পঞ্চম শ্রেণি (প্রাথমিক) - খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

আমরা অনেকেই আগে নেলসন ম্যান্ডেলার নাম শুনেছি। তিনি একজন মহান ও উদার মনের মানুষ ছিলেন। জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য তিনি রাজনৈতিক ও সংগ্রামী নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম চালিয়েছেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই জুলাই তারিখে নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সকাই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ঝোসা ছিল একটি আফ্রিকান ভাষা। এই ভাষায় ম্যান্ডেলার নাম ছিল ‘রোলিলালা' যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে গাছের ডাল টেনে নিচে নামানো । কিন্তু এই নামের গভীর তাৎপর্য হচ্ছে ‘গোলযোগ সৃষ্টিকারী'।

ম্যান্ডেলার বাবা গাডলা হেনরী ম্যান্ডেলা থেম্‌বু উপজাতি-গোষ্ঠীর প্রধান পরামর্শক ছিলেন। তাঁর মাতা নকাফি নসেকেনী ছিলেন একজন শান্ত এবং সরল প্রকৃতির মহিলা। ট্রান্সকাইতে নেলসন ম্যান্ডেলা কৃষিকাজ এবং গবাদিপশু পালন করে শৈশব অতিবাহিত করেন। রাতে তিনি আগুনের পাশে বসে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছ থেকে আফ্রিকানদের বীরত্বের কল্প- - কাহিনী শুনতেন ।

নেলসনের বয়স যখন মাত্র নয় বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর তিনি কয়েক বছর তাঁদের গোষ্ঠীপ্রধানের অভিজাত বাড়িতে বসবাস করেন। সেখানে তাঁর প্রিয় কাজ ছিল বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যেকার বিরোধ মীমাংসার জন্য সর্বোচ্চ গোষ্ঠীপ্রধানের বিচারকার্য পর্যবেক্ষণ করা। এ কাজ করতে করতেই তিনি মনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, তিনি একদিন নিজের যোগ্যতা বিচারের জন্য আইনজীবী হবেন । নেলসন ম্যান্ডেলা মেথোডিস্ট হাইস্কুলে অধ্যয়ন শেষ করে পূর্ব কেইপ শহরের এলিস-এ ফোর্ট হেয়ার কলেজে ভর্তি হন। ষোলো বছর বয়সে আফ্রিকান রীতি অনুসারে তিনি অন্য ২৫ জন বন্ধুর সাথে ত্বকচ্ছেদের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। আফ্রিকান রীতি অনুসারে ত্বকচ্ছেদ না করা পর্যন্ত কেউ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তা গোষ্ঠীর কাজ করতে পারত না। এই রীতি ছিল ‘বালকত্ব’ থেকে প্রাপ্তবয়সে প্রবেশের একটি পদক্ষেপ। তাই তিনি আনন্দসহকারে জাতীয় রীতি গ্রহণ করেন এবং নিজেকে প্রস্তুত করেন বালকত্ব থেকে প্রাপ্তবয়সের পরিচয় বহন করতে।

তাঁদের এই প্রথাগত অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা অতি দুঃখের সাথে বলেন যে, আফ্রিকায় যুবকেরা বংশানুক্রমে নিজেদের দেশে ইংরেজদের দাসত্ব করছে। কারণ তাদের জমি ইংরেজদের দখলে ছিল। এই কারণে তারা কখনোই নিজেদের পরিচালনা করার সুযোগ পেত না। তিনি আরও বলেন যে,“এভাবেই দেশের যুবকেরা নির্বোধের মতো ইংরেজদের জন্য কাজ করতে করতে ধ্বংস হয়ে যাবে।”

এই কথাগুলোর অর্থ ম্যান্ডেলা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেন নি। কিন্তু ধীরে ধীরে শিক্ষালাভ, আফ্রিকান পরিবেশের সাথে তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং অন্যায় অত্যাচারের মুখোমুখি হয়ে তিনি কথাগুলোর অর্থ যথার্থভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করেন যে, ইংরেজদের দ্বারা তাঁর স্ব-জাতির অবহেলা, অন্যায়, অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়াবেন এবং তাদেরকে বন্দীত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত করবেন।

কারাগারে বন্দীজীবন এবং সাফল্য

“আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস” (এএনসি)তে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে এএনসি যুব লীগ গঠন করতে তিনি সাহায্য করেন। এর দ্বারাই প্রথম তাঁরা ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। এর ফলে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে দেশদ্রোহিতার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ম্যান্ডেলা এএনসি পরিচালনা করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি আবার দেশদ্রোহিতার দায়ে বন্দী হন এবং পাঁচ বছরের জন্য কারাবন্দী থাকেন। পুনরায় ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। দীর্ঘ ২৭ বছরের ‘কারাভোগ' ইংরেজদের বর্ণবাদী মনোভাবের প্রতি তাঁর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অবশেষে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্ট এফ. ডব্লিও ডি’ ফেব্রুয়ারি মাসে এএনসি-র উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা তুলে নিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলাকে কারামুক্ত করে দেন।

প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা

নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তি দক্ষিণ আফ্রিকায় জাতিগত বৈষম্যের অবসানের চিহ্ন হিসাবে সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। আফ্রিকান সরকারের সংবিধানে যে সমস্ত আইন জাতিগত বৈষম্যের সৃষ্টি করেছিল তা তাঁর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে বাতিল করেন। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বিশ্ব শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম নিগ্রো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল নির্যাতিত নিগ্রোদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আনয়ন করা। এ ভাবে তাদের মর্যাদাদান ও উন্নয়নে সহায়তা করে সকলের মধ্যে সমতা স্থাপন করা। এ ছাড়া জাতিগত বৈষম্য দূর করে একটি সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আজও নেলসন ম্যান্ডেলা অনেকের অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি বর্তমান জগতে মানবাধিকার আন্দোলনের শক্তির অন্যতম উৎস। তাঁর ব্যক্তিত্ব মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে তিনি হয়েছেন নিরাশার মধ্যে আশার আলো। তিনি ঘৃণা-বিদ্বেষ ও অত্যাচারের জগতে ভালোবাসার চিহ্ন।

নেলসন ম্যান্ডেলা সময়-নিষ্ঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সকালে সাড়ে চারটার সময় ঘুম থেকে জাগা তাঁর চিরজীবনের অভ্যাস। প্রতিদিন তিনি ১২ ঘণ্টা করে কাজ করেন এবং অনিয়মের প্রতি প্রবল ঘৃণা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “সর্বত্রই আমি নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট পূর্বে উপস্থিত থেকেছি আর এটা আমাকে একজন ভিন্ন মানুষে পরিণত করেছে।”

কী শিখলাম

অত্যাচার ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে জন্মেও নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর জাতিকে জাতিগত বৈষ্যমের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন। তাঁর নিরলস পরিশ্রম, মেধা ও প্রচেষ্টার কারণে নিগ্রোদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ভোগের দ্বার খুলে গেছে। তিনি আজ বিভিন্ন মানুষ ও সংগঠনের সাথে মানবাধিকার অন্দোলন, মানব মর্যাদা এবং সম-অধিকারের মূর্ত প্রতীক হয়ে আছেন।

পরিকল্পিত কাজ

নেলসন ম্যান্ডেলার জীবন থেকে দশটি শিক্ষার নাম লেখ।

Content added By

শূন্যস্থান পূরণ কর

ক) নেলসন ম্যান্ডেলা ___ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ৷

খ) ঝোসা ভাষায় ম্যান্ডেলার নাম ছিল ___ ।

গ) ম্যান্ডেলা ___ বছর জেলে ছিলেন ।

ঘ) ম্যান্ডেলার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ___ খ্রিষ্টাব্দে আফ্রিকান সরকার সংবিধানের বৈষম্য বাতিল করেন।

ঙ)“সর্বত্রই আমি নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ___ মিনিট পূর্বে উপস্থিত থেকেছি।”

 

বাম পাশের বাক্যাংশের সাথে ডান পাশের বাক্যাংশের মিল কর

ক) ঝোসা ছিলক) অধ্যয়ন শেষ করেন।
খ) রোলিলালার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছেখ) তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
গ) নেলসন ম্যান্ডেলা মেথোডিস্ট হাইস্কুলেগ) মুক্তি দেওয়া হয়।
ঘ) নেলসনের বয়স যখন নয় বছরঘ) গাছের ডাল টেনে নিচে নামানো।
ঙ) ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসেঙ) একটি আফ্রিকান ভাষা ৷
 চ) তখন তাঁর বাবা মারা যান ৷

 

সংক্ষেপে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও

ক) নেলসন কোন শহরে জন্মগ্রহণ করেন? 

খ) ত্বকচ্ছেদ কিসের বহিঃপ্রকাশ ? 

গ) নেলসন ম্যান্ডেলা কতো বছর কারাভোগ করেন? 

ঘ) ম্যান্ডেলা কতো খ্রিষ্টাব্দে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান?

 

নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও

ক) নেলসন ম্যান্ডেলার বাল্যজীবন সম্পর্কে লেখ । 

খ) প্রথম নিগ্রো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নেলসন ম্যান্ডেলার প্রধান লক্ষ্য কী ছিল ?

Content added By
নোসিকেনী
ঝোসা
হেনরী ম্যান্ডেল
গাডলা হেনরী ম্যান্ডেলা
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে
১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে