নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

নবম অধ্যায়

পিতার সম্মুখে

 

আজকাল কোনো কোনো যুবক-যুবতী মনে করে: “প্রার্থনা করে কী লাভ?” “প্রার্থনা করা মানে সময় নষ্ট করা” “প্রার্থনা হলো কতগুলো বুলি আওড়ানো ।” তাই কেউ কেউ প্রার্থনা করতে কোনো আগ্রহ বোধ করে না, উপাসনালয়ে যেতে চায় না । কেউ কেউ আবার তাচ্ছিল্যের সাথে এমনটিও বলে: “সত্যিই কি ঈশ্বর আছেন?” “সত্যিই কি স্বর্গ-নরক আছে?” রাশিয়ার নভোচারী গ্যাগারিনও রকেটে আকাশ ঘুরে এসে বলেছিলেন; “কোথাও ঈশ্বর নেই ।” অনেক যুবক-যুবতী গির্জা-প্রার্থনায় না গিয়ে বরং বন্ধুদের সাথে গল্প- গুজব করতে এবং ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে ।

কিন্তু তারা যদি এই নিয়ে একটু গভীরভাবে চিন্তা করত: এই জীবনের উৎস কোথায়, কে আমাদের সৃষ্টি করেছেন, কোথায় আমরা যাব, কীভাবে সৃষ্টিকর্তাকে দেখা যায়, কোথায় তাঁকে পাওয়া যায় ইত্যাদি, তবে তাদের মন আলোকিত হতো । প্রার্থনার মধ্যেই এসব অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। বিশ্বাসপূর্ণ প্রার্থনা আমাদেরকে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যায়, তাঁর সাথে আমাদেরকে এক করে তোলে।

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-

• প্রার্থনার ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব;

• প্রার্থনার মাধ্যমে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব;

• ঈশ্বরের কথা শুনতে পাওয়ার উপায় বর্ণনা করতে পারব;

• প্রার্থনা করার বিভিন্ন পদ্ধতি বর্ণনা করতে পারব এবং

• নিয়মিত প্রার্থনায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবো ।

প্ৰাৰ্থনা

সাধারণ অর্থে প্রার্থনা হলো কিছু চাওয়া, যাচনা করা, মিনতি করা, ভিক্ষা করা, কোনো কিছুর জন্যে আবেদন করা বা আকুতি-মিনতি জানানো । আর আমরা প্রার্থনার সময় ঈশ্বরের কাছে অনেক কিছুই চেয়ে থাকি, যাচনা করি, তাঁর কাছে আবেদন জানাই । কিন্তু আমাদের প্রার্থনা শুধু এই 'যাচনা'-র পর্যায়ে সীমিত রাখা মোটেও ঠিক নয় । প্রার্থনার আরেকটি মহৎ দিক রয়েছে যা চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে অনেক বড় । প্ৰাৰ্থনা যদি শুধু ঈশ্বরের কাছে চাওয়া এবং পাওয়ার ব্যাপার হয় তখন আমি নিজেকে ভিক্ষুকের সম-পর্যায়ে নিয়ে আসি, ভিক্ষুক ও আমার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না । কেননা একজন ভিক্ষুক বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন মানুষের কাছে শুধু ভিক্ষা চাইতে থাকে । ভিক্ষা পেলে সে খুশি হয়, কিন্তু যখন ভিক্ষা চেয়ে পায় না, তখন সে অসুখী হয় । ঈশ্বরের কাছে আমাদের প্রার্থনা এরূপ চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার হলে আমাদের আচরণও ভিক্ষুকের মতো হতে পারে । অর্থাৎ আমরা তুচ্ছ ভিক্ষুক হয়ে যেতে পারি ।

প্রার্থনা হলো ঈশ্বরের সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপন, তাঁর পুণ্য উপস্থিতি অন্তরে অনুভব করা এবং বাস্তব জীবনে তাঁর প্রকাশ তুলে ধরা। অন্য কথায় বলা যেতে পারে, প্রার্থনা হলো ঈশ্বরের উপস্থিতিতে বাস করা বা

 

 

তাঁর উপস্থিতি জীবনে উপলব্ধি করা । তাই প্রার্থনা হলো ঈশ্বরের এক প্রেমময় সম্পর্কের ব্যাপার, যা চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে । আমরা ঈশ্বরের প্রিয় সন্তান, ভিক্ষুক নই । প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা প্রেমময় ঈশ্বরের সাথে আমাদের প্রেমের সম্পর্ক গভীর করি । আর তাঁর সাথে আমাদের মধুর সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রার্থনায় আমরা তাঁর প্রতি প্রশংসা, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং আমাদের প্রয়োজনের কথা জ্ঞাপন করি ।

প্রার্থনার গুরুত্ব

“প্রার্থনা করে কী লাভ হয়?” এই প্রশ্নের সহজ উত্তর বোধ হয় আরও দুইটি প্রশ্নের মাধ্যমে এভাবে দেওয়া যেতে পারে: “খাবার খেলে কী লাভ হয়?” বা, “মানুষ খায় কেন?” এই দুইটি প্রশ্নের উত্তরে আমরা অবশ্যই বলব, মানুষকে বেঁচে থাকার তাগিদেই খাবার খেতে হয় । এর উত্তরে বলব, খাবার ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না, তাই তাকে খেতে হয় ।

খাবার বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে । শরীরের বিভিন্ন রকম প্রয়োজনের জন্যে মানুষকে বিভিন্ন ধরনের খাবার খেতে হয় । কিন্তু মানুষের জীবনটা শুধু দেহ বা শরীর নিয়ে গঠিত নয়, দেহ ছাড়াও রয়েছে মন ও আত্মা বা হৃদয় । কাজেই দেহকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে খাবারের প্রয়োজন । কেননা শুধু দৈহিক খাবার খেয়ে হৃদয়- মনকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না । অনেক মানুষ রয়েছে যারা পেট ভরে খাওয়া সত্ত্বেও অসুখী, মুখে হাসি নেই, মনোকষ্টে ভুগছে, দুশ্চিন্তা-হতাশায় ভুগছে । তাদেরই কেউ কেউ আবার চুরি-ডাকাতি করছে, ঘুষ খাচ্ছে, নানান অন্যায় কাজ করছে । কাজেই শুধু দৈহিক খাবার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না, তাকে প্রকৃত অর্থে সুখী করতে পারে না ।

ঈশ্বরই আমাদের প্রকৃত খাদ্য যিনি আমাদের দেহ, মন ও আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখেন । তাঁকে ছাড়া আমরা বেঁচে থাকতে পারি না । তাই যীশু বলেন, “মানুষ কেবল রুটি (দৈহিক খাদ্য) খেয়েই বেঁচে থাকতে পারে না, বরং ঈশ্বরের বাণীকে খাদ্যরূপে গ্রহণ করেই সে বেঁচে থাকতে পারে” (মথি ৪:৮)। প্রার্থনা ও প্রভুর ভোজ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আমাদের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঈশ্বরকে সুস্বাদু খাদ্যরূপে গ্রহণ করি, তাঁর সাথে এক হই এবং তাঁর জীবনকে উপলব্ধি করি । প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরের মধ্যে প্রবেশ করি এবং তাঁকে আমাদের অন্তরে প্রবেশ করতে দেই ।

প্রার্থনার জীবন ছাড়া কোন মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে না । প্রার্থনা হলো জীবনের চালিকাশক্তি । বিশ্বাসপূর্ণ প্রার্থনা আমাদের ঈশ্বরের সাথে যুক্ত করে । কাজেই, প্রার্থনাবিহীন জীবন বা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসহীন জীবন মৃত, নিষ্প্রাণ । যে সব মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তাঁকে ডাকে না, তাঁর কাছে প্রার্থনা করে না, তারা অনেক সময় অসুখী, তারা হতাশা-নিরাশায় ভোগে । অনেক সময় তারা অনৈতিক ও অসুন্দর জীবনযাপন করে নিজেকে কলুষিত করে । অন্য দিকে, প্রার্থনা মানুষের জীবনকে সুন্দর করে, জীবনকে পবিত্র করে । প্রার্থনাশীল জীবন মানুষকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যায়, একেক জনকে সাধু-সাধ্বীর ন্যায় হতে সাহায্য করে ।

 

 

ঈশ্বরের উপস্থিতি

প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরের উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হই ও তাঁর সাক্ষাতে উপস্থিত হই । ঈশ্বর যদিও সবসময় আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন, আমরা কিন্তু তা সবসময় উপলব্ধি করি না। এটি যেন আমদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো । আমরা অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারি না, তাই প্রতিনিয়ত আমরা বাতাসের সাথে অক্সিজেন গ্রহণ করে চলছি । আমরা সব সময় এই বিষয়ে সচেতন থাকি না । বরং আমরা অবচেতন মনেই এই অক্সিজেন বা প্রাণবায়ু গ্রহণ করে চলছি ।

যখন একটু সচেতন হই, মাত্র তখনই আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, এই অক্সিজেন শ্বাসের সাথে গ্রহণ না করলে আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে নির্ঘাত মারা যাবো । জলে বিচরণকারী মাছের দিকে তাকালে লক্ষ করা যায় যে, যখন মাছ ডাঙ্গায় তোলা হয় তখন সেগুলো বাঁচার তাগিদে জলে ঝাপিয়ে পড়ার জন্যে কী লাফালাফিই না করে । অথচ যখন জলের ভিতর ছিল, তখন এই জীবনদায়ী জলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা হয়তোবা ততখানি উপলব্ধি করেনি ।

ঠিক তেমনিভাবে আমরাও ঐশ-জীবনের মধ্যে ডুবে আছি, তাঁর জীবন-জল পান করে বেঁচে আছি। কিন্তু আমরা তা সব সময় উপলব্ধি করি না । যখন আমরা শান্ত মন নিয়ে নিরবে বসি এবং প্রার্থনায় প্রবেশ করি, তখন আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করি যে, আমরা তাঁর প্রেমময় উপস্থিতির মধ্যে রয়েছি । ঈশ্বর যেন অসীম এক জীবন-সমুদ্র, আর আমরা সবাই, ধনী-গরিব, পাপী-ধার্মিক সবাই তাঁর জীবন-জল পান করে চলেছি আর বেঁচে রয়েছি। এই জীবন-সমুদ্রেই আমাদের জীবন, অর্থাৎ ঈশ্বরের মধ্যেই আমাদের জীবন । জলের বাইরে যেমন মাছ বাঁচতে পারে না, ঠিক তেমনিভাবে ঈশ্বরকে ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না । প্রার্থনার মধ্য দিয়েই আমরা ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করি, তাঁর সাক্ষাতে উপস্থিত হই, তাঁর প্রেম, শান্তি ও পবিত্রতা উপলদ্ধি করি, যে ব্যক্তি প্রার্থনায় ও ধ্যানে যত বেশি তাঁর উপস্থিতি উপলব্ধি করে, সে তত বেশি তাঁর পবিত্রতা, প্রেম, শান্তি ও আনন্দ উপলব্ধি করে ।

ঈশ্বরের কথা শোনা

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মাদার তেরেজা (মাদার হওয়ার পূর্বে) যখন ট্রেনে চড়ে প্রার্থনা করতে করতে দার্জিলিং যাচ্ছিলেন, তখন তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন একটি কন্ঠস্বর: “সব কিছু ছেড়ে আস।” কয়েকবার স্পষ্ট তা শুনতে পেলেন এই কন্ঠস্বর । হ্যাঁ, এ তো ঈশ্বরেরই কন্ঠস্বর । ঈশ্বর তাঁকে বলছেন তাঁর লরেটো ধর্ম-সংঘ ছেড়ে নতুন এক অজানা জীবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে । এ যেন আব্রাহামের মতো ঈশ্বরের আদেশে ঊর দেশ ছেড়ে এক অজানা নতুন এক দেশের দিকে যাত্রা । শুধু আব্রাহাম ও মাদার তেরেজা নন, ইতিহাসে আরো অনেক মানুষ খুঁজে পাব যারা নানাভাবে ঈশ্বরের কন্ঠস্বর শুনেছেন এবং সেই মতো সাড়াও দিয়েছেন। সাধু পিতর এক দিন ছাদে প্রার্থনা করার সময় এমনি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছিলেন যে, একটা বড় চাদরের চার কোণ ধরে কারা যেন যত রকমের প্রাণী, যা ছিল ইহুদিদের কাছে ‘অশুচি,’ তা-ই তাঁর সামনে নামিয়ে দিচ্ছে আর বলছে, “পিতর, ওঠ, ওদের মেরে ফেল, আর খাও” (প্রেরিত ১০:১০-১৬)। এই অদ্ভুত দর্শনের মধ্য দিয়ে পিতরের কাছে প্রকাশ করা হয়েছিল যে, যীশু শুধু ইহুদি জাতির জন্যে নয়, বরং ইহুদিরা যাদেরকে

 

 

 

‘অশুচি’ মনে করে, সেই বিজাতি ও পৌত্তলিকদের জন্যেও যীশু এসেছেন । কেননা তিনি সকল জাতির

এবং সকল মানুষের মুক্তিদাতা; শুধু মাত্র ইহুদিদের জন্যে নন । কীভাবে ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে কথা বলেন

আমরা বিভিন্নভাবে ঈশ্বরের কথা শুনতে পারি :

১. নীরবে প্রার্থনা ও ধ্যানে বসে আমরা তাঁর কথা শুনতে পাই । ২. পবিত্র শাস্ত্রের বাণী পাঠ ও ধ্যান করে তাঁর কথা শুনতে পাই ৷

৩. সৎ বিবেক হলো ঈশ্বরের কন্ঠস্বর । তাই আমাদের সুন্দর বিবেকের মধ্য দিয়ে আমরা তাঁর কথা

শুনতে পাই ।

৪. গুরুজন ও সৎ বন্ধুদের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর আমাদের কাছে কথা বলেন । যখন আমি গুরুজনদের

সু-পরামর্শ শুনি, তখন আমি ঈশ্বরের কন্ঠ শুনতে পাই ।

৫. বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়েও ঈশ্বর আমাদের কাছে কথা বলেন । ধরি, প্রতিবেশীর কোন ঘরে আগুন লাগল, বা কেউ গাড়ি চাপা পড়ে দুর্ঘটনায় পড়ল । তাদের জন্য কিছু একটা করার জন্যে আমি অন্তরে তাড়না অনুভব করি এবং সাহায্য করতে এগিয়ে যাই। এ তো ঈশ্বরেরই কন্ঠস্বর, যা আমাকে অন্যের বিপদে সাহায্য করতে তাড়না দিচ্ছে ।

৬. মণ্ডলীর নেতৃবর্গ যেমন পোপ, বিশপ, পালক, প্রচারক, পুরোহিত, ব্রাদার, সিস্টার, প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের মধ্য দিয়েও ঈশ্বর আমাদের কাছে কথা বলেন, বিশেষভাবে তাঁরা যখন শাস্ত্র-বাণীর অর্থ আমাদের কাছে তুলে ধরেন এবং সুন্দর পরামর্শ দান করেন ।

যীশু বলেন, যার কান আছে সে শুনুক । এর অর্থ হচ্ছে, ঈশ্বর অবিরত আমাদের জন্য কথা বলছেন । যদি তাঁর কথা শোনার মতো আমাদের ইচ্ছা বা আগ্রহ থাকে তবেই আমরা তা শুনতে পাব ।

প্রার্থনার বিভিন্ন পদ্ধতি

আমরা যে-সব প্রার্থনা করি তা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে । একই ব্যক্তি স্থান-কাল-অবস্থা ভেদে বিভিন্ন রকমের প্রার্থনা করতে পারে । নিম্নে বিভিন্ন ধরনের প্রার্থনা তুলে ধরা হলো ।

১. প্রশংসামূলক প্রার্থনা

সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি ধ্যান করে, তাঁর মহত্ত্ব ধ্যান করে আমরা এরূপ প্রার্থনা করতে পারি। ‘প্রভুর প্রার্থনা'-র প্রথম অংশে যীশু নিজে পিতা ঈশ্বরের প্রশংসা করেছেন, পিতার অপূর্ব প্রেমের জন্যে তাঁর মাহাত্ম ঘোষণা করেছেন । পবিত্র বাইবেলের সামসংগীতের অনেকগুলো প্রার্থনাই ঈশ্বরের প্রশংসামূলক কথা দ্বারা রচিত । সামসংগীত ১০০, ১১১, ১১৩, ১৪৫, ১৪৬, ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯ ও ১৫০ আমরা পাঠ করতে পারি।

ঈশ্বরের প্রশংসা করে আমরা কখনো বা গান করি :

“জয় প্রভু তোমারি জয়

তুমি আমাদের ভালোবাস...... ॥”

 

 

২. কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদমূলক প্রার্থনা

আমরা ঈশ্বরের অসীম ভালোবাসা, দয়া ও নানা আশীর্বাদ পেয়ে তাঁকে আমাদের হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে প্রার্থনা করে থাকি । যেমন, রোগ থেকে সুস্থ হয়ে, বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে, পরীক্ষায় ভালো পাশ করে, ভালো চাকরি পেয়ে ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে থাকি এবং আনন্দে গান করি :

“সকল ধন্যবাদ, মহিমা, গৌরব তোমার, জয় হোক, জয় হোক যীশু, জয় হোক তোমার..... | দয়ার উপর দয়া কত পেয়েছি তোমার, জয় হোক, জয় হোক যীশু, জয় হোক তোমার..... । ।”

ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে পবিত্র বাইবেলের সামসঙ্গীতে এ ধরনের অনেক প্রার্থনা রয়েছে । আমরা সামসঙ্গীত ১৩৮ এক সঙ্গে পাঠ করতে পারি ।

ওগো ঈশ্বর, মনপ্রাণ দিয়ে গাইব তোমার স্তুতি : আমার মিনতি ফিরিয়ে দাওনি তুমি! সকল স্বর্গদূতের সামনে এই সামগান তোমায় শোনাব আমি । তোমার পুণ্য মন্দির পানে মাথা নিচু করে প্রণাম জানাব আমি, এবং তোমার বিশ্বস্ততা, তোমার দয়ার জন্যে গাইব তোমার নামেরই স্তুতিগান । তোমার নামটি, তোমার অঙ্গীকার করেছ মহান সব-কিছুর চেয়ে । যখনই ডেকেছি, তুমি তো দিয়েছ সাড়া; নতুন শক্তি দিয়েছ আমার প্রাণে ওগো ঈশ্বর, তোমার প্রতিটি অঙ্গীকারের জন্যে এই পৃথিবীর সমস্ত রাজা গাইবে তোমার স্তুতি । তারা তো তোমার কর্মনীতির গাইবেই গুণগান তারা তো বলবে: “আহা, ঈশ্বর কত না মহিমময় ঊর্ধ্বলোকেই যদিও তাঁর আসন বিনম্র দীন যত মানুষকে দেখেই থাকেন তিনি; অত দূর থেকে গর্বিতদের চিনেও ফেলেন তিনি । যখন আমায় পড়তেই হয় বাধাবিপদের মুখে, তুমিই তখন বাঁচাও আমার প্রাণ; আমার ক্রুদ্ধ শত্রুর গতি রুদ্ধ করতে তুমি তো বাড়াও হাত; নিজ বাহুবলে তুমিই তখন আমায় রক্ষা কর! জানি, ঈশ্বর আমার জন্যে যা-কিছু করতে চান, সবই তো তিনি করবেন সমাপন;

 

 

ওগো ঈশ্বর, তোমার করুণা চিরকালেরই করুণা । নিজের হাতেই সৃষ্টি করেছ যাকে, তাকে একা রেখে দূরে যেয়ো না কো তুমি!

৩. অনুনয়মূলক বা আবেদনমূলক প্রার্থনা

ঈশ্বরের কাছে আমাদের আবেদনের শেষ নেই। কত কিছুর জন্যে, কত কারণেই না আমরা তাঁর কাছে আমাদের নানান আবেদন, আমাদের চাওয়া-পাওয়ার কথা জানিয়ে থাকি । আমরা অসুস্থতাকালে সুস্থতা লাভের জন্য প্রার্থনা করি, বিপদে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করি । পরীক্ষায় ভালো ফল, ভালো চাকরি, ভালো স্বাস্থ্য, সুন্দর ভবিষ্যৎ ইত্যাদি কত কিছুর জন্যেই না আমরা ঈশ্বরের কাছে আবেদন জানিয়ে থাকি । প্রভুর প্রার্থনার দ্বিতীয় অংশে যীশু নিজেই আমাদের সমস্ত আবেদন পিতার কাছে তুলে ধরতে শিখিয়েছেন ।

কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে, “ঈশ্বর তো আমাদের সব প্রয়োজনের কথা জানেন । তাহলে তাঁর কাছে চাওয়ার আবার কী প্রয়োজন রয়েছে?” হ্যাঁ, ঈশ্বর অবশ্যই আমাদের প্রয়োজনের কথা জানেন । কিন্তু আমি যে তা পেতে চাই, কোন কিছু যাচ্‌নার মধ্য দিয়ে তা-ই আমি তাঁর কাছে তুলে ধরি। যীশু নিজেই বলেছেন: “তোমরা চাও, তোমাদের দেওয়া হবে; খোঁজ, তোমরা খুঁজে পাবে; দরজায় ঘা দাও, তোমাদের জন্যে দরজাটি খুলে দেওয়া হবে । কেননা যে চায়, সে পায়; যে খোঁজে, সে খুঁজে পায়; যে দরজায় ঘা দেয়, তার জন্যে দরজাটি খুলে দেওয়া হয়” (মথি ৭:৭-৮)।

৪. অনুতাপমূলক প্রার্থনা

মানুষ হিসেবে আমরা সবাই দুর্বল। তাই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, জ্ঞানে-অজ্ঞানে আমাদের নানা ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে । ঈশ্বরের সাথে এবং অন্য মানুষের সাথে আমাদের ভালোবাসার সম্পর্ক রক্ষা করতে অনেক সময় ব্যর্থ হই । কাজেই, আমাদের নানা ভুল-ত্রুটির জন্যে আমরা অনুতপ্ত হই ও অনুশোচনা বোধ করি । সামসংগীত ৫১ অনুতাপের একটি সুন্দর আদর্শ প্রার্থনা । আমরা একসাথে সামসংগীতটির কিছু অংশ পাঠ করি:

আমার প্রতি সদয় হও, ওগো ঈশ্বর, তোমার করুণাগুণে;

তোমার অসীম কৃপায়, ওগো, মুছে ফেল তুমি আমার সকল দোষ । তুমি আমার সেই অপরাধ ধুয়ে ফেল নিঃশেষে; আমার পাপের কালিমা থেকে নির্মল কর আমায় । আমার দোষ, আমার ত্রুটি স্বীকার করি আমি; আমার সেই পাপের কথা স্মরণে আমার রয়েছে অনুক্ষণ । তোমারই কাছে পাপ করেছি আমি । তোমারই চোখে যা অন্যায়, তাই করেছি আমি । তুমিও তাই রায়বিধানে সত্যি ধর্মময়, দণ্ডবিধানে সত্যিই ত্রুটিহীন! তুমি তো জানোই, অপরাধ নিয়ে জন্মেছিলাম আমি; পাপ নিয়েই তো মায়ের গর্ভে সেদিন এসেছি আমি ।

 

 

 

ওগো, তুমি তো চাও, সত্যময় হয়ে উঠুক মানুষের অন্তর;

জ্ঞানের বাণী হৃদয়-গোপনে তাই তো শোনাও তুমি । ওগো, হিসোপ দিয়ে অভিসিঞ্চিত করে আমাকে এবার পাপমুক্তই কর: নির্মল হবো আমি । আমাকে ধৌত কর: তুষারের চেয়ে শুভ্র হবো যে আমি! আমার প্রাণে বাজতে দাও আবার সেই পুলক-ভরা আনন্দেরই সুর । তোমার হাতে চূর্ণ আমার দেহের অস্থিগুলি, আহা, নাচুক মহোল্লাসে! আমার কোন পাপের দিকে তাকিয়ে দেখো না আর: মুখ ফিরিয়েই নাও; ওগো, আমার সব অপরাধ মুছে দিয়ে যাও তুমি !

এক সঙ্গে ধ্যান করি

প্রার্থনা আমাদের আত্মার খাদ্য ও পানীয়; তা আমাদের প্রাণের ক্ষুধা ও তৃষ্ণা মিটায় । প্রার্থনা আমাদের প্রাণে আনে পরম প্রশান্তি ও হৃদয়ে জাগায় আনন্দ । আর এই শান্তি ও আনন্দ আসে স্বয়ং ঈশ্বরেরই কাছ থেকে । প্রার্থনাই আমাদেরকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যায়; প্রার্থনার মধ্য দিয়েই আমরা তাঁকে দেখি ও তাঁর বাণী শুনি ।

কাজ: পাঁচ মিনিটের জন্য নীরব ধ্যানে বস এবং ঈশ্বরের উপস্থিতি তোমার জীবনে উপলব্ধি কর ।

 

 

অনুশীলনী

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. কোন সাম সংগীতে অনুতাপের কথা বলা হয়েছে ?

ক. সাম ৫১

খ. সাম ১৩৮

গ. সাম ১৪৮

ঘ. সাম ১৫0

প্রার্থনাকে আত্মার খাদ্য বলা হয়েছে, কারণ -

i. প্রাণের ক্ষুধাও তৃষ্ণা মিটায়

ii. প্রাণে আনে পরম শান্তি

iii. হৃদয়ে জাগায় আনন্দ

নিচের কোনটি সঠিক ?

খ. ii ও iii

ঘ. i, ii ও iii

ক. i ও ii

গ. i ও iii

নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪নং প্রশ্নের উত্তর দাও :

একজন ভিক্ষুক প্রতিদিন অনলের কাছে টাকার জন্য হাত পাতে । অনল তাকে বলে, 'ভিক্ষা না করে ঈশ্বরকে ডাক ও কাজ কর, দেখবে মন ভালো থাকবে ও সুখী জীবন যাপন করতে পারবে ।' ভিক্ষুক প্রতিদিন ঈশ্বরকে স্মরণ করে, কাজ করে এবং তার জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে । ফর্মা-১২, খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, ৯ম-১০ম শ্রেণি

 

৩. ভিক্ষুক তার জীবনে কিসের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে ?

ক. সুখের

খ. ধনের

গ. সম্মানের

ঘ. প্রার্থনার

৪. ভিক্ষুক তার কাজের ফলে লাভ করবে

i. স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন

ii. পবিত্র জীবন

iii. ধনাঢ্য জীবন

নিচের কোনটি সঠিক ?

ক. i ও ii

খ. ii ও iii

গ. i ও iii

ঘ. i, ii ও iii

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১ . কীভাবে মানুষ প্রার্থনায় ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শোনে ?

২. প্রার্থনা হলো ঈশ্বরের উপস্থিতিতে বসবাস – বর্ণনা কর ।

৩. প্রশংসামূলক প্রার্থনা বলতে কী বুঝ ?

৪ . মানুষের জীবনে প্রার্থনা গুরুত্বপূর্ণ কেন ?

৫. ঈশ্বর কীভাবে মানুষের সাথে কথা বলেন ?

সৃজনশীল প্রশ্ন – ১

দৃশ্যকল্প-১

আন্না এসএসসি পরীক্ষায় A+ পেয়েছে । আন্নার পরিবারের সবাই খুশি হয়ে প্রার্থনা সভার আয়োজন করে। তারা এত বেশি আনন্দ পেল যে এলাকার গরিব লোকদের জন্য ভোজের আয়োজন করল । পরিবারের সাথে একাত্ম হয়ে সবাই সৃষ্টিকর্তার গৌরব/মহিমা কীর্তন করতে লাগল ।

দৃশ্যকল্প-২

মৌসুমী সহপাঠীকে না বলে ব্যাগ থেকে সুন্দর একটি কলম নিয়ে যায়। বিষয়টি শ্রেণির শিক্ষককে জানানো হয় । শিক্ষক আসল দোষীকে ধরতে না পেরে সকল ছাত্রীদের শাস্তি দেন । মৌসুমী নীরব। সে মনে মনে দুঃখ পেল কিন্তু সত্য স্বীকার করতে পারেনি। তাই সে অন্তরে গভীর অনুশোচনা অনুভব করে এবং তার দোষ মুছে ফেলার জন্য ঈশ্বরের কাছে আকুল আবেদন জানায় ।

ক. মাদার তেরেজা প্রথম জীবনে কোন ধর্মসংঘের সিস্টার ছিলেন ?

        মানুষ কেন প্রার্থনা করে ?

গ. মৌসুমীর প্রার্থনা তোমার পাঠ্যপুস্তকের কোন্ প্রার্থনাটি প্রকাশ করে ব্যাখ্যা কর ?

ঘ.   আন্না ও মৌসুমীর প্রার্থনার তুলনামূলক বিশ্লেষণ কর ।

 

 

সৃজনশীল প্রশ্ন – ২

১ম বন্ধু : তোমার পড়াশুনা কেমন চলছে ?

২য় বন্ধু : মোটামুটি চালিয়ে যাচ্ছি । আশা করি আগামী পরীক্ষায় আরও ভালো করতে পারব ।

১ম বন্ধু : আচ্ছা বন্ধু ! তুমি কীভাবে পড়া মনে রাখ ? আমি তো শেখার সাথে সাথে ভুলে যাই ।

২য় বন্ধু : আমি প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে বাইবেল থেকে একটি করে অধ্যায় পড়ি। তারপর আমার ক্লাসের পড়া আরম্ভ করি ।

১ম বন্ধু : তাই ! আমি তো কোনদিন সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করি না । টেবিলে গিয়েই পড়তে আরম্ভ করি। ২য় বন্ধু : বন্ধু, তুমি প্রতিদিন আমার মতো প্রার্থনা করে পড়তে বসবে, দেখবে পড়া তাড়াতাড়ি শেখা হবে। পরীক্ষার সময় সহজেই পড়া মনে পড়বে ।

ক. একদিন ছাদে প্রার্থনার সময় কে অদ্ভূত দৃশ্য দেখেছিল ?

খ. বিশ্বাসপূর্ণ প্রার্থনার ফল কী ? তা বর্ণনা দাও

গ. ২য় বন্ধু কোন শক্তির উপর বিশ্বাসী বলে তুমি মনে কর ? তা ব্যাখ্যা কর ।

ঘ     ১ম ও ২য় বন্ধুর মনোভাবের পার্থক্যের তুলনামূলক বিশ্লেষন কর।

Content added By
কিছু চাওয়া
প্রকাশ করা
ভিক্ষা করা
প্রেম করা

Promotion