তোমার জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা কিংবা সাম্প্রতিক কোনো বিষয় যা তোমার মনে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে একটি কবিতা লেখো। তোমার রচিত কবিতাটি শিক্ষক ও সহপাঠীদের সামনে উপস্থাপন করতে পারো।
তোমার লেখা কবিতায় নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো আছে কি না, খুঁজে দেখো-
• কোনো বিষয় বা ভাবকে অবলম্বন করে রচিত কি না?
• লাইনগুলোতে অন্ত্যমিল আছে কি না?
• তাল দিয়ে দিয়ে পড়া যায় কি না?
• উপমা আছে কি না?
কবিতা
বিশেষ কোনো বিষয় বা ভাব নিয়ে কবিতা রচিত হয়। কবিতায় প্রতিফলিত হয় ব্যক্তিমনের আবেগ, অনুভূতি ও উপলব্ধি। কবিতার বাক্যগঠন ও ভাষাভঙ্গি গদ্যের বাক্যগঠন ও ভাষাভঙ্গির চেয়ে আলাদা হয়। কবিতার লাইনকে বলে চরণ এবং অনুচ্ছেদকে বলে স্তবক।
বিভিন্ন ধরনের অলংকার ও ছন্দ কবিতার ভাষাকে সুন্দর করে। নিচে কবিতার অলংকার ও ছন্দ সম্পর্কে
আলোচনা করা হলো।
অলংকার: অলংকার দুই ধরনের: শব্দালংকার ও অর্থালংকার।
শব্দালংকার: কবিতায় প্রতি লাইনের শেষে প্রায়ই অন্ত্যমিল দেখা যায়। এ ধরনের অন্ত্যমিলকে অনুপ্রাস বলে। যেমন: চলি-বলি, হাওয়া-যাওয়া ইত্যাদি। আবার, কখনো কখনো কবিতার চরণের মধ্যে একই ধানির পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায়। যেমন: 'গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে'-এখানে 'গ' এবং 'র' ধ্বনির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এই ধরনের পুনরাবৃত্তির নামও অনুপ্রাস। অনুপ্রাস এক ধরনের শব্দালংকার।
অর্ণালংকার: কবিতায় উপমার ব্যবহার হয়। যেমন: 'রুম বৃদ্ধ ভিখারির রগ-ওঠা হাতের মতন রুক্ষ মাঠ'-এখানে রুক্ষ মাঠকে ভিখারির রগ-ওঠা হাতের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কোনো কিছুর বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার জন্য অন্য কিছুর সঙ্গে এভাবে তুলনা বা সাদৃশ্য তৈরি করাকে উপমা বলে। উপমা এক ধরনের অর্থালংকার।
দ্বন্দ্বঃ ছন্দ বোঝার জন্য নয়, পর্ব ও মাত্রা সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার।
লয় হলো কবিতার গতি। পর্ব হলো কবিতার এক তাল থেকে আরেক তালের মধ্যকার অংশ। আর মাত্রা হলো পর্বের একক। নিচের পদ্যাংশটুকু তাল রক্ষা করে পড়ো এবং খেয়াল করো
জেল ছাড়িয়ে/দল হারিয়ে গেলাম বনের/দিক
/সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে/করে রে ঝিক/মিক
/বনের কাছে/এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে/ভাই,
/আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে/চাই।
উপরের অংশটুকু অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে না পড়লে শ্রুতিমধুর হয় না। পড়ার এই গতির নাম লয়। আবার বাঁকা দাঁড়ির মাঝখানে থাকা 'জল ছাড়িয়ে', 'দল হারিয়ে', 'গেলাম বনের', 'দিক'-এগুলো এক একটি পর্ব। 'জল ছাড়িয়ে' পর্বে ৪ মাত্রা আছে; যথা: জল+ছা+ড়ি+য়ে। একইভাবে 'দল হারিয়ে' পর্বে ৪ মাত্রা: দল+হারি+য়ে; 'গেলাম বনের' পর্বে ৪ মাত্রা: গে+লাম+ব+নের এবং 'দিক' ১ মাত্রা।
লয়, পর্ব, মাত্রা বিবেচনায় ছন্দ তিন ধরনের: স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত। ছন্দভেদে মাত্রা গণনার ধরন আলাদা হয়ে থাকে।
স্বরবৃত্ত
বাংলা
হন্ম: এটি দ্রুত লয়ের ছন্দ। সাধারণত একেকটি পর্ব হয় ৪ মাত্রার। ছড়ার জন্য উপযোগী বলে একে ছড়ার ছন্দও বলা হয়। যেমন:
/এই নিয়েছে ওই নিল যা
/কান নিয়েছে/চিলে।
/চিলের পিছে ঘুরছি মরে
/আমরা সবাই মিলে।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ এই ছন্দের লয় মধ্যম গতির। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৬ মাত্রার পর্ব হয়। এই ছন্দের মাত্রা-গণনা পদ্ধতি একটু আলাদা। যেমন:
/তোমাতে রয়েছে/সকল কেতাব/সকল কালের/জ্ঞান,
/সকল শাস্ত্র/খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ/প্রাণ!
/তোমাতে রয়েছে/সকল ধর্ম, সকল যুগাব/তার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকলের দেব/তার।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ: এই ছন্দের লয় বা গতি ধীর। সাধারণত প্রতি পর্বে ৮ ও ৬ মাত্রা দেখা যায়। এই ছন্দের মাত্রা-গণনা পদ্ধতিও আলাদা। বর্ণ গুনে গুনেও এর মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যেমনঃ
/হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহানা
/তুমি মোরে দানিয়াছ/খ্রিষ্টের সম্মান
(কণ্টক-মুকুট শোভা। দিয়াছ, তাপস,
/অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
কবিতা পড়ি ১
গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪) বাংলাদেশের একজন কবি। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে 'রক্তরাগ', 'খোশরোজ', 'হাস্নাহেনা', 'বনি আদম', 'বিশ্বনবী' ইত্যাদি। নিচের 'জীবন বিনিময়' কবিতাটি কবির 'বুলবুলিস্তান' কাব্য থেকে নেওয়া হয়েছে।
কবিতাটি প্রথমে নীরবে পড়ো। এরপর সরবে আবৃত্তি করো।
গোলাম মোস্তফা
পল্লি-মায়ের বুক ছেড়ে আজ যাচ্ছি চলে প্রবাস-পথে
মুক্ত মাঠের মধ্য দিয়ে জোর-ছুটানো বাষ্প-রথে।
উদাস হৃদয় তাকিয়ে রয় মায়ের শ্যামল মুখের পানে,
বিদায়বেলার বিয়োগ-ব্যথা অশ্রু আনে দুই নয়ানে।
স্নেহময়ী রূপ ধরে মা দাঁড়িয়ে আছে মাঠের পরে,
মুক্ত চিকুর ছড়িয়ে গেছে দিক হতে ওই দিগন্তরে;
ছেলে-মেয়ে ভিড় করেছে চৌদিকে তার আঙ্গিনাতে,
দেখছে না সেই সন্তানেরে পুলক-ভরা ভঙ্গিমাতে।
ওই যে মাঠে গোরু চরে লেজ দুলিয়ে মনের সুখে,
ওই যে পাখির গানের সুখে কাঁপন জাগে বনের বুকে,
মাখাল মাথায় কান্তে হাতে ওই যে চলে কালো চাষা,
ওরাই মায়ের আপন ছেলে-ওরাই মায়ের ভালোবাসা।
ওরা সবাই সহজভাবে ঠাঁই পেয়েছে মায়ের কোলে,
শান্তি-সুখে বাস করে সব,
কাটায় না দিন গণ্ডগোলে,
গোরু-মহিষ যে তাঁই চরে,
শালিক তাহার পাশেই চরে কখনো বা পৃষ্ঠে চড়ে কখনো বা নৃত্য করো
রাখাল ছেলে চরায় খেনু বাজায় বেণু অশখ-মূলে
সেই গানেরই পুলক লেগে ধানের খেত ওই উঠল দুলে;
সেই গানেরই পুলক লেগে বিলের জলের বাঁধন টুটে
মায়ের মুখের হাসির মতো কমল-কলি উঠল ফুটো
দুপুরবেলায় ক্লান্ত হয়ে রৌদ্র-তাপে কৃষক ভায়া
বসল এসে গাছের ছায়ায় ভুঞ্জিতে তার স্নিগ্ধ-ছায়া,
মাথার উপর ঘন-নিবিড় কচি কচি এই যে পাতা,
ও যেন মার আপন হাতে তৈরি করা মাঠের ছাতা।
ঘাম-ভেজা তার ক্লান্ত দেহে শীতল সমীর যেমনি চাওয়া,
পাঠিয়ে দিল অমনি মা তার স্নিগ্ধ-শীতল আঁচল-হাওয়া,
কালো দিঘির কাজল জলে মিটাল তার তৃষ্ণা-জ্বালা,
কোন সে আদি কাল হতে মা রেখেছে এই জলের জালা।
সবুজ ধানে মাঠ ছেয়েছে, কৃষক তাহা দেখলে চেয়ে,
রঙিন আশার স্বপ্ন এলো নীল নয়নের আকাশ ছেয়ে;
ওদেরই ও ঘরের জিনিস, আমরা যেন পরের ছেলে,
মোদের ওতে নাই অধিকার-ওরা দিলে তবেই মেলে
ওই যে লাউয়ের জাংলা-পাতা ঘর দেখা যায় একটু দূরে
কৃষক-বালা আসছে ফিরে নদীর পথে কলসি পুরে,
ওই কুঁড়েঘর-উহার মাঝেই যে-চিরসুখ বিরাজ করে,
নাইরে সে সুখ অট্রালিকায়, নাইরে সে সুখ রাজার ঘরে
কত গভীর তৃপ্তি আছে লুকিয়ে যে ওই পল্লি-প্রাণে,
জানুক কেহ নাই বা জানুক-সে কথা মোর মনই জানে!
মায়ের গোপন বিত্ত যা তার খোঁজ পেয়েছে ওরাই কিছু
মোদের মতো তাই ওরা আর ছোটে নাকো মোহের পিছু।
(সংক্ষেপিত)
শব্দের অর্থ
আরও দেখুন...