অণুজীবঃ খালি চোখে দেখা যায় না, শুধু অণুবীক্ষণযন্ত্রে দেখা যায়, এমন জীবকে অণুজীব (Microbes) বলা হয়। জীববিজ্ঞানের যে শাখায় অণুজীব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, সে শাখাকে অণুজীবতত্ত্ব বা মাইক্রোবায়োলজি (Microbiology) বলা হয়ে থাকে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, মাইক্রোপ্লাজমা, রিকেটসিয়া ও অ্যাকটিনোমাইসিটিস প্রভৃতি অণুজীবের অন্তর্ভুক্ত।
ভাইরাস একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ বিষ (poison)।ভাইরাস হলো নিউক্লিক এসিড ও প্রোটিন সমন্বয়ে গঠিত এক প্রকার অতি-আণুবীক্ষণিক অকোষীয় সত্য যা কেবল উপযুক্ত জীবকোষের অভ্যন্তরে বংশবৃদ্ধি করতে পারে এবং বিশেষ বিশেষ রোগ সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু জীবকোষের বাইরে জড় বস্তুর মত অবস্থান করে।
আবিষ্কারঃ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মান বিজ্ঞানী চার্লস এনকুজ (Charles Encluse) সর্বপ্রথম ভাইরাসের অস্তিত্ব অনুধাবন করেন বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার (Edward Jenner) ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভাইরাসঘটিত রোগের কথা উল্লেখ করেন। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম ভাইরাস সৃষ্ট মোজাইক রোগের বর্ণনা দেন বিজ্ঞানী অ্যাডোলফ মায়ার (Air Mayer)। তিনি তামাক গাছের পাতায় ভাইরাসজনিত রোগ পর্যবেক্ষণ করেন এবং নাম দেন তামাকের মোজাইক রোগ । ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রুশ জীবাণুবিদ দিমিত্রি আইভানোভসকি (Dmitri Iwanowsky) তামাক গাছের মোজাইক রোগের কারণ হিসেবে ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণ করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান বিজ্ঞানী স্ট্যানলি (Stanley) তামাকের মোজাইক ভাইরাস (TMV)-কে রোগাক্রান্ত তামাক পাতা থেকে পৃথক করে কেলাসিত করতে সক্ষম হন। এজন্য তিনি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পিরি (Piric) এবং বদেন (Bawden) ভাইরাসের দেহ প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিডে গঠিত তা প্রমাণ করেন। ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র আবিষ্কারের পরবর্তী সময়ে (১৯৪০-১৯৯৬) ভাইরাসের এবং মরিস (Morris) ভৌত গঠন সম্বন্ধে নতুন নতুন ধারণা পাওয়া যায় (১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে শেফারম্যান (Shafferman M, মানুষের মরণব্যাধি সায়ানোব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী সায়ানোফাজ আবিষ্কার করেন। গ্যালো ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে এইডস রোগের ভাইরাস আবিষ্কার করেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে মানুষের নীরব ঘাতক হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়।
ভাইরাসের আবাস (Habitat of Virus) : ভাইরাস জীব ও জড় উভয় পরিবেশেই বাস করে, তবে সজীব দেে ভাইরাস সক্রিয় থাকে । উদ্ভিদ, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া, সায়ানোব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রভৃতি জীবদেহের সজীব কোষে ভাইরা সক্রিয় অবস্থান করতে পারে। আবার মাটি, পানি, বায়ু ইত্যাদি সর্বত্রই ভাইরাস বিরাজ করে । বিভিন্ন উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে শুরু করে প্রচন্ড ঠান্ডা পানি এবং ভাইরাস আক্রান্ত জীবের যে কোনো দেহরসে ভাইরাস বাস করতে পারে ।
ভাইরাসের আয়তন (Size of Virus) : ভাইরাস অতিক্ষুদ্র জীবসত্তা, ইলেক্ট্রণ অণুবীক্ষণযন্ত্র ছাড়া এগুলো দেখা যায় না। ভাইরাসের গড় ব্যাস ৮-৩০০ ন্যানোমিটার (nm)। তবে কিছু ভাইরাস এর চেয়ে বড় হতে পারে। গবাদি পশুর ফুট অ্যান্ড মাউথ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস সবচেয়ে ক্ষুদ্র ৮-১২ ন্যানোমিটার। ভ্যাকসিনিয়া ও ভিরিওলা ভাইরাসগুলো বেশ বড়, ২৮০-৩০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত হয়।)
১। আকৃতি অনুযায়ী (According to shape)
(i) দণ্ডাকার : এদের আকার অনেকটা দণ্ডের মতো।
উদাহরণ- টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV), আলফা-আলফা মোজাইক ভাইরাস, মাম্পস ভাইরাস।
(ii) গোলাকার : এদের আকার অনেকটা গোলাকার।
উদাহরণ-পোলিও ভাইরাস, TIV, HIV, ডেঙ্গু ভাইরাস।
(iii) ঘনক্ষেত্রাকার/বহুভুজাকার : এসব ভাইরাস দেখতে অনেকটা পাউরুটির মতো। যেমন- হার্পিস, ভ্যাকসিনিয়া ভাইরাস।
(iv) ব্যাঙ্গাচি আকার : এরা মাথা ও লেজ- এ দুই অংশে বিভক্ত।
উদাহরণ- T2 , T4, T6 ইত্যাদি।
(v) সিলিন্ড্রিক্যাল/সূত্রাকার : এদের আকার লম্বা সিলিন্ডারের মতো। যেমন- Ebola virus ও মটরের স্ট্রিক ভাইরাস।
(vi) ডিম্বাকার : এরা অনেকটা ডিম্বাকার। উদাহরণ- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস।
২। নিউক্লিক অ্যাসিডের ধরন অনুযায়ী (According to the types of nucleic acid)
(i) DNA ভাইরাস : যে ভাইরাসে নিউক্লিক অ্যাসিড হিসেবে DNA থাকে তাদেরকে DNA ভাইরাস বলা হয়।
উদাহরণ- T 2 ভাইরাস, ভ্যাকসিনিয়া, ভ্যারিওলা, TIV (Tipula Iridiscent Virus), এডিনোহার্পিস সিমপ্লেক্স ইত্যাদি ভাইরাস।
(ii) RNA ভাইরাস : যে ভাইরাসে নিউক্লিক অ্যাসিড হিসেবে RNA থাকে তাদেরকে RNA ভাইরাস বলা হয়।
উদাহরণ- TMV, HIV, ডেঙ্গু, পোলিও, মাম্পস, র্যাবিস ইত্যাদি ভাইরাস।
৩। বহিস্থ আবরণ অনুযায়ী (According to the external covering)
(i) বহিস্থ আবরণহীন ভাইরাস;
যেমন- TMV, T 2 ভাইরাস।
(ii) বহিস্থ আবরণী ভাইরাস;
যেমন- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, হার্পিস, HIV ভাইরাস।
৪। পোষকদেহ অনুসারে (According to the host body)
(i) উদ্ভিদ ভাইরাস : উদ্ভিদদেহে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসকে উদ্ভিদ ভাইরাস বলে। যেমন- TMV, Bean Yellow Virus (BYV)। ব্যতিক্রম ফুলকপির মোজাইক ভাইরাস (DNA)।
(ii) প্রাণী ভাইরাস : প্রাণিদেহে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসকে প্রাণী ভাইরাস বলে। যেমন—HIV, ভ্যাকসিনিয়া ভাইরাস।
(iii) ব্যাকটেরিওফাজ বা ফাজ ভাইরাস : ভাইরাস যখন ব্যাকটেরিয়ার উপর পরজীবী হয় এবং ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে তখন তাকে ব্যাকটেরিওফায বলে। যেমন: T 2 ,T4,T6 ব্যাকটেরিওফায।
(iv) সায়ানোফাজ : সায়ানোব্যাকটেরিয়া (নীলাভ সবুজ শৈবাল) ধ্বংসকারী ভাইরাসকে সায়ানোফায বলে। যেমন-P1LPP 1 P2LPP2 , (Lyngbya, Plectonema ও Phormidium নামক সায়ানোব্যাকটেরিয়ার প্রথম অক্ষর দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে।)
৫। পোষক দেহে সংক্রমণ ও বংশবৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে (Based on infection and reproduction in the host body) সাধারণ ভাইরাস ও রিট্রোভাইরাস।এখানে ভাইরাল RNA থেকে DNA তৈরি হয়।
৬। অন্যান্য ধরন (Other types)
যে সব ভাইরাস ছত্রাককে আক্রমণ করে থাকে তাদের মাইকোফাজ (Mycophage) বলে।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে Holmes ব্যাকটেরিয়া আক্রমণকারী ভাইরাসকে Phaginae, উদ্ভিদ আক্রমণকারী ভাইরাসকে Phytophaginae এবং প্রাণী আক্রমণকারী ভাইরাসকে Zoophaginae নামকরণ করেন।
পরজীবীতাঃ পরজীবী হিসেবে বেঁচে থাকার চরিত্রকে পরজীবিতা বলে। ভাইরাস বাধ্যতামূলক পরজীবী (obligate parasite)। এটি একটি আদি বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ ভাইরাস তার বংশবৃদ্ধি তথা জীবনের লক্ষণ প্রকাশ করার জন্য সম্পূর্ণভাবে অন্য জীবের সজীব কোষের ওপর নির্ভরশীল। অন্য কোনো জীবের (মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল ইত্যাদি) সজীব কোষ ছাড়া কোনো ভাইরাসই জীবের লক্ষণ প্রকাশ করতে পারে না, বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। কোনো আবাদ মাধ্যমে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি করা বিজ্ঞানীদের পক্ষেও আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
ভাইরাসের পরজীবিতা সাধারণত সুনির্দিষ্ট অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট প্রকারের ভাইরাস কোনো সুনির্দিষ্ট জীবদেহে পরজীবী হয় । যে সব ভাইরাস আদি কোষকে আক্রমণ করে, আর যে সব ভাইরাস প্রকৃত কোষকে আক্রমণ করে তারা ভিন্ন প্রকৃতির। প্রকৃতপক্ষে কোনো ভাইরাসের প্রোটিন আবরণটিই নির্ণয় করে তার আক্রমণের সুনির্দিষ্টতা (specificity)। পোষক কোষে কোনো ভাইরাস- প্রোটিনের জন্য রিসেপ্টর সাইট (receptor site) থাকলে তবেই ঐ ভাইরাস ঐ পোষক কোষকে আক্রমণ করতে পারবে। এ জন্যই ঠাণ্ডা লাগার ভাইরাস (cold virus) শ্বাসতন্ত্রের মিউকাস মেমব্রেন কোষকে আক্রমণ করতে পারে, চিকেন পক্স ভাইরাস ত্বক কোষকে আক্রমণ করতে পারে, পোলিও ভাইরাস ঊর্ধ্বতন শ্বাসনালী ও অন্ত্রের আবরণ কোষ, কখনো স্নায়ু কোষকে আক্রমণ করতে পারে। চিকেন পক্স ভাইরাস শ্বাসনালীকে আক্রমণ করতে পারবে না। কারণ শ্বাসনালী কোষে এর জন্য কোনো রিসেপ্টর সাইট নেই, ঠাণ্ডা লাগার ভাইরাস ত্বক কোষকে আক্রমণ করতে পারবে না, কারণ ত্বক কোষে এই ভাইরাসের জন্য কোনো রিসেপ্টর সাইট নেই।
ফাজ ভাইরাস কেবল ব্যাকটেরিয়া কোষকেই আক্রমণ করে। ফাজ ভাইরাসের মধ্যে T2-ব্যাকটেরিওফাজ E. coli ব্যাকটেরিয়াকেই আক্রমণ করে। TMV ভাইরাস কেবল তামাক গাছকেই আক্রমণ করে। এমনই ভাবে সুনির্দিষ্ট ভাইরাস নির্দিষ্ট প্রকার পোষক কোষকেই আক্রমণ করে থাকে।
ইমার্জিং ভাইরাস (Emerging virus):
যেসব ভাইরাস প্রথমে এক ধরনের পোষকে রোগ সৃষ্টি করে, কিন্তু পরবর্তীতে নতুন পোষকে রোগ সৃষ্টি করার সক্ষমতা অর্জন করে এবং রোগ সৃষ্টি করে- তাদের ইমার্জিং ভাইরাস বলে।
যেমন- করোনা ভাইরাস (SARS-COV-2) এটা প্রথমে শুধু বানরেই রোগ সৃষ্টি করতো । পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়ে মানুষে রোগ সৃষ্টি করছে।
ভিরিয়ন (Virion) :
নিউক্লিক অ্যাসিড ও একে ঘিরে অবস্থিত ক্যাপসিড সমন্বয়ে গঠিত এক একটি সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন সম্পূর্ণ ভাইরাস কণাকে ভিরিয়ন বলে। সংক্রমণ ক্ষমতাবিহীন ভাইরাসকে বলা হয় নিউক্লিয়োক্যাপসিড। প্রতিটি ভিরিয়নে সর্বোচ্চ ২০০০ হতে ২১৩০টি ক্যাপসোমিয়ার থাকে।
ভিরয়েডস (Viroids):
ভিরয়েডস হলো সংক্রামক RNA। Theodore Diener (US এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট) এবং W.S. Rayner ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভিরয়েডস আবিষ্কার করেন। ভিরয়েডস হলো এক সূত্ৰক বৃত্তাকার RNA অণু যা কয়েক শত নিউক্লিয়োটাইড নিয়ে গঠিত এবং ক্ষুদ্রতম ভাইরাস থেকেও বহুগুণে ক্ষুদ্র। কেবলমাত্র উদ্ভিদেই ভিরয়েডস পাওয়া যায়। এরা উদ্ভিদ থেকে উদ্ভিদে এবং মাতৃ উদ্ভিদ থেকে সন্তান সন্ততিতে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। উদ্ভিদ পোষকের এনজাইম ব্যবহার করে এরা সংখ্যাবৃদ্ধি করে। বিজ্ঞানীগণ এখন ধারণা করছেন হেপাটাইটিস-ডি এর কারণ ভিরয়েডস। ভিরয়েড নারিকেল গাছে ক্যাডাং রোগ তৈরি করে।
প্রিয়নস (Prions):
সংক্রামক প্রোটিন ফাইব্রিল হলো প্রিয়নস। এটি নিউক্লিক অ্যাসিডবিহীন প্রোটিন আবরণ মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের Kuru এবং Creutzfeldt রোগ; ভেড়া ও ছাগলের Scrapie রোগ প্রিয়নস দিয়ে হয়ে থাকে। বহুল আলোচিত ‘ম্যাড কাউ’ রোগ সৃষ্টির সাথে প্রিয়নস-এর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ১৯৮২ সালে প্রথম Stanley B, Prusiner অতি ক্ষুদ্র প্রকৃতির প্রিয়নস এর অস্তিত্বের কথা বলেন এবং ভেড়ার স্ক্র্যাপি (Scrapie) রোগে প্রথম পর্যবেক্ষণ (study) করা হয়। এজন্য তাকে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায়; যথা-জড়-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য এবং জীব সদৃশ বৈশিষ্ট্য
জড়-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যঃ
১ ভাইরাস অকোষীয়, অতিআণুবীক্ষণিক ও সাইটোপ্লাজমবিহীন রাসায়নিক পদার্থ ।
২. পোষক দেহের বাইরে এরা কোন জৈবনিক কার্যকলাপ ঘটায় না ।
৩. জীবকোষের বাইরে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে না।
৪. পরিসুত ও কেলাসিত করে ভাইরাসকে স্ফটিকে পরিণত করা যায়।
৫. ভাইরাস আকারে বৃদ্ধি পায় না এবং পরিবেশিক উদ্দীপনায় সাড়া দেয় না ।
৬. এদের নিজস্ব কোন বিপাকীয় এনজাইম নেই।
৭. ভাইরাস রাসায়নিকভাবে প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিডের জীবীয় বৈশিষ্ট্য সমাহার মাত্র।
জীব সদৃশ বৈশিষ্ঠ্যঃ
১. গাঠনিকভাবে ভাইরাসে নিউক্লিক এসিড (DNA বা RNA) আছে।
২. উপযুক্ত পোষক কোষের অভ্যন্তরে ভাইরাস সংখ্যাবৃদ্ধি (multiplication) করতে সক্ষম ।
৩. ভাইরাস সুনির্দিষ্টভাবে বাধ্যতামূলক পরজীবী।
৪. ভাইরাস জিনগত পুনর্বিন্যাস ঘটতে দেখা যায়।
৫. ভাইরাসে প্রকরণ (variation) ও পরিব্যক্তি (mutation) দেখা যায়।
৬. এদের অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে।
৭. নতুন সৃষ্ট ভাইরাসে মাতৃভাইরাসের বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে, অর্থাৎ একটি ভাইরাস তার অনুরূপ ভাইরাস সৃষ্টি করতে পারে।
পরিব্যক্তি (mutation) : নানাবিধ কারণে জীবের বংশগতি উপাদানের এক বা একাধিক জিনের হঠাৎ স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন। এ পরিবর্তন স্থায়ী তাই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরও পরিবর্তন ঘটে।
একটি সংক্রমণযোগ্য ভাইরাস কণাকে ভিরিয়ন (virion) বলে । ভাইরাসের গঠনগত প্রধান দুটি উপাদান হলো ক্যাপসিড (প্রোটিন) ও নিউক্লিক এসিড। এগুলোকে নিউক্লিওক্যাপসিড বা নিউক্লিওপ্রোটিন কণাও বলা হয়। এই ভাইরাসের ক্ষেত্রে সাধারণত নিউক্লিওক্যাপসিড কণার বাইরে যে বহিরাবরণ থাকে তার নাম এনভেলপ (envelope) খুব কম ক্ষেত্রে ভাইরাসের দেহে কয়েকটি এনজাইম-এর সন্ধান পাওয়া গেছে। নিচে একটি সাধারণ ভাইরাসের বিভিন্ন অংশের গঠন ও কাজ বর্ণনা করা হলো।
ক্যাপসিড (Capsid) : ভাইরাস দেহের মধ্যভাগে নিউক্লিক এসিডকে ঘিরে থাকা প্রোটিন আবরণকে ক্যাপসিড বলে। ক্যাপসিড প্রকৃতপক্ষে অসংখ্য প্রোটিন সাব-ইউনিট বা উপ-একক নিয়ে গঠিত, এগুলোকে ক্যাপসোমিয়ার (capsomcre) বলে ক্যাপসিড গঠনে ক্যাপসোমিয়ারের সজ্জাক্রমে প্রতিসাম্য (symmetry) থাকে। ক্যাপসিড সাধারণত প্রোটিন নির্মিত হলেও ক্ষেত্রবিশেষে এতে স্নেহ পদার্থ ও শ্বেতসারও পাওয়া যায়। অন্তঃস্থ নিউক্লিক এসিডকে রক্ষা করা ক্যাপসিডের প্রধান কাজ। এ ছাড়া ক্যাপসিড অ্যান্টিজেন হিসেবেও কাজ করে।
নিউক্লিওয়েড (Nucleoid): ক্যাপসিড মধ্যস্থ নিউক্লিক এসিডকে নিউক্লিওয়েড বলে। নিউক্লিওয়েড সবসময় যে কোনো একধরনের নিউক্লিক এসিড অর্থাৎ DNA বা RNA নিয়ে গঠিত। DNA দ্বিসূত্রক বা একসূত্রক হয়। আবার RNA-ও একসূত্রক বা দ্বিসূত্রক হতে পারে। দ্বিসূত্রক DNA যুক্ত ভাইরাস হচ্ছে T2 T4, ফাজ ভাইরাস। একসূত্র DNA ভাইরাস হচ্ছে কলিফাজ ইত্যাদি। একসূত্রক RNA যুক্ত ভাইরাস হলো TMV। রিওভাইরাস দ্বিসূত্রক RNA যুক্ত ভাইরাস। সাধারণত একটি মাত্র নিউক্লিক এসিড অণু নিয়ে নিউক্লিওয়েড গঠিত হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিক অগ্র থাকতে পারে। যেমন-রেট্রো ভাইরাসে দুইঅণু একসূত্রক RNA থাকে। নিউক্লিওয়েড কুন্ডলিত অবস্থায় থাকে। নিউক্লিওয়েড হচ্ছে ভাইরাসের বংশগতি বস্তু। পোষকদেহ সংক্রমণ ও প্রতিলিপি গঠনে নিউক্লিওয়েড প্রধান ভূমিকা পালন করে।
এনভেলপ (Envelope): কিছু সংখ্যক প্রাণী ভাইরাস, খুব কম সংখ্যক উদ্ভিদ ও ব্যাকটেরিয়াল ভাইরাসে ক্যাপসিডের বাইরে একটি ১০-১৫ nm পুরু আবরণ থাকে একে এনভেলপ বলে। এটি প্রোটিন, লিপিড ও শর্করা নিয়ে গঠিত। এনভেলপের গঠনগত একককে পেলপোমিয়ার (pelpomere) বলে । এনভেলপযুক্ত ভাইরাসকে লিপোভাইরাস (Lipovirus) বলা হয়। এনভেলপের বহিঃতল মসৃণ বা কাঁটাযুক্ত হতে পারে, কাঁটাগুলোকে স্পাইক (spike) বলে। এনভেলপবিহীন ভাইরাসকে নগ্ন ভাইরাস (naked virus) বলে।
এনজাইম (Enzymes) : ভাইরাসের দেহে সবসময় এনজাইম থাকে না। কিছু ক্ষেত্রে এনজাইমের উপস্থিতি দেখা যায়, যেমন-ব্যাকটেরিওফাজে লাইসোজাইম, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে নিউরামিনিডেজ এবং অন্যান্য এনজাইমের মধ্যে আছে RNA পলিমারেজ, RNA ট্রান্সক্রিপটেজ, রিভাস ট্রান্সক্রিপটেজ ইত্যাদি।)
দুটি ভাইরাসের গঠন – TMV ও T2 ফাজ
১. টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (Tobacco Mosaic Virus) বা TMV :
দন্ডাকৃতির এই ভাইরাসটির দৈর্ঘ্য ২৮০ nm থেকে ৩০০ nm এবং প্রস্থ ১৫ nm থেকে ১৮ nm পর্যন্ত হয়ে থাকে। TMV ভাইরাস প্রোটিন ও RNA দিয়ে গঠিত । বাইরের পুরু প্রোটিন আবরণটিকে ক্যাপসিড বলে। ক্যাপসিড বহু উপএকক দিয়ে গঠিত। এদের নাম ক্যাপসেমিয়ার TMV তে প্রায় ২২০০ ক্যাপসোমিয়ার পাওয়া যায়।
প্রতিটি ক্যাপসোমিয়ারে ১৫৮ অ্যামিনো এসিড
থাকে। ক্যাপসিডের অভ্যন্তরে একসূত্রক RNA কোর
(core) থাকে। RNA সূত্রটি ৬৫০০ নিউক্লিওটাইড
দিয়ে গঠিত। ওজন হিসেবে এর শতকরা প্রায় ৯৫
ভাগই প্রোটিন। TMV-এর আণবিক ওজন ৩৭ মিলিয়ন ডাল্টন এবং RNA-এর আণবিক ওজন ২.৪
মিলিয়ন ডাল্টন। প্রতিটি প্রোটিন উপ-এককের মানবিক ওজন ১৭,০০০ ডাস্টন
২. ব্যাকটেরিওফাজ বা T2 ফাজ (Bacteriophage or T2 Phage ):
T2, ব্যাকটেরিওফাজ সর্বাধিক পরিচিত ভাইরাস। এর গঠন বেশ জটিল হলেও এ সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত ভালভাবে জানা গেছে। এর দৈহিক গঠন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ ব্যাঙাচি /শুক্রাণুর মতো । T2 ফাজদের দেহকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
মাথা ও লেজ ।
মাথা (Head)
মাথাটি স্ফীত ও ষড়ভূজাকৃতির । এর বাইরের আবরণ দ্বিস্তরী প্রোটিন বা ক্যাপসিড (capsid) দ্বারা তৈরী । প্যাঁচানো DNA বিদ্যমান। দ্বিসূত্রকবিশিষ্ট
মাথার অভ্যন্তরের দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৩-১০০ ন্যানোমিটার (nm) এবং প্রস্থ প্রায় ৬৫ ন্যানোমিটার (nm)। DNA তে প্রায় ১৫০টি জিন রয়েছে।
লেজ (Tail) :
মাথার নিচের লম্বা, ফাঁপা অংশটিই লেজ। লেজ এর দৈর্ঘ্য ১০০ ন্যানোমিটার এবং ব্যাস প্রায় ২৫ ন্যানোমিটার। লেজের আবরণটি সাধারণত দৃঢ় ও সংকোচনশীল। তবে কোন কোন ফাজ এর লেজ নরম, নমনীয় ও আবরণবিহীন। লেজের ভিতরে কোন DNA থাকে না, লেজ ও মাথার সংযোগস্থলে একটি কলার (collar) অবস্থিত। লেজের নিচের প্রান্ত কিছুটা সরু হয়ে ভিত্তি ফলক বা বেসপ্লেট (base plate) তৈরি করে। (বেসপ্লেট এর চারপাশে ৬টি (৩ + ৩) সরু ও লম্বা স্পর্শক তন্তু এবং কতকগুলো (ক্ষেত্রবিশেষে ৩টি) কাঁটা থাকে যাদেরকে স্পাইক (spike) বলে। এ তত্ত্ব ও স্পাইক এর মাধ্যমে এরা পোষককোষ ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে। T2 ফাজ যেহেতু অকোষীয় বস্তু তাই এতে কোন নিউক্লিয়াস, সাইটোপ্লাজম, সাইটোপ্লাজমীয় পর্দা ও অঙ্গাণু নেই।
TMV
ডেঙ্গু ভাইরাস
ভাইরাস
নভেল করোনা ভাইরাস
Phage (ফাজ) একটি গ্রিক শব্দ যার বাংলা আভিধানিক অর্থ ভক্ষণ করা বা( to eat) এরা জীবদেহের অভ্যন্তরে সংক্রমণের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি ঘটিয়ে জীবকে (পোষককে) ধ্বংস করে। (ব্যাকটেরিয়ার দেহাভ্যন্তরে (কোষের ভিতর) বংশ বৃদ্ধি ঘটিয়ে যারা ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে তাদেরকে ব্যাকটেরিওফাজ বলে। উদাহরণ- T2 ফাজ। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী দ্য হেরেলী ফেলিক্স (d'Herelle Felix) এই ভাইরাসকে ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস বা ব্যাকটেরিওফাজ বা ফাজ নামে অভিহিত করেন।
যে প্রক্রিয়ায় ফায ভাইরাস পোষক ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রবেশ করে সংখ্যাবৃদ্ধি করে এবং অপত্য ভাইরাসগুলো পোষক দেহের বিদারণ ঘটিয়ে নির্গত হয় তাকে লাইটিক চক্র বা বিগলনকারী চক্র বলে। Escherichia coli (E.coli) নামক ব্যাকটেরিয়া কোষে T2 ব্যাকটেরিওফাযের লাইটিক চক্র নিম্নলিখিত ধাপসমূহে সংঘটিত হয়।
১. সংযুক্তি বা পৃষ্ঠলগ্নীভবন (Attachment/ Landing) :
T2 ব্যাকটেরিওফাজ সাধারণত Escherichia-coli (E.coli) ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে থাকে। E.coli ব্যাকটেরিয়ামের কোষ প্রাচীরে ফায প্রোটিনের জন্য রিসেপ্টর সাইট (receptor site) থাকে। রিসেপ্টর সাইটের প্রোটিনের সাথে ফায ক্যাপসিডের স্পর্শক তন্তুর প্রোটিনের রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে ব্যাকটেরিয়ামের প্রাচীরে T2 ফাজ দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত হয়ে যায়। এটি হলো আক্রমণের সূচনা।
২. ফাজ DNA অণু প্রবেশ (Penetration) :
ব্যাকটেরিওফাজের দন্ডাকৃতির লেজটি সংকুচিত হয়ে বিশেষ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সংযোগ স্থানের প্রাচীরে ছিদ্র তৈরি করে এবং ফায-DNA কে E.coli ব্যাকটেরিয়ামের কোষ মেমব্রেন ভেদ করে সাইটোপ্লাজমে প্রবেশ করিয়ে দেয়। শূণ্য প্রোটিন আবরণটি বাইরেই থেকে যায়।
৩. অনুলিপন (Replication) :
ফাজ DNA পোষক কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর তার নিজস্ব প্রোমোটার সিকুয়েন্স দ্বারা পোষক কোষের RNA পলিমারেজকে আকৃষ্ট করে। পোষক কোষের RNA পলিমারেজ ব্যবহার করে ফাজ mRNA তৈরি করে। ফাজ mRNA পরে প্রোটিন তৈরি করে এবং একটি বিশেষ প্রোটিন (প্রকৃতপক্ষে এনজাইম) E. coli DNA-কে খণ্ড বিখণ্ড করে নষ্ট করে দেয়। কাজেই পোষক কোষে ফাজ DNA-এর কোনো প্রতিযোগী থাকে না। ফাজ DNA নিউক্লিয়োটাইড (E. coli কোষের বিগলিত DNA থেকে মুক্ত হওয়া) কোষের রাইবোসোম, tRNA, অ্যামিনো এসিড ইত্যাদির কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং নিজের ইচ্ছেমতো নতুন ফায DNA প্রতিলিপন করে নেয় এবং ফায কোট প্রোটিন (coat protein) তৈরি করে। কোট প্রোটিন মাথা, লম্বা লেজ, স্পর্শক তন্তু, স্পাইক ইত্যাদি অংশ হিসেবে পৃথক পৃথকভাবে তৈরি হয় ।
৪. সংশ্লেষঃ
পোষক কোষের অভ্যন্তরে প্রতিটি ফাজ DNA এক একটি কোট প্রোটিনের মাথার অংশে প্রবেশ করে। পরে ক্রমান্বয়ে মাথার অংশের সাথে লেজ, লেজের শেষ প্রান্তে স্পর্শক তন্তু, স্পাইক ইত্যাদি সংযুক্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাকটেরিওফাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
৫: নির্গমন (Release) :
পোষক কোষের অভ্যন্তরে প্রচুর সংখ্যক ব্যাকটেরিওফাজ তৈরি হওয়ার পর ফাজ একটি সুনির্দিষ্ট এনজাইম তৈরি করে যার কার্যকারিতায় পোষক কোষের প্রাচীর বিদীর্ণ হয়ে যায় এবং নতুন সৃষ্ট ব্যাকটেরিওফাযসমূহ মুক্তভাবে বেরিয়ে আসে। মুক্ত হওয়া প্রতিটি ফায একটি নতুন E. coli ব্যাকটেরিয়ামকে আক্রমণ করতে সক্ষম। পোষক কোষে বংশগতীয় বস্তু প্রবেশের পর ভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটতে পারে এবং পোষক কোষ ভেঙ্গে অনেকগুলো ভিরিয়ন মুক্ত হয়। ভাইরাসের এ ধরনের সংখ্যাবৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে লাইটিক চক্র বলে। যেমন- E. coli আক্রমণকারী T2 ফাজ। এমন প্রকৃতির ফাযকে লাইটিক ফায বা ভিরুলেন্ট ফায (virulent phage) বলে। কোষপ্রাচীর বিদীর্ণ হওয়াকে লাইসিস (Lysis) বা বিগলন বলে। লাইটিক চক্রের মাধ্যমে মাত্র ৩০ মিনিটে প্রায় ৩০০টি নতুন ফায সৃষ্টি হয়ে থাকে। নির্গত নতুন ফায নতুন পোষক কোষে সংক্রমণ সৃষ্টি করে।
পোষক ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করার পর থেকে যে সময় পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ অপত্য ভাইরাস সৃষ্টি না হয় সেই সময় কালকেই ইকলিপস কাল বলে।
যে প্রক্রিয়ায় ফায ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার কোষে প্রবেশের পর ভাইরাল DNA-টি ব্যাক্টেরিয়াল DNA অণুর সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং ব্যাকটেরিয়াল DNA-র সঙ্গে একত্রিত হয়ে প্রতিলিপি গঠন করে কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ভাইরাসরূপে ব্যাকটেরিয়া কোষের বিদারণ বা লাইসিস ঘটিয়ে মুক্ত হয় না তাকে লাইসোজেনিক চক্র বলে। ল্যামডা ফায (λ −ফাজ), P1 ফাজ,M13 ফাজ ইত্যাদি ভাইরাস Escherichia coli (E. coli) ব্যাকটেরিয়া কোষে লাইসোজেনিক চক্র সম্পন্ন করে। এ ধরনের চক্রে ফায ভাইরাস পোষক কোষকে ধ্বংস না করেই সংখ্যাবৃদ্ধি করে থাকে। লাইসোজেনিক চক্রের ধাপগুলো নিম্নরূপ :
১. পোষক ব্যাকটেরিয়ায় সংযুক্তি এবং ফায DNA-এর অনুপ্রবেশ (Attachment to host bacteria and penetration of phage DNA):
লাইটিক চক্রের মতোই প্রথমে ফায ভাইরাস পোষক কোষপ্রাচীরকে ছিদ্র করে DNA অণুকে পোষক কোষে প্রবিষ্ট করায় এবং শূন্য প্রোটিন আবরণটি পোষক কোষের বাইরে থেকে যায়।
২. ব্যাকটেরিয়া DNA এর সঙ্গে ভাইরাস DNA এর সংযুক্তি (Attachment of viral DNA to bacterial DNA):
এ পর্যায়ে নিউক্লিয়েজ এনজাইম ব্যাকটেরিয়ার DNA-কে একটি জায়গায় কেটে ফেলে। এই কাটা স্থানে ফায DNA-টি গিয়ে সংযুক্ত হয়। এ ধরনের সংযুক্তিতে ইন্টিগ্রেজ এনজাইম বিশেষ ভূমিকা রাখে। ব্যাকটেরিয়ার DNA-র সঙ্গে সংযুক্ত ভাইরাস DNA-টিকে প্রোফায (prophage) বলে। এটি ব্যাকটেরিয়ায় সুপ্তাবস্থায় থাকে। ফায DNAসহ Escherichia coli (E. coli) ব্যাকটেরিয়া দ্বি-বিভাজন প্রক্রিয়ায় সংখ্যাবৃদ্ধি বা বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার জিনোম একসাথে একটি নতুন জিনোম তৈরি করে। প্রত্যেকবার সংখ্যাবৃদ্ধির সময় ব্যাকটেরিয়াল DNA-এর অনুরূপ ভাইরাল DNA অণুটিরও প্রতিলিপি গঠিত হতে থাকে। এভাবে প্রতিটি অপত্য ব্যাকটেরিয়ায় ভাইরাস DNA-র একটি কপি সংযুক্ত হতে থাকে। তবে প্রয়োজন হলে পোষক DNA থেকে ফায DNA পৃথক হয়ে লাইটিক চক্রের মাধ্যমে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাতে পারে।
লাইটিক চক্র | লাইসোজেনিক চক্র |
---|---|
১. এ প্রক্রিয়ায় কাজ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রবেশ করে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় এবং পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস গঠিত হয়। | ১. এ চক্রে ফাজ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রবেশ করার পর ভাইরাল DNA অণুটি ব্যাকটেরিয়াল DNA অণুর সাথে যুক্ত হয় এবং একত্রিত হয়ে প্রতিলিপি গঠন করে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস সৃষ্টি হয় না। |
২. পোষক ব্যাকটেরিয়া কোষের বিদারণ ঘটে। | ২. ব্যাকটেরিয়া কোষ বিদারিত হয় না। |
৩. T-সিরিজযুক্ত কাজে লাইটিক চক্র দেখা যায় | ৩. (ল্যামডা)- সিরিজযুক্ত ফাজে লাইসোজেনিক চক্র দেখা যায়। |
৪. লাইটিক চক্র একবার সম্পন্ন হলে অনেকগুলো ভাইরাসের সৃষ্টি হয়। | ৪. লাইসোজেনিক চক্র একবার সম্পন্ন হলে মাত্র দুটি ভাইরাস জিনোমযুক্ত ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়। |
৫. এ চক্রে ভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধি ভাইরাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। | ৫. এ চক্রে ভাইরাসের DNA এর সংখ্যাবৃদ্ধি পোষক |
অপকারিতা (Disadvantages):
১। ভাইরাস মানবদেহে বসন্ত, হাম, পোলিও, জলাতঙ্ক, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হার্পিস, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ভাইরাল হেপাটাইটিস, ক্যাপোসি সার্কোমা প্রভৃতি মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে থাকে।
২। বিভিন্ন উদ্ভিদের রোগ সৃষ্টিতে যেমন-সিমের মোজাইক রোগ, আলুর লিফরোল (পাতা কুঁচকাইয়া যাওয়া), পেঁপের লিফকার্ল, ক্লোরোসিস, ধানের টুংরো রোগসহ প্রায় ৩০০ উদ্ভিদ রোগ ভাইরাস দ্বারা ঘটে থাকে। এতে ফসলের উৎপাদন বিপুলভাবে হ্রাস পায়।
৩। গরুর বসন্ত; গরু, ভেড়া, ছাগল, শূকর, মহিষ ইত্যাদি প্রাণীর ‘ফুট এ্যান্ড মাউথ’ রোগ অর্থাৎ এদের পা ও মুখের বিশেষ ক্ষতরোগ (খুরারোগ) এবং মানুষ, কুকুর ও বিড়ালের দেহে জলাতঙ্ক (hydrophobia) রোগ ভাইরাস দিয়েই সৃষ্টি হয়।
৪। ফায ভাইরাস মানুষের কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়াকেও ধ্বংস করে থাকে।
৫। HIV ভাইরাস দিয়ে AIDS হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
৬। Ebola ভাইরাসের আক্রমণে cell lysis হয় বা কোষ ফেটে যায়।
৭। Zika ভাইরাস মশকীর মাধ্যমে ছড়ায়। মাইক্রোসেফালি ঘটে অর্থাৎ অপরিণত মস্তিষ্ক নিয়ে শিশু জন্মায়। ডেঙ্গুর মত লক্ষণ দেখা যায়।
৮। নিপা ভাইরাস Paramyxoviridae পরিবারভুক্ত একটি RNA ভাইরাস যার গণ নাম Henipavirus. ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ায় শূকরের খামারে প্রথম ধরা পড়লেও দ্রুত দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পরে। বাদুর এই ভাইরাসটির বাহক এবং কাঁচা খেজুরের রসের মাধ্যমে এ ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত (অনুপ্রবেশ) হয়। এ ভাইরাসের আক্রমণে শ্বসন জটিলতায় মানুষসহ গৃহপালিত পশুপাখির মৃত্যু ঘটে।
৯। সম্প্রতি SARS (Severe Acute Respiratory Syndrome) ভাইরাসের কারণে চীন, তাইওয়ান, কানাডা প্রভৃতি দেশে বহু লোকের মৃত্যু হয়েছে। MERS (Middle East Respiratory Syndrome) ভাইরাসও একটি মারাত্মক ভাইরাস।
১০। বার্ড ফ্লু-একটি ভাইরাসজনিত রোগ। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বার্ড ফ্লু মহামারী আকারে হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছরই হাজার হাজার মুরগি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা
H5N1 (Hemaglutinin types-5-Neuraminidase type-1) ভাইরাসের আক্রমণে হাঁস-মুরগিতে বার্ড ফ্লু নামক মারাত্মক রোগের সৃষ্টি হয় যা পোল্ট্রি শিল্পকে ধ্বংস করে।
১১। সোয়াইন ফ্লু- Swine Influenza virus (SIV) দ্বারা সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে সোয়াইন ফ্লু শনাক্ত করা হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের Subtype
H5N1 ও H1N1 (Hemaglutinin type-1-Neuraminidase type-1) এর কারণে এই ফ্লু ঘটে থাকে। এ ভাইরাস দ্বারা মানুষ ও শূকর আক্রান্ত হয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই ভারতে বহু লোক (২১০০) মারা যায় এবং ৩৪,০০০ মানুষ আক্রান্ত হয়। বিশ্বায়নের যুগে এ রোগের দ্রুত বিস্তার ঘটেছে মেক্সিকো থেকে সারাবিশ্বে।
১২। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস দিয়ে মানুষের লিভার ক্যান্সার, পেপিলোমা ভাইরাস দিয়ে এনোজেনিটাল (জরায়ুর মুখ) ক্যান্সার, হার্পিস সিমপ্লেক্স দিয়ে ক্যাপোসি সার্কোমা ইত্যাদি মারাত্মক রোগ হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
১৩। মানুষের অসুস্থ হওয়ার একটি সাধারণ কারণ হলো সর্দিজ্বর (common cold)। বিভিন্ন প্রকৃতির অনেকগুলো ভাইরাস এর জন্য দায়ী; তাই এর জন্য কোনো ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
১৪। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস এর আক্রমণে উচ্চজ্বর, জয়েন্টে ব্যাথা, শরীরে রেশ ওঠা, মাথা ব্যাথা, দুর্বলতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
১৫। হিউম্যান হার্পিস ভাইরাসেসঃ এটি Rhadino গণের এবং DNA ভাইরাস। এর দ্বারা ক্যাপোসি সারকোমা (HIV সম্পর্কিত রোগীদের ত্বক ক্যান্সার) রোগ হয়।
উপকারিতা (Advantages):
১। বসন্ত, পোলিও, প্লেগ এবং জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক টিকা ভাইরাস দিয়েই তৈরি করা হয়।
২। ভাইরাস হতে ‘জন্ডিস’ রোগের টিকা তৈরি করা হয়।
৩। কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় ইত্যাদি রোগের ওষুধ তৈরিতে ব্যাকটেরিওফায ভাইরাস ব্যবহার করা হয়।
৪। ভাইরাসকে বর্তমানে বহুল আলোচিত ‘জেনেটিক প্রকৌশল’-এ বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৫। ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণে ভাইরাস ব্যবহার করা হয়।
৬। কতিপয় ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ দমনেও ভাইরাসের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। যুক্তরাষ্ট্রে NPV (Nuclear polyhydrosis Virus) কে কীট পতঙ্গনাশক হিসেবে প্রয়োগ করা হয়।
৭। ফাজ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে থাকে।
৮। লাল টিউলিপ ফুলে ভাইরাস আক্রমণের ফলে লম্বা লম্বা সাদা সাদা দাগ পড়ে। একে ব্রোকেন টিউলিপ বলে। এর ফলে ফুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় এবং ফুলের মূল্য বেড়ে যায়।
৯। অস্ট্রেলিয়ার খরগোসের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ফসলের চরম ক্ষতি হচ্ছিল। Myxovirus-এর সাহায্যে খরগোস নিধন করে তাদের সংখ্যা কমানো হয়েছে।
উদ্ভিদের ভাইরাসজনিত রোগঃ
ভাইরাসের নাম | পোষক | ভাইরাসজনিত রোগ |
---|---|---|
টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (Tobacoo Mosaic Virus) | তামাক | তামাকের মোজাইক রোগ |
বিন মোজাইক ভাইরাস (Bean Mosaic Virus) | সীম | সীমের মোজাইক রোগ |
টুংরো ভাইরাস (Tungro Virus) | ধান | ধান গাছের টুংরো রোগ |
বুশিস্ট্যান্ট ভাইরাস (Bushystant Virus) | টমেটো | টমেটোর বুশিস্ট্যান্ট রোগ |
বানচি টপ ভাইরাস (Banchy top Virus) | কলা | কলার বানচি টপ রোগ |
পট্যাটো মোজাইক ভাইরাস (Potato Mosaic Virus) | গোল আলু | গোল আলুর মোজাইক রোগ |
প্রাণীর ভাইরাসজনিত রোগঃ
ভাইরাসের নাম | পোষক | ভাইরাসজনিত রোগ |
---|---|---|
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (Influenza Virus) | মানুষ | ইনফ্লুয়েঞ্জা |
হার্পিস ভাইরাস (Herpes Virus) | মানুষ | হার্পিস |
হেপাটাইটিস বি/সি ভাইরাস (Hepatites B / C Virus) | মানুষ | জন্ডিস |
এইচ আই ভি (HIV) | মানুষ | এইডস (রোগ নয়, লক্ষণ সমষ্টি) |
ভেরিওলা ভাইরাস (Variola Virus) | মানুষ | বসন্ত |
রুবিওলা ভাইরাস (Rubeola Virus) | মানুষ | হাম |
পোলিও ভাইরাস (Polio Virus) | মানুষ | পোলিও |
র্যাবিস ভাইরাস (Rabis Virus) | মানুষ | জলাতঙ্ক |
ইয়েলো ফিবার ভাইরাস (Yellow Fever Virus) | মানুষ | পীতজ্বর |
ফ্লাভি ভাইরাস (Flavi Virus) | মানুষ | ডেঙ্গুজ্বর |
ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস (Vaccinia Virus) | গরু | গো-বসন্ত |
ফুট অ্যান্ড মাউথ ভাইরাস (Foot and Mouth Virus) | গবাদিপশু | ফুট এণ্ড মাউথ ডিজিস |
কলেরাঃ Vibrio cholerae নামক ব্যাকটেরিয়া কোনভাবে মুখ দিয়ে পরিপাকতন্ত্রের ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশ করলে সুস্থ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয় । এ ব্যাকটেরিয়ার আকৃতি একটু বাঁকা কমার মতো। এর দৈর্ঘ্য ১-৫ মাইক্রণ এবং একপ্রান্তে একটি ফ্রাজেলাম থাকে। এটি একটি গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া । সুস্থ লোকের পেটে জীবাণু না যাওয়া পর্যন্ত এ রোগ হয় না। সুস্থ লোক আক্রান্ত লোকের মলের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে বা আক্রান্ত রোগীর মল বা বমি শরীরে মেখে গেলেও এ রোগ হয় না। দূষিত খাবার, পানি, মাছি দিয়ে সংক্রমিত খাবার এবং অপরিষ্কার হাতের মাধ্যমে রোগ ছড়ায় ।
লক্ষণঃ হঠাৎ প্রথমে চাল ধোয়া পানির মতো পাতলা পায়খানা (watery | stool) আরম্ভ হয় । পায়খানার সাথে কোন ব্যথা থাকে না। কখনো কখনো মলের সাথে রক্তও দেখা যায় । বার বার বমি বমি ভাব (nausea) এবং বমি হতে থাকে (পরিমাণ কম)। মলে কখনো মলের রং থাকে না। প্রথম ২/১ বার থাকলেও তারপর আর থাকে না। পিত্তরস থাকে না বলে এর রং এমন হয়। দেহের জলীয় পদার্থ বের হয়ে যাওয়ায় ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা) দেখা দেয় এবং মূত্রশূন্যতা ঘটে। পেটে ব্যথা থাকে না তবে তলপেটে জ্বালা ভাব হতে পারে। দেহের মাংসপেশিগুলোর সংকোচন (cramp) হলো এ রোগের একটি প্রধান লক্ষণ। দেহের তাপমাত্রা কমে যায়-৯৬° বা ৯৫° ফারেনহাইটে নেমে মাথা নীলাভ হয়ে যায়। চোখ কোটরগত ও ফ্যাকাশে হয়। তীব্র পানি পিপাসা আসে। জিহ্বায় হাত দিলে ঠান্ডা বোধ হয়; পায়ুতে তাপ বেশি থাকে। রক্তের চাপ কমে ৯০/৭০ মিলিমিটারে এসে দাঁড়ায়। দেহে খনিজ পদার্থের বিশেষ করে সোডিয়াম আয়নের অভাব দেখা দেয়। এ অবস্থায় রোগীর ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য হারানোর ফলে রক্তে প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে রক্ত সংবহনতন্ত্র বন্ধ হয়ে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শিশুদের ক্ষেত্রে শরীরের খিঁচুনীসহ হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রতিকারঃ রোগীকে আরামদায়ক শয্যায় এমনভাবে রাখতে হবে যেন তার দেহ উষ্ণ থাকে। এ রোগের মারাত্মক অবস্থা হচ্ছে দেহে পানি স্বল্পতা। তাই রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে প্রচলিত লবণ, পানি ও চিনি দিয়ে তৈরি খাবার স্যালাইন (oral saline) খাওয়াতে হবে অথবা বাজারে তৈরি সহজলভ্য স্যালাইনের প্যাকেট ব্যবহার করতে হবে । রোগী যাতে দুর্বল না হয়ে পড়ে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে সে জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগী খাবার স্যালাইন খেতে অপারগ হলে জরুরী ভিত্তিতে শিরার মাধ্যমে আইভি ফ্লুইড (intravenous fluid) প্রয়োগ করতে হবে। তীব্র আক্রান্ত রোগীকে আইভি ফ্লুইডের সাথে অথবা পৃথকভাবে টেট্রাসাইক্লিন, এরিথ্রোমাইসিন বা সিপ্রোফ্লাক্সাইসিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করাতে হবে। তবে এসব কাজ চিকিৎসা কেন্দ্রে করানোই ভালো।
প্রতিরোধঃ কলেরা একটি পানিবাহিত রোগ, তাই বিশুদ্ধ খাবার পানি পানের ব্যবস্থা করতে হবে; প্রয়োজনে পানি ফুটিয়ে বা uv-ফিল্টার-এ পরিশ্রুত পানি পান করতে হবে। পঁচা-বাসি খাবার, রাস্তার পাশে খোলা খাবার. অপরিশোধিত কাঁচা শাক-সব্জি খাওয়া পরিহার করতে হবে। খাবার স্পর্শ করার আগে হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। রোগীর ভেদ-বমি থেকে মাছির সাহায্যে গৌণ সংক্রমণ ঘটে, তাই খাবার সব সময় ঢেকে রাখতে হবে। রোগীর জামা কাপড়, বিছানা-পত্র পুকুর বা খাল-বিলে না ধুয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকাতে হবে। রোগীকে সুস্থ ব্যক্তি থেকে আলাদা করে রাখতে হবে। রোগীর মলমূত্র যথাযথভাবে শোধন করতে হবে। কোনো এলাকায় কলেরা দেখা দিলে ঐ এলাকার সবাইকে কলেরা ভ্যাক্সিন দিতে হবে। জনসাধারণকে স্বাস্থ্য বিধি সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।
একটি এককোষী সুকেন্দ্রিক জীবের গণ, যারা মেরুদণ্ডী প্রাণী এবং কীটপতঙ্গের মধ্যে বাধ্যতামূলক পরজীবী হিসেবে বসবাস করে।প্লাজমোডিয়াম প্রজাতির জীবনচক্রের ক্রমবিকাশ সংঘটিত হয় একটি রক্ত-খেকো কীট পোষকের ভিতর, যা পরবর্তীতে রক্ত পান করার সময় অন্য একটি মেরুদণ্ডী প্রাণীতে পরজীবীগুলো ঢুকিয়ে দেয়। মেরুদণ্ডী প্রাণীর রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে লোহিত রক্তকণিকাগুলোকে সংক্রমিত করার আগে পরজীবীগুলো তার দেহ টিস্যুতে (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যকৃতে) বিকাশলাভ করে। পোষক দেহের লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে রোগ সৃষ্টি হতে পারে, যা ম্যালেরিয়া নামে পরিচিত। চলমান সংক্রমণের সময়, একটি রক্ত-খেকো কীট (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মশা) অসুস্থ প্রাণীটিকে কামড় দিলে কিছু পরজীবী কীটের ভেতর প্রবেশ করে এবং এর ফলে পরজীবীর জীবনচক্র অব্যাহত থাকে।Plasmodium গণের প্রায় ৬০টি প্রজাতি মানুষসহ বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রাণীতে এ রোগ সৃষ্টি করে। মানবদেহে এ পর্যন্ত রোগ সৃষ্টিকারী ৪টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে।সাধারণত ৪ ধরনের পরজীবী এর আক্রমণে ম্যালেরিয়া হয়।
ম্যালেরিয়ার পরজীবীর নাম রোগের নাম জ্বরের প্রকৃতি
১. Plasmodium vivax →বিনাইন টারশিয়ান ম্যালেরিয়া→ 48 ঘন্টা পর পর জ্বর আসে
২. Plasmodium malariae →কোয়ারটার্ন ম্যালেরিয়া → 72 ঘন্টা পর পর জ্বর আসে
৩. Plasmodium ovale →মৃদু টারশিয়ান ম্যালেরিয়া→ 48 ঘন্টা পর পর জ্বর আসে
৪. Plasmodium falciparum→ ম্যালিগন্যান্ট টারশিয়ান ম্যালেরিয়া → 36-48 ঘন্টা পর পর জ্বর আসে।
ম্যালেরিয়া পরজীবীর শ্রেণিতাত্ত্বিক অবস্থান :
Kingdom: Protista
Subkingdom: Protozoa
Phylum: Apicomplexa
Class: Sporozoa
Order: Haemosporidia
Family: Plasmodiidae
Genus: Plasmodium
Species: Plasmodium vivax, P. ovale, P. falciparum, P. malariae
ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ (Transmission of Malaria): Plasmodium-এর পোষক হিসেবে প্রায় দু'শ প্রজাতির Anopheles রয়েছে। স্ত্রী Anopheles-ই ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ানোর একমাত্র মাধ্যম। রোগ বিস্তারের মাধ্যমে মহামারী সৃষ্টি করার জন্য ছয় প্রজাতির Anopheles মশকীকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। এরা হলো Anopheles culicifacies. A stephensi, A. fluviatilis, A. minimus, A.
dirus এবং A sundaicus মশকী প্রজাতিগুলো যখন ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে দংশন করে তখন রক্তের মাধ্যমে পরজীবীর বিভিন্ন ধাপ ওদের গ্রুপে প্রবেশ করে। এভাবে আক্রান্ত মশকী কোনো সুস্থ মানুষকে দংশন করলে পরজীবীগুলো মশকীর লালারসের মাধ্যমে মানবদেহে বা অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণিদেহে প্রবেশ করে ।মানুষ হচ্ছে চার প্রজাতির ম্যালেরিয়ার পরজীবীর একমাত্র প্রাকৃতিক পোষক। ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত মানুষই হলৌ ম্যালেরিয়া সংক্রমণের উৎস। তাই বলে সকল ম্যালেরিয়া রোগীই কিন্তু সংক্রমণের ভান্ডার নয়। যে রোগীর রক্তে পর্যাপ্ত সংখ্যক পরিণত, জীবন্ত ও উৎকৃষ্ট মানের গ্যামেটাসাইট থাকে সে ব্যক্তিই সংক্রমণের প্রকৃত উৎস । প্রান্তীয় রক্ত সংবহনে গ্যামেটোসাইট যদি খুব কম থাকে বা অপরিণত থাকে কিংবা স্ত্রী পুরুষ গ্যামেটোসাইটের অনুপাতে ব্যাপক বৈষম্য থাকে তাহলে রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনাও কমে যায়। মশকী যখন দংশন করে তখন Pvivax এর অন্ততঃ ৬টি এবং P falciprarum এর ১২টি গ্যামেটোসাইট মশকীর দেহে প্রবেশ করতে হয়। যাদের রক্তে পর্যাপ্ত সংখ্যক গ্যামেগোসাইট থাকে তাদের সক্রিয় (active) এবং যাদের রক্তে গ্যামেটোসাইটগুলো কোনো এক সময় কার্যকর হচ্ছে এমন অবস্থায় থাকে, তাদের বাহক বলে । চিকিৎসারত কিংবা স্বল্প চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীরা সংক্রমণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে। P falciparum-এর গ্যামেটোসাইট রক্তে ৩০-৬০ দিন বা তারও বেশি, ১২০ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে। P. vivax এর গ্যামেটোসাইট লোহিত রক্তকণিকার ভেতর ৭ দিনের বেশি বাঁচে না। কাজেই ঐ সময়ের মধ্যে মশকী রক্ত খেলে ম্যালেরিয়া ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। এভাবে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে এবং ম্যালেরিয়া জন-জনান্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
কেবল Anopheles মশকীই জীবাণু বহন করে কেন ? ম্যালেরিয়া রোগের বাহক হিসেবে একমাত্র Anopheles গণের বিভিন্ন প্রজাতির মশকীই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। কারণ অন্য প্রজাতির মশকীদেহে এমন বিষাক্ত উপাদান থাকে যা Plagsmodium-এর জন্য ধ্বংসাত্মক। ঐসব মশকী প্রজাতির মধ্যান্ত্রের প্রচন্ড ট্রিপসিন-সদৃশ কর্মকান্ড ঘটতে দেখা যায় যা Plaasmodium-এর উওকিনেটের পরিস্ফুটনকে রূদ্ধ করে দেয়। দংশনের সময়কাল, পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা ও মশকী-দেহে স্পোরোগোনি ঘটানোর সমস্ত উপাদান Plaasmodium-এর অনুকূলে থাকায় কেবল Anopheles- মশকীর দেহেই জীবাণুর পরিস্ফুটন ও বহন সম্পন্ন হয়।
joss
অযৌন চক্রে
মেরোগনিতে
স্পোরোগনিতে
সাইজোগনিতে
ম্যালেরিয়া পরজীবীর প্রতিকারঃ পৃথিবী ম্যালেরিয়ার প্রতিকার (Prevention of Malaria) থেকে কখনো সম্পূর্ণরূপে ম্যালেরিয়া উচ্ছেদ সম্ভব নয়। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিকার করা যায়। ম্যালেরিয়া প্রতিকারের প্রধান তিনটি উপায় হচ্ছে- ক. মশকী নিধন, খ. মশকীর দংশনের হাত থেকে আত্মরক্ষা এবং গ. ম্যালেরিয়াগ্রস্ত রোগীর চিকিৎসা । নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো-
১. মশকী নিধন : মশককুলের বংশ ধ্বংস করা কঠিন কাজ। তবে নিম্নলিখিত পন্থায় এদের বিস্তার রোধ করা সম্ভব ।
ক. জননক্ষেত্র নির্মূলকরণ: মশকী বদ্ধ, পচা পানিতে ডিম পাড়ে এবং সেখানে ডিম ফুটে লার্ভা ও পিউপা দশার বিকাশ ঘটে। তাই মশা নিধনের জন্য জননক্ষেত্রগুলো বিনাশ করাই উত্তম। নিম্নোক্ত উপায়ে এ কাজ করা যায় । ডোবা, নালা ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করা উচিত যাতে ঐসব স্থানে পানি জমতে না পারে। উন্মুক্ত নর্দমাগুলো ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করা এবং নর্দমাগুলো যাতে পানি বদ্ধ না থাকে সে দিকে নজর দেওয়া। বাড়ির আশেপাশের ঝোপ-ঝাড় ও জঙ্গল কেটে ফেলা। লোকালয়ের আশেপাশে যাতে পানি আবদ্ধ হয়ে না থাকে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া ।
খ. লার্ভা ও পিউপা ধ্বংসসাধন : যেসব জলাশয়ে মশকী ডিম পাড়ে সেখানে পানির উপর কেরোসিন বা পেট্রোল জাতীয় তেল ছিটিয়ে দিলে পানির উপর একটি পাতলা স্তর সৃষ্টি হয়। ফলে এ স্তর ভেদ করে মশকীর লার্ভাগুলোর পক্ষে বাতাস গ্রহণ করা সম্ভবপর না হওয়ায় তারা মারা পড়ে। বিএইচসি (BHC), ডায়েলড্রিন (dieldrin) ইত্যাদি কীটনাশক ওষুধ তেলের পানিতে ছিটিয়ে দিলে মশকীর লার্ভা ও পিউপা মারা যায়। জলাশয়ে কই, খলসে, তেলাপিয়া জাতীয় লার্ভা খাদক মাছ চাষের মাধ্যমে মশকীর লার্ভা ও পিউপা ধ্বংস করা যায়।(জুভেনাইল হরমোন পানিতে মিশিয়ে দিয়ে লার্ভাকে আজীবন লার্ভা করে রেখে দেওয়া।
গ. পূর্ণাঙ্গ মশকী নিধন : দংশন উদ্যত মশকী হাত দিয়ে মেরে ফেলা যায়। বিভিন্ন ফাঁদের সাহায্যে মশকী ধরা সম্ভব। সালফার ডাই-অক্সাইডের ধোঁয়া মশা তাড়াতে বা মেরে ফেলতে সাহায্য করে। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও বিকিরণ দিয়ে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে এদের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
২. মশকীর দংশনের হাত থেকে আত্মরক্ষা : শয়নকক্ষে মশারী ব্যবহার করতে হবে। দেহের অনাবৃত অংশে বিশেষ ক্রিম বা লোশন লাগানে হবে। মশকী নিধন কয়েল জ্বালাতে হবে। ঘরের দরজা জানালায় ঘন তারের নেট লাগাতে হবে। গোয়ালঘর থেকে শয়নকক্ষ দূরে রাখা।
৩. ম্যালেরিয়াগ্রস্ত রোগীর চিকিৎসা : ম্যালেরিয়া রোগাক্রান্ত রোগীকে সর্বদা মশারীর মধ্যে রাখতে হবে। রোগীকে যেন কোনভাবেই মশা দংশন করতে না পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা মশকীর মাধ্যমে রোগীর দেহ থেকে এই রোগের পরজীবী অন্য সুস্থ ব্যক্তির দেহে সঞ্চারিত হয়ে থাকে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে তৎক্ষনাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । ক্লোরোকুইন, নিভাকুইন, ম্যাপাক্রিন, প্যালুড্রিন ইত্যাদি ম্যালেরিয়া পরজীবীর
ভালো ওষুধ ।
পেঁপের রিং স্পট রোগ (Ring Spot Disease of Papaya ):
রিং স্পট রোগ পেঁপের একটি অন্যতম লংসাত্মক রোগ এবং শুধুমাত্র আফ্রিকা ছাড়া পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলে পেঁপে জন্যে সে সব অঞ্চলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় । তবে বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও চায়নার বিভিন্ন অংশে এ রোগের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি) উদ্ভিদ রোগত বিদ জেনসন (Jensen, 1949) প্রথম এ রোগটির নাম দেন। Ring Spot
রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু : Papaya Ringspot Virus Type P (PRSV-P) নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এ রোগ হয়ে থাকে। এটি Ponywns গণের এবং Polyviridae গোত্রের সদস্য। এটি নমনীয় সভাকার কণিকা যা প্রায় ৭৬০- room লম্বা। ভিরিয়নস সূত্রাকার ও অনাবৃত। RNA একসূত্রক এবং লম্বা প্রোটিন আবরণীতে আবৃত।
রোগের লক্ষণঃ
গাছে যে কোন বয়সের গাছে এ রোগ হতে পারে। আক্রমণের ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। তখন কান্তে গাঢ় সবুজ বর্ণের আঁকাবাঁকা দাগ দেখা যায়। অল্প বয়স্ক গাছ এ রোগে আক্রান্ত হলে এর বৃদ্ধি রহিত হয়। এবং এই কোন ফল ধরে না। রোগের চরম পর্যায়ে গাছে ফাটল দেখা দেয় এবং গাছ মরে যায়।
পাতায় : বিকৃতিসহ গোল দাগ (distortion ring spot), ক্লোরোপ্লাস্ট নষ্ট হয়ে পাতায় তীব্র সবুজ-হলুদে নক্সা, পাতা বিভিন্ন মাত্রায় হলদে রং এবং পাতা কুকড়ে যাওয়া প্রভৃতি লক্ষণ সৃষ্টি করে । পত্রবৃত্তের গোড়ায় পানিতে ভেজা গোল দাগ দেখা যায় যা কান্ডের উপরের দিকে ক্রমশ বিস্তৃত হয়। আক্রান্ত গাছের পাতা ছোট হয়ে জন্মায় ফলে কান্ড ছোট হয়ে যায় এবং গাছ খর্বাকায় হয়ে পড়ে। গাছের ফল ধারণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। শীত মৌসুমে লক্ষণ প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
ফল-এ : ফলে গাঢ় সবুজ রংয়ের রিং-এর মতো দাগ দেখা দেয়। ফলের সংখ্যা ও আকারে ভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়। ফল পরিপক্ক বা হলুদ হওয়ার সাথে সাথে দাগ অস্পষ্ট হতে থাকে। বিশেষ করে আক্রান্ত গাছে ফল ধরলে ফলে অনিয়মিত ফোলা ফোলা অংশ দেখা দেয়। অনেক সময় পুষ্ট হওয়ার আগেই ফল ঝরে যায়। গুণগতমান ও পরিমাণে পেঁপের পেপেইন ও মিষ্টতা বহুলাংশে হ্রাস পায় ।
রোগের বিস্তার : এফিড (Aphid) জাতীয় পতঙ্গ (Aplus gossypi, Mymus persicae) পেঁপের রিং স্পট'- ভাইরাস রোগ ছড়ায়। এ ভাইরাস পতঙ্গদেহে দীর্ঘ সময় ধরে থাকে না এবং পতঙ্গদেহে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে পারে না। মাক্রান্ত গাছের রসের সাথে পতঙ্গের ঠোঁটে যে ভাইরাস আসে তাই সে সুস্থ পেঁপে গাছে সংক্রমিত করে মাত্র। পতঙ্গ হয় যান্ত্রিকভাবে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে বীজের মাধ্যমে PRSV ছড়ানোর কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।
প্রতিকারের উপায় : নিচে বর্ণিত উপায়ে এই রোগের প্রতিকার করা যায়।
১. এ জমিতে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে সাথে সাথেই রোগাক্রান্ত গাছ উঠিয়ে মাটি চাপা দিতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২.জাল (net) দিয়ে পুরো জমি (পেঁপের গাছসহ) ঢেকে দিতে হবে যেন এফিড দ্বারা নতুন গাছ আক্রান্ত না হতে পারে।
৩. এফিড নিধনের জন্য পেস্টিসাইড স্প্রে করা যেতে পারে।
৪. চারা লাগানোর প্রথম থেকেই নিয়মিত পেস্টিসাইড স্প্রে করলে এফিড দ্বারা রোগ ছড়ায় না। * রোগাক্রান্ত জমিতে পেঁপে গাছের প্রুনিং (পাতা কাটা, ছাঁটা ইত্যাদি) বন্ধ রাখতে হবে, কারণ কাটা-ছেড়া স্থান দিয়ে রোগাক্রমণ ঘটে থাকে।
প্রতিরোধের উপায় : নিম্নলিখিত উপায়ে রোগটি প্রতিরোধ করা।
১. রোগ প্রতিরোধক্ষম জাতের চাষ করতে হবে। যায়।
২. নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আক্রান্ত গাছ শনাক্ত করে অপসারণ করতে হবে।
৩. আক্রান্ত বাগান থেকে যথাসম্ভব দূরে নতুন বাগান তৈরি করে নতুন আবাদী জমির পরিবর্তন করতে হবে।
৪. যে সমস্ত উদ্ভিদ এ রোগে আক্রান্ত হয় না তার সাথে মিশ্র চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে চাষাবাদ করতে হবে। মাধ্যমে
৫. এ পর্যন্ত PRSV রোগ প্রতিরোধী রোগের কোন ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করা হয়নি তবে জীব প্রযুক্তির হাওয়াই-এ পেঁপের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যেটি PRSV প্রতিরোধী।
৬. ট্রান্সজেনিক জাত ব্যবহার সবচেয়ে নিরাপদ। জিনগান পদ্ধতি ব্যবহার করে PRSV'S Coat Protein জিনকে ভ্রূণ টিস্যুতে সংযুক্ত করে নতুন ট্রান্সজেনিক জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে (১৯৯৮ সালে)। এই ট্রান্সজেনিক জাত (GMO) PRSV দ্বারা আক্রান্ত হয় না।
হেপাটাইটিস বলতে সাধারণত যকৃতের প্রদাহকে বুঝায়। এটি প্রধানত ভাইরাসজনিত যকৃতের রোগ হেপাটাইটিস অনেক কারণে হতে পারে, তবে ভাইরাসজনিত সংক্রমণই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। হেপাটাইটিস সৃষ্টিকারী ভাইরাস অনেক ধরনের। যেমন-হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-ডি এবং হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস।
হেপাটাইটিস 'এ' ভাইরাস : সাধারণত আক্রান্ত রোগীর মলমূত্র, খাবারে বা পানিতে সংক্রমিত হয়ে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। অর্থাৎ দুষিত খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে সুস্থদেহী মানুষের দেহে এ জীবাণু প্রবেশ করে। 'এ' ভাইর অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর। আক্রান্ত ব্যক্তির মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা, দূর্বলতা, বমিভাব, চোখ ও ত্বকের রং পরিবর্তন ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। 'এ' ভাইরাসের সংক্রমণ হলে অল্পকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় ক্ষেত্রে আপনা আপনি সেরে যায়।
হেপাটাইটিস 'বি' ভাইরাস : আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত সঞ্চালন, সংক্রমিত ইঞ্জেকশনের সূঁচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার আক্রান্ত মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের, রোগীর মুখের লালা এবং শরীরের যে কোনো নিঃসৃত রস থেকে এ ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। 'বি' ভাইরাস ভয়ঙ্কর ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। 'বি' ভাইরাস প্রায় ক্ষেত্রে লিভার সিরোসিসসহ নানা জটিলতা সৃষ্টি করে এবং মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।
হেপাটাইটিস 'সি' ভাইরাস : রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমেই প্রধানত এ ভাইরাস সুস্থ ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে। ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক-ড্রাগ গ্রহণে, একই সূচ ব্যবহারেও এ ভাইরাস বিস্তার লাভ করতে পারে। এ ভাইরাস রি হওয়া রক্ত ত্বকের সংস্পর্শে এলেও দেহে বিস্তার লাভ করে। 'সি' ভাইরাস অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও ঝুঁকিপূর্ণ। 'সি' ভাইরাস aleeding দূরারোগ্য, তাই প্রায় ক্ষেত্রে লিভার নষ্টসহ জটিলতা সৃষ্টি করে এবং প্রাণঘাতী
হেপাটাইটিস 'ডি' ভাইরাস : এর সংক্রমণ হেপাটাইটিস 'বি' ভাইরাসের মতো এবং প্রায়শঃই একই ব্যক্তিতে উভয়ের সন্ধান মেলে। এ রোগের কারণে লিভার সিরোসিস হয় এবং রোগীর মৃত্যু ঘটে ।
হেপাটাইটিস 'ই' ভাইরাস : অস্ত্রপথে সংক্রমিত হয়, যেমনটা হয় 'এ' ভাইরাসে। 'ই' ভাইরাস অপেক্ষাকৃত কম ঘড়ি, মুখ ক্ষতিকর। পানি বাহিত এবং খাদ্য ও স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। 'ই' ভাইরাসের সংক্রমণ হলে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় দেখা দেয় ক্ষেত্রে আপনা আপনি সেরে যায়।
রোগের লক্ষণ : লিভার (যকৃত) বড় হয়ে যায়; যকৃত সিরোসিস (liver serosis) সৃষ্টি হয়। জন্ডিস (jaundice) দেখা দেয় এবং রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়। দেহত্বক, মুখ, চোখ এবং থু থু হলুদ বর্ণের হয়। প্রস্রাবের রং- ডিম উৎ সরিষার তেলের রং এর মতো এবং পায়খানা সাদাটে হয়। গুরুতর অবস্থায় জন্ডিসের সাথে পেটে পানি আসে। বমিভার মানবদে বা বমি হয়। খাবারে অরুচি হয় এবং জ্বরও হতে পারে
প্রতিকারের উপায়
১. রুগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
২. প্রচুর পানি, টাটকা ফলের রস, ডাবের পানি, ডালিমের রস, গ্লুকোজ, আখের রস, ছোট মাছ ও মুরগীর কোল, পেঁপে, পটল ও করলার তরকারি খাওয়াতে হবে।
৩. তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে।
৪. কোমল পানীয় পরিত্যাগ করতে হবে; লবণ যাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে এবং বাসি, খোলা ও অফুটানো পানি বর্জন করতে হবে।
৫. নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হবে।
প্রতিরোধের উপায়
১. ভ্যাকসিন গ্রহণ করাই হলো প্রতিরোধের একমাত্র উপায়।
২. হেপাটাইটিস-B-এর ভ্যাকসিন ডোজ ৪টি। প্রথম ৩টি একমাস পরপর এবং ৪ র্থটি প্রথম ডোজ থেকে এক বছর পর দিতে হয়। পাঁচ বছর পর বুস্টার ডোজ নিতে হয়। এর মাধ্যমে শরীরে হেপাটাইটিস- B-ভাইরাসের বিপক্ষে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। পজিটিভ হলে B-বা আক্রান্ত বলে ধরে নেয়া হবে এবং যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।
৩. রক্ত পরীক্ষা করে HBsAg নিতে হবে।
৪. রক্ত দেয়া-নেয়ার ব্যাপারেও সাবধান হতে হবে।
৫. সেলুনে সেভ করা পরিহার করতে হবে এবং প্রতিজনের জন্য আলাদা ব্রেড ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই সবক্ষেত্রে ডিসপোজিবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করা, ইনজেকশনের যন্ত্রপাতি পরস্পর ব্যবহার না করা। : ব্যক্তিগত টয়লেট্রিজ দ্রব্য যেমন রেজর, নেল কাটার, ত্বক ফোটানো ও রক্ত গ্রহণের যন্ত্রপাতি অন্য কেউ ব্যবহার করা যাবে না।
৬. এরোগের সংক্রমণ রোধকল্পে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
ডেঙ্গু (প্রকৃত উচ্চরণ ডেঙ্গী) একটি ভাইরাসঘটিত মারাত্মক জ্বররোগ । বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এ জুরকে ডেঙ্গু জ্বর নামে অভিহিত করা হয়। এ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের নাম ফ্লাভিভাইরাস (thagavirus)। সাধারণভাবে এটি ডেঙ্গু ভাইরাস নামেও পরিচিত । এ ভাইরাসে নিউক্লিক এসিড হিসোবে RNA থাকে। মানুষ এ ভাইরাসের পোষক (host), আর বাহক বা ভেক্টর (vector) হচ্ছে Aedes aegypti ও Aedes albopictus নামক মশকী। এ ভাইরাসের বাহক উষ্ণমন্ডলীয় ও উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি বিস্তৃত। প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে প্রায় ১০ কোটি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়।
রোগের লক্ষণ : সংক্রমণের ৪-৬ দিনের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দেখা দেয় এবং ১০ দিন পর্যন্ত থাকে। এ রোগের লক্ষণ হচ্ছে- (হঠাৎ প্রচন্ড জ্বর; তীব্র মাথাব্যথা; চোখের পেছনে ব্যথা; কোমর, মাংশপেশি ও জয়েন্টে তীব্র ব্যথা; কখনও রাখা এত তীব্র হয় যে, রোগী ব্যথায় কেঁদে ফেলে। এজন্য একে হাড় ভাঙ্গা জন্ম (bone breaking disease) বলে । বমি হওয়া বা বমি বমিভাব; চামড়ায় ছোট ছোট লাল ফুসকুড়ি (rash); মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছালে রক্তক্ষরণ (bleeding) হয়
মাঝে মাঝে রোগের উপসর্গ মৃদুভাবে প্রকাশ পায় এবং ফ্লু বা অন্য ভাইরাস জ্বর হিসেবে ভুল করা হয়। যে সমস্ত শিশু বা পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তি আগে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয় নাই তাদের ক্ষেত্রে আগে আক্রান্ত রোগীর চেয়ে রোগের উপসর্গ হালকাভাবে প্রকাশ পায়। রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে রোগির রক্তক্ষরণ, লসিকানালি ও রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দাঁতের মাড়ি, মুখগহ্বরের প্রাচীর ও নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ, লিভার বড় হয়ে যাওয়া, সংবহনতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। পরবর্তীতে রক্তক্ষরণ বেড়ে গেলে রোগী শকে চলে যায় এবং মৃত্যু ঘটে। একে বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রম (Dengue Shock Syndrome).
রোগের সঞ্চারণ : স্ত্রী' এডিস মশা (Aedes aegypti, A. albopictus) এ ভাইরাসের প্রাথমিক বাহক। এই মশার ডিম উৎপাদনের জন্য মানুষের রক্তের প্রোটিন প্রয়োজন, তাই এরা মানুষকে কামড়ায়। তাই এ মশার কামড়ে ভাইরাস মানবদেহে সঞ্চারিত হয়। ভাইরাস প্রবেশের ৪-১০ দিন পর আক্রান্ত মশা তার বাকী জীবনে এ ভাইরাসের সঞ্চারণ ঘটাতে পারে। সংক্রমিত মানুষ এ ভাইরাসের প্রধান বাহক এবং মানুষের মধ্যেই এদের বৃদ্ধি ঘটে থাকে এবং অসংক্রমিত মশার জন্য ভাইরাসের উৎস বা ভান্ডার হিসেবে কাজ করে।
প্রতিকারের উপায় : ডেঙ্গু জ্বরের রোগীতে রক্ত ক্ষরণের সম্ভাবনা থাকায় অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষুধ মারাত্মক পরিণতি দেখা দিতে পারে। তাই ব্যাথা ও জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিতে হবে। রক্তের সাম্যতা রক্ষার জন্য প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন-এর প্রয়োজন পড়ে। রোগীকে প্রচুর পানি, তরল খাবার ও ফলের রস খাওয়াতে হবে । মাথায় পানি দেয়া জরুরি। তাছাড়া ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর স্পঞ্জ করে দিতে হবে। তবে রোগীর দেহে লক্ষণগুলো প্রকাশের সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
প্রতিরোধের উপায় : যেহেতু এডিস মশার মাধ্যমে রোগটি বাহিত হয় তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা এরোগ প্রতিরোধের প্রধান পদক্ষেপ। পানি জয়ে এমন ভাঙ্গা পাত্র, টায়ার, ফুলের টব প্রভৃতিতে যেন পানি জমে না থাকে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ এডিস মশা হতে ৭ দিন সময় লাগে। এজন্য ফ্রিজের তলদেশে, এয়ারকুলারের নিচে এবং ফুলের টব বা ফুলদানির পানি ৭ দিনের মধ্যে অন্তত একবার পরিষ্কার করা উচিত। দিনের বেলায় এ ধরনের মশা কামড়ায় বলে মশা দমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। বাড়ি ঘরের আশেপাশে জঞ্জাল মুক্ত করে পরিচ্ছন্ন রাখা একান্ত প্রয়োজন। পূর্ণাঙ্গ মশা নিধনের জন্য নিয়মিত পতঙ্গনাশক স্প্রে করে রোগ প্রতিরোধ করা যায়। সম্প্রতি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিতে পতঙ্গনাশক ছাড়াই ডেঙ্গু মশা নিধনের ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে ।
ব্যাকটেরিয়া (গ্রিক শব্দ, Bakterion = ছোট দন্ড) একধরনের এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব । জীবজগতে এগুলোই সরলতম ও ক্ষুদ্রতম জীব বলে পরিচিত। ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজ বিজ্ঞানী অ্যান্টনি ভ্যান লিউয়েনহুক (Antony Van Leeuwenhock) সর্বপ্রথম তাঁর আবিষ্কৃত অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে এক ফোঁটা পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। এগুলোর নাম দেন animaleule বা ক্ষুদ্র প্রাণী। তাই তাঁকে ব্যাকটেরিওলজির জনক বলা হয় ।
লিউয়েনহুক আবিষ্কৃত এসব অণুজীব পরবর্তী প্রায় ২০০ বছর অজানাই রয়ে যায়। ১৮২৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানী এরেনবার্গ (C.G. Ehrenberg) সর্বপ্রথম "bacteria" শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর ( Louis Pasteur) ও ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মান চিকিৎসক বিজ্ঞানী রবার্ট কচ (Robert Koch) প্রমাণ করেন যে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক জীব বিভিন্ন প্রাণিদেহে নানা রকম রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্জিস নামক একজন গবেষক সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন ব্যাকটেরিয়া নামক ক্ষুদ্র জীব উদ্ভিদেও রোগ সৃষ্টি করে।(ব্যাকটেরিয়া হচ্ছে কোষীয় অঙ্গাণুবিহীন, জটিল কোষপ্রাচীর ও আদিপ্রকৃতির (prokaryotic ) নিউক্লিয়াস বিশিষ্ট ক্ষুদ্রতম সরল প্রকৃতির এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব।
বিস্তৃতি ও আবাসস্থল : ব্যাকটেরিয়ার বিস্তৃতি প্রায় বিশ্বব্যাপী। এরা মাটি, বায়ু, পানি, জীবদেহের ভিতর ও বাইরে অবস্থান করে। মানুষের অন্ত্রেও এদের পাওয়া যায়। এর মধ্যে Ecoli ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স সরবরাহ করে। প্রকৃতিতে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থেকে শুরু করে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়া বেঁচে থাকতে পারে। পানি বা মাটিতে জৈব পদার্থ বেশি থাকলে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যাও সেখানে অধিক থাকে। জৈব পদার্থসমৃদ্ধ আবাদী মাটিতে ব্যাকটেরিয়া পর্যাপ্ত থাকে। মাটির গভীরে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। বাতাসে থাকলেও বায়ুস্তরের অনেক উচুঁতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি তেমন নেই।
ব্যাকটেরিয়ার সাধারণ বৈশিষ্ট্য
১. ব্যাকটেরিয়া কোষীয় জীবদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র (০.২-৫.০um), সরল এবং আণুবীক্ষণিক
২. এরা একক বা দলবদ্ধ হয়ে বাস করে।
৩. ব্যাকটেরিয়ার প্রোটোপ্লাজম আদি নিউক্লিয়াসযুক্ত (prokaryotic nucleus), অর্থাৎ নিউক্লিয়াসে নিউক্লিয়ার ঝিল্লি, নিউক্লিওলাস ও ক্রোমাটিন জালিকা থাকে না। শুধু একটি প্যাঁচানো দ্বিসূত্রক DNA তন্তু থাকে। সেজন্য ব্যাকটেরিয়ার নিউক্লিয়াসকে নিউক্লিয়ার বস্তু বা নিউক্লিওয়েড (nucleoid) বলে।
৪. প্রোটোপ্লাজমে কেবল রাইবোজোম (70S) ও মেসোজোম থাকে। একক পর্দাবৃত কোনো কোষ অঙ্গাণু নেই ।
৫. ব্যাকটেরিয়া কোষে কোষঝিল্লির বাইরে একটি সুগঠিত কোষপ্রাচীর রয়েছে, যার প্রধান উপাদান মিউকোপেপটাইড বা পেপটাইডোগ্লাইক্যান, সাথে পলিস্যাকারাইড, মুরামিক এসিড ও টিকোয়িক এসিড থাকে।
৬. অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া পরভোজী ( heterotrophic), কিছু স্বভোজী (autotrophic)। স্বভোজী ব্যাকটেরিয়ার দেহে বিভিন্ন সালোকসংশ্লেষীয় রঞ্জক, যেমন-ব্যাকটেরিওক্লোরোফিল, ব্যাকটেরিওভিরিডিন বা ক্লোরোবিয়াম ক্লোরোফিল এবং ক্যারোটিনয়েড উপস্থিত থাকে।
৭. এদের কতনা বাধ্যতামূলক অবায়বীয় (obligate anaerobes) অর্থাৎ অক্সিজেন থাকলে বাঁচতে পারে না। কতক সুবিধাবাদী অবায়বীয় (facultative anaerobes) অর্থাৎ অক্সিজেনের উপস্থিতিতেও বাঁচতে পারে এবং কতক বাধ্যতামূলক বায়বীয় (obligate aerohes) অর্থাৎ অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না ।
৮. প্রচন্ড ঠান্ডা (-১৭°C) থেকে শুরু করে ৮০°C তাপমাত্রায় ব্যাকটেরিয়া বাঁচতে পারে।
৯. ক্রোমোজোম থাকায় ব্যাকটেরিয়ায় মাইটোসিস ও মিয়োসিস কোষবিভাজন ঘটে না ।
১০. এদের বংশবৃদ্ধির প্রধান প্রক্রিয়া বিভাজন (binary fission)।
১১. ফাজ ভাইরাসের প্রতি এরা খুবই সংবেদনশীল ।
১২. এদের অধিকাংশই অজৈব লবণ জারিত করে শক্তি সংগ্রহ করে।
১৩. প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এন্ডোস্পোর (cndospore) গঠন করে ।
১৪. ব্যাকটেরিয়া সাধারণত বেসিক রং (গ্রাম পজিটিভ বা গ্রাম নেগেটিভ) ধারণ করতে পারে।
ব্যাকটেরিয়ার কোষীয় আকার, ফ্লাজেলার বিন্যাস, রঞ্জক গ্রহণ ক্ষমতা, পুষ্টি গ্রহণ, শ্বসন প্রক্রিয়া প্রভৃতির ভিত্তিতে অণুজীববিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিয়াকে নিম্নলিখিতভাবে শ্রেণিবিন্যাস করেছেন।
ক. আকৃতি অনুসারেঃ
ব্যাকটেরিয়ার কোষের আকৃতি বিভিন্ন ধরনের, যথা- গোলাকার, দন্ডাকার, প্যাচানো, কমা চিহ্ণের মতো, অণুসূত্রাকার, বহুরূপী ইত্যাদি। নিচে এদের বর্ণনা দেয়া হলো ।
১. গোলাকার (Spherical) বা কক্কাস (Coccus বহুবচনে -Cocci) : এককোষী গোল বা ডিম্বাকার, একক ব্যাকটেরিয়াকে কক্কাস বলে। সহাবস্থান অনুযায়ী এসব ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন ধরনের হয়, যেমন-
মাইক্রোকক্কাস (Micrococcus) : 'কক্কাস ব্যাকটেরিয়া যখন এককভাবে থাকে তখন তাকে মাইক্রোকক্কাস বা মনোকক্কাস বলে । উদাহরণ- Micrococcus flavus.
ডিপ্লোকক্কাস (Diplococcus) : এক্ষেত্রে গোলাকার ব্যাকটেরিয়ারসমূহ কক্কাস – জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে । উদাহরণ-Diplococcus pneumoniae.
স্ট্রেপটোকক্কাস (Streptococcus) : এরা দেখতে গোলাকার এবং একটি সারিতে শ খলাকারে থাকে উদাহরণ-Streptococcus lactis
টেট্রাকক্কাস (Tetracoccus) : যখন কক্কাই (গোলাকার ব্যাকটেরিয়া) দুটি ভিন্নতলে বিভাজিত হয় এবং ৪টি কোষের একেকটি গুচ্ছ গঠন করে। তখন সে অবস্থাকে টেট্রাকক্কাস বলে। উদাহরণ- Gaffkya tetragena.
সারসিনা (Sarcina) : যখন কক্কাই তিনটি ভিন্ন তলে বিভাজিত হয় এবং ৪টি করে এক একটি কোষগুচ্ছ গঠন করে। উদাহরণ-Sarcina lutea.
স্ট্যাফাইলোকক্কাস (Staphylococcus) : এক্ষেত্রে কক্কাই তিনটি ভিন্ন তলে অনিয়মিতভাবে বিভাজিত হয় এবং আঙ্গুরের থোকার মতো একেকটি গুচ্ছ গঠন করে। উদাহরণ- Staphylococcus aureus.
২. দণ্ডাকার বা ব্যাসিলাস (Rod-shaped or Bacillus) : এগুলো দেখতে বেলনাকার বা দণ্ডাকার। একক কোষকে ব্যাসিলাস (Bacillus) এবং একত্রে ব্যাসিলি (Bacilli) বলে। এধরনের ব্যাকটেরিয়ার সহাবস্থান অনুযায়ী এগুলো নিন্মোক্ত ধরনেরঃ
মনোব্যাসিলাস (Monobacillus ) : যখন ব্যাসিলাস এককভাবে অবস্থান করে। উদাহরণ-Bacillus
ডিপ্লোব্যাসিলাস (Diplobacillus ) : যখন দণ্ডাকার ব্যাকটেরিয়া বিভাজিত হয়ে দুটি পাশাপাশি সংলগ্ন থাকে। উদাহরণ-Moraxella lacunata.
স্ট্রেপটোব্যাসিলাস (Streptobacillus ) : ব্যাকটেরিয়া বিভাজিত হয়ে পাশাপাশি শৃঙ্খলাকারে অবস্থান করে । উদাহরণ- Bacillus tuberculosis.
কক্টোব্যাসিলাস (Coccobacillus ) : ব্যাকটেরিয়া
সামান্য লম্বা বা ডিম্বাকার হয়। Salmonella,
৩. সর্পিলাকার বা স্পাইরিলাম (Spirillum) : এ ধরনের ব্যাকটেরিয়া-দেহ সর্পিলাকার বা স্ক্রুর মতো প্যাচানো হয় । উদাহরণ-Spirillum minus.
৪. ভিব্রিও (Vibrio) : এগুলো দেখতে কমা আকৃতির, অর্থাৎ দেহ খানিকটা পাক খাওয়া হয়। উদাহরণ- Vibrio
৫. হাইফা বা অণূসূত্রাকার (Hyphac-like) : এগুলো পাতলা প্রাচীরবিশিষ্ট দীর্ঘ অণূসূত্র আকৃতির হয়।
পরিবেশগত অবস্থার কারণে কিছু ব্যাকটেরিয়া তাদের আকৃতির পরিবর্তন ঘটায়, উদাহরণ- Streptomyces sp.
৬. বহুরূপী (Plcomorphic) : এদেরকে বহুরূপী ব্যাকটেরিয়া বলে।
খ. ফ্ল্যাজেলার সংখ্যা ও অবস্থান অনুসারে:
ফ্ল্যাজেলার সংখ্যা ও অবস্থান অনুসারে ব্যাকটেরিয়া প্রধানত ছয় প্রকার; যথা-
১. অ্যাটিকাস (Atrichous) : এসব ব্যাকটেরিয়াতে কোন ফ্ল্যাজেলা থাকে না; উদাহরণ-Diptheria bacilli
২. মনোট্রিকাস (Monotrichous) : এরূপ ব্যাকটেরিয়ার এক প্রান্তে বা এক পার্শ্বে মাত্র একটি ফ্লাজেলাম থাকে। উদাহরণ-Vibrio cholerae
৩. অ্যামফিট্রিকাস (Amphitrichous) : এধরনের ব্যাকটেরিয়ার কোষের দুই প্রান্তে দুটি ফ্ল্যাজেলা থাকে; উদাহরণ-Spirilla serpentans |
৪. সেফালোট্রিকাস (Cephalotrichous) : এসব ব্যাকটেরিয়ার কোষের এক প্রান্তে একগুচ্ছ ফ্ল্যাজেলা থাকে উদাহরণ-Pseudomonas fluorescens.
৫. লফোট্রিকাস ( Lophotrichous) : এধরনের
ব্যাকটেরিয়ার কোষের দুই প্রান্তে দুইগুচ্ছ ফ্ল্যাজেলা থাকে (থাইম্যান, 1950); উদাহরণ-Spirillum volutans
৬. পেরিট্রিকাস ( Peritrichous) : এরূপ ব্যাকটেরিয়া কোষের চারপাশে বহু ফ্ল্যাজেলা থাকে; উদাহরণ- Bacillus tuposus.
গ. রঞ্জক ধারণের ক্ষমতা অনুসারে:
ড্যানিশ চিকিৎসক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান গ্রাম (Hans Christion Gram) ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ব্যাকটেরিয়া কোষে রঞ্জিতকরণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন । তাঁর নাম অনুসারে এই রঞ্জিতকরণ পদ্ধতিকে গ্রাম রঞ্জণ (Gram stain) পদ্ধতি বলা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রধান রঞ্জক হলো কিস্ট্যান্স ভায়োলেট। এ রঞ্জকের উপর ভিত্তি করে ব্যাকটেরিয়া দুই ধরনের।
১. গ্রাম পরিজটিভ (Gram positive) : এরূপ ব্যাকটেরিয়া ক্রিস্ট্যাল ভায়োলেট রং ধারণ করে এবং স্পিরিট দিয়ে ধুয়ে ফেললে রং চলে যায় না; উদাহরণ- Bacillus subjilis।
২. গ্রাম নেগেটিভ (Gram Negative) : এরূপ ব্যাকটেরিয়া ক্রিস্ট্যাল ভায়োলেট রং ধারণ করে কিন্তু স্পিরিট দিয়ে ধুয়ে ফেললে রং চলে যায়; উদাহরণ—Salmonella typhi
ঘ. অক্সিজেনের নির্ভরশীলতা অনুসারে:
অক্সিজেনের নির্ভরশীলতা অনুসারে ব্যাকটেরিয়া প্রধানত দুই প্রকার; যথা-
১.অ্যারোবিক (Aerobic) : এরা বাতাসের মুক্ত অক্সিজেন ছাড়া বাঁচে না। উদাহরণ- Azotobacter beijerinckia |
২. অ্যানঅ্যারোবিক (Anaerobic) : এরা বাতাসের মুক্ত আক্সজেন ছাড়াই বাঁচে। উদাহরণ-Clostridium
ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রোক্যারিওটিক বা আদি প্রকৃতির। বিভিন্ন শ্রেণির ব্যাকটেরিয়ার দৈহিক গঠনেও ভিন্নতা রয়েছে। তবে সাধারণতভাবে একটি আদর্শ ব্যাকটেরিয়ামে যে সব উপাদান পাওয়া যায় তা নিচে বর্ণনা করা হলো।
১. ক্যাপসুল (Capsule) : (ব্যাকটেরিয়াম কোষের জটিল কোষপ্রাচীরের সর্বাপেক্ষা বাইরের স্তর হচ্ছে ক্যাপসুল। একে স্লাইম স্তর (slime layer)-ও বলে। পলিস্যাকারাইড বা পলিপেপটাইডে গঠিত এ স্তরটি সাধারণত পিচ্ছিল ও আঠালো । এটি ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিকূল অবস্থা থেকে রক্ষা করে।
২. কোষপ্রাচীর : ক্যাপসুলের নিচের পুরু, দৃঢ় ও স্থিতিস্থাপক কত গুরটি কোষপ্রাচীর। কোষপ্রাচীরের প্রধান উপাদান মিউকোপেপটাইড এবং গৌণ উপাদানগুলোর মধ্যে প্রোটিন, লিপিড, পলিস্যাকারাইড ইত্যাদি রয়েছে। প্রাচীরের বিভিন্ন জায়গায় Sum ব্যাসের ছিদ্র রয়েছে। ছিদ্রগুলোর মধ্য দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ চলাচল করতে পারে।
৩. কোষঝিল্লি : কোষপ্রাচীরের ঠিক নিচে অবস্থিত সজীব ঝিল্লির নাম কোষঝিল্লি বা প্লাজমা মেমব্রেন। এটি ফসফোলিপিড ও প্রোটিন নিয়ে গঠিত। কোষের ভেতরে ও বাইরে দ্রবীভূত পদার্থসমূহের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা কোষঝিল্লির কাজ ।
৪. সাইটোপ্লাজম : প্লাজমামেমব্রেনে বেষ্টিত অবস্থায় কোষের স্বচ্ছ ও বর্ণহীন অংশকে সাইটোপ্লাজম বলে। এতে নিম্নোক্ত বস্তুসমূহ পাওয়া যায়।
• রাইবোজোম : এটি প্রোটিন ও RNA-র সমন্বয়ে গঠিত । এর কাজ প্রোটিন সংশ্লেষণ।
• ক্রোম্যাটোফোর (Chromatophore ) : ব্যাকটেরিয়ারকোষে ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে না। তবে কিছু ব্যাকটেরিয়ায় ক্রোম্যাটোফোর থাকে। এগুলো সালোকসংশ্লেষণে সহায়তা করে।
• কোষ গহবর : ব্যাকটেরিয়ার সাইটোপ্লাজমে অত্যন্ত ক্ষুদ্র গহ্বর দেখা যায় । গহ্বরগুলো কোষরসে পূর্ণ।
• মেসোজোম : (ব্যাকটেরিয়া কোষের প্লাজমামেমব্রেন কখনও কখনও ভেতরের দিকে ভাঁজ হয়ে থলির মতো যে বিশেষ ধরনের গঠন তৈরি করে তাকে মেসোজোম বলে। এটি ব্যাকটেরিয়ার শ্বসন ও কোষ বিভাজনের সাথে জড়িত। প্রতিলিপনের (রেপ্লিকেশন) পর দুটি অপত্য DNA অণু বিচ্ছিন্নকরণের সাথেও মেসোজোম সংশ্লিষ্ট বলে ধারণা করা হয় ।
• ভলিউটিন (Volutene) : তরুণ ব্যাকটেরিয়ার সাইটোপ্লাজমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানার আকারে ভলিউটিন থাকে। বয়স বৃদ্ধির সংগে সংগে এসব দানা কোষ গহ্বরে স্থানান্তরিত হয়। এগুলো খাদ্য সঞ্চয় করে।
৫. নিউক্লিওয়েড (Nucleoid) : ব্যাকটেরিয়ার নিউক্লিয়াস নিউক্লিয়ার ঝিল্লি, ক্রোমাটিন জালিকা ও নিউক্লিওলাস-বিহীন । সাইটোপ্লাজমে একটি মাত্র দ্বিসূত্রক DNA অত্যন্ত প্যাঁচানো, আবর্তাকারে থাকতে দেখা যায়, একে নিউক্লিওয়েড "বা সিউডোনিউক্লিয়াস বলে। এর কেন্দ্রে RNA থাকে। এ RNA অণুকে ঘিরে পলিঅ্যামিনস বা নিউক্লিওয়েড প্রোটিন থাকে । (হিস্টোন প্রোটিন থাকে না ফলে ইউক্যারিওটিক কোষের মতো ক্রোমাটিন বস্তু গঠিত হয় না, একে নগ্ন ব্যাকটেরিয়াল ক্রোমোজোমও বলা হয়। নিউক্লিওয়েডের বিভাজন ক্ষমতা, পরিব্যক্তি এবং বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ ক্ষমতা রয়েছে।
৬. ফ্ল্যাজেলা (Flagella) : সর্পিলাকার এবং দণ্ডাকার ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে সচরাচর এক বা একাধিক ফ্ল্যাজেলা দেখা যায় । ফ্ল্যাজেলা সাইটোপ্লাজমীয় বহিঃস্তর থেকে সৃষ্টি হয়ে কোষঝিল্লি ও কোষপ্রাচীর ভেদ করে বাইরে প্রসারিত সূক্ষ্ম দীর্ঘ সুতার মতো অংশ। এটি ফ্ল্যাজেলিন প্রোটিনে গঠিত এবং তিনটি অংশে বিভক্ত (i) সূত্র, (ii) সংক্ষিপ্ত হুক এবং (ii) ব্যাসাল বডি। ব্যাকটেরিয়ার চলনে ফ্ল্যাজেলা সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে ।
৭. পিলি (Pilli) : (ফ্ল্যাজেলা ছাড়াও কোনো কোনো ব্যাকটেরিয়ার (গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাটেরিয়ার) বহির্গাত্রে অসংখ্য সূক্ষ্ম সূত্রাকার উপাঙ্গ দেখা যায়, এগুলোকে পিলি বা ফিমব্রি বলে।) ফ্ল্যাজেলার তুলনায় পিলি সংখ্যায় বেশি, দৈর্ঘ্যে ও দৃঢ়তায় কম । এগুলো পিলিন (pilin) নামক প্রোটিনে গঠিত । পিলি পোষক দেহের সাথে নিজেকে আটকে রাখতে সাহায্য করে।
৮. প্লাজমিড (Plasmid) (ব্যাকটেরিয়ার প্রধান বংশগতি বস্তু DNA ছাড়াও কিছু ক্ষুদ্র, গোলাকার, দ্বিতন্ত্রী DNA অণু সাইটোপ্লাজমে থাকতে দেখা যায়, এগুলো প্লাজমিড। এরা স্ববিভাজনক্ষম এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জন্য নির্ধারিত জিন বহন করে। বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের ভিত্তিতে প্লাজমিড বিভিন্ন ধরনের হয়। (জীবপ্রযুক্তিতে ট্রান্সজেনিক ব্যাকটেরিয়া বা জীব সৃষ্টিতে ভেক্টর হিসেবে প্লাজমিড ব্যাপক ব্যবহৃত হয়।
ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি অতি দ্রুত সম্পন্ন হয়। দুটি পদ্ধতিতে জনন ক্রিয়া ঘটে- অযৌন ও যৌন
১. অযৌন জনন (Asexual Reproduction) : (গ্যামেট উৎপাদন ও এদের মিলন ছাড়াই যে জনন ঘটে তার নাম অযৌন জনন । এ ধরনের জনন পদ্ধতিতে একটিমাত্র মাতৃদেহ থেকেই নতুন জীবের সৃষ্টি হয়। ব্যাকটেরিয়াতে নানা ধরনের অযৌন জনন সম্পন্ন হলেও দ্বিভাজন পদ্ধতিই এর সংখ্যাবৃদ্ধির প্রধান উপায়। নিচে বিভিন্ন ধরনের অযৌন জনন পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।
ক. দ্বিভাজন (Binary fission) : এ ধরনের জননের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার কোষদেহটি সরাসরি (ক্রমাগত ধীর প্রক্রিয়ায়) বিভাজিত হয়ে হুবুহু একই রকমের দুটি অপত্য কোষে পরিণত হয় । প্রতিটি অপত্য কোষ পরিণত হয়ে পুনরায় একই ভাবে বিভাজিত হয়ে অসংখ্য অপত্য কোষের সৃষ্টি করে। এভাবে ক্রমাগত বিভাজন পদ্ধতির দ্বারা স্বল্প সময়ে ব্যাকটেরিয়া কোষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রক্রিয়াটি নিম্নবর্ণিত উপায়ে সম্পন্ন হয়।
১. প্রক্রিয়ার শুরুতে ব্যাকটেরিয়াল DNA ব্যাকটেরিয়া কোষের দুই প্রান্তের মাঝামাঝি অবস্থান নেয় এবং কোষঝিল্লির (কখনও কখনও একটি মেসোজোম) সাথে যুক্ত হয়।
২. কোষঝিল্লির সাথে যুক্ত অবস্থায় DNA অণুর প্রতিলিপন বা রেপ্লিকেশন ঘটে ফলে দুটি অপত্য DNA অণু সৃষ্টি হয় ।
৩. কোষটির দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং কোষের দুই প্রান্তের মাঝখানে নতুন কোষপ্রাচীর ও কোষঝিল্লির বৃদ্ধি সংঘটিত হয় ।
৪. কোষপ্রাচীর ও কোষঝিল্লি লম্বায় বৃদ্ধির কারণে অপত্য DNA অণুদুটি দুই দিকে পৃথক হয়ে যায়।
৫. দুই DNA অণুর মাঝখানে বৃদ্ধিরত কোষপ্রাচীর ও কোষঝিল্লি ক্রমশ ভেতরের দিকে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ভেতরে প্রবেশ করে ছেপ্রাচীর (septum) নির্মাণ করে।
৬. কোষের সাইটোপ্লাজম ধীরে ধীরে দুভাগে বিভক্ত হয়ে এবং গোলাকার DNA-তন্ত্রী (নিউক্লিওয়েড) পরিবেষ্টিত হয়ে দুটি পৃথক অপত্য কোষে পরিণত হয়।
৭. নতুন সৃষ্ট অপত্য কোষদুটি পরস্পর হতে পৃথক হয়ে যায়, অনুকূল পরিবেশে বৃদ্ধি পেয়ে মাতৃকোষের সমান আকার ধারণ করে এবং পুনরায় দ্বিভাজন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
খ. মুকুলোদগম (Budding) : এ প্রক্রিয়ায় মাতৃকোষের একাংশ বিবর্ধিত হয়ে মুকুল (bud) গঠন করে এবং দেহের DNA টি দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে একটি অংশ (DNA) মুকুলের মধ্যে প্রবেশ করে। ওই মুকুলটি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে বড় হয় এবং পরিণত মুকুল মাতৃকোষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অপত্য ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়।
গ. খন্ডায়ন (Fragmentation) : এ প্রক্রিয়া সূত্রাকার ব্যাকটেরিয়া যেমন-স্ট্রেপটোমাইসিস প্রজাতিতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সূত্রাকার ব্যাকটেরিয়ার দেহ বিভাজনের মাধ্যমে বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে অসংখ্য দণ্ডাকার ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করে ।
ঘ. কনিডিয়া (Conidia) : সূত্রাকার স্ট্রেপটোমাইসিস ব্যাকটেরিয়া স্পোরের মতো কতগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ কনিডিয়া বা কুনিডিওস্পোর গঠন করে বংশ বৃদ্ধি করে। কনিডিয়া দ্বিভাজন প্রক্রিয়ায় অল্প সময়ে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দেয়। (সূত্রাকার ব্যাকটেরিয়ার সচল কনিডিয়াকে গোনিডিয়া (gonidia) বলে।)গনিডিয়া (Gonidia) : কতগুলো ব্যাকটেরিয়ার প্রোটোপ্লাজম খন্ডিত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফ্ল্যাজেলাযুক্ত গনিডিয়া বা গনিডিওস্পোর উৎপন্ন করে। মাতৃ-কোষে প্রাচীর বিদীর্ণ হয়ে গনিডিয়াগুলো বাইরে বেরিয়ে এসে অপত্য ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করে। Leucothris- জাতীয় সূত্রাকার ব্যাকটেরিয়া এভাবে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় ।
চ. এন্ডোস্পোর (Endospore) : প্রতিকূল পরিবেশে উপযুক্ত খাদ্যের অভাব ঘটলে ব্যাকটেরিয়া অন্তরেণু বা এন্ডোস্পোর সৃষ্টি করে বংশের বিস্তার ঘটায়। এ সময় ব্যাকটেরিয়া কোষের প্রোটোপ্লাস্ট সংকুচিত হয়ে গোল বা প্রতিকূ ডিম্বাকার ধারণ করে। এর চারদিকে একটি পুরু আবরণ তৈরি হলে তাকে এণ্ডোম্পোর বলে।এণ্ডোস্পোরের সাহায্যে ব্যাকটেরিয়াম কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি হয় না । তাই একে বংশবৃদ্ধির উপায় হিসেবে বিবেচনা না করে বরং প্রতিকূলতা প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে রেস্টিং স্পোর (resting spore) নামে অবকাশকালীন স্পোর হিসেবে গণ করা হয়। সাধারণত Bacillaceae গোত্রের ব্যাকটেরিয়া এন্ডোস্পোর উৎপন্ন করে থাকে।
যৌন জনন (Sexual reproduction) :
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে জানা গেল যে ব্যাকটেরিয়া এক ধরনের আদি প্রক্রিয়ার যৌন জননে অংশ নেয়। এক্ষেত্রে কোনো গ্যামেটের সৃষ্টি হয় না, দুটি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে শুধু জিনগত পদার্থের বিনিময় ঘটে। তাই এ প্রক্রিয়াকে জিনগত পুনর্বিন্যাস বা জেনেটিক রিকম্বিনেশন (genetic recombination) বলে ।
E. coli নিয়ে গবেষণাকালে এ ঘটনা আবিষ্কৃত হয়েছে।ইলেকট্রণ অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে দেখা যায় যে উল্লিখিত প্রক্রিয়া ঘটার সময় দুটি ব্যাকটেরিয়া প্রত্যক্ষ সংযুক্তি কনজুগেশন (conjugation) এর মাধ্যমে মিলিত হয়। যে ব্যাকটেরিয়াম দাতা (বা পুরুষ) হিসেবে ভূমিকা পালন করে তার দেহে বিশেষ ধরনের জিনবাহী পাইলাস থাকে। এর নাম F pilus (Fertility pilus)। পাইলাস ফাঁপা সূত্রের মতো । এর ভিতর দিয়ে দাতার DNA গ্রহীতার (-) দেহে প্রবেশ করে। কিন্তু দাতা কোষের নিউক্লিও পদার্থ সম্পূর্ণরূপে স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্বেই কোষ দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে গ্রহীতা কোষটি দাতা কোষের নিউক্লিও-পদার্থের অংশবিশেষ লাভ করে একটি আংশিক বা অসম্পূর্ণ জাইগোট-এ পরিণত হয়। এ ধরনের জাইগোট মেরোজাইগোট (merozygote) নামে পরিচিত। সংশ্লেষের শেষে দাতা কোষটি বিনষ্ট হয়।
মেরোজাইগোটের অভ্যন্তরে দাতা কোষ ও গ্রহীতা কোষের নিউক্লিও-পদার্থগুলোর বিনিময় ও পুনর্বিন্যাস ঘটে । ফলে নতুনভাবে বিন্যস্ত নিউক্লিওয়েডের সৃষ্টি হয়। অতঃপর মেরোজাইগোটটি স্বাভাবিক দ্বিভাজন প্রক্রিয়ায় বিভক্ত হয়। ফলে অপত্য কোষগুলোতে মিশ্র চরিত্রের (অর্থাৎ যৌন জননে অংশ গ্রহণকারী দাতা ও গ্রহীতা কোষের মিশ্র চরিত্র) উদ্ভব ঘটে ।
ব্যাকটেরিয়ার যৌন জনন প্রকৃত যৌন জনন নয়। আধুনিক বিজ্ঞানীরা এ ধরনের মিলনকে চারিত্রিক গুণাবলির বিনিময় ও পুনর্বিন্যাস নামে আখ্যায়িত করার পক্ষপাতী।
বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের রোগ সৃষ্টির সাথে ব্যাকটেরিয়া ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। এরা মানুষের কলেরা, টাইফয়েড, টিটেনাস, যুগ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, রক্ত আমাশয় ইত্যাদি রোগ সৃষ্টি করে। ধানের পাতার ব্লাইট, গমের টুন্ডু, আখের আঠাঝরা, গোল আলুর বাদামি পচা, লেবুর ক্যাংকার, টমেটো, আলু, শশা, কুমড়ার উইন্ট, সিমের ধ্বসা ইত্যাদি বহু রোগের জন্য এরা দায়ী। এখানে ব্যাকটেরিয়াজনিত ধান গাছের রাইট ও মানুষের কলেরা রোগ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ধানের ধ্বসা বা ব্লাইট রোগ (Bacterial Blight of Rice) ধান গাছের পাতার এই রোগ Xanthomonas oryzae নামক ব্যাকটেরিয়াম-এর আক্রমণের ফলে ঘটে। ধান গাছের ক্ষতিকর রোগগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে জাপানে এ রোগের অস্তিত্বের বিবরণী প্রকাশিত হয়। জাপান, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, চীন, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশে এ রোগ মহামারী হয়ে এসেছিল। বর্তমানে ভারত ও লেবায় বাংলাদেশের ধান ফসলের জন্য এটি এক প্রধান সমস্যা।
রোগের উৎপত্তি ও বিস্তার : একাধিক উৎস থেকে রোগাক্রমণ ঘটতে পারে, যেমন- রোগাক্রান্ত বীজ, রোগাক্রান্ত খড়, জমিতে পড়ে থাকা রোগাক্রান্ত শস্যের অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি। X. oryzae বীজ ও মাটির মধ্যে অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারে । নানান আগাছা ব্যাকটেরিয়ার বেঁচে থাকার উপযোগী পরিবেশ। যে সব খাল-বিলের পানি ধানক্ষেতে সেচের জন্য ব্যবহার করা হয় তারমধ্যে ব্যাকটেরিয়া সারাবছর বেঁচে থাকতে পারে এবং দূষিত খাল-বিলের পানি গ্রীষ্মমন্ডলে রোগ উৎপত্তির অন্যতম প্রধান কারণ। সাধারণত পাতার উপরিস্থিত হাইডাথোডের ছিদ্র, কান্ডে নতুন শিকর গজানোর সময় পাতার গোড়ার দিকে যে ফাটল দেখা দেয় এবং অন্যান্য ক্ষতস্থান দিয়ে ব্যাকটেরিয়া ধানগাছের মধ্যে অণুপ্রবেশ করে । বীজতলা থেকে চারা উঠানোর সময় শিকড় ছিঁড়ে এবং চারা রোপনের আগে পাতার আগা কেটে ফেলার পথে রা জন্য যে ক্ষতের সৃষ্টি হয় তার মধ্য দিয়ে ব্যাকটেরিয়া সহজে গাছের মধ্যে প্রবেশ করে। আক্রান্ত গাছের পাতা থেকে পরিমা ব্যাকটেরিয়া বাতাস ও বৃষ্টির ছিটার সাহায্যে এক পাতা থেকে অন্য পাতায় এবং এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ক্ষতের পানির মাধ্যমেও ব্যাকটেরিয়া মাঠের অন্যান্য ক্ষেতে ছড়িয়ে রোগ সংক্রমণ করে। রোগের লক্ষণ : সাধারণত চারা লাগানোর পাঁচ-ছয় সপ্তাহ পরে এ রোগ দেখা দেয়।
রোগের লক্ষণগুলো হচ্ছে-
১. প্রাথমিক অবস্থায় পাতার কিনারার দিকে পানি ভেজার মতো দাগ দেখা দেয়। ক্রমে ঐ দাগ হলদে থেকে সাদা আলোর রঙের জলছাপের মতো দাগ সৃষ্টি করে।
২. আক্রান্ত অংশ অনেকটা ঢেউ খেলানোর মতো দেখায় এবং কয়েক দিনের মধ্যে ঝলসে শুকিয়ে খড়ের রঙ ধারণ করে।
৩. দাগের একপ্রান্ত বা উভয় প্রান্তে অথবা ক্ষত পাতার যে কোন স্থান থেকে শুরু হয়ে দাগ ধীরে ধীরে পাতার সবস্তরে ছড়িয়ে পড়ে । সংবেদনশীল জাতের ধান গাছে দাগ পাতার খোলসের নিচ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে ।
৫. পাতায় সদ্য আক্রান্ত অংশে ভোরের দিকে দুধ বর্ণের আঠালো ফোঁটা জমতে দেখা যায় যা পরে শুকিয়ে কমলা রঙের ছোট ছোট পুতির দানার মতো আকার ধারণ করে।
৬. এসব দানা অসংখ্য ব্যাকটেরিয়ার সমন্বয়ে গঠিত যা সামান্য বাতাসে ধুলোর মতো উড়ে যায় ।
৭. ধানের ছড়া বন্ধ্যা হয়, তাই ফলন ৬০% পর্যন্ত কম হতে পারে।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
১. যেহেতু এ রোগ বীজধানের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই এ রোগ নিয়ন্ত্রনের প্রধান উপায় বীজ শোধন । ব্লিচিং পাউডার (১০০ mg/ml) এবং জিঙ্ক সালফেট (২%) দিয়ে বীজ শোধন করলে রোগের আক্রমন বহুলাংশে কমে যায়।
২. ধান চাষের জন্য রোগ প্রতিরোধক্ষম প্রকরণ ব্যবহার করতে হবে।
৩. জমিতে অবশ্যই আগাছামুক্ত রাখতে হবে, ফসল কাটার পর জমি চাষে গোড়াগুলো জড়ো করে পুড়িয়ে ফেললে রোগের উৎস নষ্ট হয় এবং পুনরাক্রমনের সম্ভাবনা কমে।
৪. উঁচু জমিতে বীজতলা করতে হবে। যাতে অন্য জমির পানি বীজতলায় প্রবেশ করতে না পারে।
৫. বীজতলায় পানি কম রাখতে হবে, অতি বৃষ্টির সময় পানি সরানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে ।
৬. বীজতলায় পানি কম রাখতে হবে, অতিবৃষ্টির সময় পানি সরানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। চারা থেকে চারার দূরত্ব, লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব, সার প্রয়োগ (বিশেষ করে ইউরিয়া) বিজ্ঞানসম্মত হতে হবে।
৭. বীজ বুনা বা চারা লাগানোর আগে জমিকে ভালোভাবে শুকাতে হবে, পরিত্যক্ত খড় ও আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে হবে'।
৮. রোপণের সময় চারাগাছের পাতা ছাঁটাই করা নিষেধ।
৯. নাইট্রোজেন সার বেশি ব্যবহার করা যাবে না।
১০.ফিনাইল সালফিউরিক এসিডের এম. ক্লোরামফেনিকল ১০-২০ লিটার পরিমাণে মিশিয়ে আক্রান্ত ক্ষেতে ছিটালে রোগ নিয়ন্ত্রণ হয়।
১১.বীজ বপনের আে ০.১% সিরিসান দ্রবণে ৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে বীজবাহিত সংক্রমণ রোধ হয় ।
আরও দেখুন...