উপাসনা অর্থ ঈশ্বরকে স্মরণ করা। একাগ্রচিত্তে ঈশ্বরকে ডাকা। ঈশ্বরের আরাধনা করা। উপাসনা ধর্মপালনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ বা পদ্ধতি। ধ্যান, জপ, কীর্তন, পূজা, স্তব- স্তুতি, প্রার্থনা প্রভৃতি পদ্ধতিতে উপাসনা করা হয়।
একাগ্রচিত্তে ঈশ্বরের চিন্তা করার নাম ধ্যান। নীরবে ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করাকে বলে জপ। সরবে ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ বা গুণগান করার নাম কীর্তন। ঈশ্বরের প্রশংসা করে তাঁর নাম উচ্চারণ করাকে বলা হয় স্তব বা স্তুতি।
উপাসনা করলে দেহ-মন পবিত্র হয়। উপাসনার সময় আমরা ঈশ্বরের প্রশংসা করি। তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করি। সকলের কল্যাণ কামনা করি ।
নিচের ছকটি পূরণ করি :
উপাসনা করার তিনটি পদ্ধতির নাম লিখি : |
---|
১। |
২। |
৩। |
‘সাকার’ অর্থ যার আকার বা রূপ আছে। আকার বা রূপের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করাই সাকার উপাসনা। বিভিন্ন দেব-দেবী, যেমন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কালী, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি ঈশ্বরের সাকার রূপ। আমরা ঈশ্বরকে দেব-দেবীর প্রতিমারূপে ও অবতাররূপে উপাসনা করি। এরূপ উপাসনায় ভক্ত ঈশ্বরকে সাকাররূপে কাছে পায়। তাঁকে পূজা করে। তাঁর নিকট প্রার্থনা করে।
ঈশ্বরকে নিরাকারভাবেও উপাসনা করা যায়। নিরাকার উপাসনায় ভক্ত নিজের অন্তরে ঈশ্বরকে অনুভব করেন। ঈশ্বরের নাম জপ করেন অর্থাৎ নীরবে ঈশ্বরের নাম মনে মনে উচ্চারণ করেন। ঈশ্বরের নাম কীর্তন করেন। তাঁর স্তব-স্তুতি করে তাঁর নিকট প্রার্থনা জানান। নিজের ও জগতের কল্যাণ কামনা করেন ।
উপাসনার পদ্ধতি সাকার বা নিরাকার যা-ই হোক-না-কেন, সবই ঈশ্বরের উপাসনা । ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, নিরাকার ব্রহ্মই প্রয়োজনে সাকার রূপ ধারণ করেন। অর্থাৎ যিনি নিরাকার, তিনিই আবার সাকার। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘আমাকে যে যেভাবে ভজনা করে, আমি তাকে সেভাবেই কৃপা করি।' সুতরাং ঈশ্বরকে সাকার ও নিরাকার দুভাবেই উপাসনা করা যায় ৷
নিরাকাররূপে ঈশ্বরের ধ্যান করা হয়। সাকাররূপে তাঁর পূজা করা হয় ৷
সুতরাং ধ্যান, জপ, কীর্তন, পূজা, স্তব-স্তুতি, প্রার্থনা প্রভৃতি পদ্ধতিতে আমরা ঈশ্বরের উপাসনা করব।
উপাসনা একটি নিত্যকর্ম। প্রতিদিন উপাসনা করতে হয়। প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় তিনবার ঈশ্বরের উপাসনা করা কর্তব্য। উপাসনার জন্য আমাদের দেহ-মনের পবিত্রতা প্রয়োজন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে উপাসনা করতে হয়। মন্দিরে বা ঘরে বসে উপাসনা করা যায়। দেবতার সামনে বসে সাকার উপাসনা করতে হয়। উপাসনার সময় সোজা হয়ে উত্তর বা পূর্ব দিকে মুখ করে বসতে হয়।
নিচের ছকটি পূরণ করি :
১। ঈশ্বরকে ব্রহ্মভাবে উপাসনা করাই | |
২। প্রতিদিন উপাসনা করার সময় |
উপাসনা করার জন্য অনেক আসন বা বসার পদ্ধতি আছে। তবে পদ্মাসন ও সুখাসন উপাসনার জন্য বিশেষ উপযোগী। এখানে পদ্মাসন ও সুখাসনের ছবি দেওয়া হলো :
একা বসে যেমন উপাসনা করা যায়, তেমনি অনেকে একসঙ্গে বসেও উপাসনা করা যায় । অনেকে একসঙ্গে বসে উপাসনা করাকে সমবেত উপাসনা বলে ।
এজন্য সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে সকলে মন্দিরে বা পবিত্র স্থানে মিলিত হয়ে একসঙ্গে বসে উপাসনা করতে হয়।
আমরা জানি, উপাসনার সময় আমরা ঈশ্বরের স্তুতি বা প্রশংসা করি। ঈশ্বরের মহিমা চিন্তা করি। উপাসনা আমাদেরকে সৎপথে বা ধর্মপথে পরিচালিত করে। তাই সৎপথে চলার জন্য আমরা নিয়মিত উপাসনা করব। ঈশ্বরের নিকট শক্তি প্রার্থনা করব। নিজের ও অন্যের মঙ্গল কামনা করব।
প্রার্থনা হচ্ছে ঈশ্বরের নিকট কিছু চাওয়া। ঈশ্বর এ বিশ্বের সর্বময় কর্তা। তিনি করুণাময়। তাঁর দয়ার উপরেই আমাদের সবকিছু নির্ভর করে। তাই ঈশ্বরের নিকট আমাদের প্রাণের আবেদন জানাই। তাঁর কাছে নিজের ও অন্যের মঙ্গল কামনা করি। এই যে ঈশ্বরের কাছে কিছু চাওয়া, একেই বলে প্রার্থনা। উপাসনার একটি অঙ্গ হলো প্রার্থনা। উপাসনার সময় ছাড়াও আমরা ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করতে পারি। কোনো শুভ কাজের পূর্বে আমরা ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা জানাই। আবার কোনো বিপদে পড়লে বিপদ থেকে মুক্তির জন্যও আমরা ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা জানাই ।
নিচের ছকটি পূরণ করি :
১। উপাসনার জন্য উপযোগী আসন হলো | |
২। প্রার্থনা হচ্ছে |
উপাসনার মতো প্রার্থনা করার সময়ও দেহ ও মন পবিত্র থাকা প্রয়োজন। সাধারণত করজোড়ে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করতে হয়। প্রার্থনার সময় মনে দীনতার ভাব থাকতে হবে। তিনি প্রভু, আমি তাঁর দাস, তিনি দাতা আমি গ্রহীতা—এরূপ মনোভাবই দীনতার ভাব। উপাসনার মতো প্রার্থনাও ঈশ্বরের নিকট একা বা সমবেতভাবে করা যায়।
বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থে অনেক মন্ত্র ও শ্লোক রয়েছে। মন্ত্র ও শ্লোকে ঈশ্বর ও বিভিন্ন দেব-দেবীর স্তব করা হয়। স্তব বা স্তুতির অর্থ হচ্ছে ঈশ্বর বা দেব-দেবীর রূপ, গুণ ও মাহাত্ম্য কীর্তন করা। তাঁদের প্রশংসা করা, তাঁদের স্মরণ করা। শুধু স্তবই নয়, আমরা ঈশ্বর ও দেব-দেবীর কাছে প্রার্থনাও করি। যেন সকলের মঙ্গল হয়। সকলেই যেন শান্তি পায়।
হিন্দুধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোতে স্তব ও প্রার্থনামূলক অনেক মন্ত্র ও শ্লোক আছে। ধর্মগ্রন্থগুলো সংস্কৃত ভাষায় লেখা। তাই স্তব-স্তোত্রগুলোও সংস্কৃত ভাষায় রচিত। এছাড়া বাংলা ভাষায় অনেক প্রার্থনামূলক কবিতা আছে।
ঈশ্বর বা দেব-দেবীর স্তব করা হিন্দুধর্মের অঙ্গ। স্তব করলে ঈশ্বর ও দেব-দেবীগণ খুশি হন। তাঁরা আমাদের মঙ্গল করেন। স্তব করলে আমাদের মন পবিত্র হয়। মনে ঈশ্বরের অনুভূতি জাগ্রত হয়।
প্রার্থনা করার সময় আমরা মন্ত্র ও শ্লোকগুলো শুদ্ধভাবে আবৃত্তি করব। সেগুলোর বাংলা সরলার্থও জেনে রাখব ।
নিচের ছকটি পূরণ করি :
১। উপাসনা দুই প্রকার | |
২। নীরবে মন্ত্র বা শ্লোক উচ্চারণ করা |
আমরা এখন বেদ, উপনিষদ, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও শ্রীশ্রীচণ্ডী থেকে কিছু মন্ত্র ও শ্লোক এবং সেগুলোর সরলার্থ জানব। প্রার্থনামূলক বাংলা কবিতাও শিখব।
সবিতা পশ্চাতাৎ সবিতা পুরস্তাৎ
সবিতোত্তরাত্তাৎ সবিতাধরাত্তাৎ।
সবিতা নঃ সুবতু সর্বতাতিং
সবিতা নো রাসতাং দীৰ্ঘমায়ুঃ ৷৷
(ঋগ্ বেদ, ১০/৩৬/১৪)
কি পশ্চিম দিকে, কি পূর্ব দিকে, কি উত্তর দিকে, কি দক্ষিণ দিকে – সূর্যদেব আমাদের - পরিপূর্ণতা দিন, সূর্যদেব আমাদের পরমায়ু দীর্ঘ করুন।
যুক্তায় মনসা দেবান্
সুবৰ্ষতো ধিয়া দিবম্
বৃহজ্ জ্যাতি করিষ্যতঃ
সবিতা প্ৰসুবাতি তান্ ॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, ২/৩)
সূর্যদেব আমার মনকে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত করুন। পরমাত্মা অভিমুখী ইন্দ্রিয়গুলোকে জ্ঞানের দ্বারা সেই পরমাত্মাকে উপলব্ধি করার শক্তি দিন।
অনেকবাহূদরবজ্রনেত্র
পশ্যামি ত্বাং সর্বতোনন্তরূপম্ ।
নান্তং মধ্যং ন পুনস্তবাদি
পশ্যামি বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপ ৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ১১/১৬)
অসংখ্য তোমার হাত, অসংখ্য উদর, অসংখ্য মুখ ও চোখ। তোমার অনন্ত রূপ আমি সর্বত্র দেখছি। কিন্তু হে বিশ্বেশ্বর, বিশ্বরূপ, তোমার আদি, অন্ত, মধ্য কোথাও কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।
শরণাগতদীনার্তপরিত্রাণপরায়ণে।
সর্বস্যার্তিহরে দেবি নারায়ণি নমোস্তু তে ৷৷
(শ্ৰীশ্ৰীচণ্ডী, ১১/১২)
হে দেবী, শরণাগত, দরিদ্র ও পীড়িতজনের পরিত্রাণকারিণী, সকলের দুঃখবিনাশিনী, হে নারায়ণী, তোমাকে প্রণাম জানাই ।
গাব তোমার সুরে দাও সে বীণাযন্ত্র
শুনব তোমার বাণী দাও সে অমর মন্ত্র ।
করব তোমার সেবা দাও সে পরম শক্তি,
চাইব তোমার মুখে দাও সে অচল ভক্তি ৷৷
সইব তোমার আঘাত দাও সে বিপুল ধৈর্য,
বইব তোমার ধ্বজা দাও সে অটল স্থৈর্য ৷৷
(সংক্ষেপিত)
[ গীতবিতান (পূজাপর্ব, গান – ৯৭), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]
এ পরিচ্ছেদে যে-সকল ধর্মগ্রন্থ থেকে মন্ত্র বা শ্লোক নেওয়া হয়েছে, সেগুলো থেকে তিনটি ধর্মগ্রন্থের নাম লিখি :
১। |
২। |
৩। |
এভাবে উপাসনা ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে ইষ্ট দেবতার নাম সংকীর্তন করতে হয়।
উপাসনা ও প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। প্রার্থনা ও উপাসনার মাধ্যমে মনে স্থিরতা ও একাগ্রতা আসে। এ একাগ্রতা শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজন ।
উপাসনা ও প্রার্থনা করে আমরা সৎ ও ধার্মিক হতে পারি। আর আমরা সকলে ধার্মিক হলে আমাদের সমাজ শান্তিপূর্ণ হবে। আমরা সকলে ভালো থাকব। তাই সকলের মঙ্গলের জন্য আমরা প্রার্থনা করব।
১। ঈশ্বর নিরাকার, তবে তিনি ___ হতে পারেন।
২। নিয়মিত উপাসনা করা আমাদের ___।
৩। পদ্মাসন ও ___ উপাসনার জন্য বিশেষ উপযোগী।
৪। প্রার্থনা হচ্ছে ঈশ্বরের নিকট কিছু ___।
৫। প্রার্থনা করার সময় দেহ ও মন. ___ থাকা প্রয়োজন ।
১। মন্ত্র ও শ্লোক শুদ্ধভাবে আবৃত্তি করা হয়। ২। উপাসনা মানুষকে সৎপথে ৩। প্রার্থনার সময় মনে ৪। ঈশ্বরকে ব্রহ্মজ্ঞানে উপাসনা করাই ৫। বিভিন্ন দেব-দেবীকে প্রতিমায় আরাধনা করা | দীনতার ভাব থাকতে হবে। সাকার উপাসনা। প্রার্থনা করার সময় । পরিচালিত করে। পূজা করা হয় ৷ নিরাকার উপাসনা । |
১। উপাসনা কাকে বলে ?
২। নিরাকার উপাসনা কাকে বলে?
৩। সাকার উপাসনা কাকে বলে?
৪। উপাসনার দুটি আসনের নাম লেখ।
৫। কীভাবে প্রার্থনা করতে হয়?
১। উপাসনার অর্থ কী? সাকার ও নিরাকার উপাসনার বর্ণনা দাও ৷
২। উপনিষদ থেকে প্রদত্ত প্রার্থনামূলক মন্ত্রটি সরলার্থসহ লেখ।
৩। আমরা উপাসনা করব কেন? ব্যাখ্যা কর।
৪। প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তা কী?
৫। তোমার পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা প্রার্থনামূলক কবিতাটি লেখ ।
আরও দেখুন...