বিশ্বের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য শিল্পী ও শিল্পকর্ম 

পাঠ ১

টিসিয়ান (১৫৭৬)

ইতালির আপ্পস অঞ্চলের প্রাকৃতিক সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে টিসিয়ান জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন সামরিক বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। সে কারণে সামাজিক ও সংস্কৃতিমনা পরিবার হিসেবে তাদের একটা খ্যাতি ছিল। শৈশব থেকেই টিসিয়ান ছিলেন ভাবুক ও কবি প্রকৃতির। এর কারণ ছিল জন্মস্থানে প্রাকৃতিক পরিবেশ, পার্বত্য স্রোতধারা, সুশোভিত পত্রপুল, পাইন বন, উন্মুক্ত আকাশ। এ সবকিছুই তাকে প্রভাবিত করেছে ছবি আঁকার অনুরাগী হতে, বাবা চেয়েছিলেন তাঁকে আইন করতে। এ জন্য তাঁকে ভেনিসে পাঠালেন। কিন্তু তিনি বন্ধু জর্জনের কাছে কুড়ি বছর বয়সে ছবি আঁকার প্রথম হাতেখড়ি নেন।

অল্পদিনের মধ্যেই টিসিয়ান নিজ প্রতিষ্ঠা ও আভিজাত্যের জন্য অভিজাত সমাজে নিজেকে চিত্রশিল্পী হিসেবে তুলে ধরেন। প্রতিকৃতি ও কম্পোজিশন উভয় প্রকার চিত্রেই টিসিয়ানের দক্ষতা ছিল। ভেনিসিয়ান চিত্রশিল্পীদের মধ্যে টিলিয়ান ছিলেন সর্বপ্রধান এবং তিনি ইতালীয় অভিজাত সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। তা ছাড়া ঐ সময় শিল্পকলার জন্য ইতালির ফ্লোরেন্সের যেমন খ্যাতি ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে ভেনিসেরও তেমনি যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। ভেনিসে তিনি রাজকীয় শিল্পপদপ্রাপ্ত হন। শিল্পীপ্রতিতা ছাড়াও মানুষ হিসেবেও টিসিয়ান ছিলেন অত্যন্ত তন্ত্র। নিজের জ্ঞান ও চিত্রের মান সম্পর্কে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন।

রঙের উপর ছিল টিসিয়ানের অদ্ভুত দক্ষতা, মাত্র ছয় মাস বয়সে টিসিয়ান মাতৃহীন হন আর সে কারণেই জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর অন্তরের এই হাহাকার গোপন করতে পারেন নি।

জীবনের শেষ সময়ে এসে Mother নামে বিখ্যাত চিত্রখানি অঙ্কন করেন। তাঁর কল্পনা ছিল যিশুমাতা মেরীর মধ্যে নিজ মায়ের বিগত আাআা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে তিনি তাঁর মাকে স্বপ্ন দেখতেন— মা যেন তাঁকে ডাকছে। তাই তো তিনি তাঁর বন্ধু ও ছাত্রদের বলতেন। মা আমাকে ডাকছেন আমি শীঘ্রই তোমাদের ছেড়ে চলে যাব।

১১ বছর বয়সে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে এই শিল্পী পরলোকগমন

করেন। মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে মাতৃমূর্তি ছবিটি অঙ্কন শেষ হয়েছিল। তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে আরও আছে-Dance and The Shower of gold, Bachus and Ariadne, Salome and head of John ইত্যাদি ছবিগুলো লন্ডনের ইম্পিরিয়েল আর্ট গ্যালারিতে সংগৃহীত আছে।

পাঠ : ২

রেমব্রান্ট

(১৬০৮-১৬৬৯)

রেমব্রান্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন হল্যান্ডের শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র লোভেনে (Leyden) ১৬০৬ সালের ১৫ জুলাই। তাঁর পিতা ছিলেন বিত্তশালী লোক। তাঁর ইচ্ছা ছিল পুর উচ্চশিক্ষা নিয়ে লোডেনে একজন বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করবেন। কিন্তু রেমব্রাস্টের এই গতানুগতিক সাধারণ শিক্ষা ভালো লাগত না। পড়ার বইয়ে তিনি জীবজন্তুর ছবি এঁকে রাখতেন। পিতা তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে ১৩ বছর বয়সে জাকোব ভ্যান (Jacob Van) নামের একজন

স্থানীয় শিল্পীর নিকট প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে প্রতিকৃতি চিত্রকর Dieter Lastman এর নিকট কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৬২৪ সালে রেমব্রান্ট গোডেনে ফিরে এসে একটি শিল্পী চক্র গঠন করে স্বাধীনভাবে ব্যবসা আরম্ভ করেন।

পঁচিশ বছর বয়সে রেমব্রান্ট অতি জন্ম দিনের মধ্যে সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সুদক্ষ প্রকৃতি চিত্রকর হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অতি দ্রুত ব্যবসা জমে ওঠে, বন্ধু চিত্রের ফরমায়েশ পেতে থাকেন এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও শিল্পীকে ফরমায়েশ দিতে থাকে। শুধু সুদক্ষ এচার (etcher) রূপেও তাঁর কৃতিত্ব প্রচারিত হয়, পেইন্টিং নয় এচিং কাজেও রেমব্রান্টের অদ্ভুত দক্ষতা ছিল।

রেমব্রান্ট একসময় মুঘল চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ঐ পদ্ধতির অনেকগুলো চিত্র নকল করেছিলেন, কিন্তু ঐগুলো মুল চিত্রের ন্যায় উন্নত হয়নি।তথাপি লক্ষনের সদরে সোখলি কোম্পানি রোলের পাকা শাহজাহানের একখানি চিত্র শুধু তাঁর গৌরবোজ্জ্বল কৃতিত্বের জন্য ১,৭৫,০০০ টাকার কর করেন। ভারতের মূল মূখ্য চিত্র এর শতাংশ মূল্যেও বিয়ে হয়নি।

চিত্র জলনের ক্ষেত্রে রেমব্রান্ট ছিলেন নির্ভীক ও গাজনচেতন। চিত্রের বিষাকফুর সাথে লালের নাটকীয়তাই তার চিত্রকে বৈশিষ্ট্য দান করেছে। বিন্যাসের দিক থেকে তিনি ছিলেন যুগশিল্পী। সমগ্র ছবির মধ্যে গতীর টোন ও শ্লিষ্ট কম্পোজিশনের বর্ণ সঙ্গতি ভারসাম্য রক্ষার শিল্পীর অদ্ভুত কানের পরিচয় পাওয়া যায়।

রেমব্রান্ট ৩ বছরের কর্মজীবনে এটিং ড্রইং ও পেইন্টিং মিলিয়ে করে হাজার চিন্তা অক্ষম করেছেন। তাঁর বিখ্যাত শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে The blindness of Tobit, ধর্মবিষয়ক চিত্রের মধ্যে The Raising of Lazarus Christ at Roomans (ল্যুভর মিউজিয়ামে সম্প্রক্ষিত) সামাজিক উৎসবটিক্রের মধ্যে Samsons; Wedding

Feast কম্পোজিশন ধরনের প্রতিকৃতির মধ্যে An old man in Thought a Flora উল্লেখযোগ্য চিত্র।

১৬৬৯ সালে এই মহান শিল্পী পরলোকনমন করেন।

পাঠ : ৩

(১৮৬৯-১৯৫৪)

১৮৬৯ সালে উত্তর ফ্রাनে মাসি করেন। প্রথম জীবনে মাত আধুনিক ও প্রাচীন বহু শিল্পীর অনুশীन করেছেন। এইং বা রেখার প্রতি ছিল তাঁর অদ্ভুত দক্ষতা। প্রত্যেক রীতির মধ্যেই তিনি স্বাধীন সভন্ন রীতির সম্মান করেছেন। পারস্য সুথিচিত্রের অনুশীলন কিছুদিন শিপুতিনের স্যার চিত্ররীতিতে অন করতে গিয়ে বুঝতে পারেন ঐ পদ্ধতি তাঁর উপযোগী নয়, কারণ সুদক্ষ রেখাবিন্যাস ক্ষমতা পাণ্ডিত্য প্রভৃতি অন্তরায় হয়েছিল। বাধ্য হয়ে তিনি এমন একটি পদ্ধতি গ্রহণ করেন যাতে চিন্তা, নিষ্ঠা, নিখুঁত ক্রাফটসম্যানশিপ ও শিশুটিক্সের ন্যায় সরুগতাপূর্ণ ছিল। তাঁর চিত্রে বর্ণ ও রেখার হুপ প্রয়োগে , যা পর ঠিক না থাকলেও দর্শককে আকৃষ্ট করে। কারণ মূল বক্তব্যের সঙ্গে পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গতি রক্ষা করে পালঙ্ক্ষারযুক্ত রেখার বিন্যাসে মাতিস ত কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। আলোছায়ার প্রয়োগ সত্যক করার চিত্রগুলো বিমাজিক আকৃতি ধারণ করেছে।

বিষয় নির্বাচনে তিনি ছিলেন সাবলীল। একটা সামান্য বিষয়কেও শিল্পী তাঁর দক্ষতায় তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করতে পারেন। শিল্পীর পঞ্চনকৌশল চিত্রের বিষয়ের উপর নির্ভর করে না। এটা তাঁর নিজ পতিতার উপর নির্ভরশীল। বিষয়ের বাহ্যিকরূপ শিল্পীর নিকট সত্য হতে পারে না। শিল্পীর অন্তরে প্রতিফলিত প্রকৃতি বা বিষয়ের রূপই চিনের কৃষ্ণ ৰূপ।মাতিসের চিত্রে পরিপ্রেক্ষিত উপেক্ষিত হয়েছে- প্রতিকৃতিচিত্রে লাল, নীল প্রভৃতি বর্ণ তিনি নিজ খেয়াল খুশিতে প্রয়োগ করেছেন। বর্ণ ভারী ও উচ্ছ্বল। The Dance নামক চিত্রখানি মাতিসের একখানি বিখ্যাত চিত্র। এটা এখন মস্কোতে আছে। চিত্রখানি বলিষ্ঠ রেখা ও Wash এ অঙ্কিত হয়েছে। চিত্রের একদল নারী-পুরুষ ছান্দিক গতিতে চক্রাকারে নৃত্যরত।

মানুষগুলো এখানে রূপক, তাদের দৈহিক রূপ প্রকাশ করা শিল্পীর উদ্দেশ্য নয়, তিনি নৃত্যের অন্তর্নিহিত ছাদিক রূপ ও গতি প্রকাশ করার জন্য চিত্রখানি অঙ্কন করেছেন। খুব স্বপ্ন বর্ণ, স্বপ্ন রেখা, স্বপ্ন কলাকৌশল ও পরিশ্রমের যারা বিষয়ের ভাব প্রকাশ করার যে মতবাদ, তার সার্থক রূপ মাতিসের বিখ্যাত Head of a Woman চিত্রে। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পরলোকগমন করেন।

পাঠ : ৪

পল সেজান

(১৮৩৯-১৯০৬)

আধুনিক চিত্রকলার জনক পল সেজান ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে রোন নদীর তীরবর্তী এক প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন ব্যাংকার। আর্থিক অবস্থা ছিল সচ্ছল। প্রথমে যখন তিনি প্যারিসে গেলেন, অত্যন্ত লাজুক থাকার কারণে লোকের সাথে মিশতে পারতেন না। ভাতে পারিপার্শ্বিক লোকেরা মনে করতেন সেজান অত্যন্ত দাম্ভিক। পিতার আর্থিক সহযোগিতায় প্রায় দশ বছর পর্যন্ত তিনি চিত্রকলা অধ্যয়ন করেন। কিন্তু ছবি আঁকার তৃপ্তি তাঁর মিটল না। সেজানের ব্যক্তিগত জীবন ছিল অত্যন্ত সহজ ও সাদামাটা এবং নানা ঘাতপ্রতিঘাতপূর্ণ। সবসময় কঠোর পরিশ্রম করতেন। ছবি আঁকা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মের জন্য কখনোই সম্মান বা স্বীকৃতি পাননি। প্যারিসের শিক্ষা ও অধ্যয়ন সমাপ্ত করে তিনি আবার নিজ জন্মস্থানে ফিরে আসেন। ব্যাংকার বাবার দেয়া মাসিক ১২ পাউন্ড ভাঙা দিয়ে চলতেন। তিনি ছবিবিক্রয় করা পছন্দ করতেন না। অন্তরের গভীর উপলদ্ধি থেকে প্রকৃতি ও জীবনকে রঙের মায়াজালে বন্দি করার জন্যই তিনি ছবি আঁকতেন।

কখনো কখনো বাইরের চিত্র অঙ্কন করে তা যখন সমাপ্ত হতো ঐগুলো ঘরের নিকটবর্তী ঝোপের মাঝে ফেলে দিয়ে খাি হাতে বাড়ি ফিরে আসতেন। আর এ কারণে গোপনে তাঁর স্ত্রী তাকে অনুসরণ করতেন এবং ছবিগুলো সংগ্রহ করে গৃহের এক কোণায় লুকিয়ে রাখতেন। বলা যায় তিনি জীবিকার জন্য ছবি আঁকেন নি, বরং ছবি আঁকার জন্যই তিনি বেঁচে ছিলেন। তিনি ছবি আঁকার একটি ধারা তৈরি

করেছিলেন যার নাম ছিল Post Impressionism. তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে- তাস খেলা। ১৯০৬ সালে

তিনি পরলোকগমন করেন।

পাঠ : e

অগুস্ত রদ্যা

(১৮৪০-১৯১৭)

ফ্রঁসোয়া অগুস্ত বেনে রনা ফ্রান্সের পারীতে ১৮৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না। মাথা ভর্তি লাল চুল, লাজুক মুখচোরা বালক রদ্যা অন্যান্য সমবয়সী হৈ চৈ করা ছেলে-মেয়েদের সাথে মিশতে পারতেন না। কিন্তু একা একা ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তাঁর ছিল পাগলের মতো নেশা। শৈশব থেকেই শিল্পকলার প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ দুর্বলতা। বাল্যকালে পাঠ্যবই-এর ইলাস্ট্রেশন ও ছবি দেখে সে রকম আঁকার চেষ্টা করেও কোনো শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেন নি। ছবি আঁকার রং, তুলি, ক্যানভাস এগুলোর ব্যয়তার যোগাতে পারবেন না সেজন্য সিদ্ধান্ত নেন ভাস্কর হওয়ার, অন্তত মাটিটা বিনামূল্যে যোগাতে পারবেন ভেবে। তিনি একটি প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুলে বছর দুই পড়াশুনা করেন।

কিন্তু ল্যাটিন ও অন্যান্য গতানুগতিক বিষয়ে পড়তে তাঁরমোটেই ভালো লাগল না। অবশেষে ছবি আঁকার প্রতি ছেলের দুর্নিবার আকর্ষণ দেখে বাবা তাকে একটি চিত্রকলার স্কুলে ভর্তি করে নিলেন। শিক্ষক ছিলেন হোরেস শিকক দ্য বয়ব। অত্যন্ত দক্ষ শিক্ষক লিকক ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি গ্রন্থে নিজের শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছেন যে, তিনি সর্বাগ্রে চেষ্টা করতেন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব যেন বিকশিত হয়। সে যেন নিজের চোখ দিয়ে জীবনকে দেখতে শেখে এবং তারপর সেই দেখার স্মৃতিকে অবলম্বন করে আঁকার কাজে ব্রতী হয়। ভাস্কর্য তৈরি শেখার মধ্যে ডুবে যাবার পর রদ্যা শুধু এই স্কুলের ক্লাসের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি। তিনি লুত্যরে গিয়ে প্রাচীন মার্বেলের ভাস্কর্যগুলো আবিস্কার করলেন। ইম্পেরিয়াল গ্রন্থাগারে গিয়ে খোদাই কাজগুলোর ছবি আঁকলেন। ঘোড়ার হাটে গিয়ে জীবন্ত মডেল থেকে স্কেচ করলেন। এ সময় রদ্যা ম্যানুফ্যাকচার দ্য গবলিতে যোগ দেন। প্রথম থেকেই র্যাকে তাঁর নিজের সমস্যার সমাধান নিজেকেই করতে হয়েছে। অসম্ভব মনোবল, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করেছেন। এ সময় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা শহর ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন মূর্তি ও মানুষের ড্রইং করতেন।

রন্যার যৌবন কেটেছে কাজ নিয়ে উন্মত্ততায় এবং লোক সমাজের অজ্ঞাতে। এ সময় কবি বোদলেয়র ও সাস্তের কবিতা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। রনা আজীবনই ছিলেন কাজ পাগল মানুষ। তাঁর ভাস্কর্যে গতি ও প্রাণময়তা ভাস্কর্যকে নিয়ে এসেছিল জীবনের কাছাকাছি। তাঁকে অনেকে সে সময়কার ইম্প্রেশনিস্টদের সাথে তুলনা করলেও তিনি ছিলেন কিছুটা সিম্বলিস্ট বা প্রতীকি ধারার শিল্পী। বক্তব্য ও গতিময়তা তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্য হলেও ভাস্কর্যের জন্য সব নিয়ম- ব্যাকরণকেও ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত দক্ষভাবে। ভাস্কর্যগুলো ছিল প্রাণময় ও আবেগপূর্ণ। তাঁর নিজের উক্তিতে

বলেছেন- "শিল্পের প্রকৃত সৌন্দর্য সত্যের উন্মোচনে যদি কেউ তার দেখার জিনিসকে নির্বোধের মতো শুধুই দৃষ্টিনন্দন করতে চায়, কিংবা বাস্তবের দেখা কদর্যতাকে আড়াল করতে চায়, কিংবা তার অন্তর্গত বিষাদকে লুকিয়ে রাখতে চায়, তাহলে তাই হবে প্রকৃত কদর্যতা, আর সেখানে কোনো খাঁটি অভিব্যক্তিও থাকবে না। তিনি আরও বলেছেন - শ্রেষ্ঠ শিল্প মানব এবং জগত সম্বন্ধে যা কিছু জানবার সবই জানিয়ে দেয়। কিন্তু তারপরও যা জানায় তা হলো সেখান এমন কিছু আছে যা চিরকাল অজানাই থেকে যাবে। প্রত্যেক মহৎ শিল্পকর্মের মধ্যেই থাকে রহস্যের এই গুণাবলি।”

রদ্যা সর্বদা তাঁর উপকরণকে খোলা মনে গ্রহণ করেছেন, কখনো তাকে লুকোতে বা তার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে চাননি। তাঁর ফিগারগুলো দেখলে মনে হয় সেগুলো যেন তাদের আদি পাথর কিংবা মাটির অবস্থা থেকে সরাসরি উঠে এসেছে। মাইকেল এঞ্জেলো তাঁর কোনো কোনো ফিগার কিছুটা অসম্পূর্ণ রেখেছেন পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রতিকূলতার কারণে, বন্ধুগত সীমাবদ্ধতার জন্য। কিন্তু রদ্যার কোনো কোনো ফিগার যাকে অসম্পূর্ণতার চিহ্ন বলে মনে হয় তা শিল্পীর সচেতন সৃষ্টি, তার মধ্যে ফুটে উঠেছে শিল্পীর নিজস্ব ডিজাইনের বিশেষ অভিব্যক্তি। রদ্যা কখনোই নিছক বর্ণনায় তুষ্ট হন নি। সর্বদা তিনি আরো এক পা এগিয়ে গেছেন। তাঁর কাজ বহুমাত্রিক। আমরা সেখানে পাই বাস্তবতা, রোমান্টিকতা, অভিব্যক্তিবাদ, ইম্প্রেশনিজম এবং যৌনতার অনুষঙ্গমাখা মরমীবাদ।যোগ দেন এই আর্ট ইনস্টিটিউটে। পুরোনো প্রতিষ্ঠিত শিক্ষকরা নবীন শিক্ষকদের পেয়ে শিল্পকলা শিক্ষাকে আরও উন্নত করতে থাকেন। ধীরে ধীরে শিল্পীরা জনসাধারণকে চিত্রশিল্প ও অন্যান্য শিল্পকলার প্রয়োজন বুঝাতে সমর্থ হন। রুচি পাল্টাতে থাকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের। শিল্পীরা জীবনযাপনের অনেক কাজকে সুন্দর রূপ ও সুষমা দিয়ে গড়ে তুলতে থাকেন। ফলে ধীরে ধীরে শিল্পীদের জন্য বিভিন্ন সংস্থায় চাকরির পদ হর, কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। আজ সমাজে একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন বিজ্ঞানী যেমন অবশ্য প্রয়োজনীয়, একজন শিল্পীর প্রয়োজনও তেমনি সমান গুরুত্বপূর্ণ। চিত্রশিল্পীরা সমাজজীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ব্যবসা ও প্রশাসন-সর্বক্ষেত্রেই আজ শিল্পীদের প্রয়োজন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান, সিনেমা তৈরিতে খবরের কাগজে ছবি, কার্টুন ওসুন্দর প্রকাশনায়, বই পুস্তকের জন্য ছবি, প্রচারের জন্য পোস্টার তৈরিতে, বিজ্ঞাপনে, শিল্পকারখানার দ্রব্যাদির আকার-আকৃতির নকশায়, শিল্পদ্রব্যের প্যাকেটের নকশায় পোশাকশিল্পের নকশায় কাপড় তৈরির শিল্পে, আসবাবপত্রের নকশায় এমনি অনেক প্রয়োজনীয় কাজে শিল্পীরা তাঁদের সৌন্দর্যবোধকে কাজে লাগাচ্ছেন।

১৯৪৮ সালে যাত্রা শুরু করে সেদিনের গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউট আজ এক বিরাট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ হিসেবে শিল্পকলার বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষাদান করছে। ১৯৭১ পর্যন্ত একটিমাত্র শিল্প শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর শিল্পকলার ক্ষেত্র প্রসার লাভ করায় শিল্পীদের প্রয়োজন আরও বেড়ে যায়। ফলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠা হয়। চট্টগ্রামে একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি চারুকলা কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ এবং সরকারি আর্ট কলেজ একত্রিত হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত রাজশাহী চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়টি বর্তমানে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদে চারুকলা বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে একটি চারুকলা অনুষদ। ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদে রয়েছে চারুকলা বিভাগ। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চারুকলা বিভাগ। এছাড়া ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা) সহ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও দেওয়া হচ্ছে চারুকলা শিক্ষা। তদুপরি ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, যশোর, নড়াইল, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন শহরে রয়েছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি আর্ট কলেজ। এছাড়াও শিশুদের ছবি আঁকার জন্য শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বাংলাদেশে এখন অনেক চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর রয়েছেন। দেশে-বিদেশে শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হচ্ছে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে গিয়ে বাংলাদেশের শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্মের জন্য সুনাম ও দেশের জন্য গৌরব অর্জন করছেন। তাঁদের মূল্যবান শিল্পকর্ম বিখ্যাত জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় সংগ্রহ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি জাতীয় ভিত্তিতে বাংলাদেশের শিল্পীদের আঁকা চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। প্রতি দুই বছর পর পর আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক শিল্পকলা প্রদর্শনী ও সম্মেলন। প্রদর্শনীর নাম-এশিয়ান বিয়েনাল বা এশিয়ান দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনী। অনেক দেশের শিল্পীরা এতে অংশগ্রহণ করেন। এই সফল এশিয়ান বিয়েনাল এর জন্য বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর আছেন। তাঁদের সবার কথা এখানে বলা সম্ভব নয়। কয়েকজন

উল্লেখযোগ্য শিল্পীর কথা সংক্ষেপে এখানে আলোচনা করা হলো। অন্যান্যদের কথা ধীরে ধীরে জানতে পারবে।

পাঠ : ৮

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন

অনেক সুন্দর ও উল্লেখযোগ্য ছবি এঁকেছেন জয়নুল আবেদিন। এগুলো এখন বাংলাদেশের মূল্যবান সম্পদ এবং দেশে বিদেশে বিখ্যাত শিল্পকর্ম। এদেশে শিল্পকলা চর্চার জন্য প্রথম যে প্রতিষ্ঠান আর্ট ইনস্টিটিউট-তার প্রধান প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তিনি বাংলাদেশের নামকরা অনেক শিল্পীকে হাতে ধরে ছবি আঁকা শিখিয়েছেন। শিল্পীদের জন্য কর্মক্ষেত্র তৈরি করেছেন। সমাজকে সুন্দরভাবে চালিত করতে শিল্পীদের প্রয়োজন তা এদেশের মানুষকে বুঝাতে পেরেছেন। শিশু-কিশোরদের জন্য ছবি আঁকার স্কুল ও প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। শিল্পকলার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বাংলাদেশের মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁকে ভালোবেসে নাম দিয়েছে শিল্পাচার্য।তাঁর উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে দ্য বিকার, চুম্বন, বালজাক, দ্য সাইরেন্স, দ্য সিক্রেট, অনন্ত বসন্ত, ইভ, তিন

মূর্তি প্রভৃতি।

রনা আজীবন চিন্তা করে গেছেন ভাস্কর্য নিয়ে এবং বিশ্বাস করেছেন চিন্তাই মানুষের অন্যতম সগ্রাম। অগুস্ত রদ্যা পরোলেকগমন করেন ১৭ই নভেম্বর। তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ হয় মাসঁতে ২৪শে নভেম্বর। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী দ্য বিকোয় ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে তাঁর সমাধি শিয়রে।

পাঠ : রামকিকর বেইজ

(২৬শে মে ১৯০৬-২রা আগস্ট ১৯৮০) ১৯০৬ সালে ২৬শে মে বাবা চন্ডীচরণ ও মা সম্পূর্ণা দেবীর কোলে পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া জেল যোগীপাড়ার এক আদিবাসী গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। বড় অভাবী পরিবার, ক্ষৌরকর্মই জীবিকা, শৈশবে কুমোরদের ছবি আঁকা দেখে আপনমনে ছবি আঁকতেন ওদের মতো রং-তুলি দিয়ে। মামার বাড়ি বিষ্ণুপুরের কাপাকুপি যাওয়ার পথে সুত্রধরদের বসবাস। সে সময়ই অনক সুত্রধর নামের এক মিস্ত্রির কাছে রামকিঙ্করের মূর্তি গড়ার প্রথম পাঠ। এছাড়া বিষ্ণুপুরের মন্দিরের কাজও তাঁকে টেনেছে। মন্দিরের পোড়ামাটি আর পাথরের কাজের করেই শিল্পীর পথ চলা শুরু। বাঁকুড়ার বিখ্যাত শিল্পী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের দৃষ্টিতে এই তরুণের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাপূর্ণ, কলাকর্ম আকৃষ্ট হওয়ার মতো। তিনি রামকিঙ্ক্ষাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে শান্তি নিকেতনের কলাভবনে নগনাল বসুর কাছে অর্পণ করেন। লেখাপড়া যতটুকু করেছেন তাতে সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল না। ছবি আঁকা আর মূর্তি গড়াতেই ছিল তাঁর আসল মনোযোগ। তিনি নিজের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বড় হবেন এই ছিল তাঁর আদর্শ ও চিন্তা, সে কারণেই রামকিঙ্কর ছিলেন ভারতীয় সাঁওতাল ভাস্কর। তিনি আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যকলার অন্যতম অগ্রপথিক। যিনি আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্প অধ্যয়ন করে সেই শৈলী নিজের ভাস্কর্যে প্রয়োগ করেন। তাঁকে ভারতীয় শিল্পে আধুনিকতার জনক ও অন্যতম শ্রেষ্ঠশিল্পী মনে করা হয়। রামকিঙ্করের কাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য গতিশীলতা। তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্যের প্রায় সকল আকৃতিই গতিশীল। কেউই থেমে নেই। তাঁর বড় ভাস্কর্যের বেশিরভাগই উন্মুক্ত জায়গায় করা।

রামকিঙ্করের পেশাগত জীবনের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় ১৯৩৪ সালে। তিনি যখন কলাভবনের স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন। ১৯৩৫ এবং ১৯৩৬ সালে অনেকগুলো কাজ তিনি শেষ করেন। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে রিলিফ, সাঁওতাল দম্পতি, কৃষ্ণগোপিনী, সুজাতা প্রভৃতি। ১৯৩৭ থেকে তিনি ছাত্রদের মডেলিং শেখানোর দায়িত্ব নেন। ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়টাকে রামকিঙ্করের তেলরং পর্বের শুরু ধরা হয়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে তিনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তেলরং চিত্রের কাজ শেষ করেন। মহাত্মা গান্ধী, বুদ্ধ ও সুজাতা, হাটে সাঁওতাল সম্পতিকাজের শেষে সাঁওতাল রমনী, পিং সিরিজ, শরৎকাল, ফুলের জন্ম, নতুন শস্য, বিনোদিনী, মহিলা ও কুকুর, গ্রীষ্মকাল তাঁর উল্লেখযোগ্য চিত্র। একই সময়ের মধ্যে শেষ হয় তাঁর অনেকগুলো বিখ্যাত ভাস্কর্যের কাজও, তাঁর সৃষ্টিকর্মের কাল বিচারে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বলা যেতে পারে। এই পর্বে করা তাঁর বিখ্যাত ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে কংক্রিটে তৈরি সাঁওতাল পরিবার, প্লাস্টারে করা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি, সিফেট দিয়ে হেড অব এ ওম্যান, বাতিদান অন্যতম।

ইউক্যালিপটাস গাছের ছায়ায় যে 'সুজাতা' মূর্তিটি স্থাপিত আছে এটিকে শিল্পী তাঁর একটি প্রিয় কাজ কাতেন। তিনি বলতেন ওটি নড়ে, কথা বলে। প্রতিদিন যাদের নানাভাবে ও নানা কাজে দেখেছেন রামকিঙ্কর তাদের কথাই জীবন ভর ভেবেছেন, তাদের তিনি ভালোবেসে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এনে সকদের সম্মুখ চিত্রে ও ভাস্কর্যের মধ্যে তুলে ধরেছেন।

অভিনয় ও সংগীতের প্রতিও তাঁর প্রচন্ড আকর্ষণ ছিল। শান্তিনিকেতনে অনেক নাটক রামকিঙ্করের নির্দেশনায় অভিনীত হয়েছে। রামকিঙ্কর চিরকুমার ছিলেন। ঘর বাঁধা হয়নি এই আত্মভোলা শিল্পীর। অনলসভাবে তিনি প্রায় ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত কলালক্ষীর উপাসনা করে ১৯৮০ সালের ২রা আগস্ট পরলোকগমন করেন ।

পাঠ: ৭

বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের পরিচিতি

বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলার যাত্রা শুরু ১৯৪৮ সালে। তখন দেশের নাম পাকিস্তান। আমাদের এই অঞ্চলের নাম পূর্ব পাকিস্তান। বর্তমানে যেটা বাংলাদেশ। ভারত ভাগ হয়ে দুই দেশ হওয়ার ফলে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহরে অনেক মুসলমান নাগরিক চলে আসেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তারা নতুন স্বাধীন দেশে নতুন করে গড়ে তোলেন নতুন প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা ও নতুন জনপদ। কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন কয়েকজন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী। এঁরা হলেন শিল্পী জয়নুল আবেদিন (পরে শিল্পাচার্য উপাধি পেয়েছেন), কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক, শফিউদ্দিন আহমেদ, শফিকুল আমিন, খাজা শফিক আহমদ প্রমুখ। এঁরাই উদ্যোগ গ্রহণ করে ও অনেক চেষ্টা করে শিল্পকলা শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট। মাত্র বারো জন ছাত্র নিয়ে প্রথম ছবি আঁকার ক্লাস শুরু হয়। পাঁচ বছরের শিক্ষা কোর্স। প্রথম দলটি পাস করে বের হন ১৯৫৩ সালে। তারপর প্রতি বছর কয়েকজন করে শিল্পকলায় শিক্ষা। লাভ করে পাস করতে থাকেন। এই নবীন শিল্পীদের অনেকেই তখন দেশের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতে চলে যান, শিল্পকলায় উন্নততর শিক্ষাগ্রহণ করতে। কয়েক বছর পর এরা দেশে ফিরে এসে তাঁদের অভিজ্ঞতা, নতুন ধ্যান ধারণায় আঁকা ছবি ও ভাস্কর্য প্রদর্শনী করে দেশের শিল্পকলার প্রসার ঘটাতে থাকেন। অনেকেইশিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্ম ২৯শে ডিসেম্বর ১৯১৪ সালে

ময়মনসিংহে। স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে ভর্তি হন কলকাতা

হিসেবে অল্পদিনেই সুনাম অর্জন

করেন। আর্ট স্কুলের শিক্ষা শেষে সেখানেই শিক্ষকতার নিরোগ

পান। ১৯৩৮ সালে খুব ভালো ফল করে তিনি

তরুণ করলেই ছবি আঁকার প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন অরনুল। ১৬৫০ সালে বাংলায় এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কাধীন ব্রিটিশ শাসকদের অবহেলা ও অমানবিকতার কারণেই সাধারণ মানুষের খাবারের অভাব হয়েছিল। কলকাতার রাস্তার হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু অসহায় অবস্থা তরুণ শিল্পী মানুদের মনকে পীড়া দিয়েছিল। টি পালকদের প্রতি তার ঘৃণা না- মনে মনে সুখ হয়ে উঠ মানুষের মৃত্যু ও দুর্বিসহ অবস্থাকে বিষন্ন করে জীন মোটা কালো রেখার অনেক ছবি। যা পরবর্তীকালে দুর্ভিক্ষের চি

পরিচিত হলো। রাতমাপ্তি শিল্পীর নাম ছড়িয়ে পড়ল ভারতে।

ভারতের বাইরেও অনেক উন্নত দেশে শিল্পী জয়নুরে দুর্ভিক্ষের চিত্র বিষয়ে নামকরা লোকেরা পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রশংসা করে লিখলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বেঁচেছিলেন

৬২ বছর। সবসময় কর্ম- সচল ছিলেন তিনি। হঠাৎ করেই দুরারোগ্য

ফুসফুসের ক্যান্সার রোগে পাকাত হয়ে ১৯৭৬ সালের ২৮শে মে মৃত্যুবরণ করেন। শেষ বয়সে লোকশিল্পের জাদুঘর গড়ে তোলার কাজ করে যাচ্ছিলেন। বাংলার পুরোনো রাজধানী সোনারগারে এই লোকশিল্পের জাদুঘর। শুধু করেছিলেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি।

শিল্পাচার্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মগুলোর নাম- মুর্ভিক্ষের চিত্র-১৯৪৩, গ্রাম, মই দেয়া, চুর পাড়ি, গুনটানা, সভা, সুমকার ছবি, প্রসাধন,পাইনার মা, নবান্ন (৬০ ফুট দীর্ঘ মনপুরা- ৭০ (২০ ফুট দীর্ঘ ফল)। স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিষয় করে এঁকেছেন "মুক্তিযোদ্ধা” নামের ছবি। তাঁর ছি সংগ্রহ রয়েছে জাতীয় মানুষরে মরমনসিংহে র সাহালায় এবং দেশে-বিদেশে ব্যক্তিগত প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহশালায়। শিল্পাচার্য তাঁর সারা জীবনে অনেক পুরুস্কার, সম্মান প্রস্থা অর্জন করেছেন। বিশ্বের বহু দেশে তিনি নামন্বিত হয়েছেন। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি লিট উপাধি সেন। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জাতীয় অধ্যাপকের।

জীবনের পঞ্চাশ বছর সময়কাল তিনি ছবি আঁকতেন। আর একটি-দুটি নয়, অনেক। একটা হিসাব ধরা যাক- প্রতিদিন ৫টি করে চং করলে ৫০ বছরে পাড়ায় প্রায় ১ লক্ষ । হ্যাঁ, র মতো এত বেশি ড্রইং সারা বিশ্বের আর কোনো

শিল্পী করেছেন কিনা জানা যায়নি। ড্রইং-এ তার সক্ষতা তুলনাহীন। আর্ট ইনস্টিটিউটের তিনিও একজন প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক। প্রথম জীবনে খুবই নিষ্ঠা নিয়ে অনেক শিল্পীদের গড়ে তুলেছেন। পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলেন নকশা কেন্দ্র। নকশা কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন। একদল শিল্পী নিয়ে অসংখ্য मথুন নতুন সকলা তৈরি করেন ভাভিদের অন্য ও অন্যান্য কারুশিল্পীদের জন্য।

জন্ম ২রা ডিসেম্বর, ১৯২১ কলকাতায়। কলকাতা আর্ট স্কুলে চিত্রকলায় শিক্ষা লাভ করেন। তরুণ বয়সেই ব্রতচারী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ব্রতচারী আন্দোলন হলো খাঁটি বাঙালি হিসেবে নিজকে তৈরী করা এবং অন্যকেওউদ্বুদ্ধ করা। অন্যদিকে শিশু-কিশোরদের বাঁটি বাঙালি ও উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য 'মুকুল ফৌজ' গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন মুকুল ফৌজের সর্বাধিনায়ক (১৯৪৮-৫১)। শরীর চর্চায়ও তার সুনাম ছিল। সুন্দর দেহ ও সু-স্বাস্থ্যের জন্য-১৯৪৫ সালে মিঃ বেলন উপাধি ও পুরস্কার লাভ করেন।

কামরুল হাসানের সবচেরে উল্লেখযোগ্য কাজ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আঁকা ছবি-ইয়াহিয়ার জানোয়ারের ম মুখ। এটি একটি পোস্টারচিত্র। যার মধ্যে লেখা ছি এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে। ইয়াহিয়ার মুখ জানোয়ার আকৃতির। যে লক্ষ লক্ষ বাঙালির হত্যার হোতা। তাঁর এই পেস্টারচিত্র আঁকার গুণে মুক্তিযুে জন্য ছিল উৎসাহ ও প্রেরণার এক জন। তাই একটি ছবিই কাজ করেছে অল্পের-লক্ষ মেশিনগানের।কামরুল হাসান তাঁর ছবি আঁকা, লেখা, বক্তৃতা অর্থাৎ সব রকম কাজের মধ্য দিয়ে অন্যায় ও অভিকারের বিরুদ্ধে প্রতি করতেন। কবিদের এমনি এক প্রতিবাদী কবিতার সভার সভাপতিত্ব করার সময় ১৯৮৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মুসযন্ত্রের কিয়া ব্য হয়ে অনুষ্ঠানের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন। কামরুল হাসান বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা স্তূপকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতীকের নকশা নির্মাণ করেন। সারা জীবনে তিনি অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। সামাজিক ৩ রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক সম্মান, প্রন্থা ও পুরস্কার পেে

তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলো হলো নবান্ন, উকি দেয়া, তিনকন্যা, বাংলার রূপ, জেগে,

পেঁচা, নাইওর, শিয়াল, বাংলাদেশ, গণহত্যার আগে ও পরে ইত্যাদি। তাঁর অনেক ছবি সহ রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়

জানুঘরে।

পাঠ ১০

আনোয়ারুল হক শিল্পকলার একজন নিবেদিত প্রাণ ও শিক্ষক হিসেবে শিল্পী জানোয়াসে হক খ্যাতি অর্জন করেন। প্রতিটি ছাত্রকে তিনি হাতে ধরে লেখাতেন। তাঁর সারা জীবন কাটে চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করে। তিনি কয়েকবার চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ফাঁকে ফাঁকে কিছু চিত্রকলা করে রেখে গেছেন। জগতে সুন্দর ছবি আঁকায় তাঁর খ্যাতি ছিল।

তিনি করেন আফ্রিকার উপচায়। ছেলেবেন সেখানেই কাটে। শিল্পকল শিক্ষাগ্রহণ করেন কলকাতা আর্ট স্কুলে। তারপর সেখানেই তরুণ বয়সে শিক্ষকতার যোগ দেন। তারপর ১৯৪৮ সালে ঢাকায় ইনস্টিটিউটে যোগ দিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত উক্ত প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতা করে গিয়েছেন। তিনি ১ ন ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ কम।

পাঠ : ১১

এস. এম. সুলতান

একজন খেয়ালী মানুষ ও বৈশিষ্ট্যমর চিত্রকলার শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর ছবির বিষয় বাংলাদেশের গ্রাম জীবন, চাষ-বাস, কৃষক, জেলে ও খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁর ছবির মানুষেরা কস্তরে মতো নয়। বলিষ্ঠ দেহ ও শক্তিশালি। তাঁর আঁকার গুণে ছবি বুঝতে কারও কষ্ট হয় না। তিনি মানুষকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, যে কৃষককুলকে আমরা দেখি তাদের বাইরের স্তূপ, তা বাস্থ্য দুর্বল শরীর। আসলে তো তা নয়। কৃষক জমি কর্ষণ করে, ফসল ফলার, খাদ্য যোগায়। তারাই তো আসলে দেশের শক্তি। তাদের ভেতরের রূপটা শক্তিশাণী। সুকানজন্মগ্রহণ করেন নড়াইলে ১৯২৩ সালে। তাঁর ছেলেবেলা কাটে গ্রামে। তারপর ছবি আঁকা শেখেন কলকাতা আর্ট স্কুলে। ভাগ্যো বের হয়ে পড়েন ঘুরে বেড়ান দেশ-বিদেশে। ছবি আঁকেন, মাঝে মাঝে প্রদর্শনী করেন আবার উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে জীবন। ভারত, পাকিস্তানের অনেক অঞ্চল ঘুরেছেন।

ঘুরেছেন ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশ। বেশ-ভূষাও ছিল অন্য সবর থেকে আলাদা। লম্বা চুল, কখনো পা পর্যন্ত কালো আলখাল্লা পরা, নো গেরা রঙের চাদর সারা পারে জড়িয়ে, কখনো মেয়েদের মতোই শাড়ি ও চুড়ি পরে ঘুরছেন। সন্ন্যাসীর মতোই জীবন কাটিয়েছেন। শেষ বলে তাই নিজের স্থানে বসবাস করেন। শিশুদের জন্য বিশেষ ধরনের শিক্ষার স্কুল করেন। নাম শিশু। শিশুরা লেখাপড়া করবে। ছবি আঁকবে, গান গাইবে, প্রকৃতি, গাছপালা, জী-র সাথে আপন হয়ে মিশে যাবে। মনের আনন্দে সব শিখবে। জোর করে নয়। সুলতা পশু-পাখি পালতেন। নিজের সন্তানের মতো সে সব পশু-পাখিকে বর করতেন। ১৯৯৪ সালে নড়াইলেই একা বছর বয়সে মৃত্যুকরণ করেন। তাঁর চিত্রকর্ম বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। শিল্পকলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে 'প্রেসিডেন্ট পার্টিস্টের' সম্মান প্রদান করেন। তিনি সাধীনতা পদক লাভ করেন।

পাঠ : ১২

শফিউদ্দিন আহমেদ

এক আদর্শ শিক্ষক। পরিচি, মার্জিত ভাব এবং দক্ষ চিত্রশিল্পী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। স্থাপচিত্রে, বিশেষ করে কাঠ খোলাই এচিং, এরোটিস্ট, ছাই-পরেন্ট ও ডিপ এচিং মাধ্যমে একজন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী। আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা থেকেই শিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীকে তাঁর মেধা, শিল্প চেতনা, শিক্ষা নিয়ে শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। শফিউগিনের জন্ম কলকাতার ১৯২২ সালে। ছবি আঁকা শেখেন কলকাতা আর্ট স্কুলে। তারপর কিছুদিন সেখানেই শিক্ষকতা করেন। অর্ণ বসেই তাঁর কাঠ খোলাই ছাপচিত্রেরসারা ভারতে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর সে সব চিত্রগুলো হলো সাঁতা মেরে, দের পথে ইত্যাদি।

শিল্পী শফিউজিন আহমেन তেলরঙেও অনেক ছবি এঁকেছেন। ছাপ পদ্ধতির চিত্রে যে সব বিষয়ে ছবি এঁকেছেন সেগুলো হলো- বন্যা, ছেলে, জান ও মাহ বিষয়ক ছবি, নৌকা, বড় ইত্যাদি নিসর্গচিত্র ও 'চোখ' বিষয়ে চিত্রকলা। শিল্পাচার্য আবেদিন তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন- শিল্পকার মান বিচারে অর্থাৎ কোন ছবিটি ভালো এবং কোনটির মান উত্তীর্ণ তা সঠিকভাবে বিচার করতে পারেন শিল্পী শফিউদ্দিন আহমেদ। জীবনে অনেক পুরস্কার ও সম্মানসহ একুশে পদক অর্জন করেছেন। ২০শে মে ২০১২ তারিখে এই প্রতিভাবান শিল্পী

কাজী আবুল কাশেম

একজন সফল পুস্তক চিত্রণের শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে বই, পত্রিকার প্রছন ও ইলাস্ট্রেশন (ছবি) তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ। 'দোপেয়াজা হরনামে রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্টুন এঁকে খ্যাতি লাভ করেন। শিশু ও কিশোরদের জন্য লিখেছেন এবং শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। তাঁর জন্ম ১৯১৩ সালে ফরিদপুরে। ছবি আঁকা শিখেছেন নিজের চেষ্টায় কোনো পার্টসে পড়ার সুযোগ পাননি । শিশুদের বইয়ে ছবি আঁকার জন্য কয়েকবার জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে পুরস্কৃত হন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন।

দেশ-বিদেশের উল্লেখযোগ্য শিল্পী ও শিল্পকর্মকরেছেন তিনি। এঁদের ধারাবাহিকতায় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান ও অন্যান্য শিল্পীরাও চিত্রকলার ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে লোকজ ধারায় কাজ করে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচকে বিষয় করে পাপেট শিল্পকে জনপ্রিয় করেছেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার।

বাংলাদেশের লোকজ ঐতিহ্য ইতিহাসের ফসল। ভিত্তি তার কৃষিজ প্রকাশ তার বিভিন্ন। নকশিকাথা, সরা, পুতুল, শীতলপাটি, হাঁড়ি, বাঁশ ও বেতের কাজ হচ্ছে লোকজ শিল্প বা আমাদের ঐতিহ্যের রূপ। আর এর সাথে আছে আমাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস।

শিল্পকলার এই যে ঐতিহ্য এটা যেমন হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতায় চলে এসেছে, তেমনি বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, আমাদের লাল সবুজ পতাকা। তিরিশ লক্ষ শহিদের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই মাতৃভূমি। আপামর জনসাধারণের সাথে আমাদের প্রথিতযশা চিত্রশিল্পীরাও সেদিন তাঁদের রং-তুলি নিয়ে পোস্টার, ফেস্টুন, প্লাকার্ডে তদানীন্তন স্বাধীনতা বিরোধী পশ্চিমাগোষ্ঠী হায়েনাদের রূপটি তুলে ধরে উজ্জীবিত করেছিলেন এদেশের মুক্তিকামী মানুষদের। যার নিদর্শন হিসেবে আমরা দেখতে পাই কামরূল হাসানের সেই বিখ্যাত পোস্টার ইয়াহিয়ার ছবি সম্বলিত লেখা 'এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে। তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এদেশে যেসকল ভাস্কর্য বিশেষ করে অপরাজেয় বাংলা, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, শাবাশ বাংলাদেশ, জাগ্রত চৌরঙ্গী, সংশপ্তক এবং শহিদমিনার, মৃতিসৌধসহ বাংলাদেশের নানান জায়গায় যেসকল ভাস্কর্য ও স্মৃতি তৈরি হয়েছে, তার মাঝে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যা যুগ যুগ ধরে এ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং এর ফলে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে আমাদের শিল্প- সাহিত্যের অঙ্গনে একটা ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও সংগীতের মতো চিত্রকলার ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধ এসেছে তার বহুমাত্রিক রূপ নিয়ে। আমাদের শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে অজস্র শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন এবং করছেন।

Content added By