পঞ্চম শ্রেণি (প্রাথমিক) - হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

শিষ্টাচার

আমরা আমাদের কোনো শিক্ষকের সম্মুখীন হলে তাঁকে প্রণাম করি। অন্য কোনো গুরুজনের প্রতিও সম্মান জানাই। তাঁদের সঙ্গে শান্ত নরম গলায় কথা বলি। আবার সহপাঠী বা সমবয়সী বন্ধুদের কুশল জিজ্ঞাসা করি, ‘কী খবর ? ভালো আছ তো ?” ছোটদের আদর করি। বড়দের সম্মান জানিয়ে চলা এবং বলা, সমবয়সীদের ও ছোটদের সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার, এই যে নম্র-ভদ্র আচরণ একেই বলে শিষ্টাচার।

শিষ্ট কথাটির অর্থ ‘ভদ্র’। ‘আচার’ মানে ব্যবহার। তাহলে শিষ্টাচার হলো শিষ্ট যে আচার অর্থাৎ নম্র ও ভদ্র ব্যবহার। শিষ্টাচার একটি নৈতিক গুণ এবং ধর্মের অঙ্গ ।

শিষ্টাচার আমাদের চরিত্রকে সুন্দর করে, উন্নত করে, পবিত্র করে। সজ্জন বা ধার্মিক ব্যক্তির চরিত্রের অন্যতম প্রধান গুণ এই শিষ্টাচার। শিষ্টাচারের দ্বারা মানুষের মন জয় করা যায়। এ গুণ থাকলে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়। বড়, সমবয়সী ও ছোটদের কাছ থেকে সম্মান পাওয়া যায়। আমরা যদি একে অন্যের প্রতি শিষ্টাচার প্রদর্শন করি, তাহলে আমাদের সমাজও থাকবে শান্ত-সুন্দর ।

আমরা জানি, জীবের মধ্যে আত্মারূপে ঈশ্বর বিরাজ করেন। তাই কারো প্রতি শিষ্টাচার প্রদর্শন মানে ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। এ কারণেও ছোট-বড় সকলের প্রতিই আমরা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি। আর এভাবেই শিষ্টাচার ধর্মের অঙ্গরূপে বিবেচিত হয়।

শিষ্টাচার প্রদর্শনের দুটি দৃষ্টান্ত দাও ৷

ভগবান শ্রীকৃষ্ণও শিষ্টাচারের আদর্শ প্রকাশ করেছেন। তাঁর শিষ্টাচারের একটি কাহিনী বলছি ।

 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শিষ্টাচার

আমরা জানি, ভগবান জীবের মঙ্গলের জন্য, ধর্ম বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, দুষ্টের দমন করতে পৃথিবীতে নেমে আসেন। ভগবান এভাবে পৃথিবীতে অবতরণ করেন বা নেমে আসেন বলে তাকে অবতার বলা হয় ৷

দ্বাপর যুগে ভগবান স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণরূপে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন। তাই তো বলা হয় ‘কৃষ্ণস্ত ভগবান্ স্বয়ম্।' — শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান ।

সে সময়ে চেদি নামক একটি দেশের রাজা ছিলেন শিশুপাল। শিশুপাল খুব দুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। প্রজাদের উপর অত্যাচার করতেন। অন্য রাজাদের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে যুদ্ধ করতেন।

তখন দেবরাজ ইন্দ্র পৃথিবীর শান্তি রক্ষার জন্য দেবর্ষি নারদকে পাঠালেন পৃথিবীতে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে। দয়াময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যাতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন মথুরায় পিতা বসুদেবের আলয়ে বাস করছিলেন।

স্বর্গ থেকে নেমে এলেন দেবর্ষি নারদ। হাতে তাঁর বীণা। সে বীণা বাজিয়ে তিনি ভগবানের গুণগান করেন। আর রয়েছে জপের জন্য অক্ষমালা ৷

নারদ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সামনে এলেন। উঠে দাঁড়ালেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁকে বসার আসন দিলেন। বসতে অনুরোধ জানালেন। নারদ না বসা পর্যন্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজ আসনে বসলেন না।

তিনি নারদের কুশল জিজ্ঞেস করলেন। দেবতাদের কুশল জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেবতারা সবাই ভালো আছেন তো?' তারপর শান্ত কণ্ঠে বিনয়ের সঙ্গে নারদকে তাঁর আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন।

স্বয়ং ভগবান হয়েও শ্রীকৃষ্ণ নারদের প্রতি যে আচরণ করলেন, তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে শিষ্টাচার।

আমরাও ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অনুসরণ করে মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারীদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সকলের প্রতি শিষ্টাচার প্রদর্শন করব। নম্রভাবে প্রশ্ন করব। ভদ্রভাবে প্রশ্নের উত্তর দেব । শ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা, সমবয়সীদের সৌজন্য জানাব। আর ছোটদের স্নেহ করব। তাদের সঙ্গেও আমরা শিষ্ট আচরণ করব। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের অসুবিধাগুলো বিবেচনা করে তাদের সহায়তা করব। মনে রাখব শিষ্টাচার একদিনের নয়, প্রতিদিনের আচরণে থাকবে শিষ্টাচার। আমরা প্রতিনিয়ত করব শিষ্টাচারের অনুশীলন । 

 

পরমতসহিষ্ণুতা

শ্যামল আর শামিমা সহপাঠী ।

একদিন ওরা বইমেলায় গেছে বই কিনতে। বই কিনে বেরিয়ে এলো ওরা মেলা থেকে । একটু হাঁটতেই দেখে ফুটপাথের পাশে যে অস্থায়ী খাবার দোকানগুলো বসেছে, সেগুলোর একটার নাম ‘এসো কিছু খাই'।

শ্যামল আর শামিমা সেখানে ঢুকল।

শ্যামল বলল, ‘আইসক্রিম খাব। ’

শামিমা বলল, “না রে, একটু ঠান্ডা লেগেছে। আমি চা খাব। ’

তখন শ্যামল বলল, “ঠিক আছে, তুই চা খা, আমি আইসক্রিম খাই। '

শামিমা বলল, “ঠিক আছে। ’

তোমার নিজের জীবন থেকে অথবা তোমার জানা পরমতসহিষ্ণুতা প্রদর্শনের একটি ঘটনা বল।

এই যে নিজে নিজের মতে ঠিক থেকে অন্যের মতকেও মেনে নেওয়া, শ্রদ্ধা করা—একেই বলে পরমতসহিষ্ণুতা।

সবাই সব বিষয়ে একমত হবে, তা আশা করা যায় না। তাই অন্যের ভিন্ন মতকেও শ্রদ্ধা করতে হবে। হিন্দুধর্মের পাশাপাশি পৃথিবীতে আরও অনেক ধর্মমত আছে। যেমন ইসলাম, বৌদ্ধধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ইত্যাদি। প্রতিটি ধর্মমতের নিজস্ব বিধিবিধান আছে, ধর্মচর্চার নিজস্ব পথ ও পদ্ধতি আছে। এক্ষেত্রে নিজের ধর্ম বা মতকে আমরা মানব, অন্য ধর্ম বা মতেরও স্বীকৃতি দেব। এর অন্যথা হলে সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়। সমাজে অশান্তির সৃষ্টি হয় ।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও পরমতসহিষ্ণুতা প্রয়োজন। এর অন্যথায় রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। ঐক্য বা সংহতির একটি সূত্র হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা।

পরমতসহিষ্ণুতা প্রয়োজন এমন দুটি ক্ষেত্রের উল্লেখ কর।

স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকার শিকাগো শহরে এক ধর্মসভায় পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শ তুলে ধরেছিলেন। সেই কাহিনীটি শোনাচ্ছি :

পরমতসহিষ্ণুতা ও স্বামী বিবেকানন্দ

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দ, সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ। আমেরিকার শিকাগো শহরে এক ধর্ম মহাসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

সেই ধর্ম মহাসভার প্রথম অধিবেশনের সভাপতি কার্ডিনাল গিবসন উপস্থিত শ্রোতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন স্বামী বিবেকানন্দকে।

অভ্যর্থনার উত্তরে স্বামী বিবেকানন্দ তুলে ধরলেন পরমতসহিষ্ণুতার হিন্দুধর্মসম্মত আদর্শ ।

যেখানে অনেকেই কেবল নিজ-নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ এবং জয়লাভে মুখর ছিলেন, সেখানে স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বলেন, ‘যে ধর্ম অন্যকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতার ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়ে আসছে, আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই সত্য বলে বিশ্বাস করি। ’

তিনি শিবমহিম্নস্তোত্র থেকে উল্লেখ করলেন-

রুচীনাং বৈচিত্র্যাঋজুকুটিলনানাপথজুষাং। 

নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামৰ্ণব ইব ৷৷

অর্থাৎ – বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তারা সকলেই একই সমুদ্রে তাদের জলরাশি ঢেলে দেয়। তেমনি নিজের রুচির বৈচিত্র্যের কারণে সোজা-বাঁকা নানা পথে যারা চলেছে, হে ঈশ্বর, তুমিই তাদের সকলের একমাত্র লক্ষ্য।

সভায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল ।

সবাই স্বামী বিবেকানন্দের মুখে পরমতসহিষ্ণুতার এ কথা শুনে মুগ্ধ হলেন ৷

তাই নিজের মতে স্থির থেকেও পরের মতকে শ্রদ্ধা করা যায় ।

সুতরাং আমরাও পরমতসহিষ্ণুতাকে ধর্মের অঙ্গ বলে মানব। নিজেদের জীবনে, সমাজে ও রাষ্ট্রে পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শ অনুসরণ করে চলব।

Content added By

শূন্যস্থান পূরণ কর :

১। নম্র-ভদ্র আচরণকে___ বলে।

২। শিষ্টাচার ধর্মের ___।

৩। নৈতিক গুণ হিসেবে শিষ্টাচার ___ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

৪। অন্যের যুক্তিযুক্ত মতকে শ্রদ্ধা করা বা মেনে নেওয়াকে বলে ___।

৫। পরমতসহিষ্ণুতা সংহতির একটি ___।

 

ডান পাশ থেকে শব্দ এনে বাম পাশের শব্দের সঙ্গে মেলাও :

১। আমরা শিক্ষককে 

২। নম্র-ভদ্র আচরণকে বলে 

৩। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং 

৪। পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শ তুলে ধরেছিলেন।

৫। সকল ধর্মই

শিষ্টাচার প্রদর্শন করেছিলেন 

স্বামী বিবেকানন্দ। 

সত্য। 

শিষ্টাচার। 

প্রণাম করি । 

স্বামী প্রণবানন্দ।

 

নিচের প্রশ্নগুলোর সংক্ষেপে উত্তর দাও :

১। শিষ্টাচার কাকে বলে? 

২। শিষ্টাচার প্রদর্শন করলে সমাজ কেমন হবে ? 

৩। শিশুপাল কোন দেশের রাজা ছিলেন? তিনি কেমন লোক ছিলেন ? 

৪। নারদকে দেখে শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়ালেন কেন? 

৫। পরমতসহিষ্ণুতা কাকে বলে ?

 

নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :

১। শিষ্টাচারের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর। 

২। দেবর্ষি নারদ যখন শ্রীকৃষ্ণের নিকট এলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ কীভাবে শিষ্টাচার প্রদর্শন করেছিলেন ? 

৩। পরমতসহিষ্ণুতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর। 

৪। শিকাগোতে বিবেকানন্দ হিন্দুধর্ম সম্পর্কে যা বলেছিলেন তা তোমার পাঠ্যপুস্তক অনুসারে নিজের ভাষায় লেখ । 

৫। ‘তুমি তাদের সকলের একমাত্র লক্ষ্য’– কে, কাদের একমাত্র লক্ষ্য? কেন ?

Content added By
রাজা শিবি
রাজা রন্তিদেব
রাজা শিশুপাল
রাজা হরিশচন্দ্র