আখলাক আরবি শব্দ। এর অর্থ চরিত্র, স্বভাব, আচার-আচরণ, ব্যবহার ইত্যাদি। মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের মাধ্যমে যেসব আচার, ব্যবহার, চালচলন এবং স্বভাবের প্রকাশ পায়, সেসবের সমষ্টিই হলো আখলাক। এককথায় মানবচরিত্রের সব দিকই আখলাকের অন্তর্ভুক্ত। মানবচরিত্রের সৎ ও অসৎ দিকগুলোর বিচারে আখলাককে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। আখলাকে হামিদাহ্ (প্রশংসনীয় আচরণ) এবং আখলাকে যামিমাহ্ (নিন্দনীয় আচরণ)
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের মাধ্যমে যেসব উত্তম আচার, ব্যবহার, চালচলন এবং স্বভাবের প্রকাশ পায়, সেসবের সমষ্টিকে আখলাকে হামিদাহ্ বা উত্তম চরিত্র বলা হয়। যেমন- পরোপকারিতা, শালীনতাবোধ, সৃষ্টির সেবা, আমানত রক্ষা, শ্রমের মর্যাদা, ক্ষমা ইত্যাদি।
আখলাকে হামিদাত্র গুরুত্ব
মানবজীবনে আখলাকে হামিদাহ্র (উত্তম চরিত্রের) গুরুত্ব অপরিসীম। মানবজীবনের সুখ-শান্তি আখলাকে হামিদাহ্ বা প্রশংসনীয় আচরণের উপর নির্ভরশীল। প্রশংসনীয় আচরণের মাধ্যমেই উত্তম চরিত্র গড়ে ওঠে। আখিরাতের সুখ-দুঃখও আখলাকে হামিদাহ্র উপর নির্ভর করে। যার স্বভাব-চরিত্র যত সুন্দর হবে, সে ততই সৎকর্মশীল হবে এবং আল্লাহর কাছে প্রিয় হবে।
আখলাকে হামিদাত্র সুফল
১. মহান আল্লাহ ও তার রাসুল (স.)-এর ভালোবাসা লাভ
উত্তম চরিত্রের অধিকারী হলে মহান আল্লাহ ও তার রাসুল (স.)-এর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, 'তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি আমার নিকট অধিক প্রিয়, যার চরিত্র সর্বোত্তম।' (বুখারি ও মুসলিম)
২. ইমানের পূর্ণতা অর্জন
উত্তম চরিত্র মানুষের ইমানকে পূর্ণতা দান করে। এ সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেন,
اكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيْمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا
অর্থ: 'চরিত্রের বিচারে যে উত্তম, মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণতম ইমানের অধিকারী।' (আবু দাউদ)
৩. সর্বোত্তম মর্যাদা লাভ
উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুল (স.)-এর নিকট উঁচু মর্যাদা লাভ করেন এবং সমাজের নিকটও উঁচু মর্যাদার অধিকারী হন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, 'তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ, যার চরিত্র উত্তম।' (বুখারি)
৪. কিয়ামতের দিন সবচেয়ে ভারি আমল
মহানবি (স.) বলেন, 'কিয়ামতের দিন যে জিনিসটি মুমিনের পাল্লায় সবচেয়ে ভারি হবে তা হলো উত্তম চরিত্র।' (আবু দাউদ)
দলগত কাজ: আখলাকে হামিদাহর সুফলগুলো উল্লেখ কর। |
বাড়ির কাজ: সদাচারণের গুরুত্ব বর্ণনা কর। |
মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। আর সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে হলে পরস্পরের সহযোগিতার প্রয়োজন। অন্যের প্রয়োজনে বা উপকারে আসার নামই হলো পরোপকার।
পরোপকারের আরবি প্রতিশব্দ হলো 'ইহসান' الْإِحْسَانُ, যার অর্থ অন্যের উপকার করা। আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে সেগুলোকে উত্তম বা যথাযথভাবে পালন করার নামই পরোপকার।
তাৎপর্য
পরোপকার মহান আল্লাহর একটি বড় গুণ। মহান আল্লাহ পরম দয়ালু। সমগ্র সৃষ্টির প্রতি তার এ অসীম দয়া ও করুণা বিরাজমান। তিনি সকল মানুষকে সমান যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে সৃষ্টি করেননি। এ কারণে মানুষ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তাই মানুষ সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী অপরের উপকার করতে হবে।
পরোপকারের সুফল
১. আল্লাহর ভালোবাসা লাভ
পরোপকারী ব্যক্তিদের আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
অর্থ: "তোমরা সৎকর্ম ও পরোপকার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীল ও পরোপকারীদেরকে ভালোবাসেন।" (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৯৫)
২. সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়
পরোপকারের মাধ্যমে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পদ ব্যয় করে বা ভালো কথা বলেও মানুষের উপকার করা যায়। এতে সমাজ থেকে ঝগড়া-ফাসাদ দূর হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. শত্রু মিত্রে পরিণত হয়
পরম শত্রুকেও পরোপকারের মাধ্যমে আপন করা যায়। কঠোর হৃদয়বিশিষ্ট লোকের অন্তর ও জয় করা যায়।
৪. আল্লাহর রহমত লাভ
আল্লাহর কোনো সৃষ্টির প্রতি দয়া করলে তিনি দয়াকারী ব্যক্তির উপর রহমত বর্ষণ করেন। এ সম্পর্কে মহানবি (স.)-এর হাদিস-
ارْحَمُوا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ
অর্থ: 'তোমরা জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবে। তাহলে আসমানের অধিপতি মহান আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।' (তিরমিযি)
৫. মানুষের ভালোবাসা অর্জন
দয়া বা পরোপকারের মাধ্যমে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিক বন্ধন মজবুত হয়। কঠিন হৃদয়ের মানুষকে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা যায়। পরম শত্রুও মিত্রতে পরিণত হয়।
আমরা সর্বদা সৃষ্টির সেবা করব। বিপদে-আপদে অপরের সাহায্য করব।
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে মানুষকে কীভাবে উপকার করা যায় তার একটি তালিকা তৈরি করবে। |
শালীনতার আরবি প্রতিশব্দ 'তাহযিব' (اهْدِيبُ) যার অর্থ ভদ্রতা, নম্রতা ও লজ্জাশীলতা। আচার-আচরণে, কথাবার্তায়, বেশভূষায় ও চালচলনে মার্জিত পন্থা অবলম্বন করাকে শালীনতা বলে।
গুরুত্ব
শালীনতা মানুষের একটি মহৎগুণ। এটির গুরুত্ব অপরিসীম। শালীনতাবোধ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। শালীনতা আল্লাহর অনুগত বান্দা হতে সাহায্য করে। আচার-ব্যবহারে শালীন ব্যক্তিকে সবাই পছন্দ করে। শালীন পোশাক-পরিচ্ছদ সৌন্দর্যের প্রতীক। শালীন ও ভদ্র আচরণের মাধ্যমে বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। সমাজকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাখতে শালীনতার প্রয়োজন সর্বাধিক। শালীনতাপূর্ণ আচার-ব্যবহার সম্প্রীতি ও সৌহার্দের চাবিকাঠি। অশোভন বা অশালীন পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচরণ অনেক সময় সমাজে বিপর্যয় ডেকে আনে, সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করে। নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়।
শালীনতাপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পক্ষান্তরে অভদ্র বা অশালীন আচরণ বন্ধুকেও দূরে ঠেলে দেয়। মানুষ অশালীন ব্যক্তিকে পছন্দ করে না। তার সাহচর্য পরিত্যাগ করে। মহানবি (স.) বলেন, 'মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে নিকৃষ্ট, যার অশ্লীলতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লোকেরা তাকে পরিত্যাগ করে।' (বুখারি) অশালীন ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা কখনোই পছন্দ করেন না। বরং অশালীন ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ঘৃণা করেন। এ সম্পর্কে মহানবি (স.)-এর বাণী:
إِنَّ اللهَ يَبْغَضُ الْفَاحِشَ الْبَنِي
অর্থ: 'নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা অশালীন ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন।' (তিরমিযি)
শালীনতা মানুষের জীবনে অপরিহার্য বিষয়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে শালীনতা শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সূরা লুকমানে উল্লেখ আছে যে, হযরত লুকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে শালীনতা শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন, "হে পুত্র, অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না। পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে চলো না, কারণ আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারী ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। তুমি পদচারণ করবে সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করবে। নিশ্চয়ই স্বরের মধ্যে গাধার স্বর সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।" (সূরা লুকমান, আয়াত ১৯)
শালীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শালীনতা অবলম্বন করে চলা উচিত। এতে জীবন সুন্দর ও মধুময় হয়ে ওঠে। সমাজেও সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে শালীন আচরণের সুফলগুলো পোস্টারে লিখে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে। |
বাড়ির কাজ: 'অশালীন পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচরণ বিপর্যয় ডেকে আনে।' ব্যাখ্যা কর। |
ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও সহানুভূতিশীল হয়ে আদর-যত্ন করার নামই হলো সৃষ্টির সেবা। মহান আল্লাহ এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা করে পাঠিয়েছেন। আর সৃষ্টিকুলের সবকিছু যেমন- জীবজন্তু, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা ইত্যাদি মানুষের উপকারের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এসব সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি দেখানো এবং এগুলোর যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা অবশ্য কর্তব্য।
গুরুত্ব
যে সৃষ্টির প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করে, আল্লাহ তার প্রতি খুশি হয়ে রহমত বর্ষণ করেন। এ সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেন,
ارْحَمُوا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمُكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ
অর্থ: 'তোমরা জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবে। তাহলে আসমানের অধিপতি মহান আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।' (তিরমিযি)
পৃথিবী ও এই মহাবিশ্বে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর সৃষ্টি। সৃষ্টিজগতের সবকিছু নিয়ে আল্লাহর সৃষ্টি পরিবার। আল্লাহর সৃষ্টি পরিবারে মানুষই সেরা সৃষ্টি। পরিবারে যেমন পরিবার প্রধানের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে তেমনি সৃষ্টিজগতের প্রতিও মানুষের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। সৃষ্টিকুলের প্রতি এ দায়িত্ব পালন করার নাম সৃষ্টির সেবা।
মানুষের উপর প্রধানত দুই ধরনের কর্তব্য রয়েছে। প্রথমত স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য, তারপর সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য। সৃষ্টির প্রতি মানুষের কর্তব্যগুলোর মধ্যে অসহায় ও দুস্থ মানুষকে সাহায্য ও সহযোগিতা করা যেমন কর্তব্য, তেমনি গাছপালা, পশু-পাখি, বৃক্ষলতা এবং পরিবেশের প্রতিও মানুষের কর্তব্য রয়েছে। সৃষ্টির প্রতি সদয় হলে এবং এদের লালনপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করলে আল্লাহ খুশি হন। তেমনি এদের প্রতি অবহেলা করলে, নিষ্ঠুর আচরণ করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।
আমাদের চার পাশের কীটপতঙ্গ, গাছপালা, তরুলতা, পশু-পাখি সবকিছুর প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কারণ এ সবকিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ। আমাদের স্বার্থেই এ পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। মহান আল্লাহ এ সবকিছু আমাদের উপকারের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আমাদের প্রিয় নবি (স.) সৃষ্টিজীবের প্রতি সর্বদা সদয় ছিলেন। সমাজে কোনো ব্যক্তি পীড়িত হলে তার সেবা করতে হবে। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে সমাজে একে অপরের সেবা ও সাহায্য করলে আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়া যায়। প্রিয় নবি (স.) বলেছেন, 'যে মুসলমান অন্য মুসলমান ভাইয়ের অভাব মোচন করে আল্লাহ তায়ালা তার অভাব দূর করেন।' (মুসলিম) গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কুকুর, বিড়াল প্রভৃতি সকল প্রাণীরই আমাদের ন্যায় ক্ষুধা ও পিপাসা আছে। এদেরকে খেতে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
মহানবি (স.) বলেন, 'কোনো এক মহিলা একটি বিড়াল বেঁধে রাখে। সে বিড়ালটিকে খেতে দেয়নি এবং ছেড়েও দেয়নি যাতে পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে। অবশেষে বিড়ালটি বাঁধা অবস্থায় খাদ্যাভাবে মারা গেলে আল্লাহ ঐ মহিলাকে শাস্তি দেন। (বুখারি ও মুসলিম)
প্রিয় নবি (স.) আরও বলেন, 'বনি ইসরাইলের এক পাপী মহিলা একটি তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পিপাসায় কাতর দেখে পানি পান করায়। এতে আল্লাহ তায়ালা ঐ মহিলার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন।' (বুখারি ও মুসলিম)
জীবজন্তুর মতো উদ্ভিদের প্রতিও সদয় হতে হবে। অকারণে গাছ কাটা উচিত নয়। গাছের পাতা ছেঁড়া বা চারাগাছ উপড়ে ফেলাও উচিত নয়। গাছপালার যত্ন করা উচিত। বৃক্ষলতাও মহান আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে। পরিবেশ রক্ষায় ও নিজেদের প্রয়োজনে জীবজগৎ ও পরিবেশের প্রতি সদাচরণ করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আমরা সৃষ্টির সেবা করব, জীবজন্তুকে কষ্ট দেবো না। অকারণে কোনো বৃক্ষের ক্ষতি করব না। বৃক্ষ রোপণ করব এবং এর যত্ন করব।
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে সৃষ্টির সেবামূলক কাজগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে। |
আমানত অর্থ গচ্ছিত রাখা বা দায়িত্বে রাখা। গচ্ছিত বা দায়িত্বে রাখা বস্তু সযত্নে রেখে এর মালিকের কাছে যথাযথভাবে ফেরত দেওয়াকে আমানত রক্ষা বলে। যিনি আমানত রক্ষা করেন, তাকে আমানতদার বলে। আমানতের মাল নষ্ট করা বা আত্মসাৎ করার নাম খেয়ানত করা। আর আত্মসাৎকারীকে খেয়ানতকারী বলে।
গুরুত্ব
সমাজের প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ দায়িত্ব তার নিকট পবিত্র আমানত। সামাজিক শান্তি রক্ষার জন্য আমানত রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যিনি আমানত রক্ষা করেন, তাকে সবাই বিশ্বাস করে এবং ভালোবাসে। সমাজের সবাই তাকে মর্যাদা দেয়। আমানতের খেয়ানতকারীকে সমাজের কেউ পছন্দ করে না এবং বিশ্বাসও করে না। বরং তাকে সবাই ঘৃণা করে। আমানত রক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمْنَتِ إِلَى أَهْلِهَا
অর্থ: "নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে তোমরা যেন আমানতসমূহ তার মালিককে যথাযথভাবে ফেরত দাও।" (সূরা আন-নিসা, আয়াত ৫৮)
আমানত রক্ষা করা ইমানের অঙ্গ। এ ব্যাপারে মহানবি (স.) বলেন,
لَا إِيْمَانَ لِمَنْ لَّا أَمَانَةَ لَهُ
অর্থ: 'যার আমানতদারি নেই, তার ইমানও নেই।' (বায়হাকি)
আমানতের খেয়ানত করা মুনাফিকের লক্ষণ।
মহানবি (স.) বলেন,
آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثُ إِذَا حَدَّثَ كَذِبَ وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ -
অর্থ: 'মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে, আমানতের খেয়ানত করে।' (বুখারি ও মুসলিম)
আমানতের খেয়ানতকারী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ঘৃণিত। মানুষের কাছেও ঘৃণিত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার
বাণী:
إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْخَائِنِينَ
অর্থ: "নিশ্চয়ই আল্লাহ খেয়ানতকারীদের পছন্দ করেন না।" (সূরা আল-আনফাল, আয়াত ৫৮)
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা দলভিত্তিক আলোচনা করে আমানত রক্ষার কয়েকটি ক্ষেত্রের তালিকা প্রস্তুত করে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে। |
মানুষ জীবনধারণের জন্য যেসব কাজ করে তাকে শ্রম বলে। মানুষ তার নিজের বেঁচে থাকার, অপরের কল্যাণের এবং সৃষ্টি জীবের উপকারের জন্য যে কাজ করে তা-ই শ্রম। মানুষের উন্নতির চাবিকাঠিই হলো শ্রম। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি উন্নত। শ্রমের ব্যাপারে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلُوةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ
অর্থ: "অতঃপর যখন নামায শেষ হবে তখন তোমরা জমিনের বুকে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) অন্বেষণ করবে।" (সূরা আল-জুমুআ, আয়াত ১০)
শ্রমের মর্যাদা
ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অত্যধিক। শ্রম দ্বারা অর্জিত খাদ্যকে ইসলাম উৎকৃষ্ট খাদ্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং জীবিকা অন্বেষণকে ইবাদত হিসেবে ঘোষণা করেছে।
এ প্রসঙ্গে মহানবি (স.) বলেন,
طَلَبُ كَسْبِ الْحَلَالِ فَرِيضَةٌ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ -
অর্থ: 'ফরজ ইবাদতের পর হালাল বুজি উপার্জন করা একটি ফরজ ইবাদত।' (বায়হাকি)
মানুষের কল্যাণের জন্য মহান আল্লাহ এ পৃথিবীতে অফুরন্ত সম্পদ রেখেছেন। এ সম্পদগুলো আহরণ করতে হলে প্রয়োজন হয় শ্রমের। শ্রমের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোও আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টিগতভাবেই দান করেছেন। এগুলো হচ্ছে আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তথা হাত, পা ও মস্তিষ্ক। এগুলোকে কাজে লাগাতে মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- "তিনি তো তোমাদের জন্য ভূমি সুগম করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার দেওয়া রিযিক থেকে আহার কর।" (সূরা আল-মুল্ক, আয়াত ১৫)
আমাদের প্রিয় নবি (স.) শ্রমকে ভালোবাসতেন। তিনি নিজেও শ্রমে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি শিশু বয়সে মেষ চরাতেন। বড় হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। হিজরতের পর মদিনার জীবনে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে তিনি পরিখা খননে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পরিশ্রমী ব্যক্তিকে আল্লাহ পছন্দ করেন।
মহানবি (স.) আরও বলেন, 'নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নাই। আল্লাহর নবি দাউদ (আ.) নিজের হাতে কাজ করে খেতেন।' (বুখারি)
প্রিয় নবি (স.)-এর কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) নিজ হাতে জাঁতা ঘোরাতেন। আর এজন্য তাঁর হাতে জাঁতা ঘুরানোর দাগ পড়ে গিয়েছিল। এমনিভাবে তিনি নিজেই পানির মশক বয়ে আনতেন। এতে তাঁর বুকে দড়ির দাগ পড়েছিল। ঘরের সকল কাজ তিনি নিজে করতেন। নিজে ঝাড়ু দিতেন। সাহাবিগণ একদিন নবি করিম (স.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, কোন প্রকার উপার্জন উত্তম? নবি করিম (স.) জবাবে বলেন, 'মানুষের নিজ হাতের কাজের বিনিময় এবং সৎ ব্যবসায় থেকে প্রাপ্ত মুনাফা।' (সুনানে আহমাদ)
সর্বশ্রেষ্ঠ মানব প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) নিজে এবং তাঁর সাহাবিগণ জীবিকার জন্য পরিশ্রম করতে লজ্জাবোধ করতেন না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা শ্রমজীবীদের প্রশংসায় বলেন, "এমন বহুলোক আছে যারা জমিনের দিকে ভ্রমণ করে ও আল্লাহর অনুগ্রহ খুঁজে বেড়ায়।" (সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত ২০)
ইসলামে শ্রমিকের মজুরি সাথে সাথে আদায় করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এ সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেন, 'মজুরের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি আদায় করে দেবে।' (বায়হাকি)
সুতরাং আমরা সবাই শ্রমের প্রতি মর্যাদাশীল হবো, নিজেদের কাজ নিজেরাই করব এবং আমরা নিজেরা স্বাবলম্বী হবো।
দলগত কাজ: কী কী কাজ শিক্ষার্থী নিজেরা করতে পারে তার একটি তালিকা তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করবে। |
মহান আল্লাহর অন্যতম গুণ ক্ষমা। সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য মানুষের এ গুণটি থাকা খুবই প্রয়োজন।
ক্ষমার আরবি প্রতিশব্দ 'আফ্টন' -এর অর্থ মাফ করা, প্রতিশোধ গ্রহণ না করা। ইসলামি পরিভাষায় এর অর্থ হলো প্রতিশোধ গ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নিয়ে মাফ করে দেওয়া।
গুরত্ব
মহান আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি মানুষকে অনেক নিয়ামত দান করেছেন। মানুষের সুখ-শান্তির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু মানুষ তার অজ্ঞতার কারণে সেই সর্বশক্তিমান প্রভুর কথা ভুলে যায়, তার হুকুম অমান্য করে, তার সাথে অংশীদার স্থাপন করে। পরে যখন মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, তখন আল্লাহ মানুষকে ক্ষমা করে দেন। মহান আল্লাহর ঘোষণা "তিনিই তার বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং পাপসমূহ ক্ষমা করেন।" (সূরা আশ-শুরা, আয়াত ২৫)
আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী হওয়া সত্ত্বেও মানুষকে ক্ষমা করে দেন। মহান আল্লাহ তার রাসুল (স.)-কে ক্ষমার নীতি অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন,
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَهِلِينَ
অর্থ: "আপনি ক্ষমা করুন, সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলুন।" (সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৯৯) মহান আল্লাহ আরও বলেন,
فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ
অর্থ: "অতএব, আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।" (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৫৯)
যেসব মানুষ আল্লাহ এবং তার দেওয়া বিধান অমান্য করে, পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হয় সর্বশক্তিমান আল্লাহ সেসব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।
ক্ষমার ব্যাপারে মহান রাব্বুল আলামিনের নীতি ও আদর্শ আমাদের অনুসরণ করা আবশ্যক। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, কোনো কাজে বা কথায় তার ভুলত্রুটি হয়ে যেতে পারে। অতএব, অন্যের ভুলভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতিসমূহ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে আমাদের দেখা উচিত।
মানুষকে ক্ষমা করলে আল্লাহ খুশি হন এবং যে ক্ষমা করে আল্লাহ তার গুনাসমূহ ক্ষমা করে দেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَإِنْ تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
অর্থ: "আর যদি তুমি তাঁদের মার্জনা কর, তাঁদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা কর এবং ক্ষমা কর, তবে জেনে রেখো আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।" (সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত ১৪)
মহানবি (স.) ছিলেন ক্ষমার মূর্ত প্রতীক। একবার এক ইহুদি মহিলা প্রিয় নবি (স.)-কে তার বাড়িতে দাওয়াত দেন এবং বিষ মিশ্রিত ছাগলের গোশত তাঁকে খেতে দেন। রাসুল (স.) উক্ত গোশতের কিছু খেতেই বিষক্রিয়া অনুভব করেন। পরে ঐ মহিলা গোশতে বিষ দেওয়ার কথা স্বীকার করে। কিন্তু প্রিয় নবি (স.) তাকে ক্ষমা করে দেন। এমনিভাবে মক্কা বিজয়ের পর মহানবি (স.) প্রাণের শত্রুদেরকেও ক্ষমা করে দেন। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, 'আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোমরা মুক্ত স্বাধীন।' পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ ক্ষমার উদাহরণ আর দ্বিতীয়টি নেই। অপরাধীকে ক্ষমা করলে অপরাধী লজ্জিত হয়ে অপরাধ ছেড়ে দেয়। শত্রুকে ক্ষমা করলে শত্রু বন্ধুতে পরিণত হয়। আমরা অন্যকে ক্ষমা করব। অন্যকে ভালোবাসব।
একক কাজ: শিক্ষার্থীরা ক্ষমার ছোট ছোট ঘটনা যা নিজের জীবনে ঘটেছে, তা নিজের ভাষায় লিখে শিক্ষককে দেখাবে। |
বাড়ির কাজ: ক্ষমার গুরুত্ব বর্ণনা কর। |
এমন কিছু আচরণ বা কাজ যা মানুষকে হীন, নিচু ও নিন্দনীয় করে তোলে, সেগুলোকে আখলাকে যামিমাহ্ বা নিন্দনীয় আচরণ বলে। নিন্দনীয় আচরণগুলো হচ্ছে হিংসা, ক্রোধ, লোভ, প্রতারণা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, ইভটিজিং, ছিনতাই প্রভৃতি। এ নিন্দনীয় আচরণগুলো মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে কলুষিত করে। এ চরিত্রের অধিকারীকে মানুষ ঘৃণা করে। ইহকাল ও পরকালে সে ঘৃণিত ও অভিশপ্ত হবে। জাহান্নামের নিম্নস্তরে পৌঁছে যাবে। (তাবারানি)
আখলাকে যামিমাত্র কুফল
১. ঘৃণার পাত্র
হীন বা মন্দ চরিত্রের লোকেরা সমাজের কাছে যেমনিভাবে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়, তেমনিভাবে পরিবারের কাছেও ঘৃণিত হয়। পরকালেও সে ঘৃণিত ও অভিশপ্ত হবে। এ প্রসঙ্গে মহানবি (স.) বলেন, 'বান্দা তার কুচরিত্রের কারণে জাহান্নামের নিম্নস্তরে পৌঁছে যাবে।' (তাবারানি)
২. জান্নাত থেকে বঞ্চিত
মন্দ চরিত্রের লোকেরা পরকালে জান্নাত লাভ করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে মহানবি (স.) বলেন,
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ الْجَوَاظُ وَلَا الْجَعْظَرِي
অর্থ: 'দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।' (আবু দাউদ)
চরিত্র সংশোধন ব্যতীত আত্মার সংশোধন সম্ভব হয় না। এজন্য চারিত্রিক দুর্বলতার সব দিকগুলোর সংশোধন করা আবশ্যক।
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে অসদাচরণের কুফলগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে। |
অন্যের সুখ-সম্পদ, মানসম্মান নষ্ট হওয়ার কামনা এবং নিজে এর মালিক হওয়ার বাসনা করাকে হিংসা বলে। হিংসা শব্দের আরবি প্রতিশব্দ 'হাসাদুন' )حَسَدٌ(, যার অর্থ হিংসা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি।
অপকারিতা
হিংসা একটি মারাত্মক মানসিক ব্যাধি। হিংসা বহু কারণে সৃষ্টি হয়। যেমন: শত্রুতা, লোভ, অহংকার, নিজের অসৎ উদ্দেশ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা, নেতৃত্বের লোভ ইত্যাদি। এসব কারণে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ করে থাকে। ইসলাম এ কাজগুলোকে হারাম ঘোষণা করেছে। হিংসার অপকারিতা সীমাহীন। হযরত আদম (আ.)-এর মর্যাদা দেখে ইবলিস তাঁর প্রতি হিংসা করে। ফলে সে অভিশপ্ত হয়। আল্লাহ তায়ালার দয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
মানব সৃষ্টির পর হিংসার কারণেই সর্বপ্রথম পাপ সংঘটিত হয়। আদম (আ.)-এর পুত্র কাবিল হিংসার বশবর্তী হয়ে তারই আপন ভাই হাবিলকে হত্যা করে। হিংসা মানুষের ভালো কাজগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এ সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেছেন,
إِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ
অর্থ: 'আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়, হিংসা তেমনই পুণ্যকে ধ্বংস করে দেয়।' (ইবনু মাজাহ)
হিংসা মানুষের শান্তি বিনষ্ট করে। মনে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রাখে। হিংসুক ব্যক্তি আল্লাহ এবং মানুষের কাছে ঘৃণিত। কেউ তাকে ভালোবাসে না। কেউ তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে না। সমাজের লোকেরা তাকে এড়িয়ে চলে। হিংসা সমাজে ঝগড়া-ফাসাদ, মারামারি এবং অশান্তি সৃষ্টি করে। মানুষের মনে অহংকার সৃষ্টি হয়। অহংকার মানুষের পতন ঘটায়।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজিদে হিংসা থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
অর্থ: "আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই যখন সে হিংসা করে।" (সূরা আল-ফালাক, আয়াত ৫)
আল্লাহ তায়ালা হিংসা বর্জনকারীকে ভালোবাসেন। হিংসা বর্জনকারী জান্নাত লাভ করবেন। প্রিয় নবি একবার তাঁর এক সাহাবিকে জান্নাতি বলে ঘোষণা দেন। তিনি কী আমল করেন এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা যাকে কোনো উত্তম বস্তু দান করেছেন আমি তার প্রতি কখনোই হিংসা পোষণ করি না। (ইবনু মাজাহ)
আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিৎ 'আমরা হিংসা করব না। নিজের ক্ষতি করব না। সমাজের শান্তি বিনষ্ট করব না।'
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে হিংসার কুফলের তালিকা তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করবে। |
'ক্রোধ' এর আরবি প্রতিশব্দ 'গাদাব' (غَضَبٌ) যার অর্থ রাগ। স্বীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়া বা কারো দ্বারা তিরস্কৃত হওয়ার কারণে প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছায় মানুষের মনের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তাকে ক্রোধ বলে। অহংকার, তিরস্কার, ঝগড়া প্রভৃতি কারণে ক্রোধের সৃষ্টি হয়।
ক্রোধ ও রাগের ফলে মানুষ অনেক নির্দয় ও অত্যাচারমূলক কর্মকাণ্ড করে ফেলে। পরবর্তিতে এর কারণে লজ্জিত ও অবজ্ঞার পাত্রে পরিণত হয়। তাই মুসলমানদের উচিত ক্রোধের সময় নিজেকে সংবরণ করা। এ বিষয়ে মহানবি (স.) বলেন,
لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرْعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ
অর্থ: 'শক্তিশালী সেই ব্যক্তি নয়, যে খুব কুস্তি লড়তে পারে। বরং প্রকৃত শক্তিশালী হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।' (বুখারি ও মুসলিম)
অপকারিতা
ক্রোধ একটি নিন্দনীয় বিষয়। এটি মানুষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। আর হিংসা মানুষের সৎকর্মসমূহ শেষ করে দেয়। ক্রোধের সময় মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সে নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। ক্রোধ মানুষের ইমানকে ধ্বংস করে দেয়। এ সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেন, 'সিরকা মধুকে যেভাবে বিনাশ করে, ক্রোধও ইমানকে তদ্রূপ নষ্ট করে।' (বায়হাকি)
ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আল্লাহর গযব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। প্রিয় নবির সাহাবি হযরত ইবনু উমার (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে জানতে চাইলেন, এমন কোনো কাজ আছে যা আল্লাহ তায়ালার গযব থেকে রক্ষা করবে? রাসুল (স.) বলেন, 'তুমি রাগ করবে না।' (তাবারানি)
ক্রোধ সংবরণ করা একটি পুণ্যের কাজ। রাসুল (স.)-এর এক সাহাবি একবার রাসুল (স.)-কে বললেন, 'হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমাকে একটি ভালো কাজের নির্দেশ দিন।' প্রিয় নবি (স.) তাকে বললেন 'তুমি রাগ করবে না।' (বুখারি)
মহানবি (স.) বলেছেন, 'ক্রোধ শয়তানের পক্ষ থেকে আসে, শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুনকে পানি ঠাণ্ডা করে। যদি কারো রাগ হয়, তবে তার উচিত ওযু করে নেওয়া।' (বুখারি ও মুসলিম)
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ক্রোধ পরিহারের উপায়গুলো বের করবে এবং পোস্টারে লিখে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করবে। |
বাড়ির কাজ: 'ক্রোধ একটি নিন্দনীয় বিষয়'- ব্যাখ্যা কর। |
লোভ-এর আরবি প্রতিশব্দ 'হিরছুন' (حُصُ) এর অর্থ লালসা, লিপ্সা, মোহ, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা ইত্যাদি। অধিক পাওয়ার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষাকে লোভ বলে। যেমন: অর্থ-সম্পদের লোভ, পদমর্যাদার লোভ, খাদ্যদ্রব্যের লোভ, পোশাক-পরিচ্ছদের লোভ ইত্যাদি।
লোভের কুফল
লোভ মানুষের মনের শান্তি বিনষ্ট করে। অধিক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মানুষকে সারাক্ষণ বিভোর রাখে। ফলে নিজের কাছে যা আছে তাতে তুষ্ট না থেকে আরও পাওয়ার আশায় সে অস্থির থাকে। লোভ মানুষকে নানা প্রকার অপরাধমূলক কাজের দিকে ধাবিত করে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, কালোবাজারি, মজুদদারি, দ্রব্যে ভেজাল দেওয়া, সুদ-ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজ লোভের কারণেই সংঘটিত হয়।
লোভী ব্যক্তি অন্যের ধন-সম্পদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং অবৈধ উপায়ে তা হস্তগত করার চেষ্টা করে। ইসলাম এরূপ লোভকে নিষিদ্ধ করেছে। প্রিয় নবি (স.) বলেছেন, 'তোমরা লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাক। কেননা এই জিনিসই তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছে এবং পরস্পরকে রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে উস্কে দিয়েছে। আর এই লোভ-লালসার কারণেই তারা হারামকে হালাল সাব্যস্ত করেছে।' (সহিহ্ মুসলিম)
খাদ্যের প্রতি লোভে অনেকে মাত্রাতিরিক্ত খায়। এতে সে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আবার কখনো তা তার জীবন নাশেরও কারণ হয়। আর তাই কথায় বলে, 'লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।'
লোভ থেকে বাঁচার উপায়
ধৈর্য এবং অল্পে তুষ্টির গুণ থাকলে লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকা যায়। রাসুল (স.) বলেছেন, 'ইমান এবং লোভ এক অন্তরে একত্রিত হতে পারে না, কেননা ইমানের পরিনাম হচ্ছে ধৈর্য, তাওয়াক্কুল এবং অল্পে তুষ্ট থাকা।' (নাসাই ও তিরমিযি)
তকদিরের উপর বিশ্বাস রাখা লোভ দমনের প্রধান উপায়। মহানবি (স.) বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা চাওয়ার ক্ষেত্রে উত্তম পন্থা অবলম্বন কর। কেননা বান্দার ভাগ্যে যা নির্ধারিত আছে তার অতিরিক্ত সে পাবে না।’ (হাকিম)
জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সহজ-সরল পথ অবলম্বন করলে লোভ বর্জন করা সম্ভম্ব হয়। আমরা লোভের কুফল জানব। লোভ বর্জন করব। তকদিরে বিশ্বাস করব। অল্পে তুষ্ট থাকব। নিজেরা সুখে থাকব। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করব।
দলগত কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে লোভের কুফল আলোচনা করে লোভ বর্জনের উপায়গুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে। |
প্রতারণার আরবি প্রতিশব্দ 'আল-গাশু' (اَلْغَشُ) যার অর্থ ঠকানো, ফাঁকি দেওয়া, প্রবঞ্চনা ও ধোঁকা। কথাবার্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে ধোঁকা দেওয়াকে প্রতারণা বলে। পণ্যদ্রব্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রেখে বিক্রি করা, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা ইত্যাদি প্রতারণার অন্তর্ভুক্ত।
কুফল
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতারণা একটি মানবতাবিরোধী অতি গর্হিত কাজ। এটি মিথ্যার শামিল। ইসলাম সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণকে সমর্থন করে না। কুরআন মজিদে ঘোষণা করা হয়েছে
وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقِّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
অর্থ: "তোমরা সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণ করো না এবং জেনে-শুনে সত্যকে গোপন করো না।" (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৪২)
প্রতারণা একটি সামাজিক অপরাধ। কারণ এর ফলে মানুষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে। সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়। সমাজের মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। প্রতারণাকারী খাঁটি মুসলমান নয়। আমাদের নবি (স.) একদিন বাজারে গিয়ে খাদ্যদ্রব্যের একটি বড় স্তূপ দেখতে পান। স্তূপটির উপরিভাগের দ্রব্য শুকনো ছিল। কিন্তু স্তূপটির ভিতরের অংশও শুকনো আছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য তিনি ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তখন তিনি ভিতরের অংশ ভিজা দেখতে পেলেন। রাসুলুল্লাহ (স.) মালিকের কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। মালিক জানাল তাতে বৃষ্টির পানি লেগেছে। তখন রাসুল (স.) তাকে বললেন, তুমি ভেজা খাদ্য উপরে রাখলে না কেন? যাতে লোকেরা তা দেখতে পেত?
এ প্রসঙ্গে মহানবি বললেন,
مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا
অর্থ: 'যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দেয় সে আমাদের দলভুক্ত নয়।' (মুসলিম)
প্রতারণা মুনাফিকের কাজ। এর শাস্তি বড় কঠিন। সত্যিকার ইমানদার ব্যক্তি কখনোই প্রতারণার আশ্রয় নেয় না। মানুষকে ধোঁকা দেয় না। অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না।
আমরা প্রতারণা করব না।
মানুষকে ধোঁকা দেবো না।
অঙ্গীকার ভঙ্গ করব না।
দলগত কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে প্রতারণার কুফল আলোচনা করবে এবং এগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে। |
বাড়ির কাজ : তুমি বা তোমার পরিবারের কেউ প্রতারিত হয়ে থাকলে সে ঘটনা সংক্ষেপে লেখ। |
পিতামাতার অবাধ্য হওয়া বলতে বোঝায়, তাঁদের শ্রদ্ধা ও সম্মান না করা। পিতামাতার কথামতো না চলা, তাঁদের নির্দেশ অমান্য করা। আল্লাহর অনুগ্রহের পর সন্তানদের প্রতি পিতামাতার অনুগ্রহ সবচেয়ে বেশি। তাঁরা সন্তানের আপনজন। তাঁদের স্নেহ-মমতায় সন্তান লালিত-পালিত হয়। সন্তানের আরাম আয়েশের জন্য তাঁরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য তাঁরা সবরকম ব্যবস্থা করেন। কাজেই সন্তানের কর্তব্য হলো পিতামাতার বাধ্য থাকা।
পিতামাতার অবাধ্য হওয়া জঘন্য অপরাধ। এর অপকারিতা অনেক।
অপকারিতা
১. শিকের পর সবচেয়ে বড় গুনাহ পিতামাতার অবাধ্য হওয়া।
২. পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার পাপ এত ভয়াবহ যে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এ পাপ ক্ষমা করেন না। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, 'মহান আল্লাহ তার ইচ্ছা অনুযায়ী সকল পাপই ক্ষমা করে দেন। কিন্তু পিতামাতার অবাধ্যতার পাপ তিনি ক্ষমা করেন না।' (বায়হাকি)
৩. পিতামাতার অবাধ্য হলে পরকালে জাহান্নামের কঠিন আগুনে জ্বলতে হবে।
এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, 'তাঁরাই (পিতামাতা) তোমার বেহেশত ও দোযখ।' (ইবনু মাজাহ)
অর্থাৎ পিতামাতার সন্তুষ্টির উপর যেমন সন্তানের জান্নাত লাভ নির্ভর করে, ঠিক তেমনি তাঁদের অসন্তুষ্টির কারণে সন্তান দোযখবাসী হবে। নবি করিম (স.) আরও বলেন, 'তার নাক ধূলিমলীন হোক, আবার তার নাক ধূলিমলীন হোক, আবার তার নাক ধূলিমলীন হোক।' তাঁকে জিজ্ঞাস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! সে কে? তখন তিনি বললেন, 'যে ব্যক্তি পিতামাতার যেকোনো একজনকে অথবা উভয়কে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল, তবুও সে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারল না।' (মুসলিম)
৪. মাতার অবাধ্য হওয়াকে আল্লাহ তায়ালা হারাম ঘোষণা করেছেন।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, 'আল্লাহ তোমাদের জন্য মায়েদের অবাধ্য হওয়াকে হারাম করে দিয়েছেন।'
(সহিহ বুখারি)
৫. পিতা সন্তানের প্রতি অসন্তুষ্ট হলে আল্লাহ তায়ালাও তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, 'পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।' (তিরমিযি)
পিতামাতা সন্তানের কল্যাণেই কখনো তাঁদের শাসন করেন বা কড়া কথা বলেন। এটা সন্তানকে মেনে নিতে হবে। এতে তার ভবিষ্যৎ সুখময় হবে।
আমরা পিতামাতার আদেশ-নিষেধ মেনে চলব। এটি মানবিক দায়িত্ব। এতে তাঁরা সন্তুষ্ট থাকবেন। আল্লাহ আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন।
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা দলে ভাগ হয়ে পিতামাতার অবাধ্যতার পরিণতি কী তার একটি তালিকা তৈরি করবে। |
ইভটিজিং শব্দটি ইভ (Eve) ও টিজিং (Teasing)-এর একত্রিতরূপ। বাইবেল অনুসারে প্রথম নারীর নাম ইভ(Eve)। এখানে 'ইভ' বলতে নারী সমাজকে বোঝানো হয়েছে। আর 'Tease' অর্থ পরিহাস, জ্বালাতন করা, উত্ত্যক্ত করা, খেপানো। ইভটিজিং (যৌন হয়রানি) বলতে কথা, কাজ, আচরণ ইত্যাদির মাধ্যমে নারীদের উত্ত্যক্ত করাকে বোঝানো হয়েছে। নারীদের প্রতি অশালীন উক্তি করা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা ইভটিজিংয়ের (যৌন হয়রানির) অন্তর্ভুক্ত।
১৯৭৬ সালে প্রণীত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স-এ ইভটিজিং-কে সংজ্ঞায়িত করা হয়। যাতে বলা হয় যে, রাস্তা বা জনসম্মুখে কোনো নারীকে অশোভন শব্দ, অঙ্গভঙ্গি ও মন্তব্যের মাধ্যমে যৌন উৎপীড়ন করা ইভটিজিং হিসেবে গণ্য হবে।
অপকারিতা
ইভটিজিং (যৌন হয়রানি) একটি সামাজিক ব্যাধি। নারীদেরকে উত্ত্যক্ত করা, কাউকে মন্দনামে ডাকা বা উপহাস করা গর্হিত কাজ। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ ط بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَّمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّلِمُونَ
অর্থ: "তোমরা একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করবে না এবং একে অপরকে মন্দনামে ডাকবে না। ইমান গ্রহণের পর মন্দনামে ডাকা বড় ধরনের অপরাধ। যারা তওবা না করে তারাই যালিম।" (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১১)
বর্তমানে প্রায়ই স্কুল-কলেজের সামনে, রাস্তার মোড়ে, গলির মুখে কিছু বখাটে ছেলে দাঁড়িয়ে মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত করে। এর ফলে অনেক মেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, প্রয়োজনীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। কেউ কেউ আবার আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। এতে সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হয়। সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। জাতি ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়।
প্রতিকার
১৯৭৬ সালে প্রণীত বাংলাদেশ আইনে ইভটিজিং (যৌন হয়রানি) একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়েছে। এর শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। পারিবারিক অনুশাসন, ধর্মীয় শৃঙ্খলা, সামাজিক সচেতনতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আমরা ইভটিজিংয়ের (যৌন হয়রানির) মতো খারাপ কাজ করব না। আমরা সবসময় ভদ্র, নম্র, শালীন আচরণ করব। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করব।
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা ইভটিজিংয়ের (যৌন হয়রানির) ফলে কী কী সামাজিক ক্ষতি হয় তার একটি তালিকা তৈরি কর। |
বাড়ির কাজ: সমাজে ইভটিজিং (যৌন হয়রানি) প্রতিরোধ করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তার একটি তালিকা তৈরি কর। |
জোরপূর্বক বা বল প্রয়োগ করে অন্যের সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়াকে ছিনতাই বলে। ছিনতাই একটি সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড। এতে সমাজের শান্তি বিনষ্ট হয়। মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। নিরপত্তাহীনতায় থাকে।
কুফল
ছিনতাই একটি জঘন্য সামাজিক অনাচার। এটি চুরি-ডাকাতি অপেক্ষা মারাত্মক। ছিনতাই সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে। সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। এর ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। মানুষের মূল্যবান অর্থ সম্পদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। ফলে সমাজে ও রাষ্ট্রে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়।
ছিনতাইকারী দুনিয়াতে ও আখিরাতে নির্মম শাস্তি ভোগ করবে। এ সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেন,
مَنْ أَخَذَ شِبْرًا مِنَ الْأَرْضِ ظُلْمًا فَإِنَّهُ يُطَوَّقَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ سَبْعِ أَرْضِينَ
অর্থ: 'যে ব্যক্তি সামান্য পরিমাণ জমি ছিনতাই করে, কিয়ামতের দিন সাতগুণ জমি তার গলায় বেড়িরূপে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।' (বুখারি ও মুসলিম)
যে ছিনতাই করে তার পূর্ণ ইমান থাকে না। এ সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেন, 'কোনো ব্যক্তি প্রকাশ্যে ছিনতাই ও লুটতরাজ করলে সে মুমিন থাকে না'
ছিনতাই বর্বর যুগের চরিত্রবিশেষ। ইসলাম এ বর্বরতাকে সমূলে উৎপাটন করার লক্ষ্যে ঘোষণা করেছে
لا ضَرَرَ وَلَا صِرَارَ فِي الْإِسْلَامِ
অর্থ: 'ইসলামি বিধানে না নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নিয়ম আছে, না অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার নিয়ম আছে।'
পবিত্র কুরআন মজিদে এবং মহানবি (স.)-এর হাদিসে ছিনতাই, ডাকাতি, লুটতরাজ ইত্যাদি অপকর্মের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রতিকার
এ ধরনের সামাজিক অপরাধ, অনাচার, অত্যাচার থেকে আমাদের মুক্তি পাওয়া একান্ত প্রয়োজন। সেজন্য সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন।
মানুষকে ছিনতাই-এর কুফল সম্পর্কে সচেতন করা এবং কুরআন ও হাদিসের আলোকে এর অপকারিতা সম্পর্কে অবহিত করা প্রয়োজন।
অপরাধীদেরকে এরূপ সামাজিক অনাচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে।
সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে এ ধরনের অনাচার সমাজ থেকে দূর হবে।
আমরা ছিনতাইয়ের কুফল অনুধাবন করব। এ ধরনের জঘন্য কাজে লিপ্ত হবো না। এ জঘন্য কাজ যারা করে তাদেরকে এ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করব।
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে ছিনতাইয়ের কুফল আলোচনা করে এর প্রতিকারের উপায়গুলো পোস্টার লিখে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে। |
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. কোন যুদ্ধে বিজয়ের পর ইহুদি মহিলা মহানবি (স.)-কে বিষ মিশ্রিত গোশত খেতে দেয়?
ক. বদর
খ. উহ্রদ
গ. খাইবার
ঘ. হুনাইন
২. 'নামায শেষে তোমরা জমিনের বুকে ছড়িয়ে পড়।' আল্লাহ তায়ালার এ নির্দেশের উদ্দেশ্য কী?
ক. শ্রমিকের অধিকার বর্ণনা করা
খ. নামাযের গুরুত্ব বর্ণনা করা
গ. শ্রমের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা
ঘ. শ্রমের গুরুত্ব বর্ণনা করা
৩. শালীনতার গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ তা মানুষকে
i. আল্লাহর অনুগত বান্দা হতে সাহায্য করে
ii. পরিবেশের প্রতি সদাচরণে সহায়তা করে
iii. অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. i ও ii
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii
নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৩ ও ৪ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও:
জাবির আবিরের নিকট একটি বই জমা রাখল। দুই দিন পর ফেরত চাইলে আবির বইটি ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়।
৪. আবিরের দ্বারা কী লঙ্ঘিত হয়েছে?
ক. আহদ
খ. আমানত
গ. আদল
ঘ. তাহসিব
৫. আবিরকে বলা যায় -
ক. মুশরিক
খ. মুনাফিক
গ. ফাসিক
ঘ. কাফির
সৃজনশীল প্রশ্ন
১। শিল্পপতি জামিল সাহেব তাঁর গার্মেন্টসে কর্মীদের যথাসময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পরিশোধ করেন। তিনি কর্মীদেরকে সততার সাথে কাজ করার পাশাপাশি তৈরি পোষাকের গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য কঠোর নির্দেশ দেন। তারপরও এক কর্মী জনাব মাযহার আলী ইচ্ছাকৃতভাবে কাপড় কম দিয়ে পোশাক তৈরি করে এবং বিষয়টি গোপন রাখে। এতে জামিল সাহেবের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে জামিল সাহেব ঐ কর্মীর বেতন বন্ধ করে দেন। এক পর্যায়ে সামান্য বেতনের ঐ কর্মচারীর পরিবারের সমস্যার কথা বুঝতে পারলে জামিল সাহেব ঐ কর্মচারীকে ক্ষমা করে বেতন চালু করে দেন।
(ক) শালীনতা কী?
(খ) যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়- হাদিসটি ব্যাখ্যা কর।
(গ) জামিল সাহেবের আচরণে যে গুণটি সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে তা ব্যাখ্যা কর।
(ঘ) জনাব মাযহার আলীর কর্মকাণ্ডটি পাঠ্যবইয়ের আলোকে ব্যাখ্যা কর।
২। জসিম সাহেবের বাড়িতে রজব মিয়া মাসিক দুই হাজার টাকা বেতনে কাজ করে। বেতনের টাকাগুলো জসিম সাহেবের নিকটই জমা রাখেন। এভাবে দুই বছর কাজ করার পর ঢাকা শহরে বেড়াতে এসে নিখোঁজ হন। এ অবস্থায় জমানো টাকা দিয়ে জসিম সাহেব তার এলাকায় এক বিঘা জমি ক্রয় করে রজব মিয়ার নামে কওলা করেন। দীর্ঘ দশ বছর পরে রজব মিয়া জসিম সাহেবের বাড়িতে ফিরে আসলে, জসিম সাহেব তার জমির দলিল হাতে দিয়ে জমি বুঝিয়ে দেন। অপরদিকে আরমান সাহেবের ড্রাইভার রমিজ মিয়া বিদেশে যাওয়ার জন্য জমি বিক্রি করে আরমান সাহেবের নিকট দুই লাখ টাকা দেন। আরমান সাহেব তাকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে একটি জাল ভিসা তৈরি করে দেন। রমিজ মিয়া এর মাধ্যমে বিদেশে যেতে ব্যর্থ হয়ে টাকা ফেরত চাইলে আরমান সাহেব বলেন, তোমাকে ভিসা দেওয়া হয়েছে, কাজেই তুমি বিদেশে যেতে না পারার দায়ভার আমি বহন করব না।
(ক) পরোপকার কী?
(খ) আখলাকে যামিমাহ্ বলতে কী বোঝায়?
(গ) জসিম সাহেবের কাজটির মাধ্যমে কোন বিষয়টি রক্ষা পেয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
(ঘ) রমিজ মিয়ার সাথে আরমান সাহেবের আচরণের পরিণতি কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ কর।
Read more