বর্তমান বৃহদায়তন ব্যবসায়ের জগতে কোম্পানি সংগঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ব্যবসায় সংগঠন। এটি একটি আইন-সৃষ্ট যৌথ মালিকানার স্বেচ্ছামূলক ব্যবসায় সংগঠন, এর এমন বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে যা একে অন্যান্য ব্যবসায় সংগঠন থেকে পৃথক সত্তার অধিকারী করেছে। কোম্পানি সংগঠনের এ বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. জটিল গঠন পদ্ধতি (Complicated formation): যৌথ মূলধনী কোম্পানির গঠন পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট আইনানুগ আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়।
২. স্বেচ্ছামূলক সংস্থা (Voluntary association): যৌথ মূলধনী কোম্পানি একটি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যবসায় সংস্থা। মুনাফার উদ্দেশ্যে কতিপয় ব্যক্তির স্বেচ্ছাকৃত প্রচেষ্টায় কোম্পানি গঠিত হয়ে থাকে । যে কেউ ইচ্ছা করলেই শেয়ার ক্রয় করার মাধ্যমে কোম্পানির মালিক হতে পারে, আবার কেউ ইচ্ছা করলেই শেয়ার হস্তান্তর করে সহজেই ব্যবসায় হতে বিদায় নিতে পারে ।
৩. বিপুল পুঁজি (Huge capital): বহু সংখ্যক ব্যক্তির সংগঠন বিধায় কোম্পানি তুলনামূলকভাবে অধিক মূলধন সংগ্রহ করতে পারে । এটি জনগণের নিকট শেয়ার বিক্রি করে প্রয়োজনীয় মূলধনের সংস্থান করে থাকে ।
৪. বৃহদায়তন ব্যবসায় সংগঠন (Large-scale enterprise): আধুনিক বৃহদায়তন ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে যৌথ মূলধনী কোম্পানি সমধিক পরিচিত। প্রচুর সদস্য সংখ্যা, ব্যাপক মূলধন সর্বক্ষেত্রেই কোম্পানি বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত।
৫. লভ্যাংশ বণ্টন (Distribution of dividend): যৌথ মূলধনী কোম্পানির অর্জিত মুনাফার একটা নির্দিষ্ট অংশ লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ার মালিকদের মধ্যে শেয়ারের আনুপাতিক হারে বণ্টিত হয়ে থাকে । কোম্পানির সাধারণ সভার অনুমোদনক্রমে পরিচালকগণ এই লভ্যাংশের পরিমাণ ঘোষণা করেন ৷
৬. করারোপ (Taxation): কোম্পানির ওপর ধার্য করের হার সাধারণত অধিক হয়ে থাকে। এর অর্জিত মুনাফার ওপর করারোপ করা হয়। আবার শেয়ার মালিকদের প্রাপ্ত লভ্যাংশের উপর কর প্রদান করতে হয় ।
৭. বিলোপসাধন (Dissolution): যৌথ মূলধনী কোম্পানির গঠন যেমন আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ তেমনি এর বিলোপসাধনের ক্ষেত্রেও আনুষ্ঠানিকতা পালনের প্রয়োজন হয়। কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী এর বিলোপসাধন ঘটে। এ কারণে কোম্পানির সদস্য বা শেয়ারহোল্ডারগণ ইচ্ছা করলেই এর বিলোপসাধন করতে পারে না ।
৮. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা (Democratic management): যৌথ মূলধনী কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল স্তরে গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুসৃত হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শেয়ারহোল্ডারগণের ভোটের মাধ্যমে কোম্পানির পরিচালকগণ নির্বাচিত হয়ে থাকে এবং তাদের দ্বারা কোম্পানি পরিচালিত হয়। এছাড়া ব্যবসায়ের উল্লেখযোগ্য নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও শেয়ারহোল্ডারগণের ভোটের ফলাফলের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে।
১. আইন-সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান (Law-created concern): কোম্পানি আইন দ্বারা এ প্রতিষ্ঠান সৃষ্ট হয়। বাংলাদেশে যৌথ মূলধনী কোম্পানিসমূহ ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন অনুযায়ী গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। উক্ত আইনের ২.১ (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে যে, ”কোম্পানি বলতে এ আইনের অধীনে গঠিত এবং নিবন্ধনকৃত কোনো কোম্পানি বা কোনো বিদ্যমান কোম্পানিকে বোঝাবে।”
২. সদস্য সংখ্যা (Number of members) : কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী কোম্পানির সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে এর সদস্য সংখ্যা ন্যূনতম ২ এবং সর্বাধিক ৫০ জনে সীমাবদ্ধ থাকে এবং পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির বেলায় সর্বনি সদস্য সংখ্যা ৭ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যা কোম্পানির সংঘ-স্মারকে উল্লিখিত শেয়ার সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে ।
৩. পৃথক ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা (Seperate and aritificial entity): কোম্পানি একটি স্বতন্ত্র কৃত্রিম ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। এ কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা এর সদস্যদের সত্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আইন অনুযায়ী এটি কৃত্রিম ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা ভোগ করে থাকে। এই আইনগত সত্তাবলে কোম্পানি নিজ নামে অন্যের সাথে যেমনি লেনদেন করতে পারে তেমনি মোকদ্দমাও দায়ের করতে পারে।
৪. চিরন্তন অস্তিত্ব (Perpetual succession): আইনের দৃষ্টিতে কোম্পানি চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী এক কৃত্রিম ব্যক্তি। কোম্পানির সদস্য বা শেয়ার মালিকদের অস্তিত্বের উপর এ অস্তিত্ব নির্ভর করে না। কোম্পানির মালিকানা বা সদস্য পদের পরিবর্তনে এর অস্তিত্ব বিপন্ন হয় না। কেবল কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী কোম্পানির বিলোপসাধন করা হলেই এর অস্তিত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে থাকে।
৫. সীমিত দায় (Limited liability): কোম্পানির সদস্য বা শেয়ারহোল্ডারদের দায় সীমিত। একজন সদস্য যে পরিমাণ অর্থের শেয়ার কিনবে ঠিক সে পরিমাণ অর্থের জন্যই তাকে দায়ী করা যেতে পারে-এর বেশি নয়। অর্থাৎ এর সদস্যদের দায় তাদের ক্রয়কৃত শেয়ারের মোট মূল্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে।
৬. বাধ্যতামূলক নিবন্ধন (Compulsory registration ) : যৌথ মূলধনী কোম্পানির নিবন্ধন আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক। কোম্পানি আইন অনুসারে যৌথ মূলধনী কোম্পানিকে অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হবে। নিবন্ধন ব্যতীত কোনো কোম্পানি গঠিত এবং পরিচালিত হতে পারে না ।
৭. সাধারণ সীলমোহর (Common seal): প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব নামাঙ্কিত একটি সাধারণ সীলমোহর থাকে। কোম্পানির যাবতীয় দলিল-দস্তাবেজ ও কাগজপত্রে এ সীলমোহর ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। এ সীলমোহরের মাধ্যমেই যৌথ মূলধনী কোম্পানি স্বতন্ত্র ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা নিয়ে জনসাধারণের নিকট পরিচিতি লাভ করে ।
৮. শেয়ারের হস্তান্তরযোগ্যতা (Transferability of shares): যৌথ মূলধনী কোম্পানির শেয়ারগুলো অবাধে হস্তান্তরযোগ্য। শেয়ারের হস্তান্তরের সাথে সাথে কোম্পানির মালিকানায়ও পরিবর্তন সূচিত হয়। অর্থাৎ শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে শেয়ার ক্রয়কারী কোম্পানির মালিক হন ।
পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি সংগঠন আইন-সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার অধিকারী বৃহদায়তন প্রকৃতির ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। যা কোম্পানি আইন এবং নিজস্ব স্মারকলিপি ও পরিমেল নিয়মাবলির আওতায় একটি স্বতন্ত্র ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে গঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে ।
আরও দেখুন...