নিচের কোন শব্দটি বেদনার ভাব প্রকাশ করে?
প্রিয় মুস্তাফা
এক্ষুনি তোর চিঠি গেলাম। তাতে তুই আমায় লিখেছিস যে, তোর ওখানে থাকবার জন্য যা যা করা জরুরি ছিল, সব তুই করে ফেলেছিস। আমি এই খবরও পেয়েছি যে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইনचিनয়ারিং বিভাগে আমাকে নেওয়া হয়েছে। তুই আমার জন্যে যা করেছিল, দোস্ত, সবকিছুর জন্যে তোকে ধন্যবাদ, শুকরিয়া। তবে এটা নিশ্চয়ই, তোর কাছে একটু অদ্ভুত ঠেকবে যখন আমি এ খবরটা দেবো না দোস্ত, আমি আমার মত পালটেছি। আমি তোকে অনুসরণ করে সেই দেশে যাৰ না, যে দেশ 'শ্যামল, সজল আর সুত্র সু সব মুখে ভরা'—যেমন তুই লিখেছিল। না, আমি এখানেই থাকব। কোনোদিন এদেশ ছেড়ে যাব না ।
আমি কিন্তু সত্যি বড় অন্ধতে আছি, মুস্তাফা। আমাদের জীবন আর কখনোই এক খাতে বয়ে যাবে না। অর্থভিন্ন কারণ, আমি যেন শুনতে পাচ্ছি তুই আমার মনে করিয়ে দিচ্ছিস—কী রে, আমরা না কথা দিয়েছিলাম সব সময় একসঙ্গে থাকব, যেমন আমরা চিরকাল একসঙ্গে বালে উঠতাম, 'আমরা বড়োলোক হবোই। আমাদের অনেক টাকা হবে।” কিন্তু দোস্ত, কিছুই আর আমার করার নেই। হ্যাঁ, আমার এখনও সেদিনটা মনে পড়ে যেদিন কায়রোর বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আমি তোর হাত চেপে ধরেছিলাম।
তুই বলছিলি, ‘উড়োজাহাজ ছাড়বার আগে আরো পনেরো মিনিট সময় আছে হাতে । অমনভাবে হা করে আকাশে তাকিয়ে থাকিস না। শোন। পরের বছর তুই কুয়েত যাবি। মাইনে যা পাবি তা থেকে যথেষ্ট টাকা বাঁচাতে পারবি। ফিলিস্তিনের মাটি থেকে শেকড় ওপড়াতে তাই যথেষ্ট। তারপর ক্যালিফোর্নিয়া গিয়ে নতুন করে শেকড় পুঁতবি। আমরা একসঙ্গে সব শুরু করেছি, আর একসঙ্গেই চালিয়ে যেতে হবে আমাদের...'
সেই মুহূর্তে আমি তোর ঠোঁটের দ্রুত নড়াচড়া দেখছিলাম, মুস্তাফা। তোর কথা বলবার ধরনটাই ছিল ওরকম, দাঁড়ি-কমা বাদ দিয়ে হড়বড় করে তোড়ে বলে চলা। কিন্তু আবছাভাবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল তোর এই পালানোতে তুই পুরোপুরি সুখী না। পালাবার তিনটে ভালো কারণ তুই দেখাতে পারিসনি। আমিও সর্বক্ষণ এই আক্ষেপে ভুগেছি । কিন্তু সবচেয়ে স্পষ্ট চিন্তাটা ছিল—এই গাজাকে ছেড়ে সবাই মিলে পালিয়ে যাই না কেন আমরা? কেন যাই না? কেন পারি না? তোর অবস্থা অবশ্য ভালো হতে শুরু করেছিল। কুয়েতের শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে তোকে কনট্রাক্ট দিয়েছিল, যদিও আমাকে দেয়নি। যে দুরবস্থার দাবনার মধ্যে আমি গড়াগড়ি যাচ্ছিলাম, সেটা যেন আর পালটাবেই না। তুই মাঝে মাঝে আমাকে কিছু টাকা পাঠাতিস । তুই চেয়েছিলি আমি যেন ঋণ হিসেবেই তা গ্রহণ করি, কারণ তোর ভয় ছিল নয়তো আমি অপমানিত বোধ করব। আমার বাড়ির হালচাল তো তুই জানতিস । তুই জানতিস, স্কুলের চাকরিতে আমি যে সামান্য মাইনে পেতাম, তাতে আমার আম্মা, আমার ভাবি, আর তার ছেলেমেয়েসহ সংসারটা চালানোই অসম্ভব ছিল ।
পরে কুয়েতের শিক্ষামন্ত্রণালয় আমাকেও কনট্রাক্ট দিয়েছিল। আমি তোকে সবকিছু জানিয়েই চিঠি লিখতাম । সেখানে আমার বেঁচে থাকাটা ছিল কেমন একটা চটচটে ফাঁকা দমবন্ধ দশা । আমার গোটা জীবনটাই কেমন যেন পিচ্ছিল হয়ে গেছে, মাসের গোড়া থেকেই পরের মাস পয়লার জন্যে একটা উগ্র বাসনা আমায় কুরে কুরে খায় । সেই বছরটার মাঝামাঝি, ফিলিস্তিনে বোমা হামলা হয়। ঘটনাটা আমার রুটিন খানিকটা পালটে দিয়ে থাকবে—তবে সেদিকে নজর দেবার খুব একটা ফুরসৎ বা উপায় আমার ছিল না। এই ফিলিস্তিন পেছনে ফেলে রেখে আমি চলে যাব ক্যালিফোর্নিয়া, নিজেকে নিয়ে নিজে বাঁচব, আমার এই হতভাগা বেচারি জীবন কত ভুগেছে, কত সয়েছে !
আম্মা, ভাবি আর তার বাচ্চাদের জন্যে সামান্য টাকা পাঠাতাম আমি, যাতে তারা কোনোক্রমে টিকে থাকতে পারে। তবে এই শেষ বন্ধনটাও আমি ছিঁড়ে ফেলে নিজেকে মুক্ত করে ফেলব—সবুজ ক্যালিফোর্নিয়ায়। এই হার, এই পরাজয়ের পচা গন্ধ থেকে বাঁচাব নিজেকে। যে সহানুভূতি, যে সমব্যথা আমাকে আমার ভাইজানের বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল, তাদের আম্মা আর আমারও আম্মা—এরা কেউই কোনোকালে এই খাড়াই থেকে আমার উড়াল ঝাঁপকে কোনো মানে দিতে পারবে না। অনেকদিন কেটেছে—আর এই পিছুটান টানাহেঁচড়া চলবে না । আমাকে পালাতে হবে। এসব অনুভূতি তোর চেনা, মুস্তাফা, কারণ তোরও তো সত্যি এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল ।
যখন আমি জুন মাসে ছুটিতে গেলাম। আমার যাবতীয় পার্থিব সম্পত্তি জড়ো করলাম এক জায়গায়। মধুর পলায়নের জন্যে উদ্বেল হয়ে উঠলাম । কিন্তু কী সেই অস্পষ্ট আবছায়া যা কোনো লোককে তার পরিবারের কাছে টেনে নিয়ে আসে? মুস্তাফা, আমি জানি না। আমি শুধু জানি—আমি আম্মার কাছে গিয়েছি, আমাদের বাড়িতে সেদিন সকালবেলায় । আমি যখন গিয়ে পৌঁছেছি, আমার ভাবি, আমার মরহুম ভাইজানের স্ত্রী, আমার সঙ্গে দেখা করল । আর ফুঁপিয়ে বলল, তার মেয়ে নাদিয়া জখম হয়ে গাজার হাসপাতালে আছে, আমাকে দেখতে চায় । আমি কি তাকে দেখতে যাব সেদিন সন্ধ্যাবেলা? তোর মনে আছে নাদিয়াকে, তেরো বছর বয়েস, আমার ভাইয়ের মেয়ে?
সেদিন সন্ধ্যেয় আমি এক পাউন্ড আপেল কিনে নিয়ে নাদিয়াকে দেখতে হাসপাতালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম । আমি জানতাম কিছু একটা রহস্য আছে। আমার আম্মা আর আমার ভাবি আমার কাছে যা চেপে গিয়েছে, এমন একটা কিছু যা তারা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। নাদিয়াকে আমি ভালোবাসতাম নিছক অভ্যাসবশেই, সেই একই অভ্যাস যা আমাকে ভালোবাসিয়েছে তাদের প্রজন্মের সবকিছুকে। সেই যে প্রজন্ম বড়ো হয়ে উঠেছে পরাজয়, হতাশায় আর বাস্তুহীনতায় ।
কী ঘটেছিল সেই মুহূর্তে? আমি জানি না মুস্তাফা । খুব শান্তভাবেই আমি ঢুকেছিলাম ধবধবে সাদা ঘরটায়। নাদিয়া শুয়ে আছে তার বিছানায় একটা মস্ত বালিশে পিঠ দিয়ে, যার ওপর তার চুল কালো এক ঘন পশলার মতো ছড়িয়ে আছে । তার ডাগর চোখ দুটোয় কী রকম একটা ছমছমে গভীর স্তব্ধতা । তার কালো চোখের তারায় টলমল করছে পানি। তার মুখখানি শান্ত নিশ্চল। এখনো বড্ড ছেলেমানুষ আছে নাদিয়া, কিন্তু তাকে দেখাচ্ছে কোনো বাচ্চার চেয়েও বেশি, আরো বেশি, কোনো বাচ্চার চেয়ে বড়ো, অনেক বড়ো । 'নাদিয়া !'
সে তার চোখ তুলে তাকিয়েছিল আমার দিকে। তার ক্ষীণ, মৃদু হাসির সঙ্গে আমি তার গলা শুনতে পেলাম ।
“চাচা! তুমি কি এক্ষুনি কুয়েত থেকে এলে'?
তার কণ্ঠস্বর কী রকম যেন ভেঙে গেল তার গলায়। দুই হাতে ভর দিয়ে কোনোমতে সে উঠে বসল। গলাটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। আমি হালকাভাবে তার পিঠ চাপড়ে তার পাশে বসে পড়লাম । ‘নাদিয়া! আমি তোর জন্যে কুয়েত থেকে উপহার নিয়ে এসেছি, অনেক উপহার। বিছানা ছেড়ে উঠবি যখন, একেবারে সেরে যেতে হবে কিন্তু, ততদিন আমি সবুর করব। তারপর তুই আমার বাড়ি আসবি আর এক এক করে সব আমি তোকে দেব। তুই যে লাল সালোয়ারগুলো আনতে লিখেছিলি সেগুলো এনেছি। একটা নয়—অনেক।' মিথ্যে কথা। আমি এমনভাবে কথাগুলো বললাম যেন জীবনে এই প্রথম আমি কোনো পরম সত্য কথা বলছি । নাদিয়া কেঁপে উঠল, ভয়ঙ্কর এক স্তব্ধতার মধ্যে সে তার মাথা নোয়াল। আমি টের পেলাম, তার চোখের জল আমার হাতের পিঠ ভিজিয়ে দিচ্ছে।
“কিছু বল, নাদিয়া ! লাল সালোয়ারগুলো তোর চাই না?”
সে তার ডাগর চোখ দুটি তুলে আমার দিকে তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থতমত খেয়ে থেমে গেল । তারপর দাঁতে দাঁত চাপল। আমি তার গলা শুনতে পেলাম আবার। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। “চাচা !’
সে তার হাত বাড়িয়ে দিল । আঙুল দিয়ে তুলে ধরল গায়ের সাদা চাদর। আঙুল তুলে দেখাল তার পা, উরুর কাছ
থেকে কেটে বাদ দেওয়া ।
দোস্ত, মুস্তাফা... আমি কোনোদিন নাদিয়ার পা দুটো ভুলব না—উরুর কাছ থেকে কাটা। না! হাসপাতাল থেকে সেদিন আমি বেরিয়ে গিয়েছিলাম। হাতের মধ্যে মুঠো করা দুটি পাউন্ড, নাদিয়াকে দেব বলে এনেছিলাম। জ্বলজ্বলে সূর্য রাস্তা ভরিয়ে দিয়েছে টকটকে রক্তের রঙে। এই ফিলিস্তিনে সবকিছু দপদপ করছে বিষাদে, মনস্তাপে, যা শুধুই কোনো রোদনের মধ্যে আবদ্ধ নয়। যুদ্ধের আহ্বান এই বিষাদ। তারও বেশি, এ যেন কাটা পা ফিরে পাবার জন্যে একটা প্রচণ্ড দাবি !
গাজার রাস্তায় রাস্তায় আমি হেঁটে বেড়ালাম । চোখ ধাঁধানো আলোয় ভরা সব রাস্তা । ওরা আমাকে বলেছে— নাদিয়া তার পা হারিয়েছে, যখন সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার ছোটো ছোটো ভাইবোনদের ওপর, তাদের ঢেকে দিয়েছিল নিজের ছোট্ট শরীরটা দিয়ে । বোমা আর আগুন থেকে তাদের বাঁচাতে, যে-আগুনের হিংস্র থাবা তখন বাড়িটায় পড়েছিল। নাদিয়া নিজেকে বাঁচাতে পারত, সহজেই সে ছুটে পালিয়ে যেত পারত লম্বা লম্বা পা ফেলে, রক্ষা করতে পারত তার পা। কিন্তু সে তা করেনি। কেন?
না, মুস্তাফা, দোস্ত আমার, আমি ক্যালিফোর্নিয়া যাব না—আর তাতে আমার কোনো খেদ নেই । ছেলেবেলায় এক সঙ্গে আমরা যা শুরু করেছিলাম, তাও আমরা শেষ করব না। সেই আবছা মতো অনুভূতি যা তুই গাজা ছেড়ে যাবার সময় অনুভব করেছিলি, সেই ছোট্ট বোধটাকে বিশাল হয়ে গড়ে উঠতে দিতে হবে তোর ভেতর। ছড়িয়ে পড়তে দিতে হবে তাকে, নিজেকে ফিরে পাবার জন্যে হাতড়াতে হবে তোকে, তন্নতন্ন করে তোকে নিজেকে খুঁজতে হবে পরাজয়ের এই ধ্বংসস্তূপে।
আমি তোর কাছে যাব না মুস্তাফা। বরং তুই, তুই আমাদের কাছে ফিরে আয় । ফিরে আয়, মুস্তাফা, নাদিয়ার কাটা পা দুটি থেকে শিখতে, ফিরে আয় জানতে কাকে বলে জীবন, অস্তিত্বের মূল্য কী আর কতটা ! ফিরে আয়, মুস্তাফা, দোস্ত আমার, ফিরে আয় ! আমরা সবাই তোর জন্যে অধীর অপেক্ষা করে আছি