তৃতীয় অধ্যায়
শীল
শীল কুশল ধর্মের আধার বা প্রতিষ্ঠাভূমি। কারণ শীলের মধ্যে সমস্ত কুশল ধর্ম প্রতিষ্ঠা বা আশ্রয় লাভ করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। শীল কায়িক, বাচনিক এবং মানসিক কর্মকে পরিশীলিত করে। শীল পালনে মনের পরিদাহ নির্বাপিত হয়ে শীতল হয়। তাই এসব আচরণীয় নিয়ম বা বিধি- বিধানকে শীল বলে । শীলের দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহ দমিত হয় বলে শীলের অপর নাম 'দমগুণ' । নৈতিক ও সুন্দর চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে শীল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কারণে শীল শব্দের অর্থ করা হয়েছে চরিত্র। বৌদ্ধধর্মে গৃহী, শ্রমণ এবং ভিক্ষুদের প্রতিপালনীয় ভিন্ন ভিন্ন শীল রয়েছে। যেমন : পঞ্চশীল, অষ্টশীল, দশশীল এবং প্রাতিমোক্ষশীল। এ অধ্যায়ে আমরা দশশীল সম্পর্কে পড়ব। দশশীল প্রব্রজ্যাধারী শ্রমণদের পালনীয়। তাই দশশীলকে শ্রামণ্যশীলও বলা হয়। দশশীলে শ্রমণদের পালনীয় দশটি নিয়ম বা বিধি-বিধান রয়েছে।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
* দশশীল সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব
* বাংলা অর্থসহ পালি ভাষায় দশশীল বলতে পারব।
* দশশীলের গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারব
* দশশীলের আবশ্যকতা ব্যাখ্যা করতে পারব।
* দুঃশীলতার ফল বর্ণনা করতে পারব।
পাঠ ১ শ্রমণদের পালনীয় শীল
সিদ্ধার্থ গৌতম দুঃখমুক্তির পথ অন্বেষণের জন্য রাজপ্রাসাদের রাজকীয় ভোগ-বিলাস, পিতা-মাতা, স্ত্রী- পুত্র এবং রাজ সিংহাসনের মায়া ত্যাগ করে সন্ন্যাস জীবন অবলম্বন করেন। সুদীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনায় তিনি আবিষ্কার করেন দুঃখ থেকে মুক্তির পথ- আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এ মার্গ অনুসরণকারী নির্বাণ লাভ করেন। তাই এ মার্গ দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আদর্শ মার্গ বা উত্তম পথ। সঠিকভাবে এ মার্গ অনুসরণ করার জন্য প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে হয়। প্রব্রজ্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে। যিনি পাপমল পরিহার করেন, তিনি প্রব্রজিত নামে কথিত হন। সকল প্রকার পাপ পরিহার করার জন্য সংসার ত্যাগ করে অনাগারিক জীবনগ্রহণ করাকে প্রব্রজ্যা বলে। সংসার একটি আবর্ত বিশেষ। এ আবর্তে পতিত হলে মানুষের পক্ষে নিষ্কৃতি লাভ করা অতীব দুস্কর। গৃহজীবনে সর্বদা নানা রকম ঝামেলা এবং বৈষয়িক চিন্তায় বিভোর থাকতে হয়। প্রব্রজ্যা জীবন ঝামেলা ও কামনা বাসনা মুক্ত। তাই বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
প্রব্রজ্যা সম্পর্কে বুদ্ধ বলেছেন, সম্বাধো ঘরবাসো অনুভোকানো পান অর্থাৎ গৃহবাস ঝামেলাপূর্ণ, প্রব্রজ্যা আকাশের ন্যায় উন্মুক্ত। প্রব্রজ্যা জীবন দুটি প্রধান ধাপে বিভক্ত। যেমন : ভ্রমণ এ ভিক্ষু । প্রব্রজ্যা জীবনের প্রথম ধাপ বা শিক্ষানবিশ জীবন পালনকারীকে শ্রমণ বলা হয়। দশশীল প্রমপদের জন্য নিত্য পালনীয়। দশশীল বিশুদ্ধ ও অনাসক্ত জীবন এবং পাপযুক্ত সুন্দর চরিত্র গঠনে সহায়ক বলে দশশীলকে সুচরিত শীলও বলে। শ্রামণ্য জীবনের উচ্চতর স্তর হচ্ছে ভিক্ষু জীবন। ভিক্ষু জীবন প্রব্রজ্যা জীবনের দ্বিতীয় ধাপ। ভিক্ষুদের ২২৭টি শীল বা প্রাপ্তিমোক্ষ শীল পালন করতে হয়। সাধারণত, প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে শ্রমণ হওয়ার জন্য কমপক্ষে সাত বছর বয়স হওয়া বাঞ্চনীয়। বলা হয়ে থাকে যে, কাক ভাড়াতে সক্ষম যে কেউ প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে ভ্রমণ হতে পারে। বাংলাদেশের বৌদ্ধরা সপ্তাহকালের জন্য হলেও প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে শ্রামণ্য জীবন পালন করে। অপরদিকে ভিক্ষু হতে হলে বিশ বছর বয়স হতে হয়। তবে ভিক্ষু হওয়ার আগে কিছুদিনের জন্য হলেও প্রাযণ্য জীবন পালন করতে হয়।
প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করছেন
অনুশীলনমূলক কাজ
প্রব্রজ্যা জীবন কয়টি ধাপে বিভক্ত ও কি কি? প্রব্রজ্যা সম্পর্কে বুদ্ধ কী বলেছেন? দশশীলকে কেন সুচরিত শীল বলা হয়।
শীन
২৩
পাঠ : ২
দশশীল প্রার্থনা (পালি ও বাংলা)
ওকাস অহং ভন্তে তিসরণেন সদ্ধিং পজ্জা দসসীলং ধম্মং যাচামি,
অনুগ্নহং কত্বা সীলং দেখ মে ভন্তে।
দুতিযম্পি অহং ভস্তে তিসরণেন সন্ধিং পবা দসসীলং ধম্মং যাচামি,
অনুগ্রহং কত্বা সীলং দেখ মে ভন্তে ।
ততিযম্পি অহং ভন্তে তিসরণেন সন্ধিং পবা দসসীলং ধম্মং যাচামি,
অনুগ্রহং কত্বা সীলং দেখ মে ভন্তে।
শেখার কৌশল
একজন প্রার্থনা করলে 'অহং' এবং সমবেতভাবে করলে 'মযং'
একজনে করলে 'যাচামি' সমবেতভাবে করলে 'যাচাম' একজনে করলে 'মে' সমবেতভাবে করলে 'নো' বলতে হবে।
বাংলা অনুবাদ :
ভিন্তে অবকাশ পূর্বক সম্মতি প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ প্রব্রজ্যা দশশীল প্রার্থনা করছি। ভন্তে, দয়া করে আমাকে দশশীল প্রদান করুন।
দ্বিতীয়বার ভন্তে অবকাশ পূর্বক সম্মতি প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ প্রব্রজ্যা দশশীল প্রার্থনা করছি।
ভন্তে, দয়া করে আমাকে দশশীল প্রদান করুন ।
তৃতীয়বার ভন্তে অবকাশ পূর্বক সম্মতি প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ প্রব্রজ্যা দশশীল প্রার্থনা করছি।
ভন্তে, দয়া করে আমাকে দশশীল প্রদান করুন ।
দশশীল (পালি)
১. পাণাতিপাতা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিয়ামি ।
২. অদিন্নাদানা বেরমণী সিথাপদং সমাদিয়ামি ।
৩. অব্রহ্মচরিয়া বেরমণী সিদ্ধাপদং সমাদিয়ামি ।
৪. মুসাবাদা বেরমণী সিথাপদং সমাদিয়ামি।
৫. সুরা-মেরে-মজ্জ পমাদঠানা বেরমণী সিখাপদং সমাদিয়ামি।
28
বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
৬. বিকালভোজনা বেরমণী সিদ্ধাপদং সমাদিযামি।
৭. নচ্চ-গীত-বাদিত- বিসুদ সন বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিয়ামি
৮. মালা-গন্ধ-বিলেপন-ধারণ মন্ডন বিসনঠানা বেরমণী সিখাপদং সমাদিয়ামি ।
৯. উচ্চসयনা মহাসযনা বেরমণী সিখাপদং সমাদিয়ামি।
১০. জাতরূপ-রজতং পটিয়হনা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিয়ামি।
দশশীল (বাংলা)
১. প্রাণিহত্যা থেকে বিরত থাকব- এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
২. অদত্তবস্তু গ্রহণ (চুরি) করা থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। -
৩. অব্রহ্মচর্য থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৪. মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৫. সুরা এবং মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৬. বিকাল বেলা ভোজন থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৭. নাচ-গান-বাদ্যযন্ত্রের উৎসব দর্শন করা থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৮. মালাধারণ, সুগন্ধিদ্রব্যের প্রলেপ, অলঙ্কার গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ - করছি।
৯. উচ্চশয্যা ও মহাশয্যা (অত্যন্ত আরামদায়ক শয্যা) থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
১০. সোনা-রূপা বা মুদ্রা আদান-প্রদান ও গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি ।
শব্দার্থ
পবা প্রব্রজ্যা, ধম্মং - অনুগ্রহ করে, বেরমণী- - - ধর্ম, ভিসরণেন ত্রিশরণসহ, কত্ত্বা করে, অনুগ্রহং করা বিরত থাকা, সীলং শীল, সিক্খাপদং শিক্ষাপদ, মুসাবাদা - মিথ্যাভাষণ, অদিন্নাদানা - অদত্তবস্তু (চুরি করা বা যা দেয়া হয়নি), নচ্চ নাচ, গীতবাদিত গান বাজনা, বিলেপন প্রলেপ, উচ্চসয়না -উঁচুশয়ন, জাতরূপ রজতং সোনারুপা, পটিয়াহনা- প্রতিগ্রহণ
28
বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
৬. বিকালভোজনা বেরমণী সিদ্ধাপদং সমাদিযামি।
৭. নচ্চ-গীত-বাদিত- বিসুদ সন বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিয়ামি
৮. মালা-গন্ধ-বিলেপন-ধারণ মন্ডন বিসনঠানা বেরমণী সিখাপদং সমাদিয়ামি ।
৯. উচ্চসयনা মহাসযনা বেরমণী সিখাপদং সমাদিয়ামি।
১০. জাতরূপ-রজতং পটিয়হনা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিয়ামি।
দশশীল (বাংলা)
১. প্রাণিহত্যা থেকে বিরত থাকব- এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
২. অদত্তবস্তু গ্রহণ (চুরি) করা থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। -
৩. অব্রহ্মচর্য থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৪. মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৫. সুরা এবং মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৬. বিকাল বেলা ভোজন থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৭. নাচ-গান-বাদ্যযন্ত্রের উৎসব দর্শন করা থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৮. মালাধারণ, সুগন্ধিদ্রব্যের প্রলেপ, অলঙ্কার গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ - করছি।
৯. উচ্চশয্যা ও মহাশয্যা (অত্যন্ত আরামদায়ক শয্যা) থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
১০. সোনা-রূপা বা মুদ্রা আদান-প্রদান ও গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি ।
শব্দার্থ
পবা প্রব্রজ্যা, ধম্মং - অনুগ্রহ করে, বেরমণী- - - ধর্ম, ভিসরণেন ত্রিশরণসহ, কত্ত্বা করে, অনুগ্রহং করা বিরত থাকা, সীলং শীল, সিক্খাপদং শিক্ষাপদ, মুসাবাদা - মিথ্যাভাষণ, অদিন্নাদানা - অদত্তবস্তু (চুরি করা বা যা দেয়া হয়নি), নচ্চ নাচ, গীতবাদিত গান বাজনা, বিলেপন প্রলেপ, উচ্চসয়না -উঁচুশয়ন, জাতরূপ রজতং সোনারুপা, পটিয়াহনা- প্রতিগ্রহণ -
শীল
২৫
পাঠ : : ৩
দশশীল পালনকারীর করণীয়
দশশীল পালনকারীকে চীবর প্রত্যবেক্ষণ, পিণ্ডপাত প্রত্যবেক্ষণ, শয্যাসন প্রত্যবেক্ষণ ও গিলান (ঔষধ) প্রত্যয় প্রত্যবেক্ষণ - এই চার প্রকার প্রত্যবেক্ষণ বা পর্যবেক্ষণ ভাবনা করতে হয়। এ প্রত্যবেক্ষণ ভাবনা দশশীল পালনকারী শ্রমণের অবশ্য করণীয়।
চীবর প্রত্যবেক্ষণ
চীবর পরিধানকারী শ্রমণকে চীবর পরিধানের কারণ চিন্তা বা ভাবনা করতে হবে। চীবর পরিধানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি এরূপ চিন্তা করেন : আমি অর্থ সংযুক্ত জ্ঞানে এ চীবর পরিধান করছি। চীবর ব্যবহারে চিত্ত সংযত ও সমাহিত হয়। চীবর পরিধানে শীত, তাপ, ধূলাবালি, মশা-মাছির কামড়, সরীসৃপ ও অন্যান্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। চীবর পরিধানে লজ্জা নিবারণ হয়। উপরোক্ত কারণেই চীবর পরিধান করছি। বিলাসিতা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নয় ।
পিণ্ডপাত প্রত্যবেক্ষণ
ভিক্ষু-শ্রমণগণের ভিক্ষা পাত্রে খাদ্য-ভোজ্য-লেহ্য-পেয় যা কিছু পিণ্ডাকারে সংগৃহীত হয় তাই পিত্তপাত। শ্রমণগণ পিণ্ডপাত সম্পর্কে এরূপ চিন্তা বা ভাবনা করেন ভিক্ষা লব্ধ আহার আমি অর্থ সংযুক্ত জ্ঞানে অবহিত হয়ে ভৈষজ্যবৎ (ঔষধের ন্যায়) অর্থাৎ জীবন ধারণের প্রয়োজনে গ্রহণ করছি। তা খেলাধুলা, আমোদ-প্রমোদ বা কোনোরূপ শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়। আমার এই আহার গ্রহণ ক্ষুধা ও রোগ নিবারণের জন্য। এ পরিমিত আহার বুদ্ধ প্রদর্শিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা মধ্যম পথ অনুশীলনের জন্য গ্রহণ করছি।
শয্যাসন প্রত্যবেক্ষণ
শ্রমণগণ শয্যাসন সম্পর্কে এরূপ চিন্তা বা ভাবনা করেন: আমি অর্থ সংযুক্ত জ্ঞানে অবহিত হয়ে শয্যা এবং আসন গ্রহণ করছি। শীত ও উষ্ণতা নিবারণ, মশা-মাছির দংশন, বায়ু, রৌদ্র, সরীসৃপ ও ঋতুজনিত নানা উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই শয্যাসন গ্রহণ করছি। কর্মস্থান ভাবনা ও একাগ্রতা সাধনার জন্য এ শয্যাসন গ্রহণ করছি। শুধু আলস্য বা নিদ্রা যাপন করে বৃথা সময় ক্ষেপণের জন্য নয় ।
গিলান প্রত্যয় প্রত্যবেক্ষণ
শ্রমণগণ গিলান প্রত্যয় প্রত্যবেক্ষণ সম্পর্কে এরূপ চিন্তা বা ভাবনা করেন : আমি অর্থ সংযুক্ত জ্ঞানে অবহিত হয়ে রোগ উপশমের জন্য গিলান বা ঔষধ সেবন করি। নানা রকম দুঃখ দায়ক বেদনাসমূহ থেকে নিরাময় হওয়ার জন্য ঔষধ সেবন করি। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ঔষধ সেবন করি না।
বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
অনুশীলনমূলক কাজ
দশশীল পালনকারীকে কি কি ভাবনা করতে হয়? ব্যাখ্যা করো।
পাঠ : 8
দশশীলের গুরুত্ব
চারিত্রিক শুদ্ধতাই ধর্ম চর্চার মূল ভিত্তি। শীলের লক্ষ্য হচ্ছে পাপের পঙ্কিল পথ পরিহার করে এবং পাপমূলে কুঠারাঘাত করে মানুষের চরিত্রকে সংযত, শুদ্ধ ও সুন্দর করা। তাই শীলকে মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থে শীল সম্পর্কে এরূপ উল্লেখ আছে : পাহাড়, পর্বত, বৃক্ষলতা প্রভৃতি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বৃদ্ধি ও বিপুলতা লাভ করে তেমনি সাধকগণ শীলকে আশ্রয় করে এবং শীলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভাবনা করে থাকেন। মহাপরিনির্বাণ সূত্রে বর্ণিত আছে যে, 'শীলের দ্বারা সমাধি বৃদ্ধি পায়। সমাধির দ্বারা প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পায়। প্রজ্ঞা পূর্ণ চিত্ত কামাসব, ভাসব ও অবিদ্যাসব থেকে মুক্তি লাভ করে।' আসবমুক্ত চিত্ত চির প্রশান্তি লাভ করে। এ কারণে তথাগত বুদ্ধ মানব কল্যাণে শীলের গুরুত্ব উপলব্ধি করে শীল পালনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং শীল লঙ্ঘনকে মহাপাপ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, দুঃশীল ব্যক্তির শতবর্ষের জীবন অপেক্ষা শীলবান ব্যক্তির একদিনের জীবন শ্রেয়ঃ । শীল পালনের সুফল অনেক। যেমন : শীলবান ব্যক্তির মহাভোগ সম্পত্তি লাভ হয়। তিনি সর্বত্র প্রশংসিত হন, সর্বত্র নিঃসঙ্কোচে উপস্থিত হন, সজ্ঞানে দেহ ত্যাগ করেন এবং মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভ করেন। এসব কারণ বিবেচনা করে বলা যায়, শীল পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে দশশীলের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো :
১. হিংসা, ক্রোধ ও ভোগস্পৃহার কারণে আঘাত এবং হত্যা করা হয়। দশশীলের প্রথম শীলটি এসব অমানবিক প্রবৃত্তি দূর করে এবং সর্বপ্রাণীর প্রতি মৈত্রীভাবাপন্ন করে তোলে ।
২. লোভ, মোহ ও তৃষ্ণা বশত মানুষ অদত্ত বস্তু গ্রহণ করে। দ্বিতীয় শীলটি এ অশুভ মনোবৃত্তিসমূহ দূর করে এবং নিজের পরিশ্রম লব্ধ বস্তু ভোগ করতে উদ্বুদ্ধ করে ।
৩. অসংযত ইন্দ্রিয় বা কাম লালসার কারণে মানুষ অব্রহ্মচর্য আচরণ করে। তৃতীয় শীলটি ইন্দ্রিয় দমন করে অনৈতিক কামাচার পরিত্যাগ করতে এবং বুদ্ধ নির্দেশিত ব্রহ্মচর্য পালনে
উৎসাহী করে। ৪. মিথ্যা, কটু, অসারকথা প্রভৃতি ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি করে এবং মানুষকে দুঃখ দেয় । পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য নষ্ট করে। চতুর্থ শীল এসব থেকে বিরত রেখে সত্য, সংযত ও সারযুক্ত
কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করে।
শীল
৫. মাদকদ্রব্য মানুষের স্মৃতি এবং হিতাহিত জ্ঞান নষ্ট করে। মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। শ্রামণ্য জীবনের পরিপন্থী অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ করে। পঞ্চমশীল এসব কু-অভ্যাস পরিত্যাগ করে সুস্থ ও স্মৃতিময় জীবনযাপনে সহায়তা করে ।
অপরিমিত ভোজন ইন্দ্রিয়কে অসংযত ও উত্তেজিত রাখে। ইন্দ্রিয় লিপ্সা মানুষকে অনৈতিক কামাচার ও অতিরিক্ত ভোগ স্পৃহায় প্রলুব্ধ করে। ষষ্ঠ শীল ইন্দ্রিয় দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংযত জীবনযাপন এবং ধ্যান-সমাধিতে অধিক মনোনিবেশ করতে প্রেরণা যোগায় । তাছাড়া অভুক্ত মানুষের ক্ষুধার জ্বালা-যন্ত্রণা বুঝতে ও তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শিক্ষা দেয় ।
৭. নৃত্য-গীত-বাদ্য প্রভৃতি বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড মানুষের মনকে বিক্ষিপ্ত করে। ভোগ- লালসা ও কামোদ্দীপক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে। দায়িত্ব ও কর্তব্য হতে বিচ্যুত করে। সপ্তম শীল শান্ত- সংযত জীবন গঠনে ভূমিকা রাখে ।
৮. মাল্যধারণ, সুগন্ধ প্রসাধনী লেপন ও নানা রকম গহনা পরিধান ভোগ-বিলাসের প্রতি আসক্ত করে তোলে। ভোগ-বিলাস ব্রহ্মচর্য আচরণের পথে বড় অন্তরায়। অষ্টম শীল ভোগ- বিলাসের আসক্তি বিদূরিত করে ব্রহ্মচর্য পালনের জন্য উপযুক্ত করে তোলে।
৯. বিলাসবহুল শয়নাসন মানুষকে আরামপ্রিয়, অলস ও উদ্যম হীন করে তোলে। নির্বাণ লাভের জন্য উদ্যম বা সম্যক প্রচেষ্টা অপরিহার্য। নবম শীল অলসতা ও আরামপ্রিয়তা দূর করে উদ্যমশীল করে তোলে।
১০. কথায় বলে অর্থ অনর্থের মূল। স্বর্ণ-রৌপ্য অর্থ সম্পদ মানুষের তৃষ্ণা বর্ধিত করে। তৃষ্ণা
দুঃখের মূল কারণ। দশম শীল তৃষ্ণা ক্ষয় করে এবং দুঃখ মুক্ত করে পরম শান্তি নির্বাণের পথে
উপনীত করে । মানবতা ও নৈতিকতার সব বৈশিষ্ট্য দশশীলের মধ্যে নিহিত আছে। ফলে দশশীলের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা সহজে বোধগম্য।
পাঠ : ৫ দুঃশীলতার ফল
যাঁরা শীল পালন করেন তাঁদের শীলবান বলা হয়। অপরদিকে যারা শীল পালন করে না তাদের দুঃশীল বলা হয়। দুঃশীল ব্যক্তি দুশ্চরিত্রের অধিকারী হয়। তারা সর্বদা পাপকর্মে লিপ্ত থাকে। বিবেকবোধ হারিয়ে ফেলে। ফলে ভালো-মন্দ বিচার করতে পারে না। পরিবার ও সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে শান্তি বিনষ্ট করে। তারা নিজের এবং অপরের ক্ষতি সাধন করে। নিচে দুঃশীলতার কতিপয় ফল তুলে ধরা হলো:
১. দুঃশীল ব্যক্তি প্রমাদের বা অলসতার বশবর্তী হয়ে স্বীয় সম্পত্তি বিনষ্ট করে।
২. অকুশল কাজের জন্য তারা সর্বত্র নিন্দিত হয় ।
৩. সভা সমাবেশে সংকোচ বোধ করে এবং মৌন থাকে।
৪. মোহাবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
৫. মৃত্যুর পর দুর্গতি প্রাপ্ত হয় ।
এসব কারণ বিবেচনা করে দুঃশীলতা পরিহার করে সকলের শীল পালন করা উচিত ।
অনুশীলনমূলক কাজ
আরো পাঁচটি দুঃশীলতার ফল বলো।
আরও দেখুন...