পূজা সেন তার মায়ের কথা অনুযায়ী সপ্তাহের প্রতি শনিবার সন্ধ্যার পর শনিদেবের পূজায় মত্ত হন।
পূজা সেন কেন শনিদেবের পূজা করেন?
পঞ্চম অধ্যায়
দেব-দেবী ও পূজা-পাৰ্বণ
ঈশ্বর নিরাকার হলেও মানবকল্যাণে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। ঈশ্বর যখন নিজের কোনো গুণ বা ক্ষমতাকে কোনো বিশেষ আকার বা রূপে প্রকাশ করেন, তখন তাঁকে দেবতা বা দেব-দেবী বলে। যেমন- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি। ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা, ভগবান বিষ্ণু প্রতিপালন ও রক্ষাকারী দেবতা এবং শিব ধ্বংসের দেবতা। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে আমরা তিন প্রকার দেব-দেবীর পরিচয় পাই বৈদিক দেবতা, পৌরাণিক দেবতা ও লৌকিক দেবতা।
বৈদিক দেবতা যে-সকল দেবতার নাম বেদে উল্লিখিত হয়েছে, তাঁদের বৈদিক দেবতা বলে। যেমন- -
অগ্নি, ইন্দ্র, বিষ্ণু, ঊষা প্রভৃতি।
পৌরাণিক দেবতা যে-সকল দেবতার নাম পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে, তাঁদের পৌরাণিক দেবতা বলে। যেমন - দুর্গা, কালী, গণেশ প্রভৃতি।
লৌকিক দেবতা বেদে বা পুরাণে উল্লেখ নেই, লৌকিকভাবে পূজিত হন এমন দেবতাদের বলা হয় - লৌকিক দেবতা। যেমন, ा, শ প্রকৃতি
আমরা এ সকল দেব-দেবীর পূজা করে থাকি। দেব-দেবীর পূজা করলে ঈশ্বর খুশি হন এবং ভক্তের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন।
কর্মা-৭, হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা- অষ্টম শ্রেণি
হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
'পূজা' ও 'পার্বণ' শব্দদুটি আমরা সাধারণত সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু পূজা মানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। দেব-দেবীকে পুষ্পপত্র, নৈবেদ্য ইত্যাদি দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করাকে পূজা বলে। আর 'পার্বণ' শব্দের অর্থ হলো পর্ব বা উৎসব। উৎসব মানে আনন্দানুষ্ঠান। হিন্দুধর্মের বিধি-বিধান অনুসারে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজায় বিভিন্ন ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হয়। একেই বলে পার্বণ। পূজা উপলক্ষে নানারকমের আয়োজন করা হয়। পূজার জন্য নানারকম উপকরণ সংগ্রহ ও ব্যবহার করা হয়। যেমন- প্রতিমা নির্মাণ; দেবতার ঘর সাজানো; বিভিন্ন ধরনের বাদ্য বিশেষ করে ঢাক, ঢোল, ঘণ্টা, কাঁসি, শঙ্খ ইত্যাদির আয়োজন; ভক্তদের সাথে ভাব বিনিময়, বিচিত্রধর্মী খাওয়া-দাওয়া, বিভিন্ন ধরনের আনন্দমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন; পরিচ্ছন্ন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান ইত্যাদি ।
পার্বণ পূজা অনুষ্ঠানকে অধিক আনন্দঘন করে তোলে। ফলে ঈশ্বর ও দেব-দেবীর প্রতি ভক্তি, একাগ্রতা,
গভীর শ্রদ্ধাবোধ, নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সংহতি ইত্যাদির সৃষ্টি হয় এ অধ্যায়ে আমরা পূজার উপকরণ বা উপচার, এগুলো ব্যবহারের তাৎপর্য, মনসা, নারায়ণ ও শনিদেবের পরিচয়, পূজাপদ্ধতি, প্রণামমন্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে জানব ।
এ অধ্যায়শেষে আমরা-
• পূজার উপকরণের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব
• পূজা-পার্বণ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক উপচার ব্যবহারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে পারব
• মনসাদেবীর পরিচয় ও পূজাপদ্ধতি বর্ণনা করতে পারব
• মনসাপূজার প্রণামমন্ত্র বলতে, লিখতে এবং তার সরলার্থ ব্যাখ্যা করতে পারব
• মনসাদেবীর পূজার শিক্ষা ও প্রভাব বর্ণনা করতে পারব
• নারায়ণ ও শনিদেবের পরিচয় ও পূজাপদ্ধতি বর্ণনা করতে পারব
• নারায়ণ ও শনিদেবের প্রণামমন্ত্র বলতে, লিখতে এবং তার সরলার্থ ব্যাখ্যা করতে পারব
• পারিবারিক জীবনে নারায়ণ ও শনি পূজার শিক্ষা ও প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব
• মনসা, নারায়ণ ও শনি পূজার শিক্ষা উপলব্ধি করে শ্রদ্ধাভরে পূজা-অর্চনায় উদ্বুদ্ধ হব
• প্রাকৃতিক উপচার সংরক্ষণে যত্নশীল হব
• পূজা-পার্বণের জন্য প্রাকৃতিক উপচার সংগ্রহ এবং পূজা-পার্বণের ধর্মীয় ও নান্দনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করব।
দেব-দেবী ও পূজা-পার্বন
পাঠ ১ ও ২ : পূজা-উপকরণের ধারণা এবং পূজা-উপকরণ ব্যবহারের তাৎপর্য হিন্দুধর্মে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করা হয়। পুজো করার বিভিন্ন রীতি-নীতি আছে, যাকে পূজাবিধি বলে। বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা সঠিকভাবে করার জন্য ও পূজার রীতি-নীতিসমূহ সঠিকভাবে পালন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। এ-সকল পুরাসামগ্রীকে পূজার উপকরণ বা উপচার বলে উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পূজার রীতি-নীতি বা বিধি অনুসারে অতীষ্ট দেবতার উদ্দেশে নৈবেদ্য সমৰ্পণ - করতে হয়। নৈবেদ্যের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফল, মিষ্টি বা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন হয়। এগুলোকেও পূজার উপকরণ বা উপচার বলে ।
দেব-দেবীৱ পছন্স অনুসারে পূজা-উপকরণেরও ভিন্নতা রয়েছে। তবে সাধারণভাবে বিভিন্ন দেব-দেবীর পুজা করার জন্য নিম্নবর্ণিত উপকরণসমূহ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
১. নিজ বা প্রতিমা পূজায় দেব-দেবীর বিগ্রহ বা প্রতিমা নির্মাণ করা হয় ।
২. কলস বা ঘট: পুজার উপকরণ হিসেবে মাটি বা ধাতুর তৈরি একটি কলস বা ঘট ব্যবহার করা হয়। পূজার সময় কলসটি গঙ্গা নদীর জল বা প্রবহমান নদীর পরিষ্কার জল দিয়ে পূর্ণ করা হয়। কলসকে মলঘটও বলা হয়। অর্থাৎ কলস বা ঘট মঙ্গলের প্রতীক। একে মা পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। কলসের মুখে অগ্নপক্ষৰ ও তার ওপর একটি সবুজ নারিকেল স্থাপন করা হয়। এদের সঙ্গে সজীবতার সম্পর্ক রয়েছে। কলসের সবচেয়ে চওড়া অংশ পৃথিবীকে নির্দেশ করে। এর কেন্দ্র জলকে নির্দেশ করে। কলসের ঘাড় অগ্নিকে নির্দেশ করে এবং মুখের খোলা অংশ বায়ুকে নির্দেশ করে।
প্রদীপ পূজার একটি উপকরণ প্রদীপ। প্রদীপসৃষ্ট আলো সকল অন্ধকার
দূর করে বলে একে জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। প্রদীপ
আমাদের জীবনের আলো ও আত্মাকে নির্দেশ করে।
8. সূচক পূজা-উপকরণ, যা সৃষ্টির পবিত্র ধ্বনি সৃষ্টি করে। এর সুরেলা ধ্বনি যেন সকলকে জ্ঞানের জগতে, ভক্তির আ আনায় তোমরা এস, দেবতার কাছে আনত হও, আত্মনিবেদন কর।
৫. ফুলের মালা ফুলের মালা দেব-দেবীদের সম্মানিত ও সজ্জিত করার মাঙ্গলিক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৫২
হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
আসন: আসন দেবতাদের বসার জন্য ব্যবহার করা হয়।
৭. মুকুট: মুকুট দেবতাদের উচ্চ সম্মানের প্রতীক ।
৮. পান-সুপারি পানের মধ্যে বিভিন্ন দেবীর অধিষ্ঠান কল্পনা করা হয়। সুপারির কঠিন অংশ আমাদের অহংবোধের প্রতীক, যা পূজার শেষে দেবতার উদ্দেশে সমর্পণ করা হয়। ৯. কর্পূর: সুগন্ধি কপূর পূজার পরিবেশকে বিশুদ্ধ ও স্নিগ্ধ করে।
১০. গঙ্গাজল: দেব-দেবীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য পবিত্র গঙ্গার জল ব্যবহার করা হয়, কেননা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে গঙ্গার জল পবিত্র। এ-জলে বিভিন্ন ধরনের রোগ-পীড়া ভালো করার ক্ষমতা বিদ্যমান। এ ছাড়াও এ জল আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা ও বৈষয়িক সম্পদ বৃদ্ধির সহায়ক। ১১. ধূপকাঠি ধূপকাঠি আমাদের ইচ্ছাসমূহ নির্দেশ করে, যা দেব-দেবীর পূজার সময় বিশেষ
পাত্রে রেখে প্রজ্জ্বলন করা হয়
১২. থালা থালায় বিভিন্ন সামগ্রী পূজার উদ্দেশে রাখা হয়
১৩. ধূপ ধূপ এক ধরনের সুগন্ধযুক্ত ধোঁয়া সৃষ্টিকারী পূজা-উপকরণ, যা আমাদেরকে খারাপ শক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত করে বলে বিবেচনা করা হয় ।
১৪. চন্দন: চন্দন কাঠ সুগন্ধি। চন্দন কাঠ জলে ঘষে অনুলেপন তৈরি করা হয়। চন্দনের গন্ধ পবিত্র
পরিবেশের সৃষ্টি করে। এ কারণেই দেব-দেবীর উদ্দেশে সচন্দন পুষ্প বা বিশ্বপত্র নিবেদন করা
হয়। চন্দন একটি মঙ্গলজনক ও নান্দনিক পূজা-উপকরণ।
১৫. আবির এক ধরনের লাল রঙের গুঁড়া, যা দেব-দেবীদের জন্য ব্যবহার করা হয়। ১৬. চাল চাল বস্তুগত পূজা-উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
১৭. নৈবেদ্য ফুল, ফল, মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি নৈবেদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়, যা দেব-দেবীর কাছে আমাদের আত্মসমর্পণকে নির্দেশ করে। ১৮. পঞ্চারতি। একই সাথে পাঁচটি প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা যায় এমন একটি পূজা-উপকরণ
১৯. ঘণ্টা: পূজায় ঘণ্টা বাজানো হয়। এটি মঙ্গলজনক শব্দসৃষ্টিকারী পূজা-উপকরণ। ২০. হলুদ: হলুদ পরিশুদ্ধ চিন্তাকে নির্দেশ করে এবং মনকে আকর্ষণ করে। এ ছাড়াও হলুদ দেবী দুর্গার
প্রতীক। হলুদে ভেষজ গুণ রয়েছে।
২১. পবিত্র সুতা যজ্ঞের জন্য প্রয়োজন হয়।
একক কাজ: পূজার উপচারসমূহের নাম লেখ।
নতুন শব্দ: সমার্থক, বিচিত্রধর্মী, সম্প্রীতি, পঞ্চারতি
দেব-দেবী ও পূজা-পার্বণ
পাঠ ৩ ও ৪ মনসাদেবীর পরিচয় ও পূজাপদ্ধতি মনসাদেবীর পরিচয়
মনসা সর্গের দেবী। তিনি সর্পকুলের জননী। তিনি আমাদের সর্পতর থেকে রক্ষা করেন। তিনি উর্বরতা ও সমৃদ্ধির দেবী হিসেবেও পরিচিত। বাংলাদেশসহ পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে মনসাদেবীর পূজা করা হয়। মনসা মূলত লৌকিক দেবী। পরে পৌরাণিক দেবীরূপে পরিগণিত হয়েছেন। দেবী মনসা ব নামেও পরিচিত। কেননা তিনি সাপের বিষ হরণ করে থাকেন। ব্রহ্মার উপদেশে ঋষি বশিষ্ঠ সর্ণমন্ত্রের সৃষ্টি করেন এবং তাঁর তপস্যার দ্বারা মন থেকে সেই মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে মনসার আবিৰ্ভাব ঘটে। মন থেকে সাকার রূপ লাভ করেছেন বলে তাঁর নাম হয়েছে মনসা। পুরাণমতে তিনি জরৎকারু মুনির পত্নী, আস্তিক মুনির মাত্রা এবং সাপের রাজা বাসুকির বোন তাঁর পিতার নাম কশ্যপ মুনি এবং মাতার নাম নাগমাতা নামেও পরিচিত।
মনসাদেবীর চারটি হাত এবং তিনি গৌরবর্ণা। তাঁর আরেক নাম ভাগগৌরী। চন্দ্রের মতো সুন্দর এবং প্রসন্ন তাঁর মুখমণ্ডল। অরুণ বর্ণের অর্থাৎ ভোরের সূর্যের আলোর মতো লাল রঙের কাপড় তিনি পরিধান করেন। তিনি সোনার অলংকার পরিধান করেন। কয়েকটা সাপ তাঁকে জড়িয়ে থাকে, যেন তাঁর অলংকার। হাঁস তাঁর বাহন। প্রসন্ন মুখে তিনি হাঁসের ওপর বসে থাকেন। এ ছাড়াও আটটি সাপ তাঁর হাত, মুকুট ও পাদদেশ দিরে থাকে
মনসার পূজাপদ্ধতি
আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপঞ্চমী তিথিকে বলা হয় নাগপঞ্চমী। এ সময় বাড়ির উঠানে সিঙ্গলাছ স্থাপন করে মনসাদেবীর পুজা করা হয়। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতেও মনসাপুজার বিধান আছে বর্তমানে সর্বজনীনভাবে মনসাদেবীর মন্দিরে মনসাপুজা করা হয়। আবার পারিবারিক পর্যায়ে
পারিবারিক মন্দিরেও মনসাদেবীর পূজা হয়। মনসাপুজার মুখ্য উদ্দেশ্য সাপের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া। এজন্য অন্যান্য পূজার মতো সাধারণ পূজাবিধি অনুসরণ করতে হয়। পুজার প্রারম্ভে সংকল্প গ্রহণ, মনসার প্রতিমা স্থাপন, আচমন, চক্ষুদান হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
প্রভৃতি বিধি অনুসরণ করতে হয়। এ ছাড়া মনসার ধ্যান, আবাহন মন্ত্রপাঠ এবং পূজার মন্ত্রপাঠ করতে হয়। অতঃপর স্নানমন্ত্র পাঠ করে মনসাদেবীকে স্নান করাতে হয় এবং অষ্ট নাগমন্ত্র পাঠের মাধ্যমে দেবীর পূজা আরম্ভ করতে হয়। শেষে পুষ্পাঞ্জলি ও প্রণামমন্ত্রের মাধ্যমে পূজা সমাপন করতে হয়। সবশেষে দেবী-প্রতিমাকে বিসর্জন দেয়া হয়।
পাঠ ৫ : মনসাদেবীর প্রণামমন্ত্র এবং মনসাপূজার শিক্ষা ও প্রভাব মনসাদেবীর প্রণামমন্ত্র
আস্তিকস্য মুনের্মাতা ভগিনী বাসুকেস্তথা ।
জরৎকারুমুনেঃ পত্নী মনসাদেবি নমোঽস্তু তে ॥ সরলার্থ: আস্তিক মুনির মাতা, নাগরাজ বাসুকির ভগ্নি, জরৎকারু মুনির পত্নী, হে মনসাদেবী! তোমাকে প্রণাম ।
মনসাপূজার শিক্ষা ও প্রভাব
মনসাদেবীর পূজা করলে সাপের ভয় থাকে না। মনসাদেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে অনেক উপাখ্যান রচিত হয়েছে। সে-সকল উপাখ্যানে মনসাদেবীকে পূজা না করার ভয়াবহ পরিণাম এবং পুজা করার সুফল বর্ণিত হয়েছে। মনসাদেবীর পূজার সময় উপাখ্যানগুলো শোনানো হয়। এরূপ উপাখ্যান অবলম্বনে অনেক পালাগানও রচিত হয়েছে। 'মনসার ভাসান' এরকম একটি পালাগান। এ ছাড়াও মনসাপূজার মাধ্যমে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিভিন্ন সাপ সম্পর্কে ধারণা গ্রহণের সুযোগ ঘটে। বিষধর সাপের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ফলে সর্পদংশনের ঘটনা কম ঘটে। এ পূজার মূল শিক্ষা হলো সর্ম্পকে বশীভূতকরণের কৌশল আয়ত্ত করা, যার মাধ্যমে শত্রুকে সুপথে ফিরিয়ে এনে সমাজে শাস্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়।
একক কাজ মনসাদেবীর পূজার সুফলগুলো লেখ।
নতুন শব্দ: প্রজ্বলিত, জগদ্গৌরী, নাগপঞ্চমী, কদু ।
পাঠ ৬ : নারায়ণদেবের পরিচয় ও পূজাপদ্ধতি
নারায়ণদেবের পরিচয়
বিষ্ণুর সহস্র নামের মধ্যে ২৪৫তম নাম নারায়ণ। হিন্দুধর্ম অনুসারে নারায়ণ পরমব্রহ্ম পরমাত্মা ও পরমেশ্বর নামে পরিচিত। 'নার' বা 'নারা' শব্দের অর্থ মানুষ এবং 'অয়ন' শব্দের অর্থ আশ্রয়। সুতরাং 'নারায়ণ' শব্দের অর্থ সকল মানুষ বা সকল জীবের আশ্রয়স্থল। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও পুরাণ অনুসারে নারায়ণকে সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
দেব-দেবী ও পূজা-পার্বণ
হিন্দুধর্মগ্রন্থ অনুসারে ভগবান বিষ্ণু শ্যামবর্ণ। তাঁর চার হাত। এক হাতে পদ্ম, এক হাতে শঙ্খ, এক হাতে চক্র এবং আর এক হাতে রয়েছে গদা। শ্রীমদভগবদগীতা অনুসারে তিনি বিশ্বরূপ। তাঁর সহধর্মিণীর নাম দেবী লক্ষ্মী। এই বিষ্ণুই নারায়ণ বা হরি। তিনি এ বিশ্বের পালনকর্তা। তাঁর বাহন পদ্ধ
নারায়ণপূজার উদ্দেশ্য: ভগবান নারায়ণ সকল জীবের আশ্রয়স্থল। নারায়ণপূজার মুখ্য উদ্দেশ্য নারায়ণের আশীর্বাদ লাভ এবং তাঁর কৃপায় পারিবারিক সুখ-শান্তি অর্জন করা সময়কাল: যে-কোনো সময় বা মাসে নারায়ণপূজা করা যায়। তবে বৈশাখ মাসে নারায়ণপূজার প্রচলন অধিক লক্ষ করা যায়।
পূজাপদ্ধতি
প্রতিমারূপে, শালগ্রাম শিলারূপে, তাম্রপাত্রে বা জলে নারায়ণপূজা করা হয়। শালগ্রাম শিলা। এক প্রকার সামুদ্রিক জীবাশ্ম, যা ভারতের গন্ধকী নদীর তীরে শালগ্রাম নামক গ্রামে পাওয়া যায় এই জীবাশ্মটি গোল ও কালো রঙের হয়ে থাকে। এই পিলাকে নারারপচক্রও বলা হয় নারায়ণপূজায় অন্যান্য পুজার মতোই সাধারণ পূজাবিধি অনুসরণ করতে হয়। তারপর বিশেষভাবে নির্ধারিত মন্ত্রে নারায়ণের পূজা করা হয়। সাধারণত নারায়ণপূজার জন্য সাদা ফুলের প্রয়োজন হয়। তুলসীপাতা নারারণের প্রিয়।
পাঠ ৭ : নারায়ণের প্রণামমন্ত্র এবং নারায়ণপূজার শিক্ষা ও প্রভাব
নারায়ণের প্রণামমव
ওঁ নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণ হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণার গোবিন্দায় নমো নমঃ ॥
সরলার্থঃ নারায়ণ ব্রহ্মণ্যদেব তিনি কৃষ্ণ, তিনি গোবিন্দ তিনি পৃথিবী, ব্রাহ্মণ ও জগতের হিতসাধন করেন। তাঁকে বারবার নমস্কার জানাই
৫৬
হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
নারায়ণপুজার শিক্ষা ও প্রভাব
নারায়ণ পালনের দেবতা। তাই নারায়ণদেবের কাছ থেকে আমরা আমাদের সন্তান-সন্ততি তথা সকল
জীবকে দায়িত্বের সঙ্গে পালন করার শিক্ষা পাই । নারায়ণকে স্মরণ করলে পাপ দূর হয়। হৃদয় পবিত্র হয়। মনে শক্তির সঞ্চার হয়। নারায়ণ আমাদের প্রতিপালনকারী দেবতা। তিনি আমাদের দেহের মধ্যে আত্মারূপে বিরাজ করেন। নারায়ণপূজার মাধ্যমে ভক্তেরা ভগবান নারায়ণের আশীর্বাদ লাভ করেন। তাঁর আশীর্বাদ ভক্তদের দৈনন্দিন জীবনকে সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে তোলে। নারায়ণপূজার ফলে মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভক্তগণ শান্তির জন্য পরম শ্রদ্ধাভরে ভগবান নারায়ণের উপাসনা করেন এবং তাঁর মহিমা কীর্তন করেন।
একক কাজ: নারায়ণপূজার পাঁচটি প্রভাব লেখ।
নতুন শব্দ: শালগ্রাম শিলা, গণ্ডকী, জীবাশ্ম, তাম্রপাত্র । পাঠ ৮ : শনিদেবের পরিচয় ও পূজাপদ্ধতি
শনিদেবের পরিচয়
হিন্দুধর্মে অন্যান্য দেবতার মতো শনিদেরও একজন উপাস্য দেবতা। তিনি সূর্য ও ছায়ার পুত্র এবং নবগ্রহের অন্যতম। জীবনে চলার ক্ষেত্রে যে-সকল বাধা-বিপত্তি আসে, শনিদেব তা দূর করেন। তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বাধা-বিপত্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শনিদেবের পূজা করেন।
শনিদেবের চার হাত। তাঁর গায়ের রং কালো এবং পোশাকও কালো । তাঁর হাতে তরবারি, তীর ও ধনু দেখা যায়। তাঁর বাহন শকুন।
শনিদেবের পূজা
সময়কাল: শনি দেবতার নাম অনুসারে শনিবারে তাঁর পূজা করা হয়।
দেব-দেবী ও পূজা-পার্বণ
শনিপূজার উদ্দেশ্য: শনিপূজার উদ্দেশ্য হলো শনিদেবকে সন্তুষ্ট রাখা, বিভিন্ন ধরনের রোগ-পীড়া থেকে মুক্ত থাকা এবং মনের শান্তি বজায় রাখা ।
শনিদেবের পূজাপদ্ধতি
সাধারণত মন্দিরে বা পারিবারিক পর্যায়ে সূর্যাস্তের পরে শনিপূজা করা হয়। অন্যান্য পূজার মতো সকল ধরনের বিধি-বিধান অনুসরণ করা হয়। পারিবারিক পর্যায়ে শনিপূজার ক্ষেত্রে বাড়ির আঙ্গিনাকে বেছে নেয়া হয়। গৃহের অভ্যন্তরে শনিপূজা করা হয় না। পূজায় মন্ত্র ও শনিদেবের পাঁচালি পাঠ করা হয়। পাড়া-প্রতিবেশীদের পূজা অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় শনিপূজায় ভোগ হিসেবে পাঁচ প্রকারের ঋতুভিত্তিক ফল এবং পাঁচ রকমের ফুল নিবেদন করা হয়। কোনো-কোনো অঞ্চলে খিচুড়ি, দুধ, চিনি, বাতাসা, কলা, গুড়, মিষ্টান্ন ও ময়দার প্রসাদ তৈরি করা হয়। খিচুড়ি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে মুগের ডাল ব্যবহার করতে হয়। এ ছাড়াও পূজার উপকরণ হিসেবে পান-সুপারি, মধু, মাসকলাই, কালো তিল, বেগুনি বা কালো রঙের ফুলের প্রয়োজন হয় । শনিপূজাশেষে প্রসাদ বিতরণ করা হয়
পাঠ ৯ : শনিদেবের প্রণামমন্ত্র এবং শনিপূজার শিক্ষা ও প্রভাব শনিদেবের প্রণামমন্ত্ৰ
ওঁ নীলাঞ্জনচয়প্রখ্যং রবিসুতমহাগ্রহম্। ছায়ায়া গর্ভসম্ভূতং ত্বং নমামি শনৈশ্চরম্ ।
সরলার্থ: তোমার দেহ নীলবর্ণ, তুমি সূর্যদেবতার পুত্র, ছায়ার গর্ভে তোমার জন্ম, তোমাকে আমি নমস্কার জানাই।
শনি পূজার শিক্ষা ও প্রভাব
শনিদেবের পূজা করলে আমাদের আপদ-বিপদ দূর হয়। আমাদের দায়িত্বহীনতা, অপবিত্রতা ও পাপের কারণে শনিদেব খুব রুষ্ট হন। তখন আমরা কষ্ট পাই। কষ্টের মধ্য দিয়ে আমাদের উপলব্ধি ঘটে। আমরা তখন দায়িত্বশীলতা ও পবিত্রতার প্রতি মনোযোগী হই। মা যেমন সন্তানকে গভীর ভালোবাসা সত্ত্বেও সংশোধনের জন্য শাস্তি দেন, তেমনি শনিদেরও কখনো কখনো আমাদের কষ্ট দিয়ে সংশোধন করেন এবং অধর্মের পথ থেকে ধর্মপথে ফিরিয়ে আনেন। তাই প্রতিসপ্তাহে শনিবার শনিপূজা করা হিন্দুদের একটি নিয়মিত ধর্মকৃত্য ।
দলীয় কাজ: শনিদেবের পূজায় ব্যবহৃত উপচারের একটি তালিকা তৈরি কর।
নতুন শব্দ: নবগ্রহ, পাঁচালি, কৃষ্ণবর্ণ ।
ফর্মা-৮, হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা- অষ্টম শ্রেণি