পঞ্চম শ্রেণি (প্রাথমিক) - বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

যার সাহায্যে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে তাকে ভাষা বলা হয়। ভৌগোলিক ভিত্তিতে ভাষা নানা প্রকার হয়, যেমন— সংস্কৃত, পালি, বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি ইত্যাদি। গৌতম বুদ্ধ পালি ভাষাতে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তাঁর প্রচারিত ধর্মবাণী ত্রিপিটকে লিপিবদ্ধ আছে এবং পালি ভাষাতে লেখা। সুতরাং ত্রিপিটকের সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম সম্পর্কে জানতে হলে পালি শব্দের অর্থ, উৎপত্তি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

পালি শব্দের অর্থ পাঠ, সারি, পক্তি, বীথি বা শ্রেণি। পালি পাঠ সব সময় বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্রের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই যে ভাষায় বুদ্ধবাণী সংরক্ষিত হয়েছে সেটাই পালি। বুদ্ধ ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রাবস্তী, জেতবন, পূর্বারাম, বেণুবন, নালন্দা প্রভৃতি তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ সমস্ত বিহারে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণ আছে। এ বিহারগুলোতে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র বুদ্ধের ধর্ম গ্রহণ করে ভিক্ষুসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। বিহারগুলোতে বিভিন্ন ভাষাভাষীর লোকসমাগম ও ভিক্ষুসংঘ একত্রিত হতো। এ বিহারগুলোতেই পালি ভাষার উৎপত্তি হয়। পালি ভাষার প্রাচীন নাম হচ্ছে মাগধী। বিশেষ করে উত্তর ভারতে প্রচলিত শব্দ সম্ভারে পালি ভাষা পুষ্ট ও বর্ধিত হয়। পালি প্রথমে কথ্যভাষা ছিল, পরে সাহিত্যের ভাষায় রূপ নেয় ৷

ভারতীয় আর্য ভাষার তিনটি স্তর রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে—প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা, মধ্য মাগধী বা ভারতীয় আর্য ভাষা ও নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা। পালি মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার অন্তর্গত। এর উৎপত্তি কাল খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৮০০ শতক। কেউ কেউ মনে করেন, মাগধী নিরুত্তি থেকে পালি ভাষার উৎপত্তি। আবার কারও কারও মতে, পশ্চিম ভারত কিংবা পূর্ব ভারতই পালির উৎপত্তিস্থল। এ সব অঞ্চলের ভাষা পালি ভাষার সাথে জড়িত। এক- সময় উত্তর ভারত মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। এ সময় পালি ভাষা বা মাগধী ভাষা সমস্ত উত্তর ভারতের রাষ্ট্রভাষা ছিল।

পালি ভাষার অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পালি সংস্কৃতের চেয়ে সহজ ও শ্রুতিমধুর। বুদ্ধের সময়ে এ ভাষা কথ্য ভাষা ছিল। বিভিন্ন জাতির মধ্য থেকে অনেকে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁরা ভারতের বিভিন্ন স্থানের আঞ্চলিক ভাষায় প্রথমে কথা বলতেন। পরে সবারই বোধগম্য একটি সহজ সরল ভাষার সৃষ্টি হয়। এটাই পালি ভাষা। ভারতীয় অন্যান্য ভাষার সাথে সমন্বয় সাধনের ফলে এ ভাষা জনসাধারণের অনুধাবনের জন্য সহজতর হয়। বাংলা ভাষার সাথে পালি ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এ ভাষার আর একটি বৈশিষ্ট্য।

পালি ভাষার অক্ষর বা বর্ণের সংখ্যা একচল্লিশ। তন্মধ্যে আটটি স্বরবর্ণ এবং তেত্রিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ।

স্বরবর্ণ

যে সমস্ত বর্ণ অন্য বর্ণের সাহায্য ছাড়া স্পষ্টরূপে স্বতন্ত্র উচ্চারিত হয়, তাদেরকে স্বরবর্ণ বলে। পালিতে স্বরবর্ণ আটটি:

অ আ ই ঈ উ ঊ এ ও

তন্মধ্যে অ ই উ— এ তিনটি হ্রস্ব স্বর এবং আ ঈ ঊ এ ও এ -পাঁচটি দীর্ঘস্বর।

ব্যঞ্জনবর্ণ

যে সমস্ত বর্ণ স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হয় না, তাদেরকে ব্যঞ্জনবর্ণ বলে। পালিতে ব্যঞ্জনবর্ণ তেত্রিশটি :

ক খ গ ঘ ঙ 

চ ছ জ ঝ ঞ 

ট ঠ ড ঢ ণ 

ত থ দ ধ ন 

প ফ ব ভ ম 

য র ল ব স

হ ল ং 

তন্মধ্যে প্রথম পঁচিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ পাঁচ বর্গে বিভক্ত:

ক   খ   গ   ঘ   ঙ -এ পাঁচটি ক বর্গ

চ    ছ   জ  ঝ  ঞ -এ পাঁচটি চ বর্গ

ট    ঠ   ড   ঢ   ণ  -এ পাঁচটি ট বর্গ [বর্গের প্রথম অক্ষর অনুসারে বর্গের নামকরণ হয় ৷]

ত   থ   দ   ধ   ন - এ পাঁচটি ত বর্গ 

প  ফ  ব   ভ   ম -এ পাঁচটি প বর্গ

ব্যঞ্জনবর্ণ স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হয় না। বর্গসমূহের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণকে অঘোষ বর্ণ বলে। বর্গসমূহের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম বর্ণ এবং য, র, ল, ব, হ -এদেরকে ঘোষ বর্ণ বলে ।

ং (অং)— এ বর্ণটিকে নিগ্রহিত (নিগৃহীত) বলে ।

এ ছাড়া বর্গের প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম বর্ণকে অল্পপ্রাণ বলে।

বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ণকে মহাপ্রাণ বলা হয় ।

অর্থাৎ অল্পপ্রাণ বলতে আস্তে এবং মহাপ্রাণ বলতে জোরে উচ্চারণ করতে হয়।

আবার উচ্চারণ স্থান হিসেবে কণ্ঠ, তালু, মূর্ধা, দন্ত বলা হয় ।

যেমন— ক খ গ ঘ ঙ অ আ হ – এগুলো উচ্চারণ করলে কণ্ঠে আওয়াজ হয়। তদ্রপ—

চ    ছ    জ   ঝ   ঞ   হ   ই   ঈ -কণ্ঠবর্ণ

ণ    ফ    ব   ভ    ম    উ   ঊ      -ওষ্ঠ বর্ণ

ট     ঠ    ড   ঢ    ণ     র   ল  -মূর্ধা বৰ্ণ

ত    থ    দ    ধ    ন    ল    স  -দন্ত বৰ্ণ

অক্ষর উচ্চারণের ক্ষেত্রে কণ্ঠ, ওষ্ঠ, মূর্ধা এবং দন্ত কাজ করে।

সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় স্বরের সংখ্যা বেশি। কিন্তু পালি ৮টি স্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ।

তোমরা মনে রাখবে, বাংলা ভাষার স্বরবর্ণের ঋ, ৯, ঐ, ঔ— এ চারটি অক্ষর পালি ভাষায় নেই। আর ব্যঞ্জনবর্ণের শ, ষ, স -এ তিনটির মধ্যে শুধু ‘স’ এর ব্যবহার আছে। ড়, ঢ়-এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। এ ছাড়া পালিতে ´ (রেফ), ঃ (বিসর্গ), < (ঋ-ফলা) নেই।

এ সম্পর্কে তোমাদের পুরো ধারণা থাকলে পালি শব্দ গঠন সহজতর হবে। পালির সংগে বাংলার সম্পর্ক বেশি। কারণ, বাংলা ভাষার উৎপত্তি পালি ভাষা থেকেই। চর্যাপদের ভাষা হচ্ছে বাংলা ভাষার আদি।

তোমাদের সুবিধার জন্য নিম্নে পালি ও বাংলা শব্দের একই রূপের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:

পালি                  বাংলা

অঞ্জলি              অঞ্জলি

সঞ্চয়                 সঞ্চয়

কণ্টক              কণ্টক

পণ্য                   পণ্য

উত্তম                 উত্তম

উত্তর                 উত্তর

আহার               আহার

বুদ্ধি                   বুদ্ধি

স্বাগত                স্বাগত

কুঠার               কুঠার

কোকিল          কোকিল

কল্যাণ             কল্যাণ

তোমাদের বর্তমান পাঠ্যপুস্তক ‘বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা'র দ্বিতীয় অধ্যায়ের বন্দনা, তৃতীয় অধ্যায়ের প্রদীপ পূজা ও ধূপ পূজা, চতুর্থ অধ্যায়ের দশশীল পালিতে লেখা আছে। তোমরা লক্ষ্য করবে, পালি উদ্ধৃতির কোথাও ঋ, ৃ, ৯, ঐ, ঔ, (রেফ), ঃ (বিসর্গ) নেই ।

সুতরাং দেখা যায়, ভাষার দিক দিয়ে পালির বেশ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পালির শব্দগত বৈশিষ্ট্য সহজে অনুমান করা যায়। শুধু ধাতুরূপ, শব্দরূপ, কাল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ব্যাকরণগত পার্থক্য আছে। তবে অন্যান্য ভাষার চেয়ে অনেকটা সহজ ।

Content added By

শূন্যস্থান পূরণ কর :

১. এ সমস্ত বিহারে বিভিন্ন ___ সংমিশ্রণ আছে।

২. যে ভাষায় বুদ্ধবাণী ___ হয়েছে সেটাই পালি ।

৩. একসময় উত্তর ভারত ___ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

৪. এ বিহারগুলোতে পালি ভাষার ___ হয়।

৫. পালি প্রথমে কথ্যভাষা ছিল, পরে ___ ভাষার রূপ নেয়।

৬. বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ণকে ___ বলা হয়।

 

বাম পাশের বাক্যাংশের সাথে ডান পাশের বাক্যাংশের মিল কর :

বামডান

১. তাঁর প্রচারিত ধর্মবাণী

২. এ সমস্ত বিহারে বিভিন্ন

৩. এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতের চেয়ে

৪. এসব অঞ্চলের ভাষা পালির সাথে

৫. আ ঈ ঊ এ ও-

৬. সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায়

১. বাংলার সম্পর্ক পালির বেশি।

২. ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

৩. এ পাঁচটি দীর্ঘস্বর।

৪. স্বরের সংখ্যা বেশি।

৫. ত্রিপিটকে লিপিবদ্ধ আছে।

৬. জাতির সংমিশ্রণ আছে।

৭. উচ্চারণে কোনো প্রভেদ নেই।

 

নিচের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও :

১. ভারতীয় আর্য ভাষার তিনটি স্তর কী কী ? 

২. প্রাচীন ভারতের চারটি বৌদ্ধ বিহারের নাম লেখ। 

৩. পালি ভাষায় অক্ষর বা বর্ণের সংখ্যা কত ? 

৪. পালি স্বরবর্ণে কোন বর্ণগুলো ব্যবহার হয় না? 

৫. অল্পপ্রাণ বলতে কী বোঝ? 

৬. পালিতে ব্যঞ্জনবর্ণ কয়টি?

 

নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :

১. পালি ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে লেখ। 

২. পালি বর্ণমালার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর । 

৩. পালিতে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ কয়টি ও কী কী? 

৪. প্রথম পঁচিশটি পালি বর্ণের পাঁচটি বিভক্তকরণ দেখাও। 

৫. পালি ও বাংলা শব্দের একই রূপের বারোটি শব্দের একটি তালিকা তৈরি কর। 

৬. পালি বর্ণমালা সম্পর্কে একটি ধারণা দাও ।

Content added By
মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা
প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা
নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা
ভারতীয় দ্রাবিড় ভাষা