সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - শিল্প ও সংস্কৃতি - NCTB BOOK

ভূবনজোড়া আমাদের এই প্রকৃতির পাঠশালাতে আমরা প্রতিমুহূর্তে কত কিছু দেখছি, জানছি আর শিখছি! উপরের কবিতাটিতে কবি সহজ করে বুঝিয়েছেন প্রকৃতির নানা উপাদান আর বিষয়বস্তু আকাশ, বাতাস, পাহাড়, নদী, মাটি, সাগর আমাদের কি শিক্ষা দেয় । এবার নিবিড় প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে আমরা শুরু করব আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির পাঠ ।

নয়ন মেলে এবার একবার নিজের চারপাশটা দেখি চলো, প্রকৃতির উপাদান আর বিষয়বস্তুর মধ্যে শিল্পীর চোখ দিয়ে খুঁজে দেখি ছবি আঁকার উপাদান। নিজের চারপাশে প্রকৃতির অজস্র উপাদানের মধ্যে যে উপাদানটা আমরা সবচেয়ে বেশি দেখতে পাই তা হলো গাছ। কত রকমের গাছপালায় ভরা আমাদের প্রকৃতি আর কতই না বিচিত্র তাদের ডালপালা আর কাণ্ডের ধরন। এ যেন প্রকৃতি জুড়ে সোজা, বাঁকা, কোণাকুণি রেখার সমারোহ। এবার আর একটু গাছের কাছে গেলে হয়তো বা দেখতে পাব গাছের নীচে ধীর গতিতে হেঁটে চলা শামুক। তার খোলশটা দেখতে আবার প্যাঁচানো রেখার মতো। আকাশের মেঘ, নদীর ঢেউগুলো দেখতে অনেকটা ঢেউ খেলানো রেখার মতো, এইভাবে খুঁজে দেখলে আমরা আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে খুঁজে পাবো নানা রকমের রেখা।

রেখার ঘের দিয়ে তৈরি হয় আকার। যেমন—একটি রেখার এক প্রান্ত যখন অন্য প্রান্তকে স্পর্শ করে তখনই আকার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ আকার হলো বাইরের রেখা বা সীমা রেখায় আবদ্ধ একটি রূপ। ছবিতে আকারগুলো সাধারণত দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে দ্বিমাত্রিক ভাবে আঁকা হয়, কোন গভীরতা থাকে না। সাধারণভাবে আকার দুই প্রকার, প্রাকৃতিক ও জ্যামিতিক। আকৃতি বলতে বুঝায় কোন বস্তু কতটা ছোট বা বড় তাকে। তবে সাধারণ ও ব্যবহারিক বাংলায় আকার-আকৃতি শব্দ দুটোকে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়।

গড়া থেকে গড়ন, গড়ন হলো বস্তুর ত্রিমাত্রিক রূপ। যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বেধ আছে অর্থাৎ গভীরতার দিকে ও বস্তুটির যে দিকগুলো আছে সে গুলোকে মিলিয়ে যখন রূপটিকে আমরা তুলে ধরি তখন সেটা হয় গড়ন। ছবি আঁকার জগতে আকারের মতো গড়নেরও আছে ভিন্নতা, কোনোটা প্রাকৃতিক যেমন – ফুল, পাখি, লতা, পাতা, গাছপালা এইসব আবার কোনোটি জ্যামিতিক-ত্রিভূজ, চতুর্ভূজ, বৃত্ত, কোণ, সিলিন্ডার ইত্যাদি।

সূর্যের সাত রঙা আলোরা প্রতিনিয়ত রাঙিয়ে দিচ্ছে আমাদের চারপাশকে। সূর্যের সে সাত রঙা আলো নিয়ে আরো অনেক মজার মজার কথা আমরা বিজ্ঞান বিষয়ে জানতে পারব। কিন্তু এখানে আমরা জানব ছবি আঁকার বৰ্ণিল জগত সম্পর্কে।

আমাদের চারপাশের প্রকৃতির অজস্র রঙের মধ্য হতে যে রংটি আমরা বেশি দেখতে পাই তা হলো সবুজ। মাঠের ঘাস, গাছে পাতা, কাঁচা ফল, সব মিলিয়ে কত্ত রকমের সবুজ ছড়িয়ে আছে আমাদের প্রকৃতিতে। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, ছবি আঁকার জগতে বর্ণচক্রে প্রাথমিক রংগুলো হলো লাল, নীল, হলুদ । নীল আর হলুদ রং মিলে তৈরি হয় সবুজ, লাল আর হলুদ মিলে হয় কমলা, লাল আর নীলে হয় বেগুনি। সবুজ, কমলা, বেগুনি হলো দ্বিতীয় স্তরের রং। আবার একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রকৃতির সবুজ রঙের মধ্যেও রয়েছে বৈচিত্র্য। কোনোটি হলদে সবুজ আবার কোনোটি নীলচে সবুজ তেমনি কমলা রঙের মধ্যে কোনোটি হলদে কমলাতো আবার কোনটি লালচে কমলা, বেগুনি রঙের মধ্যে কোনোটি লালচে বেগুনি আবার কোনোটি নীলচে বেগুনি । রঙের এই পার্থক্যগুলো আমরা তৃতীয় স্তরের বর্ণচক্রে জানতে পারব।

কোনো বস্তুর যে অংশে আলো পড়ে তার অন্য প্রান্তে তখন ছায়া তৈরি হয়। যেমন আমরা যদি সূর্যের আলোর দিকে মুখ করে দাড়িই আমাদের বিপরীত পাশটা তখন ছায়ার দিকে থাকে। এই ভাবে আলোছায়ার কারণে আমরা বস্তুর গঠন বুঝতে পারি।

আবার আমাদের চারপাশের উপাদান গলো দেখে, স্পর্শ করে আমরা তাদের ধরণ বা বুনট বুঝতে পারি।

রেখা দিয়ে তৈরি আকার-আকৃতির মধ্যবর্তী দুরত্বকে বলা হয় পরিসর। প্রকৃতির এইসব বিষয়বস্তু আর উপাদান গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আমরা জেনে ফেললাম ছবির উপাদানগুলোকে।

এর মাঝে খেয়াল করেছ বাতাসে গাছটি একদিক থেকে অন্য দিকে দুলছে আর গাছের নীচে ধীর গতিতে চলা প্যাচানো খোলসের শামুকটির পাশে দ্রুত গতিতে উড়ে চলছে হরেক রঙের প্রজাপতি। ঠিক তেমনি করে আমরাও যখন কোন অভিব্যাক্তি বুঝাতে হাত, পা অথবা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছন্দময় ভাবে পরিচালনা করি নাচের ভাষায় তাকে বলে চলন।

তেমনি হাতের বিভিন্ন ভঙ্গির মধ্যদিয়ে যখন কোন আভিব্যাক্তি প্রকাশ করি নাচের জগতে তার নাম মুদ্রা। এর মাঝে আকাশের উজ্জ্বল আলোটা একটু কমে গিয়ে সূর্যটা মেঘের ভিতরে লুকালো আলোছায়ার ভেতর দিয়ে প্রকৃতি জানালো তার আনন্দ বেদনার গল্প, আর এই রকমের বিভিন্ন মুখভঙ্গির মধ্যদিয়ে অভিব্যক্তির প্রকাশকে নাচের জগতে রস নামে পরিচিত।

এবার প্রকৃতিতে একটু কান পেতে শুনি, বাতাসে দুলে ওঠা গাছটির পাতায় পাতায় ধাক্কা লেগে তৈরি হওয়া শব্দটা শুনতে পাচ্ছি কি? সাথে গাছটির ডালে বসে সুমধুর সুরে ডেকে যাওয়া একটি পাখির ডাক! বাতাসের শব্দ আর পাখির সুমধুর সুরের মধ্যদিয়ে আমরা চলে এলাম সংগীতের জগতে। মানুষ, জীবজন্তু, পশুপাখির কন্ঠ হতে অথবা পদার্থের আঘাতে যে আওয়াজ বা শব্দ হয় তাকে ধ্বনি বলে। আর গ্রহণযোগ্য শ্রুতিমধুর ধ্বনিকে সংগীতে স্বর বলে। সংগীতের মূল স্বর হলো ৭টি— সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি । একাধিক স্বরের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় সুর ।

একটু খেয়াল করলে এবার আমরা বুঝতে পারব গাছের ডালে বসে গান গাওয়া পাখিটি একটি নির্দিষ্ট তালে সুমধুর স্বরে ডেকে যাচ্ছে যা কখনও দ্রুত আবার কখনও বা ধীর গতিতে। সংগীতের জগতে গতিকে বলে লয় যা-বিলম্বিতলয়, মধ্যলয়, দ্রুতলয় এই তিন নামে পরিচিত। সংগীতে লয়কে মাপা হয় মাত্রা দিয়ে, আর মাত্রার ছন্দবদ্ধ সমষ্টিকে বলা হয় তাল। যেমন-কাহারবা, দাদরা ইত্যাদি। নিয়মবদ্ধ মাত্রার সমাবেশই ছন্দ। গীত, বাদ্য আর নৃত্য এই তিনকে একসাথে সংগীত বলে ।

আপন মনে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান আর বিষয়বস্তু দেখার ভেতর দিয়ে আমরা আঁকা, গড়া, নাচ, গানের উপাদানগুলো সম্পর্কে কত কিছু জেনে ফেললাম। জেনে নেয়া বিষয়গুলোকে এবার আমরা নিজেদের মতো শিল্প সৃষ্টির কাজে লাগাব।

প্রথমে আমরা বর্ণচক্রের রংগুলোর সাথে মিলিয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপকরণ যেমন – রংবেরঙের ফুল, পাতা, ইত্যাদি সংগ্রহ করে একটা প্রাকৃতিক বর্ণচক্র বানাব।

                 সে এক মজার খেলা 

রঙের সাথে সাথে রং মিলিয়ে চলছে রঙের মেলা 

                 সে এক মজার খেলা 

নীল হলুদে সবুজ হবে কালো লালে খয়েরী 

সাদা কালো ছাইয়ের মতো রংটি হবে তৈরি 

গোলাপি চাও, লালে সাদা মেশাও যায় বেলা। 

                কমলা হবে লাল হলুদে, 

                     বেগুনি লাল নীলে। 

                 ফিকে হবে সব গাঢ় রং 

এমনি করে চলছে মধুর রং বানানোর খেলা।

 

যা করব— 

* বর্ণচক্রের রংগুলোর সাথে মিলিয়ে বিভিন্ন রঙের পাতা খুঁজে সংগ্রহ করব। 

* বর্ণচক্রের রংগুলোর সাথে মিলিয়ে বিভিন্ন রঙের ফুল খুঁজে সংগ্রহ করব। 

* গানের সাথে মিলিয়েও বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপকরণ যেমন-মাটি, ছাই সংগ্রহ করে রং বানানোর চেষ্টা করব। 

* খাতায় আঁকা পাতাগুলো রং করার ক্ষেত্রে গাঢ়-হালকা সবুজ রং এর পাশাপাশি অন্য রং মিলিয়ে দেখতে পারি কেমন হয়। যেমন- নীল, হলুদ, লাল ইত্যাদি রং মিশিয়ে দেখতে পারি । 

* রঙের গানটি ভালোভাবে আনুশীলন করব। 

* আনন্দময় ভঙ্গির মধ্যদিয়ে সবাই মিলে গানটি গাওয়ার চেষ্টা করব।

এইসব কাজ করার জন্য আমাদের একটা খাতা চাই। চলো তাহলে রং-বেরং এর কাগজ দিয়ে খাতাটা বানিয়ে ফেলি। খাতাটার মলাটে নিজের মত সুন্দর করে নকশা করা চাই কিন্তু। এই খাতায় আমরা বিভিন্ন সময়ে যা কিছু সংগ্রহ করব যেমন পাতা, ফুল, পত্রিকার অংশ ইত্যাদি যা আমাদের পছন্দের তা আঠা দিয়ে সংরক্ষণ করব। যা কিছু আঁকা/লেখা তাও কিন্তু করতে হবে এই খাতায়। নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়ের কাজ আর চর্চাগুলো সম্পর্কেও লিখে রাখব এই খাতায়। খাতাটি হবে আমাদের সবসময়ের সঙ্গী। যা হবে আমাদের বন্ধুখাতা।

 

Content added By