যে কোনো একটি বিষয় অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা কর:
ভূমিকা: স্বদেশ মানুষের কাছে পরম সাধনার ধন, পরম নিবাস। স্বদেশের মানুষ, স্বদেশের রূপ-প্রকৃতি, তার পশু-পাখি এমনকী তার প্রতিটি ধূলিকণাও মানুষের কাছে প্রিয় ও পবিত্র। যে দেশ আলো দিল, বাতাস দিল, অন্ন-পানি দিল, বস্ত্র দিল, তার প্রতি যদি সেই শ্যামল স্নেহে প্রতিপালিত সন্তানদের মমতামণ্ডিত আনুগত্যবোধ না থাকে, তবে তারা কেবল অকৃতজ্ঞই নয়, বিশ্বের সকল নিন্দনীয় বিশেষণে বিশেষিত।
স্বদেশপ্রেম: যে ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যে মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং বড়ো হয়ে ওঠে, সে পরিবেশের প্রতি, সেখানকার মানুষের প্রতি তার একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ গড়ে ওঠে। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি এ আজন্ম আকর্ষণই স্বদেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেম সকলের অন্তরেই থাকে। কখনও এ প্রেম থাকে সুপ্ত অবস্থায়, কখনও থাকে তা সুপ্রকাশিতভাবে। সুখের দিনে স্বদেশপ্রেম থাকে সুপ্তিমগ্ন। কিন্তু দুঃখের দিনে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে স্বদেশপ্রেম উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। পরাধীনতার দুঃখ-বেদনায়, বিদেশিদের অকথ্য নির্যাতনে অন্তরের সুপ্ত স্বদেশপ্রেমের ঘুম ভাঙে। কিংবা দেশ যখন শত্রুর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়, তখন সমগ্র জাতি স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বদেশের ও স্বজাতির মানমর্ষাদা রক্ষাকল্পে রণক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার জন্য দলে দলে ছুটে যায়। তখন মনে হয়- 'নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।'
স্বদেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ও উন্মেষ: প্রকৃতপক্ষে স্বদেশপ্রেমের উদ্ভব আত্মসম্মানবোধ থেকে। যে জাতির আত্মসম্মানবোধ যত প্রখর, সে জাতির স্বদেশপ্রেম তত প্রবল। স্বদেশপ্রেম এক প্রকার পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। নিঃস্বার্থ, হিংসাবিহীন দেশপ্রেমই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডি উপেক্ষা করে বৃহত্তর স্বার্থের দিকে মন যখন পরিচালিত হয়; যখন আত্মকল্যাণ অপেক্ষা বৃহত্তর কল্যাণবোধ সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন জ্বলে ওঠে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার নিষ্কলুষ প্রদীপ শিখা। দেশপ্রেমিকের দেশ সেবার পথে বাধা অনেক, অত্যাচার সীমাহীন। কিন্তু পথের ঝড়, ঝঞ্ঝা, বজ্রপাত তাদের দৃঢ় বলিষ্ঠ পদক্ষেপের নিকট মিথ্যে প্রমাণিত হয়। ইতিহাসের পানে তাকালে এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত মেলে। পরদেশি কিংবা স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু কিংবা উদ্যত অস্ত্র তাদের নিবৃত্ত করতে পারে না। আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসও স্বদেশপ্রেমের গর্বে গর্বিত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সর্বশেষে ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্বদেশপ্রেমের প্রমাণ দেয়।
অন্ধ স্বদেশপ্রেমের পরিণতি: স্বদেশপ্রেম দেশ ও জাতির গৌরবের বস্তু হলেও অন্ধ স্বদেশপ্রেম বা উগ্র জাতীয়তাবাদ ধারণ করে ভয়ংকর রূপ। জাতিতে জাতিতে সংঘাত ও সংঘর্ষ অনিবার্য করে তোলে অন্ধ স্বদেশপ্রেম। আমরা স্বদেশের জয়গান গাইতে গিয়ে যদি অপরের স্বদেশপ্রেমকে আহত করি, তবে সেই স্বদেশপ্রেম বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে ডেকে আনে ভয়াবহ রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত। হিটলারের তৎকালীন জার্মানি কিংবা মুসোলিনির ইতালি উগ্র-জাতীয়তাবাদের নগ্নরূপ। চলমান বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব অন্ধ স্বদেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ।
দেশপ্রেম ও রাজনীতি: বস্তুত রাজনীতিবিদের প্রথম ও প্রধান শর্তই হলো দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেমের পবিত্র বেদিমূলেই রাজনীতির পাঠ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদ দেশের সদাজাগ্রত প্রহরী। পরাধীন বাংলাদেশের দিকে দিকে যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছিল, তাদের সকলেরই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পরাধীনতার বন্ধন থেকে দেশজননীর শৃঙ্খল-মোচন। তাদের অবদানেই আজ দেশ স্বাধীন। আজও দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বর্তমান। রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এখনও কত নতুন দলের আবির্ভাব ও নিষ্ক্রমণ। কিন্তু আজ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই মহত্তর, বৃহত্তর কল্যাণবোধ থেকে ভ্রষ্ট। রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থ চিন্তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রবল। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, মানুষের প্রয়োজনে সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার সাধনা, দেশপ্রেমের অঙ্গীকার ও সার্থকতা এখন প্রায়ই অনুপস্থিত। সংকীর্ণ রাজনীতিসর্বস্ব দেশপ্রেম প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস ও সর্বনাশের পথকেই করে প্রশস্ত।
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বভাবনা: যথার্থ দেশপ্রেমের সাথে বিশ্বপ্রেমের কোনো অমিল নেই, নেই কোনো বিরোধ, বরং স্বদেশপ্রেমের ভেতর দিয়ে বিশ্বপ্রেমের এক মহৎ উপলব্ধি, জাগরণ। স্বদেশ তো বিশ্বেরই অন্তর্ভুক্ত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ- সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষ বিশ্বপ্রেমের এ বাণীকে জাতীয় জীবনে গ্রহণ করলেই সংকীর্ণ অন্ধ জাতীয়তাবোধ থেকে আমাদের মুক্তি। বিশ্বপ্রেমের উজ্জ্বল আলোকে আমাদের স্বদেশপ্রেম হবে উদ্ভাসিত। আমরা স্বদেশকে ভালোবেসে বিশ্বদেবতারই বন্দনা করি। আজ যখন বিশ্বের সর্বত্র গণতন্ত্রের প্রবল জোয়ার এসেছে তখন বিশ্ব নাগরিকত্বের চেতনা হবে তাকে যথার্থভাবে গ্রহণ করা। স্বদেশ-চেতনা তো বিশ্ববোধেরই প্রাথমিক শর্ত। দেশের জল-মাটি-অরণ্য- পশুপাখি-মানুষ-সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে পারলে পৃথিবীর মানুষকেও ভালোবাসা যায়। তখনই তার মধ্যে জন্ম নেয় বিশ্বাত্মবোধ।
উপসংহার: দেশপ্রেম আমাদের মনের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। সেই অনলে অন্তরের যত কিছু পাপবোধ, যা কিছু ক্ষুদ্র, গ্লানিময় তার আহুতিদানেই আমাদের জীবন পরিশুদ্ধ হয়। এক মহৎ চেতনার বিভায় মানব-জন্ম হয় ভাস্বর। মানুষের জীবনে যদি দেশপ্রেমের চেতনা না থাকে, যদি বৃহত্তর কল্যাণবোধ থাকে অসুন্দরের ছদ্মবেশে আচ্ছন্ন, তাহলে হৃদয়ের কোন ঐশ্বর্য নিয়ে মানুষ মহৎ হবে? বৃহৎ হবে কোন সম্পদ নিয়ে? কোথায় তাহলে জীবনের মহিমা? কোথায় সেই উন্নত উত্তরাধিকার? দেশপ্রেম তো শুধু কতগুলো প্রাণহীন শব্দসমাহার নয়, নয় কোনো নিছক বিমূর্ত আদর্শ। স্বদেশপ্রীতির মধ্যেই মনুষ্যত্বের উদ্বোধন, মহৎ জীবনের সংকল্প, বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধন।