ঈশ্বরের দশ আজ্ঞা হলো ভালোবাসার বিধান। দশটি আজ্ঞাকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম তিনটি (প্রটেস্টান্টমণ্ডলীর চারটি) আজ্ঞা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের ভালোবাসা সম্পর্কিত। পরের সাতটি (প্রটেস্টান্টমণ্ডলীর ছয়টি) মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা সম্পর্কিত। এবার আমরা এই আজ্ঞাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পিতা-মাতার মধ্য দিয়ে ঈশ্বর আমাদের জীবন দিয়েছেন এবং এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তবে বাবা ও মা দুইজনে কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের লালনপালন ও রক্ষা করেছেন। আদরযত্ন, স্নেহ এবং দরকারি সবকিছু দিয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন। তাই আমাদের জীবনে পিতা-মাতার স্থান ও তাঁদেরকে উপযুক্ত সম্মান দেওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাঁদের কথা মেনে চলা, তাঁদের সেবাযত্ন ও সম্মান করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। শুধু ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করা নয় বরং পিতামাতাকে সম্মান করা আমাদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। আমাদের সন্তানসুলভ কর্তব্যগুলো হলো :
১। পিতা-মাতাকে ভালোবাসা।
২। পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা ৷
৩। পিতা-মাতার বাধ্য থাকা।
৪। তাঁদের বৃদ্ধবয়সে, অসুস্থতায়, একাকিত্ব ও দুঃসময়ে নৈতিক ও বৈষয়িক সহায়তা দান।
ঈশ্বর মানুষের জীবনদাতা। এই জীবনের মালিকও তিনি। এই জীবন নাশ করার অধিকার কোনো মানুষের নেই। পঞ্চম আজ্ঞায় ঈশ্বর বলেছেন : “তুমি নরহত্যা করবে না; আর যে নরহত্যা করে সে বিচারাধীন হবে।” এই আজ্ঞাটির মধ্য দিয়ে বিশেষভাবে মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হয়েছে। আমরা এই আজ্ঞাপালনের মধ্য দিয়ে অন্য সকল মানুষের জীবন রক্ষা করে নিজের জীবনকেই রক্ষা করি; অন্য সকলের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে নিজের জীবনকেই শ্রদ্ধা দেখাই ।
যীশু বলেছেন,“শুধু যে নরহত্যা করা পাপ, তাই নয়, বরং অন্যের সাথে রাগও করতে পারবে না। কারণ রাগ দ্বারা আমরা মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করি।”এই কারণে সাধু আগস্টিনের কথানুসারে এই আজ্ঞাটির দুইটি দিক আছে। প্রথমটি হলো নিষেধাজ্ঞা, যার মধ্য দিয়ে বলা হয়েছে নরহত্যা করবে না। দ্বিতীয় দিকটি হলো আদেশমূলক। এর মধ্য দিয়ে মানুষের সাথে ভালোবাসা, শান্তি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে আদেশ করা হয়েছে।
ব্যভিচার করার অর্থ হলো পুরুষ বা নারী হিসাবে কারো দিকে কামনার দৃষ্টি নিয়ে তাকানো। ঈশ্বর আমাদের মধ্যে ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা ও মিলনের ক্ষমতা দিয়েছেন। আমরা যেন তাঁর সুন্দর ব্যবহার করি। আমরা যেন নারীকে নারী ও পুরুষকে পুরুষের সম্মান দিয়ে তাদের গ্রহণ করি। এই আজ্ঞার দ্বারা যেকোনো ধরনের অশুচি চিন্তা ও অশালীন আচরণ, যার মাধ্যমে দেহ ও মন কলুষিত হয় তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাধু গ্রেগরীর ভাষায়, অনেক মানুষ সম্মান থাকতে সম্মানের মর্যাদা দিতে জানে না, কিন্তু ব্যভিচার দ্বারা পশুর পর্যায়ে চলে যাবার পর তা বুঝতে পারে। সেজন্যে আমাদেরকে মন্দ বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। যেমন: অলসতা, খাওয়াদাওয়ায় অমিতাচারিতা, ইন্দ্রিয়সেবা, অশালীন পোশাক-পরিচ্ছদ, অসংযত কথাবার্তা, মন্দ ছবি দেখা, বাজে বিষয় পড়া, কুচিন্তা করা ও খারাপ আচরণের মধ্য দিয়েও আমরা ব্যভিচার করতে পারি। তাই এগুলো পরিহার করে আমাদের দৃষ্টি, চিন্তা-ভাবনা, কথা ও আচরণ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে হবে। ঘন ঘন পাপ স্বীকার ও খ্রিষ্টপ্রসাদ গ্রহণ করা, প্রতিদিন নিয়মিত প্রার্থনার অভ্যাস বজায় রাখা, ভিক্ষাদান করা ইত্যাদি আমাদেরকে পবিত্র পথে থাকতে অনেক সহায়তা করে। পবিত্ৰতা ঈশ্বরের একটি দান। যারা এর অন্বেষণ করে তারা তা পায়।
প্রতিবেশীর জিনিস বা সম্পদ না-বলে নেওয়া বা নিজের বলে দাবী করা বা জোর করে নিয়ে যাওয়া হলো চুরি। শুধু তা–ই নয়, পরীক্ষায় নকল করে, অন্যের সুনাম নষ্ট করে, চুরি কাজে অন্যকে সাহায্য করে, জিনিস বিক্রির সময় ক্রেতাকে ঠকিয়ে, দাম না দিয়ে কারো দোকানের জিনিস নিয়ে গিয়ে, হারানো জিনিস পেলে ফিরিয়ে না দিয়ে, গাড়িতে চড়ে ভাড়া না দিয়ে চলে যাওয়া, অপচয় ও অন্যের সম্পদ নষ্ট করে, অন্যের ন্যায্য পাওনা মজুরি মিটিয়ে না দিয়ে, অন্যের মর্যাদা নষ্ট করেও চুরির সমান পাপ করতে পারি। তাই ব্যক্তি মালিকানা ও অন্যের সম্পদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। চুরি করা জিনিস ফেরত দিতে পারলে মানুষ মানসিক প্রশান্তি লাভ করে।
ঈশ্বর এই আজ্ঞার দ্বারা আমাদেরকে মিথ্যা কথা বলতে নিষেধ করেছেন। কারো বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে তার সুনাম নষ্ট করা, স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে সেই কুৎসাপূর্ণ কথায় কান দেওয়া, তা শুনে অন্যের কাছে গিয়ে পরচর্চা করা, কারো চাটুকারিতা করা এবং প্রতারণা করার মাধ্যমেও আমরা মিথ্যাবাদী হতে পারি। কারণ মিথ্যার দ্বারা আমরা শয়তানের শামিল হই, নিজের সত্যবাদিতার সুনাম নিজেই নষ্ট করি। শয়তানও এদেন বাগানে হবার কাছে মিথ্যা বলেছিল। মিথ্যার দ্বারা আমরা সমাজকে নষ্ট করি কারণ তাতে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়। কথায় ও কাজে সৎ আচরণই হলো সততা বা সরলতা। সত্য জীবন যাপন করার অর্থ হলো ঈশ্বরের সাথে যুক্ত থাকা। কথা ও কাজের মিল রেখে প্রতিবেশীর সাথে জীবন যাপন করা ।
ব্যভিচার করো না, এই আজ্ঞাটির ব্যাখ্যায় আমরা জেনেছি যে, বিবাহিত জীবনের মধ্য দিয়ে একজন পুরুষ ও নারী স্বামী-স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করে। তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ স্বামী বা স্ত্রীর উপর অধিকার থাকে। এই অধিকার অন্য কেউ নিতে পারে না। তাই কোনো জীবিত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রীকে কাম-লালসার দৃষ্টি নিয়ে তাকানোর মধ্য দিয়ে মানুষ পাপ করে থাকে। এ ধরনের আচরণে একটি পরিবার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাদের বিবাহের পবিত্র সম্পর্ক নষ্ট হয়। উদাহরণ স্বরূপ রাজা দাউদ উরিয়ার স্ত্রীর প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাপ করেছিলেন। এরপর তাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে আরও পাপ করেছিলেন। এই কারণে ঈশ্বর তাঁকে শাস্তি দিয়েছিলেন।
এই আজ্ঞার মাধ্যমে অন্যের জিনিসের প্রতি লোভ করতে নিষেধ করা হয়েছে। যে জিনিস আমার নেই বা আমার নয় তা পাবার জন্য আমাদের যে তীব্র বাসনা বা আকর্ষণ তাই হলো লোভ। লোভের কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পাওয়ার বাসনা প্রবল হয়ে উঠে। এই লোভের কারণে অনেক সময় আমরা নানা ধরনের অন্যায় কাজ করে থাকি। যেমন : কারো টাকা – পয়সা, খেলনা, বই-খাতা, কলম, মোবাইল ফোন বা কাপড়চোপড় এগুলো দেখে আমরা লোভ করব না। পরের দ্রব্যে লোভের কারণে লোভী মানুষ সম্পদ আহরণ করতে করতে অনেক ধনী হয়ে যায় এবং অনেক মানুষ গরিব হয়ে যায়। এভাবে পৃথিবীতে ধনীগরিবের বৈষম্য বাড়ে। লোভের কারণে মানুষ নিষ্ঠুর ও ধ্বংসাত্মক হয়ে যায়, সে তখন খুন করতেও দ্বিধা করে না। তাই বিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিজের আশা আকাঙ্ক্ষার একটা সীমা বেঁধে দেন এর বেশি তাঁরা নেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। আমরাও পরের দ্রব্যে আমাদের লোভ-লালসা কমাবার জন্য একটা সীমা বেঁধে নিতে পারি।
পূর্বেই আমরা জেনেছি দশ আজ্ঞা হলো ভালোবাসার বিধান। এই আজ্ঞাগুলো মেনে চললে আমরা সুখী ও পবিত্র জীবন যাপন করতে পারব। ঈশ্বর ও প্রতিবেশীর সাথে আমাদের সুসম্পর্ক বজায় থাকবে। মানুষ সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারবে। আমরা স্বর্গের আনন্দ লাভ করতে পারব। এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে ঐশরাজ্য। কিন্তু আজ্ঞাগুলো মেনে না চললে আমাদের জীবন হবে পাপময়। আমাদের জীবন হবে অসুখী ও অশান্তিপূর্ণ । তখন আমাদের জন্য পৃথিবীটা নরকে পরিণত হবে। আজ্ঞাগুলো মেনে চলা আমাদের তাই একান্ত কর্তব্য।
পিতামাতাকে সম্মান করা, নরহত্যা না করা, ব্যভিচার না করা, চুরি না করা, মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়া, পরস্ত্রী বা পরপুরুষে লোভ না করা ও পরের দ্রব্যে লোভ না করার গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছি।
দশ আজ্ঞা পালনের পাঁচটি সুফল ও পালন না করার পাঁচটি কুফল লেখ ও ছোট দলে সহযোগিতা কর।
ক) দশ আজ্ঞার প্রথম তিনটি আজ্ঞা হলো প্রতি মানুষের ভালোবাসা সম্পর্কে।
খ) পিতামাতার মধ্য দিয়ে ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন।
গ) পিতামাতাকে সম্মান করা আমাদের ও মানবিক দায়িত্ব।
ঘ) নরহত্যা করবে না এই আজ্ঞাটির মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের প্রতি দেখানো হয়েছে।
ঙ) পরীক্ষায় নকল করা সমান পাপ ।
ক) আমাদের জীবনে পিতামাতার স্থান | ক) আমাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। |
খ) আমরা সকলের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে | খ) নিষ্ঠুর ও ধ্বংসাত্মক হয় ৷ |
গ) ঈশ্বর আমাদের মধ্যে | গ) ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা ও মিলনের ক্ষমতা দিয়েছেন। |
ঘ) ব্যক্তি মালিকানা ও অন্যের সম্পদের প্রতি | ঘ) শক্তি দিয়ে থাকেন। |
ঙ) লোভের কারণে মানুষ | ঙ) অতি গুরুত্বপূর্ণ। |
চ) নিজের জীবনকেই শ্রদ্ধা দেখাই । |
ক। নরহত্যা সম্পর্কে ঈশ্বর কী বলেছেন?
খ। চুরি বলতে কী বোঝ ?
গ। আমরা কীভাবে মিথ্যাবাদী হই?
ঘ। সততা বলতে কী বোঝ ?
ঙ। দশ আজ্ঞা না মেনে চললে আমাদের জীবন কেমন হয়?
ক) পিতামাতাকে সম্মান করবে –এই আজ্ঞাটি ব্যাখ্যা করো ও সন্তানসুলভ দায়িত্বগুলো লেখ।
খ) মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না --আজ্ঞাটি ব্যাখ্যা কর।
গ) পরের দ্রব্যে লোভ করবে না – আজ্ঞাটি ব্যাখ্যা কর।
ঘ) দশ আজ্ঞা পালন করার সুফলগুলো লেখ ।
আরও দেখুন...