আদর্শ জীবন চরিত
এ অধ্যায়ে যা আছে-
বৌদ্ধধর্মে অনেক মহান ও আদর্শবান ব্যক্তি আছেন যাঁরা নিজ নিজ কর্মগুণে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। ত্রিপিটকে বহু প্রসিদ্ধ থের-থেরী, শ্রেষ্ঠী এবং ধর্মপ্রাণ উপাসক-উপাসিকার কথা আছে। তাঁরা সৎ জীবন-যাপন করতেন। মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দান করতেন। তাঁরা বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসার, পরোপকার, মানবকল্যাণ, সৎ জীবনযাপন, নীতিশিক্ষা প্রভৃতিতে অনেক অবদান রেখেছেন। তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করে মহৎ জীবন গঠন করা যায়। তোমরা পূর্বের শ্রেণিতে মহাপ্রজাপ্রতি গৌতমী ও সীবলী থের সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনেছ। এ অধ্যায়ে তোমরা সীবলী থের সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানতে পারবে। এছাড়াও, মিত্রা থেরী এবং সুজাতার জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানতে পারবে।
সীবলী থের
মহালি কুমার ছিলেন বৈশালী রাজ্যের লিচ্ছবি বংশের রাজপুত্র। তিনি কোলীয় রাজ্যের পরমা সুন্দরী রাজকন্যা সুপ্রবাসাকে বিবাহ করেন। মহালি কুমার ও সুপ্রবাসা খুবই ধার্মিক ছিলেন। সৎ ও ন্যায়ের পথে থেকে তাঁরা সংসার জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। যথাসময়ে রানি সুপ্রবাসা গর্ভবতী হন। গর্ভবতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহালি কুমারের পরিবার এবং বৈশালী রাজ্য প্রচুর ধন-সম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। তখন রাজা ও রানি বুঝতে পারলেন তাঁদের সংসারে এক পুণ্যবান সন্তান জন্মগ্রহণ করবেন। কিন্তু অতীত কর্মফলের কারণে সুপ্রবাসা অনেক গর্ভযন্ত্রণা ভোগ করেন। গর্ভযন্ত্রণা হতে মুক্তি লাভ এবং নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য তিনি সাতদিন ভিক্ষুসংঘকে মহাদান দেন। এ দানের প্রভাবে তিনি নিরাপদে এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। তাঁরা পুত্রের নাম রাখেন সীবলী কুমার। জন্মের পর থেকে পিতা-মাতার পরম আদর-যত্নে সীবলী কুমার বড়ো হতে লাগলেন। কিন্তু সংসারের কাজ কর্মে তিনি ছিলেন উদাসীন। সব সময় চিন্তামগ্ন থাকতেন। অতঃপর, পরিণত বয়সে সীবলী বুদ্ধের অগ্রশ্রাবক সারিপুত্র থের'র নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। অতীত জন্মে তিনি অনেক কুশলকর্ম সম্পাদন করেছিলেন। সেই কর্মফলের কারণে প্রব্রজ্যা গ্রহণের দিনেই তিনি অর্হত্বফল লাভ করেন। তাঁর প্রব্রজ্যা গ্রহণের পর থেকে ভিক্ষুসংঘেরও লাভ সৎকার বেড়ে যায়। অতীত পুণ্যকর্মের ফল স্বরূপ তিনি যা চাইতেন তা লাভ করতেন। এই কারণে ভিক্ষুসংঘে তিনি 'লাভীশ্রেষ্ঠ' নামে পরিচিত ছিলেন। ত্রিপিটকের অন্তর্গত থেরগাথা গ্রন্থে সীবলী থের'র জীবন বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। তোমরা সেই জীবনী পাঠ করে সীবলী থের'র নানা গুণাবলি সম্পর্কে জানতে পারবে।
বৌদ্ধরা বুদ্ধের পাশাপাশি সীবলী থেরকেও ফুল, ফল, পানীয়, আহার ও দানীয়বস্তু দ্বারা পূজা করে থাকেন। পূজার সময় শ্রদ্ধ্য সহকারে 'সীবলী পরিত্রাণ সূত্র' পাঠ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক বৌদ্ধ বিহার ও পরিবারে আনুষ্ঠানিকভাবে সীবলী পূজার আয়োজন করা হয়। বৌদ্ধদের বিশ্বাস, সীবলী থেরকে পূজা করলে এবং 'সীবলী পরিত্রাণ সূত্র' পাঠ করলে সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট ও অভাব-অনটন দূর হয়। ধন-সম্পদ লাভ হয়। সংসার জীবন সুখের হয়।
সীবলী থের'র গুণাবলি
সীবলী থের অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি সর্বদা উত্তমরূপে শীল পালন করতেন। দান কর্ম করতেন। অন্যকে শীল পালন ও দান প্রদানে উপদেশ দিতেন। সকল প্রকার অকুশল কর্ম থেকে বিরত থাকতেন। ধ্যান সাধনা ও সংযত জীবন যাপন করতেন।
সীবলী থের'র উপদেশ
যিনি শীল পালন করেন তিনি ইহলোকে প্রসংশা ও সম্মান প্রাপ্ত হন। শীলবান ও সুচিত্তের অধিকারী ব্যক্তি ইহলোকে সুকীর্তি ও পরকালে নির্বাণ লাভ করেন। সীবলী থের'র গুণাবলি ও উপদেশ অনুসরণ করা আমাদের প্রত্যেকের উচিত।
অংশগ্রহণমূলক কাজ-২৯: একক কাজ
মিলকরণ: বাম পাশের বাক্যের সাথে ডান পাশের সঠিক বাক্যের মিল করি
ক. মহালি কুমার ছিলেন | ক. খুবই ধার্মিক ছিলেন। |
খ. মহালি কুমার ও সুপ্রবাসা | খ. সুপ্রবাসা ভিক্ষুসংঘকে মহাদান দেন। |
গ. নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য | গ. লিচ্ছবি বংশের রাজপুত্র। |
ঘ. শীল পালনকারী ব্যক্তি | ঘ. প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। |
ঙ. সীবলী অগ্রশ্রাবক সারিপুত্র থের'র নিকট | ঙ. প্রশংসা ও সম্মান প্রাপ্ত হন। |
অংশগ্রহণমূলক কাজ-৩০: দলগত কাজ
অনুচ্ছেদ লিখন: দলে আলোচনাপূর্বক নিজেদের দেখা সীবলী পূজা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদ লিখি
মিত্রা থেরী
গৌতম বুদ্ধের সময়ে মিত্রা থেরী কপিলাবস্তু নগরে শাক্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি অত্যন্ত শীলবান ও বিনয়ী ছিলেন। মানব সেবা ও কল্যাণে তিনি সর্বদা নিয়োজিত থাকতেন। সংসারের প্রতি তিনি ছিলেন সদা উদাসীন। তিনি মহাপ্রজাপতি গৌতমীর সঙ্গে সংসার ত্যাগ করে ভিক্ষুণীব্রত গ্রহণ করেন। ভিক্ষুণীব্রত গ্রহণ করে তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কর্মগুণে তিনি ভিক্ষুণীসংঘে মর্যাদাপূর্ণ স্থান লাভ করেন।
প্রব্রজ্যা গ্রহণের পর তাঁর প্রজ্ঞাচক্ষু উৎপন্ন হয়। জগত সংসারের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করে তিনি বলেন, 'স্বর্গ আমার কাম্য নয়। রাগ, ঘৃণা, হিংসা, লোভ পরিহার করে একাহারী হয়ে ভিক্ষুণী জীবনব্রত পালন করছি। সর্বপ্রাণীর কল্যাণ সাধনই আমার ব্রত।'
মিত্রা থেরীর উপদেশ
সকলের রাগ, ঘৃণা, হিংসা, লোভ পরিহার করে সর্ব প্রাণীর কল্যাণ সাধন করা উচিত।
অংশগ্রহণমূলক কাজ-৩১: একক কাজ
কুইজ: টিক (✔) চিহ্ন দিয়ে সঠিক উত্তর বাছাই করি
ক) মিত্রা থেরী কোন বংশে জন্মগ্রহণ করেন? মৌর্যবংশে/শাক্যবংশে/ক্ষত্রিয়বংশে
খ) শৈশবে মিত্রা থেরী ছিলেন ধর্মপরায়ণ/কৃপণ/সত্যবাদী
গ) সংসারের প্রতি মিত্রা থেরী ছিলেন আগ্রহী/উদাসীন/উৎফুল্ল
ঘ) প্রব্রজ্যা গ্রহণের পর কার প্রজ্ঞাচক্ষু উৎপন্ন হয়। বিশাখার/ মিত্রা থেরীর/মহাপ্রজাপতি গৌতমী থেরীর
ঙ) 'সর্বপ্রাণীর কল্যাণ সাধনই আমার ব্রত' উক্তিটি- সুজাতার/ ক্ষেমা থেরীর/মিত্রা থেরীর
অংশগ্রহণমূলক কাজ-৩২: একক কাজ
বাক্য লিখন: মিত্রা থেরী'র উপদেশ অনুসরণ করলে যে উপকার লাভ করা যাবে সে সম্পর্কে ৫টি বাক্য লিখি
১ |
২ |
৩ |
৪ |
৫ |
সুজাতা
সুজাতা ছিলেন একজন মহান ধার্মিক উপাসিকা। নৈরঞ্জনা নদীর তীরে উরুবেলার সেনানী নামক এক গ্রাম ছিল। সুজাতা সেই গ্রামের এক শ্রেষ্ঠী কন্যা ছিলেন। সে সময় সেনানী গ্রামের নিকটে প্রাচীন এক বিশাল অশ্বত্থ বৃক্ষ ছিল। তখন সেনানী গ্রামে বৃক্ষদেবতাকে পূজা দেয়ার প্রথা প্রচলন ছিল। একদিন শ্রেষ্ঠীকন্যা সুজাতা অশ্বত্থ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেন যে, 'যদি আমি উপযুক্ত স্বামী লাভ করি এবং প্রথম পুত্রসন্তানের মা হই, তবে প্রতিবছর আমি বৃক্ষদেবতাকে পূজা-অর্ঘ্য দান করব।' যথাকালে তাঁর সেই আশা পূর্ণ হয়েছিল। পরিণত বয়সে নন্দিক বণিকের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল এবং বিয়ের পর তিনি এক পুত্র সন্তান লাভ করেছিলেন। সন্তান লাভের পর তিনি বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে বৃক্ষদেবতাকে পূজা করবেন বলে মনস্থির করেন। পূজার উদ্দেশ্যে তিনি পরম যত্নে পায়েস তৈরি করছিলেন। সে সময় তিনি পূর্ণা নামক দাসীকে বলেন, 'মা পূর্ণা! তুমি পূজার বেদিটা পরিষ্কার করে এসো।'
চিত্র-১৪: সুজাতার পায়সান্ন দান
দাসী পূর্ণা দ্রুত সেখানে গিয়ে দেখল, এক দেবতা নিগ্রোধ গাছের গোড়ায় বসে আছেন। সে চিন্তা করল, 'আজ বৃক্ষদেবতা নিজ হাতে পূজা গ্রহণ করার জন্য গাছের নিচে বসে আছেন।' মূলত সে সময় নিগ্রোধ বৃক্ষের নিচে সিদ্ধার্থ গৌতম ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। উৎফুল্ল চিত্তে দাসী পূর্ণা এসে শ্রেষ্ঠীকন্যা সুজাতাকে শুভ সংবাদটি জানালেন। সংবাদ শুনে শ্রেষ্ঠীকন্যা সুজাতা সোনার পাত্রে পায়েস এবং পূজার বিবিধ উপকরণ নিয়ে অশ্বত্থ গাছের নিচে এলেন। সুজাতা গাছের নিচে বেদিতে বসা সিদ্ধার্থকে দেখে বৃক্ষদেবতা মনে করলেন। তখন শ্রদ্ধা নিবেদনপূর্বক নিজ হাতে পূজাসহ সিদ্ধার্থকে সোনার পাত্রে পায়েস ও পানীয় দান করেন। এর পর সশ্রদ্ধ বন্দনা করে বিনম্র বাক্যে বললেন, 'দেব! পাত্রসহ এই পায়েস ও সুগন্ধি পানীয় আপনাকে দান করছি। এই দান গ্রহণ করে আপনি আমাকে কৃতার্থ করুন।' সিদ্ধার্থ গৌতম সুজাতার দান গ্রহণ করলেন এবং সুজাতা প্রদত্ত পায়েস খেয়ে নিগ্রোধ বৃক্ষের নিচে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হন। অবশেষে সিদ্ধার্থ গৌতম সেই বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বোধিজ্ঞান লাভ করেন এবং জগতে 'বুদ্ধ' নামে খ্যাত হন।
অংশগ্রহণমূলক কাজ-৩৩: একক কাজ
মিলকরণ: বাম পাশের বাক্যের সাথে ডান পাশের সঠিক বাক্যের মিল করি
সুজাতা ছিলেন একজন মহান |
সুজাতার স্বামীর নাম ছিল |
পূর্ণা নামক মহিলা ছিলেন |
সিদ্ধার্থকে দেখে সুজাতা |
সুজাতার প্রদত্ত পায়েস খেয়ে |
সিদ্ধার্থ বোধিজ্ঞান লাভ করেন। |
বৃক্ষদেবতা মনে করলেন। |
ধার্মিক উপাসিকা। |
নন্দিক বণিক |
সুজাতার দাসী |
জীবনচরিত পাঠে সুফল
মহান ব্যক্তিদের জীবনচরিত পাঠে তাঁদের জীবন ও কর্মের নানা দিক সম্পর্কে জানা যায়। দয়া, উদারতা, ত্যাগ, সংযম, সৎচরিত্র মহৎ ব্যক্তিগণের জীবনের অনন্য গুণ। তাঁরা সর্বদা মৈত্রীপরায়ন ও মহানুভব সম্পন্ন হন। তাঁরা অন্যের উপকার, কল্যাণ এবং সুখের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। তাঁরা সকল প্রাণীর সুখের জন্য কুশল কর্ম করেন। পালি সাহিত্যে সীবলী থের, মিত্রা থেরী এবং সুজাতার মতো আরো অনেক মহৎ ব্যক্তির আদর্শ জীবনচরিত পাওয়া যায়। তাঁরা সকল মানুষের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি, ঐক্য ও সৌহার্দ্যের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। কর্মগুণে তাঁরা হয়েছেন স্মরণীয় ও সম্মানিত। অসংখ্য ভালো ও কল্যাণকর কর্মের কারণে আজও তাঁরা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। তাঁরা সর্বদা পরহিত ও পর কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। এসব বরেণ্য ব্যক্তিদের জীবনচরিত পাঠ করলে অনেক সুফল পাওয়া যায়। তাঁদের জীবনচরিত পাঠ করে আদর্শবান হওয়া যায়। সৎ ও ন্যায় পরায়ণ হওয়া যায়। সহনশীল, উদার ও পরোপকারের মনোভাব সৃষ্টি হয়। নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি বিকশিত হয়। তাই আমাদের আদর্শ জীবনচরিত পাঠ করা এবং মহৎ ব্যক্তিদের শিক্ষা ও আদর্শ অনুশীলন করা উচিত।
অংশগ্রহণমূলক কাজ-৩৪: দলগত কাজ
তালিকা তৈরি: মহৎ ব্যক্তিদের জীবনচরিত পাঠ করে যেসব গুণাবলি অর্জন করা যায় দলে আলোচনাপূর্বক তার একটি তালিকা তৈরি করি
আরও দেখুন...