

এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
• ১৯৭০ এর নির্বাচনোত্তর জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করতে পারব; • ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মূলকথা জানব ও এর গুরুত্ব ও প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করতে পারব;
• ২৫শে মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিবরণ দিতে পারব ও এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারব ;
• ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা উল্লেখ করতে পারব; মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির বিবরণ দিতে পারব ও অস্থায়ী সরকারের গঠন ও ভূমিকা বর্ণনা করতে পারব;
•মুক্তিবাহিনীর গঠন বর্ণনা করতে ও তাদের ভূমিকা মূল্যায়ন করতে পারব; • সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির তৎপরতা ও ভূমিকা বর্ণনা করতে পারব;
•মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের সহযোগিতার স্বরূপ বর্ণনা ও মূল্যায়ন করতে পারব;
•মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের ভূমিকা মূল্যায়ন করতে পারব,
•মুক্তিযুদ্ধে যৌথবাহিনীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে পারব;
•মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও অত্যাচারের বিবরণ দিতে পারব;
• পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনা বলতে পারব;
•মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে পারব; • দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ ও গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত হব।

Content added By

মানুষ সমাজে মিলেমিশে বাস করে। এভাবে বাস করতে গিয়ে সে নিজের প্রয়োজনে নানা কিছু সৃষ্টি করে। মানুষের সৃষ্টিশীল সকল কাজই তার সংস্কৃতি। সমাজ ও অঞ্চল ভেদে সংস্কৃতির রূপ ভিন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মানুষ ও সমাজের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। এদেশের সংস্কৃতি কিন্তু এক জায়গায় থেমে নেই। পরিবেশ-পরিস্থিতি ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মিটাতে আমাদের সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত বা ইতিবাচক পরিবর্তনই উন্নয়ন। সংস্কৃতি এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় হস্তান্তরিত হতে হতে সংস্কৃতির মধ্যে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। আবার অন্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেও সংস্কৃতি তার রূপ বদল করে। একেই সংস্কৃতির পরিবর্তন বা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বলে। 

পরিবর্তন যে ধরনেরই হোক, সংস্কৃতি স্থির নয়। মানুষ যে পরিবেশে বাস করে তার মধ্যে থেকে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটতে পারে আবার বাইরের উপাদান সংগ্রহ করেও এই পরিবর্তন হতে পারে। 

সাধারণভাবে উন্নয়ন বলতে বোঝায় কোনো কিছু শুরু থেকে ক্রমশ পরিপূর্ণতা লাভ করা। একসময় উন্নয়ন বলতে কেবল অর্থনৈতিক অবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বা অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বোঝানো হতো। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা উন্নয়ন বলতে ‘সামাজিক উন্নয়ন' কথাটিকে নির্দেশ করেন । তাই মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নই প্রকৃত উন্নয়ন। সাধারণত উন্নয়ন বা সামাজিক উন্নয়ন হলো একধরনের ‘সামাজিক পরিবর্তন'। কোনো সমাজের উন্নয়নের ফলে যেমন সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয় তেমনি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলেও সমাজে উন্নয়ন ঘটে। যেমন: বাংলাদেশে অনেক জায়গায় এখন লাঙলের পরিবর্তে ট্রাক্টর ব্যবহার হচ্ছে, এটা বস্তুগত সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। এর ফলে কৃষি উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হয়েছে। এইভাবে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সমন্বিতভাবে সমাজের উন্নয়ন ঘটায়। 

কাজ : ভাত মাছ খাওয়ার পাশাপাশি বার্গার খাওয়াকে কী ধরনের পরিবর্তন বলে তুমি মনে করো। 

Content added By

আমরা উপরে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সম্পর্কে জেনেছি। এখন সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো- 

১. উন্নয়নের লক্ষ্য হলো সমাজের সকলের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি সাধন, শোষণ ও বৈষম্যের মাত্রা কমানো বা অবসান করা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে মানব কল্যাণে কাজে লাগানো। আবার যেহেতু মানুষের জীবনযাত্রার প্রণালি হচ্ছে সংস্কৃতি, তাই জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি প্রভৃতির উন্নয়ন সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকেই নির্দেশ করে। এজন্য অনেক সময় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও উন্নয়নকে সমার্থক মনে হয় । এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও উন্নয়নের একটি বৈশিষ্ট্য। 

২. বস্তুগত সংস্কৃতি যত দ্রুতগতিতে পরিবর্তন হয় অবস্তুগত সংস্কৃতি তত দ্রুত পরিবর্তন হয় না। ফলে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের এই অসমতা সমাজে সমস্যা তৈরি করে যা সমাজে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সংস্কৃতির পরিবর্তনের এই গতি বা পার্থক্য সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য। আর উন্নয়নের দ্রুতগতি বা ধীরগতির উপর নির্ভর করে সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশের পরিবর্তনের মাত্রা হচ্ছে উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য। 

৩. উন্নয়ন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের অগ্রাধিকার দেয়। এটি উন্নয়নের একটি বৈশিষ্ট্য। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হলে সমাজের অগ্রগতি ঘটে, উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় । ফলে সমাজে নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যা সামাজিক পরিবর্তন হিসাবে গণ্য করা হয়। আর সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে। 

৪. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- পরিবর্তন সকল সময় একটি সরলরেখায় ক্রমশ ঊর্ধ্বগতিতে এগিয়ে যায় না। অনেক সময় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিম্নগতির দিকেও যায়। তাই ঊর্ধ্বগতি ও নিম্নগতি দুটোই পরিবর্তন। একটি ইতিবাচক অন্যটি নেতিবাচক। তবে উন্নয়ন বলতে ঊর্ধ্বগতি বা ইতিবাচক পরিবর্তনকে বোঝায়। তাই সংস্কৃতির উন্নয়ন হলো সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন। যেমন: আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের সংস্কৃতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের পরিবর্তনই ঘটছে । ইতিবাচক পরিবর্তনটি হলো সাংস্কৃতিক উন্নয়ন।

৫. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন দুটোই সময়ের মাত্রার মধ্যে সংগঠিত হয়। এটিও পরিবর্তনের একটি বৈশিষ্ট্য। যেমন: পুরাতন পাথর যুগ ও নতুন পাথরের যুগ দুইটি সময়কাল । দুই সময়ের সংস্কৃতিতে পার্থক্যও আছে। এই পার্থক্য সময়ের পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে এই পরিবর্তন পরবর্তী সময়েও ধারাবাহিকভাবে ঘটে থাকে। যেমন: পুরাতন পাথর যুগের অনেক হাতিয়ার নতুন পাথর যুগের সময়ে উন্নতি ঘটেছে। এটি হচ্ছে সংস্কৃতির উন্নয়ন তথা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন।

কাজ : সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের মধ্যে তুলনা করো।

 

Content added By