বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় দায় হলো ব্যবসায়ী সমাজের । আবহমান কাল থেকে কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি মানুষের চিন্তায় আসেনি । কিন্তু যখন শিল্প-বাণিজ্য বেড়ে ওঠা শুরু হলো তখনই পরিবেশ দূষণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকলো । গ্রামের একটা ছোট বাজারকে নিয়েই যদি ভাবা যায় তবে দেখা যাবে হাটের দিন মানুষের কোলাহল, ধুলা-বালিসহ নানানভাবে সেখানের পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ছে । বাজারে উচ্চ আওয়াজে গানের সিডি বাজানো হচ্ছে, ঔষধ বিক্রেতাসহ নানান বিক্রেতারা মাইকে উচ্চস্বরে বক্তৃতা দিচ্ছে- এভাবে যদি শহর ধরা যায়, রাজধানী ধরা যায় তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ব্যবসায়কে কেন্দ্র করে পরিবেশ কতটা দূষিত হচ্ছে । নিম্নে বিভিন্ন ধরনের দূষণে ব্যবসায়ের প্রভাব সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
১. শব্দ দূষণ ও এর প্রভাব (Sound pollution& its influence) : পারিপার্শ্বিকতায় শব্দ ও কোলাহল বেড়ে যাওয়ার কারণে শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশে যে অস্বাভাবিকতার জন্ম নেয় তাকে শব্দ দূষণ বলে । এই শব্দ দুষণে ব্যবসায়ীরাই মুখ্য ভূমিকা রাখে। ব্যবসায়ের উন্নয়ন এবং বাজার ও শহর সৃষ্টি শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ । উড়োজাহাজ উঠছে ও নামছে এতে শব্দ দূষণ ঘটছে । রেলগাড়ি, বাস-ট্রাকসহ সব ধরনের পরিবহণ শব্দ দূষণের কারণ । মেশিনের শব্দ, বুলডোজার ও ড্রিলের শব্দ, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি নানান ব্যবসায়িক কাজে শব্দ দূষণ ঘটছে । গ্রামের বাজারে উচ্চ আওয়াজে দোকানে সিডি বাজছে, মাইকিং হচ্ছে- এগুলোরও প্রধান কারণ ব্যবসায় । এরূপ শব্দ দূষণের ফলে মানুষের শ্রবণ শক্তি, চিন্তা ও অনুভূতি শক্তি হ্রাস পাচ্ছে । মানসিক চাপ বাড়ছে, সুস্থ চিন্তা-ভাবনায় বাধার সৃষ্টি হচ্ছে । উচ্চ রক্তচাপসহ কানে ও মাথায় নানা ধরনের রোগ সৃষ্টিতে এরূপ দূষণ অন্যতম কারণ ।
২. পানি দূষণ ও এর প্রভাব (Water pollution & its influence) : পানির স্বাভাবিকতায় প্রাণীজগত ও সৃষ্টিকূলের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকরণের কাজকেই পানি দূষণ বলে । এই পানি দূষণের অন্যতম কারণ ব্যবসায় কর্মকাণ্ড । শিল্পবর্জ্য ও ব্যবসায়িক তরল ময়লা যখন নির্দ্বিধায় পানিতে ছেড়ে দেয়া হয় তখন ঐ পানি মানুষের জন্য আর উপকারী থাকে না । বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষা নদীর পানির রং ও দুর্গন্ধ থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় । নদীতে ও সমুদ্রে জলযান চলছে। তৈল, ময়লাসহ নানান আবর্জনা ফেলা হচ্ছে পানিতে । তৈল ট্যাংকার ফেটে ও খনি থেকে তৈল নির্গত হচ্ছে পানিতে। এতে পানি তার স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে। এভাবেই ব্যবসায় কর্মকাণ্ড পানি দূষণে বিরূপ ভূমিকা রাখছে। এরূপ পানি দূষণ চর্মরোগ সৃষ্টির মুখ্য কারণ । এছাড়া পানিবাহিত রোগ টাইফয়েড, ডায়রিয়া, জণ্ডিস ইত্যাদি পানি দূষণের ফলে সৃষ্টি হয় । মাছসহ জলজ প্রাণী নিধনে পানি দূষণ মুখ্য ভূমিকা রাখে ।
৩. বায়ু দূষণ ও এর প্রভাব (Air pollution & its influence) : স্বাভাবিক উপাদানের বাইরে বায়ুতে যখন নানান ধরনের ধুয়া, গ্যাস, ধুলা-বালি, সিসাসহ নানান খারাপ উপাদান যুক্ত হয় তখন তাকে বায়ু দূষণ বলে । ব্যবসায় আজ এই নির্মল বায়ু থেকেও মানুষকে বঞ্চিত করছে। ঢাকা শহরের কথাই যদি ধরা যায় তবে পরিবহনের গাড়িগুলো প্রতিদিন যে পরিমাণ ধুয়া ছড়াচ্ছে; তাতে ঢাকার বাতাস দূষিত হচ্ছে । ইটের ভাটা আমাদের দেশে বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ । শিল্প কারখানার ধুয়া, ধুলা-বালি, পরিবহণের পোড়া ডিজেল থেকে নির্গত সিসা ইত্যাদি বায়ু দূষণ করছে। এতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। ওজনস্তর ক্ষয় হচ্ছে। নানান ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে। ত্বক ক্যান্সার, ফুসফুসজনিত রোগ, যক্ষ্ণা, এ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব এ কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
৪. মাটি দূষণ ও এর প্রভাব (Soil pollution & its influence): উর্বর মাটি যখন নানান খারাপ উপাদানযুক্ত হয়ে তার স্বাভাবিকতা হারায় তখন তাকে মাটি দূষণ বলে। এই মাটিও আজকে ব্যবসায় কর্মকাণ্ডের কারণে দূষণের অসহায় শিকার । কৃষি ফার্মগুলো অতিরিক্ত সার আর কীটনাশক ব্যবহার করে মাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে । শিল্পবর্জ্য জমিতে ফেলে মাটির ক্ষতি করা হচ্ছে । ইটের ভাটার টুকরো ইট মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করছে । খনি থেকে সম্পদ আহরণের ফলে জমি যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি এ সকল খনিজ পদার্থ মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। ভূগর্ভস্থ পানি অধিক মাত্রায় উঠিয়ে ফেলার কারণে মাটির শুষ্কতা বাড়ছে । মাটির নিচ দিয়ে যখন বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নানান সংযোগ লাইন টানা হচ্ছে তাতেও মাটি তার স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে । এই মাটি দূষণ কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে । মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে । দূষিত মাটিতে চাষ করা শাক-শব্জী খেয়ে মানুষ পেটের পিড়া, কিডনি ও লিভারের নানা রোগে ভুগছে।
Read more