নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ভূগোল ও পরিবেশ - NCTB BOOK

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছরই আমাদের জীবন, সম্পদ ও পরিবেশের বিপুল ক্ষতিসাধন করে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান এসব দুর্যোগের অন্যতম কারণ।

দুর্যোগ ও বিপর্যয় (Disaster and Hazard )

আমাদের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশের প্রতিটি নাগরিকের বিপর্যয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। দুর্যোগ হচ্ছে এরূপ ঘটনা, যা সমাজের স্বাভাবিক কাজকর্মে প্রচণ্ডভাবে বিঘ্ন ঘটায় এবং জীবন, সম্পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ক্ষতিগ্রস্ত সমাজের পক্ষে নিজস্ব সম্পদ দিয়ে এই ক্ষতি মোকাবিলা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। দুর্যোগ কোনো স্থানের জনবসতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে ঐ জনবসতি পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে না। এর জন্য বাইরের সাহায্য বা হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে বিপর্যয় বলতে বোঝানো হয়েছে কোনো এক আকস্মিক ও চরম প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট ঘটনাকে। এই ঘটনা জীবন, সম্পদ ইত্যাদির উপর প্রতিকূলভাবে আঘাত করে।

Content added By
পরিবেশ বিরূপ আকার ধারণ করে
খুবই বেগবান এবং ভয়াবহ বিধ্বংসী
জমি হারিয়ে মানুষ অন্যত্র চলে যায়
মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট
'A' এর তুলনায় 'C' দুর্যোগটি দীর্ঘস্থায়ী
'A' এর তুলনায় 'C' দুর্যোগটি বেশি শক্তিশালী
'C' এর তুলনায় 'A' দুর্যোগটি বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়
'C' এর তুলনায় 'A' দুর্যোগটি ভূমিরূপের অধিক ক্ষতিসাধন করে

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যা অন্যতম। এ দেশের মানুষের কাছে বন্যা যেমন ভয়াবহ তেমনি অর্থনৈতিক অবস্থার উপর অপরিসীম প্রভাব ফেলে । প্রকৃতপক্ষে এ দেশের প্রেক্ষিতে কোনো এলাকা প্লাবিত হয়ে যদি মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতিসাধন হয় তাহলেই বন্যা হয়েছে ধরা হয়। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক ও বৃষ্টিবহুল দেশ। এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২,৩০০ মিলিমিটার । ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীসহ ৭০০টি নদী এ দেশে জালের মতো বিস্তার করে আছে। এর মধ্যে ৫৪টি নদীর উৎসস্থল ভারতে অবস্থিত।

বন্যার কারণ (Causes of Flood)

     প্রাকৃতিক কারণ  মানবসৃষ্ট কারণ
 উজানে প্রচুর বৃষ্টি।
ভৌগোলিক অবস্থান ৷
মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাব
নদীর গভীরতা কম ।
হিমালয়ের বরফগলা পানিপ্রবাহ ।
বঙ্গোপসাগরের তীব্র জোয়ার-ভাটা। ভূমিকম্প।
 নদী অববাহিকায় ব্যাপক বৃক্ষ কর্তন । গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ। অন্যান্য নদীতে নির্মিত বাঁধের প্রভাব। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ।

বন্যার শ্রেণিবিভাগ (Classification of Flood)

                          মৌসুমি বন্যা
 ঋতুভিত্তিক  বিস্তৃতি ব্যাপক  ক্ষতির পরিমাণ বেশি  পানি হ্রাস-বৃদ্ধির গতি ধীর

 

  বন্যা                  জোয়ার-ভাটাজনিত বন্যা

 আকস্মিক বন্যা

পানি হ্রাস-বৃদ্ধির দ্রুত গতি

পার্বত্য এলাকায় দেখা যায়

 স্বল্প স্থায়ী


সাধারণ উচ্চতা ৩ থেকে ৬ মিটার

অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় বন্যার রূপ ভয়াবহ

বন্যার প্রভাব (Impact of Flood)

বাংলাদেশের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক। বন্যায় এলাকা প্লাবিত হয়ে বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়। মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। পশুপাখির জীবন বিনষ্ট ও বিপন্ন হয়। ধ্বংস হয় সম্পদ। ২০০০ সালের বন্যায় দেশের ১৬টি জেলার ১.৮৪ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়। উৎপাদন আকারে এ ক্ষতির পরিমাণ ৫.২৮ লক্ষ মেট্রিক টন।

কাজ : বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তের পরিসংখ্যান থেকে শেষ পাঁচ বছরের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শতকরা মান স্তম্ভ লেখচিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ কর।


পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ বাংলাদেশ তথা এ ঢালু সমভূমির দেশে বিভিন্ন শতাব্দীতে বন্যা হয়েছে। ১৯৫৪ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে ১৯৭৪, ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালের বন্যা ছিল ভয়াবহ । এর মধ্যে ১৯৯৮ সালের দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় সবচেয়ে বেশি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রবল বৃষ্টিপাতের যে রেকর্ড রয়েছে তা তুলনাহীন বলা যায় । বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর কারণেই বন্যা এ দেশের একটি চির পরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তাই বলা যায় দুর্যোগ এবং বিপর্যয় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এ বিপর্যয়কে প্রতিরোধ করা একান্ত প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে অতীতকাল থেকেই মানুষ বন্যা প্রতিকারের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে আসছে। এসো বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক :

বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (Flood Control Measures )

 ক. সাধারণ ব্যবস্থাপনা (General management)
(১) সহজে স্থানান্তরযোগ্য বসতি তৈরি করা। (২) নদীর দু'তীরে ঘন জঙ্গল সৃষ্টি করা।
(৩) নদী-শাসন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা।
(৪) বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন ।
(৫) পুকুর, নালা, বিল প্রভৃতি খনন করা এবং সেচের পানি সংরক্ষণ করা।
(৬) প্রতি বছর বন্যা মোকাবেলার জন্য সরকারিভাবে স্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা 

 

খ. শ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল প্রকৌশল ব্যবস্থাপনা (Labour intensive and expensive engineering management )
(১) ড্রেজারের মাধ্যমে নদীর তলদেশ খনন করে পানির
পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। (২) সন্নিহিত স্থানে জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে
পানিপ্রবাহকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা। (৩) ভারত থেকে আসা পানিকে বাঁধের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন করা।
(৪) সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
(৫) নদী তীরকে স্থায়ী সুদৃঢ় কাঠামোর সাহায্যে সংরক্ষণ
করা ।

 

 গ. সহজ প্রকৌশলগত ব্যবস্থাপনা (Easy engineering management )
(১) নদীর দু'তীরে বেড়িবাঁধ দিয়ে নদীর পানি উপচেপড়া বন্ধ করা।
(২) দেশের সর্বত্র বনায়ন সৃষ্টি করা।
(৩) রাস্তাঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা। (৪) বন্যা প্রবল অঞ্চলে সর্বোচ্চ বন্যা লেভেলের উপরে ‘আশ্রয়কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠা করা।
(৫) শহর বেষ্টনীমূলক বাঁধ দেওয়া ।

 

 কাজ : কোনো বন্যা উপদ্রুত এলাকায় তোমরা সাহায্যের জন্য যাওয়ার সময় কোন কোন বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেবে ছক আকারে তার একটি পরিকল্পনা তৈরি কর।

বন্যা এ দেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করে। তাই বলা যায় বন্যা বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি ভয়াবহ সমস্যা। এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প, কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে এবং কিছু প্রচেষ্টা পরিকল্পনাধীন আছে। বাংলাদেশের প্রধান ৩টি নদীর উৎস চীন, নেপাল, ভারত ও ভুটান। এ ৩টি নদীর মোট অববাহিকা এলাকার পরিমাণ ১৫,৫৪,০০০ কিলোমিটার, যার মাত্র ৭ শতাংশ এলাকা এ দেশে অবস্থিত। কিন্তু এসব নদী প্রবাহের ৮০ শতাংশেরও বেশি পানি বাইরে থেকে আসে এবং বন্যার জন্য দায়ী ৯০ শতাংশ পানিই এ ৩টি নদী নিয়ে আসে। তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও এর মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার জন্য প্রয়োজন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা ।

 

Content added || updated By

দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যে অবস্থা তাকে খরা বলে। অনেকদিন বৃষ্টিহীন অবস্থা থাকলে অথবা অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে মাটির আর্দ্রতা কমে যায়। সেই সঙ্গে মাটি তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বা কোমলতা হারিয়ে রুক্ষরূপ গ্রহণ করে খরায় পরিণত হয়।

অনাবৃষ্টি বা খরার প্রভাব (Rainless or Impact of drought)

  • আমাদের দেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খরার প্রভাবে কৃষিজ ফসলের উৎপাদন কমে যায় ।
  • খাদ্যদ্রব্যের অভাব হওয়ায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
  • উপদ্রুত অঞ্চলে পানির অভাব দেখা দেয়।
  • প্রবল উত্তাপে বিভিন্ন ধরনের অসুখের প্রাদুর্ভাব ঘটে।
  • পরিবেশ রুক্ষ হয়ে ওঠে।
  • অগ্নিকাণ্ডের উপদ্রব বেড়ে যায়।

বৃষ্টিহীন ও খরাযুক্ত পরিবেশ মানুষ ও জীবজগতের স্বাভাবিক কাজকর্মের বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বনজ সম্পদ বৃদ্ধি তথা অধিক বৃক্ষরোপণ করে এবং ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

ঘূর্ণিঝড় (Cyclone)
প্রচন্ড শক্তিশালী এবং মারাত্মক ধ্বংসকারী বাংলাদেশে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় উল্লেখযোগ্য। স্থান অনুসারে ঘূর্ণিঝড়ের বিভিন্ন নামকরণ হয় তা তোমরা পূর্বেই জেনেছ। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রমুখী ও ঊর্ধ্বমুখী বায়ুরূপে পরিচিত। এর কেন্দ্রস্থলে নিম্নচাপ এবং চারপাশে উচ্চচাপ বিরাজ করে। বাংলাদেশে আশ্বিন-কার্তিক এবং চৈত্র-বৈশাখ মাসে এ ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয় (চিত্র ১৪.১)। বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর কারণে ঘূর্ণিঝড় হয় এবং একই ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণে ফানেল আকৃতির কারণে এ দেশে অধিকসংখ্যক ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়।

কাজ : বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের ফলে মানুষের মৃত্যু ব্যতীত আর কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়, তার একটি তালিকা তৈরি কর ।

ঘূর্ণিঝড় একটি সাময়িক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গত তিন দশকে বাংলাদেশের পূর্বাংশে বেশি ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, কুতুবদিয়া, উরিরচর, চর জব্বার, চর আলেকজান্ডার প্রভৃতি স্থানে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সংঘটিত কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের সময়কাল, নাম ও মৃত মানুষের সংখ্যা নিম্নের সারণিতে দেখানো হলো।

সারণি ১: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সংঘটিত কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়

 সংঘটিত হওয়ার সাল  ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের নাম মৃত   মৃত মানুষের সংখ্যা
 ১২ই নভেম্বর, ১৯৭০  ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়  প্রায় ৫,০০,০০০ জন
 ২৯শে নভেম্বর, ১৯৮৮  ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়  প্রায় ১,০৮,০০০ জন
 ২৯শে এপ্রিল, ১৯৯১  ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়  প্রায় ৫,৭০৮ জন
 ১৫ই নভেম্বর, ২০০৭  সিডর  প্রায় ৩,৪৪৭ জন
 ২৫শে মে, ২০০৯  আইলা  প্রায় ৩৩০ জন

নদীভাঙন (River Bank Erosion)

নদীখাতে পানিপ্রবাহের কারণে পার্শ্ব ক্ষয়কে নদীভাঙন বলে। পলিমাটি গঠিত সমভূমি অধ্যুষিত বাংলাদেশে নদীভাঙনে প্রতি বছর প্রচুর ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়। অনেক মানুষের জীবনহানি ঘটে।

 কাজ : নদীর গতিপথ অবস্থার নাম উল্লেখ কর।
 ১  ২  ৩
     

নদীভাঙনের কারণ (Causes of river bank erosion)

  •  জলবায়ু পরিবর্তন।
  • নদীর প্রবাহপথ ও তীব্র গতিবেগ ।
  •  নদীর গতিপথ পরিবর্তন।
  •  নদীগর্ভে শিলার উপাদান।
  • রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি। বাহিত শিলার কঠিনতা।
  •  নদীগর্ভে ফাটলের উপস্থিতি।

বৃক্ষ নিধন

 কাজ : নদীভাঙনের কারণগুলো কীভাবে নদীভাঙনে কার্যকরী ভূমিকা রাখে? দলে বিভক্ত হয়ে দু'টি কারণ ব্যাখ্যা কর।
                  কারণ        কার্যকরী ভূমিকা
  ১।  
  ২।  

স্বল্প আয়তনবিশিষ্ট বাংলাদেশে নদীভাঙনকে একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে। বর্ষাকালেই নদীভাঙন বেশি হয়। বিশেষত প্রায় প্রতি বছর বন্যা মৌসুম ও সন্নিহিত সময়ে প্রায় ৪০টি ছোট-বড় নদীতে নদীভাঙন দেখা যায়। অনেক সময় নদী-তীরে খরাজনিত ব্যাপক ফাটলের সৃষ্টি হলে তার প্রভাবেও নদীতে ভাঙন ধরে এবং ভূমির অংশবিশেষ নদীগর্ভে বিলীন হয় (চিত্র ১৪.২)। নদীভাঙনে ভূমির যে ক্ষয় হয় তা অপূরণীয়। এছাড়া আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়াও মারাত্মক আকার ধারণ করে।

নদীভাঙনজনিত ক্ষয়ক্ষতি (Loss from river bank erosion)

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় নদীভাঙন এ দেশের জন্য নিয়মিত সমস্যা বলা যায়। নদীভাঙনের ক্ষতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ দেশে প্রতি বছর পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও তিস্তাসহ প্রায় ৪১০টি নদী-উপনদীতে বন্যা এবং সন্নিহিত নদীতে ভাঙনের ঘটনা ঘটে। এ দেশের মানুষ নদীভাঙন নামক দুর্যোগের সঙ্গে কমবেশি জড়িত। এর মধ্যে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন লোক প্রত্যক্ষভাবে নদীভাঙনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদের মধ্যে প্রায় তিন লক্ষ লোক আশ্রয় নেয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা এবং বাঁধের উপর। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয় । এছাড়া প্রতি বছর প্রায় ৮,৭০০ হেক্টর জমি নদীভাঙনে নিঃশেষ হয়ে যায়।

নদীভাঙনে ক্ষতিতের উপাদানঃ

 খামার   ফসল
 চাষযোগ্য জমি
গৰাদি পশু
দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র
সেচ প্রকল্প
বৈদ্যুতিক টাওয়ার
সামাজিক প্রতিষ্ঠান
পারিবারিক অন্যান্য সম্পদ বসতবাড়ি
 গৰাদি পশু
গাছপালা
বৈদ্যুতিক টাওয়ার
সামাজিক প্রতিষ্ঠান

কাজ : বাংলাদেশের মানচিত্রে পদ্মা ও যমুনা নদীর ভাঙন সংঘটিত স্থানসমূহ নির্দেশ কর।

নদীভাঙন বাংলাদেশের একটি চলমান প্রক্রিয়া বিশেষ। এ দেশের প্রধান নদী ও শাখানদী দ্বারা কমবেশি নদীভাঙন প্রক্রিয়া চলে। দেশের প্রায় ১০০টি উপজেলার নদীভাঙন সংঘটিত হয়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাতে নদীভাঙনে জমির মালিকগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। কারণ তারা কখনই আর সে জমি পুনরুদ্ধার করতে পারে না। এ কারণে ভূমিহীন মানুষের স্থানান্তর ঘটে। এদের নির্দিষ্ট কোনো কাজের সুযোগ থাকে না। সেই সঙ্গে তারা সামাজিক মর্যাদাও হারায়। ফলশ্রুতিতে তারা দুর্ভিক্ষের সাথী হয়ে শহর-নগরের ভাসমান মানুষে পরিণত হয় এবং সর্বোপরি সরকারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় ।

Content added || updated By

বাংলাদেশ যেহেতু মহাসাগরগুলো থেকে অনেক দূরে অবস্থিত সেহেতু এ দেশকে সরাসরি সামুদ্রিক ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে তেমন চিহ্নিত করা যায় না। তবে বাংলাদেশের উত্তরে আসামের খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড়, হিমালয়ের পাদদেশ, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ভূমিকম্প প্রবণতা যথেষ্ট লক্ষ করা যায়। এছাড়াও রয়েছে ভূ-গাঠনিক গতিময়তা। সামগ্রিক দিক হতে দেখা যায় বাংলাদেশ ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে (চিত্র ১৪-৩)।

বাংলাদেশের পূর্বাংশে রয়েছে টারশিয়ারি যুগের পাহাড়। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত স্বল্প ভাঁজবিশিষ্ট ভঙ্গিল প্রকৃতির পাহাড়গুলোকে আসামের লুসাই এবং মিয়ানমারের আরাকান পাহাড়ের সমগোত্রীয় বলে ধরা হয়। এ পাহাড়গুলো বেলেপাথর, সেলপাথর এবং কর্দম দ্বারা গঠিত। গঠনগত কারণে এ চত্বর ভূমিকম্পপ্রবণ। আবার রয়েছে পুরাতন পলল গঠিত প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ— বরেন্দ্রভূমি, মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় এবং লালমাই পাহাড়। বাকি অংশ নবগঠিত প্লাবন সমভূমি। সুতরাং ভূতাত্ত্বিক গঠনগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশেষত উত্তর ও পূর্ব দিক যথেষ্ট ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল।

উত্তরে হিমালয় চত্বর এবং মালভূমি, পূর্বে মিয়ানমার আরাকান ইয়োমার অস্তিত্ব এবং উত্তর-পূর্বে নাগা- দিসাং-জাফলং অঞ্চলের সংশ্লিষ্টতা অনেক বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ করে তুলেছে।
১৫৪৮ সাল থেকেই বাংলাদেশ এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ভূমিকম্প সংক্রান্ত রেকর্ড সংগৃহীত শুরু হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্র উপকেন্দ্রের সঙ্গে তিন ধরনের পরিমাপ সম্পর্কযুক্ত। অগভীর কেন্দ্র (০-৭০ কিলোমিটার), মধ্য পর্যায়ের কেন্দ্র (৭০- ৩০০ কিলোমিটার) এবং গভীর কেন্দ্র ( ১,৩০০ কিলোমিটার)। সুতরাং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে উপকেন্দ্র না থাকলেও সংলগ্ন অঞ্চলে ভূমিকম্প হলে তার প্রভাব হিসেবে বাংলাদেশেও ভূকম্পন অনুভূত হয় ।

১৯৯৩ সালে সমগ্র বাংলাদেশকে তিনটি ভূকম্পনীয় সংঘটিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা— অঞ্চল ১ (মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ, রিখটার স্কেল মাত্রা ৭) ; অঞ্চল ২ (মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ, রিখটার স্কেল মাত্রা ৬); অঞ্চল ৩ (কম ঝুঁকিপূর্ণ, রিখটার স্কেল মাত্রা ৫)। এ তিনটি অঞ্চলের অধীনে রয়েছে যথাক্রমে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চল, মধ্য অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল (চিত্র ১৪.৪)। বাংলাদেশে সংঘটিত কয়েকটি ভূমিকম্পের সময়কাল, রিখটার স্কেল মাত্রা ও ক্ষয়ক্ষতি নিচের সারণিতে দেখানো হলো।

সারণি ২ : বাংলাদেশে সংঘটিত কয়েকটি ভূমিকম্প

 সাল  রিখটার স্কেলে  ক্ষয়ক্ষতি
 ১২ই জুন, ১৮৯৭  ৮.৭ মাত্রায়  ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন
 ২২শে নভেম্বর, ১৯৯৭  ৬.০ মাত্রায়  চট্টগ্রাম শহরে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়
 ২৭শে জুলাই, ২০০৮  ৫.১ মাত্রায়  ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আতঙ্কের সৃষ্টি হয় 

উৎস : বাংলাপিডিয়া

কাজ : ভূমিকম্প থেকে রক্ষার জন্য প্রস্তুতিমূলক ৪টি কাজের তালিকা তৈরি কর।

ভূমিকম্পে করণীয় (What is to be done in earthquake)

  • বাড়িতে থাকাকালীন বৈদ্যুতিক সংযোগ বিছিন্ন করতে হবে। গ্যাসের চুলা বন্ধ করতে হবে। | তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে।
  • ট্রেনে বা গাড়ির ভিতর থাকাকালীন যদি ভূমিকম্প হয় তবে কোনো জিনিস ধরে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত।
  • লিফটের ভিতরে থাকাকালীন দ্রুত নিচে নামার চেষ্টা করতে হবে। লিফটের ভিতরে আটকে পড়লে লিফট রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে হবে ।
  • বাড়ির বাইরে থাকাকালীন বড় দালান- কোঠার নিচে না দাঁড়িয়ে খোলা মাঠে বা স্থানে দাঁড়াতে হবে ।
  • মার্কেট, সিনেমা হল, আন্ডারগ্রাউন্ড ও শপিংমলে থাকলে এতদাঞ্চলে ভূমিকম্পে আকস্মিক ভীতিকর এক পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। আগুন লাগাও স্বাভাবিক। তাই এক্ষেত্রে প্রথমে নিচু হয়ে বসে বা শুয়ে থাকা শ্রেয় এবং পরবর্তীতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে হবে।
  • হাতের কাছে সবসময় লোহা কাটা করাত, পানির বোতল, আগুন রোধক রাখতে হবে।

অতীতকাল থেকে বাংলাদেশ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশে প্রধানত ভূমিকম্প হয় গঠনগত কারণে। এছাড়া পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ার কারণেও কিছু স্থান প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাতে বসেছে। এ দিক দিয়ে ঢাকা শহর উল্লেখযোগ্য। আবার অন্যদিকে ঢাকার উপর নগর গড়ার চাপ থাকায় ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ (Essential measures )

১। ভূমিকম্প সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন।
২। সারাদেশে ভবন নির্মাণে জাতীয় ‘বিল্ডিং কোড' এবং কোডের কাঠামোগত অনুসরণ বাধ্যতামূলক হবে।
৩। ঢাকা শহরে রাজউকের ভবন নির্মাণ প্ল্যান অনুমোদনের নীতিমালা যুগোপযোগী করা প্রয়োজন।
৪। সারাদেশে রাস্তা প্রশস্ত করতে হবে।
৫। ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে উদ্ধার কাজে ব্যবহারের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো কর্তৃক তালিকা অনুযায়ী যন্ত্রপাতি প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের দপ্তরে সংরক্ষণ করতে হবে।
৬। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহে স্বেচ্ছাসেবক দলগঠন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
৭। দুর্যোগকবলিত এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য নৌবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে ‘ডগ স্কোয়াড’ রাখা ।
৮। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন ও মহড়া অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা।

৯। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন কর্তৃক সিলেটে নির্মীয়মান কেন্দ্রের সঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর এবং সিলেট কেন্দ্রের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা।

কাজ : ভূমিকম্পের পরে দুর্যোগকবলিত এলাকায় বহুবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত? আলোচনা অনুষ্ঠান ।

Content added || updated By

ভূমিকম্পের সঙ্গে সুনামি সংঘটনের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে সুনামি সংঘটনের তেমন উল্লেখযোগ্য প্রচলন নেই। তবে অতীতে ১৭৬২ সালের ২রা এপ্রিল কক্সবাজার এবং সন্নিহিত অঞ্চলে সুনামির প্রভাব ঘটে। মিয়ানমারে আরাকান উপকূলে ৭.৫ রিখটার স্কেল মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটনের ফলে সুনামির আগমন হয়। ১৯৪১ সালে আন্দামান সাগরে ভূমিকম্পের ফলে বঙ্গোপসাগরে সুনামি সংঘটন হয়। তবে এর ফলে প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয় ভারতের পূর্ব উপকূল। যার পরিণতিতে ৫,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়। ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সিনুয়েলুয়ে দ্বীপে সংঘটিত ভূমিকম্পের কারণে যে সুনামির আগমন ঘটে তার প্রভাব বাংলাদেশে ঘটতে দেখা যায় এবং লোকের মৃত্যু ঘটে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা হচ্ছে এরূপ একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান যার আওতায় পড়ে— যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুর্যোগ প্রতিরোধ, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং দুর্যোগে সাড়াদান ও পুনরুদ্ধার ইত্যাদি কার্যক্রম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান উদ্দেশ্য হলো তিনটি :

(ক) দুর্যোগের সময় জীবন, সম্পদ এবং পরিবেশের যে ক্ষতি হয়ে থাকে তা এড়ানো বা ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করা;
(খ) প্রয়োজন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের মধ্যে অল্প সময়ে সকল প্রকার ত্রাণ পৌছানো ও পুনর্বাসন নিশ্চিত
করা এবং
(গ) দুর্যোগ পরবর্তী পুনরুদ্ধার কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করা।
সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুর্যোগপূর্ব, দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ের কার্যক্রমকে বোঝায়।

নিম্নে প্রদত্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা চক্রে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উপাদানসমূহ ও দুর্যোগের কোন স্তরে কী ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন সে ব্যাপারে আলোকপাত করা হলো :

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা চক্র (Disaster Management Circle)

দুর্যোগ প্রতিরোধ, দুর্যোগ প্রশমন এবং দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মুখ্য উপাদান। সুতরাং দুর্যোগকে কার্যত মোকাবিলার লক্ষ্যে দুর্যোগপূর্ব সময়েই এর ব্যবস্থাপনার বেশি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। দুর্যোগ সংঘটনের পরপরই এর ব্যবস্থাপনার অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে, সাড়াদান, পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন। অতীতে দুর্যোগে সাড়াদানকেই সম্পূর্ণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলে ধরে নেওয়া হতো ।

প্রতিরোধ (Prevention)

প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও এর ক্ষয়ক্ষতি কমানোর ব্যাপারে প্রতিরোধ কার্যক্রম সফলতা বয়ে আনতে পারে। দুর্যোগ প্রতিরোধের কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত প্রশমনের ব্যবস্থা রয়েছে। কাঠামোগত প্রশমনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নির্মাণ কার্যক্রম যথা- বেড়িবাঁধ তৈরি, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, পাকা ও মজবুত ঘরবাড়ি তৈরি, নদী খনন ইত্যাদি বাস্তবায়নকেই বোঝায়। কাঠামোগত দুর্যোগ প্রশমন খুবই ব্যয়বহুল, যা অনেক দরিদ্র দেশের পক্ষে বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। অকাঠামোগত দুর্যোগ প্রতিরোধ যেমন— প্রশিক্ষণ, গণসচেতনতা বৃদ্ধি, পূর্বপ্রস্তুতি ইত্যাদি কার্যক্রম স্বল্প ব্যয়ে করা সম্ভব।

প্রশমন (Mitigation )

দুর্যোগের দীর্ঘস্থায়ী হ্রাস এবং দুর্যোগ পূর্বপ্রস্তুতিকেই দুর্যোগ প্রশমন বলে। মজবুত পাকা ভবন নির্মাণ, শস্য বহুমুখীকরণ, ভূমি ব্যবহারে বিপর্যয় হ্রাসের কৌশল নির্ধারণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শক্ত অবকাঠামো নির্মাণ, কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় লোক স্থানান্তর; প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন ইত্যাদি কার্যক্রম দুর্যোগ প্রশমনের আওতাভুক্ত। দীর্ঘস্থায়ী দুর্যোগ প্রশমন ব্যয়বহুল হলেও সরকার সীমিত সম্পদের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদী খনন, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, বনায়ন ইত্যাদি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

পূর্বপ্রস্তুতি (Preparedness)

দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতি বলতে দুর্যোগপূর্ব সময়ে দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর ব্যবস্থাসমূহকে বোঝায়। আগে থেকে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিতকরণ, দুর্যোগ সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, ড্রিল বা ভূমিকা অভিনয় এবং রাস্তাঘাট, যানবাহন, বেতার যন্ত্র ইত্যাদি দুর্যোগের পূর্বে প্রস্তুত রাখা দুর্যোগ প্রস্তুতির অন্তর্ভুক্ত ।

সাড়াদান (Response)

সাড়াদান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার একটি অংশ মাত্র। দুর্যোগের পরপরই উপযুক্ত সাড়াদানের প্রয়োজন হয়। সাড়াদান বলতে নিরাপদ স্থানে অপসারণ, তল্লাশি ও উদ্ধার, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমকে বোঝায় ।

পুনরুদ্ধার (Recovery )

দুর্যোগে সম্পদ, পরিবেশ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো ইত্যাদির যে ক্ষতি হয়ে থাকে তা পুননির্মাণের মাধ্যমে দুর্যোগপূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনাকেই পুনরুদ্ধার বোঝায়। এক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সাহায্য ও সহায়তার প্রয়োজন হয়।

উন্নয়ন (Development)

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাকে দুর্যোগপূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পরপরই ঐ এলাকার উন্নয়ন কাজে হাত দিতে হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়ার পূর্বে ভৌগোলিক ও পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যের উপর লক্ষ রাখতে হবে।

উপকূলীয় দুর্যোগ ব্যবস্থা (Coastal Disaster Management)

উপরিউক্ত যে সকল দুর্যোগ সম্পর্কে বলা হলো তার ভিতরে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলসমূহে ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, অন্যদেশের ভূমিকম্পের প্রভাব প্রভৃতির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য যে সকল পদক্ষেপ নেওয়া হয় তা বেশিরভাগই উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল সাধারণত খরা, নদীভাঙন, বন্যা ও ভূমিকম্প দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন— ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, খরা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদিকে তাৎক্ষণিক মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আবহাওয়ার তথ্যভিত্তিক সময়মতো পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ। এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের জন্য সরকারি পেশাভিত্তিক দপ্তর হিসেবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর কাজ করে থাকে। পাশাপাশি মহাকাশ গবেষণার জন্য সরকারি আর একটি সংস্থা হচ্ছে স্পারসো । স্পারসো ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে মেঘচিত্র সরবরাহ করে আবহাওয়া অধিদপ্তরকে পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণে সহায়তা করছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আবহাওয়ার উপাত্ত সংগ্রহ করে, রাডার চিত্র নিয়ে অঙ্কন ও বিশ্লেষেেণর মাধ্যমে পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কীকরণের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বন্যা সংক্রান্ত পূর্বাভাস দান ও প্রচারের ব্যবস্থা করে থাকে। যদিও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার কোনো কলাকৌশল অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয়নি, তথাপি রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায়। জরুরি পরিস্থিতিতে আর্তদের চিকিৎসা, উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কাজে আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ বেসামরিক প্রশাসনকে সব রকম সাহায্য ও সহযোগিতা দান করে থাকেন। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন দুর্যোগ সংক্রান্ত সংকেতসমূহ প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাসমূহ যেমন— অক্সফাম, ডিজাস্টার ফোরাম, কেয়ার বাংলাদেশ, কারিতাস, প্রশিকা, সিসিডিবি, বিডিপিসি (বাংলাদেশ দুর্যোগ প্রস্তুতি কেন্দ্র) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়েই আমাদের থাকতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান কার্যক্রম যেমন— উন্নয়ন, প্রতিরোধ, প্রশমন ও প্রস্তুতি ইত্যাদি স্বাভাবিক সময়ে অর্থাৎ দুর্যোগপূর্ব অবস্থায় সফলভাবে পরিচালিত করলে দুযোর্গকালীন সময়ে আমরা দুর্যোগের হাত থেকে জীবন, সম্পদ ও পরিবেশকে বহুলাংশে রক্ষা করতে সক্ষম হবো। তাই যথাযথ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগ মোকাবিলার স্বার্থে আমাদেরকে দুর্যোগ কর্মপরিকল্পনা এবং দুর্যোগ সংক্রান্ত আপদকালীন পরিকল্পনা, ব্যক্তি, পরিবার, গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে তৈরি করে অনুশীলনের মাধ্যমে এসবের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা উচিত।

Content added By