আমরা সকলেই হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, মুখেভাত, হাতেখড়ি ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেছি। দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতীপূজা ইত্যাদিতেও অংশ নিয়েছি। এমনকি বাড়িতে বা পাড়ার এসব পূজার আয়োজনে সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে।
ছক ২.১: আমার দেখা ধর্মানুষ্ঠান
হিন্দুধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো নানা নিয়ম-কানুন মেনে অনুষ্ঠিত হয়। অভিভাবক/ধর্মীয় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনা করে যে কোনো একটি অনুষ্ঠান/পূজা/পার্বণের প্রয়োজনীয় উপকরণ, নিয়ম-কানুনের তালিকা করো।
ছক ২.২: অনুষ্ঠান-বিধি
অনুষ্ঠান/পূজা/ পার্বণের নাম ও উদ্দেশ্য:
| |
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
| |
নিয়ম কানুন:
|
এই যে বিভিন্ন ধরনের পূজা-পার্বণ, অনুষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের নিয়ম এবং সে মোতাবেক বিভিন্ন পূজায় বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ব্যবহৃত হয়, এগুলোকে বলা হয় পূজার উপচার।
পূজা বলতে বোঝায় প্রশংসা বা শ্রদ্ধা নিবেদন করা। দেশ ও অঞ্চলভেদে পূজাপদ্ধতির ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। তবে পূজার মৌলিক নিয়ম ও উপচারগুলোর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দেব-দেবী অনুসারে পূজার পদ্ধতি ও মন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। পূজা করার সময় যেসব নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়, সেগুলো পূজাবিধি নামে পরিচিত।
বৈদিক যুগে পূজা ছিল যজ্ঞভিত্তিক। এরপরে পৌরাণিক যুগে ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির সাকার রূপ হিসেবে দেবদেবীর পূজা করা হতো। ঋষিরা ধ্যানে দেবতার রূপ প্রত্যক্ষ করে বর্ণনা করেছেন। বহু দেবদেবীর পূজার প্রচলন থাকলেও হিন্দুধর্ম কিন্তু বহু ঈশ্বরবাদী নয়। দেবতারা ঈশ্বর নন। তাঁরা হলেন ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতার সাকার রূপের প্রকাশ মাত্র। ঈশ্বর ও দেবতার রূপকে চিন্তা করে ঘট, প্রতিমা, যজ্ঞের বেদী, আগুন, জল, যন্ত্র (বিশেষ প্রতীকী চিহ্ন), প্রতিমার ছবি, মণ্ডল এবং হৃদয়ে পূজা করার প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে প্রতিমা, ছবি, ঘট প্রভৃতি আধারে পূজা করার রীতিই বেশি প্রচলিত।
ফুল, দূর্বা, বেলপাতা, তুলসীপাতা, চন্দন, আতপ চাল, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য ইত্যাদি পূজার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত পঞ্চ বা দশ উপচারে দেবতার পূজা করা হয়। তবে বিশেষ পূজায় দেবতাকে ষোড়শ উপচারে পূজা করা হয়।
পঞ্চোপচার- গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য এই পাঁচটি হচ্ছে পঞ্চোপচার তথা পূজার প্রধান উপচার বা উপকরণ।
দশোপচার- পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, স্নানীয়, পুনরাচমনীয়, গন্ধ, পুষ্প (ফুল), ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য এই দশটি হচ্ছে দশোপচার।
ষোড়শোপচার- রজতাসন (রূপার আসন), স্বাগত (আবাহন), পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, স্নানীয়, বস্ত্র, আভরণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, পুনরাচমনীয় ও তাম্বুল (পান) এই ষোলোটি উপচার হচ্ছে ষোড়শোপচার। ষোড়শ উপচারে পূজার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে মধুপর্ক। এই মধুপর্ক দুধ, দই, ঘি, মধু, চিনি এবং সামান্য জলের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়।
এক এক দেবতা এক এক প্রকার ফুল ও পাতা বেশি ভালোবাসেন; আবার কোনো কোনো ফুল ও পাতা পছন্দ করেন না। যেমন-শিবপূজায় ধুতরা ও আকন্দ ফুল, নারায়ণ পূজায় সাদা ফুল, দুর্গাপূজায় লাল রঙের ফুল মঙ্গলজনক। বিষ্ণু বা নারায়ণকে অবশ্যই তুলসী পাতা দিয়ে পূজা করতে হয়, শিব বেলপাতা পছন্দ করেন। গণেশ, শিব ও দুর্গার পূজায় তুলসী পাতা নিষিদ্ধ। আবার নারায়ণপূজা ও সূর্যপূজায় বেলপাতা নিষিদ্ধ।
পূজার কিছু উপকরণের তাৎপর্য তুলে ধরা হলো
১। বিগ্রহ বা প্রতিমা: প্রতিমার রূপের মাঝে নিবিড়ভাবে মগ্ন হলে ভক্ত পরমাত্মার সাক্ষাৎ লাভ করে।
২। কলস বা ঘট: পূজায় মাটি বা ধাতুর তৈরি কলস বা ঘট ব্যবহার করা হয়। কলস বা ঘট মঙ্গলের প্রতীক। এই ঘট পৃথিবী বা মানবদেহ নির্দেশ করে। ঘটের জল প্রাণ তথা কুলকুন্ডলিনী বা পবিত্র গঙ্গার প্রতীক। কলসের মুখে আম্রপল্লব বিকাশমান প্রগতিকে নির্দেশ করে। ঘটের নারিকেল জ্ঞান তথা মস্তকের প্রতিনিধিত্ব - করে। কলসের চওড়া অংশ পৃথিবীকে বোঝায়। কলসের ঘাড় অগ্নিকে এবং মুখের খোলা অংশ প্রাণরূপ বায়ুকে নির্দেশ করে। ঘটের উপর দূর্বা, চাল ও নৈবেদ্য জীবজগতের আহারের প্রতীক। ঘটের বহমান জল সংগীত তথা জীবজগতের সঙ্গে সৃষ্টিশীল সুরের সম্পর্ক প্রকাশ করে।
৩। প্রদীপ: প্রদীপের আলো জ্ঞানের প্রতীক।
৪। শঙ্খ: শঙ্খ মঙ্গলসূচক পবিত্র ধ্বনির সৃষ্টি করে। জ্ঞান ও ভক্তির জগতে আহ্বান জানায়।
৫। ফুলের মালা: ফুলের মালা সম্মান ও সজ্জিত করার মাঙ্গলিক উপকরণ।
৬। আসন: আসন দেবতাদের বসার জন্য ব্যবহার করা হয়।
৭। মুকুট: মুকুট উচ্চ সম্মানের প্রতীক।
৮। পান-সুপারি: পান শুদ্ধতার প্রতীক। সুপারির কঠিন অংশ আমাদের অহংবোধের প্রতীক, যা পূজার শেষে ইষ্ট দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা হয়।
৯। কপূর: সুগন্ধি কপূর বিশুদ্ধতা ও স্নিগ্ধতার প্রতীক।
১০। গঙ্গাজল: গঙ্গার জল পবিত্রতার প্রতীক। এই জল বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময় করে বলে বিশ্বাস করা হয় । এই জলকে আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা ও বৈষয়িক সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়ক বলে গণ্য করা হয়।
১১। থালা: থালা সমস্ত উপকরণের সমাহারের প্রতীক।
১২। ধূপ: ধূপ সুগন্ধ তথা ভালো কাজের প্রতীক, যা খারাপ শক্তির প্রভাব থেকে জগৎকে মুক্ত রাখে।
১৩। চন্দন: চন্দন কাঠের গন্ধ পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করে।
১৪। আবির: আবির রোগ নিরাময়ক ও সৌহার্দ্যের প্রতীক। তাই দোলযাত্রা বা হোলি উৎসবে এবং বিভিন্ন পূজায় এই উপকরণের ব্যবহার হয়।
১৫। চাল: চাল বস্তুগত আহারের প্রতীক, যা প্রাণরূপ শরীরকে জীবন ধারণের জন্য টিকিয়ে রাখে।
১৬। নৈবেদ্য: ফুল, ফল, মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি নৈবেদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়, যা আত্মসমর্পণের নির্দেশক।
১৭। পঞ্চারতি: পঞ্চভূতকে পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার অনন্য মাধ্যম পঞ্চারতি।
১৮। ঘণ্টা: ঘণ্টা মঙ্গলজনক শব্দসৃষ্টির প্রতীক।
১৯। হলুদ: হলুদ পরিশুদ্ধ চিন্তার নির্দেশক ও মনের আকর্ষক। হলুদে ভেষজ গুণ রয়েছে। হলুদ দেবী দুর্গাকেও (বাসন্তী দেবী) নির্দেশ করে।
২০। পবিত্র সুতা: পবিত্র সুতা বন্ধনের প্রতীক। তাই ঘটবন্ধনের সময় কাণ্ডারের চারপাশে সুতা ব্যবহার হয়
ছক ২.৪: পূজার উপকরণ
উপকরণ | বৈশিষ্ট্য | ইতিবাচক প্রভাব |
প্রদীপ | জ্ঞানের আলো | অজ্ঞানতা দূর করে দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করা। |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
দেবদেবীর পূজায় কাঁসা, ঘণ্টা, ঢাক, ঢোল, সানাই প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। ঘণ্টাকে বলা হয় 'সর্ববাদ্যময়ী'। অন্য বাদ্যের অভাবে শুধু ঘণ্টা বাজিয়েও পূজা করা যায়। তবে এক এক দেবতার পূজায় এক এক বাদ্য নিষিদ্ধ। যেমন-লক্ষ্মীপূজায় ঘণ্টা, শিবপূজায় করতাল, দুর্গাপূজায় বাঁশি, ব্রহ্মাপূজায় ঢাক এবং সূর্যপূজায় শঙ্খ বাজানো নিষেধ।
বাম হাতে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে মূলমন্ত্র অথবা স্তোত্রপাঠ করতে হয়। একইসঙ্গে দেবতার শ্রীচরণে চার বার, নিজের নাভিদেশে দুই বার, মুখমণ্ডলে তিন বার ও সর্বাঙ্গে সাত বার ঘুরিয়ে পঞ্চারতি যথাক্রমে- দীপ, কপ্রদীপ, ধূপ, জলপূর্ণ শঙ্খ, বস্ত্র, ফুল ও চামর দিয়ে আরতি করে প্রণাম করতে হয়। এছাড়া ময়ূর-পালকের পাখা ব্যবহারের প্রচলন আছে।
ইতঃপূর্বে আমরা বেশ কয়েকটি দেবদেবীর পূজাপদ্ধতি জেনেছি। এবার আমরা কালীপূজা এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী সম্পর্কে জানব।
'কালী' শব্দটি 'কাল' শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। 'কাল' শব্দের অর্থ 'কৃষ্ণ' বা 'ঘোর বর্ণ'। প্রকৃত অর্থে কাল বা সময়কে রচনা করেন যিনি তিনিই কালী। দেবী কালী মা দুর্গারই একটি রূপ। শাক্ত মতে তিনিই পরম ব্রহ্ম। কালী শবরূপী শিবের উপর দন্ডায়মান। শিব হচ্ছেন স্থির বা নীরব। আর কালী হচ্ছেন 'গতির প্রতীক'। এই গতিই জগতের প্রাণ। হিন্দুধর্মে সুদূর অতীতকাল থেকে মাতৃপূজার প্রচলন রয়েছে, যার মধ্যে কালীপূজা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আবার, কালীমাতার গায়ের বর্ণ কালো- এই দৃষ্টিতে তাঁকে কালী বলা হয়। অসুর বিনাশের জন্য তিনি রুদ্রময়ী কৃষ্ণমূর্তি ধারণ করেছিলেন। তখন তাঁর নাম হয় কালীদেবী। এ বিষয়ে একটি কাহিনি রয়েছে:
পুরাকালে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অত্যাচারী অসুর ছিল। এরা ছিল দুই ভাই, যাদের অত্যাচারে দেবতারা পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। একসময় এদের সাথে দেবতাদের যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে দেবতারা পরাজিত হয়ে স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। দেবতারা তখন দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে দেবী মহামায়ার শরণাপন্ন হন। বিবরণ শুনে ক্রুদ্ধ দেবীর শরীর-কোষ হতে কৌশিকী নামে এক দেবীর জন্ম হয়। দেবী মহামায়াও কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেন। মহামায়ার সেই কৃষ্ণমূর্তিই কালী। অসুরদের সেনাপতি চন্ড ও মুন্ড দেবীকে আক্রমণ করে। দেবী পূর্বের ভয়ঙ্কর কৃষ্ণমূর্তি অর্থাৎ কালীরূপ ধারণ করেন। তাঁর হাতে চণ্ড-মুণ্ড নিহত হয়। দেবীর নাম হয় চামুণ্ডা। সবশেষে আসে শুম্ভ ও নিশুম্ভ। দেবীর হাতে শুম্ভ-নিশুম্ভসহ একে একে সকল অসুর নিহত হয়। অসুরবিনাশী কৃষ্ণবর্ণের সেই দেবীই কালীমাতা হিসেবে পূজিত।
কালীমাতার মূর্তির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। দেবীর চার হাত। উপরের ডান হাতে অভয়মুদ্রা ধারণ করা, বাম হাতে খা। নিচের ডান হাতে বরমূদ্রা, বাম হাতে ছিন্ন মস্তক। দেবীর কন্ঠে মুন্ডমালা। মুন্ড বা মস্তকে চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক- এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে, যা সকল জ্ঞানকে প্রকাশ করে। দেবীর কোমরে কাটা হাতের মেখলা, যা কর্মের ধারক। তিনি সাদা দাঁত দিয়ে লাল বর্ণের জিহ্বাকে কর্তন করে আছেন। এটি সত্ত্বগুণ দিয়ে রজোগুণকে খণ্ডন করা বোঝায়, অর্থাৎ ত্যাগের দ্বারা ভোগকে জয় করা বোঝায়। দেবীর শ্মশান-বাস কর্মফল ভোগান্তে জীবের শেষ আশ্রয়স্থলকে নির্দেশ করে। তাঁর তিনটি চোখ- মানস, জ্ঞান ও দিব্য। শ্মশানবাসী, সর্বত্যাগী দেবীর পায়ের কাছে মহাকাল শিব শুয়ে আছেন। অসুর বিনাশের শেষে তাণ্ডবনৃত্যরত দেবীকে শান্ত করার জন্য স্বামী মহাকাল বা শিবের এই অবস্থানকে দেখানো হয়েছে। তাছাড়া জগৎপ্রসবিনী হিসেবে সমস্ত লজ্জার উর্ধ্বে উঠে দেবী বসন ত্যাগ করে দিগম্বরা হয়েছেন।
কালীপূজা দুভাবে হয়- গৃহে এবং সর্বজনীন মন্দিরে। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে কালীপূজা হয় যা সর্বাধিক প্রচলিত পূজা। এছাড়া মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালীপূজাও যথেষ্ট জনপ্রিয়। এছাড়া কালীমাতার মন্দিরে নিত্যপূজাও অনুষ্ঠিত হয়।
বাড়িতে বা মণ্ডপে প্রতিমা তৈরি করে কালীপূজা করা হয়। গভীর রাতে কালী পূজা করা হয়। দেবীর চক্ষু দান ও প্রাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই কালীপূজা শুরু হয়। ধ্যান, পূজা, আরতি, ভোগ ইত্যাদির পর প্রণাম ও পুষ্পাঞ্জলির মাধ্যমে পূজার সমাপ্তি হয়।
শবারূঢ়াং মহাভীমাং ঘোর-দংষ্ট্রাবরপ্রদাম্
হাস্যযুক্তাং ত্রিনেত্রাঞ্চ কপালকর্তৃকাকরাম্।
মুক্তকেশীং লোলজিহ্বাং পিবন্তীং রুধিরং মুহঃ
চতুর্বাহযুতাং দেবীং বরাভয়করাং স্মরেৎ ।।
সরলার্থ: দেবী কালী শবারূঢা, ভীমা ভয়ংকরী, তিনি ত্রিনয়নী, ভয়ানক তাঁর দাঁত, লোল তাঁর জিহ্বা। তিনি মুক্তকেশী, হাতে নরমুণ্ড ও কর্তৃকা (কাটারি)। অপর দুহাতে বর ও অভয় মুদ্রা। দেবী হাস্যময়ী।
প্রণামমন্ত্র:
কালি কালি মহাকালি কালিকে পাপনাশিনি।
ধর্মার্থমোক্ষদে দেবি মহাকালি নমোহস্তুতে।।
সরলার্থ: হে কালী, মহাকালী, কালিকা পাপনাশিনী, ধর্ম, অর্থ ও মোক্ষদায়িনী দেবী তোমাকে নমস্কার করি।
দেবী কালী বিশ্বের সকল অশুভ শক্তি ধ্বংস করে সকলের মধ্যে মঙ্গলবার্তা ছড়িয়ে দেন। তিনি অন্যায় প্রতিরোধকারিণী ও কল্যাণময়ী। তিনি তাঁর ভক্তদেরকে মাতৃরূপে পালন করেন। তিনি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত। তিনি আমাদের সদা মঙ্গল করেন। আমরা তাঁর কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদী, আবার সাধারণের প্রতি কোমল হওয়ার শিক্ষা পাই। পাশাপাশি অশুভ শক্তি সন্তানের কোনো ক্ষতি করতে চাইলে মা রুদ্রা চামুণ্ডামূর্তি ধারণ করে সরাসরি তা বিনাশ করেন। তাই কালীমাতার পূজার দ্বারা মায়ের স্নেহের পাশাপাশি অশুভ শক্তির কাছ থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি।
পূজা উপলক্ষে মেলা বসে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে উৎসবে যোগ দেন। নির্মল আনন্দে মেতে উঠেন। যা একটি সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি করে। এটি কালীপূজার একটি বিশেষ তাৎপর্য। এ পূজার মাধ্যমে আমাদের আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ছক ২.৫: কালীপূজার তাৎপর্য
জন্মাষ্টমী হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের রোহিণী নক্ষত্রযুক্ত অষ্টমী তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব উদ্যাপন করা হয়। এই দিন জন্মাষ্টমী ব্রতের সঙ্গে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা যথাযোগ্য মযার্দায় জন্মাষ্টমী উদ্যাপন করেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। দেবকীর দাদা কংস তাঁর পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করে মথুরার সিংহাসন গ্রহণ করেন। বসুদেব ও দেবকীর বিয়ের পরপরই দৈববাণীর মাধ্যমে কংস জানতে পারল যে, দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে তার মৃত্যু হবে। এই কথা শুনে কংস দেবকী ও বসুদেবকে কারাগারে বন্দি করে। একে একে তাঁদের ছয় সন্তানকে হত্যা করে কংস। শ্রীহরির নির্দেশে বসুদেব- দেবকীর সপ্তম গর্ভের ভ্রূণ রোহিণী নিজ গর্ভে স্থাপন করেন এবং সন্তান বলরামের জন্ম দেন। তাঁদের অষ্টম সন্তান হিসেবে জন্ম নেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণের জন্মরাত্রেই দৈব নির্দেশে কংসের কারাগার থেকে বসুদেব তাঁকে গোকুলে নিয়ে যান। তাঁর নতুন মাতাপিতা হলেন যশোদা ও নন্দ।
শৈশবেই শ্রীকৃষ্ণকে মেরে ফেলার জন্য কংস পুতনা, শকটাসুর, কালীয় নাগ, তৃণাবর্ত, বৎসাসুর, বকাসুর, ধেনুকাসুর, অঘাসুর ইত্যাদি রাক্ষসদের পাঠায়। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাদের প্রত্যেককে বধ করেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ব্রতের আগের দিন সংযম পালন করে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করতে হয়। জন্মাষ্টমী ব্রত পূজার দিন ভোরবেলায় স্নান করে উপবাস থাকতে হয়। তিথি অনুসারে রাতে শালগ্রাম শিলা সামনে রেখে নানাবিধ উপচারে বাল্য গোপালরূপী কৃষ্ণের বিগ্রহপূজা করতে হয়। গোপালরূপী বিগ্রহকে একটি ফল বা কুমড়ায় রেখে পূজার আগে কৃষ্ণের ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রতীকী আয়োজন করা হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর রেশম ও নতুন ছুরি বা ব্লেড দিয়ে নাড়ি কাটার আয়োজন করতে হয়। এরপর ষষ্ঠী দেবীর পূজা করা হয়। তারপর শ্রীকৃষ্ণের নামকরণ, চূড়াকরণ, উপনয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় সম্পাদন করা হয়।
মাঞ্চাপি বালকং সুপ্তং পর্য্যঙ্কে স্তনপাষিণম্।
শ্রীবৎসবক্ষঃপূর্ণাঙ্গং নীলোৎপলদলচ্ছবিম্।
সরলার্থ: বালকরূপী শ্রীভগবান পালঙ্কে শুয়ে স্তন পান করছেন, তাঁর বুক অপূর্ব সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ ও শরীর যেন নীলপদ্মের পাঁপড়ির মতো।
পূজামন্ত্র
"ওঁ ক্রীং শ্রীকৃষ্ণায় নমঃ।"
ধ্যান ও মন্ত্র উচ্চারণের পর বেদমন্ত্রে আগুন স্থাপন করে ঘি দিয়ে হোম করতে হয়। হোমের মন্ত্র, "ওঁ ধর্মায় ধর্মেশ্বরায় ধর্মপতয়ে ধর্মসম্ভায় গোবিন্দায় নমো নমঃ স্বাহা'। অতঃপর গুড়মেশানো ঘি দিয়ে চন্দ্রার্ঘ্য দিতে হয়। এ সময়ে শঙ্খে জল, কুশ, চন্দন, দূর্বা, আতপ চাল নিয়ে বীরাসনে বসে চন্দ্রকে অর্ঘ্য দিতে হয়। আর মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়, "ক্ষীরোদার্ণবসম্ভূত অত্রিনেত্রসমুদ্ভব। গৃহাণার্ঘ্যং শশাঙ্কেদং রোহিণ্য। ব্রহ্মাত্মে সহিতো মম।"
চন্দ্রের প্রণামমন্ত্র "ওঁ জ্যোৎস্নায়া পতয়ে তুভ্যং জ্যোতিষাং পতয়ে নমঃ। নমস্তে রোহিণীকান্ত সুধাবাস নমোহস্তুতে। নভোমণ্ডল দীপায় শিরোরস্নায় ধূর্জটেঃ। কলাভিবর্দ্ধমানায় নমশ্চন্দ্রায় চারবে।"
কৃষ্ণায় বাসুদেবায় হরয়ে পরমাত্মনে।
প্রণত ক্লেশনাশায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।।
বসুদেবং সুতং দেবং কংসঃ চাণুরমর্দনঃ।
দেবকী পরমানন্দং কৃষ্ণং বন্দে জগৎগুরোঃ।।
হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধো দীনবন্ধো জগৎপতে।
গোপেশ গোপীকাকান্ত রাধাকান্ত নমোহস্তুতে।।
পাপোহং পাপকর্মাহং পাপাত্মা পাপসম্ভবঃ।
ত্রাহি মাং পুন্ডরীকাক্ষ সর্বপাপ হরো হরিঃ।।
দক্ষিণা, অচ্ছিদ্রাবধারণ করে পূজা শেষ করতে হবে।
ব্রত সমর্পণ মন্ত্র- "ভূতায় ভূতেশ্বরায় ভূতপতয়ে ভূতসম্ববায় গোবিন্দায় নমো নমঃ" ॥
পূজা শেষে প্রসাদ ভোজনের আগে পারণ মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়- "সর্বায় সর্বেশ্বরায় সর্বপতয়ে সর্বসম্ভবায়ে গোবিন্দায় নমো নমঃ।"
শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময়ে চারিদিকে অরাজকতা, নিপীড়ন, অত্যাচার চরম পর্যায়ে ছিল। সেই সময়ে মানুষের স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। সবখানে ছিল অশুভ শক্তির বিস্তার। এই অশুভ শক্তি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। জন্মাষ্টমীতে আমরা পূজা ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে সমবেত হয়ে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও একাত্মতার বোধ প্রকাশ করি। তাই আবহমানকালের চিরন্তন ধারায় কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী সকলের কাছে একটি চিরন্তন উৎসব।
ছক ২.৬: আমার এলাকায় জন্মাষ্টমী উৎসব
সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে সঞ্চার বা গমন করাকেও তাই সংক্রান্তি বলা হয়। প্রতিটি বাংলা মাসের শেষ দিন অর্থাৎ যেদিন মাসটি পূর্ণ হয় সে দিনকে সংক্রান্তি বলে। এভাবে ১২ মাসে ১২টি সংক্রান্তি আসে। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পৌষসংক্রান্তি ও চৈত্রসংক্রান্তি। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস, পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ প্রভৃতি অত্যন্ত মঙ্গলজনক।
চৈত্রসংক্রান্তির প্রধান উৎসব শিবপূজা বা নীলপূজা। এই পূজার একটি অঙ্গ চড়কপূজা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই চৈত্রসংক্রান্তিতে মেলা হয়। এজন্যই সংক্রান্তিময় বারোটি মাসের পূজা ও অনুষ্ঠানের আনন্দকে ১২ মাসে ১৩ পার্বণ বলে বর্ণনা করা হয়।
রাজা শশাঙ্কের আমল থেকে বাংলা নববর্ষের সূচনা হলেও মোগল সম্রাট আকবরের সময় থেকে এর আনন্দ আয়োজন আরো বিস্তার লাভ করে বলে মত রয়েছে। তবে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব কখন, কীভাবে প্রথম শুরু হয়েছিল, তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রামীণ বাংলাদেশে বৈশাখ মাসের শুরুতে হালখাতা, পুণ্যাহ, আমানি, লাঠিখেলা, কবিগান, ষাঁড়ের লড়াই, বৈশাখী মেলা ইত্যাদি নামে নানা রকম পারিবারিক, সামাজিক উৎসব চালু ছিল।
বর্ষবরণের সময়ে হিন্দুরীতি অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট লোকাচার থাকলেও পহেলা বৈশাখের উৎসবটি ঐতিহ্যগতভাবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকলেই উদ্যাপন করে আসছে। বর্তমানে এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন জাতীয় উৎসব। অতীতের সমস্ত ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুনকে বরণ করে নিয়ে সকলের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় নববর্ষ। এসময় ব্যবসায়ীরা নববর্ষের শুরুতে তাদের পুরোনো হিসাব-নিকাশ শেষ করে নতুন হিসাবের খাতা খোলেন। এ উপলক্ষে নতুন-পুরোনো ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ব্যবসায়ীরা মিষ্টিমুখ করান ব্যবসায়ীরা। উৎসবের মধ্য দিয়ে পুরোনো পাওনা আদায় করেন। এছাড়াও লোকে নতুন পোশাক পরে। ঘরে ঘরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। নববর্ষে উপহারের মাধ্যমে কুশল বিনিময় ও কোলাকুলি করা হয়।
নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় বসে বৈশাখী মেলা। বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকাবাইচ, হাডুডু খেলা, যাত্রা, পালাগান, কবিগান, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গানের উৎসব হয়।
বর্ষবরণ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বৈসাবি, বিজু ইত্যাদি উৎসব আনন্দমুখর পরিবেশে উদ্যাপিত হয়। ফুলবিজুতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা জলে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে জলদেবতাকে সন্তুষ্ট করে। নববর্ষ উপলক্ষে মারমা ও রাখাইনরা ঐতিহ্যবাহী জলক্রীড়ার আয়োজন করে।
'এসো হে বৈশাখ' গানের মধ্য দিয়ে এই দিনে অনেকেই বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। একটি বছরের জন্য অশুভকে বিদায় জানায়।
বর্ষবরণের একাল-সেকাল | সেকালের বর্ষবরণ, একালের বর্ষবরণ |
|
|
দীপাবলি কথাটির অর্থ আলোর উৎসব। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে সারি সারি প্রদীপ জ্বালিয়ে দীপাবলি উৎসব হয়। এই উৎসব দেওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, দীপালি, সুখরাত্রি ইত্যাদি নামেও পরিচিত। দীপাবলির দিন লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মী পূজা করা হয়। অলক্ষ্মীকে বিদায় জানিয়ে লক্ষ্মীকে মহাসমারোহে ঘরে স্থাপন করা হয়। দীপাবলি উপলক্ষে বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয়। রঙিন আলপনা এবং বিভিন্ন সামগ্রীতে ঘর সাজানো হয়। হিন্দুধর্মাবলম্বী নতুন জামা-কাপড় পরে। হিন্দুধর্মাবলম্বী ছাড়াও জৈন ও শিখ ধর্মাবলম্বীরা এই উৎসব উদযাপন করেন।
শ্রীরামচন্দ্র ১৪ বছরের বনবাস শেষে দেশে ফেরার সময়ে তাঁর ভক্তরা প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসব পালন করেছিলেন। আবার রাম-রাবণের যুদ্ধে রামের জয়ের সংবাদেও অযোধ্যায় দীপাবলি উৎসব উদ্যাপন করা হয়েছিল।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এদিন নরকাসুরকে বধ করে ১৬ হাজার বন্দিনীকে মুক্ত করেন। সেদিন দ্বারকা জুড়ে আলোকমালায় দীপান্বিতা উৎসব উদ্যাপন করা হয়। শ্রীমদ্ভাগবত- এর বর্ণনা অনুসারে বৃন্দাবনে ব্রজগোপিনীরা দীপান্বিতা অমাবস্যায় গিরিরাজ গোবর্ধনের পূজা করে বৃন্দাবনকে অসংখ্য দীপমালায় সজ্জিত করেছিলেন।
দীপাবলির অনুষ্ঠান অঞ্চলভেদে পাঁচদিনব্যাপী হয়। প্রথমদিন ধনতেরাস। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন এই উৎসবের শুরু। ধনতেরাসের দিন ব্যবসায়ীদের অর্থবর্ষের শুরু। এইদিন নতুন বাসন, সোনার গয়না ইত্যাদি কেনার রীতি দেখা যায়। দ্বিতীয় দিন নরকচতুর্দশী বা ভূতচতুর্দশীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ১৪ রকমের শাক খাওয়া হয়। সাধারণত বাড়ির নারীদের সঙ্গে শিশুরাও নানারকমের শাক সংগ্রহ করতে যায়। এতে তাদের প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয় হয়। এই দিন পিতৃ ও মাতৃকুলের চৌদ্দপুরুষকে স্মরণ করে চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালানো হয়। তৃতীয় দিন প্রদীপ, মোমবাতি, আতশবাজিতে মুখরিত হয় দীপাবলি। চতুর্থ দিন শুদ্ধ পদ্যমী বা বালি প্রতিপদা অনুষ্ঠান হয়। এই দিন নববিবাহিত বধূ স্বামীর কপালে মৃত্যুঞ্জয়ী লাল তিলক পরিয়ে আরতির মাধ্যমে তার দীর্ঘায়ু কামনা করে থাকে। বৈষ্ণবরা এইদিন গোবর্ধন পূজা বা অন্নকূট করে ১০৮টি পদ রান্না করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেন। পঞ্চম দিন উদ্যাপিত হয় ভাইফোঁটা বা যমদ্বিতীয়া।
ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে কালীপূজার দুই দিন পরে হয়। পুরাণ অনুযায়ী মৃত্যুর দেবতা যম এই তিথিতে বোন যমুনার নিমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে যান। সেই দিন যমুনাদেবী ভাইয়ের কল্যাণ কামনায় পূজা করেন। এই পূজার ফলে যমদেব অমরত্ব লাভ করেন। যম সেদিন যমুনাকে বলেন, এই তিথিতে যে ভাই নিজের বোনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর পূজা স্বীকার করবে ও তাঁর হাতে খাবার গ্রহণ করবে, তাঁর ভাগ্যে অকালমৃত্যুর ভয় থাকবে না। সেই থেকে এই তিথিটি যমদ্বিতীয়া, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা নামে পরিচিত।
আরেকটি পৌরাণিক কাহিনিতে আছে, নরকাসুরকে বধ করার পর শ্রীকৃষ্ণ বোন সুভদ্রার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সুভদ্রা ভাইকে মিষ্টি এবং ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা করেছিলেন। ভাইয়ের কপালে তিলক লাগিয়েছিলেন। কেউ এই ঘটনাকেও ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উৎসবের সূচনা বলে মনে করো।
হিন্দুধর্মাবলম্বী অনেকেই এই উৎসব উদ্যাপন করেন। উৎসব উপলক্ষে বোন ভাইকে নতুন জামা কাপড় বা অন্যান্য উপহার সামগ্রী দেয় এবং ভাইও বোনকে প্রত্যুপহার দেয়। বাড়িতে বাড়িতে এই দিনে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়।
ভাইফোঁটার দিন বোনেরা ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা দিতে দিতে বলে-
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।
রাখিবন্ধন উৎসবে বোন ভাইয়ের হাতের কবজিতে রাখি বেঁধে দেয়। এর বদলে ভাই বোনকে উপহার দেয় এবং সারা জীবন তাকে রক্ষা করার শপথ নেয়। এরপর ভাই-বোন পরস্পরকে মিষ্টি খাওয়ায়।
যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের কবজিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে দ্রৌপদী নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে শ্রীকৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে নিজের বোন বলে সম্বোধন করতেন এবং দ্রৌপদীকে এর প্রতিদান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। অনেকদিন পর কৌরবরা যখন দ্রৌপদীকে অপমান করে তাঁর বস্ত্রহরণ করতে চাইল, তখন শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে সেই প্রতিদান দেন। এভাবেই রাখিবন্ধনের প্রচলন শুরু হয়। আবার পৌরাণিক কাহিনি মতে, বিষ্ণু বৈকুন্ঠ ছেড়ে দৈত্যরাজ বলির রাজ্য রক্ষা করতে এসেছিলেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিকে বলেন, আমার স্বামী নিরুদ্দেশ। যতদিন না তিনি ফিরে আসেন, ততদিন আমাকে আশ্রয় দিন। বলিরাজ তাঁর অনুরোধ রাখেন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখি বেঁধে দেন এবং আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজ মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুন্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজ বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখিবন্ধন উৎসব হিসেবে উদ্যাপন করে।
বঙ্গভঙ্গ প্রতিবাদ খ্রীষ্টাব্দে, ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখিবন্ধন উৎসব উদ্যাপন করেছিলেন। তিনি বাংলার সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলা এবং বাংলাকে ভাগ করার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এই উৎসব করেন। সেই দিন তিনি পথে পথে হেঁটে সকলের হাতে রাখি পরিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই দিনটির উদ্দেশ্যে একটি গান লিখেছিলেন-
"বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ-
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান।
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা-
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন-
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।
রবীন্দ্রনাথ হয়তো উত্তর ভারত থেকে রাখিবন্ধনের প্রেরণা পেয়েছিলেন। শ্রাবণী পূর্ণিমায় সেখানে হিন্দু ও জৈনসমাজে সৌহার্দ্য বা ভ্রাতৃত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে পরস্পরের হাতে রঙিন সুতা বেঁধে দেওয়ার রীতি আছে। সুতা বাঁধার সময়ে তারা বলে: যার দ্বারা মহাবলী দৈত্যরাজ বলিকে বাঁধা হয়েছিল, তার দ্বারা আমি তোমাকে বাঁধলাম অর্থাৎ এ বন্ধন যেন কখনো ছিন্ন না হয়।
দলে/জোড়ায় পরিকল্পনা করে সহজলভ্য উপাদান দিয়ে নান্দনিক রাখি তৈরি করে সহপাঠীদের সঙ্গে 'রাখিবন্ধন' উৎসব উদ্যাপন করো।
রাখিবন্ধন উৎসবের আলোকে নিচের ছকটি পূরণ করো।
ছক ২.৭: রাখিবন্ধনের গুরুত্ব
রাখিবন্ধন উৎসব থেকে তুমি যে মূল্যবোধ অর্জন করেছ | |
ডান দিকের ঘরে গোল চিহ্ন দাও | শিষ্টাচার, ধর্মনিষ্ঠতা, ন্যায়পরায়ণতা, ভ্রাতৃপ্রেম, পিতা-মাতার প্রতি ভক্তি, সত্যবাদিতা, গুরুজনে ভক্তি, মানবিকতা, সহমর্মিতা, দায়িত্বশীলতা, অধ্যবসায়, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা, |
রাখিবন্ধন উৎসব থেকে অর্জিত মূল্যবোধকে তুমি কীভাবে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাবে?
|
'নবান্ন' শব্দের অর্থ 'নতুন অন্ন' বা নতুন ভাত। এটি বাংলার একটি লোকজ উৎসব। হেমন্তে আমন ধান কাটার পর অগ্রহায়ণ কিংবা মাঘ মাসে হিন্দুগৃহস্থরা এই উৎসব উদ্যাপন করে। নবান্ন উৎসবে দেবতা, অগ্নি, ব্রাহ্মণ, পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজনকে নতুন অন্ন নিবেদন করা হয়। এই উৎসবে চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে 'কাকবলী'।
পৌষসংক্রান্তির দিনেও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা আছে। এই দিন নতুন ধানের চাল দিয়ে ভাত, নানা রকম পিঠা দিয়ে পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধ করা হয়। কালের বিবর্তনে এই নবান্ন উৎসবের মুখরতা অনেকটা কমে গেলেও গ্রামবাংলায় এখনো টিকে আছে। নবান্ন উৎসবে পিঠা-পায়েস আদান প্রদান কীর্তন, পালাগান, জারিগানে গ্রামবাংলা মুখরিত হয়ে ওঠে।
নতুন বাড়ি তৈরি এবং বাড়িতে প্রথম প্রবেশ করার সময় বিভিন্ন পূজা ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের বিধান আছে। আমাদের জীবনে চতুবর্গ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষকে পরিপূর্ণতা দেয় একটি গৃহ। নতুন গৃহে প্রবেশের সময় বিষ্ণু, বাস্তু বা ভূমি, গৃহকর্তার অভীষ্ট দেবতার পূজা করা হয়। এ সময় নান্দিমুখ বৃদ্ধিশ্রাদ্ধের মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ কামনা করা হয়। দ্বারদেবতার পূজা হয়। নতুন ঘর তৈরির আগে ভূমি পূজা বা ভিত পূজারও বিধান আছে। গৃহপ্রবেশের দিন পুরোহিত, গুরুজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। এই দিন গৃহকর্তা সকলকে নিয়ে গৃহের সর্বাঙ্গীণ সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধির মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন।
তোমার এলাকায় হিন্দুধর্মসংশ্লিষ্ট যেসব লোক উৎসব উদ্যাপিত হয় সেগুলো সম্পর্কে দলে বা জোড়ায় তথ্য সংগ্রহ করো। এরপর নিচের ছকটি এককভাবে পূরণ করো।
ছক ২.৮: আমার এলাকার লোক উৎসব
লোক উৎসবের নাম | উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ |
|
|
|
|
|
|
|
|
ধর্মীয় রীতি-নীতি ও ঐতিহ্য অনুসরণ করে সমগ্রজীবনে যেসব মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান পালন করা হয়, সেগুলোই হিন্দুধর্মমতে সংস্কার। মনুসংহিতা, পরাশরসংহিতা, যাজ্ঞবন্ধ্যসংহিতা প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রে হিন্দুধর্মের এসব সংস্কারগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে লেখা আছে।
জন্ম ও জন্ম পরবর্তী সময়ে প্রত্যেক সনাতন ধর্মাবলম্বীর জন্য পালনীয় কিছু বিধি-বিধান আছে। এগুলোকে দশবিধ সংস্কার বলা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে-গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন, জাতকর্ম, নামকরণ, অন্নপ্রাশন: বিদ্যারম্ভ, চূড়াকরণ, উপনয়ন, সমাবর্তন বিবাহ। বৈদিক যুগে এ সকল সংস্কার পালিত হলেও এখনকার সময়ে দশবিধ সংস্কারের সবগুলো সমানভাবে পালিত হয় না। এখন যে সকল সংস্কার পালিত হয় তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো
সীমন্তোন্নয়ন: গর্ভধারণের পর চতুর্থ, ষষ্ঠ বা অষ্টম মাসে নিরাপদ প্রসবের আকাঙ্ক্ষায় এই সংস্কার পালন করা হয়। বর্তমানে এই সংস্কার সাধ-ভক্ষণ বা সাধ নামে বেশি পরিচিত।
জাতকর্ম: সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিতা যব, যষ্টিমধু ও ঘৃত দ্বারা সন্তানের জিহ্বা স্পর্শ করে মন্ত্রোচ্চারণ করেন।
নামকরণ: সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার দশম, একাদশ, দ্বাদশ বা শততম দিনে নামকরণ করতে হয়।
নিষ্ক্রমণ: নিষ্ক্রমণ অর্থ 'বাইরে যাওয়া'। এই অনুষ্ঠানে বাবা-মা শিশুকে বাইরে নিয়ে যান। এ সময়ে শিশুটি প্রথমবারের মতো বাইরের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়। জন্মের পর চতুর্থ মাসে এটি পালন করার নিয়ম। শিশুকে স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরানো হয়। তাকে বাইরে নিয়ে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, চাঁদ বা সূর্য দেখানো হয়।
অন্নপ্রাশন: শিশুর প্রথম খাবার খাওয়া উপলক্ষে যে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান হয়, তাকে অন্নপ্রাশন বলে। একে আমরা 'মুখে ভাত' হিসেবেও জানি। পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে যষ্ঠ বা অষ্টম মাসে এবং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে পঞ্চম বা সপ্তম মাসে এই অনুষ্ঠান হয়। অন্নপ্রাশনে আত্মীয়, প্রতিবেশীরা নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসে শিশুকে আশীর্বাদ করেন, উপহার দেন।
অন্নপ্রাশনের পর বিদ্যারম্ভ নামে আরেকটি সংস্কার প্রচলিত আছে।
বিদ্যারম্ভ: ছোট শিশুদের জ্ঞান, অক্ষর এবং শেখার প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অনুষ্ঠান। শিশু চার বছর অতিক্রম করলে পঞ্জিকা দেখে বিদ্যারম্ভের উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা হয়। এরপর পূজা-অর্চনা হয়। শিশুকে হাতে ধরে অক্ষর লেখানো হয়। এই সংস্কার 'হাতেখড়ি' নামেই বেশি পরিচিত। সাধারণত সরস্বতী পূজার সময় শিশুদের হাতেখড়ি অনুষ্ঠান করা হয়।
চূড়াকরণ: গর্ভাবস্থায় সন্তানের মাথায় যে চুল হয়, কেটে ফেলার তা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। উপনয়ন সংস্কার থাকলে এটি উপনয়নের সময় নতুবা অন্নপ্রাশনের সময়ে সম্পন্ন করা হয়।
এই সংস্কারের সঙ্গে কর্ণভেদ নামে একটি অতিরিক্ত সংস্কারের উল্লেখ আছে।
কর্ণভেদ: কর্ণভেদ অর্থ 'কানে ছিদ্র করা'। এই সংস্কার মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি পালন করতে দেখা যায়। 'উপনয়ন' সংস্কারে চূড়াকরণের পর কর্ণভেদের বিধান আছে।
উপনয়ন: উপনয়ণ সংস্কারে বিদ্যাশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীকে প্রথমে গুরুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। 'উপনয়' শব্দটির মানে 'কাছে নিয়ে যাওয়া'। প্রচলিত একটি অর্থে উপনয়ন বলতে বোঝায় যজ্ঞোপবীত বা পৈতা ধারণ।
সমাবর্তন: লেখাপড়া শেষে গুরু যখন শিষ্যকে বাড়ি ফেরার অনুমতি দেন তখন একটি উৎসব হয়। এটিই সমাবর্তন। আগেকার দিনে উপনয়ন শেষে গুরুগৃহে বাস করাই ছিল রীতি। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে গুরুর অনুমতি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হতো।
বর্তমানে গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাশিক্ষার প্রচলন নেই। সে কারণে এ সংস্কারটি এখন আর পালিত হয় না, তবে 'সমাবর্তন' নামটি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র বিতরণ উৎসব এখন 'সমাবর্তন' নামে উদ্যাপিত হয়। এখনকার সময়ে যারা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাদের উপাধিপত্র (সার্টিফিকেট) প্রদান উৎসবের সঙ্গে আগেকার গুরুগৃহ ত্যাগের উৎসবের তুলনা করা যেতে পারে।
বিবাহ: বিবাহ শব্দের অর্থ বিশেষরূপে ভার বহন করা। প্রাপ্তবয়সে বেদ ও পিতৃপুজা, হোম ইত্যাদির মাধ্যমে মন্ত্র উচ্চারণ করে একজন ছেলে ও একজন মেয়ের জীবনকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার সংস্কারকে বিবাহ বা বিয়ে বলা হয়। এর মাধ্যমে পরিবার গড়ে ওঠে। পরিবারের সকলে মিলেমিশে সুখ-দুঃখ ভাগ করে, একে অপরকে সহযোগিতা করে জীবন যাপন করে।
বিবাহে যেমন কতকগুলো শাস্ত্রীয় বিধি-বিধান পালিত হয়, তেমনি পালিত হয় কতকগুলো লৌকিক ও স্থানীয় আচার।
মনুসংহিতায় বিভিন্ন রকমের বিবাহ পদ্ধতির বর্ণনা আছে। এর মধ্যে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য উল্লেখযোগ্য। বর্তমান সমাজে ব্রাহ্ম বিবাহই বেশি প্রচলিত ও স্বীকৃত। বাবা-মা মেয়েকে নতুন কাপড় ও অলংকারে সাজিয়ে, আমন্ত্রিত অতিথি ও আত্মীয় স্বজনকে সাক্ষী রেখে, বরের কাছে কন্যাদান করেন। একে ব্রাহ্মবিবাহ বলে। আবার প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত সমাজে গান্ধর্ব বিবাহেরও প্রচলন আছে। নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি শপথ করে মাল্য বিনিময়ের মাধ্যমে যে বিবাহ করে, তাকে বলা হয় গান্ধর্ব বিবাহ। বিবাহের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্রটি হলো-
"যদিদং হৃদয়ং তব তদন্ত হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদন্ত হৃদয়ং তব।" (ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ)
অর্থাৎ তোমার এই হৃদয় হোক আমার, আমার হৃদয় হোক তোমার।
বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা থাকে। তারা একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথি হয়ে জীবনের পথে নতুন যাত্রা শুরু করে।
ছক ২.৯: সংস্কারের একাল-সেকাল
বেশিরভাগ মানুষ এখনও পালন করে | খুব কম পালিত হয় | এখন আর পালিত হয় না |
|
|
|
আমাদের সংগৃহীত উপকরণ | বন্ধুদের সংগৃহীত উপকরণ | ||
উৎসবের নাম | উপকরণ | উৎসবের নাম | উপকরণ |
|
|
|
|
হিন্দুধর্মীয় স্থানের নাম: | |
অবস্থান: | |
উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য | |
১.
| |
২.
| |
৩.
| |
৪.
| |
৫.
|
ছক ২.১১: তীর্থকথা
তীর্থস্থানের নাম | অবস্থান |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
তীর্থ শব্দের অর্থ 'অবতরণের স্থান'। দেবতা, মহাপুরুষ বা মুনি-ঋষিদের জন্ম বা অবতরণের পুণ্যস্থানই তীর্থস্থান বা তীর্থক্ষেত্র। জগতের মঙ্গলের জন্য তাঁরা পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে জন্ম নেন। আবার প্রয়োজনীয় কাজ শেষে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তাঁদের জীবন তথা লীলাকর্মের সঙ্গে যুক্ত পবিত্র ভূমিও তীর্থস্থানের অন্তর্ভুক্ত। তীর্থস্থান দর্শন করে মন পবিত্র ও নির্মল হয়, পুণ্যলাভ হয়। পুণ্যলাভ করে মানুষ স্বর্গবাসী হতে পারে। আবার কামনা-বাসনা শূন্য হৃদয়ে মানুষ বিশ্বস্রষ্টার সান্নিধ্য পেতে চায়। একে বলা হয় জীবনমুক্তি বা মোক্ষলাভ।
এবারে আমরা হিন্দুধর্মীয় কিছু পুণ্যস্থান বা তীর্থক্ষেত্র সম্পর্কে জানব।
অযোধ্যা, মথুরা, হরিদ্বার, কাশী বা বারাণসী, কাঞ্চী, অবন্তিকা ও দ্বারকা- এই সাতটি তীর্থকে একসঙ্গে সপ্ততীর্থ বলা হয়। এ বিষয়ে হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়েছে-
অযোধ্যা মথুরা মায়া কাশী কাঞ্চী অবন্তিকা।
পুরী-দ্বারাবতী চৈব সপ্তৈতা মোক্ষদায়িকাঃ।। (পদ্মপুরাণ, ভূমিখণ্ড)
সরলার্থ: অযোধ্যা, মথুরা, মায়া বা হরিদ্বার, কাশী বা বারাণসী, কাঞ্চী বা কাঞ্চীপুরম, অবন্তিকা বা উজ্জয়িনী এবং দ্বারাবতী বা দ্বারকা এই সাতটি তীর্থ মানুষকে মোক্ষ দান করে।
সপ্ততীর্থের মধ্যে অযোধ্যা, মথুরা, হরিদ্বার এবং বারাণসী বা কাশী এই চারটি তীর্থের বর্ণনা দেওয়া হলো
ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অন্তর্গত একটি শহর অযোধ্যা। বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্রের জন্ম ও লীলাভূমি হলো অযোধ্যা। শাস্ত্রে তাই অযোধ্যাকে সপ্ততীর্থের অন্তর্গত পবিত্র তীর্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অযোধ্যায় প্রথমে চোখে পড়ে মহাবীর হনুমানের মন্দির 'হনুমানগড়'। লঙ্কা-জয় শেষে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে হনুমানও অযোধ্যায় আসেন। হনুমানকে এই হনুমানগড়ে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। টিলাসদৃশ উঁচু জায়গায় মন্দিরটির অবস্থান। হনুমানের সঙ্গে এখানে রাম-সীতার পূজা করা হয়।
কণকভবন অযোধ্যার একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির। এখানে স্বর্ণালংকারে ভূষিত রাম-সীতার মূর্তি রয়েছে। বিয়ের পর রাম ও সীতা মিথিলা থেকে অযোধ্যায় ফিরে আসেন। তারপর তাঁরা কণকভবনে বসবাস করতে থাকেন। এখানে রাম-সীতার নিত্যপূজা করা হয়।
অযোধ্যায় রঘুবংশের কুলগুরু ঋষি বশিষ্ঠের একটি আশ্রম আছে। হিন্দি ভাষায় রামায়ণ-রচয়িতা তুলসী দাসের নামে এখানে 'তুলসী স্মারক ভবন' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে রামলীলা ও কীর্তন হয়।
তীর্থের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান সরযূ নদী। এখানে অনেকগুলো শানবাঁধানো ঘাট রয়েছে। যার মধ্যে রামঘাট সর্বশ্রেষ্ঠ। এই ঘাটে রামচন্দ্র দেহত্যাগ করার জন্য নদীর জলে নামেন। ঠিক তখনই ব্রহ্মা উপস্থিত হয়ে রামকে বিষ্ণুর জ্যোতিতে প্রবেশ করতে অনুরোধ করেন। বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্র বিষ্ণুর জ্যোতির সঙ্গে মিশে যান। রামের অনুগামীরাও এই স্থানে নদীর জলে দেহত্যাগ করে দিব্যলোক প্রাপ্ত হন। তাই এই ঘাটকে রামচন্দ্রের মহাপ্রস্থান ঘাট বলা হয়। ঘাটের জলে সিক্ত হয়ে পাপমুক্ত হওয়া যায়। এখানে পিতৃতর্পণ করলে পিতামাতা স্বর্গবাসী হন, ভক্তদের এমন বিশ্বাস রয়েছে। রামঘাটের পাশেই লক্ষ্মণঘাট। নদীর যে স্থানে লক্ষ্মণ যোগবলে দেহত্যাগ করেন, সেই স্থানের নাম লক্ষ্মণঘাট।
অযোধ্যার সবচেয়ে বড় উৎসব দুটি- রামনবমী ও দীপাবলি। চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। ঐ তিথিতে পালন করা হয় রামনবমী। আবার, লঙ্কা-জয় শেষে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে আসেন। অযোধ্যাবাসীরা আনন্দিত হয়ে সেদিন মাটির প্রদীপ জ্বালায়। রামকে অভিনন্দন জানায়। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে এই উৎসব উদ্যাপিত হয়। অমাবস্যার অন্ধকারে গঙ্গার ঘাটগুলো তখন আলোকময় হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থী এই উৎসবে যোগ দেন।
ভারতের বড় শহর গুলো থেকে ট্রেনে বা বাসে চড়ে যাওয়া যায়। অযোধ্যা ক্যানটনমেন্ট স্টেশন থেকে মূল তীর্থের দূরত্ব দশ কিলোমিটার। অটোরিকশা বা ট্যাক্সিতে করে এই দূরত্ব অতিক্রম করা যায়।
উত্তর প্রদেশের মথুরা জেলার একটি প্রাচীন শহর মথুরা। এর পাশেই বৃন্দাবন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগে মথুরায় কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্য ও কৈশোর লীলা অতিবাহিত হয় বৃন্দাবনে। ভক্ত ও ভগবানের লীলামাহাত্ম্যে পূর্ণ এই দুটি স্থান। এসব মিলে মথুরা তীর্থ। এখানে প্রায় পাঁচ হাজার মন্দির রয়েছে। প্রধান প্রধান মন্দির ও শ্রীকৃষ্ণের লীলামাহাত্ম্যের কিছু অংশ এখানে বর্ণনা করা হলো
কেশবমন্দির: মথুরা শহরে অবস্থিত এটি একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের মূল বেদির বামপাশে রয়েছে জগান্নথদেব, বলরাম ও সুভদ্রার ছবি। ডানপাশে রয়েছে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের বিগ্রহ। কাছাকাছি রয়েছে মহাবীর হনুমানের মূর্তি। মন্দির-চত্বরের ভিতরে একটি ছোট মন্দির রয়েছে, যাকে কংসের কারাগার বলা হয়। এই কারাগারে বসুদেব ও দেবকীর পুত্ররূপে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়। জন্মের সময় বসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে নারায়ণের চতুর্ভুজ মূর্তিরূপে দেখতে পান। সেই মূর্তিই এখানে পূজিত হয়।
দ্বারকাধীশমন্দির: দ্বারকাধীশ অর্থ দ্বারকার অধীশ্বর অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ। মন্দিরে তাঁরই বিগ্রহের পূজা দেওয়া হয়। পাশে রয়েছে প্রভু নিত্যানন্দের মূর্তি।
রঙ্গভূমি: রঙ্গভূমি অর্থ রণভূমি বা যুদ্ধভূমি। যমুনা তীরের এই স্থানে কংসের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে কংস নিহত হয়। এটি পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত।
বিশ্রামঘাট: কংসকে বধ করে পরিশ্রান্ত কৃষ্ণ যমুনাতীরের এই ঘাটে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। যমুনার চব্বিশটি ঘাটের মধ্যে এটি অন্যতম। এখানে পিতৃতর্পণ করলে পিতামাতা স্বর্গবাসী হন, এ রকম বিশ্বাস প্রচলিত আছে।
কালীয়নাগঘাট: কালীয়নাগ সহস্র ফণাযুক্ত একটি বিষধর সাপ। শ্রীকৃষ্ণ এই স্থানে তাকে দমন করে বৃন্দবনবাসীকে রক্ষা করেন। সে কারণে ঘাটের নাম হয়েছে কালীয়নাগ ঘাট।
বাঁকে বিহারীমন্দির: বৃন্দাবনের মন্দিরগুলোর মধ্যে এটি একটি বড় মন্দির। এখানে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি পূজা করা হয়। স্বামী হরিদাস নিধুবনে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি পেয়ে এই মন্দিরে স্থাপন করেন।
রাধা-দামোদরমন্দির: ষড়-গোস্বামীর অন্তর্গত জীবগোস্বামী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি এখানে সেবিত হয়।
শ্রীরঙ্গনাথ মন্দির: এখানে অনন্তনাগের ওপর শায়িত অবস্থায় ভগবান বিষ্ণুর বিগ্রহ রয়ছে। মন্দিরের দেয়ালে অনেক চিত্র আছে। এখানকার মিউজিয়ামে শ্রীকৃষ্ণের লীলামাহাত্ম্যর নানান মূর্তি রয়েছে।
মদনমোহনমন্দির: অনেক উঁচু বেদির উপর অবস্থিত মদনমোহনমন্দির একটি সুদৃশ্য মন্দির। সিঁড়ির অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে মূল বেদিতে উঠতে হয়। মন্দিরের গায়ে অপূর্ব নকশা রয়েছে। এই মন্দিরের পেছনে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের সমাধি আছে
নিধুবন: ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর ভক্তদের মিলনভূমি হলো নিধুবন। এখানে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা ও গোপীরা বিরাজ করতেন। পুরো বনটি তুলসীগাছে পূর্ণ।
গোবর্ধনপর্বত: মথুরা তীর্থের মাঝখানে রয়েছে গোবর্ধনপর্বত। এর চারদিকে চক্রাকারে মন্দিরগুলোর অবস্থান।
ভক্তরা হেঁটে মন্দিরগুলো দর্শন করেন। মন্দিরদর্শনের সমবেত এই যাত্রাকে বলা হয় ব্রজমণ্ডল পরিক্রমা। প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এই পরিক্রিমা শুরু হয়।
দোলপূর্ণিমা, রাসপূর্ণিমা ও ঝুলনযাত্রা- এই তিনটি উৎসব মথুরা ও বৃন্দাবনের প্রধান উৎসব। ফাল্গুন মাসের শুরুপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে দোলপূর্ণিমা উৎসব উদ্যাপিত হয়। শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে ঝুলনযাত্রা উৎসব হয়। আবার, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে রাসপূর্ণিমা হয়। তখন ভারতবর্ষসহ সারা বিশ্বের বৈষ্ণব ভক্ত ও দর্শনার্থীরা এই উৎসবে যোগ দিতে আসেন।
ভারতের যে-কোনো বড় শহর থেকে আন্তঃনগর ট্রেনে বা দূরপাল্লার বাসযোগে মথুরা শহরে যাওয়া যায়। বিমানযোগে যাওয়ার জন্য প্রথমে আগ্রা বিমানবন্দরে নামতে হবে। আগ্রা থেকে মথুরার দূরত্ব মাত্র সাতান্ন কিলোমিটার। ট্যাক্সি বা গণপরিবহণে এই দূরত্ব অতিক্রম করে মথুরায় পৌঁছানো সম্ভব। মথুরা শহর থেকে মূল তীর্থগুলো খুব কাছাকাছি। রিকশা বা অটোতে এই দূরত্ব অতিক্রম করে মথুরা-তীর্থ দর্শন করা যায়।
অযোধ্যা আর মথুরা ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত নগর। এ সম্পর্কে এখানে যা তথ্য দেওয়া আছে, তার বাইরে আরও কিছু তথ্য বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে এককভাবে সংগ্রহ করো। এরপর দলে বা জোড়ায় বা অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করে লেখো।
ছক ২.১২: অযোধ্যা আর মথুরার কথা
অযোধ্যা | মথুরা |
|
|
ভারতবর্ষের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হরিদ্বার জেলায় হরিদ্বার তীর্থের অবস্থান। হরিদ্বার অর্থ হরি বা বিষ্ণুর দরজা। অন্যদিকে শিবের ভক্তরা এর নাম দিয়েছেন হরদ্বার। হিমালয় হতে উৎপন্ন হয়ে গঙ্গা যে স্থানে সমভূমিতে প্রবেশ করেছে সেখানেই হরিদ্বার তীর্থের অবস্থান। সপ্ততীর্থের অন্তর্ভুক্ত এই তীর্থ অতি পবিত্র। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ভগীরথের বংশে সগর নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর ৬০ হাজার পুত্র কপিল মুনির অভিশাপে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান। গঙ্গাজলের পবিত্র স্পর্শে তাঁদের উদ্ধার হবে, এই লক্ষ্যে ভগীরথ গঙ্গাদেবীকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন। সন্তুষ্ট হয়ে দেবী জলধারা রূপে পৃথিবীতে নেমে আসেন। সগরের সন্তানদের দেহাবশেষ গঙ্গাজলে সিক্ত হয়। ফলে তাঁরা উদ্ধার পেয়ে স্বর্গে চলে যান। সে কারণে ভক্তদের বিশ্বাস, পবিত্র এই তীর্থে গঙ্গার জলে স্নান করলে পাপমুক্ত হওয়া যায়, স্বর্গলাভ করা যায়। মহাভারতে পবিত্র এই তীর্থকে স্বর্ণদ্বার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
গঙ্গার দুই পাড়ে অপরূপ পাহাড়-পর্বত, বন-বনানী। সৌন্দর্য দেখে মন জুড়িয়ে যায়। মনে একধরনের আকর্ষণ বা মায়ার সৃষ্টি হয়। তাই এই তীর্থকে মায়াপুরীও বলা হয়। অন্যদিকে এই তীর্থ দর্শন করে জীবের মোহমায়া কেটে যায়। শাস্ত্রে তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে মায়াপুরী।
গঙ্গার পাড়ে রয়েছে শিবের বিশালাকার বিগ্রহ। দূর থেকে সহজেই যা চোখে পড়ে। বহমান গঙ্গার দুপাশে মাইলের পর মাইল পাথর দিয়ে বাঁধানো। স্থানে স্থানে পারাপারের সেতু ও বাঁধনো ঘাট। ঘাটগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ ব্রহ্মকুণ্ডঘাট। স্থানীয় বাসিন্দারা একে 'হর কি পৌড়ি' বলেন। অর্থাৎ হরির প্রস্থানঘাট। ভারতবর্ষে অনুষ্ঠিত চারটি কুম্ভমেলার স্থানের মধ্যে এটি একটি। পুরাণ অনুসারে, সমুদ্র-মন্বনের শেষে ধন্বন্তরি দেবতা অমৃতকুম্ভ নিয়ে উঠে আসেন। অমৃত হলো এক ধরনের পানীয় যা খেলে অমরত্ব লাভ করা যায়। আবার কুম্ভ হলো বড় আকারের পাত্র। অমৃতের সুরক্ষার্থে ভগবান নারায়ণ তা নিয়ে অন্যত্র রওনা দেন। তখন বিন্দু-পরিমাণ অমৃত কুম্ভ হতে হরিদ্বারের এই স্থানে পতিত হয়। কুম্ভ থেকে অমৃত পতিত হওয়ার কারণে মেলার নামকরণ হয়েছে কুম্ভমেলা। প্রতি ১২ বছর পরপর এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সূর্য ও বৃহস্পতি কুম্ভরাশিতে অবস্থান করলে হরিদ্বারে পূর্ণ কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
হরিদ্বারে ব্রহ্মকুণ্ডঘাটে সন্ধ্যার সময় গঙ্গাদেবীর আরতি হয়। ভক্তরা গাছের পাতার ছোট নৌকায় অর্ঘ্য সাজিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেন। সারাঘাট তখন আলোকময় হয়ে ওঠে। সেই দৃশ্য অতি মনোরম।
ভারতবর্ষের বড় বড় শহর থেকে বাসযোগে সরাসরি হরিদ্বার যাওয়া যায়। ট্রেনে যেতে হলে বড় শহরের স্টেশন থেকে হরিদ্বার স্টেশনে নামতে হবে। হরিদ্বার স্টেশন থেকে তীর্থের দূরত্ব ২০ কিলেমিটার। বিমানে যেতে হলে বড় বড় শহরের বিমান বন্দর থেকে উত্তরাখণ্ডের দেরাদুন নামতে হবে। দেরাদুন থেকে হরিদ্বারের দূরত্ব ৫১ কিলোমিটার। অটোরিকশায় এই দূরত্ব অতিক্রম করে সহজেই হরিদ্বারে পৌঁছানো সম্ভব।
ভারতের উত্তরপ্রদেশের বারাণসী জেলায় বারাণসী তীর্থের অবস্থান। আসলে গঙ্গা নদীর দুটি উপনদী 'বরুণ' ও 'অসি' যা মিলে গঠিত হয়েছে বারাণসী। গঙ্গার সঙ্গে নদী দুটির মিলনের মধ্যবর্তী পবিত্র ভূমিই বারাণসী। বারাণসীর অন্য নাম কাশী। কাশীতীর্থ দর্শন করে মানুষের মোহ নাশ হয়। ভ্রান্ত জ্ঞান দূর হয়ে হৃদয় আলোকিত হয়। তাই এর নাম কাশী। মহাদেব কখনো এই পবিত্র স্থান ছেড়ে চলে যান না। তাই এই তীর্থের নাম দেওয়া হয়েছে অবিমুক্ত।
তীর্থের শহর বারাণসীতে ছোট-বড় মিলে প্রায় তেইশ হাজার মন্দির রয়েছে। তাই একে হিন্দুদের ধর্মীয় রাজধানী বলা হয়। মন্দিরগুলোর মধ্যে 'কাশী বিশ্বনাথমন্দির' অন্যতম। এখানে শিবলিঙ্গের পূজা করা হয়, দ্বাদশ জ্যেতির্লিঙ্গের মধ্যে যা অন্যতম। ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য মহাদেব তাঁদের মাঝে জ্যোতির্ময় লিঙ্গরূপে আবির্ভূত হন। তাঁরই প্রস্তরীভূত রূপ জ্যোতির্লিঙ্গ। এখানে মহাদেব সর্বদা বিরাজ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। পূজার পাশাপাশি এখানে বৈদিক মন্ত্র পাঠ হয়, শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশিত হয়।
বিশ্বনাথমন্দিরের চূড়া এক হাজার কেজি ওজনের সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো। পাশে জ্ঞানবাপি নামে একটি কুন্ড রয়েছে। কুন্ডের জলে স্নান করলে মূর্খেরও জ্ঞান লাভ হয়- এমন বিশ্বাস ভক্তদের রয়েছে।
সংকট-মোচনমন্দির বারাণসীর একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির। সংকট থেকে মুক্তি দেন মহাবীর হনুমান। তাঁর নাম অনুসারে মন্দিরটির নামকরণ। হনুমানসহ এখানে রাম-সীতা পূজিত হন। তুলসীমানস মন্দির এখানকার একটি বড় মন্দির। হিন্দিভাষায় রামায়ণ রচয়িতা তুলসীদাসের নামে এই মন্দির। মন্দিরের নানা কক্ষে রামায়ণের কাহিনিকে শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। দেয়ালে লেখা রয়েছে রামায়ণের শ্লোক। রাম, সীতা ও হনু- মানের পাশাপাশি এখানে তুলসীদাসেরও পূজা করা হয়। আবার, উত্তরবঙ্গের নাটোরের (বর্তমান বাংলাদেশের) রানী ভবানী এখানে একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে দশভুজা দুর্গাদেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া আর একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির অন্নপূর্ণা দেবীর মন্দির। নানা অলংকারে ভূষিত অন্নপূর্ণা দেবীকে এখানে পূজা করা হয়। দেবীর কৃপায় কাশীতে কোনো মানুষ খাবারের কষ্ট পান না- এমন লোকশ্রুতি রয়েছে।
বারাণসী তীর্থের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে পবিত্র গঙ্গা। গঙ্গাতীরে মোট ৮১টি ঘাট রয়েছে। দশাশ্বমেধ একটি উল্লেখযোগ্য ঘাট। পিতামহ ব্রহ্মা এখানে ১০টি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। 'দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান করলে মোক্ষ লাভ হয়' মহাভারতে এমনটি বলা হয়েছে। আবার মণিকর্ণিকা ঘাটে শিবের কানের অলংকারের 'মণি' পড়েছিল। সতীর শবদেহ নিয়ে নৃত্য করার সময়ে এই ঘটনা ঘটে। তাই এর নাম মণিকর্ণিকা ঘাট। দানবীর হরিশ্চন্দ্রের নামে নির্মিত হয়েছে হরিশ্চন্দ্র ঘাট। হরিশ্চন্দ্র ও দশাশ্বমেধ ঘাটের পাশেই কাশীর দুটি মহাশ্মশান। এখানে শবদাহ করলে মৃত ব্যক্তির দিব্যলোক প্রাপ্তি হয় বলে ভক্তদের বিশ্বাস রয়েছে। অন্যদিকে অসি নদী ও গঙ্গার সঙ্গমস্থলে তৈরি হয়েছে অসিঘাট। এটিও একটি পবিত্র তীর্থ।
ঘাটগুলোতে গঙ্গাদেবীর সন্ধ্যা-আরতির দৃশ্য অতি চমৎকার। গঙ্গার ঘাটে সুসজ্জিত মঞ্চ নির্মিত হয়। ধুনুচিতে নানা সুগন্ধি দ্রব্য পোড়ানো হয়। আরতির জন্য নির্দিষ্ট ঝাড়-প্রদীপ জ্বালানো হয়। তারপর সুসজ্জিত পুরোহিতেরা প্রদীপ হাতে নিয়ে বাজনার তালে মঞ্চে নেচে নেচে গঙ্গার আরতি করেন। মনোরম সেই দৃশ্য দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ ভক্ত সেখানে সমবেত হন। ঘাটে জায়গা না পেয়ে কেউবা নৌকায় চড়ে গঙ্গাবক্ষে বসে আরতির দৃশ্য উপভোগ করেন।
বারাণসীর দুটি বড় উৎসব হলো মহাশিবরাত্রি উৎসব এবং গঙ্গা-উৎসব। ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি পূজা অনুষ্ঠিত হয়। উৎসব উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের হয়, গঙ্গাবক্ষে আরতি হয়। আবার লঙ্কাজয় শেষে রামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে গঙ্গা-উৎসব উদ্যাপিত হয়। ঐ দিন লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে মাটির পাত্রে করে গঙ্গার বুকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অমাবস্যার অন্ধকারে এই দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে যায়।
ভারতের যে-কোনো বড় শহর থেকে ট্রেনে কিংবা বাসে চড়ে বারাণসীতে পৌঁছানো যায়। স্টেশনগুলো থেকে মূল তীর্থের দূরত্ব পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের মধ্যে। বিমানযোগে যেতে হলে প্রথমে বারাণসীর লালবাহাদুর শাস্ত্রী বিমান বন্দরে নামতে হবে। সেখান থেকে মূল তীর্থের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। অটোরিকশা বা ট্যাক্সিতে এই দূরত্ব অতিক্রম করে মূল তীর্থ দর্শন করা সহজেই সম্ভব।
ছক ২.১৩: তীর্থস্থান-এর তথ্য
তীর্থস্থানের নাম | উৎসব (সময়/তিথি) | মন্দির | অবস্থান | উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
কেবল ভারতীয় উপমহাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী হিন্দুধর্মের অনেক অনুসারী আছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা চমৎকার স্থাপনার অনেক মন্দির তৈরি করেছেন, এবারে আমরা সেইসব মন্দির এবং সেগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জানব।
পণ্ডিত চাণক্য বলেছেন 'বসুধৈব কুটুম্বকম্'। এ পৃথিবীতে সবাই সবার আত্মীয়। হিন্দুধর্ম এই বিশ্বজনীন ধারণাকে সমর্থন করে। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন প্রার্থনায় সারা বিশ্বের সকল অস্তিত্বের মঙ্গল কামনা করা হয়।
সপ্তসিন্ধুর অববাহিকায় বিকশিত হওয়া হিন্দুধর্ম একটা সময় উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এসব অঞ্চলে হিন্দু রাজাদের নেতৃত্বে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল।
দক্ষিণ ভারতের কলিঙ্গ, চোল ও বিজয়নগরের রাজারা সমুদ্র অভিযানে উৎসাহ দিতেন। তাঁদের উৎসাহে এসব রাজ্যের বণিকরা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বাণিজ্য বিস্তার করতে থাকেন। তাঁদের মাধ্যমে বর্তমান কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ও ইন্দোনেয়িশায় হিন্দুধর্মের প্রসার ঘটে। এখনো এসব অঞ্চলে হাজার হাজার প্রাচীন হিন্দু মন্দির রয়েছে। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে নিয়মিত প্রাচীন মন্দিরগুলো আবিষ্কৃত হচ্ছে।
বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপকে একসময় যব দ্বীপ বলা হতো। জাভা ধান চাষের জন্য খুব উর্বর ভূমি ছিল। এখানে প্রচুর ধান হতো। পার্শ্ববর্তী দ্বীপ থেকে বিভিন্ন মসলা নিয়ে আসা হতো ধান কেনার জন্য। আবার ভারত ও আরব থেকে বণিকরা এখানে আসতেন মসলা কিনে নেওয়ার জন্য। এভাবে ভারতীয়রা এ অঞ্চলে যায়।
রাধেন বিজয় নামের এক হিন্দু রাজপুত্র মঙ্গোলিয়া থেকে আসা দখলদার থেকে জাভাকে মুক্ত করে ১২৯৪ সালে মাজাপাহিট রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে গজমদ নামের এক হিন্দু সেনাপতির নেতৃত্বে এ সা- ম্রাজ্য আরো বিস্তৃতি লাভ করে। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি মাজাপাহিট সাম্রাজ্য পাপুয়া নিউগিনি থেকে মালয় দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। বর্তমান ইন্দোনেশিয়া দেশটি মূলত এই রাজবংশের সময় গঠিত হয়। আজকের মালয়েশিয়াও সেসময় এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৩৯৮ সালে মাজাপাহিট সাম্রাজ্য প্রতিবেশী আরেকটি সাম্রাজ্যকে আক্রমণ করে। সুমাত্রার শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য। শ্রীবিজয়ার রাজার ঘাঁটি ছিল বর্তমানের সিঙ্গাপুরে। সেখান থেকে পিছু হটে রাজা প্রেমেশ্বর মালাক্কা দ্বীপে চলে যান।
এদিকে মাজাপাহিট রাজবংশ নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে দুর্বল হতে থাকে। একসময় শেষ মাজাপাহিট রাজা পশ্চিমের দিকে পালিয়ে গিয়ে মাউন্ট লাউয়ের এক হিন্দুমন্দিরে আশ্রয় নেন। এই রাজনৈতিক শূন্যতায় এ অঞ্চলে অন্য ধর্মের প্রসার শুরু হয়। এখনো ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে প্রায় ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠী হিন্দুধর্মাবলম্বী। ইন্দোনেশিয়া নামটির সৃষ্টি ইন্ডিয়া ও এশিয়া দুটি শব্দের সংশ্লেষে তৈরি। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় প্রতীক ও মূলনীতিতে এখনো হিন্দুসংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ করা যায়।
মাজাপাহিট সাম্রাজ্যের আগে অষ্টম শতাব্দীতে জাভা ও মালয় নিয়ে শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্য ছিল। ১০২৫ সালে চোল সাম্রাজ্যের আক্রমণে শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্যের পরাজয় ঘটে। দিন দিন সাম্রাজ্যটি দুর্বল হয়ে পড়ে।
নবম শতাব্দীতে হিন্দুরাজা জয়বর্মণের নেতৃত্বে কম্বোডিয়ায় বর্তমান খেমার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্দশ শতকে রাজা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হলে হিন্দুসাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষ এখনো হিন্দু দেবদেবীর পূজা করে।
সিঙ্গাপুর শব্দটি সংস্কৃত সিংহপুর শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ সিংহের নগর। সাং নিলা উতামা এই রাজ্যের পত্তন ঘটান। মিয়ানামারের পূর্বনাম ছিল ব্রহ্মদেশ। কথ্যরূপে বার্মা বলা হতো। সেখানে কিছু হিন্দুরাজ্য ছিলো। ভিয়েতনামে চম্পারাজ্য নামে একটি হিন্দুরাজ্য ছিল। জাপান, কোরিয়া ও ফিলিপাইনের সংস্কৃতিতেও হিন্দুধর্মের প্রভাব লক্ষ করা যায়। জাপানের দেবদেবী বেনজাইটেন, কাঙ্গিতেন ও বিষমন্তেন যথাক্রমে হিন্দু দেবদেবী সরস্বতী, গণেশ ও কুবেরের প্রতিরূপ যেন।
এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর নাম এখনো হিন্দু ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে যাচ্ছে। যেমন- আফগানিস্তানের পূর্বনাম ছিল উপগণস্থান। কান্দাহার ছিল মহাভারতের উল্লিখিত গান্ধার রাজ্য। কম্বোডিয়ার নাম ছিল কম্বোজ। পেশোয়ার এসেছে পুরুষপুর থেকে। একইভাবে লাহোর লবপুর, কাশ্মীর কাশ্যপপুরী, মালয়েশিয়া মলয়দেশ, তিব্বত ত্রিবিষ্টপ থেকে এসেছে।
প্রাচীনকালে হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা এবং সাগর-মহাসাগরের কারণে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে যেত না। ভারত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় অন্য অঞ্চলে যাওয়ার প্রয়োজনও তেমন অনুভূত হতো না। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ, রেললাইন স্থাপন ইত্যাদির জন্য ভারত থেকে প্রচুর হিন্দুধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী আফ্রিকা, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মিয়ানামার, মরিশাস, ফিজি, গুয়ানা, সুরিনাম, কাতার, আরব আমিরাতে হিন্দুজনগোষ্ঠী বসবাস করে।
প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত কিছু উল্লেখযোগ্য মন্দিরের বর্ণনা করা হলো
ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের যোগজাকার্তা রাজ্যে মন্দিরটি অবস্থিত। প্রাচীন জাভার বৃহত্তম এ হিন্দুমন্দিরটি নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি তৈরি হয়েছিল। এ মন্দিরের অদূরেই পৃথিবীর বৃহত্তম বৌদ্ধমন্দির বরবুদুর স্থাপন করেছিল শৈলেন্দ্র রাজবংশ। এই রাজবংশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রতিবেশী সঞ্জয় রাজবংশ এটি স্থাপন করেছিল বলে ধারণা করা হয়।
এটি মূলত একটি মন্দির কমপ্লেক্স। ৮টি ১৫৪ ফুট উঁচু মন্দিরকে কেন্দ্র করে এখানে ২৪০টি মন্দির ছিল। অনেক মন্দির নষ্ট হয়ে গেলেও ৮টি বড় মন্দির এখনো টিকে আছে। এসব মন্দিরে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের পূজা করা হয়।
এই মন্দিরপ্রাঙ্গণে প্রতি সন্ধ্যায় রামায়ণের ওপর গীতিনাট্য উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবছর হাজার হাজার বিদেশী পর্যটক এই গীতিনাট্য দেখতে আসে।
কম্বোডিয়ার আঙ্কোর ওয়াট হলো প্রস্বানান মন্দিরের মতো একটি মন্দির কমপ্লেক্স। ১৬২.৬ হেক্টর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এ কমপ্লেক্স গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় কাঠামো হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দ্বাদশ শতকে রাজা সূর্যবর্মণ দেবতা বিষ্ণুকে উৎসর্গ করে এ মন্দিরটি স্থাপন করেন। পরে এটি বৌদ্ধমন্দিরে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আঙ্কোর ওয়াটের আক্ষরিক অর্থে 'রাজধানী মন্দির'। এই মন্দির কমেপ্লেক্স করতে ২৭ বছর সময় লেগেছিল।
বাটু শব্দের অর্থ পাথর। পাথুরে গুহার একটি নেটওয়ার্ক এই বাটু কেভ। এখানে ১৪০ ফুট উচু মারুগানের মূর্তি আছে। ১৮৯০ সালে তামিল ব্যবসায়ী কে. থামবুসামি পিল্লাই এই মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মূর্তিকে কেন্দ্র করে শ্রী সুব্রামনিয়াম স্বামী দেবস্থানম নামে একটি মন্দির আছে। বর্তমানে এটি মালয়েশিয়ার একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে থাইপুসাম নামে বিখ্যাত হিন্দু উৎসব উদ্যাপিত হয়। এতে যোগ দিতে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর থেকে পর্যটকেরা আসেন।
ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে সমুদ্রতীর ধরে সাতটি মন্দির সারিবদ্ধভাবে স্থাপন করা হয়েছিল। স্থানীয় ভাষায় তানাহ লট অর্থ সমুদ্রের ভূমি। সমুদ্র তীরবর্তী একটি পাথরের উপর মন্দিরটি অবস্থিত। এটি বালির অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। ধারণা করা হয় হিন্দুধর্ম গুরু ডাং হায়াং নিরর্থ ষোড়শ শতকে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানকার পূজিত দেবতা বরুণ।