নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - NCTB BOOK
Please, contribute to add content into রাষ্ট্র, নাগরিকতা ও আইন.
Content
রাস্তায় ট্রাফিক আইন মেনে চলা
অধিক সংখ্যক লোককে শিল্পকারখানায় কাজে লাগানো
দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা
রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা
সার্বভৌমত্ব রক্ষা
কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন
আইন প্রণয়ন
প্রচলিত আইন মানা
রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ
ভোট প্রদান
নিয়মিত কর প্রদান

রাষ্ট্র হচ্ছে সামাজিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সমাজে বসবাসরত সকল মানুষকে একটি ঐক্য সূত্রে বাধা এবং তাদের কল্যাণ ও সমস্যা সমাধানের জন্যই রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। সমাজ বিকাশের একটি সস্তরে সমাজের মধ্য থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে। প্রচীন ও মধ্যযুগে রাষ্ট্রকে মনে করা হতো ঈশ্বরের সৃষ্টি করা একটি প্রতিষ্ঠান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রকে 'সর্বজনীন কল্যাণ সাধনকারী" এবং "মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান বলে ব্যাখ্যা করেছেন। রাষ্ট্র হলো নাগরিকদের জন্য। নাগরিকের সুখ ও শান্তি বিধান করার জন্য রাষ্ট্রকে অনেক কাজ করতে হয়। রাষ্ট্রের এই কাজ কতগুলো অপরিহার্য এবং কতগুলো ঐচ্ছিক। আবার রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদেরও বেশ কিছু দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করতে হয়। অন্যদিকে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিধান এবং সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আইনের বিধিবিধান আবশ্যক। এ অধ্যায়ে আমরা রাষ্ট্র, নাগরিক ও আইন সম্বধ্যে অবহিত হব ।

Content added By

রাষ্ট্রের ধারণা

প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনো রাষ্ট্রে বসবাস করে। হঠাৎ করে কোনো রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি। আমি মানুষ প্রথমে গোত্রভিত্তিক বসবাস করত। সময়ের পরিবর্তনে একসময় রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। মানুষই রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিকেরই রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণকে ঐ রাষ্ট্রের নাগরিক বলা হয়। নাগরিকদের সুন্দর সুষ্ঠুভাবে বাঁচার জন্য রাষ্ট্র অনেক কাজ করে থাকে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক তত্ত্ববিদরা রাষ্ট্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, 'বয়ংসম্পূর্ণ জীবনের জন্য কতিপয় পরিবার ও গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠনই রাষ্ট্র'। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর. এম. ম্যাকাইভারের মতে, রাষ্ট্র হচ্ছে সরকার কর্তৃক প্রণীত আইন দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন, যার কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতা রয়েছে এবং যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসরত অধিবাসীদের ওপর বলবৎ হয়। অধ্যাপক গার্নার রাষ্ট্রের সবচেয়ে সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা নিয়েছেন। তিনি বলেন, “রাষ্ট্র হলো বহুসংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে গঠিত এমন এক জনসমাজ, যারা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যা বহিশক্তির নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত এবং যাদের একটি সুসংগঠিত সরকার আছে, যে সরকারের প্রতি ঐ জনসমাজ স্বভাবতই অনুগত'।

সুতরাং, আমরা বলতে পারি, রাষ্ট্র হলো একটি ভূখন্ডভিত্তিক সমাজ বিশেষ, যার সংগঠিত সরকার ও জনসমষ্টি রয়েছে। এবং যার নিজস্ব ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত আছে।

Content added By

রাষ্ট্রের ধারণা ব্যাখ্যা করলে আমরা রাষ্ট্রের চারটি উপাদান দেখতে পাই, যথা: জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব । প্রত্যেক রাষ্ট্রই এ চারটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত।

জনসমষ্টি রাষ্ট্রের প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে জনসমষ্টি। জনসমষ্টি কাতে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনগণকে বোঝায়। রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনসমষ্টি একান্ত অপরিহার্য। জনসমষ্টির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক হতে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। তবে রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনসংখ্যা কত হবে তার কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কয়েক কোটি হতে পারে। আবার কয়েক হাজারও হতে পারে। গণচীন ও ভারতে জনসংখ্যা একশ' কোটির উপরে। অন্যদিকে স্যানম্যারিনো ও মোনাকো এ দুটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জনসংখ্যা যথাক্রমে ৩৮,৩০০ ও ৩৮,৯৬৩ (২০১৯ সালে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রতিবেদন অনুযায়ী)।

নির্দিষ্ট খণ্ড নির্দিষ্ট ভূখন্ড হচ্ছে রাষ্ট্রের অপরিহার্য দ্বিতীয় উপাদান। প্রত্যেক রাষ্ট্রই একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। তৃষ্ণ বলতে স্বলভাগ, সমুদ্রসীমা, আকাশসীমাও বোঝায়। রাষ্ট্রের জনগণের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। জনসমষ্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সপ্তগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে অথবা সাংবিধানিকভাবে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিটি রাষ্ট্রই ভূখণ্ডের সীমানাকেন্দ্রিক নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তোলে। ভূখণ্ড বড় হলো- দারুস সালাম, সুইজারল্যান্ড, ব্রুনাই ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভূখণ্ডটি পৃথিবীর মানচিত্রে সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্থান পায়। অনেক সময় রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বেশ কয়েকটি দ্বীপের সমষ্টিও হতে পারে, যেমন- জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি ।

বা ছোট হতে পারে, যেমন- রাশিয়ার আয়তন অনেক বড় আর ছোট আয়তনের রাষ্ট্র।

 সরকার রাষ্ট্রের অপরিহার্য তৃতীয় উপাদানটি হলো সরকার। সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন আশিকভাবে সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনটি বিভাগ থাকে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও কর বিভাগ। এ তিন বিভাগের সমন্বয়ে সরকার গঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণতঃ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের সরকার গঠন করে। সরকার পদ্ধতি বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন হতে পারে। সরকার বলতে ব্যাপক অর্থে শাসকগোষ্ঠীর সকলকে বোঝায়, যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ক্ষমতা সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়। অধ্যাপক পার্লারের মতে, 'রাষ্ট্র যদি হয় জীবদেহ তবে সরকার হলো এর মস্তিক্যরূপ।

সার্বভৌমত্ব । রাষ্ট্র গঠনের মুখ্য উপাদান সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌম শব্দ দ্বারা চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতাকে বোঝায়। সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রের গঠন পূর্ণতা পায়। এ ক্ষমতা রাষ্ট্রকে অন্যান্য সংস্থা থেকে পৃথক করে। সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের ঐ বৈশিষ্ট্য যার ফলে নিজের ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোনো প্রকার ইচ্ছার যারা রাষ্ট্র আইনসঙ্গতভাবে আবদ্ধ নয়। প্রত্যেক সমাজ ব্যবস্থায় চূড়ান্ত ক্ষমতা কার্যকর করার জন্যে একটি মাত্র কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থাকবে। আর এ ক্ষমতাই হলো সার্বভৌম ক্ষমতা। সার্বভৌমের আদেশই হলো আইন। সার্বভৌমের আদর্শ বা আইন মানতে সকলেই বাধ্য। সার্বভৌম ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুইটি দিক রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মধ্যকার সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। এই সার্বভৌম

রাষ্ট্র, নাগরিকতা ও আইন

ক্ষমতার ঊর্ধ্বে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের অর্থ হলো রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহির্শক্তির নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে। কেবল জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার থাকা সত্ত্বেও একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা না থাকলে তা রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হবে না। যতদিন রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বিদ্যমান থাকে ততদিন সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্ব থাকবে। সরকারের পরিবর্তন সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্বকে নষ্ট করে না।

সুতরাং, জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড সরকার এবং সার্বভৌমত্ব এ চারটি উপাদান নিয়েই রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর যে কোনো একটি উপাদান না হলে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।

Content added By

একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র কী কাজ করে কিংবা রাষ্ট্র কী করতে পারে, আমাদের জানা দরকার। অর্থাৎ জনগণের জন্য রাষ্ট্র কী ধরনের সেবা প্রদান করে এবং এর সামর্থ্য কতটুকু এ পাঠ থেকে আমরা তা জানব। মানুষের প্রয়োজনেই রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। মানব জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের কাজ। বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্র প্রধানত দুই ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে, যথা: নিয়ন্ত্রণমূলক এবং কল্যাণমূলক। এ দুই ধরনের ভূমিকার ভিত্তিতে আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যেমন- অপরিহার্য বা মুখ্য কার্যাবলি এবং কল্যাণমূলক বা ঐচ্ছিক কার্যাবলি।

অপরিহার্য বা মুখ্য কার্যাবলি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রে বসবাসরত জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেগুলোকে অপরিহার্য বা মুখ্য কাজ বলা হয়। রাষ্ট্রের অপরিহার্য কাজগুলো নিম্নরূপ। আর. এম. ম্যাকাইভার তাঁর The Modern State গ্রন্থে বলেছেন, 'আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ বা দায়িত্ব। নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নিশ্চয়তা থেকে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের সৃষ্টি হয়। জনসাধারণকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, সমাজের শাস্তি ভক্ষাকারীদের শাস্তির বিধান করা এবং সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকে। রাষ্ট্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশ ও অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনী গড়ে তোলে। বাংলাদেশে পুলিশ, র‍্যাব, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ইত্যাদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা রাষ্ট্রের আরেকটি অপরিহার্য কাজ। দেশের ভৌগোলিক অখতা এবং বৈদেশিক আক্রমণ থেকে দেশ রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন ও পরিচালনা রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব। আধুনিককালে প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলেছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সামর্থ্য ও আধুনিকায়ন একটি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ সুবিধা প্রদান করে, যেমন- আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব প্রদানে তাদের দেশরক্ষা বাহিনীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রকে পরিচিত করা, রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত সম্পদের ওপর দাবি প্রতিষ্ঠিত করা, অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন, আঞ্চলিক কোর্ট গঠন, বহির্বিশ্বে অর্থনৈতিক বাজার সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ করা, বিদেশে অবস্থানরত দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সেবা প্রদান করা ইত্যাদি হচ্ছে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক অপরিহার্য কাজ।

আইন প্রণয়ন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ। রাষ্ট্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্টের মাধ্যমে আইন প্রণীত হয়। দেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট প্রভৃতি বিচারালয়ের মাধ্যমে দেশের সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের আবশ্যিক কাজের মধ্যে পড়ে।

রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদন, নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে। এ কাঠামোয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ, তাদের কর্মবণ্টন ও নির্দেশ, কাজ তদারক এবং পরিচালনা করা রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। অর্থ ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অর্থ সংগ্রহ ও বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের একটি মুখ্য কাজ। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরনের কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। বিভিন্ন উৎস থেকে এ অর্থ সপ্তাহ করা রাষ্ট্রের আবশ্যিক কাজ। রাষ্ট্রের অধীন বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, মালিকানার ওপর খাজনা ও কর নির্ধারণ এবং তা আদায় করা ও সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। রাষ্ট্র বাজেট প্রণয়ন, মুদ্রা প্রবর্তন ও মুদ্রা বিনিয়োগের ব্যবস্থা, গণনা ও পরিমাপের একক নির্ধারণ এবং মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা,মুদ্রাস্ফীতি রোধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রভৃতিও রাষ্ট্রের মুখ্য কার্যাবলি।

কল্যাণমূলক বা ঐচ্ছিক কার্যাবলি : বর্তমানে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের দাবি করে। রাজনৈতিক তত্ত্ববিদরা এখন একমত যে, রাষ্ট্রের ভূমিকা শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং কর আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্রকে অবশ্যই সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্য, নাগরিকদের নৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক জীবনের পরিপূর্ণ দলগত। রাষ্ট্রের কার্যাবলির একটি ছক বিকাশে কল্যাণমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। জনকল্যাণ ও উন্নয়নে রাষ্ট্রের তৈরি কর। এ কাজগুলো ঐচ্ছিক বা গৌণ কাজ। যে রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে যতবেশি উন্নত তার ঐচ্ছিক কার্যাবলি ততবেশি বিস্তৃত।

রাষ্ট্রের জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ। শিক্ষিত নাগরিক তার অধিকার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন থাকেন এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হন। এজন্য রাষ্ট্র শিক্ষা বিস্তারের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করে এবং শিক্ষা সুবিধা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। সরকার বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করে, নারী শিক্ষার ওপর গুরুত্বসহ বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করে ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে।

জনসাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং বিদ্যমান বিভিন্ন বৈষম্য ও কুপ্রথা দূরীকরণে রাষ্ট্র পুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং অসুস্থদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে হাসপাতাল, দাতব্য চিকিৎসালয়, শিশুসদন, মাতৃমকাল কেন্দ্র, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, দেশব্যাপী অস্থায়ী হেলথ ক্যাম্পেইন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতিও পরিচালনা করে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের সুব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, রোগ প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক টিকা প্রদান প্রভৃতি সেবাও রাষ্ট্র প্রদান করে। এছাড়া যৌতুক ও বর্ণ বা গোত্রপ্রথা দূরীকরণ, বাল্যবিবাহ রোধ এবং জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্য, যেমন- চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, তেল ইত্যাদি সরবরাহ প্রক্রিয়া সচল রাখা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তদুপরি খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য উৎপাদন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান, সার, বীজ, কীটনাশক সরবরাহ, সেচের ব্যবস্থা করা, খাদ্য গুদামজাতকরণ প্রভৃতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে স্বীকৃত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। তাই রাষ্ট্রকে খাদ্য নিরাপত্তায় পূর্বের তুলনায় অধিক মনোযোগ দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক সাফল্য অর্জন করেছে।

যে কোনো রাষ্ট্রের অর্থনেতিক উন্নতি তার শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়ন ও প্রসারের সাথে সংশ্লিষ্ট। রাষ্ট্রে নিত্যনতুন শিল্প গড়ে তোলা, বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠায় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহ ও ঋণ প্রদান, শিল্পজোন প্রতিষ্ঠা, ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার, উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি ও রপ্তানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করা রাষ্ট্রের কাজ। আমদানি নির্ভর না হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন যে কোনো রাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এজন্য বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার জন্য রাষ্ট্রকে অনেক বেশি নজর দিতে হয়। এছাড়া রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কলকারখানা স্থাপন ও পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ এবং এর মাধ্যমে অধিক সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজ।

দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যথা: রাস্তাঘাট, সেতু, সড়ক, রেলপথ, নৌ-চলাচল, বিমান যোগাযোগ ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ এবং যোগাযোগের আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত থাকা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঐচ্ছিক কাজ। বর্তমান বিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক বিপ্লব সাধিত হয়েছে। ইন্টারনেট, নেটওয়ার্কিং ও তরঙ্গের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে বিশ্বে পারস্পরিক যোগাযোগ অনেক বেড়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঐচ্ছিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সুষ্ঠু পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য অপরিহার্য।

জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য তুলে ধরা রাষ্ট্রের কাজ। জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে দেশীয় শিল্প, গান-বাজনা, আঞ্চলিক বৈচিত্র্য রক্ষা, লোকশিল্পের সরক্ষণ, জাদুঘর প্রতিষ্ঠা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঐচ্ছিক কাজ। জনগণের চিত্তবিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় মঞ্চ, খেলার মাঠ, পার্ক ও উদ্যান প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐচ্ছিক কাজ হলো জনগণের স্বাধীনতা এবং অধিকার রক্ষা করা। রাষ্ট্র জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চলাচলের স্বাধীনতা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ লক্ষ্যে নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করে। এছাড়া জনগণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় পরিবেশ সৃষ্টি, সংগঠন ও রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা, জনগণের বিপরীতমুখী স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ, সমাজে দুর্নীতি প্রতিরোধ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণ, শরণার্থীদের আশ্রয় দান ইত্যাদি রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক রাজনৈতিক কাজ।

সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। রাষ্ট্রে বসবাসরত দরিদ্র,বিধবা, অনাথ ও প্রতিকীদের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা, বেকারদের জন্য ভাতা, ব্যাংকদের জন্য সরকার ভাতা, পেনশন প্রদান ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক কার্যাবলি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রের বিশাল কর্মীবাহিনীকে পরিচালনা করা ও নিয়ন্ত্রনে রাখা রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজ। শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন শ্রমনীতিমালা প্রণয়ন, ন্যূনতম সঠিক মঞ্জুরি ও কাজের সময় নির্ধারণ, কাজের পরিবেশ সৃষ্টি, বোনাস, ইন্স্যুরেন্স, পেনশনসুবিধা প্রদান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক তৈরি, কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ধর্ম অফিসার নিয়োগ প্রভৃতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়া রাষ্ট্র বিবিধ উন্নয়নমূলক ও জনহিতকর কাজ সম্পাদন করে থাকে, যেমন- কৃষি ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বনায়ন কর্মসূচি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও পুনর্বাসন, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি প্রতিরোধ, নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি, বিদ্যুতায়ন ও জ্বালানি সরবরাহ, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, নগরায়ণ, গ্রামীণ উন্নয়ন, কালোবাজারি রোধ, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, নারী ও শিশু পাচার রোধ, অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদি বহুবিধ কাজ রাষ্ট্র সম্পাদন করে। রাষ্ট্র একটি বৃহদাকার সংগঠন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ রাষ্ট্রকে মোকাবিলা করতে হয়। তবে সার্বিকভাবে জনগণের কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। জনগণের চাহিদা অনুযায়ী বিশ্বের কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশে রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজের পরিধি দিনদিন ব্যাপক ও বিস্তৃত হচ্ছে।

 

Content added || updated By

নাগরিকের ধারণা

রাষ্ট্র গঠনের একটি পূর্বশর্ত হলো জনসমষ্টি। যখন একটি রাষ্ট্র পূর্ণাঙ্গভাবে আত্মপ্রকাশ করে তখন সেই জনসমষ্টি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে এর নাগরিকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। রাষ্ট্রের নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞানের ওপর রাষ্ট্রের কার্যক্রমের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে। নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং কীভাবে সুনাগরিক হওয়া যায় তা আমাদের জানতে হবে।

ল্যাটিন শব্দ Civics থেকে Citizen বা নাগরিক শব্দটির উৎপত্তি হয়। পৌরনীতি পাঠের মূল বিষয়বস্তু হলো নাগরিকত্ব ও রাষ্ট্র। সাধারণত নাগরিক শব্দটি দ্বারা নগরে বসবাসরত অধিবাসীকে বোঝায়। একসময়ে যারা শাসনকার্যে সরাসরি জড়িত থাকতেন, তাদেরকেই কেবল নাগরিক হিসেবে ধরা হতো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞায় বলেছেন, 'সে ব্যক্তিই নাগরিক যে নগর রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব ও শাসনকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তিনি তাঁর ধারণায় অধিকাংশ জনগণকে নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেননি। তাঁর মতে অধিকাংশেরই যথাযথভাবে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করার সামর্থ্য কিংবা অফুরন্ত সময় নেই। গ্রিক নগররাষ্ট্রে এ যুক্তিতে দাস এবং নারীদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো না এবং তারা রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে পারত না।

বর্তমানে নগর রাষ্ট্রের স্থলে জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে। আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ আয়তনে অনেক বড়, এখানে জনসংখ্যাও বেশি এবং নাগরিক সুবিধাসমূহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকলেই ভোগ করে। কিন্তু এত বিপুল জনসমষ্টিকে সরাসরি শাসনকার্যে অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব নয়। তাই নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণের শাসনকার্যে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের স্থলে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং যারা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেন এই মাপকাঠি ধরা হয়েছে। আধুনিক ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড জে'লাকি তাঁর নাগরিকের সংজ্ঞায় বলেছেন, 'যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে তাকেই নাগরিক বলা হয়। অধ্যাপক গেটেল বলেন, "নাগরিক হচ্ছে রাজনৈতিক সমাজের সেসব সদস্য, যারা উক্ত সমাজের প্রতি কর্তব্য পালনে বাধ্য থাকেন এবং সমাজ থেকে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারী হন।

সুতরাং, নাগরিকত্ব বলতে বোঝায়, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অধিকার, নাগরিক সুবিধা ভোগ করা এবং রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধ্য হওয়া। বৃহৎ অর্থে, নাগরিক হচ্ছেন তিনি, যিনি ঐ রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং রাষ্ট্রের আইন, সংবিধান ও অন্যান্য নির্দেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে নিজের কর্মের মাধ্যমে ভূমিকা রাখেন এবং রাষ্ট্র কর্তৃক কণ্টনকৃত সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সকলেই সমান অধিকার ভোগ করে। বর্তমানে নারী-পুরুষ, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে সকলেই নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারে; তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব অর্জনের শর্তাবলী বিভিন্ন রকম।নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য

রাষ্ট্র যেমন নাগরিকদের বিবিধ সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার দিয়ে থাকে তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিও নাগরিকদের কতগুলো পায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর নির্ভরশীল ও পরিপূরক। নাগরিকদের উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ নিম্নরূপ :

নাগরিকের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলা। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা,অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে সর্বদা সজাগ এবং চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ও সংবিধান মেনে চলা এবং আইনের প্রতি সম্মান দেখানো নাগরিকদের অন্যতম দায়িত্ব। কেউ আইন অমান্য করলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। স্বাভাবিক জীবনের ব্যাঘাত ঘটে। তাই সুষ্ঠু জীবনযাপন, শান্তি শুশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রত্যেক নাগরিককে আইন মেনে চলতে হবে। সততা ও সুবিবেচনার সাথে ভোট দেওয়া নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর ফলে যোগ্য ও উপযুক্ত প্রার্থী জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবেন। অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ প্রার্থীকে ভোটদানে বিরত থাকা উচিত। রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস নাগরিকদের প্রদেয় কর ও খাজনা। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক প্রতিরক্ষা এবং উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। নাগরিকদের যথাসময়ে কর প্রদান করে রাষ্ট্রীয় কাজে সহযোগিতা করতে হবে। রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা নাগরিকের কর্তব্য। সরকারের গৃহীত যে কোনো কাজ জনগণের কাজ। নাগরিকদের সততা, কাজে একাগ্রতা ও নিষ্ঠার ওপর সরকারের সফলতা, উন্নতি ও অগ্রগতি নির্ভর করে। প্রতিটি শিশুই রাষ্ট্রের নাগরিক। পিতামাতা তার অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন। তাই সন্তানদের জীবন রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষেধক টিকাদান, সুস্থ সবল রাখা এবং নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে পাঠানো পিতামাতার দায়িত্ব। এতে করে সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে অবদান রাখবে।প্রত্যেক নাগরিককেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। নিজস্ব সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় অর্জন ও সফলতা এবং সবসময় দেশের মঙ্গল কামনা করা নাগরিকদের কর্তব্য। জাতীয় সংগীত, জাতীয় ইতিহাস, জাতীয় বীর ও মনীষীদের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের একে অপরকে সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, ভিন্নমত মূল্যায়ন করা ও সম্মান করার মধ্য দিয়ে জাতীয় সংহতি অর্জন করা সম্ভব। এটা প্রত্যেককেই বিশ্বাস করতে হবে যে, বৈচিত্র্যের মধ্যেই সৌন্দর্য নিহিত। প্রত্যেক নাগরিককেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এমনকি রাষ্ট্রের বেজাইনি কোনো কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে কোনোক্রমেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। তাহলেই সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে।

Content added By

সাধারণভাবে আইন বলতে সামাজিকভাবে স্বীকৃত লিখিত ও অলিখিত বিধিবিধান ও রীতিনীতিকে বোঝায়। মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অধিকাংশ মানুষই এ নিয়ম-কানুনসমূহ মেনে চলে। সুতরাং আইন হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নিয়ম-কানুন, রীতিনীতি বা বিধিবিধান। এ অর্থে আইন মূলত দুই ধরনের- সামাজিক আইন ও রাষ্ট্রীয় আইন। সামাজিক জীবনে যে সকল বিধিবিধান বা রীতিনীতি মানুষ মেনে চলে তা হচ্ছে সামাজিক আইন। আর রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে এবং মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে কিংবা সমাজে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধে সর্বজনীনভাবে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশই রাষ্ট্রীয় আইন নামে পরিগণিত। বিভিন্ন রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ ও আইনবিশারদগণ আইনের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।

টি. এইচ. গ্রীন বলেছেন, 'রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত অধিকার এবং বাধ্যবাধকতাসমূহ আইন'। অধ্যাপক হল্যান্ডের মতে, আইন হচ্ছে মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের কতগুলো সাধারণ নিয়ম যা সার্বভৌম রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক প্রণীত হয় আইনের একটি উৎকৃষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করেছেন উড্রো উইলসন। তিনি বলেন, আইন হলো সমাজের সেইসকল প্রতিষ্ঠিত প্রথা ও রীতিনীতি যেগুলো সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং যা সরকারের অধিকার ও ক্ষমতার দ্বারা বল করা হয়।

সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং মানুষের সামাজিক কল্যাণের জন্য গৃহীত সুনির্দিষ্ট নিয়মের সমষ্টিকেই আইন বলে।

আইনের বৈশিষ্ট্য

উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে আইনের যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় তা নিম্নরূপ : 

১. আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ ও ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।

২. আইন হচ্ছে সর্বজনীন, তা রাষ্ট্রের সকলের উপর সমানভাবে প্রযোজ্য। 

৩. আইন হচ্ছে একধরনের আদেশ বা নিষেধ, যা সকলকেই মান্য করতে হয়। যারা আইন অমান্য করে তাদের সাজা পেতে হয়।

৪. আইন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বমূলক কর্তৃপক্ষ হতে স্বীকৃত এবং আরোপিত।

৫. আইন হলো সমাজে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি।

আইনের উৎস

আইনের বিভিন্ন উৎস রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হল্যান্ড আইনের ৬টি প্রধান উৎসের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো : ১. প্রথা ২. ধর্ম ৩. বিচার সংক্রান্ত রায় ৪. বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা ৫. ন্যায়বোধ ও ৬. আইনসভা।

১. প্রথা : প্রথা হলো আইনের সবচেয়ে প্রাচীনতম উৎস। সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, আচার-আচরণ ও অভ্যাসই হচ্ছে সামাজিক প্রথা। এ সকল সামাজিক প্রথার আবেদন এতই বেশি যে, এগুলো অমান্য করলে সংঘাত ও বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়। কালক্রমে এসব প্রচলিত প্রথা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়ে আইনে পরিণত হয়েছে। যেমন- ব্রিটেনের অধিকাংশ আইনই প্রথা থেকে এসেছে।

২. ধর্ম মানুষের ওপর ধর্মের প্রভাব অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ঐশ্বরিক আইন অনুসরণ করে আসছে। তাই ধর্ম, ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মগ্রন্থ আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য ইত্যাদি মূল্যবোধ ধর্ম চিহ্নিত করেছে বলে প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় রীতিনীতি প্রভাব বিস্তার করে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় বিধানই রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে বিবেচিত হয়। ইসলামিক রাষ্ট্রের আইন প্রধানত কুরআন ও শরিয়ার ওপর নির্ভরশীল। হিন্দু আইনও মূলত হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ, যেমন- বেদ, গীতা, রামায়ণ প্রভৃতির ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান যুগেও ধর্মীয় রীতিনীতি আইনরূপে গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তন করা হয়। বিবাহ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্মীয় বিধি-বিধান ও রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলে।

৩. বিচার সংক্রান্ত বিচারকের রায় অথবা বিচার বিভাগীয় রায়ও আইনের একটি উৎস। বিচারকালে বিচারক যদি প্রচলিত আইনের মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হন তখন তিনি স্বীয় বুদ্ধি, মেধা ও প্রজ্ঞার সাহায্যে প্রচলিত আইনের সাথে সঙ্গতি রেখে আইনের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বিচারের রায় প্রদান করেন। এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে যায় এবং একসময় আইনে পরিণত হয়। তাই দেখা যায়, বিচারকের রায়ও আইনের একটি উৎস।

৪. বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা বা তাদের আইন বিষয়ক গ্রন্থাবলিও আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। প্রখ্যাত আইনবিদদের ব্যাখ্যা, মূল্যায়ন, আলোচনা ইত্যাদি থেকে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় আইনের সন্ধান লাভ করে। ব্রিটেনের আইন ব্যবস্থায় আইনবিদ কোক, ব্ল্যাকস্টোন, আমেরিকার কেন্ট, ইসলামি আইনের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা (রা.) প্রমুখের অনেক অভিমতই আইনের মর্যাদা লাভ করেছে।

৫. ন্যায়বোধ। বিচারক যখন প্রচলিত আইনের মাধ্যমে কিংবা উপযুক্ত আইনের অভাবে ন্যায়বিধান করতে ব্যর্থ হন তখন নিজস্ব সামাজিক নীতিবোধের আলোকে ন্যায্য রায় প্রদান করেন। এরূপ নীতিবোধ দ্বারা প্রণীত আইন দেশের আইনের মর্যাদা লাভ করে। তাই ন্যায়নীতি ও ন্যায়পরায়ণতা আইনের একটি প্রকৃষ্ট উৎস।

৬. আইনসভা আধুনিক রাষ্ট্রে আইনসভাই আইনের প্রধান উৎস। সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরই আইনসভা বা আইন পরিষদ আছে। এ আইনসভায় দেশের জনগণের স্বার্থকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সংশোধন হয়ে থাকে। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও রাষ্ট্র প্রধানের জারিকৃত প্রশাসনিক ডিক্রি, বৈদেশিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশনের রেটিফিকেশনও আইন হিসেবে গৃহীত হয়।

সুশাসনের জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনের অনুশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সকল নাগরিক সমানভাবে স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে। কেউ কারও অধিকার ক্ষুন্ন করতে পারে না।সাধারণভাবে আইনের অনুশাসন দুটি ধারণা প্রকাশ করে, যথা: আইনের প্রাধান্য ও আইনের দৃষ্টিতে সকলের সাম্য।

আইনের প্রাধান্য বজায় থাকলে সরকার সেচ্ছাচারী হতে পারে না এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করতে সচরাচর সাহস করে না। বিনা অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করা, বিনা বিচারে কাউকে আটক রাখা ও শাস্তি দেওয়া প্রভৃতি আইনের শাসনেরপরিপন্থি। আইনের প্রাধান্য নাগরিক স্বাধীনতার রক্ষাকক। সমাজে আইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে কেউ আইন অমান্য করে অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সরকারও কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় অযৌক্তিক প্রতিবন্যকতা সৃষ্টি করতে সাহস পাবে না।

আইনের দৃষ্টিতে সামা বলতে বুঝায় সমাজে ধনী-দরিদ্র, সকা- দুর্বল, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেই সমান। আইনের চোখে কেউ বাড়তি সুবিধা পাবে না। সকলের জন্য একই আইন প্রযোজ্য। রাষ্ট্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা তখনই খর্ব হয় যখন আইনের অনুশাসন থাকে না। আইনের শাসনের অভাবে নাগরিকরা হয়রানির শিকার হতে পারে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে আইনের শাসন কায়েম হয় না। বর্তমান সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশের তথ্য অধিকার আইন

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা নাগরিকের জন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তথ্য প্রাপ্তির অধিকার এরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশ সরকার ৫ এপ্রিল ২০০৯ তথ্য অধিকার আইন জারি করে। জনগণের তথ্য প্রাপ্তির অধিকারকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এই আইন প্রণীত হয়।

পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রেই তথ্য অধিকার আইন রয়েছে। এখানে আমাদের প্রথমে জানতে হবে তথ্য বলতে কী বুঝায় । সাধারণভাবে বলা যায় যেকোনো ধরনের রেকর্ডই তথ্য। তথ্য অধিকার আইনে তথ্য বলতে কোনো কর্তৃপক্ষের গঠন, কাঠামো ও দাপ্তরিক কর্মকান্ড সংক্রান্ত যে কোনো স্মারক, বই মানচিত্র, চুক্তি, তথ্য-উপাত্ত, লগবহি, আদেশ- বিজ্ঞপ্তি, দলিল, নকল কপি, পত্র, প্রতিবেদন, হিসাব বিবরণী, প্রকল্প প্রস্তাব, আলোকচিত্র, অডিও-ভিডিও, অঙ্কিত চিত্র, ফিল্ম, ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতকৃত যেকোনো ইন্‌স্ট্রুমেন্ট, যান্ত্রিকভাবে পাঠযোগ্য দলিলাদি এবং ভৌত গঠন ও বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে সকল তথ্যবহ কতু বা এদের প্রতিলিপিকে বুঝানো হয়েছে। তবে দাপ্তরিক নোটশিট বা নোটশিটের প্রতিলিপি এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।

বর্তমান তথ্য অধিকার আইনে তথ্য কমিশন' নামে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে। তথ্য কমিশনে একজন প্রধান তথ্য কমিশনারসহ দু'জন তথ্য কমিশনার রয়েছেন। আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের কর্তৃপক্ষের নিকট হতে তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং কর্তৃপক্ষও একজন নাগরিককে তথ্য প্রদানে বাধ্য থাকবে। আইন অনুযায়ী সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা কার্যালয়ের সাথে সংযুক্ত বা অধীন কোনো অধিদপ্তর, পরিদপ্তর বা দপ্তরের প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয় কার্যালয়, আঞ্চলিক কার্যালয়, জেলা কার্যালয় বা উপজেলা কার্যালয় তথ্য প্রদান ইউনিট হিসেবে কাজ করবে।

তথ্য অধিকার আইন অনুসারে তথ্য জানার জন্য লিখিতভাবে বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বা ই-মেইলে আবেদন করতে হবে। যারা লেখাপড়া জানে না তাদের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহযোগিতা প্রদান করবেন এবং আবেদনে টিপসই নিয়ে দাখিল করতে পারবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তথ্য প্রদান না করলে তথ্য প্রদানের সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পরবর্তী ত্রিশ দিনের মধ্যে অনুরোধকারী আপিল করতে পারবেন। আবেদনকারী আপিল কর্তৃপক্ষের নিকট সুবিচার না পেলে তথ্য কমিশনের নিকট অভিযোগ পাঠাতে পারবেন। এক্ষেত্রে তথ্য কমিশনের কাজ হচ্ছে মূলত

রাষ্ট্র, নাগরিকতা ও আইন

অভিযোগ গ্রহণ করা ও সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তথ্যের সরক্ষক বা ভাষার হয়ে উঠতে হবে। তার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে- আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনগণকে জানানো, কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য প্রান্তির সুবিধা সৃষ্টি, তথ্যের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ ও তথ্য সরবরাহে ব্যর্থতা নির্ধারণ।

সুতরাং, তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমাদের তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে দরিদ্র, প্রাপ্তিক এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে। প্রতিটি সংস্থার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে ও দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব হবে। জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে মানবাধিকার ও দারিদ্র্য বিমোচনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সর্বোপরি গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হবে।

Content added By