সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - হিন্দু ধর্ম শিক্ষা - NCTB BOOK

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে

এই দুই লাইনের মাধ্যমে আমরা কৃষ্ণের বন্দনা করছি। কৃষ্ণকে ভালোবেসে অনেক মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারী নিজেদের জীবন মানব কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। এ রকম কয়েকজন মহাপুরুষ এবং মহীয়সী নারীর জীবন সম্পর্কে এখন আমরা জানব ।

Content added By

মীরাবাঈ ছিলেন একজন কৃষ্ণ সাধিকা। তিনি ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজস্থানের কুড়কী নামক গ্রামে রাঠোর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রত্নসিংহ এবং মাতা বীর কুঁয়রী। মীরা ছিলেন তাঁর পিতা মাতার একমাত্র আদরের সন্তান।

মীরাবাঈ

মাত্র আট বছর বয়সে মীরা তাঁর মাকে হারান। সে সময় মাতৃহারা মীরাকে নিয়ে তাঁর পিতা খুবই বিপদের মধ্যে পড়েন। তখন তাঁর পিতামহ রাও দুধাজী মীরাকে নিজের কাছে নিয়ে যান। পিতামহের রাজপ্রাসাদে মীরার শৈশব কাটতে থাকে। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তিনি প্রাসাদের কাছে একটি চতুর্ভুজজীর মন্দির তৈরি করেছিলেন। 

সেখানে সাধু সন্ন্যাসীরা ধর্মীয় আলোচনা করতেন। একবার এক সাধু মীরাকে গিরিধারী গোপালের একটি বিগ্রহ দেন। এই বিগ্রহের সেবা পূজা করেই মীরার সময় কাটত। তিনি প্রিয় গোপালকে নিজের লেখা গান শোনাতেন। ছোটবেলা থেকেই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।

মীরার বয়স যখন আঠারো। তখন চিতোরের রাণা সংগ্রাম সিংহের পুত্র ভোজরাজ সিংহের সঙ্গে মীরার বিয়ে হয়। শ্বশুর বাড়িতে তাঁর অসংখ্য দাস-দাসী ছিল। কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। কিন্তু এ রাজবাড়ি ও সংসারের প্রতি তাঁর কোনো আসক্তি ছিল না। তাঁর একমাত্র কাম্য বস্তু ছিল কৃষ্ণপ্রেম ও কৃষ্ণ আরাধনা। মাঝে মাঝেই তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে আপন মনে ভজন সংগীত গেয়ে উঠতেন। তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে স্বামী ভোজরাজ একটি কৃষ্ণমন্দির নির্মাণ করেন। মীরা খুশি হয়ে কৃষ্ণ ভজনে দিন অতিবাহিত করেন। মীরার কৃষ্ণপ্রেম এবং সুমধুর কণ্ঠে ভজন সঙ্গীতের কথা সর্বত্র প্রচারিত হয়। চিতোরের সাধারণ মানুষের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন কৃষ্ণসাধিকা মীরাবাঈ নামে।

রাজ পরিবারের অনেকেই মীরার এই জীবন যাত্রাকে মেনে নিতে পারেননি। এ অবস্থায় হঠাৎ করে তাঁর স্বামী ভোজরাজ সিংহ মারা যান। তখন চিতোরের নতুন রাণা হন বিক্রমজিৎ সিং। তিনি মীরাকে হত্যা করার জন্য বহুবার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবারই গিরিধারীর কৃপায় মীরা রক্ষা পান। শেষ পর্যন্ত মীরা তাঁর পিতৃগৃহ মেড়তায় ফিরে আসেন। কিন্তু এখানেও তাঁর ঠাঁই হয়নি। তাঁর কাকার বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের কারণে মীরা চলে যান বৃন্দাবনে। বৃন্দাবনে এসে মীরা তীব্রভাবে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমভক্তিতে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তারপর একদিন তিনি বৃন্দাবনের লীলা সাঙ্গ করে কৃষ্ণের স্মৃতি বিজড়িত দ্বারকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। দ্বারকা ধামে এসে রণছোরজীর বিগ্রহের ভজন-পূজনেই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটান। এই দ্বারকা ধামেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
কৃষ্ণভক্ত মীরাবাঈ ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ভগবানকে পাওয়ার পথ দেখান। তাঁর রচিত ভজন সঙ্গীত এবং ভগবৎ সাধনা এক নতুন পথের সন্ধান দিয়ে গেছে। তাঁর দেখানো এই নতুন পথ হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির সৃষ্টি করে। এই সম্প্রীতি যে মিলনধারায় প্রকাশ পায় তার নাম ‘ভক্তিবাদ'। ভক্তিবাদের মূল উদ্দেশ্য সকল শ্রেণির মানুষকে সমান চোখে দেখা।

মীরাবাঈয়ের বাণী

  • মানবজীবনের একমাত্র কাম্যবস্তু হলো কৃষ্ণপ্রেম আর গিরিধারীলালের সাক্ষাৎ।
  • একমাত্র ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ভগবানকে পাওয়া সম্ভব।
  • মিথ্যা লোভ বা ছলনায় কখনও বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়ো না।
  • ভজন সঙ্গীত মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি তৈরি করে।

শিক্ষা: মীরাবাঈয়ের জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, যাঁরা প্রকৃত সাধক তাঁরা কখনো মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করেন না। এঁরা জাগতিক সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে যান। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সম্প্রীতির বাঁধনে বেঁধে রাখেন। দৈহিক জগতের মোহ ত্যাগ করে তাঁরা শুধু একাগ্র চিত্তে সাধনা করেন। আমরাও তাঁদের মতো সর্বদা ঈশ্বরের নাম স্মরণ করব। কর্তব্য কর্মে কোনো অবহেলা করব না। ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব। জ্ঞানের আলো দিয়ে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার দূর করব।

Content added || updated By

প্রভু নিত্যানন্দ ১৪৭৩ সালে বীরভূম জেলার একচক্রা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হারাই পণ্ডিত এবং মাতার নাম পদ্মাবতী।তাঁর প্রকৃত নাম ছিল কুবের। গ্রামের পাঠশালায় তাঁর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ার চেয়ে ধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল বেশি। তাঁর বয়সি ছেলেরা যখন খেলাধুলায় ব্যস্ত তখন তিনি মন্দিরে গিয়ে বসে থাকতেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই রামায়ণ, মহাভারতের চরিত্রগুলোয় অভিনয় করতেন। সারাক্ষণ কৃষ্ণচিন্তায় মগ্ন থাকতেন। কী করলে শ্রীহরির দর্শন পাওয়া যাবে এটাই ছিল তাঁর সর্বক্ষণের ভাবনা ।

প্রভু নিত্যানন্দ ও তার ভক্তরা

কুবেরের বয়স তখন বারো বছর। একদিন এক সন্ন্যাসী তাঁদের বাড়িতে এলেন। কুবের তখন সন্ন্যাসীর সঙ্গে বৃন্দাবনে যাওয়ার বায়না ধরেন। কুবের নাছোড়বান্দা, তিনি সন্ন্যাসীর সাথে বৃন্দাবনে যাবেনই। কেননা তিনি জানতেন বৃন্দাবন শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র। অবশেষে পিতামাতার সম্মতি মিলল। তিনি সেই সন্ন্যাসীর সঙ্গে গৃহত্যাগ করলেন। তাঁরা দুজনে একত্রে বহু তীর্থস্থান ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। হঠাৎ কুবের একদিন সন্ন্যাসীকে হারিয়ে ফেললেন। এরপর তিনি একাই বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। এভাবে একদিন তিনি উপস্থিত হলেন কাঙ্ক্ষিত বৃন্দাবনে। সেখানে তাঁর দেখা হয় পরম সন্ন্যাসী শ্রীপাদ মানবেন্দ্রপুরীর সাথে। তাঁর কাছ থেকে তিনি কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নেন। তিনি কৃষ্ণচিন্তায় বিভোর থাকেন। শ্রীহরির চিন্তায় তাঁর দিন কাটতে থাকে। হঠাৎ একদিন তিনি কৃষ্ণকে স্বপ্নে দেখতে পান। স্বপ্নে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে নবদ্বীপে যাওয়ার আদেশ দেন। এরপরেই তিনি বৃন্দাবন ছেড়ে নবদ্বীপের পথে রওনা হলেন। এখানে তাঁর সঙ্গে নিমাই পণ্ডিতের সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা দুজনে মিলে যেন এক হয়ে যান। জীবোদ্ধারের জন্য যেন দুই দেহে তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে। সেদিন থেকে কুবেরের নতুন নাম হলো নিত্যানন্দ। সংক্ষেপে নিতাই। আর গৌরাঙ্গের সংক্ষিপ্ত নাম গৌর। ভক্তরা সংক্ষেপে বলতেন গৌরনিতাই। নবদ্বীপে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর তাঁরা উভয়ে মিলে হরিনামে মেতে ওঠেন। তাঁরা সকল শ্রেণির মানুষের কাছে বৈষ্ণব মত প্রচার করতে থাকেন। তাঁদের প্রেমধর্মে ছিল না কোনো জাতিভেদ বা উঁচুনীচু ভেদাভেদ। যখন শুদ্ধাচরণের নিচে চাপা পড়েছিল মানবপ্রেম তখনই প্রেমভক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে লোক তাঁদের অনুসারী হতে লাগলেন।

নবদ্বীপে তাঁরা নেচেগেয়ে হরিনাম প্রচার করতে লাগলেন। সেই সময় নবদ্বীপে জগাই-মাধাই নামে দুই ভাই নগর কোতোয়ালের কাজ করত। তাঁরা ছিল মদ্যপ ও হরিবিদ্বেষী। যে কোনো অন্যায় কাজ করতে তারা দ্বিধা করত না। গৌরনিতাই প্রেমভক্তি দিয়ে জগাইমাধাইকে উদ্ধার করেন। এদের দুই ভাইয়ের জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তারাও তখন নবদ্বীপে কৃষ্ণনামে মাতোয়ারা হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরে শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু সন্ন্যাস নিয়ে নীলাচলে চলে যান। প্রভু নিত্যানন্দ শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নির্দেশ মতো গৌড়ে গিয়ে বিদ্বান, মূর্খ, চণ্ডাল, ধনী, দরিদ্র সকলের মধ্যে হরিনাম আর প্রেমধর্ম বিতরণ করতে লাগলেন। তিনি সকলকে এক কৃষ্ণ নামে আবদ্ধ করলেন। সার্থক হলো তাঁর প্রেমভক্তি ও কৃষ্ণ নামের আন্দোলন। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু গৌড়বাসীর অন্তরে চির অমর হয়ে থাকেন। ১৫৪২ সালে এই মহাসাধক ইহলোক ত্যাগ করেন।

প্রভু নিত্যানন্দ কোনো তর্কবিতর্ক ছাড়া ধর্মের কোনো বিচার-বিশ্লেষণ না করেই সকলের মধ্যে প্রেমভক্তি বিতরণ করেছেন। তিনি কখনোই ধর্ম নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করেননি। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ করেননি। তিনি হিন্দুধর্ম ও সমাজ জীবনে এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ফলে সাধারণ মানুষ সমস্ত কিছু ভুলে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। যে কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁর কাছে এসে পরম শান্তি লাভ করত। এমনিভাবে অসংখ্য মানুষ প্রভু নিত্যানন্দের সংস্পর্শে এসে নবজীবন লাভ করেন। সার্থক হয় প্রেমভক্তি ও কৃষ্ণনামের আন্দোলন। আমরাও তাঁর মতো সকল মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখব। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ করব না। সকলকে সম্প্রীতির বাঁধনে বেঁধে রাখব।

প্রভু নিত্যানন্দের বাণী

  • মানুষে মানুষে কোনো উঁচু-নিচু ভেদাভেদ করবে না।
  • একমাত্র প্রেমভক্তি ও মানবপ্রেম দিয়ে মানুষকে আপন করা যায়।
  • কাউকে যদি ক্ষমা করো, তাহলে তুমিও ক্ষমা পাবে।
  • সকলকে এক কৃষ্ণনামে আবদ্ধ হতে হবে।
  • সংসারে সংসারী হয়ে কৃষ্ণনাম নিতে হবে।
     
Content added By

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রাচীনপন্থীদের ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি প্রবল হয়ে উঠে। এদের হিংসা-বিদ্বেষ গোটা সমাজজীবনকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলে। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে জর্জরিত মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধ ভুলে দিশাহারা হয়ে পড়ে। ঠিক এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ই মে পতিতপাবন প্ৰভু জগদ্বন্ধুর আবির্ভাব হয়। তাঁর পিতা দীননাথ চক্রবর্তী এবং মাতা বামাদেবী।
পণ্ডিত দীননাথ চক্রবর্তী বাস করতেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ডাহাপাড়া গ্রামে। তিনি ছিলেন একজন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি ন্যায়রত্ন উপাধি পেয়েছিলেন। প্রভু জগদ্বন্ধু দেখতে ছিলেন খুব সুন্দর। তাঁর গায়ের রঙ ছিল কাঁচা সোনার মতো।

প্রভু জগদ্বন্ধু

জগদ্বন্ধুর বয়স যখন মাত্র চৌদ্দমাস তখন তাঁর মা মারা যান। দীননাথ তখন এই ছোট শিশুটিকে নিয়ে তাঁর নিজের গ্রাম গোবিন্দপুরে ফিরে আসেন। তখন জগদ্বন্ধুর লালনপালনের ভার পড়ে তাঁর জেঠতুত বোন দিগম্বরী দেবীর ওপর। জগদ্বন্ধুর বয়স যখন পাঁচবছর তখন তাঁর বাবাও মারা যান। এর কয়েক মাস পর চক্রবর্তী পরিবার চলে আসে ফরিদপুরের শহরতলী ব্রাহ্মণকান্দায়। জগদ্বন্ধু ফরিদপুর জেলা স্কুলে লেখাপড়া শুরু করলেও শেষ করেন পাবনা জেলা স্কুলে। পাবনা শহরের উপকণ্ঠে ছিল এক প্রাচীন বটগাছ। তার নিচে থাকতেন এক বাকসিদ্ধ মহাপুরুষ। লোকে তাঁকে ‘ক্ষ্যাপাবাবা বলে ডাকত। একদিন তাঁর সাথে জগদ্বন্ধুর সাক্ষাৎ হয়। জগদ্বন্ধুর সাথে তাঁর ভাব জমে যায়। জগদ্বন্ধু তাঁকে ‘বুড়ো শিব’ বলে ডাকতেন। জগদ্বন্ধু অবসর পেলেই সেই বটগাছের নিচে গিয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যেতেন।

কিছুদিনের মধ্যে শহর ও শহরতলিতে তাঁর এক তরুণ ভক্তদল গড়ে ওঠে। প্রভু জগদ্বন্ধু একদিন ভক্তদের ছেড়ে তীর্থ ভ্রমণে বের হন। তিনি বিভিন্ন তীর্থস্থান ও গ্রামগঞ্জে হরিনাম বিলিয়ে উপস্থিত হন শ্রীধাম বৃন্দাবনে। সেখানে তাঁর সাধনা চলতে থাকে গভীর থেকে গভীরে। বৃন্দাবনে কিছুকাল থেকে তিনি ফিরে আসেন ফরিদপুরে। ফরিদপুরের উপকণ্ঠে ছিল বুনোবাগদি, সাঁওতাল প্রভৃতি শ্রেণির বাস । তখনকার সমাজপতিদের দৃষ্টিতে তারা ছিল ঘৃণ্য ও অস্পৃশ্য। এদের অনেকেই একটু সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে এবং দরিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে ধর্মান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক সেই সময় জগদ্বন্ধুর কৃপাদৃষ্টি পড়ে এসব হতদরিদ্র ও অসহায় লোকদের ওপর। তিনি বাগদিদের সর্দার রজনীকে ভালোবেসে বুকে টেনে নেন। রজনী বলেন, ‘আমরা নিচু জাতি। সবাই আমাদের ঘৃণা করে আর তুমি আমাকে বুকে টেনে নিলে!' প্ৰভু বললেন, “মানুষের মধ্যে কোনো উঁচু নিচু নেই। সবাই সমান।

সবাই আমরা ঈশ্বরের সন্তান। ভগবান মানুষের মধ্যেই আছেন। মানুষের মধ্যে কখনও বর্ণগত ও জাতিগত বৈষম্য হতে পারে না। ছোট বড় ভেদাভেদ শুধু তার গুণ ও কর্মের মাধ্যমে। তোমরা সবাই শ্রীহরির দাস। আজ থেকে তোমার নাম হরিদাস মোহন্ত।” তাঁর ভক্ত হরিদাস মোহন্ত অল্পদিনের মধ্যেই প্রভুর কৃপায় প্রসিদ্ধ পদকীর্তনীয়া রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ধীরে ধীরে যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল প্রভৃতি জেলায় হরিনাম কীর্তনের এক অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যায়। প্রভু একদিন ভক্তদের নিয়ে ভ্রমণে বের হয়েছেন। ফরিদপুর শহরের এক জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় এসে তিনি বলেন, “এখানেই আমি শ্রীঅঙ্গন প্রতিষ্ঠা করতে চাই।” সেই সময় শ্রীরামকুমার মুদি নামে এক ভক্ত শ্রীঅঙ্গন প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেন। প্রভুর নির্দেশেই ১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন। বহু গুণীজন ও ভক্ত অনুরাগীর পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে এ পবিত্র তীর্থভূমি শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন।

এই শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনেই শুরু হয় প্রভুর গম্ভীরা লীলা। ১৯০২ সাল থেকে শুরু করে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলে প্রভুর গম্ভীরা লীলা। এ সময় তিনি ছিলেন মৌনী। এর তিন বছর পর ১৯২১ সালে এই শ্রীঅঙ্গনেই প্ৰভু ইহলীলা সংবরণ করেন।

প্রভু জগদ্বন্ধুর জীবনে দুটি দিক রয়েছে। একটি তাঁর আধ্যাত্মিক দিক। অন্যটি সমাজে পিছিয়ে পড়া অসহায় মানুষের জন্য তাঁর বন্ধুরূপ প্রকাশ। তিনি ছিলেন মানবতার মূর্ত প্রতীক। অসহায় নিষ্পেষিত জীবকে উদ্ধারের জন্য তিনি এবং তাঁর ভক্তরা সর্বত্র হরিনাম কীর্তন প্রচার করেন। প্রভুর আগমন বার্তা এবং হরিনাম কীর্তনের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে মহানাম সম্প্রদায়। এ সম্প্রদায় গঠনে শ্রীপাদমহেন্দ্ৰজী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মহানাম সম্প্রদায় মানবতার পাঁচটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যথা : (১) চুরি না করা (২) হিংসা না করা (৩) সত্যবাদী হওয়া (৪) আত্মসংযমী হওয়া এবং (৫) অন্তরে ও বাহিরে শুচি বা পবিত্র থাকা। প্রভু জগদ্বন্ধু শ্রীশ্রী হরিকথা, ত্রিকাল, চন্দ্রপাত গ্রন্থসহ বহু কীর্তন রচনা করেছেন।

প্রভু জগদ্বন্ধুর কয়েকটি বাণী

  • ভ্রষ্টবুদ্ধি হয়ে মাতা-পিতার মনে কষ্ট দিতে নেই।
  • যে সংসারে শান্তি পায় না, সে সংসার ত্যাগ করলেও শান্তি পায় না।
  • কেউ মূর্খ থাকিও না। মূর্খ আমার কথা বুঝিতে পারিবে না। অজ্ঞানের হরিভক্তি হয় না।
  • পরচর্চা কর্ণে বা অন্তরে স্থান দিও না। পরচর্চা, পরনিন্দা ত্যাগ করো। ঘরের দেয়ালে লিখে রেখ, পরচর্চা নিষেধ।
  • জীবদেহে নিত্যানন্দের বসবাস। কোনো জীবকে আঘাত করলে নিত্যানন্দকে আঘাত করা হয়।

শিক্ষা : প্রভু জগদ্বন্ধুর জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, সব মানুষ সমান, কেউ উঁচু-নিচু নয়। কোনো মানুষই ঘৃণ্য বা অস্পৃশ্য নয়। তিনি তাঁর প্রেম ভক্তি দিয়ে ম্লেচ্ছ, চণ্ডাল থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষকে মানব ধর্মে দীক্ষিত করেন। আমরাও তাঁর মতো সকল মানুষকে ভালোবাসব। কারো মনে আঘাত দিব না। কারণ মানুষকে আঘাত দিলে সে আঘাত নিত্যানন্দকে বা ভগবানকে দেয়া হয়। পিতামাতা হচ্ছেন পরম গুরু। তাঁদেরকে কষ্ট দিব না। তিনি শিক্ষা গ্রহণের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই আমরাও জগদ্বন্ধুর কথা মেনে মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করব। কাজের মধ্যে সর্বদা হরিনাম করব। পরচর্চা ও পরনিন্দা করব না। এই শিক্ষাগুলো আমরাও আমাদের জীবনে মেনে চলব।
 

Content added By

স্বামী স্বরূপানন্দ ১৮৭১ সালে ৮ই জুলাই চাঁদপুরের পুরাতন আদালত পাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সতীশ চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ও মাতা মায়াদেবী। স্বামী স্বরূপানন্দের পূর্ণ নাম ছিল অজয় হরি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর ডাক নাম ছিল বল্টু। ছোটবেলা থেকেই বল্টুর জীবনে কিছু অসাধারণ লক্ষণ দেখা যায়। শৈশবে প্রায় সময়ই তিনি ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ছোটবেলায় একবার তিনি
তাঁর বন্ধুদের মাঠে নিয়ে যান খেলার কথা বলে। কিন্তু তিনি বন্ধুদের সাথে সাধারণ কোনো খেলা খেলেননি। আসনে বসে বন্ধুদের তিনি শ্রীহরির নাম জপ করতে বলেন। বন্ধুরা সবাই বল্টুর কথামতো শ্রীহরির নাম জপ করতে থাকে। একসময় তারা সকলে একে একে বাড়ি চলে যায়। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেলেও বল্টু বাড়ি ফিরে যায়নি। মা-বাবা দুঃচিন্তায় বল্টুর খোঁজে বের হন। শেষ পর্যন্ত তাঁর সন্ধান মেলে নির্জন এক স্থানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। জীবনের দুঃখ, সংকট ও মানবিক দুর্দশা তাঁকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে অনুপ্রাণিত করেছিল।
তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন যোগীপুরুষ এবং পিতা স্বভাব কবি। স্বরূপানন্দ ছিলেন তাঁদের সবগুলো গুণের উত্তরাধিকারী। তাঁর জীবনে আধ্যাত্মিকতা, কাব্য, সংগীত, সাহিত্য, লোকশিক্ষা, বিজ্ঞান ও বিপ্লববাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে।

স্বামী স্বরুপানন্দ

স্বামী স্বরূপানন্দ ১৮৯৮ সালে চেন্নাই যান। তিনি চেন্নাই থাকাকালীন শ্রীরামকৃষ্ণের আদেশে ইংরেজি ভাষায় মাসিক সাময়িকী ‘প্রবুদ্ধ ভারত' -এর সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন।

স্বামী স্বরূপানন্দ বেলুড়ে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগান বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর পিতা মাতা তাঁকে স্বামী বিবেকানন্দের কাছে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দিলেন। তিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে বিভিন্ন দেশ ঘুরে সাধন ভজনে সিদ্ধি লাভ করেন। ফিরে এসে তিনি হয়ে ওঠেন এক নতুন মহামন্ত্রের দিশারী, ওঙ্কার সাধক শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ ।

স্বামী স্বরূপানন্দ ওঙ্কার সাধনার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে সর্ব মন্ত্রের সেরা মন্ত্র ওঙ্কার সাধনার ইচ্ছা জেগেছিল। ছেলেবেলায় শত চেষ্টা করেও তাঁকে কেউ এই ওঙ্কার সাধনা থেকে বিচ্যুত করতে পারেননি। তিনি বলেন, “ওঙ্কার সর্ব মন্ত্রের প্রাণ, সর্ব মন্ত্রের সমন্বয় এবং সর্ব তত্ত্বের স্বীকৃতি।” নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র সকল শ্রেণি পেশার লোক যাতে একত্রে উপাসনা করতে পারেন সে জন্য তিনি সমবেত উপাসনার প্রবর্তন করেন। তিনি বলেন, সমবেত উপাসনায় যে যার সাধ্যমতো পূজার সামগ্রী নিয়ে আসবে। সমবেত উপাসনা সকলকে এক কাতারে নিয়ে আসে। এখানে সবাই মিলে এক হয়। সমবেত উপাসনায় কোনো সম্মান অসম্মানের প্রশ্ন থাকে না। তিনি আরো বলেন, আমরা শুধু নিজের মুক্তির জন্যই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব না ।

আমাদের তপস্যা হবে জগতের সকলের কল্যাণ এবং সকলের মুক্তির জন্য। ১৯০৬ সালের ২৭শে জুন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

স্বামী স্বরূপানন্দ শুধু আধ্যাত্মিক চর্চা ও তপস্যাই করতেন না। তিনি অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন। দুর্ভিক্ষ কবলিত অসহায় মানুষকে উদ্ধার করতে তিনি ছুটে যেতেন। দরিদ্র মানুষের খাদ্য ঘাটতি মেটাতে সাহায্য করেছেন সাধারণ কৃষকদের উন্নতির জন্য তিনি আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি কয়েকটি স্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয় ও জনহিতকর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন

স্বামী স্বরূপানন্দের বাণী

  • ভিক্ষা করো না, কর্ম করো।
  • বীজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হবে তার ফলকে দিয়ে।
  • ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হয় সেই ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের শ্রেষ্ঠতা দিয়ে।
  • নিখিল বিশ্বের কুশল হোক, জাতি বৈর নির্মূল হোক।
  • সাম্প্রদায়িকতার অবসান হোক।

শিক্ষা: স্বামী স্বরূপানন্দের জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, বিপদে আর্ত পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সাধ্যমত তাদেরকে সবরকম সহযোগিতা করতে হবে। জীবের সেবা মানেই ঈশ্বরের সেবা করা। তাই সৰ্ব জীবের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে।

Content added By

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র পাবনা জেলার হিমাইতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা ১২৯৫ সালের ৩০ শে ভাদ্র (ইংরেজি ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর), শুক্রবার শুভ তালনবমী তিথিতে শিবচন্দ্র চক্রবর্তীর ঘরে মাতা মনোমোহিনী দেবীর কোলে জন্ম নেয় এক শিশু। শুভদিনে মাতা মনোমোহিনী দেবী নিজ পুত্রের নাম রাখেন অনুকূলচন্দ্র। অনুকূলচন্দ্রের পিতা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ আর মাতা মনোমোহিনী দেবী ছিলেন অত্যন্ত ইষ্টপ্রাণ একজন রমণী।

পাবনার হিমাইতপুরেই অনুকূলচন্দ্রের শৈশব, বাল্য ও কৈশোর অতিক্রান্ত হয়। পাঁচ বছর বয়সে ভগবান শিরোমণি আর সূর্য শাস্ত্রীর নিকট বালক অনুকূলচন্দ্রের হাতেখড়ি সম্পন্ন হয়। প্রথমে কাশীপুর-হাটতলায় কেষ্ট বৈরাগীর পাঠশালায় তিনি পাঠ গ্রহণ শুরু করেন। পরে তিনি পাবনা ইন্সটিটিউশনে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। এরপরে তিনি পড়াশুনা করেন পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য মনোনীত হন। পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতিও নেন। এর মধ্যে তিনি জানতে পারেন, তাঁরই এক সহপাঠী টাকার অভাবে পরীক্ষার ফি দিতে পারছেন না। এগিয়ে এলেন অনুকূল। নিজের প্রবেশিকা পরীক্ষার ফি দিয়ে দিলেন বন্ধুকে। সেবার আর তাঁর পরীক্ষা দেয়া হলো না। অনুকূল পাশ করলেন পরের বছর। মায়ের ইচ্ছায় এরপর তিনি ভর্তি হলেন কোলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে। এখানেও তিনি স্থানীয় কুলিমজুরদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছেন।

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

চিকিৎসা বিদ্যা শেষ করে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। এসেই তিনি গ্রামের গরীব দুঃখী মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, মানুষের দুঃখ দূর করতে হলে শুধু শারীরিক চিকিৎসা নয়, মানসিক ও আত্মিক চিকিৎসারও প্রয়োজন আছে। এভাবে সারাজীবন তিনি গরীব-দুঃখী মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। শৈশবকাল থেকেই অনুকূলচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। মাতৃআজ্ঞা পালনে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। তিনি তাঁর বাণীতে বলেছেন, “মাতৃভক্তি অটুট যত, সেই ছেলেই হয় কৃতী তত।”

পিতার প্রতিও ছিল তাঁর সমান শ্রদ্ধা ও কর্তব্যবোধ। একবার পিতার অসুখের সময় সংসারে খুব অভাব- অনটন দেখা দিল। বালক অনুকূলচন্দ্র তখন নিঃশঙ্কচিত্তে সংসারের হাল ধরলেন। তিনি তখন প্রতিদিন আড়াই মাইল পথ পায়ে হেঁটে শহরে গিয়ে মুড়ি বিক্রি করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে বাবার জন্য ঔষধ-পথ্য ও সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী এনে মায়ের হাতে তুলে দিতেন। এভাবে তিনি পিতামাতাকে পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে নিরন্তর ভালোবেসেছেন। তিনি বলেছেন, “পিতায় শ্রদ্ধা মায়ে টান, সেই ছেলে হয় সাম্যপ্ৰাণ। ”

অনুকূলচন্দ্র ছিলেন সমাজের অসহায় অবহেলিতদের বন্ধু। তাদের নিয়ে তিনি কীর্তন দল গঠন করেন। কীর্তনের মধ্য দিয়ে তিনি তাদের মানসিক শান্তির বিধান করেন। অনেক শিক্ষিত তরুণও এগিয়ে আসেন। তার এই কীর্তন একসময় একটি আন্দোলনে পরিণত হয়। সবাই তাকে তখন ডাক্তার না বলে ‘ঠাকুর’ বলে ডাকত। সে থেকে তিনি ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র নামে পরিচিত হন। তার খ্যাতি ক্রমশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

সৎসঙ্গ আশ্রম ,পাবনা

মানুষ যাতে সৎ পথে থাকে, সৎ চিন্তা করে সেজন্য ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণের জন্য পাবনার হিমাইতপুরে গড়ে তোলেন সৎসঙ্গ আশ্রম। যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি, সস্ত্যয়ণী ও সদাচার এই পাঁচটি সৎসঙ্গের মূলনীতি।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুকূলচন্দ্র বিহারের দেওঘরে যান এবং সেখানে আদর্শ একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্যসম্প্রদায় এবং সৎসঙ্গের কর্মকাণ্ড উভয় বাংলার নানা অঞ্চলে আজও সক্রিয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর আশ্রম ও কার্যালয় আছে। এর মাধ্যমে জনগণকে সেবা দেওয়া হয়। প্রতি বছর ৩০শে ভাদ্র অসংখ্য ভক্তের মিলনে ঠাকুরের পুণ্য জন্মভূমি হিমাইতপুরে পবিত্র গঙ্গাস্নান উৎসব পালিত হয়।

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বিসত্যানুসরণ, পুণ্যপুঁথি, অনুশ্রুতি, চলার সাথীসহ বহু পুস্তক রচনা করেছেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ২৭ জানুয়ারি ৮১ বছর বয়সে অমৃতলোকে গমন করেন।

শিক্ষা বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের কিছু অমিয় বাণী হলো:-

১. অভ্যাস, ব্যবহার ভাল যত 

   শিক্ষাও তা’র জানিস্ তত। 

২. মুখে জানে ব্যবহারে নাই  

     সেই শিক্ষার মুখে ছাই ।

৩. ঝোঁক না বুঝে শিক্ষা দিলে 

     পদে-পদে কুফল মিলে।

৪. শিক্ষকতা করতে গেলেই 

     ছাত্রদের ধাত বুঝে নিও, 

     ভাল লাগার রকম দেখে 

     সেই পথেতে শিক্ষা দিও।

৫. শিক্ষা দিও এমনিভাবে 

    বুঝতে না পারে শিখছে সে, 

    শিক্ষা যদি ভীতি আনে 

    বুঝবে না সে তরাসে।

শিক্ষা: শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিক্ষা ছিল মানুষের কোনো ভেদাভেদ নাই। যে যে-সম্প্রদায়েরই হোক না কেন মনে রাখতে হবে ঈশ্বর এক ধর্ম এক। সংসারে থাকবে, মন রাখবে ভগবানে। শুধু লেখাপড়া করলেই বড় হওয়া যায় না, আচার ব্যবহার জানতে হয়। শিষ্টাচার, সততা, সময়ানুবর্তিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, সদাচার প্রভৃতি নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে হবে। সবসময় মানবসেবামূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের এই সব শিক্ষা স্মরণ রেখে আমরা পথ চলব এবং জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলব।

 

Content added By