পূর্বের শ্রেণিগুলোতে আমরা সাক্রামেন্ত সম্বন্ধে অল্প পরিসরে ধারণা পেয়েছি। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে আমরা সাতটি সাক্রামেন্তের নাম জেনেছি। তৃতীয় শ্রেণিতে আমরা দীক্ষাস্নান-এর বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জেনেছি। চতুর্থ শ্রেণিতে পাপ স্বীকার, হস্তার্পণ ও খ্রিষ্টপ্রসাদ-এর বিষয়ে অনেক কিছু শিখেছি।এ পর্যায়ে আমরা রোগীলেপন, যাজকবরণ এবং বিবাহ সাক্রামেন্ত সম্বন্ধে একটু বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করব।
রোগীদের জন্য মণ্ডলীর রয়েছে বিশেষ সহানুভূতি, প্রার্থনা, সমর্থন, ভালোবাসা ও যত্ন। এই বিশেষ সহানুভূতি থেকেই রোগীদের জন্য মণ্ডলী রোগীলেপন সাক্রামেন্তের ব্যবস্থা করেছেন। যেন এই সাক্রামেন্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে রোগীরা তাদের জীবনে ঈশ্বরের কৃপা ও আশীর্বাদ লাভ করতে পারে। এই সাক্রামেন্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা যেন মনের সাহস ও সান্ত্বনা পেতে পারে। সর্বোপরি তারা যেন এই সাক্রামেন্ত গ্রহণের ফলে রোগযন্ত্রণা থেকে পূর্ণভাবে নিরাময় লাভ করতে পারে। রোগীলেপন সাক্রামেন্তটি অন্তিমলেপন সাক্রামেন্ত বা নিরাময়কারী সাক্রামেন্ত নামেও আমাদের কাছে পরিচিত।
রোগীলেপন তেল রোগীদের কপালে ও হাতে লেপন করা হয় এবং সেইসঙ্গে প্রার্থনা করে বলা হয় “এই মুদ্রাঙ্কনে চিহ্নিত হয়ে পরমেশ্বরের মহাদান স্বয়ং পবিত্র আত্মাকে গ্রহণ কর।” খ্রিষ্ট হলেন আরোগ্যদাতা। তিনি রোগাক্রান্ত মানুষের যত্ন নিয়েছেন ও সুস্থ করেছেন। যীশু রোগীদের নিরাময় করার জন্য বিভিন্ন বাস্তব চিহ্নের আশ্রয় নিয়েছেন : যেমন থুথু, হস্তস্থাপন, কাদা ও পরে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা ইত্যাদি। এসব চিহ্নের মাধ্যমে যীশু রোগীদের সুস্থ করেছেন। যীশু রোগীদের সুস্থ করার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত মণ্ডলীর উপর। অসুস্থদের জন্য খ্রিষ্টমণ্ডলীর নিজস্ব ধর্মীয় রীতি আছে যা আমরা সাধু যাকোবের ধর্মপত্রে পাই। সাধু যাকোব বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে রোগপীড়িত,সে মণ্ডলীর প্রবীণদের (যাজকদের) ডাকুক; এবং তাঁরা তার গায়ে তেল মেখে দেবার পর প্রভুর নামে প্রার্থনা করুন। প্রভু তাকে সুস্থ করে তুলবেন; আর সে যদি কোনো পাপ করে থাকে, তার সেই পাপের মোচন হবে।”(যাকোব ৫:১৪-১৫) তেল হচ্ছে প্রাচুর্য ও আনন্দের চিহ্ন। স্নানের আগে ও পরে গায়ে তেল মেখে মানুষ পরিশুদ্ধ হয়। শিশুদের গায়ে আগে তেল মেখে স্নান করানো হয় যেন সহজে ঠান্ডা না লাগে। তেল হলো নিরাময়, সৌন্দৰ্য, স্বাস্থ্য ও শক্তির উৎস। অন্যদিকে তেললেপনের মাধ্যমে রোগীরা আধ্যাত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, নিরাময় ও আরাম পেয়ে থাকে।
প্রাচীনকাল থেকেই মণ্ডলীর উপাসনা ঐতিহ্যে পবিত্র তেল দ্বারা রোগীদের লেপন করার প্রথা প্রচলিত আছে। বহু শতাব্দী ধরে রোগীদের তেললেপন দেওয়া হতো শুধুমাত্র তাদেরকেই যারা মরণাপন্ন অবস্থায় ছিল। এ কারণেই সাক্রামেন্তটি ‘অন্তিমলেপন’ নাম পেয়েছে। তবে রোগীলেপন সাক্রামেন্তটি যারা মরণাপন্ন শুধু তাদের জন্যই নয়। তাই ভক্তদের মধ্যে যদি কেউ রোগ বা বার্ধক্যের কারণে খুব বেশি অসুস্থ বোধ করে, তাহলে তাকেও এই সাক্রামেন্ত প্রদান করা যেতে পারে। এই সাক্রামেন্তের পূর্বে পাপ স্বীকার ও খ্রিষ্টপ্রসাদ দেওয়া যেতে পারে।
এ সাক্রামেন্ত গ্রহণের ফলে আমরা পবিত্র আত্মার অনুগ্রহ, গুরুতর অসুস্থতা অথবা বৃদ্ধ অবস্থার দুর্বলতায় যেসকল সমস্যার উদ্ভব হয় তা জয় করার জন্য শক্তি, শান্তি ও সাহস লাভ করি। পবিত্র আত্মার শক্তিতে প্রভুর নিকট থেকে এই সহায়তা অসুস্থ ব্যক্তির আত্মাকে সুস্থতা দান করে, এমনকি ঈশ্বরের ইচ্ছা হলে দেহের আরোগ্যও এনে দেয়। তদুপরি, “সে যদি কোনো পাপ করে থাকে, তার সেই পাপের মোচন হবে”।
ঈশ্বর মনোনীত জাতিকে “যাজকদের রাজ্য ও এক পবিত্র জনগণ” রূপে গঠন করেছেন। কিন্তু ইস্রায়েল জাতির বারোটি গোষ্ঠীর একটিকে অর্থাৎ লেবি গোষ্ঠীকে ঈশ্বর বেছে নেন এবং উপাসনা অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করার জন্য তাদেরকে আলাদা করে রাখেন। ঈশ্বর নিজেই তাদের উত্তরাধিকার।
পুরাতন নিয়মে যাজকত্বের আরম্ভ একটি বিশেষ অনুষ্ঠান- রীতির দ্বারা সম্পাদিত হতো। যাজক মানুষদের পক্ষে ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থাপনের জন্যই নিযুক্ত করা হয়, যেন তিনি পাপের জন্য অর্ঘ্য ও বলি উৎসর্গ করেন। ঐশবাণী ঘোষণার এবং যজ্ঞবলি ও প্রার্থনার দ্বারা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুরাতন নিয়মে যাজকত্ব স্থাপিত হয়েছে। তথাপি সেই যাজকত্ব পরিত্রাণ আনয়নে অক্ষম। সেখানে যাজকের বারংবার যজ্ঞবলি উৎসর্গ করতে হয় এবং নির্দিষ্ট পবিত্রতা অর্জনে তা ব্যর্থ। একমাত্র খ্রিষ্টের যজ্ঞবলিই তা সম্পন্ন করতে পারে। মহাযাজক ও অনন্য মধ্যস্থতাকারী খ্রিষ্টমণ্ডলীকে করে তুলেছেন রাজ্য, তাঁর আপন ঈশ্বর ও পিতার উদ্দেশ্যে যাজক। বিশ্বাসীদের গোটা সমাজই সত্যিকারে যাজক। সকল খ্রিষ্টবিশ্বাসী তাদের নিজ নিজ আহ্বান অনুসারে, খ্রিষ্টের যাজকীয়, প্রাবক্তিক ও রাজকীয় প্রেরণ দায়িত্বে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দীক্ষাস্নানের যাজকত্ব অনুশীলন করেন।
বিবাহ সাক্রামেন্তের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারী নিজেদের মধ্যে জীবনের সামগ্রিক অংশীদারিত্ব স্থাপন করে। তারা তাদের ভালোবাসার ফল হিসাবে সন্তানের জন্মদান ও খ্রিষ্টীয় শিক্ষাদীক্ষায় ভালো মানুষ করে গড়ে তোলার আহ্বান লাভ করে। এই সাক্রামেন্তের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে এক পবিত্র ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধন বা সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আমরা জানি যে, ঈশ্বর আমাদেরকে তাঁর নিজের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছেন। তাই তিনিই মানুষকে ভালোবাসার আহ্বান জানান। এটিই হলো প্রতিটি মানুষের মৌলিক ও জন্মগত আহ্বান। কারণ ঈশ্বর যিনি নিজেই ভালোবাসা, তিনি তাঁর সাদৃশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু ঈশ্বর মানুষকে পুরুষ ও নারী করেই সৃষ্টি করেছেন, তাই তাদের পারষ্পরিক ভালোবাসা ঈশ্বরের অসীম ও চিরস্থায়ী ভালোবাসারই প্রতিচ্ছবি। আর এ-ভালোবাসায় ঈশ্বর মানুষকে আহ্বান জানান। তোমরা ফলবান হও, বংশ বৃদ্ধি কর, পৃথিবী ভরিয়ে তোলো। সেজন্যই ঈশ্বরের এই সৃষ্টিকাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন পুরুষ ও একজন নারী সঠিক, পবিত্র ও ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী বিবাহ সাক্রামেন্ত গ্রহণ করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আহ্বান পায়। যীশু নিজেই বলেছেন,“বিয়ের অর্থ হলো দুটি জীবনের অবিচ্ছেদ্য মিলন, যা স্মরণ করিয়ে দেয় আদিতে ঈশ্বরের পরিকল্পনা। তাই বিবাহ-ব্যবস্থায় জীবন ও প্রেমের যে ঘনিষ্ঠ মিলন রয়েছে তা স্বয়ং খ্রিষ্টের দ্বারাই স্থাপিত। তাই বিবাহবন্ধন হলো একটি পবিত্র বন্ধন। বিবাহ সাক্রামেন্ত গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই যথাযথ প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। প্রস্তুতিমূলক ক্লাসে তাদের ভালোমতো বোঝাতে হবে যে,এটি একটি সাক্রামেন্ত। এটি হলো একটি চিরন্তন ও শাশ্বত সন্ধি। এই সন্ধি কখনো ভেঙে যাবার নয়। কাথলিক মণ্ডলীতে একবার বিয়ের পর কেউই ইচ্ছা করলেই তা ভেঙে দিতে পারবে না। অর্থাৎ স্বামী তার স্ত্রীকে বা স্ত্রী তার স্বামীকে কোনোমতেই পরিত্যাগ করতে পারবে না। যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে তাদের মতামত যাচাই করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অর্থাৎ প্রার্থী যদি কোন কারণে বাবা-মা, বা অভিভাবকের চাপে বাধ্য হয়ে বিবাহ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে তাহলে এই বিয়ে অবশ্যই বাতিল করতে হবে। তাই বিয়ের আগে অবশ্যই প্রার্থীদের মতামত যাচাই করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার সম্মতির বিনিময়কে খ্রিষ্টমণ্ডলী বিবাহের অপরিহার্য উপাদানরূপে গণ্য করে। সম্মতি ছাড়া বিবাহের কোনো অস্তিত্ব নেই।"
একজন যাজক বা পরিসেবক বিবাহ সাক্রামেন্ত প্রদান করতে পারেন। তিনি খ্রিষ্টমণ্ডলীর নামে স্বামী-স্ত্রীর সম্মতি গ্রহণ করেন এবং মণ্ডলীর আশীর্বাদ প্রদান করেন। বিবাহিত জীবনে অবশ্যই স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের নিকট আজীবন বিশ্বস্ত থাকবে। বিবাহিত জীবনে অনেক সময় বিভিন্ন ছোটখাটো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুলবোঝাবুঝি, মনোমালিন্য, রাগ, মান-অভিমান ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। আর এগুলো হওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু যখনই এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তখনই সঙ্গে সঙ্গে পরস্পরের মধ্যে মিলন সাধন করতে হবে। বিবাহ সাক্রামেন্ত গ্রহণের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী ঈশ্বরের কাছ থেকে যে আশীর্বাদ ও অনুগ্রহ পায় তা সারা জীবন তাদের আলোকিত করে রাখে। এই অনুগ্রহ তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রধান পাথেয়।
সাক্রামেন্ত অনুসারে চলার উপায়
১। প্রভু যীশু খ্রিষ্টকে পূর্ণভাবে বিশ্বাস করা।
২। মণ্ডলীর নিয়মনীতি মেনে চলা।
৩। নিয়মিত ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করা।
৪। নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ও সাক্রামেন্তগুলো গ্রহণ করা।
৫। পবিত্র জীবন যাপন করা ও মন্দতার পথ ত্যাগ করা।
ক) রোগীলেপন সাক্রামেন্ত গ্রহণের ফলে একজন রোগী ঈশ্বরের বিশেষ কৃপা ও আশীর্বাদ লাভ করে। রোগী তার মনের শক্তি, সাহস ও সান্ত্বনা লাভ করে এবং নিজেকে ভালো মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করে তুলতে পারে।
খ) যাজকীয় জীবন হলো জীবনের একটি বিশেষ আহ্বান। এই সাক্রামেন্ত গ্রহণ করে যাজকগণ পৃথিবীতে অপর খ্রিষ্ট হয়ে খ্রিষ্টের কাজ চালিয়ে নিয়ে যান।
গ) বিবাহ ঈশ্বরের একটি বিশেষ আহ্বান। বিবাহ সাক্রামেন্তের জন্য প্রার্থীর সম্মতি যাচাই করা একান্তই আবশ্যক। এটি একটি চিরন্তন সন্ধি যা কখনো ভেঙে যাবে না।
ক) যীশু রোগীদের সুস্থ করার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন প্রতিষ্ঠিত ___ উপর ।
খ) রোগীলেপন সাক্রামেন্তের অপর নাম ___।
গ) যাজকত্ব ___ আনয়নে সক্ষম ।
ঘ) বিশপদের সেবাকর্মের দায়িত্ব অধীনস্থ শ্রেণির ___ উপর প্রদান করা হয়েছে।
ঙ) বিবাহ সাক্রামেন্ত গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই ___ প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে।
ক) তেল হচ্ছে প্রাচুর্য ও | ক) সত্যিকারে যাজক। |
খ) রোগীলেপন তেল | খ) প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছেন। |
গ) বিশ্বাসীদের গোটা সমাজই | গ) একটি পবিত্র বন্ধন ৷ |
ঘ) বিবাহবন্ধন হলো | ঘ) আনন্দের চিহ্ন। |
ঙ) ঈশ্বর আমাদেরকে তাঁর নিজের | ঙ) রোগীদের কপালে ও হাতে লেপন করা হয়। |
চ) মিলনের জন্য স্থাপিত হয়েছে। |
ক) কে রোগীলেপন সাক্রামেন্ত প্রদান করতে পারে?
খ) একজন যাজকের প্রধান কাজ কী?
গ) বিবাহ সাক্রামেন্ত গ্রহণের পূর্বে কোন জিনিসটি যাচাই করা আবশ্যক?
ঘ) বিবাহ সাক্রামেন্ত কারা প্রদান করতে পারে?
ক) রোগীলেপন সাক্রামেন্তের প্রধান কাজ কী ব্যাখ্যা কর।
খ) যাজকবরণ সাক্রামেন্তের গুরুত্ব বর্ণনা কর ।
গ) বিবাহ সাক্রামেন্ত সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?
আরও দেখুন...