আমরা আমাদের বাসায় নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করি। যেমন: খাদ্য লবণ, বেকিং পাউডার, ভিনেগার, কোমল পানীয় ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থ।
খাদ্য লবণ
সাগরের পানিতে অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্য লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) এবং তার সাথে খুবই সামান্য পরিমাণে CaCl2 MgCl2 সহ অন্য কিছু লবণ দ্রবীভূত থাকে। আবার, মাটির তলদেশে খনিজ পদার্থ হিসেবেও সোডিয়াম ক্লোরাইড পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সমুদ্রের পানি থেকে খাদ্য লবণ সংগ্রহ করা হয়। সমুদ্র উপকূলের লবণ চাষিরা বিভিন্ন আকৃতির বর্গাকার বা আয়তাকার জমির চারপাশে বাঁধ নির্মাণ করে খানিকটা খুলে রাখে। জোয়ারের সময় যখন পানি ঐ জায়গায় প্রবেশ করে তখন পানি প্রবেশের মুখ বন্ধ করে জোয়ারের পানি আটকে দেওয়া হয়। যখন ঐ পানি সূর্যের তাপে শুকিয়ে যায় তখন ঐ জায়গায় লবণ দেখতে পাওয়া যায়। এটাকে সল্ট হারভেস্টিং বলে। সস্ট হারভেস্টিং এর মাধ্যমে পাওয়া এই লবণকে শিল্পকারখানায় বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পাদন করে খাবার উপযোগী খাদ্য লবণে পরিণত করা হয়।
সস্ট হারভেস্টিং এর মাধ্যমে পাওয়া লবণের সাথে বালু মিশ্রিত থাকে। এই লবণকে কোনো পাত্রে নিয়ে পানি মিশালে লবণ পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যায় কিছু বালু পাত্রের তলায় পড়ে থাকে। তখন লবণ পানির প্রবণকে হেঁকে আলাদা করে নেওয়া হয়। এবার এই দ্রবণকে তাপ প্রয়োগ করলে পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যায় এবং লবণ পাত্রের তলায় পড়ে থাকে। এভাবে উৎপন্ন লবণকে প্যাকেটে করে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। আমাদের শরীরের যাবতীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবার জন্য বিভিন্ন আয়ন যেমন: Nat, K+ ইত্যাদি দরকার হয়। শরীরে যদি কোনো কারণে Na+ এর ঘাটতি হয় তবে Nacl পানির সাথে মিশিয়ে খেলে সেই ঘাটতি পুরণ হয়।
Nacl এর ব্যবহার: Nacl অনেক কাজে ব্যবহার করা হয়। যেমন :
(i) ভাত-এর সাথে আমরা তরকারি খাই। তরকারিতে Nacl লবণ না দিলে তরকারি সুস্বাদু হয় না।
(ii) শিল্পকারখানায় NaOH যৌগ প্রস্তুত করার জন্য NaCl ব্যবহৃত হয় ।
(iii) ডায়রিয়া বা পানিশূন্যতা পূরণের জন্য ওষুধ শিল্পে স্যালাইনের মধ্যে NaCl প্রয়োজন হয়।
বেকিং পাউডার
বেকিং সোডা বা খাবার সোডার রাসায়নিক নাম সোডিয়াম হাইড্রোজেন কার্বনেট (NaHCO3)। বেকিং সোডা (NaHCO3) তৈরি করে তার মধ্যে টারটারিক এসিড (C4H6O6) মিশালে বেকিং পাউডার তৈরি হয়। সাধারণত কেক বানানোর কাজে বেকিং পাউডার ব্যবহার করা হয়।
বেকিং সোডা প্রস্তুতি
অ্যামোনিয়া গ্যাস, খাদ্য লবণ, পানি এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে বেকিং সোডা প্রস্তুত করা যায়। প্রথমে পানির মধ্যে NaCl কে দ্রবীভূত করে NaCl এর সম্পৃক্ত দ্রবণ প্রস্তুত করা হয়। এবার এই সম্পৃক্ত দ্রবণের মধ্যে NH, গ্যাস প্রবাহিত করে NH, দ্বারা সম্পৃক্ত করা হয়। কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে NH, সম্পৃক্ত NaCl দ্রবণের মধ্যে প্রবাহিত করা হয়। এক্ষেত্রে CO2, NH3, H2O একত্র হয়ে প্রথমে অ্যামোনিয়াম হাইড্রোজেন কার্বনেট (NH HCO3) উৎপন্ন হয়। এরপর অ্যামোনিয়াম হাইড্রোজেন কার্বনেট সোডিয়াম ক্লোরাইড-এর সাথে বিক্রিয়া করে সোডিয়াম হাইড্রোজেন কার্বনেট (NaHCO3) বা বেকিং সোডা উৎপন্ন করে ।
বেকিং সোডাকে বিক্রিয়া পাত্র থেকে পৃথক করে তার সাথে টারটারিক এসিড মেশানো হয়৷ এ মিশ্রণকে বেকিং পাউডার বলে।
বেকিং সোডার ব্যবহার: কেক প্রস্তুতির সময় ময়দার মধ্যে বেকিং পাউডার মিশিয়ে তাপ প্রদান করা হয়। বেকিং সোডা মিশ্রণের টারটারিক এসিডের (C4H6O6) সাথে বিক্রিয়া করে সোডিয়াম টারটারেট (C4H4 Na2O6), CO2 গ্যাস এবং H2O উৎপন্ন করে। এই CO2 গ্যাস এর জন্য কেক ফুলে উঠে।
বাড়িতে কিংবা বেকারিতে পাউরুটি ফোলানোর জন্য ইস্ট নামক ছত্রাকও ব্যবহার করা হয়। এ জন্য প্রথমে চিনির দ্রবণে ইস্ট মেশানো হয়। এই মিশ্রণ দিয়ে ময়দা মাখিয়ে দলা করে উষ্ণ জায়গায় রেখে দিলে ইস্টের সবাত শ্বসনের কারণে কার্বন ডাই অক্সাইডের উৎপন্ন হয় যা পাউরুটিকে ফুলতে সাহায্য করে। পাউরুটি ফুলে ওঠার পর ওভেনে বেকিং করা হলে উত্তাপে ইস্ট মারা যায়, তখন পাউরুটির ফোলা বন্ধ হয় ৷
সিরকা বা ভিনেগার
ইথানয়িক এসিডের 49%-10% জলীয় দ্রবণকে ভিনেগার বলা হয়। ভিনেগার তরল পদার্থ। সাধারণত আচার তৈরি করার সময় ভিনেগার যোগ করা হয়।
ভিনেগারের প্রস্তুতি
25 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে 35 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখা একটি স্টিলের পাত্রে ইথানল (CH3CH2OH) এবং অ্যাসিটোব্যাকটর নিয়ে এর মধ্যে অক্সিজেন গ্যাসের বুদবুদ প্রবাহিত করলে ভিনেগার বা অ্যাসিটিক এসিড বা ইথানয়িক এসিড (CH3COOH) প্রস্তুত হয়। অ্যাসিটোব্যাকটর এমন এক ধরনের এনজাইম নিঃসৃত করে যা ইথানলকে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করতে সাহায্য করে।
খাদ্য সংরক্ষণে ভিনেগারের ভূমিকা
আচারকে যদি ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে তবে আচার পচে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। আচার-এর মধ্যে ভিনেগার দিলে আচারকে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে না। ভিনেগারের মূল উপাদান ইত্থানয়িক এসিড। ভিনেগারকে যখন আচারের মধ্যে দেওয়া হয় তখন ইথানয়িক এসিড কর্তৃক ত্যাগকৃত প্রোটন, H+ ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে এবং খাদ্য দীর্ঘকাল ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। এভাবে ভিনেগার দিয়ে খাদ্য সংরক্ষণ করা হয়।
কোমল পানীয়
ঠাণ্ডা অবস্থায় ও উচ্চ চাপে পানিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস দ্রবীভূত করে কোমল পানীয় তৈরি করা হয়। কোমল পানীয়তে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং পানি বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড (H2CO3) উৎপন্ন করে। খাদ্য হজম বা পরিপাক হবার জন্য মানুষ কোমল পানীয় পান করে থাকে।
আরও দেখুন...