হিন্দুধর্মে সহাবস্থান
সকল ধর্মের মানুষের সাথে সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস হিন্দুধর্মের প্রধান ভাবনাগুলোর একটি। হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ গীতা'য় ফলের আশা না করে সকলের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। হিন্দুধর্মে সৃষ্টির সকল মানুষের মঙ্গলের জন্য ভালোবাসা নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যেতে বলা হয়েছে।
হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ এ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের কল্যাণ, অপরের সাথে সম্প্রীতি নিয়ে সহাবস্থানের বিষয়ে চমৎকার কিছু বাণী আছে। স্থানী অরুণানন্দ সম্পাদিত পরম পবিত্র বেদসার সংগ্রহ থেকে কয়েকটি বাণী নিচে দেওয়া হলো:
মনুষ্যের মধ্যে কেহ বড় নয় বা কেহ ছোট নয়। ইহারা ভাই ভাই।
হে জ্যোতিঃ স্বরূপ! তুমি মানব সমাজের শক্তিপুঞ্জের সহিত অবস্থান কর এবং তুমিই যজমানের কর্মফল প্রদান কর। তুমি সকলেরই হিতকারী বন্ধু।
(সামবেদ পূর্বাচিক, ১/১/২)
হে দুঃখনাশক পরমাত্মন। আমাকে সুখের সহিত বর্জন কর। সব প্রাণী আমাকে মিত্রের দৃষ্টিতে দেখুক। আমি সব প্রাণীকে যেন মিত্রের দৃষ্টিতে দেখি। আমরা একে অন্যকে মিত্রের দৃষ্টিতে দেখিব।
(যজুর্বেদ, ৩৬/১৮)
হিন্দুধর্মের বিভিন্ন যুগের মহাত্মা মহাপুরুষেরা এই সম্প্রীতিরই জয়গান গেয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস অন্য ধর্মের আরাধনা পদ্ধতিকেও গভীরভাবে জানার চেষ্টা করেন। রামকৃষ্ণের মতে এই বিভিন্ন ধর্মের সাধনা ঈশ্বরকে উপলব্ধি করারই নামান্তর। তিনি বলেছিলেন সকল ধর্মের উদ্দেশ্য ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা, বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন পথে হাঁটলেও সকল ধর্মই স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করতে চায়। তাঁর বিখ্যাত বাণী হলো, 'সকল ধর্মই সত্য, যত মত তত পথ', অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মের মত ও পথ ভিন্ন হলেও তাদের উদ্দেশ্য ও গন্তব্য এক বা অভিন্ন।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় বলেছিলেন, "I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration but we accept all religions as true" যা বাংলায় লিখলে দাঁড়ায় এরকম: “আমি গর্বিত যে আমি এমন একটি ধর্মের যা বিশ্বকে সহনশীলতা এবং সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা শিখিয়েছে। আমরা কেবল সর্বজনীন সহনশীলতায় বিশ্বাস করি না, আমরা সকল ধর্মকেই সত্য বলে মেনে নিই।”
১৮১২ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষের গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা হরিচাঁদ ঠাকুর হিন্দুধর্মে সম্প্রীতি-সহাবস্থানের আরেকটি উজ্জ্বল নাম। তিনি মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রবর্তক ছিলেন। তার প্রচলিত সাধন পদ্ধতিকে বলা হয় মতুয়াবাদ। মতুয়াবাদ সত্য, প্রেম ও পবিত্রতা এই তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ মতবাদে সকল মানুষ সমান; জাতিভেদ বা সম্প্রদায়ভের মতুয়াবাদে স্বীকৃত নয়। হরিচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পরে তার পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়েছিলেন। এখন অবধি সেই ঐক্যের আলোয় ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকায় যে মেলার আয়োজন হয় তাতে অংশগ্রহণ করে এবং উৎসবে মেতে ওঠে।
হরিচাদ ঠাকুর যে বারোটি উপদেশ সকলের জন্য রেখে গিয়েছেন তা 'দ্বাদশ আজ্ঞা' নামে পরিচিত। এই দ্বাদশ আমার পঞ্চম আজ্ঞায় হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন, "সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে।" আর ষষ্ঠ আজ্ঞায় বলেছেন, “জাতিভেদ করবে না।”
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংঘজননী সারদা দেবীও সহাবস্থানের তাৎপর্য মনে করিয়ে দিয়েছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তার বলা শেষ বাণী ছিল, যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেষ। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার।"
হিন্দুধর্মের প্রধান গ্রন্থসমূহ এবং মহাত্মা মহাপুরুষদের বাণী থেকে আমরা বুঝতে পারি হিন্দুধর্ম মানুষে মানুষে একসাথে সশ্রদ্ধ ভালোবাসা নিয়ে সহাবস্থানের কথা বলে। হিন্দুধর্ম দল-মত নির্বিশেষে সবার কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার কথা বলে। অন্যান্য ধর্মেও এই সহাবস্থানের কথা বারবার বলা হয়েছে। তোমার শিক্ষক এবং বন্ধুদের কাছ থেকে তুমি আরও অনেক কিছু জানতে পারবে।
আরও দেখুন...