আমরা যে অতিথি বক্তার বক্তব্য শুনলাম, সেই অভিজ্ঞতাটি নিজের ভাষায় নিচে লিখে ফেলি।
অভিজ্ঞতা
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
মানুষ সুষ্ঠু জীবনযাপন করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে কতগুলো কাজ নিয়মিত করে। এর মধ্যে কিছু কাজ শরীর, মন সুস্থ রাখার জন্য, কিছু কাজ জীবিকা উপার্জনের জন্য এবং কিছু ধর্মীয় রীতিনীতির অনুসরণ। এভাবে বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং গৃহীদের কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচরণ রয়েছে। ভিক্ষু শ্রমণ এবং গৃহীরা এসব আচরণ মেনে চললে ধর্মীয় বিধান রক্ষার পাশাপাশি সংঘ এবং সমাজের শৃঙ্খলা পরিপূর্ণভাবে বজায় থাকে।
সংসার জীবন ত্যাগ করে যাঁরা প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন তাঁরা শ্রমণ এবং শ্রমণেরা নির্দিষ্ট সময়ে উপসম্পদা গ্রহণ করলে তাঁরা ভিক্ষু হিসেবে অভিহিত হন। সাধারণভাবে সাত বছর হলে শ্রমণ এবং শ্রমণ হিসেবে বিশ বছর অতিবাহিত করে ভিক্ষু হওয়া যায়। ভিক্ষুদের পরম লক্ষ্য নির্বাণ সাধনা হলেও ভিক্ষুসংঘ এবং গৃহীদের মধ্যে বুদ্ধ নির্দেশিত শিক্ষার প্রচার ও অনুসরণ করাও তাঁদের কর্তব্য। তথাগত বুদ্ধ তাঁর ধর্ম প্রচার, সংরক্ষণ এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাণসাধনার লক্ষ্যে ভিক্ষুদের জন্য কিছু বিধিবিধান নির্দেশ করেছেন। বিনয়পিটকে বর্ণিত এসব বিধিবিধানই ভিক্ষুদের আচরণবিধি হিসেবে সেই সময় থেকে অনুসৃত হচ্ছে।
বৌদ্ধ গৃহী বলতে সাধারণত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সংসারধর্ম পালনকারীকে বোঝায়। সংসারধর্ম পালন করতে গিয়ে মানুষ বিভিন্ন কারণে সমাজবদ্ধ হয়। সমাজে বসবাস করতে হলে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সে অবস্থায় গৃহীরা যাতে ধর্মের পথে শান্তি ও কল্যাণময় জীবনযাপন করতে পারে, তথাগত বুদ্ধ সে সম্পর্কেও কিছু উপদেশ দিয়েছেন। এসবই গৃহীদের আচরণবিধি হিসেবে পরিগণিত হয়। বুদ্ধের এই অনুশাসন বা বিধিগুলো গৃহীদের জন্য অবশ্যপালনীয়।
শ্রমণ ও ভিক্ষুরা গৃহ ও সংসার ত্যাগ করে নির্বাণ সাধনায় নিমগ্ন থাকেন। তাঁদের নির্বাণ সাধনার স্থান হলো বিহার, যা তাঁদের আবাসস্থানও বটে। বিহারে অবস্থানকারী ভিক্ষু-শ্রমণদের ব্রহ্মচর্যা পালনে বিঘ্ন না ঘটার জন্য তাঁদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে সংযমী হতে হয়। যেমন-
ভিক্ষুদের জন্য পাতিমোক্স শীল:
'পাতিমোক্স' গ্রন্থে ভিক্ষুদের পালনীয় ২২৭টি শীলের কথা আছে। ভিক্ষুদের এসব শীল আবশ্যিকভাবে পালন করতে হয়। 'পাতিমোক্স' গ্রন্থে ভিক্ষুদের অবশ্য পালনীয় এসব বিধি-বিধানের বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ভিক্ষুদের প্রতিমাসে অন্তত দুবার, পূর্ণিমা ও অমাবস্যার চতুর্দশীতে পাতিমোক্স আবৃত্তি করতে হয়। পাতিমোক্স বর্ণিত অধিকাংশ শীল রাজগৃহে বুদ্ধ কর্তৃক দেশিত হয়েছিল। ভিক্ষুদের জন্য বিধিবদ্ধ হয়েছে বলে এই শীলসমূহ ভিক্ষুশীল নামে অভিহিত। গুরুত্ব অনুসারে ভিক্ষুশীলসমূহকে আট ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা: পারাজিকা, সংঘাদিসেস, অনিয়ত, নিসগগিয়া, পাচিত্তিয়া, পাটিদেসনিয়া, সেখিয়া এবং অধিকরণ সমথ।
ভিক্ষুদের পাতিমোক্সে বর্ণিত বিধিবিধানসমূহ অবশ্যই পালন করতে হয়। তথাগত বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণের পূর্বে তাঁর অন্তিম দেশনায় অপ্রমত্ত হয়ে কর্তব্য সম্পাদনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন-যতদিন ভিক্ষুসঙ্ঘ শুদ্ধাচারী হয়ে সত্যপথে চলবে ততদিন সদ্ধর্ম পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
ভিক্ষু শ্রমণদের প্রত্যবেক্ষণ ভাবনা:
ভিক্ষু-শ্রমণেরা গৃহীদের কাছ থেকে চারটি মৌলিক উপাদান দান হিসেবে গ্রহণ করেন। সেগুলো হলো- আহার, বাসস্থান, পরিধেয় বা চীবর এবং ওষুধ-পথ্য। এ চারটি বস্তুকে এককথায় বলা হয় চতুপ্রত্যয় গৃহীরা ভিক্ষুক চতুপ্রত্যয় দান করেন বলে তাঁরা দায়ক দায়িকা হিসেবে অভিহিত। ভিক্ষু-শ্রমণেরা চতুপ্রত্যয় গ্রহণ বা ব্যবহার করার সময় সে বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভের জন্য প্রত্যবেক্ষণ ভাবনা করেন। প্রত্যবেক্ষণ শব্দের অর্থ সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ। এ ভাবনা চার প্রকার; যেমন-
ক) আহার গ্রহণ করার সময়, "আমি কেবল জীবন-ধারণের জন্য এ আহার গ্রহণ করছি। শারীরিক সৌন্দর্য কিংবা শক্তি বৃদ্ধির জন্য নয়।"
খ) চীবর পরিধানের সময়, "পোকা-মাকড়, সরীসৃপ-জাতীয় প্রাণীর কাপড়, শীত ও উষ্ণতা নিবারণ, ধুলা-বালি, লজ্জা নিবারণ প্রভৃতি থেকে সুরক্ষার জন্য এ চীবর পরিধান করছি। আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য নয়।"
গ) শয্যা গ্রহণের সময়, "এ শয্যা কেবল শীত ও উষ্ণতা নিবারণের জন্য, দংশক-ধুলাবালি-রৌদ্র-পোকামাকড়, সরীসৃপ প্রভৃতির আক্রমণ নিবারণ এবং চিত্তের একাগ্রতা সাধনের জন্য। আলস্য বা নিদ্রায় অনর্থক কালক্ষেপণের জন্য নয়।"
ঘ) ওষুধ গ্রহণের সময়, "কেবল রোগ উপশমের জন্য প্রয়োজনমতো এ ওষুধ সেবন করছি। অন্য কোনো অকুশল উদ্দেশ্যে নয়।"
উল্লিখিত প্রত্যবেক্ষণ ভাবনা ভিক্ষু-শ্রমণদের মনে লোভ-দ্বেষ-মোহ বিনাশের হেতু হয়।
চার অকরণীয়:
ভিক্ষু-শ্রমণদের চারটি কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়, যাকে চার অকরণীয় বলে। যথা- ১. ব্যভিচার না করা ২. চুরি না করা ৩. জীবহত্যা না করা এবং ৪. দৈবশক্তিসম্পন্ন বলে দাবি না করা এবং দৈবশক্তি প্রদর্শন না করা। চতুর্থ অনুশাসনটি প্রবর্তিত হয়েছিল বৈশালীতে দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পর। সে সময় কিছু কিছু ভিক্ষু নিজেদের দৈবশক্তির অধিকারী বলে প্রচার করে গৃহীদের মনোযোগ আকর্ষণপূর্বক খাদ্য সংগ্রহ করত। বুদ্ধ সেজন্য দৈবশক্তিসম্পন্ন বলে প্রচার ও তা প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকার জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করেন।
সংযম ব্রত:
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সোনা রুপা গ্রহণ করা একবারেই বারণ। যদি কোনো গৃহস্থ তা দান করেন তাহলেও ভিক্ষু তা নিজের জন্য রাখতে পারবেন না। হয় তা দাতাকে ফেরত দেবেন অথবা অন্য কোনো গৃহস্থকে দান করবেন। অন্য কোনো গৃহস্থকে দান করার ফলে তিনি তার বিনিময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিতে পারবেন। তবে সেগুলো ভিক্ষু নিজের জন্য নিতে পারবেন না। অন্য ভিক্ষু বা ভিক্ষুসঙ্ঘের জন্য নিতে পারবেন। বুদ্ধ শাসনের উন্নতির জন্য ভিক্ষুসঙ্ঘ ভূমি, বিহার প্রভৃতি স্থাবর সম্পত্তি গ্রহণ করতে পারবেন। বুদ্ধের সময় রাজা, মহারাজা ও গৃহীরা এরকম দান করতেন। তবে এগুলো সঙ্ঘসম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হবে।
আহার: ব্রহ্মচর্য প্রতিপালনকারীরা একাহারী। সাধারণত মধ্যাহ্নের আগে দুপুর বারোটার আগে অর্থাৎ আহার গ্রহণ করতে হয়। বুদ্ধের সময়ে পিণ্ডচারণের মাধ্যমে ভিক্ষু-শ্রমণেরা গৃহীদের বাড়িতে গিয়ে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করতেন। এখনো বাংলাদেশে কিছু কিছু জায়গায় এ প্রথা চলমান আছে। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভিক্ষু- শ্রামণদের গৃহীদের বাড়ীতে আমন্ত্রণ করলে সেখানে আহার গ্রহণ করা যায়।
নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য: ভিক্ষুদের নিজস্ব কোনো সম্পদ নেই। তাঁদের সম্পদ বলতে বোঝায় তিনটি চীবর, যথা: সংঘাটি, উত্তরাসঙ্ঘ, অন্তর্বাস, ভিক্ষাপাত্র, ক্ষুর, সুঁচ-সুতা, কটিবন্ধনী এবং জল ছাঁকুনি। এগুলোই ভিক্ষু-শ্রমণদের জীবনধারনের জন্য যথেষ্ট বলে বুদ্ধের নির্দেশনা রয়েছে। এগুলো সংক্ষেপে অষ্টপরিষ্কার হিসেবে অভিহিত, যা প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা গ্রহণের সময় দান করা হয়।
দশশীল: ত্রিশরণসহ দশশীল শ্রমণদের জন্য দৈনন্দিন জীবনে প্রতিপালন করা অত্যাবশ্যকীয়। দশশীল সমূহ হলো: ১. জীবহত্যা ২. চুরি ৩. ব্যভিচার ৪. সুরা পান ৬. বিকালভোজন ৭. নৃত্যগীতে অনুরক্তি ৮. গন্ধমাল্য প্রভৃতি ধারণ ৯. আরামদায়ক শয্যায় শয়ন এবং ১০ সোনা-রুপা গ্রহণ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা।
পঞ্চভাবনা: ভিক্ষু-শ্রমণদের জন্য ভাবনা একটি নিত্যকর্ম। মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, অশুভ ও উপেক্ষা এই ভাবনাগুলো অবলম্বন করে গৈরিক জীবনের লোভ, দ্বেষ, মোহ দূরীভূত হয়, যা বৌদ্ধধর্মে পঞ্চভাবনা নামে অভিহিত। ভিক্ষু-শ্রমণদের জন্য সকাল-সন্ধ্যা পঞ্চভাবনা চর্চা করা দরকার, যা পালন করলে মন শান্ত থাকে এবং নৈতিক জীবন সুন্দর হয়। পঞ্চভাবনা নিম্নরূপ-
মৈত্রী ভাবনা: সকল প্রাণী শত্রুহীন হোক, বিপদহীন হোক, ভয়হীন হোক, সুখে বাস করুক-এরুপ কল্যাণকামনাই মৈত্রী ভাবনা।
করুণা ভাবনা: দুঃখীর দুঃখে ব্যথিত হয়ে 'দুঃখমুক্তি' কামনা করাকে করুণা ভাবনা বলে।
মুদিতা ভাবনা: অপরের সৌন্দর্য, যশ, লাভ, ঐশ্বর্য, অথবা সৌভাগ্য দেখে নিজচিত্তে আনন্দ অনুভব করাই মুদিতা। 'সকল প্রাণী যথালব্ধ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হোক'- এটি হলো মুদিতা ভাবনার মূলমন্ত্র।
অশুভ ভাবনা: শরীর ব্যাধি ও অশুচির আধার, অনিত্য এবং মৃত্যুর অধীন। এ বিষয়গুলো অবলম্বন করে ভাবনা করাই হচ্ছে অশুভ ভাবনা।
উপেক্ষা ভাবনা: লাভ-অলাভ, যশ-অযশ, নিন্দা-প্রশংসা, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি অষ্টপ্রকার লোকধর্মে চিত্তকে অবিচলিত রেখে ভাবনা করাই হচ্ছে উপেক্ষা ভাবনা।
ধ্যান ও সমাধি: ব্রহ্মচর্য জীবন পালনে ধ্যান ও সমাধি একটি গুরুত্বপূর্ণ নিত্যকর্ম, যা ভিক্ষু-শ্রমণের পালন করেন। চিত্তের একাগ্রতা সাধন করার মূলে ধ্যান সমাধি প্রধান অঙ্গ। তৃষ্ণার বশীভূত হয়ে মানুষ লোভ, দ্বেষ ও মোহে জর্জরিত হয়ে দুঃখে পতিত হয়। এসব স্বভাবের কারণে মানুষ চঞ্চল, অসংযত ও মানসিক অশান্তি ভোগ করে। নিয়মিত ধ্যান ও সমাধির মাধ্যমে চিত্তে একাগ্রতা সাধন সম্ভব, যা আসক্তি দূরীভূত হয়। বুদ্ধের নির্দেশিত ধ্যানানুশীলনকে বিদর্শন ভাবনা বলা হয়। এই বিদর্শন ভাবনা অনুশীলনে নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। শীল ব্যতীত সমাধি হয় না, সমাধি ব্যতীত প্রজ্ঞা হয় না। প্রজ্ঞাই হচ্ছে নির্বাণের শেষ স্তর।
ভিক্ষুদের সপ্ত অপরিহাণীয় ধর্ম: মহাপরিনির্বাণ সূত্রে বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে সাতটি বিধানের দেশনা করেছিলেন, যা ভিক্ষুদের সপ্ত অপরিহাণীয় ধর্ম নামে আখ্যায়িত। এগুলো যথাযথভাবে অনুশীলন করলে ভিক্ষুদের পরাজয় ঘটবে না। নিচে তা দেওয়া হলো :
১. ভিক্ষুগণ একত্রে সম্মিলিত হয়ে কাজ করবেন।
২. ভিক্ষুগণ একতার মাধ্যমে সঙ্ঘ-কর্তব্য সম্পাদন করবেন।
৩. ভিক্ষুগণ বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুদের সম্মান, পূজা ও সেবা করবেন।
৪. ভিক্ষুগণ প্রয়োজনীয় নির্দেশিত শিক্ষাপদসমূহ প্রতিপালন করবেন।
৫. ভিক্ষুগণ পুনর্জন্মের কারণ তৃষ্ণার বশবর্তী হবেন না।
৬. ভিক্ষুগণ অরণ্যে বা একান্তে নির্বাণ সাধনায় মনোনিবেশ করবেন।
৭. ভিক্ষুগণ আগত ও অনাগত ভিক্ষু-শ্রমণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করবেন।
বৌদ্ধভিক্ষু ও গৃহীদের সমন্বিত প্রয়াসেই বৌদ্ধসমাজ প্রবহমান। আমরা জানি যে, যে কোনো সমাজের প্রগতি ও উন্নয়ন নির্ভর করে সে সমাজের ঐক্য ও সংহতির ওপর। পারস্পরিক দায়িত্ব কর্তব্য যথাযথ পালনের মাধ্যমেই সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। তাই সামাজিক একতার জন্য প্রয়োজন শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন ও সচেতন কর্তব্যবোধ। এরূপ জীবন একদিনে গড়ে ওঠেনা। এর জন্য দৈনন্দিন জীবনে কিছু করণীয় রয়েছে। যা অনুসরণ ও অনুশীলন করলে গৃহীদের জীবন মঙ্গলময় হয়ে ওঠে। পবিত্র ত্রিপিটকে এ বিষয়ে তথাগত বুদ্ধ গৃহীদের জন্য কিছু বিধি-বিধান প্রদান করেছেন। এগুলোকে গৃহী বিনয়ও বলে। গৃহী বিনয়ের এ বিধানগুলো ত্রিপিটকে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে বিন্যস্ত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সূত্র হলো সিগালোবাদ সূত্র, কলহবিবাদ সূত্র, পরাভব সূত্র, মঙ্গলসূত্র, ব্যাগপজ্জ সূত্র, খাবিসান সূত্র, লক্ষ্মণ সূত্র, গৃহীপতিপদা সূত্র, ধৰ্ম্মিক সূত্র প্রভৃতি।
তথাহত বুদ্ধ ধর্মোপদেশের মাধ্যমে প্রদত্ত এই জীবন বিধান বা অনুশাসন গৃহী বৌদ্ধদের জন্য অবশ্যপালনীয়। এখানে কয়েকটি সূত্র হতে গৃহীদের নিত্যকর্ম ও অনুশাসন সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
একদিন রাজগৃহে বেণুবন বিহারে অবস্থানকালে বুদ্ধের সাথে সিগালক নামে এক ব্রাহ্মণ পুত্রের দেখা হয়। সে সময় সিগালক স্নানশেষে সিক্ত বস্ত্রে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ উর্ধ্ব অধঃ- ষড়দিকে নমস্কার করছিলেন। বুদ্ধ তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে সিগালক বলে, পৈতৃক প্রথা ও পিতার নির্দেশে তিনি ষড়দিকে নমস্কার করছেন। বুদ্ধ বুঝতে পারলেন সিগালক ষড়দিক বন্দনার মর্মাথ তিনি নিজে জানেন না। অতঃপর, বুদ্ধ তাকে ষড়দিক বন্দনায় মর্মাথ ব্যাখ্যা করে গৃহীদের করণীয় সম্পর্কে যে অনুশাসন প্রদান করেন, তা সর্বজনীন নিত্য পালনীয় কর্ম হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ববহ। নিচে এ বিষয়ে কিছু তুলে ধরা হলো:
চার প্রকার ক্লিষ্টকর্ম বর্জন: এ বিষয়ে তথাগত বুদ্ধ বলেন, চারদিক বন্দনা মানে, ধার্মিক উপাসকদের চারটি ক্লিষ্ট কর্ম পরিত্যাগ করা। ক্লিষ্ট কর্ম হলো যে কর্ম পরবর্তীতে দুঃখ, কষ্ট আনয়ন করে। সেগুলো হলো প্রাণিহত্যা, অদত্তবস্তু গ্রহণ, ব্যভিচার ও মিথ্যা ভাষণ-ধার্মিক গৃহীর এই চার প্রকার ক্লিষ্টকর্ম বর্জন করা উচিত। এছাড়া তথাগত বুদ্ধ আরো বলেন-
চার প্রকার পাপকর্ম বর্জন: স্বেচ্ছাচারিতা, হিংসা, ভয় ও অজ্ঞানতার বশবর্তী হয়ে পাপানুষ্ঠান করা- এ চার প্রকার পাপকর্ম ধার্মিক গৃহীর পরিত্যাগ করা উচিত। এসব পাপকর্ম যশ-খ্যাতি ক্ষয় করে।
ষড়দোষ বর্জন: ষড়দিক প্রার্থনা সম্পর্কে বুদ্ধ বলেন, ছয়টি অকরণীয় বিষয়ে সচেতন হওয়া। নেশাদ্রব্য গ্রহণ, অসময়ে ভ্রমণ, আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত, দ্যুত ক্রীড়া, কুসংসর্গ, আলস্যপরায়ণতা- এই ষড়দোষ ধার্মিক গৃহীর পরিত্যাগ করা উচিত। কারণ:
ক) নেশা গ্রহণের ফলে ছয়টি বিষময় ফল ভোগ করতে হয়। যথা- ১. অকারণে ধনহানি ঘটে, ২. কলহ বৃদ্ধি পায়, ৩. বিবিধ রোগের উৎপত্তি ঘটে, ৪. দুর্নাম রটে, ৫. নির্লজ্জ হয় এবং ৬. হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়। এসব কারণে জীবনহানিও ঘটতে পারে।
খ) অসময়ে ভ্রমণের ফলে ১. নিজে অরক্ষিত থাকে, ২. স্ত্রী-পুত্র অরক্ষিত থাকে, ৩. বিষয়সম্পত্তি অরক্ষিত থাকে ৪. সর্বদা আশঙ্কাযুক্ত হয়ে চলতে হয়, ৫. পাপকর্মে মিথ্যা কলঙ্ক আরোপিত হয় এবং ৬. বিভিন্ন রকমের দুঃখজনক বিষয়ের সম্মুখীন হতে হয়।
গ) আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত থাকলে সর্বদা উৎকণ্ঠিত চিত্তে কালযাপন করতে হয়।
ঘ) দ্যুত ক্রীড়া অর্থাৎ তাস, পাশ, জুয়া জাতীয় খেলায় ১. জয়ী ব্যক্তির শত্রু বৃদ্ধি পায় ২. পরাজিতের অনুশোচনা হয়, ৩. সম্মানহানি ঘটে ৪. সভা-সমিতিতে কথার মূল্য থাকে না, ৫. মিত্র-পরিজনদের নিকট লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয় এবং ৬. স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণে অসমর্থ হয়।
ঙ) কুসংসর্গের ফলে ১ ধূর্ত ২. দুশ্চরিত্র ৩. নেশাগ্রস্থ, ৪. জুয়াড়ি, ৫ প্রবঞ্চক এবং ৬. ডাকাত জাতীয় ব্যক্তি বন্ধু হয়। ফলে চরিত্র কলুষিত ও জীবনহানি হয়।
চ) আলস্যপরায়নতার ফলে অনুৎপন্ন ধন উৎপন্ন হয় না, উৎপন্ন ধন ধ্বংস হয়। এছাড়া তথাগত বুদ্ধ এ বিষয়ে আরো কিছু পরামর্শ প্রদান করেন। যেমন-
মিত্রের লক্ষণ: যে ব্যক্তি বন্ধুকে পাপকার্য হতে নিবৃত্ত করেন, মঙ্গলকার্যে প্রবৃত্ত করেন অশ্রুত বিষয় শ্রবণ করায়, স্বর্গে যাওয়ার পথ নির্দেশ করে এরূপ ব্যক্তিকে প্রকৃত বন্ধু বা মিত্র বলে জানবে। এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা উচিত।
অমিত্রের লক্ষণ: যে সর্বদা অপরের ধন হরণ করে, বাক সর্বস্ব, চাটুকার ও প্ররোচক- এরূপ ব্যক্তি মিত্ররূপী অমিত্র। তাকে বর্জনীয়।
গৃহীর ষড়দিক: ধার্মিক গৃহীর ছয় প্রকার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা উচিত। একে গৃহীর ষড়দিক রক্ষা করা বলে।
ক) পূর্ব দিকে নমস্কারের অর্থ হচ্ছে মাতাপিতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা। পাঁচভাবে মাতা-পিতার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয়। যথা- ১. বৃদ্ধকালে মাতা-পিতার ভরণ পোষণ করা, ২. নিজের কাজের আগে তাঁদের কাজ সম্পাদন করা, ৩. বংশ মর্যাদা রক্ষা করা, ৪, মাতা-পিতার বাধ্যগত থেকে তাঁদের বিষয়সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ এবং ৫. মৃত জ্ঞাতিদের উদ্দেশে দান দেওয়া। মাতাপিতাও সন্তানের প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য পালন করতে হয়। যথা ১. পাপ হতে নিবৃত্ত করা, ২. কল্যাণকর্মে প্রবৃত্ত করা ৩. উপযুক্ত সময়ে বিদ্যা শিক্ষা দান করা ৪. পরিণত বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ করা, ৫. যোগ্যতা চিন্তা করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করা।
খ) পশ্চিম দিকে নমস্কারের অর্থ হচ্ছে স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য পালন করা। স্ত্রী প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য পালন করতে হয়। যথা: ১. স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রর্দশন করা, ২. ভদ্র ব্যবহার করা, ৩. পরস্ত্রীতে আসক্ত না হয়ে স্বীয় স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, ৪. বৈষয়িক ব্যাপারে কর্তৃত্ব দেওয়া এবং ৫. সাধ্যমতো বস্ত্রালংকার দেওয়া। স্ত্রীকেও স্বামীর প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য পালন করতে হয়। যথা: ১. সুচারুরূপে গৃহকার্য করা, ২. পরিজনবর্গ ও অতিথিদের প্রতি সাদর সম্ভাষণ করা, ৩. স্বামীর প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ রাখা, ৪. স্বামীর সঞ্চিত ধন অপচয় না করা এবং ৫. গৃহকর্মে নিপুণা এবং অলস না হওয়া।
গ) উত্তর দিকে নমস্কারের অর্থ হচ্ছে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের প্রতি কর্তব্য পালন করা। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য পালন করতে হয়। যথা: দান ও সামগ্রিক অর্থ সাহায্য করা, ২. প্রিয়বাক্য বলা, ৩. হিতাচরণ করা, ৪. প্রগাঢ় সহানুভূতি প্রদর্শন করা এবং ৫. সরল ব্যবহার করা। আত্মীয়স্বজন ও কুলপুত্রে প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য করতে হয়। যতা: ১। প্রমত্তকালে তাকে রক্ষা, ২. তার ধনসম্পত্তি রক্ষা করা, ৩. ভয়ে আশ্বস্ত করা, ৪. বিপদকালে তাকে ত্যাগ না করা এবং ৫. তাকে সম্মান করা।
ঘ) দক্ষিণ দিকে নমস্কারের অর্থ হচ্ছে গুরুর প্রতি কর্তব্য পালন করা। গুরুর প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য পালন করতে হয়। যথা: ১. গুরুর সামনে উচ্চ আসনে না বসা, ২. সেবা করা, ৩. আদেশ পালন করা, ৪. মনোযোগ সহকারে উপদেশ শ্রবণ করা এবং ৫. বিদ্যাভ্যাস করা। গুরুকেও শিষ্যের প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য পালন করতে হয়। যথা: ১. সুন্দররূপে বিনীত করা, ২. খুঁটিনাটি বিষয় শিক্ষা দেওয়া, ৩. পাঠ্য বিষয় নির্বাচন করে দেওয়া, ৪. বন্ধুদের নিকট ছাত্রের প্রশংসা করা এবং ৫. বিপদে রক্ষা করা।
ঙ) উর্ধ্ব দিতে নমস্কারের অর্থ হচ্ছে শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের প্রতি কর্তব্য পালন করা। শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য পালন করতে হয়। যথা: ১. শ্রদ্ধাচিত্তে অন্ন, বস্ত্র, ঔষধ বাসস্থান প্রভৃতি দিয়ে সেবা করা, ২. জনসাধারণকে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন করে তোলা, ৩. তাঁদের হিত কামনা করা, ৪. শ্রদ্ধাচিত্তে তাঁদের অভ্যর্থনা জানানো এবং ৫. উৎকৃষ্ট খাদ্যদ্রব্য দিয়ে অ্যাপ্যায়ন করা। শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণও ও গৃহীর প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য পালন করতে হয়। যথা: ১. তাকে পাপকর্ম হতে নিবৃত্ত রাখা, ২. কল্যাণকর্মে প্রবৃত্ত করা, ৩. তাদের হিত কামনা করা, ৪. অশ্রুত বিষয় ব্যক্ত করা এবং ৫. জ্ঞাত বিষয় সংশোধন করে দেওয়া ও সুমার্গ প্রদর্শন করা।
চ) অধঃ দিকে নমস্কারের অর্থ হচ্ছে কর্মচারীদের প্রতি কর্তব্য পালন করা। কর্মচারীদের প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য পালন করতে হয়। যথা: ১. সামর্থ অনুযায়ী কার্যভাব অর্পণ করা, ২. উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া, ৩. রোগের সময় সেবা করা, ৪. উৎকৃষ্ট খাদ্য ভাগ করে দেওয়া এবং ৫. মধ্যে মধ্যে বিশ্রাম দেওয়া। কর্মচারীদেরও গৃহস্বামীর প্রতি পাঁচ প্রকার কর্তব্য পালন করতে হয়। যথা: ১. গৃহস্বামীর পূর্বে শয্যা ত্যাগ করা, ২. পরে শয়ন করা, ৩. কেবল প্রদত্ত বস্তু গ্রহণ করা, ৪. যথাযথভাবে কর্ম সম্পাদনা করা এবং ৫. গৃহস্বামীর সুখ্যাতি ও প্রশংসা করা।
এ সূত্রেও তথাগত বুদ্ধ গৃহীবিধান বিষয়ে কোলীয় বংশের ব্যঘপজ্জ নামক এক ব্রাহ্মণকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। এক সময় বুদ্ধ কোলীয় গ্রামে অবস্থান করছিলেন। ব্যঘপজ্জ নামক একজন কোলীয় বুদ্ধের নিকট সংসারে আবদ্ধ গৃহীদের ইহকাল ও পরকালে হিতের জন্য কিছু নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ করেন। বুদ্ধ গৃহীজীবনে মঙ্গলজনক চারটি বিষয় মেনে চলার নির্দেশ দেন। নিদের্শনাসমূহ নিচে তুলে ধরা হলো
উৎসাহ: পরিশ্রম ও সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ দ্বারা জীবিকা নির্বাহে উৎসাহী হতে হবে। যেকোনো কাজ সুসম্পন্ন করার প্রতি উৎসাহী হতে হবে।
সংরক্ষণ: সদুপায়ে কষ্টে অর্জিত অর্থসম্পদ সর্তকতার সাথে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে চোর, অপহরণকারী, ঈর্ষাপরায়ণ জ্ঞাতি বা আগুন দ্বারা নষ্ট না হয়।
সৎলোকের সংশ্রব: ত্রিরত্নে শ্রদ্ধাশীল, প্রজ্ঞাসম্পন্ন, শীলবান, অপরের মঙ্গলকামী ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করা উচিত। এঁদের সৎ গুণাবলি অনুসরণ করা উচিত। এঁরাই কল্যাণমিত্র। সৎ জীবন গঠনে এঁদের সংশ্রব অপরিহার্য।
শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবযাপন: আয় বুঝে ব্যয় করা গৃহীর একান্ত কর্তব্য। মিতব্যয়ী হতে হবে। আবার কৃপণতাও পরিহার করতে হবে। আয়-ব্যয় সমন্বয় করে যথারীতি জীবিকা নির্বাহকে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন বলে।
বুদ্ধ এ-প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, চারটি গুণে গুনান্বিত হলে ইহ ও পরকালে মহা উপকার সাধিত হয়।
সে চার গুণ হলো-শ্রদ্ধাগুণ, শীলগুণ, দানগুণ ও প্রজ্ঞাগুণ।
৩. আয়-ব্যয় বিষয়ে বুদ্ধের উপদেশ:
বুদ্ধ আয় বা লাভের অংশকে চার ভাগ করে ব্যবহার করতে উপদেশ দিয়েছেন যথা:
১. একভাগ নিজে পরিভোগ করবে। এ অংশ থেকে এক ভাগ দান করবে।
২. দুই ভাগ কৃষি বা বাণিজ্যে নিযুক্ত করবে।
৩. চতুর্থ ভাগ সঞ্চয় করে রাখবে, যাতে বিপদের দিনে ব্যবহার করা যায়।
এগুলো ছাড়াও গৃহীদের উদ্দেশ্য করে বুদ্ধ আরও অনেক ধর্মোপদেশ দান করেছেন। এসব উপদেশ পালনে গৃহী- জীবন যেমন সুখের হয়, তেমন নির্বাণের পথেও অগ্রসর হওয়ার যায়। তাই এসব উপদেশ সকল গৃহীর মেনে চলা উচিত।
মানবজীবন গঠন করার জন্য প্রত্যেক মানুষকে পরিপূর্ণ নিয়ম-নীতি অনুশীলন করা খুবই প্রয়োজন। নিয়ম-নীতি ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে সুন্দর ও আদর্শ জীবন গঠন করা সম্ভব নয়। সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধ জীবন লাভ করার জন্য বুদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহীদের অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। ত্রিপিটক গ্রন্থে তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। দীর্ঘনিকায়ের অষ্টকথায় গৃহীদের বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে "ইমস্মিও পন সূত্তে যং কিঞ্চি গিহিনা কত্তবক্সং অকথিতং নথি, তস্মা অথং সুত্তন্তো গিহিবিনযো নাম", অর্থাৎ গৃহীদের যা কিছু বিধিবিধান করণীয়, তা এই সূত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে। গৃহী জীবনে বুদ্ধ বিভিন্ন সূত্রে আদর্শ জীবন গঠনে করণীয় নিয়ম-নীতিগুলো প্রতিপালন করলে প্রত্যেকের জীবনে কল্যাণ সাধিত হবে। দৈনন্দিন জীবনে আদর্শ জীবন গঠনে করণীয় চারটি নিত্যকর্ম সম্পাদন করা আবশ্যক। নিচে ত্যা তুলে ধরা হলো :
১. প্রাতঃকৃত্য: মানবজীবনে সুন্দর ও আদর্শ জীবন গঠনের জন্য সূর্যোদয়ের আগে শয্যা ত্যাগ করা উচিত। যারা ভোরভেলা শয্যা ত্যাগ করে, তাদের মানসিক প্রশান্তি বাড়ে। প্রথমে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে প্রয়োজনে স্নান করে সকল প্রাণীর সুখও মঙ্গলের জন্য বুদ্ধের সামনে গিয়ে ত্রিরত্ন প্রার্থনা করতে হয়। সকালে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে ফুল পূজা, ধূপবাতি পূজা, বিভিন্ন ফল ও আহার্য দ্রব্য দিয়ে বুদ্ধ পূজা করতে হয়। প্রয়োজনে বিহারে ভিক্ষুর কাছে পঞ্চশীল গ্রহণ করে সূত্র শ্রবণ করার মাধ্যমে দিনের কাজ শুরু করা উচিত।
২. সারাদিনের কর্মজীবন: মানবজীবন বড়ই দুঃখ ও কষ্টকর। সুন্দর ও আদর্শ জীবন গঠন করার জন্য সৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারলে মৃত্যুর পর সুগতি প্রাপ্ত হয়। সৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য বুদ্ধ উল্লেখ করেছেন- অস্ত্র বাণিজ্য, প্রাণী বাণিজ্য, মাংস বাণিজ্য, বিষ বাণিজ্য, মদ বাণিজ্য এ পঞ্চ বাণিজ্য নিষিদ্ধ। সৎ উপায়ে জীবিকা অর্জনের জন্য কৃষিকাজ ও অন্যান্য বাণিজ্য করা যেতে পারে।
৩. সান্ধ্যকৃত্য: শরীর ও মন ভালো থাকার জন্য সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ ব্যায়াম করা বা পদচারণ করা উচিত। অনেকে সকালে এ ব্রত পালন করে থাকে। খোলা আকাশে কিছুক্ষণ ভ্রমণ করলে শরীর রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত হয়। অনেকে চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ করে ভালোভাবে মুখ-হাত ধৌত করে নিকটস্থ কোনো বিহার বা বাড়িতে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে এককভাবে বা সমবেতভাবে বুদ্ধ বন্দনা করে থাকে। যদি বিহাবের বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকেন, তিনি সন্ধ্যায় একটা নির্দিষ্ট সমবেত ত্রিরত্ন বন্দনার আয়োজন করবেন, প্রয়োজনে ত্রিপিটক থেকে বিভিন্ন সূত্র পাঠ করবেন।
৪. রাতের কৃত্য: শরীর সুস্থ ও ভালো থাকার জন্য নিয়মিত আহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে পরিমিত আহার করা উচিত। বিশেষ করে গভীর রাতে আহার করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও শরীরে খাদ্য হজম হয় না, এতে শরীরের বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হয়। আহার গ্রহণ করার সময় স্মৃতি সহকারে ভোজন করা ভালো। রাতে ভোজন শেষে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমানো উচিত নয়। রাতে আহার করার আগে মৈত্রীভাবনা বা মরণাস্মৃতি ভাবনা করে ঘুমালে ঘুম ভালো হয়।
সভার আচরণবিধি: যথাসময়ে অনুষ্ঠানে যাওয়া এবং সুন্দর পোশাক পরিধান করা সবার উচিত। সভায় এলে নীরবতা পালন করা একটি নৈতিক দ্বায়িত্ব। সকলের বক্তৃতা শুনে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উত্তম।
রোগী দেখতে যাওয়া: পরিবারের কোনো আত্মীয় ও প্রতিবেশীর নিকটস্থ কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে দেখতে যাওয়া একটি সামাজিক দায়িত্ব। যথাসময়ে তাকে ভরণপোষণ দেওয়া, সাহস দেওয়া, প্রয়োজনে ওষুধ-পথ্য দেওয়া দরকার।
মৃত দর্শন: সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনেকসময় কোনো আত্মীয় ও পাড়াপ্রতিবেশী মৃত্যু হলে সেখানে যাওয়া নৈতিক কর্তব্য। একজন আত্মীয় হিসেবে তাঁদের প্রতি সমবেদনা জানানো সামাজিক কর্তব্য। প্রয়োজনবোধে পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে তাদেরকে আর্থিক, কায়িক ও বাচনিকভাবে সহযোগিতা করা উচিত।
পরিবারে ছেলেমেয়েদের কর্তব্য: পরিবারে পড়ালেখার পাশাপাশি মা-বাবাদের বিভিন্ন কাজে-কর্মে সহযোগিতা করা ছেলেমেয়েদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। এতে মা-বাবার কিছুটা কষ্ট কমে। পারিবারিক ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন।
নিত্যপালনীয় ধর্মাচার: প্রতিটি বৌদ্ধপরিবারে পূজার্চনা করার জন্য একটি করে বুদ্ধের আসন রয়েছে। প্রতিদিন বুদ্ধমূর্তিকে শ্রদ্ধা, পূজা, বন্দনা করা দরকার। দৈনিক কমপক্ষে দুবেলা বন্দনা করা সকলের উচিত।
গৃহীদের সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম: বৈশালী একটি সমৃদ্ধ নগরী ছিল। বৈশালীবাসীদের উদ্দেশে বুদ্ধ সপ্ত অপরিহাণীয় ধর্ম দেশনা করেন। বৈশালীতে অবস্থানকালে বজ্জীবাসীর শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকার জন্য বুদ্ধ এটি ব্যাখ্যা করেছিলেন। নিচে তা উল্লেখ করা হলো:
১. সভাসমিতিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে সকলে মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
২. গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্মিলিতভাবে সম্পাদন করা এবং নতুন কিছু ঘটলে তা-ও সবাই মিলিতভাবে করা।
৩. সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কোনোরকম রাষ্ট্রবিরোধী কোনো নীতি চালু না করা, প্রচলিত সুনীতি উচ্ছেদ না করা এবং প্রাচীন সুনীতি ও অনুশাসন মেনে চলা।
৪. গুণী, বয়োবৃদ্ধদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, গৌরব ও পূজা করা এবং তাদের আদেশ পালন করা।
৫. কুলবধূ এবং কুলকুমারীদের প্রতি কোনোরকম অন্যায় আচরণ না করা অর্থাৎ স্ত্রীজাতির প্রতি সম্মান, মর্যাদা যথাযথভাবে রক্ষা করা।
৬. পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত বিহার, চৈত্য, এবং প্রদত্ত সম্পত্তি যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা ও সদ্ধর্মে প্রতিপালনে অনুগত হওয়া।
৭. অর্হৎ ও শীলবান ভিক্ষুদের প্রয়োজনীয় দান দিয়ে সেবা করা, তাঁদের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা ও নিরাপদ অবস্থান সুনিশ্চিত করা।
আরও দেখুন...