বাংলাদেশের মানুষের জীবন, সংস্কৃতি এবং কৃষি এক সুতোয় গাঁথা। প্রাচীনকাল থেকে কৃষিই ছিল এ দেশের মানুষের অন্যতম অবলম্বন। সময়ের ধারাবাহিকতায় সেই প্রাচীন কৃষিতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিক কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষি উৎপাদনে বয়ে আনছে ব্যাপক সাফল্য। অথচ কৃষিপ্রধান এই দেশে এক সময় অভাব-অনটন লেগেই ছিল। এ ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সংঘটিত দুর্ভিক্ষ সমগ্র বাংলাদেশকে গ্রাস করেছিল। জাপানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে বৃটিশ সরকার বাংলা ও আসামের খাদ্যগুদামের খাদ্যশস্য হয় পশ্চিমে স্থানান্তর করেছিল, নয় ধ্বংস করেছিল। দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষে শুধু পূর্ব বাংলায় লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়। মহাযুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়লেও ঐ সময় বৃটিশ সরকার একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। আসাম ও বাংলার জন্য ঢাকার শেরে বাংলা নগরে একটি কৃষি ইন্সটিটিউট, কুমিল্লায় একটি ভেটেরিনারি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অনুষদ খুলে ডিগ্রি পর্যায়ে কৃষি শিক্ষা চালুর ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি কৃষি বিভাগ নামে একটি বিশেষায়িত দপ্তর চালু করা হয় । এতে তাৎক্ষণিকভাবে দুর্ভিক্ষাবস্থার উন্নতি না হলেও বাংলাদেশের কৃষির আধুনিকায়নের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিতি লাভ করে। এদের নির্দেশনায় তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার জন্য দক্ষ মাঠ কর্মী তৈরি করতে কিছু কৃষি সম্প্রসারণ ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (Agricultural Extention Training Institute) ও পশু চিকিৎসা ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (Veterinary Training Institute) স্থাপন করা হয়। প্রায় প্রতিটি জেলায় সরকারি কৃষি ফার্ম, পোল্ট্রি ফার্ম এবং কোথাও কোথাও ডেইরি ফার্ম চালু হয় প্রদর্শনী খামার হিসেবে। পাট, আখ, চা ইত্যাদি অর্থকরী ফসলের বিষয়ে গবেষণার জন্য একক গবেষণা ইন্সটিটিউট যথাক্রমে ঢাকা, ঈশ্বরদী ও শ্রীমঙ্গলে স্থাপিত হয়। গাজীপুরে কৃষি গবেষণা ও ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট স্থাপন করা হয়।
এই সকল আয়োজনের ফলে পূর্ব বাংলায় কৃষির আধুনিকায়ন শুরু হয় উনিশ শতকের ষাটের দশকে। প্রধান কৃষি ফসল ধানের ক্ষেত্রে এর প্রভাব সবচাইতে বেশি দেখা যায়। বিভিন্ন স্বাদগন্ধের কম ফলনশীল স্থানীয় ধানের পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল ইরি, ব্রি ধানের চাষ শুরু করা হয়। এগুলো চাষের জন্য সার, সেচ ও অন্যান্য পরিচর্যার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির চাহিদা কৃষিতে বাড়তে থাকে। ফলে প্রতি একর জমিতে উৎপাদন ব্যয় ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে ফলনও বৃদ্ধি পায় কিন্তু উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র কৃষকেরা হয় ক্ষেতমজুরে পরিণত হন, না হয় ভিটেমাটি ছেড়ে শহরে পাড়ি জমান নতুন পেশার খোঁজে। এ সময় উন্নত জাতের মুরগি, হাঁস ও গরুর খামার কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করে দেয়। পরিবহন ও বিপণনের সুবিধার জন্য দেশের শহরগুলো ঘিরে আধুনিক মুরগির খামার দিন দিন বেড়ে চলেছে।
কৃষিতে বিভিন্ন ফসলের উচ্চতর ফলন, পশুজাত দ্রব্যাদি যেমন- ডিম, দুধ, মাংস ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি হয় ও গ্রামীণ জীবনে শিক্ষার বিস্তার ঘটে।
মাটি বা জমি কৃষির মূল ক্ষেত্র। এই মাটি নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্ত নেই । মাটির গঠন, প্রকারভেদ, উর্বরতা, মাটিতে বসবাসকারী অনুজীব ও এদের উপকারিতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেছেন । ফসল উদ্ভিদ, গবাদি পশুপাখি, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর পুষ্টি, বৃদ্ধি, প্রজনন, নিরাময় ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয়ে এই বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো কৃষকরা গ্রহণ করেছেন । ফলে স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাদ্য উৎপাদনে কৃষির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। উচ্চ ফলনশীল ধান, গম, ভুট্টা, যব এই সব শস্যের উৎপাদনশীলতা আগের তুলনায় অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে আটটি পূর্ণাঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি পূর্ণাঙ্গ ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্স বিশ্ববিদ্যালয় চালু রয়েছে। নতুন স্থাপিত হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শিঘ্রই চালু হওয়ায় পথে । প্রায় সকল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান পড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষকগণ গবেষণা করে থাকেন। তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত উন্নত জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীরা কৃষকদেরকে অবহিত করেন। ফলে দেশের কৃষি উৎপাদনে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। নিয়ম কানুন মেনে চাষ করলে প্রচলিত উচ্চ ফলনশীল জাতের চেয়েও এরা বেশি ফলন দেয়। বিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে বর্তমানে বিভিন্ন ফসলের হাইব্রিড উদ্ভাবন করেছেন।
বিজ্ঞানীগণ নানা ধরনের ফুল, ফল, শাকসবজি, মুরগি, গরু, মাছ ও বৃক্ষ বিদেশ থেকে এনে এদেশের কৃষিতে সংযোজন করেছেন। এগুলোর সাথে সংকরায়ণ করে দেশীয় পরিবেশ সহনীয় নতুন জাত উদ্ভাবন করছেন, যেগুলো এ দেশের কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কৃষি উৎপাদনের এই অগ্রগতি গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনেছে। কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। উৎপাদন বৈচিত্র্য বেড়েছে, সেই সাথে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। একই সাথে বেড়েছে পুঁজির ব্যবহার। মাছ, মুরগি ও ডিম উৎপাদন প্রায় শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের চাহিদা গ্রামীণ জনজীবনে দ্রুতই বেড়ে চলেছে।
কাজ : শিক্ষার্থীরা অভিনয়ের মাধ্যমে কৃষির আধুনিকায়ন আমাদের জীবনধারার কী পরিবর্তন এনেছে তা ব্যক্ত করবে। |
আরও দেখুন...