নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - NCTB BOOK

অষ্টম শ্রেণিতে তোমরা অম্ল, ক্ষার ও লবণ কী ধরনের রাসায়নিক পদার্থ তার একটা প্রাথমিক ধারণা পেরেছ। এই অধ্যায়ে আমরা অম্ল বা এসিড, ক্ষার ও লবণ সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করব। এগুলো কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন কিংবা কর্মজীবনে ব্যবহার হয়, সেটার একটা ধারণা দেওয়া হবে। অম্ল ও ক্ষারের পরিমাপের জন্য pH বলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, এই অধ্যায় শেষে আমরা সেটি সম্পর্কেও ধারণা পেয়ে যাব।

 

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা:

  • শক্তিশালী ও দুর্বল এসিডের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পারব।
  • প্রাত্যহিক জীবনে এসিডের ব্যবহার এবং সাবধানতা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • এসিড অপব্যবহারের সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব।
  • নির্দেশক ব্যবহার করে বিভিন্ন বস্তুর অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব চিহ্নিত করতে পারব (লিটমাস, পূর্বের শ্রেণিতে তৈরিকৃত ফুল, সবজির নির্যাসের সাহায্যে)।
  • পাকস্থলীতে এসিডিটির কারণ এবং সঠিক খাদ্য নির্বাচন ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • পদার্থের pH এর মান জানার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  •  ক্ষারকের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • প্রাত্যহিক জীবনে ক্ষারের প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যবহারের সাবধানতা ব্যাখ্যা করতে পারব ।
  • প্রশমনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • প্রাত্যহিক জীবনে প্রশমনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  •  লবণের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • প্রাত্যহিক জীবনে লবণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • পরীক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার লবণ তৈরি করতে পারব। (ধাতু + এসিড, ধাতুর অক্সাইড+এসিড)
  •  আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অম্ল, ক্ষার ও লবণের অবদানকে প্রশংসা করব।
Content added By

৭.১.১ শক্তিশালী ও দুর্বল এসিড

অষ্টম শ্রেণিতে তোমরা বেশ কিছু জৈব এসিডের নাম জেনেছ। তোমরা এটাও জেনে গেছ যে এসিডগুলো পানিতে হাইড্রোজেন আয়ন (H) তৈরি করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, কিছু কিছু এসিড, বিশেষ করে জৈব এসিডগুলো কিন্তু পানিতে পুরোপুরিভাবে বিয়োজিত না হয়ে আংশিকভাবে বিরোজিত হয় । অর্থাৎ যতগুলো এসিডের অণু থাকে তার সবগুলো হাইড্রোজেন আয়ন (H1) তৈরি করে না। সে জন্য এই এসিডগুলোকে দুর্বল এসিড বলে (চিত্র ৭.০১)। পক্ষান্তরে, খনিজ এসিডগুলো পানিতে পুরোপুরি বিরোজিত হয়ে হাইড্রোজেন আয়ন (H) তৈরি করে। অর্থাৎ যতগুলো এসিডের অণু থাকে, তার সবগুলোই বিয়োজিত হয়।তবে কিছু এসিড আছে, যেমন: কার্বোনিক এসিড (H2CO3), যেটি জৈব এসিড না হলেও দুর্বল এসিড।

 

 

৭.১.২ প্রাত্যহিক জীবনে এসিডের ব্যবহার ও সাবধানতা

তোমরা কি জান, বোলতা বা বিচ্ছু হুল ফুটালে প্রচণ্ড জ্বালা করে কেন? এর কারণ হলো বোলতা এবং বিছুর হুলে থাকে হিস্টামিন (Histamine) নামে এক ধরনের ক্ষারক পদার্থ। তাই এসব ক্ষেত্রে জ্বালা নিবারণের জন্য যে মলম ব্যবহার করা হয়, তাতে থাকে ভিনেগার অথবা বেকিং সোডা, যেগুলো এসিড কিংবা এসিড জাতীয়। এগুলো ঐ ক্ষারকের সাথে বিক্রিয়া করে সেগুলো নিষ্ক্রিয় করে; ফলে জ্বালা আর থাকে না। এ ধরনের খাবার খাওয়ার পর কোনো ধরনের কোমল পানীয় পান করি। এটা কি আমাদের কোনো কাজে আসে? আসলে খাবার হজম করার জন্য আমাদের পাকস্থলীতে নির্দিষ্ট মাত্রায় হাইড্রোক্লোরিক এসিডের প্রয়োজন হয়। এই মাত্রার হেরফের হলে আমাদের পরিপাকে অসুবিধা হয়। কোমল পানীয়গুলো অল্পমাত্রায় এসিডিক, তাই পুরুপাক খাবার পর কোমল পানীয় আমাদের পরিপাকে সাহায্য করে।

 

অষ্টম শ্রেণিতে তোমরা জেনেছ যে লেবু, কমলা, আপেল, পেয়ারা, আমলকী ইত্যাদি নানা রকম ফলের মাঝে আছে নানা রকমের জৈব এসিড, যেগুলো আমাদের খুবই প্রয়োজনীয়। আবার কিছু কিছু এসিড আছে, যে গুলো রোগ প্রতিরোধও করে। যেমন ভিটামিন সি বা এসকরবিক এসিড। তোমরা কি জান, ভিটামিন সি ক্ষত সারাতে খুবই সহায়ক হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের শরীরে এর অভাবে স্কার্ভি রোগ হয়?

আম, জলপাই ইত্যাদি নানা রকম আচার (চিত্র ৭.০২) সংরক্ষণে কী এসিড ব্যবহার করা হয় সেটি কি তোমরা জান? এটি হলো ভিনেগার বা এসিটিক এসিড (CH3COOH)। বিয়েবাড়িতে দাওয়াত খাওয়ার পর বোরহানি বা দই খেলে কোনো লাভ হয় কি? হ্যাঁ, লাভ হয়। কোমল পানীয়ের মতো বোরহানি (চিত্র ৭.০৩) বা দই খেলে এতে বিদ্যমান ল্যাকটিক এসিড হজমে সহায়তা করে।

তোমরা কি জান, কেক, বিস্কুট বা পাউরুটি ফোলানো হয় কীভাবে? এটি করা হয় বেকিং সোডা ব্যবহার করে।

 

অম্ল, ক্ষারক ও লবণের ব্যবহার

তাপ দিলে বেকিং সোডা ভেঙে কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়, যেটি কেক বা পাউরুটিকে ফুলিয়ে ভোলে।আমরা টয়লেট পরিষ্কার করার জন্য যেসব পরিষ্কারক ব্যবহার করি, তার মূল উপাদান কী তোমরা জান? এর মূল উপাদান হলো শক্তিশালী এসিড, যেমন HCl, HNO3 H2S04 সৌর প্যানেলে তৈরি সৌরবিদ্যুৎ সংরক্ষণের জন্য, বা বাসাবাড়িতে আইপিএস (IPS) চালানোর জন্য এবং গাড়িতে যে ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়, তার অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান হলো সালফিউরিক এসিড ।

তোমরা জান যে, ফসল উৎপাদনের জন্য সার হলো অতি প্রয়োজনীয় একটি জিনিস। সার হিসেবে আমরা যেগুলো ব্যবহার করি তার অন্যতম হলো অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট (NHNO3), অ্যামোনিয়াম সালফেট ((NH4)2SO4) ও অ্যামোনিয়াম ফসফেট ((NH4)3PO4), আর সার কারখানায় এগুলো তৈরি করা হয় যথাক্রমে নাইট্রিক এসিড (HNO3), সালফিউরিক এসিড (H2SO ) এবং ফসফরিক এসিড (H3PO4) দিয়ে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নানা রকম এসিড। তাই আমাদের জীবনে এসিডের ভূমিকা অপরিসীম ও অনস্বীকার্য। তবে কিছু কিছু এসিড, বিশেষ করে শক্তিশালী এসিডগুলো (যেমন H2SO4, HNO3, HCl) মানবদেহের জন্য যেমন মারাত্মক ক্ষতিকর, তেমনি আমাদের অনেক প্রয়োজনীয় এবং নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রেরও অনেক ক্ষতি করে। আমাদের শরীরে কোথাও লাগলে সেই স্থান পুড়ে যায় এবং সেখানে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করে। তোমরা হয়তো এসিড ছুড়লে মানুষের শরীর কীভাবে ঝলসে যায় সেগুলো পত্রিকায় বা টেলিভিশনের খবরে দেখেছ। অন্যদিকে এসিড কাপড়ে লাগলে কাপড়ও পুড়ে যায় কিংবা ছিদ্র হয়ে যায়। একইভাবে ধাতব পদার্থসমূহ এসিডের সংস্পর্শে এলে তাও ক্ষয় হয়ে যায়। অতএব এসিডের ব্যবহারে আমাদের খুবই সাবধান হতে হবে। কোনো কারণে পারে এসিড পড়লে সাথে সাথে প্রচুর পানি দিয়ে সেই জায়গাটা ধুয়ে ফেলতে হবে।

দলগত কাজ

কাজ: মাটির অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব দেখা (চিত্র 1.08 ) ।

প্রয়োজনীয় উপকরণ: ১টি বিকার কিংবা কাচের বোতল, কিছু মাটি, লাল ও নীল লিটমাস কাগজ, ফুলের নির্যাস, নাড়ানি, পানি, চিমটা।

পদ্ধতি: বিকারে বা কাচের বোতলে কিছু মাটি নিয়ে (১০০ গ্রাম) ১০-২০ মিলিলিটার (কয়েক চামচ) পানি যোগ কর। নাড়ানি দিয়ে খুব ভালোভাবে নাড়া দাও। চিমটা দিয়ে প্রথমে न

লিটমাস কাগজ বিকারের মিশ্রণে ডুবাও। কিছু সময় অপেক্ষা কর। তলানি জমা হলে লিটমাস কাগজের রং পরিবর্তন খাতার লিখে রাখ।

যদি লিটমাস পেপার সংগ্রহ করতে না পার তাহলে ফুলের নির্যাস দিয়েও এই পরীক্ষাটি করতে পার। এবার তোমরা আগের শ্রেণিতে তৈরি করা নির্যাস একে একে টেস্টটিউবে নিয়ে বিকারের মিশ্রণে যোগ করে দেখ নির্যাসের রং কীভাবে পরিবর্তন হয়। মাটি অম্লীয়, ক্ষারীয় বা নিরপেক্ষ—তিন রকমেরই হতে পারে এবং এটি মূলত নির্ভর করে এতে কী ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান তার উপর।

 

৭.১.৩ এসিডের অপব্যবহার, আইনকানুন ও সামাজিক প্রভাব

পৃথিবীর সকল সমাজেই এক-দুইজন খারাপ/নিষ্ঠুর চরিত্রের মানুষ (চিত্র ৭.০৫) থাকে— আমাদের সমাজেও আছে। তারা নিজের প্রতিহিংসা মেটাতে অন্য মানুষের শরীরে এসিড ছুড়ে মারার মতো ভয়ানক অপরাধ করতে পারে। এসিড ছুড়ে মারার ফলে মানুষের শরীর সম্পূর্ণ ঝলসে যায়। মুখমণ্ডলে এসিড ছুড়লে সেটি বিকৃত আকার ধারণ করে। এ কারণে যারা এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হন, তারা তাদের বিকৃত চেহারা নিয়ে জনসম্মুখে আসতে চায় না, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তারা আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়, তাদের বেশির ভাগই স্কুল-কলেজের ছাত্রী বা গৃহবধূ। এসিড-সন্ত্রাসের কারণে এই সম্ভাবনাময় ও মেধাবী ছাত্রীদের পড়াশোনা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার গৃহবধূরা এর শিকার হলে পুরো পরিবারে নেমে আসছে দুর্বিষহ জীবন। তাই এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে এবং মানুষকেও এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।

৭.১.৪ এসিড ছুড়লে শাস্তি

এসিড ছোড়া একটি মারত্মক অপরাধ। বাংলাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী এসিড ছোড়ার শান্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। যে এসিড ছোড়ে, সে একদিকে যেমন অন্যের জীবনটি ধ্বংস করে দিচ্ছে, অন্যদিকে নিজেও কঠোর শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। হয়তো বাকি জীবন জেলখানায় বন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে। তাই আমাদের সব মানুষকে এসিড ছোড়ার ভয়াবহতার কথা বোঝাতে হবে। যারা সাধারণ মানুষের কাছে এত সহজে এসিড বিক্রি করে তাদেরকেও সতর্ক করতে হবে কিংবা শাস্তি দিতে হবে। একই সাথে কেউ এসিড দিয়ে আক্রান্ত হলে তাকে কীভাবে প্রতিরক্ষা করতে হবে (যেমন পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা), সে ব্যাপারটিও সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে।

৭.১.৫ নির্দেশক ব্যবহার করে বিভিন্ন বস্তুর অম্লত্ব ও ক্ষারকত্ব শনাক্তকরণ

আগের শ্রেণিতে তোমরা বেশ কয়েকটি ফুলের নির্যাস তৈরি করেছ এবং এদেরকে নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করে এসিড ও ক্ষারক শনাক্ত করেছ। এখন এসব নির্দেশক দিয়ে আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত কিছু জিনিসের অম্লত্ব ও ক্ষারকত্ব পরীক্ষা করতে পারি।

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ: টুথপেস্ট, লিটমাস কাগজ, বিকার বা কাচের বোতল বা গ্লাস, ফুলের নির্যাস, নাড়ানি, পানি, চিমটা।

পদ্ধতি: বিকারে ৪-৫ গ্রাম টুথপেস্ট নাও। ৫-১০ সিসি বিশুদ্ধ পানি যোগ করে ভালোভাবে নাড়ানি দিয়ে নাড়া দাও। মিশ্রণটি কিছুক্ষণ রেখে দাও। এবার চিমটা দিয়ে প্রথমে নীল লিটমাস কাগজ বিকারের মিশ্রণে ডুবাও। এ সময় এর বর্ণ পরিবর্তন লক্ষ কর। একইভাবে লাল লিটমাস কাগজ ডুবিয়ে বর্ণ পরিবর্তন লক্ষ কর (চিত্র ৭.০৬)। তোমরা কী দেখতে পেলে? লাল লিটমাস কাগজের রং পরিবর্তিত হয়ে নীল হলো আর নীল লিটমাসের কোনো পরিবর্তন হলো না। অর্থাৎ টুথপেস্ট হলো ক্ষারীয় পদার্থ। এবার একটি টেস্টটিউবে টুথপেস্টের ১-২ মিলিলিটার পরিমাপ নিয়ে তাতে সবজি ও ফুলের নির্যাস যোগ করে দেখ কী ধরনের বর্ণ পরিবর্তন হয়।

 

কাজ: বিভিন্ন রকম পানীয় ও ফলের রসের অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব শনারকরণ (চিত্র ৭.০৭)।

প্রয়োজনীয় উপকরণ: নানা রকম পানীয় (সফট ড্রিংকস) ও ফলের জুস (আম, লিচু, কমলা ইত্যাদি), বিকার, লিটমাস কাগজ, ফুলের নির্যাস।

পদ্ধতি: বিকারে বা কাচের বোতলে একে একে পানীয় নাও এবং লাল ও নীল লিটমাস কাগজ ডুবাও। কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করলে? লাল লিটমাস কাগজের রঙে কোনো পরিবর্তন হলো না, কিন্তু নীল লিটমাস কাগজের রং পরিবর্তিত হয়ে লাল হয়ে গেল। এ থেকে কী বুঝা গেল? আমরা সাধারণত যেসব পানীয় ও ফলের রস পান করে থাকি, সেগুলো অম্লীয় পদার্থ। এবার প্রতিটি পানীয় ও ফলের রসে তোমাদের আগের তৈরি ফুলের নির্যাস একে একে যোগ করে দেখ কী ধরনের রং পরিবর্তন হয় ।

 

৭.১.৬ পাকস্থলীতে এসিডিটির কারণ ও সঠিক খাদ্য নির্বাচন

তোমরা জান, পাকস্থলীতে খাদ্য হজম করার জন্য আমাদের সবার হাইড্রোক্লোরিক এসিডের প্রয়োজন হয় এবং সেটি নিজে থেকে আমাদের পাকস্থলীতে তৈরি হয়। কোনো কারণে যদি এই এসিডের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন সেই অবস্থাকেই আমরা পাকস্থলীর এসিডিটি বলি। এখন প্রশ্ন হলো, কখন এবং কী কী কারণে পাকস্থলীতে এসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়? নানা কারণে পাকস্থলীতে এসিডের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে (চিত্র ৭.০৮), যার মাঝে অন্যতম হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য। তোমরা নিজেরা কর করতে গিয়ে দেখেছ যে আমরা যেসব পানীয় আর ফলের রস পান করি, তার প্রায় সবই অম্লীয়। কাজেই এসব পানীর বেশি মাত্রায় পান করলে বা খালি পেটে পান করলে সেটা এসিডিটি সৃষ্টি করতে পারে। অন্যান্য পানীয়, বিশেষ করে মাত্রাতিরিক্ত চা, কফি- জাতীয় পানীয়গুলোও পাকস্থলীতে এসিডিটি বাড়ায়। বেশি ভাজা, তেলযুক্ত এবং চর্বিজাতীয় খাবারও পাকস্থলীতে এসিডিটি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ এবং অন্যান্য অতিরিক্ত মসলা দেওয়া খাবার, চকলেট— এগুলোও এসিডিটি তৈরির কারণ। খাদ্য ছাড়াও আরো কিছু কারণে এসিডিটি বেড়ে যেতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো দুশ্চিন্তা। নিয়মিত সময়মতো খাবার না খাওয়া, কিংবা প্রয়োজন মাফিক ঘুম না হলেও এসিডিটি হতে পারে। আবার কখনো কখনো ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণও এসিডিটির কারণ হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে উপযুক্ত খাদ্য নির্বাচন করে এসিডিটির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়?

প্রথমত: যেসব খাদ্যদ্রব্য বা পানীয়ের কারণে এসিডিটি হয়, সেগুলো অতিরিক্ত গ্রহণ না করে পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে সামরিকভাবে ঐ খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত: বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্য আছে যেগুলো কিছুটা ক্ষারধর্মী এবং ফলে এসিডিটি নিষ্ক্রিয় করতে পারে। ঐ সব খাদ্য গ্রহণ করে আমরা এসিডিটির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি। এসব খাদ্যের মধ্যে রয়েছে বেশির ভাগ শাকসবজি। যেমন: ব্রকলি, পুঁইশাক, পালংশাক, গাজর, শিম, বিট, লেটুসপাতা, মাশরুম, ভুট্টা, আলু, ফুলকপি ইত্যাদি।

আবার কিছু কিছু খাদ্যশস্য আছে (যেমন: ডাল, মিষ্টি ভুট্টা), যেগুলো এসিডিটি কমাতে সাহায্য করে। দুধজাতীয় খাবারের মধ্যে সম্মা মাখন, ছাগলের দুধ থেকে তৈরি করা মাখন, সয়া দুধ, বাদাম দুধ- এগুলোও ক্ষারধর্মী, যা এসিডিটি কমাতে পারে। নানা রকমের বাদাম, হারবাল চা, সবুজ চা, আদা চা খেয়েও অতিরিক্ত এসিড কমানো যায় ।

Content added || updated By

তোমরা জান, কোনো একটি পদার্থ এসিড, ক্ষার না নিরপেক্ষ তা নির্দেশক ব্যবহার করে জানা যায়। কিন্তু তাতে কী পরিমাণ এসিড বা ক্ষার আছে, সেটি কীভাবে বুঝা যাবে? সেটি বুঝা যায় pH এর মান পরিমাপ করে। তাহলে এবার আমরা এই pH দিয়ে কী বোঝায় তা জেনে নিই।

নিরপেক্ষ জলীয় প্রবণ বা বিশুদ্ধ পানি যেখানে কোনো এসিড বা ক্ষার থাকে না, তার pH হয় ৭। আর যদি এতে এসিড যোগ করা হয় তাহলে pH এর মান কমে যায়। যত বেশি এসিড যোগ করা যায়, pH এর মান ততই কমে যায়। পক্ষান্তরে যদি বিশুদ্ধ পানি বা নিরপেক্ষ জলীয় দ্রবণে ক্ষার যোগ করা হয়, তাহলে এর pH বাড়তে থাকে। যত বেশি ক্ষার যোগ করা হয়, pH এর মান ততই বাড়তে থাকে ।

চিত্র ৭.০৯: ইউনিভার্সাল নির্দেশক কালার চার্ট

সুতরাং বলা যায়:

কোনো দ্রবণের pH- ৭ হলে তা নিরপেক্ষ জলীয় দ্রবণ বা বিশুদ্ধ পানি হবে।কোনো দ্রবণের pH - ৭ হলে (৭ থেকে কম হলে) তা অগ্নীর বা এসিডীয় প্রবণ হবে। কোনো দ্রবণের pH > ৭ হলে (৭ থেকে বেশি হলে) তা ক্ষারীয় প্রবণ হবে। pH এর মান ৭ থেকে যত বেশি কম হবে, এসিডটি তত শক্তিশালী, আবার pH এর মান ৭ থেকে যত বেশি হবে, ক্ষারকত্বও তত বেশি শক্তিশালী হবে।থেকে শুরু করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী কৃষিকাজের ক্ষেত্রে এমনকি রাসায়নিক শিল্পে pH এর মান জানা এবং নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তোমরা কি জান আমাদের ধমনির রক্তের pH কত? আমাদের ধমনির রক্তের pH হলো প্রায় ৭.৪। অর্থাৎ এটি সামান্য ক্ষারধর্মী। এর সামান্য হেরফের হলে (±০.৪) মারাত্মক বিপর্যয়, এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে। আবার আমাদের জিহ্বার লালার pH-এর মান ৬.৬-এর কাছাকাছি থাকলে তখন তা সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে। আমাদের পাকস্থলীতে খাদ্য হজম করার জন্য দরকারি pH এর মান হলো ২। এটি যথেষ্ট শক্তিশালী এসিডের পরিমাণ, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই কারণ খাবার হজম করার জন্য আমাদের পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক এসিডের মতো শক্তিশালী এসিড থাকে। এই মান ০.৫-এর মতো হেরফের হলেই তা বদহজম সৃষ্টি করে। আমাদের প্রস্রাবের pH-এর মান ৭-এর কম থাকা স্বাভাবিক ।

মাটির pH সাধারণত ৪ থেকে ৮-এর ভেতর থাকে। অর্থাৎ এটি এসিডিক থেকে শুরু করে ক্ষারীয় হতে পারে। মাটির pH-এর মান ৩-এর কম অর্থাৎ বেশি অম্লীয় (Acidic) হলে মাটির অনেক দরকারি উপাদান যেমন: ক্যালসিয়াম (Ca), ম্যাগনেসিয়াম (Mg) মাটি থেকে চলে যায়। তার ফলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। এসিডিক মাটির জন্য ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম যুক্ত সার ব্যবহার করে pH এর মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অন্যদিকে মাটির খুব ক্ষারীয় হলে অর্থাৎ pH-এর মান ৯.৫-এর বেশি হলেও মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে Al- (অ্যালুমিনিয়াম আয়ন) সহজেই মাটি থেকে গাছের মূলে চলে যায় এবং এতে গাছের মারাত্মক ক্ষতি হয়। ক্ষারীয় মাটির জন্য নাইট্রেট ও ফসফেট-জাতীয় সার ব্যবহার করে pH-এর মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অতিরিক্ত এসিড বা ক্ষার অর্থাৎ pH খুব কমে গেলে বা বেড়ে গেলে মাটিতে থাকা উপকারী অনেক অণুজীব মারা যায়, ফলে গাছপালার স্বাভাবিক জৈবিক কার্যকলাপ ব্যাহত হয়।

বাজারে মুখ ধোয়ার জন্য যেসব প্রসাধন সামগ্রী পাওয়া যায়, তাতে লেখা থাকে pH এর মান ৫.৫, এর কারণ কী? এর কারণ আমাদের ত্বক সাধারণত এসিডিক হয় এবং এর pH ৪-৬ এর মধ্যে থাকে। তবে নবজন্ম নেওয়া শিশুদের ত্বকের pH-এর মান ৭ এর কাছাকাছি থাকে। তাই বড়দের জন্য যেসব প্রসাধনী ব্যবহৃত হয়, তা শিশুদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এতে শিশুদের ত্বকের ক্ষতি হতে পারে।

বিভিন্ন শিল্প রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় pH নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নানা রকম ঔষধ, কলমের কালি, বেকারিতে, লজেন্স জাতীয় মিষ্টি খাদ্যদ্রব্য, চামড়া প্রস্তুতি ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে pH এর মান নিয়ন্ত্রণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া আলোকচিত্র-সংক্রান্ত রাসায়নিক বিক্রিয়ায়, রং তৈরি ও ব্যবহারে, ধাতব পদার্থের ইলেকট্রোপ্লেটিং এরকম হাজারো ক্ষেত্রে pH এর মান নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করা হয়।

কোন মানের pH দ্রবণে কোন বর্ণ ধারণ করবে, তা বোঝার জন্য একটি চার্ট রয়েছে (চিত্র ৭.০৯)। একে ইউনিভার্সাল নির্দেশক কালার চার্ট বলে। কোনো দ্রবণে কয়েক ফোঁটা ইউনিভার্সাল নির্দেশক যোগ করলে দ্রবণ যে বর্ণ ধারণ করে, সেই বর্ণ ইউনিভার্সাল নির্দেশক কালার চার্টের বর্ণের সাথে মিলিয়ে দ্রবণের pH পরিমাপ করা হয়।

 

Content added By

৭.৩.১ ক্ষারকের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য

অষ্টম শ্রেণিতে তোমরা ক্ষারক ও ক্ষার কী তা জেনেছ। এখন এ অধ্যায়ে এদের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য জানা যাক।নির্দেশকের সাথে বিক্রিয়ার মাধ্যমে রং পরিবর্তন: তোমরা সবাই জান সকল ক্ষারক লাল লিটমাস কাগজের রং পরিবর্তন করে নীল করে। এছাড়া আরো কিছু নির্দেশক আছে, যেগুলো নিয়মিতভাবে পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত হয়। (যেমন- মিথাইল অরেঞ্জ, মিথাইল রেড, ফেনলফথেলিন) এগুলোও রং পরিবর্তন করে। টেবিল; ৭,০১ এ কোন ক্ষারক নির্দেশকের কী ধরনের রং পরিবর্তন করে তা দেখানো হলো।

টেবিল ৭.০১: ক্ষারক ও নির্দেশকের বিক্রিয়ার ফলে রং পরিবর্তন

নির্দেশক

নির্দেশকের রং

কমলা

ক্ষারকের ধারণকৃত রং

হলুদ

লাল লিটমাস কাগজ

মিথাইল অরেঞ্জ

মিথাইল ব্লেড

ফেনলফথেলিন

গোলাপি

পানিতে দ্রবণীয় ক্ষারক অর্থাৎ ক্ষারসমূহ পানিতে হাইড্রঅক্সাইড আয়ন (OH) উৎপন্ন করে।

NaOH → Nat KOH + OH K+ + OH

NHOH—) NHA + OH

ক্ষারক এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে লবণ উৎপন্ন করে। ক্ষারক ও এসিড পরস্পর বিপরীতধর্মী পদার্থ এবং বিক্রিয়া করে একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে নিরপেক্ষ পদার্থ লবণ ও পানি তৈরি করে। পরে তোমরা আরো বিস্তারিতভাবে এই বিক্রিয়া শিখৰে।

দলগত কাজ

কাজ: ক্ষারকের রাসায়নিক ধর্ম সম্পর্কে জানা (চিত্র 9.30 ) ।

অম্ল, ক্ষারক ও লবণের ব্যবহার

প্রয়োজনীয় উপকরণ: ক্ষারক (চুন বা Ca(OH)2), এসিড (ভিনেগার) এবং একটি নির্দেশক ( লাল লিটমাস কাগজ বা ফেনলফথেলিন), বিকার বা কাচের বোতল।

পদ্ধতি: বিকারে বা কাচের বোতলে ৫০ মিলিলিটার চুনের প্রবণ নাও। লাল লিটমাস কাগজ দ্রবণে ডুবাও। লিটমাস কাগজটি নীল হয়ে গেল, তাইতো? এতে প্রমাণিত হলো যে ক্ষারক লাল লিটমাসকে নীল করে। এবার ড্রপার দিয়ে আস্তে আস্তে ভিনেগার বিকারে নেওয়া Ca(OH), প্রবণ যোগ কর এবং নাড়াতে থাকো। নীল লিটমাস কাপজটি দ্রবণে ডুবিয়ে কোনো পরিবর্তন হয় কি না দেশ। প্রথম দিকে চিত্র ৭১০ : ক্ষারকের রাসায়নিক ধর্ম সম্পর্কে জানা দেখৰে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। কমপিত ভিনেগার যোগ করতে থাক আর লিটমাস কাগজ দিয়ে রং পরিবর্তন হয় কি না খেয়াল করো। এক পর্যায়ে দেখবে নীল লিটমাস কাগজের রং পরিবর্তিত হয়ে লাল হয়ে গেল। কেন এমন হলো? কারণ হলো, এসিড যোগ করাতে তা আস্তে আস্তে ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইডের সাথে বিক্রিয়া করছে। এভাবে যখন সমস্ত Ca(OH), বিক্রিয়া করে ফেলেছে, তখন এসিড যোগ করার ফলে দ্রবণটির এসিডিক হয়ে গেছে আর সে কারণেই নীল লিটমাস লাল হয়ে গেছে।

সাবান বার লাল লিটমাস পেপার সাবানেরক্ষারের প্রভাবে নীল হয়ে যাচ্ছে,

৭.৩.২ প্রাত্যহিক জীবনে ক্ষারের ব্যবহার ও সাবধানতা

তোমরা কি জান, মৌমাছি হুল ফুটালে বা পিঁপড়া কামড় দিলে জ্বলে কেন, ফুলে যায় কেন? কারণ হলো, পিঁপড়ার কামড়ের মাধ্যমে মূলত ফরমিক এসিড নিঃসৃত হয়, যা আমাদের শরীরে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে। আর মৌমাছি হুল ফুটালে ফরমিক এসিড, মেলিটিন (Melittin) এবং অ্যাপামিন (Apamin) নামক এসিডিক পদার্থ নিঃসৃত হয়, যার কারণে জ্বালাপোড়াও হয় আবার আক্রান্ত স্থান ফুলেও যায়।

চিত্র ৭.১১ : সাবানের ক্ষারকর পরীক্ষা

এখন প্রশ্ন হলো পিপড়া কামড়ালে বা মৌমাছি হুল ফুটালে করণীয় কী?

যেহেতু এসব ক্ষেত্রে জ্বালাপোড়ার কারণ হচ্ছে এসিড, তাই আমরা এসিডকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে এরকম মলম, লোশন (যেমন চুন) ব্যবহার করতে পারি। এরকম আরো একটি লোশন হলো ক্যালামিন (Calamine), যা মূলত জিংক কার্বোনেট (ZnCO3)। বেকিং সোডা ব্যবহার করেও ভালো ফল পাওয়া যায়।মাটির এসিডিটি দূর করতে ক্ষার: তোমরা আগেই জেনেছ, মাটিতে এসিডিটি বাড়লে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। তখন ক্ষারক ব্যবহার করে এসিডিটিকে প্রশমিত করা যায় এবং উর্বরতা ফিরিয়ে আনা যায়। এক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত ক্ষারক হলো চুন (CaO) এবং মিল্ক অব লাইম (Ca(OH)2)। অবশ্য এ কাজে চুনাপাথরও (CaCO3) ব্যবহার করা হয়।

বাসাবাড়িতে পরিষ্কারক হিসেবে প্রচুর পরিমাণে অ্যামোনিয়াম হাইড্রক্সাইড ব্যবহৃত হয়। টুথপেস্ট বা টুথ পাউডার আমাদের নিত্যদিনের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু, যা ক্ষারীয়। খাওয়ার পরে সাধারণত আমাদের মুখে এসিডীয় অবস্থা তৈরি হয়। আর টুথপেস্ট বা পাউডার দিয়ে ব্রাশ করলে একদিকে যেমন দাঁত পরিষ্কার হয়, অন্যদিকে তেমনি পেস্ট বা পাউডারের ক্ষার সৃষ্ট এসিডকে নিষ্ক্রিয় করে। ফলে দাঁতের ক্ষয় রোধ হয় ।

আবার থালা-বাসন পরিষ্কার করার জন্য যে শক্ত সাবান বা তরল সাবান ব্যবহার করা হয়, সেগুলোতেও ক্ষারক থাকে (চিত্র ৭.১১)। এমনকি আমরা যে কাপড় কাচার সাবান ব্যবহার করি, তা–ও তৈরি করা হয় সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ও চর্বি বা তেল থেকে। একইভাবে শেভিং ফোম বা নরম সাবান তৈরি করা হয় পটাশিয়াম হাইডোক্সাইড ও চর্বি বা তেল থেকে।

তোমরা জান যে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা বা এসিডিটির কারণে আমরা যে এন্টাসিড খাই তা হলো ম্যাগনেসিয়াম হাইড্রোক্সাইড (Mg(OH)2) ও অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রক্সাইড (Al(OH)3) নামের ক্ষার। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ক্ষারক বা ক্ষারসমূহ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক কাজে লাগে।ক্ষার ও ক্ষারক ব্যবহারে সাবধানতা: তোমরা নিজের হাতে কখনো নিজেদের জামাকাপড় পরিষ্কার করে দেখেছ কী ঘটে? একটু বেশি কাপড় একসাথে পরিষ্কার করলে দেখা যায়, হাতের তালু থেকে একটু একটু চামড়া উঠে যায়। এর জন্য দায়ী হলো সাবানে থাকা ক্ষার। এসিড যেমন মানুষের শরীরের ক্ষতি করতে পারে, তেমনি ক্ষারও শরীরের ক্ষতি করতে পারে। তাই শক্তিশালী ক্ষারীয় দ্রব্যাদি নিয়ে কাজ করার সময় হাতে রাবারের মোজা এবং গায়ে অ্যাপ্রোন পরা উচিত।

অম্ল, ক্ষারক ও লবণের ব্যবহার

৭.৩.৩ প্রশমন এবং এর প্রয়োজনীয়তা

পাকস্থলীর এসিডিটির জন্য পেটের ব্যথা হলে ম্যাগনেসিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড নামক এন্টাসিড খেলে ব্যথা সেরে যায় কেন? কারণ হলো, এসিডিটির জন্য দায়ী হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সাথে ম্যাগনেসিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইডের প্রশমন বিক্রিয়া ঘটে, যার ফলে অতিরিক্ত হাইড্রোক্লোরিক এসিড নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং ব্যথা আর থাকে না। বিক্রিয়াটি নিচে দেখানো হলো:

এসিড ক্ষার

+

→ লবণ

+ পানি

2HCl + Mg(OH)2 3HCl MgCl2 + 2H2O

+

Al(OH)3

AlCl3 + 3H20

আবার চুন (CaO) ও স্ল্যাক লাইম [Ca(OH)2] দিয়ে মাটির যে এসিডিটি দূর করে উর্বরতা বৃদ্ধি করা হয়, সেটিও হয় প্রশমন বিক্রিয়ার মাধ্যমে, যা নিচে দেখানো হলো:

ক্ষার + এসিড

লবণ +

পানি

CaO H2SO4 + CaSO4 + H2O Ca(OH)2 + H2SO4CaSO4 + 2H2O

তোমরা ইতোমধ্যেই জেনেছ, খাওয়ার পর আমাদের মুখে এসিড তৈরি হয় আর টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করলে এসিডের কারণে দাঁতের ক্ষয়রোধ হয়। এখানেও কিন্তু একধরনের প্রশমন বিক্রিয়াই ঘটে। টুথপেস্টের pH সাধারণত ৯-১১ এর মধ্যে হয় অর্থাৎ এরা ক্ষারীয় এবং এতে ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড, বেকিং সোডা, টেট্রাসোডিয়াম পাইরোফসফেট জাতীয় পদার্থ থাকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রশমন বিক্রিয়া আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

Content added || updated By

৭.৪.১ লবণের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য

এর আগে তোমরা জেনেছ যে লবণ হলো এসিড ও ক্ষারকের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন পদার্থ। এখন তোমরা এর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য জানবে। 

কাজ: লবণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে  আলোচনা কর

প্রয়োজনীয় উপকরণ: ১টি পাত্র, খাবার লবণ, বিশুদ্ধ পানি, লাল ও নীল লিটমাস কাগজ, নাড়ানি।

পদভিঃ পারে ৫-১০ গ্রাম লবণ নিয়ে ৫ মিলিলিটার বিশুদ্ধ পানি যোগ কর। নাড়ানি দিয়ে ভালোভাবে নাড়া দিয়ে লবণের প্রবণ তৈরি কর। এবার একে একে লাল ও লিটমাস কাগজ যোগ করে দেখ এদের রং পরিবর্তন হয় কি না ।

 

লিটমাস কাগজের রং কি পরিবর্তন হলো? না, হলো না। এতে প্রমাণিত হলো যে লৰণ নিরপেক্ষ পদার্থ। তবে কিছু কিছু লবণের জলীয় দ্রবণ অম্লীয় বা ক্ষারীয় হতে পারে। যেমন: বেকিং সোডা (NaHCO·) বা খাবার সোডা। এটিও একটি লবণ, কিন্তু এর জলীয় দ্রবণ এসিডিক এবং এটি নীল লিটমাসকে লাল করে। এর কারণ হলো, যদিও এটি একটি লবণ কিন্তু পানিতে এটি হাইড্রোজেন আয়ন উৎপন্ন করে।

NaHCO3 - → Na+ + H+ + CO3 2 -

আবার সোডিয়াম কার্বোনেটের (Na, CO) জলীয় দ্রবণ ক্ষারীয় এবং সেটি লাল লিটমাসকে নীল করে। এর কারণ হলো, পানিতে সোডিয়াম কার্বোনেট, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ও কার্বোনিক এসিড তৈরি করে।

Na2CO3- NaOH + H2CO3

কিন্তু উৎপন্ন কার্বোনিক এসিড দুর্বল এসিড হওয়ায় তা পুরোপুরি বিয়োজিত হয় না, আংশিকভাবে বিয়োজিত হয়। পক্ষান্তরে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড একটি শক্তিশালী ক্ষার বলে তা পুরোপুরি বিয়োজিত হয়ে হাইড্রোক্সাইড আয়ন তৈরি করে। ফলে দ্রবণে হাইড্রোক্সাইড আয়নের আধিক্য থাকে আর সে কারণেই দ্রবণটি ক্ষারীয় হয় এবং লাল লিটমাসকে নীল করে। কার্বোনেট লবলগুলো এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে অন্য একটি লবণ, কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ও পানি তৈরি করে। প্রায় সব লবণই কঠিন এবং গলনাংক ও স্ফুটনাংক তাপমাত্রা অনেক বেশি হয়। বেশির ভাগ লবণই পানিতে দ্রবণীয়, তবে কিছু কিছু লবণ আছে যারা পানিতে দ্রবীভূত হয় না। যেমন : ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (CaCO3), সিলভার সালফেট (Ag2SO4), সিলভার ক্লোরাইড (AgCl)।

কাজ: ডিমের খোসা মূলত CaCO3 এবং এসিড দিয়ে এটাকে প্রবীভূত করা সম্ভব। একটি ডিম ভিনেগারে ডুবিয়ে রাখো এবং মাঝে মাঝে পরিষ্কার করে নতুন ভিনেগার দাও। দেখবে ডিমের শক্ত খোসা দ্রবীভূত হয়ে নরম তুলতুলে একটি ডিমে পরিণত হয়েছে।

৭.৪.২ লবণের ব্যবহার

লবণের ব্যবহারের কথা বলা হলে সবার আগে আমাদের খাবারের কথা চলে আসে। আমরা আমাদের খাবারে সব সময় লবণ ব্যবহার করি। লবণ ছাড়া তরকারি রান্না করলে সেটি ম্যাদহীন হবে এবং আমরা অনেকেই তা খেতে পারব না। যে লবণ আমাদের খাদ্যের স্বাদ বাড়িয়ে খাওয়ার উপযোগী করে তোলে, তা হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl), যা সাধরণ লবণ বা টেবিল লবণ নামেও পরিচিত। তরকারি ছাড়াও আরো অনেক খাবার, যেমন: পাউরুটি, আচার, চানাচুর ইত্যাদিতে খাবার লবণ ব্যবহার করা হয়। খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করার জন্য আরেকটি লবণ— সোডিয়াম গ্লুটামেট ব্যবহার করা হয়, যেটি 'টেস্টিং সল্ট' নামে পরিচিত।

আমরা কাপড় কাচার যে সাবান ব্যবহার করি তা হলো মূলত সোডিয়াম স্টিয়ারেট (C17H35COONa) আর শেভিং ফোম বা জেলে থাকে পটাশিয়াম স্টিয়ারেট (C17H35COOK)। কাপড় কাচার সোডা হিসেবে জামরা যে সোডিয়াম কার্বোনেট (Na2CO3) ব্যবহার করি তাও একটি লবণ। আবার আমরা জীবাণুনাশক হিসেবে যে তুঁতে (CuSO4.5H2O) বা ফিটকিরি [K2SO4. Al2(SO4)3.24H2O] ব্যবহার করি, সেগুলোও লবন ।

কৃষিতে লবণের ব্যবহার

তোমরা জান যে মাটির এসিডিটি নিষ্ক্রিয় করার জন্য আমরা যে চুনাপাথর ব্যবহার করি, এই চুনাপাথর একটি লবণ। আবার আমরা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য যে সার ব্যবহার করে থাকি, তাদের বেশির ভাগই হলো লৰণ। যেমন: অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট (NH 4 NO3), অ্যামোনিয়াম ফসফেট ((NH4)3PO4), পটাশিয়াম নাইট্রেট (KNO3) ইত্যাদি।তুঁতে বা কপার সালফেট (CuSO4) কৃষিজমিতে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রতিরোধে বহুল ব্যবহৃত একটি লবণ। এটি শৈবালের উৎপাদন বন্ধে খুব কার্যকরী।

শিল্প-কারখানায় লবণ

শিল্প-কারখানার নানা কাজে খাবার লবণ অপরিহার্য। যেমন: চামড়াশিল্পে চামড়ার ট্যানিং করতে, মাখন ও পনিরের শিল্পোৎপাদনে, কাপড় কাচার সোডা ও খাবার সোডা তৈরি করতে, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণ ইত্যাদি কাজে খাবার লবণ ব্যবহৃত হয়। বেশ কিছু লৰণ যেমন: হুঁতে (CuSO4), মারকিউরিক সালফেট (HgSO4), সিলভার সালফেট (Ag2SO4) শিল্প-কারখানায় প্ৰভাৰক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

টেক্সটাইল ও রং তৈরির কারখানার রং ফিক্স করার কাজে লবণ প্রয়োজন হয়। ধাতুর বিশুদ্ধকরণে লবণ লাগে। রাবার প্রস্তুতিতে লবণ ব্যবহার করে রাবারকে (ল্যাটেক্স) রাবার গাছের নির্যাস থেকে আলাদা করা হয়। ঔষধ কারখানায় স্যালাইন এবং অন্যান্য ঔষধেও লবণ ব্যবহৃত হয়। ডিটারেন্ট তৈরিতেও ফিলার হিসেবে লবণ খুবই প্রয়োজনীয়।কাজেই দেখা যাচ্ছে যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কৃষিতে, শিল্প-কারখানায় লবণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।না,

দলগত কাজ

কাজ: ধাতু ও এসিড থেকে লবণ তৈরি (চিত্র ৭.১৩)।

এই পরীক্ষাটি তোমাদের স্কুলের ল্যাবরেটরিতে শিক্ষকের উপস্থিতিতে করা বাঞ্ছনীয়।প্রয়োজনীয় উপকরণ: একটি ধাতু (যেমন: Mg), পাতলা হাইড্রোক্লোরিক এসিড, একটি বিকার, চামচ, ফানেল, ১টি পাত্র, ত্রিপদী স্ট্যান্ড, স্পিরিট ল্যাম্প বা বার্নার, অ্যাপ্রোন ।

পদ্ধতি: অ্যাপ্রোন পরে নাও। বিকারে ৫০ মিলিলিটার পাতলা হাইড্রোক্লোরিক এসিড নাও। এবার ৫-১০ গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম রিবন (সরু ভার) বা ভার গুঁড়া চামচ দিয়ে বিকারে যোগ করে। কোনো বুদবুদ উঠছে কি? না উঠলে হালকা তাপ দাও। দেখবে বুদবুদ উঠতে শুরু করবে। বুদবুদ উঠা শেষ হলে আরো কিছু ম্যাগনেসিয়াম যোগ কর। তাপ দেয়ার পরও বুদবুদ না উঠলে বুঝতে হবে এসিড পুরোপুরি বিক্রিয়া করে ফেলেছে এবং আর কোনো এসিড বিকারে অবশিষ্ট নেই। এভাবে সমস্ত এসিড বিক্রিয়া না করা পর্যন্ত অল্প অল্প করে ম্যাগনেসিয়াম রিবন (সরু তার) বা গুঁড়া যোগ করতে থাক। এবারে ফানেল ও ফিল্টার কাগজের সাহায্যে অতিরি ম্যাগনেসিয়াম মিশ্রণ থেকে আলাদা কর। প্রাপ্ত দ্রবণকে ত্রিপদী স্ট্যান্ডের উপর বসিয়ে স্পিরিট ল্যাম্প দিয়ে তাপ দিতে থাক, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাত্রের পায়ে লবণের ছোট ছোট দানা দেখা যায়। এবাবে তাপ দেওয়া বন্ধ করে পাত্রটিকে ঠাণ্ডা কর। পাত্রের তলায় বা গায়ে দানাদার বস্তু কী পেয়েছ? এটি হলো ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড লবণ। এখানে ম্যাগনেসিয়াম হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে MgCl2 ও H2 গ্যাস উৎপন্ন করেছে। এই হাইড্রোজেন গ্যাসের কারণেই আমরা বিকার থেকে বুদবুদ উঠতে দেখি। MgCl2 পানিতে দ্রবীভূত ছিল পানি বাষ্পীভূত করে আমরা লবণটি আলাদা করতে পেরেছি।

Content added || updated By