আমাদের সমাজে কিছু অসাধারণ মানুষ আছেন। এঁদের অনেক গুণ। এঁরা শুধু নিজের কথা ভাবেন না। সমাজ ও দেশের কথা ভাবেন। সকলের মঙ্গলের কথা ভাবেন। সকলকে ভালোবাসেন। সকলের সুখ- শান্তির জন্য কাজ করেন। পরোপকারই তাঁদের জীবনের সাধনা। জগতের কল্যাণ করাই তাঁদের জীবনের উদ্দেশ্য। এঁরা মহান। এঁরা অলৌকিক গুণসম্পন্ন। এঁরা জ্ঞান চর্চা করেন। মানুষের কল্যাণের কথা বলেন। মানুষকে ধর্মপথে চলার শিক্ষা দেন। সুন্দর সমাজ গঠনে রয়েছে এঁদের অনেক অবদান। এঁরা ধর্মীয় ব্যক্তি বা মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারী।
আমাদের ধর্মে অনেক মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারী আছেন- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, হরিচাঁদ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রণবানন্দ, সারদা দেবী, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, ভগিনী নিবেদিতা, মা আনন্দময়ী প্রমুখ। এঁদের মধ্যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, হরিচাঁদ ঠাকুর, সারদা দেবী, ভগিনী নিবেদিতা, স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে জেনেছি। এ অধ্যায়ে আমরা স্বামী প্রণবানন্দ ও মা আনন্দময়ী সম্পর্কে জানব:
স্বামী প্রণবানন্দ ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর গ্রাম। তাঁর পিতা বিষ্ণুচরণ ভূঁইয়া। মাতা সারদা দেবী। বিষ্ণুচরণ ছেলের নাম রাখেন জয়নাথ। পরে নাম দেন বিনোদ।
বিনোদ বাজিতপুর গ্রামের ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি ছিলেন শিবের ভক্ত। ছোটবেলা থেকেই তিনি ধ্যান করতেন। বিনোদ কীর্তন খুব পছন্দ করতেন। তিনি বন্ধুদের নিয়ে একটি কীর্তনের দল গঠন করেন।
বিনোদ ছিলেন খুব সংযমী ও পরিশ্রমী। বন্ধুদেরও তিনি সংযমী হতে বলতেন। বিনোদ বন্ধুদের নিয়ে আশ্রম গড়ে তোলেন। তাঁর পরিচয় হয় তপস্বী ব্রহ্মচারী হিসেবে। তখন ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। মাদারীপুর ছিল বিপ্লবীদের একটি প্রধান কেন্দ্র। বিনোদ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংঘবদ্ধ করেন। বিভিন্ন জেলা থেকে বিপ্লবীরা এসে আশ্রমে আশ্রয় নেন।
পিতার মৃত্যুর পর মায়ের আদেশে বিনোদ গয়াধামে যান। গয়ায় মৃত পিতৃপুরুষের উদ্দেশে পিও দান করেন। পিণ্ডদানের সময় তীর্থযাত্রীদের উপর পাণ্ডাদের অত্যাচার দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন। তিনি সংকল্প করেন হিন্দুদের তীর্থসমূহ সংস্কার করতে হবে। গ্রামে ফিরে বিনোদ মাদারীপুর, বাজিতপুর, খুলনা প্রভৃতি স্থানে সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এসবের মাধ্যমে গরিব-দুঃখীদের সেবা দিতে থাকেন।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে বিনোদ সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষা নেন। তখন তাঁর নাম হয় স্বামী প্রণবানন্দ। এ সময় তিনি গৈরিক বেশ ধারণ করেন। অর্থাৎ গেরুয়া রংয়ের কাপড় পরেন।
তীর্থযাত্রীরা যাতে সহজে পুণ্যকর্ম করতে পারে স্বামী প্রণবানন্দ সে ব্যবস্থা করেন। প্রথমেই তিনি গয়ায় সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এটা 'ভারত সেবাশ্রম সংঘ' নামে খ্যাতি লাভ করে। পরে বিভিন্ন স্থানে ভারত সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রণবানন্দ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করতেন না। তিনি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতেন। মানুষের মধ্যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। তিনি সনাতন আদর্শে সংগঠিত হওয়ার কথা বলতেন। তিনি বলেন, 'আহারে, বিহারে ও আলাপে সংযম অভ্যাস করবে। দুর্বল ব্যক্তি আত্মজ্ঞান ও মুক্তি লাভ করতে পারে না।'
তিনি সংঘ ও সংঘশক্তির ওপর জোর দিতেন। সংঘনেতার গুরুত্বের কথা বলতেন। তিনি বলেন, 'সংঘ, সংঘশক্তি ও সংঘনেতা- এই তিনে মিলে হয় এক।'
স্বামী প্রণবানন্দের বাণী শুনে মানুষ নতুন জীবন পায়। অসংখ্য মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।
স্বামী প্রণবানন্দ ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি কলকাতায় দেহত্যাগ করেন।
মা আনন্দময়ী ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার খেওড়া গ্রামে তাঁর মামা বাড়িতে। তাঁর পিতার নাম বিপিনবিহারী ভট্টাচার্য। মাতার নাম মোক্ষদাসুন্দরী। তাঁর পিতার বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকুট গ্রামে।
মা আনন্দময়ীর প্রকৃত নাম নির্মলা সুন্দরী। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তাঁর বাবা ছিলেন একজন সাধক। একদিন নির্মলা বাবাকে প্রশ্ন করে, 'আচ্ছা বাবা, হরিকে ডাকলে কী হয়?' বাবা বললেন, 'হরিকে ডাকলে মঙ্গল হয়।' তখন থেকে নির্মলা হরিকে ডাকা শুরু করে।
বিক্রমপুরের রমণীমোহন চক্রবর্তীর সঙ্গে নির্মলার বিয়ে হয়। রমণীমোহন ঢাকার শাহবাগে নবাবের বাগানের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। নির্মলা স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। পাশেই ছিল রমনা কালীবাড়ি। তিনি নিয়মিত সেখানে যেতেন। নিয়মিত সাধনা করতেন। এ কালীবাড়ির পাশে মা আনন্দময়ীর আশ্রম গড়ে ওঠে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মূল আশ্রমটি ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তীতে সেখানে আশ্রমটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
নির্মলা হরিনাম করতেন। হরিনাম করার সময় কখনো কখনো তিনি অচেতন হয়ে পড়তেন। শরীর থেকে দিব্যজ্যোতি বের হতো। তাঁর সংস্পর্শে এসে অনেকে শান্তি পেত। অনেক অসুস্থ রোগী সুস্থ হয়ে উঠত। এ থেকে সবাই বুঝতে পারল, তিনি দেবী। তখন থেকে তাঁর নাম হয় 'মা আনন্দময়ী'।
পরবর্তী সময়ে স্বামীর সঙ্গে তিনি ভারতের দেরাদুনে চলে যান। সেখানে তাঁর সাধনার কথা ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে তাঁর শিষ্য হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থানে মা আনন্দময়ীর নামে আশ্রম গড়ে ওঠে। তাঁর জন্মস্থান খেওড়াতে তাঁর নামে একটি আশ্রম আছে। একটি উচ্চবিদ্যালয় আছে। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ আগস্ট মা আনন্দময়ী পরলোক গমন করেন। তাঁর মরদেহ ভারতের হরিদ্বারের নিকট কনখল আশ্রমে সমাধিস্থ করা হয়।
মা আনন্দময়ী বলতেন, 'সংসারটা ভগবানের। কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া মানুষের কর্তব্য।' আরো বলতেন, 'জগতে মত ও পথের শেষ নেই। সব পথেই সত্যকে পাওয়া যায়। সব ধর্ম সমান। সব মানুষ সমান।' শিশুদের জন্য তাঁর অনেক নৈতিক শিক্ষামূলক উপদেশ আছে। যেমন-
(১) ভগবানের নাম করবে। তাতে মঙ্গল হবে।
(২) গুরুজন ও বাবা-মায়ের কথা শুনবে। ভালো করে লেখাপড়া শিখবে।
(৩) অন্তরে যদি ভগবানের প্রতি ভালোবাসা থাকে, ভক্তি থাকে তাহলে আর ভয় নেই।
আরও দেখুন...