নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং - NCTB BOOK

সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যবসা-বাণিজ্যের কার্যপরিধিও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পণ্য-বাজারে নানামুখী প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় মুনাফা অর্জন করতে হলে একজন ব্যবসায়ীকে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থের সদ্ব্যবহার করতে হয়, যেন উৎপাদন বা বিক্রয় খরচ ন্যূনতম রাখা সম্ভব হয়। এতে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটি সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনে সফলকাম হয়। সে উদ্দেশ্যে সকল প্রতিষ্ঠান তার বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উৎস থেকে সংগ্রহ করে এবং পণ্য-বাজারের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সর্বোত্তম প্রকল্পে তহবিল বিনিয়োগ করে। ফলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে অর্থের আগমন ও নির্গমনপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। অর্থায়ন, অর্থের এই প্রবাহকে সুচারুভাবে নিয়ন্ত্রণ করে । অর্থায়নের নানাবিধ নীতি এই নিয়ন্ত্রণ-প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা একজন ব্যবসায়ীকে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করেও অধিক মুনাফা অর্জনে সহায়তা করে। বর্তমানে অর্থায়নকে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার সহায়ক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার না করে বরং ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-

১.১ অর্থায়নের সংজ্ঞা বর্ণনা করতে পারব।

১.২ অর্থায়নের ক্রমবিকাশের ধারা বর্ণনা করতে পারব।

১.৩ অর্থায়নের শ্রেণিবিভাগ বিশ্লেষণ করতে পারব। ১.৪ অর্থায়নের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব।

১.৫ অর্থায়নের নীতি ব্যাখ্যা করতে পারব।

১.৬ আর্থিক ব্যবস্থাপকের কার্যাবলি বর্ণনা করতে পারব।

Content updated By

অর্থায়ন তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে। কোন উৎস থেকে কী পরিমাণ তহবিল সংগ্রহ করে, কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ করা হলে কারবারে সর্বোচ্চ মুনাফা হবে, অর্থায়ন সেই সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মালামাল বিক্রয় থেকে অর্থের আগমন হয়। কারবারে মালামাল প্রস্তুত ও ক্রয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের তহবিলের প্রয়োজন হয়। যেমন: মেশিনপত্র ক্রয়, কাঁচামাল ক্রয়, শ্রমিকদের মজুরি প্রদান ইত্যাদি। এগুলো তহবিলের ব্যবহার। তহবিলের এই প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনামাফিক তহবিল সংগ্রহ করতে হয়, যেন উৎপাদনপ্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। অর্থায়ন বলতে তহবিল সংগ্রহ ও ব্যবহার-সংক্রান্ত এই প্রক্রিয়াকে বুঝায় ।

তোমার এলাকার কোনো দর্জির দোকানে গেলে দেখতে পাবে, একজন বা দুজন সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করছে। আবার হয়তো কেউ কাপড় কাটছে বা বোতাম সেলাই করছে। ফলে একটি দর্জির দোকানের মালিককে তার এই কার্যপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্য সেলাই মেশিন ক্রয়, সুতা, বোতাম, কাঁচি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় পরিমাণে ক্রয় করতে হয়। ব্যবসার শুরুতে সাধারণত এসব ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সে তার নিজস্ব মূলধন ব্যবহার করে নির্বাহ করে। ব্যয় নির্বাহের জন্য তহবিলের ঘাটতি হলে নিজস্ব মূলধনের সাথে কিছু পরিমাণ অর্থ আত্মীয়স্বজন থেকেও ঋণ নিতে পারে। ব্যবসায় চলাকালীন অবস্থায় মাসের শেষে কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য যে ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজন হয়, সেটি সে কাপড় সেলাই থেকে অর্জিত আয় হতে পরিশোধ করে। এই আয় থেকে তাকে ঋণের অর্থ পরিশোধেরও পরিকল্পনা করতে হয়। একজন দর্জি দোকানের মালিকের সব সময় প্রত্যাশা থাকে, যেন ব্যবসার আয় থেকে ব্যবসায়ের ব্যয় নির্বাহের পরও কিছু মুনাফা থাকে, যা দিয়ে সে নিজের পরিবারের নৈমিত্তিক খরচ মিটিয়েও ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে পারে কিংবা ব্যবসায় সম্প্রসারণে ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং একজন দর্জি দোকানের মালিক যদি তহবিলের উৎস ব্যবহার সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবসায় পরিচালনা করে, তবেই সে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে মুনাফা অর্জন করতে পারবে। অন্যথায় দেখা যাবে, কাপড় সেলাই করতে সুতা প্রয়োজন কিন্তু নগদ অর্থ নেই বলে খরিদ্দার ফেরত যাচ্ছে। অথবা পুরাতন মেশিনটি পরিবর্তন করে নতুন মেশিন ক্রয় করার তহবিল নেই বলে ব্যবসাটি বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। ব্যবসায় অর্থায়নে বা ফিন্যান্সে ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে কখন, কী কারণে, কত তহবিল প্রয়োজন এবং কোথা থেকে সেই তহবিল সরবরাহ করা উচিত তা নিয়ে আলোচনা করা হয়।

পরিবারেও অর্থায়নের প্রয়োগ আছে। সাধারণত প্রতিটি পরিবারের এক বা একাধিক আয়ের উৎস থাকে। চাকুরি, ব্যবসায়, কৃষিকাজ, আত্মউদ্যোগ ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবারভেদে আয়ের সংস্থান হতে পারে। আবার দৈনন্দিন বাজার খরচ, বাড়ি ভাড়া, স্কুলের বেতন, বিভিন্ন বিল প্রদান ইত্যাদি খাতে পরিবারের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয় সংঘটিত হয়। আয়ের সাথে যেমন ব্যয়ের সংগতি রাখা প্রয়োজন, তেমনি ব্যয়ের সঠিক সময়ের দিকটাও সংগতিপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। যখন যে পরিমাণ ব্যয় প্রয়োজন, তখন সে পরিমাণ অর্থ না থাকলে 

হয়তো স্কুলের বেতন বকেয়া হয়ে যাবে, ফলে স্কুল থেকে নাম কাটাও যেতে পারে। পূর্বপরিকল্পনামাফিক এই তহবিলের উৎস নির্ধারণ ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারই পরিবারের ক্ষেত্রে অর্থায়ন প্রক্রিয়া। নিত্যনৈমিত্তিক এই ধরনের প্রয়োজন ছাড়াও মাঝেমধ্যে পরিবারকে তার আয়ের বাইরেও বড় অংকের ব্যয় করতে হতে পারে। বাসায় নতুন টেলিভিশন কিংবা রেফ্রিজারেটর ক্রয়ের জন্য যদি আয়ের নিয়মিত উৎস থেকে অর্থ সরবরাহ করা সম্ভব না হয়, তখন দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঋণ ফেরত দেওয়ার একটি পরিকল্পনা করা প্রয়োজন হয়। ফলে পরিবারের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য পরিকল্পনামাফিক তহবিলের উৎস নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা করতে অর্থায়নের ধারণা সহায়তা করে।

একটি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও অর্থায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিচিত হওয়া যায়। বিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার মূল উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন নয়, সেখানেও আয়-ব্যয় ও তহবিল ব্যবস্থাপনার একটি পরিকল্পনা থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ছাত্রদের বেতন, পরীক্ষার ফি, ভর্তি ফি, এসব উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করে। সুষ্ঠুভাবে ক্লাস পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে এই তহবিল দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। যেমন: শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন, ঘরভাড়া প্রদান, বিদ্যুৎ বিল প্রদান, বিভিন্ন প্রকার সংস্কারমূলক ব্যয়, কম্পিউটার ও আসবাবপত্র ক্রয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির বহুবিধ কার্যপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য তহবিলের বিভিন্ন উৎস ও ব্যবহারের বিবিধ খাত বিবেচনা করে যথাযথভাবে তহবিল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা বিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে অর্থায়ন। উপরের উদাহরণগুলোর মধ্যে দর্জির দোকান একটি মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান, কিন্তু পরিবার ও বিদ্যালয় মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান নয় বর্তমান পাঠ মূলত মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা বা কারবারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন নিয়ে জড়িত। একজন মুদি দোকানির অর্থায়ন প্রক্রিয়াটি কেমন? মুদি দোকানি পণ্য বিক্রয় করে মুনাফা অর্জন করে। আবার পণ্য বিক্রয়ের জন্য তাকে পণ্য ক্রয়, দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীর বেতন ইত্যাদি চলতি খরচ, যা নিয়মিতভাবে সম্পাদন করতে হয়। আবার কখনো কখনো ক্রেতার প্রয়োজনে তাকে দোকানের আয়তন বৃদ্ধি, রেফ্রিজারেটর ক্রয় ইত্যাদি বড় আকারের খরচ করতে হয়। এগুলো তার স্থায়ী খরচ। ফলে মুদি দোকানি সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য চলতি ও স্থায়ী সম্পদে তহবিল বিনিয়োগ করে। বিক্রয়লব্ধ আয় হতে যদি বিনিয়োগের তহবিল সংস্থান করা না যায়, তবে তাকে বিভিন্ন উৎস যেমন: নিজস্ব তহবিল, বন্ধুবান্ধব, ধারে পণ্য ক্রয় ইত্যাদি থেকে তহবিল জোগাড় করতে হয়। আবার স্থায়ী সম্পদ অর্জনের জন্য যে বড় অংকের অর্থের প্রয়োজন হয়, সেটি সাধারণত বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে গ্রহণ করতে পারে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থ পরিশোধের সুযোগ থাকায় ঋণ পরিশোধের ঝুঁকি কিছুটা কমে যায়। মুদি ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে বিক্রয়লব্ধ অর্থের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে চলতি ব্যয় নির্বাহ, কিছু দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, কম ঝুঁকিপূর্ণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করে, সঠিক সময়ে ঋণের কিস্তির পরিশোধ সম্পর্কিত তহবিল ব্যবস্থাপনা কারবারি অর্থায়নের মূল কাজ।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বাটা কোম্পানি, কোহিনূর কেমিক্যালস এগুলো বড় পরিসরের কারবারি প্রতিষ্ঠানকে বল হয় কোম্পানি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন প্রক্রিয়া মুদি দোকান বা দর্জির দোকানের মতো সরল নয়, বরং অপেক্ষাকৃত জটিল। একটি কোম্পানি অর্থ বা তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু ভিন্ন ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকে। যেমন কোম্পানি তার প্রয়োজনীয় তহবিল মূলত শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করে। প্রতিষ্ঠানের সুনাম, মুনাফার হার, গ্রাহকসেবা বা ভোক্তা সন্তুষ্টি শেয়ারবাজারে শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বিভিন্ন উৎসের মধ্যে কোন উৎস, কখন, কী পরিমাণে ব্যবহার করে তহবিল সংগ্রহ করা উচিত এবং কোন কোন খাতে কী পরিমাণে তা কীভাবে খরচ বা বিনিয়োগ করে মুনাফা বৃদ্ধি করা যায়, কারবারি অর্থায়ন তা নিয়ে আলোচনা করে এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে।

অর্থায়ন প্রক্রিয়া একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি, একটি অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই একেকটি অর্থায়ন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া বিভিন্ন রূপ নেয়। এবার আমরা অর্থায়নের এই ধরনের একটি শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করব। যদিও আমাদের পাঠের মূল বিষয় কারবারি অর্থায়ন, কিন্তু এখানে আমরা অন্য কিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন প্রক্রিয়ারও একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা পাব।

ক) পারিবারিক অর্থায়ন

পারিবারিক অর্থায়নের ক্ষেত্রে পরিবারের আয়ের উৎস ও পরিমাণ নির্ধারণ করে, সেই আয় কীভাবে ব্যয় করলে পরিবারের সদস্যদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হয়, তা নির্ধারণ করা হয়। পরিবারের প্রয়োজনীয় অসংখ্য ব্যয়ের মধ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়গুলো পূরণ করা হয়। পরিবারের আয় যদি ব্যয়ের জন্য যথেষ্ট না হয় তবে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন, পরিচিত ব্যক্তি, বন্ধু-বান্ধব থেকে অর্থ ঋণ হিসাবে নেওয়া যায়। নিয়মিত আয়ের সাথে সংগতি রেখে নিয়মিত ব্যয়সমূহ নির্ধারণ করা হয়। স্থায়ী সম্পদ যেমন: টিভি, ফ্রিজ, গাড়ি, গৃহ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া যায়। কিন্তু সংগৃহীত তহবিল সীমাবদ্ধ বলে এর উপযুক্ত ব্যবহার প্রয়োজন। যদি পরিবারের সংগৃহীত তহবিল প্রয়োজনীয় ব্যয়ের তুলনায় বেশি হয়, তবে সেটা ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য সঞ্চয় করা হয়।

খ) সরকারি অর্থায়ন

প্রতিটি সরকারের একটি অর্থ ব্যবস্থাপনা আছে। একটি সরকারের প্রেক্ষাপটে তার বার্ষিক ব্যয় কোন কোন খাতে কী পরিমাণে হবে এবং সেই অর্থ কোন কোন উৎস থেকে সংগ্রহ করা যাবে, তা সরকারি অর্থায়নে আলোচনা করা হয়। সরকারকে দেশের সার্বিক উন্নয়নে অনেক খাতসমূহে অর্থ ব্যয় করতে হয়, যেমন: রাস্তাঘাট, সেতু, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি হাসপাতাল, আইন-শৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা, সামাজিক অবকাঠামো ইত্যাদি। এই ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে বিভিন্ন উৎস হতে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়, যেমন: আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, গিফট ট্যাক্স, আমদানি শুল্ক, রপ্তানি শুল্ক, সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড, ট্রেজারি বিল ইত্যাদি। সরকারি অর্থায়নে প্রথমে ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী তহবিল সংগ্রহ করা হয়। সরকারি অর্থায়নের মূল লক্ষ্য সমাজকল্যাণ। সরকারি অর্থায়ন সাধারণত অলাভজনক হয়। সরকারি অর্থায়নের ব্যয়, আয় অপেক্ষা বেশি হতে পারে। সরকারি মালিকানার বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকে, যা অপেক্ষাকৃত কম লাভজনকও হতে পারে। যেমন: BCIC-এর অধীনে রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, যদি সরকারের বাজেট হতে সম্পূর্ণ অর্থের সংস্থান করতে হয়। অনেক সময় সরকারের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাজনিত ব্যয়ের জন্য অর্থের সংকট সৃষ্টি হতে পারে। ফলে অনেক সময় সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে। যেমন : ADB (Asian Development Bank), বিশ্বব্যাংক, IDB (Islamic Development Bank) ইত্যাদি। তবে ঋণ প্রদানের সময় এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেয়, যা দেশের উন্নয়ন ও ভাবমূর্তি সংরক্ষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এ পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার অন্যান্য উৎস থেকে অর্থের সংস্থান করতে চায়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এবং আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে বৃহৎ প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন করা হয়ে থাকে। এ ধরনের অর্থায়ন প্রকল্পকে PPP (Public Private Partnership) বলা হয়ে থাকে।

গ) আন্তর্জাতিক অর্থায়ন

আন্তর্জাতিক অর্থায়নে আমদানি ও রপ্তানির খাতগুলো নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। বাংলাদেশ প্রধানত আমদানিনির্ভর দেশ। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী, কাঁচামাল, মেশিনারিজ, ঔষধ, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। অপরপক্ষে বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাতদ্রব্য, তৈরি পোশাক, কৃষিজাত দ্রব্য ইত্যাদি রপ্তানি করা হচ্ছে। রপ্তানি হতে আমদানি বেশি করতে হয় বলে প্রতিবছর বিরাট অংকের বাণিজ্যঘাটতি দেখা যায়। এই ঘাটতি পূরণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স বিশেষ ভূমিকা রাখে। আন্তর্জাতিক অর্থায়নে আমদানি ও রপ্তানি খাতসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং এ সংক্রান্ত ঘাটতি কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় তা আলোচনা করা হয়।

ঘ) অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অর্থসংস্থান

সমাজে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থাকে, যা মানবকল্যাণে বা দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের সেবা নিয়োজিত। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য অর্থ বা অর্থের সমতুল্য পণ্য বা সেবার প্রয়োজন আছে এবং সেই অর্থের দক্ষ ব্যবস্থাপনারও প্রয়োজন আছে। এ ক্ষেত্রে অর্থায়ন যে ভূমিকা রাখে তা হচ্ছে অর্থ ও অর্থ সমতুল্য সম্পদ সংগ্রহের উৎস চিহ্নিতকরণ এবং তার সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির সেবামূলক উদ্দেশ্যকে সফল করা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি এতিমখানা মুনাফাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নয়। তবে এটিরও অর্থের প্রয়োজন আছে। বিভিন্ন অনুদানের মাধ্যমে এরা অর্থ সংগ্রহ করে। সংগৃহীত অর্থ ব্যয় করা হয় এতিমদের বিভিন্ন উন্নয়নে। ফলে অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অর্থের উৎস চিহ্নিতকরণ এবং উদ্দেশ্য অর্জনে এর যথাযোগ্য ব্যবহার নিশ্চিত করাই অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নের মূল উদ্দেশ্য।

ঙ) ব্যবসায় অর্থায়ন

অর্থায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরন হচ্ছে ব্যবসায় অর্থায়ন বা বিজনেস ফাইন্যান্স। মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে লাভ-ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে গঠিত সংগঠনকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলা হয়। ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার তহবিল সংগ্রহ ও বিনিয়োগের জন্য যে অর্থায়ন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে, সেটিই ব্যবসার অর্থায়ন। কারবারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়: একমালিকানা কারবার, অংশীদারি কারবার ও যৌথ মূলধনি কারবার। এই তিন প্রকার প্রতিষ্ঠানেরই অর্থায়নের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো বিনিয়োগের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও অর্থ ব্যবস্থাপনা। অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে স্বীয় মূলধন ও ঋণ উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্যবসায় অর্থায়নই এই পাঠের মূল বিষয়।

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কারবারি প্রতিষ্ঠান সাধারণত ছোট প্রতিষ্ঠান, যা একমালিকানা বা অংশীদারি কারবার হিসেবে গঠিত। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, গ্রাম-গঞ্জের হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, মুদি দোকান, সেলুন, বুটিক শপ ইত্যাদি এই ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। একমালিকানা প্রতিষ্ঠানে লাভ হলে মালিক একা ভোগ করে, লোকসান হলে ক্ষতিপূরণের জন্য মালিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও ব্যবহৃত হয়।

অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে অংশীদারদের মধ্যে ঝুঁকি বণ্টিত হয় বিধায় ব্যবসার আর্থিক ক্ষতি বহনে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। এ ধরনের একমালিকানা বা অংশীদারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তহবিল সংগ্রহের উৎস মালিকের নিজস্ব তহবিল, মুনাফা, আত্মীয়স্বজন থেকে গৃহীত ঋণ, ব্যাংক অথবা গ্রামীণ মহাজন থেকে সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ। সুতরাং নিজস্ব তহবিল নিয়োগ করে এর যথাযোগ্য ব্যবহার নিশ্চিত করে মুনাফা অর্জন করাই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়নের মূল উদ্দেশ্য।

যৌথ মূলধনি কোম্পানির অর্থায়ন প্রক্রিয়া ভিন্ন ধরনের। একটি প্রতিষ্ঠান যৌথ মূলধনি হতে হলে সরকারি অনুমোদন নিতে হয়। সরকার অনুমোদন দেওয়ার আগে ন্যূনতম মূলধনের পরিমাণ পরিচালকগণের পরিচয়পত্র, ব্যবসার উদ্দেশ্য ও নানাবিধ দলিলাদি বিচার-বিশ্লেষণ করে। অনুমোদন পেলে একটি কোম্পানি তার বড় অংকের কাঙ্ক্ষিত মূলধনকে ছোট ছোট অংকে বিভক্ত করে শেয়ার হিসেবে বিক্রয় করে। যেমন: ১০ কোটি টাকার মূলধন ১,০০০ টাকার ১ লক্ষ শেয়ারে বিভক্ত করে সাধারণ জনগণের কাছে বিক্রয় করা হয়। একেকটি শেয়ারের মূল্য মাত্র ১,০০০ টাকা হওয়ার কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছোট লাভজনক হলে তারা সাধারণত নিয়মিতভাবে লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন। বিনিয়োগকারীরাও কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারে। শেয়ারহোল্ডারগণ কোম্পানির মালিক এবং প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারহোল্ডাররা শেয়ারবাজার যেমন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার বিক্রয় করে শেয়ারটি নগদ অর্থে রূপান্তর করতে পারে। শেয়ার ছাড়া বন্ড ও ডিবেঞ্চার বিক্রয় করেও যৌথ মূলধনি কারবার সাধারণ জনগণ থেকে ঋণের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ডিবেঞ্চারহোল্ডার অর্থাৎ যারা ডিবেঞ্চার বা ঋণপত্র ক্রয় করে, তাদেরকে নির্দিষ্ট হারে নিয়মিতভাবে সুদ প্রদান করতে হবে। কেননা তারা শেয়ারহোল্ডারদের মতো কোম্পানির মালিক নয়।

চ) ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সাধারণত সে দেশের ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক- এ ধরনের সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, তবে এদের অর্থায়ন প্রক্রিয়া সাধারণত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে একটু ভিন্ন প্রকৃতির। এই ব্যাংকগুলো মানুষের ক্ষুদ্র তহবিলকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন মেয়াদি আমানত সৃষ্টি করে এবং আমানতকারীকে নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। আবার এই তহবিল থেকে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন কারবারে উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদান করে। এছাড়া ব্যক্তিগত বিভিন্ন প্রয়োজনেও ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া যায়। এই ঋণের উপর ব্যাংক নির্দিষ্ট হারে সুদ ধার্য করে। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃক ঋণ গ্রহীতার জন্য ধার্যকৃত সুদের হার আমানতকারীকে প্রদেয় সুদের হার হতে অপেক্ষাকৃত বেশি। এই দুধরনের সুদের হারের পার্থক্যই ব্যাংকগুলোর মুনাফা। ব্যাংকিং অধ্যায়ে আমরা এসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত জানব। বাণিজ্যিক ব্যাংক ছাড়া কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানও দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ হলো ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), বাংলাদেশ গৃহ নির্মাণ অর্থায়ন সংস্থা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ইত্যাদি। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিন্ন ভিন্ন খাতের উন্নয়নে সবিশেষ ভূমিকা পালন করে ।

Content updated By

বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক মুক্তবাজার ব্যবস্থায় মুনাফা অর্জনের জন্য প্রতিটি সরকারি, বেসরকারি, আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে পূর্ব পরিকল্পনামাফিক অর্থায়ন করতে হয়। সুচিন্তিত ও সুদক্ষ অর্থায়ন ব্যবস্থাপনার ব্যবহারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকি হ্রাস পায় এবং মুনাফা বৃদ্ধি পায়। নিচের বিষয়সমূহ অর্থায়ন ব্যবস্থাপনাকে অধিক অর্থবহ করে তোলে ।

ক) ব্যবসায়িক মূলধন সংকট

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অর্থায়ন সম্পর্কিত ধারণা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ বলে আর্থিক সংকট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই সংকটের জন্য কারবার প্রতিষ্ঠান সুচারুরূপে পরিচালনা করা একটি দুরূহ কাজ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল কেনা প্রয়োজন কিন্তু অর্থসংকটের জন্য সে যদি যথাসময়ে উপযুক্ত পরিমাণে কাঁচামাল কিনতে অপারগ হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনপ্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। অর্থায়ন-সংক্রান্ত ধারণা তাকে পরিকল্পনামাফিক যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ ও তার যথার্থ ব্যবহারে সহায়তা করে।

খ) অনগ্রসর ব্যাংক ব্যবস্থা

উপরন্তু উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট সুসংগঠিত নয় বলে ঋণের জন্য আবেদন করলেও কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে ঋণ পাওয়া যায় না। অনেক সময় ব্যাংক ঋণের বিপরীতে যে সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয়, তার অপ্রতুলতার কারণে ব্যাংক ঋণ উপযুক্ত সময়ে ও যথার্থ পরিমাণে পাওয়া যায় না। ফলে ব্যবসায়ীদের এ অর্থসংকট হতে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য খুবই পরিকল্পিতভাবে অর্থের সংস্থান করতে হয় এবং সঠিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অর্থের লাভজনক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। সঠিক আর্থিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা ব্যবসায়ীদের এ ধরনের সমস্যা পূর্বানুমান করতে সাহায্য করে এবং যেসব পদ্ধতিতে তা মোকাবিলা করা যায় তার ধারণা দেয়।

গ) স্বল্পশিক্ষিত উদ্যোক্তা

বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা স্বল্পশিক্ষিত বলে তারা একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। এতে করে অনেক লাভজনক প্রতিষ্ঠান উপযুক্ত আর্থিক পরিকল্পনার অভাবে আর্থিক সংকটে সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না এবং অবশেষে লাভের বদলে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অথচ এই ক্ষতির কারণ শুধু আর্থিক অব্যবস্থাপনা। অর্থায়ন ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জ্ঞান থাকলে সহজেই একজন ব্যবসায়ী পরিকল্পনামাফিক স্বল্পমূল্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ সংস্থান করে তার সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে পর্যাপ্ত মুনাফা অর্জন করতে পারে।

ঘ) উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ ও জাতীয় আয়

একটি সফল বিনিয়োগ জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। অর্থায়নবিষয়ক জ্ঞানের প্রয়োগে একজন ব্যবসায়ী বিনিয়োগের বিভিন্ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে ভবিষ্যৎ আয়-ব্যয়ের সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে লাভজনক প্রকল্পটি বেছে নিতে পারে। এই ধরনের লাভজনক বিনিয়োগ কারবারটির জন্য যেমন অর্থবহ, তেমনি সারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

Content updated By

কারবারি অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা বলতে কারবারের জন্য প্রয়োজনমাফিক তহবিল সংগ্রহ, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে সেই তহবিল বিনিয়োগ এবং তহবিল বণ্টনসংক্রান্ত ব্যবস্থাপনাকে বুঝায়। এই ব্যবস্থাপনার কিছু নীতিমালা আছে, যা নিচে তুলে ধরা হলো।

ক) তারল্য বনাম মুনাফানীতি

একজন মুদি দোকানি তার প্রতিদিনের বিক্রয়লব্ধ নগদ আয় (তরল সম্পদ) সম্পূর্ণটাই কাচামাল ক্রয় ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয়ের কথা চিন্তা করে নিজের কাছে রেখে দিতে পারে অথবা সেই নগদ অর্থের কিছু অংশ কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য রেখে বাকিটা কোনো ব্যাংকের একাউন্টে জমা রাখতে পারে, যা থেকে নির্দিষ্ট সময়ে কিছু সুদ/মুনাফা পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে দোকানিকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নগদ অর্থ কী পরিমাণ নিজের কাছে রাখলে দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটানো সম্ভব। যদি নগদ অর্থ বেশি পরিমাণে দোকানি নিজের কাছে রেখে দেয়, তাতে ব্যাংক থেকে প্রাপ্য আয়ের পরিমাণ কমে যাবে। আবার ব্যাংকে বেশি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলে ব্যবসার দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় নগদ অর্থের ঘাটতি হবে, যা ব্যবসার সুষ্ঠু পরিচালনাকে ব্যাহত করবে। ফলে ব্যবসায়ীকে তারল্য ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য রেখে আর্থিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। অর্থাৎ একদিকে তাকে যেমন দৈনন্দিন কার্য পরিচালনার মতো নগদ অর্থ হাতে রাখা প্রয়োজন, অন্যদিকে মুনাফা অর্জনের জন্য সেই অর্থ বিনিয়োগ করাও প্রয়োজন। নগদ অর্থ ও মুনাফার মধ্যে বিপরীত সম্পর্ক। নগদ অর্থ বেশি রাখলে মুনাফা কমে যায়, আবার মুনাফা বৃদ্ধিকল্পে বেশি বিনিয়োগ করা হলে তারল্যে ঘাটতি হয়। তারল্য ও মুনাফার মধ্যে উপযুক্ত ভারসাম্য বজায় রাখা অর্থায়নের একটি অন্যতম নীতি।

খ) উপযুক্ততার নীতি

স্বল্পমেয়াদি তহবিল দিয়ে চলতি মূলধন ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিল দিয়ে স্থায়ী মূলধন সরবরাহ করা অর্থায়নের একটি নীতি। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে রাখার জন্য যে নিত্যনৈমিত্তিক অর্থের প্রয়োজন হয়, সেটিই চলতি মূলধন; যেমন: কাঁচামাল ক্রয়, শ্রমিকের মজুরি প্রদান ইত্যাদি। অন্যদিকে মেশিন ক্রয়, কারবারের দালানকোঠা নির্মাণ ইত্যাদি হলো স্থায়ী মূলধন। চলতি মূলধনের পরিমাণ কম হয় বলে এর উৎসও কম হয়, ফলে এটি স্বল্পমেয়াদি উৎস হতে সংগ্রহ করা ভালো। বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিভিন্ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগ ব্যাংক, ডিবেঞ্চারহোল্ডার, এই ধরনের উৎসগুলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে থাকে। পক্ষান্তরে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে চলতি মূলধন ব্যবস্থাপনা করা উচিত। দীর্ঘমেয়াদি উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহের জন্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিক হারে সুদ প্রদান করতে হয়। ফলে যদি চলতি ব্যয় নির্বাহের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উৎস হতে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, তবে দেখা যায় উপার্জিত আয় হতে ঋণের সুদ পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে যায় ।

গ) কারবারের বৈচিত্র্যায়ণ ও ঝুঁকি বণ্টন

তহবিল বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কারবারি পণ্য বা সেবা যতদূর সম্ভব বৈচিত্র্যপূর্ণ হলে কারবারের ঝুঁকি বণ্টিত হয় ও হ্রাস পায়। প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে কেন্দ্র করে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে। ফলে ব্যবসাকে নানামুখী ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। এই ঝুঁকিগুলো বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হতে পারে। যেমন: অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন, বাজারে নতুন পণ্যের উপস্থিতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আকস্মিক দুর্ঘটনা ইত্যাদি। এসব পরিবর্তনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা বা এর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ব্যবস্থাপকদের পক্ষে সাধারণত সম্ভব নয়। তবে ঝুঁকি বণ্টনের নীতি অনুসরণের ফলে অনিশ্চিত বাজার পরিস্থিতিতেও প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জন সম্ভব। একজন ব্যবসায়ী যদি শুধু একধরনের পণ্যের ব্যবসা করে, তাহলে ব্যবসায়ের মুনাফা অর্জন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে কারবারের পণ্য যদি বিভিন্ন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়, তাহলে ঝুঁকি বণ্টিত হয়ে যায়। অর্থাৎ কোনো একটি পরিস্থিতিতে একটি পণ্যের বিক্রয় হ্রাস পেলে অন্যান্য পণ্যের বিক্রয় দিয়ে কারবারটির হ্রাসকৃত বিক্রয় পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হয়, ফলে সব ধরনের অবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মুনাফা অর্জিত হয়। একজন মুদি ব্যবসায়ী যদি তার দোকানে সনাতনী সাবান ও হালাল সাবান দু'ধরনের সাবানই বিক্রয় করেন তবে দু'ধরনের ক্রেতারই দোকানে সমাগম হবে। দোকানি যদি শুধু সাধারণ বা সনাতনী সাবান রাখেন, তবে হালাল সাবানের ক্রেতারা অন্য দোকানে গিয়ে হালাল সাবান কিনবে, এতে শুধু সনাতনী সাবান বিক্রেতার মোট বিক্রয় হ্রাস পাবে। আবহাওয়া ও ঋতুভেদেও কোনো কোনো পণ্যের বিক্রয় হ্রাস বা বৃদ্ধি হয়। যেমন: শীতবস্ত্রের চাহিদা শুধু শীতকালে বেশি থাকে। ফলে এই সময়ে এর বিক্রয় বৃদ্ধি পায়। একজন কাপড় বিক্রেতা যদি শীতবস্ত্র ও গ্রীষ্মকালীন বস্ত্র দুই ধরনের বস্ত্রই তার দোকানে বিক্রয় করেন, তবে ঋতুভিত্তিক পণ্যের চাহিদা হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে মুনাফা অর্জন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এমনিভাবে একটি বইয়ের দোকানে যদি শুধু কবিতার বই বিক্রয় করা হয়, আর পাশাপাশি অন্য একটি দোকানে যদি কবিতার বই, গল্পের বই, ধর্মীয় বই, বিভিন্ন শিক্ষণীয় বই বিক্রয় করা হয়, তবে দেখা যায় ক্রেতারা বই কেনার জন্য পরের দোকানটিতেই ভিড় করবে। কারণ ক্রেতারা সেখান থেকে নানা ধরনের প্রয়োজনীয় বই একই সাথে কিনতে পারবে। ঝুঁকি হ্রাসে বৈচিত্র্যায়ণের এই নীতি তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। সেখানে একটি উৎসের বদলে বহুবিধ উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করাকে প্রাধান্য দেয়া হয় ।

Content updated By

আর্থিক ব্যবস্থাপকরা দু'ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করে :

  1. আয় সিদ্ধান্ত বা অর্থায়ন সিদ্ধান্ত
  2. ব্যয় সিদ্ধান্ত বা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত

আয় সিদ্ধান্ত বা অর্থায়ন সিদ্ধান্ত

আয় সিদ্ধান্ত বলতে মূলত তহবিল সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে বুঝায়। অর্থায়ন সিদ্ধান্তের আওতায় তহবিল সংগ্রহের ভিন্ন উৎস নির্বাচন এবং এসব উৎসের সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণ করে অর্থায়ন-সংক্রান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সাধারণত চলতি ব্যয় নির্বাহের জন্য স্বল্পমেয়াদি উৎস থেকে আর স্থায়ী ব্যয় নির্বাহের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত ব্যবসায় তহবিল সংগ্রহে মালিকপক্ষের নিজস্ব পুঁজি ও বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যবসায় তহবিল সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া বড় কোম্পানিগুলো শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করতে পারে। এই শেয়ারহোল্ডাররাই কোম্পানির মালিক। কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণের মাধ্যমে তহবিলের যে অংশ সংগ্রহ করে, তার জন্য প্রতিষ্ঠানটির ঋণের দায় বৃদ্ধি পায়, আবার মালিকপক্ষ হতে সংগৃহীত মূলধনের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে মালিকপক্ষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে সঠিক অর্থায়ন সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই একটি প্রতিষ্ঠান ঋণের দায় ও মালিকানা স্বত্বের মধ্যে লাভজনক ভারসাম্য সৃষ্টিতে সফল হয়।

ব্যয় সিদ্ধান্ত বা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত

একটি দর্জি দোকানের সেলাই মেশিন ক্রয়-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত একটি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত। মুদি দোকানের আসবাবপত্র, রেফ্রিজারেটর ক্রয়-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত একটি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য উৎপাদনমুখী মেশিন ক্রয়, কারখানা নির্মাণের খরচও এই জাতীয় সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রত্যাশিত আগমন-নির্গমনের একটি পরিকল্পনা করতে হয়। যেমন: প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মেশিন ক্রয়- সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। যদি মেশিন দ্বারা প্রস্তুতকৃত পণ্যসামগ্রীর বিক্রয় পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়, এতে করে যদি মুনাফা ও নগদ প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং সর্বমোট নগদ প্রবাহ যদি মেশিনের ক্রয় মূল্য থেকে বেশি হয়।

অর্থাৎ, মেশিনটি যদি আগামী দশ বছর ব্যবহার করা যাবে মনে হয়, তাহলে মেশিনের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তটির জন্য আগামী দশ বছরে মালামাল বিক্রয় থেকে যে অর্থের আগমন হবে তার সাথে মেশিনের ক্রয়মূল্যের তুলনা করতে হবে। সুতরাং আগামী দশ বছরে পণ্যের মূল্য কী হবে এবং কী পরিমাণ বিক্রয় হবে তা বিবেচনা করেই কেবল আগামী দশ বছরের বিক্রয়লব্ধ নগদ প্রবাহ বের করা সম্ভব। নগদ প্রবাহ হতে মুনাফার পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে উৎপাদন ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে নগদ প্রবাহ নির্ধারণ করতে হয়। ভবিষ্যতের পণ্য বিক্রয়ের পরিমাণ ও পণ্যের মূল্য নির্ধারণ একটি দুরূহ কাজ বলে বিনিয়োগ সিদ্ধান্তটি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।

অন্যান্য সিদ্ধান্ত

উপরিউক্ত দুটি সিদ্ধান্ত আর্থিক ব্যবস্থাপকের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া আর্থিক ব্যবস্থাপককে আরো কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যেমন-

ক) কী পরিমাণে কাঁচামাল ক্রয় বা প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযোগী এবং সেই অর্থ কোথা থেকে সংগ্রহ করা যাবে- এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে চলতি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত বলে।

খ) দৈনন্দিন প্রয়োজন নির্বাহ করার জন্য কী পরিমাণ নগদ অর্থ রাখা উচিত, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ।

গ) যেসব উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে, তাদের প্রাপ্য প্রদান করা আরেকটি সিদ্ধান্ত ।

ব্যাংক ঋণ ও অন্যান্য ঋণ যেমন- বন্ড, ডিবেঞ্চার ইত্যাদির মাধ্যমে তহবিল সংগৃহীত হলে যথাসময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ প্রদান করার সিদ্ধান্ত আর্থিক ব্যবস্থাপকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। একইভাবে শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত তহবিলের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত হারে মুনাফা অর্জন ও লভ্যাংশ বণ্টন ও আর্থিক ব্যবস্থাপকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।

Content updated By

সপ্তদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের পরেই উৎপাদন কৌশল জটিলতর হয় এবং বিশেষায়িত ও বিভাজিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদন-প্রক্রিয়া উৎকর্ষ লাভ করে। বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে অর্থায়ন-সংক্রান্ত ধারণা ও ব্যবহার অত্যাবশ্যক হয়ে যায়। হিসাবশাস্ত্রের বিকাশের সাথে সাথে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফিন্যান্স মূলত আর্থিক বিবরণীর বিচার-বিশ্লেষণের কাজে নিয়োজিত ছিল। ক্ল্যাসিকাল ধারার ব্যষ্টিক অর্থনীতির উন্নতির সাথে সাথে কারবারের নিজস্ব ও বিশেষায়িত অর্থনীতি নিয়েও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অর্থায়ন সম্পৃক্ত ছিল। অর্থায়নের ক্রমবিকাশের এই ধারা অর্থায়নের প্রকৃতি ও আওতা সম্পর্কে আমাদের একটি অর্থবহ ধারণা দেয়। গতানুগতিক ধারায় আর্থিক ব্যবস্থাপকদের প্রধান দায়িত্ব ছিল হিসাব সংরক্ষণ ও তা বিশ্লেষণপূর্বক ভবিষ্যৎ কার্যক্রম প্রণয়ন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিবেদন তৈরি করা এবং নগদ অর্থের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি তার প্রদেয় বিলগুলো যেন যথাযথ সময়ে পরিশোধে সমর্থ হয়, তাও অর্থায়নের ক্রমবিকাশের ধারায় অর্থায়নের কাজ হিসেবে যুক্ত হয়। কিন্তু সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আর্থিক ব্যবস্থাপকদের দায়িত্বকে পরিবর্তিত করেছে। অর্থায়নের বিকাশের মূল চারণভূমি যুক্তরাষ্ট্রে অর্থায়নের যে বিবর্তন গত শতাব্দীতে সংঘটিত হয়েছে তা পরে সারা বিশ্বেই অর্থায়নের বিবর্তনের ধারা হিসেবে পরিচয় লাভ করে।

ক) ১৯৩০-এর পূর্ববর্তী দশক : এই সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর মধ্যে একত্রীকরণের প্রবণতা শুরু হয়। আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ করে কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন প্রতিষ্ঠান একত্রীকরণ হওয়া উচিত এই সংক্রান্ত রূপরেখা দিতে আর্থিক ব্যবস্থাপকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তারা এই একত্রীকরণে বিশাল অংকের অর্থসংস্থান ও আর্থিক বিবরণী তৈরি করার দায়িত্ব পালন করেন।

খ) ১৯৩০-এর দশক : একত্রীকরণ প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রে যথেষ্ট সফলতা পায়নি। আগের দশকে একীভূত অনেক প্রতিষ্ঠানই পরের দশকে দেউলিয়া হয়ে যায়। উপরন্তু ত্রিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে চরম মন্দা শুরু হয়। অনেক লাভজনক প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় পড়ে যায়। সেমতাবস্থায় কারবারগুলো পুনর্গঠন করে কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়াত্ব থেকে রক্ষা করা রাখা যায়, এ ব্যাপারে আর্থিক ব্যবস্থাপক বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় থেকেই শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে অর্থায়নের প্রয়োজন দেখা দেয়।

গ) ১৯৪০-এর দশক : এ সময়ে সুষ্ঠুভাবে কারবার পরিচালনার জন্য তারল্যের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করা যায়। নগদ অর্থপ্রবাহের বাজেট করে সুপরিকল্পিত নগদপ্রবাহের মাধ্যমে অর্থায়ন সেই দায়িত্ব পালন করে।

ঘ) ১৯৫০-এর দশক : এই দশকে অর্থায়ন পূর্বের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ লাভজনক বিনিয়োগ প্রকল্প মূল্যায়নে নানা প্রকার গাণিতিক বিশ্লেষণ কাজে নিয়োজিত হয়। সুদূরপ্রসারী প্রাক্কলনের মাধ্যমে উপযুক্ত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে বিক্রয় বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রাস করে মুনাফা সর্বোচ্চকরণ করাই তখন অর্থায়নের প্রধান কাজে পরিণত হয়। এই ধারাকে অর্থায়নের সনাতন ধারা হিসেবে গণ্য করা হয়।

চ) ১৯৬০-এর দশক : এই সময় থেকেই আধুনিক অর্থায়নের যাত্রা শুরু। অর্থায়ন মূলধন বাজারকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে। শেয়ারহোল্ডাররা প্রতিষ্ঠানের মালিক ফলে শেয়ার হোল্ডারদের সম্পদ বা শেয়ারের বাজারদর সর্বাধিকরণই ছিল এই সময়ের অর্থায়নের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার ক্ষেত্রে নানা রকম আর্থিক বিশ্লেষণমূলক কার্য শুরু হয়। অর্থায়নে ঝুঁকির ধারণা বুঝিয়ে দেয় যে মুনাফা বৃদ্ধির সাথে সাথে সাধারণত ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং মুনাফা বৃদ্ধি সর্বদা কাঙ্ক্ষিত নাও হতে পারে।

ছ) ১৯৭০-এর দশক : এই দশকে কম্পিউটার অধ্যায়ের শুরু হয়, যা শুধু উৎপাদন কৌশলই নয়, কারবারি অর্থায়নকেও পাল্টিয়ে দেয়। অর্থায়ন এখন অংকনির্ভর হয়ে উঠেছে। বেশির ভাগ আর্থিক সিদ্ধান্ত মূলত জটিল অংকনির্ভর এবং কম্পিউটারের মাধ্যমেই তা সুচারুরূপে সম্পাদন করার প্রবণতা এই সময়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। যেমন ঝুঁকির ধারণা এখন অনেকটা সঠিকভাবে পরিমাপ ও ব্যবস্থাপনা করা হয় । মূলধনি কাঠামোর সনাতন ধারণাও অনেক জটিল ও অংকনির্ভর হয়। এই সময় যেসব তাত্ত্বিক কারবারি অর্থায়নকে নানা তত্ত্বের বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ করেছিলেন, তাদের মধ্যে হ্যারি মার্কোইজ, মার্টন মিলার, মডিগ্নিয়ানি ছিলেন উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে ১৯৯০-এর দশকে এসব তাত্ত্বিকগণ গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অর্থায়নের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

জ) ১৯৮০-এর দশক : ব্যবসায় সম্প্রসারণ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য অর্থায়ন তার সনাতনী দায়িত্বের পরিবর্তন করে নতুনরূপে আবির্ভূত হয়। এই সময় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে মূলধনের সুদক্ষ বণ্টন ও প্রকল্পগুলো হতে অর্জিত আয়ের বিচার-বিশ্লেষণই ছিল অর্থায়নের মূল বিষয়।

ঝ) ১৯৯০-এর দশক ও আধুনিক অর্থায়নের সূচনা: এই দশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization) আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানির প্রতিবন্ধকতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। অর্থায়নও এ সময়ে আন্তর্জাতিকতা লাভ করে। একদিকে যেমন অর্থায়নের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত পৃথিবীর কোথায়, কোন পণ্য প্রস্তুত করা ও বিক্রয় করা লাভজনক সেটা বিবেচনা করে, আরেকদিকে বিশ্বের কোন মূলধনি বাজার কী প্রকৃতির ও কোথা থেকে তহবিল সংগ্রহ করা লাভজনক, তাও অর্থায়নের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। ফলে অর্থায়ন হলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় একটি প্রায়োগিক সমাধানের ক্ষেত্র, যা হিসাবরক্ষণ, অর্থনীতি ও অন্যান্য আর্থিক বিষয়গুলোকে সংমিশ্রণ করে সৃষ্টি হয়েছে।

Content updated By
Please, contribute to add content into বহুনির্বাচনি প্রশ্ন.
Content
Please, contribute to add content into সৃজনশীল প্রশ্ন.
Content