সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মায় আর কটি লোক। শতকরা প্রায় নিরানব্বই জন মানুষকেই চেষ্টা করতে হয়, জয় করে নিতে হয় জগৎকে। বাঁচে সে লড়াই করে প্রতিকূলতার সঙ্গে। পলাতকের স্থান এই জগতে নেই। চেষ্টা ছাড়া আত্মপ্রতিষ্ঠা অসম্ভব। সুখ চেষ্টারই ফল—দেবতার দান নয়। কথায় আছে, ঈশ্বর তাকেই সাহায্য করেন যে নিজেকে সাহায্য করে। নির্ভীক সত্য সাধক, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী এবং পরমতসহিষ্ণু ব্যক্তিমাত্রই চেষ্টার মাধ্যমে তৈরি করে নিতে পারে নিজের পথ ।
১৯৬১ সালে আলজেরিয়ায় যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের ঢেউ তুঙ্গে, তখন রাজপথে প্রতিবাদকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ফরাসি পুলিশ—চালিয়েছিল নির্মম গণহত্যা। প্রায়ই জঙ্গলে, নদীতে, খালেবিলে পাওয়া যেত প্রতিবাদকারীদের লাশ। পনের বছরের কিশোরী ফাতিমা বেদার ঐ সংগ্রামে জীবন দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন । ফাতিমাকে হত্যা করায় আন্দোলন আরো তীব্র হয়। দলে দলে নারী ও শিশুরা জড়ো হয় প্রতিবাদ সমাবেশে। ফাতিমা বেদারদের রক্তের বিনিময়ে আলজেরিয়া ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়।
শওকত ওসমানের 'জাহান্নাম হইতে বিদায়' উপন্যাসে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী এ দেশকে বিভীষিকাময় নরককুণ্ডে পরিণত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন তৎপরতার কথাও আছে। প্রবীণ স্কুলশিক্ষক গাজী রহমান স্বীয় প্রাণ সংশয়াপন্ন দেখে আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু এ পলাতক জীবন নিয়ে তিনি বিব্রত। তিনি যেন তাঁর নিজের কাছেই অপরিচিত জন। দেড় মাসের পলাতক জীবনে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার। অসীম সাহসী এ সকল মানুষের সাথে মিশে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্ভীকচিত্তে তিনি পা রাখেন বাস্তবের কঠিন কর্তব্যভূমিতে।
তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহারই—যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তণ্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে। তরুণ অরুণের মতোই যে তারুণ্য তিমির-বিদারী, সে যে আলোর দেবতা। রঙের খেলা খেলিতে খেলিতে তাহার উদয়, রঙ ছড়াইতে ছড়াইতে তাহার অস্ত । যৌবন-সূর্য যেথায় অস্তমিত, দুঃখের তিমির-কুন্তলা নিশীথিনীর সেই তো লীলাভূমি ।
সুখ-সমৃদ্ধিতে ঐশ্বর্যময় এবং প্রাণৈশ্বর্যে ভরপুর এই সুন্দর দেশটি বর্গীর আক্রমণ থেকে শুরু করে বার বার শত্রুর লোলুপ দৃষ্টিতে পড়েছে। বিপর্যস্ত হয়েছে এ দেশের সহজ-সরল মানুষের জনজীবন, অর্থনৈতিক বুনিয়াদ এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য । কিন্তু কোনো শত্রুর কাছে পরাভব মানেনি এ দেশের গণমানুষ। তাই তো যুগে যুগে আমরা দেখি নুরলদীন-তিতুমীর-হাজী শরিয়তউল্লাহ-সূর্যসেন-প্রীতিলতা-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিস্ময়কর শক্তি-সাহস এবং শৌর্যবীর্য। হাজার বছর ধরে এ দেশের মানুষের রয়েছে রক্তে রঞ্জিত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
আশেকনগর গ্রামের এনায়েতউল্লাহ উত্তরাধিকারসূত্রে একজন পীর। অঢেল তার ধনসম্পদ। কিন্তু ঘরে তার কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় মনে তার শূন্যতা। তাই বার্ষিক জলসা শেষ হওয়ার পরপরই এনায়েত দ্বিতীয় বিবাহ সেরে ফেলে। নতুন বউ অল্পবয়সী, দেখতে অতি নিরীহ গোছের-একেবারে এনায়েতের মনের মত। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই সে বেরিয়ে আসে ঘোমটা থেকে, কথা বলে অনবরত এবং হাসতে থাকে খলখল শব্দে। পীর স্বামী তাকে মাজারের ভয় দেখায়, শরীয়ত-মারফত শেখায় এবং পাক মাজারের সাথে ঠিকভাবে আচরণের জন্য শাসায়। কিন্তু নতুন বউ সারার মনে প্রবল বিদ্রোহ। সে তার বাবার বয়সী স্বামীকে কোনোমতেই সহ্য করতে পারে না। এনায়েত বিচলিত হয়।
ওয়াজ করিবার সময় পীর সাহেবের প্রায়ই জযবা আসিত। সে জযবাকে মুরিদগণ “ফানাফিল্লাহ' বলিত। এই 'ফানাফিল্লাহ'র সময় পীর সাহেব 'জ্বলিয়া গেলাম', 'পুড়িয়া গেলাম' বলিয়া চিৎকার করিয়া চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িতেন।……….তাই জযবার সময় একখণ্ড কালো মখমল দিয়া পীর সাহেবের চোখমুখ ঢাকিয়া দিয়া তাহার হাত-পা টিপিয়া দিবার ওসিয়ত ছিল।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে শাসনের নামে চালিয়েছে শোষণের স্টিম রোলার। এ সময় ভারতে স্বাধীনতার দাবিতে দানা বেঁধে ওঠে স্বদেশি আন্দোলন। ভারতবর্ষ জুড়ে তীব্র আন্দোলনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কেঁপে ওঠে। ফলে এ আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদী সরকার ভারতের অগণিত তরুণ-যুবাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলায়। মৃত্যু অবধারিত জেনেও মুক্ত স্বদেশের স্বপ্নে বিভোর আন্দোলনকারীরা পিছপা হননি। স্বদেশিদের দুর্বার এ সংগ্রামে তেত্রিশ কোটি ভারতবাসীর ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন।