নষ্ট হওয়া স্বভাব যার – এক কথায় কী হবে?
যে সুবিন্যস্ত পদসমষ্টি দ্বারা কোনো বিষয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, তাকে বাক্য বলে। কতগুলো পদের সমষ্টিতে বাক্য গঠিত হলেও যে কোনো পদসমষ্টিই বাক্য নয়। বাক্যের বিভিন্ন পদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বা অন্বয় থাকা আবশ্যক। এ ছাড়াও বাক্যের অন্তর্গত বিভিন্ন পদ দ্বারা মিলিতভাবে একটি অখণ্ড ভাব পূর্ণ রূপে প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন, তবেই তা বাক্য হবে।
ভাষার বিচারে বাক্যের নিম্নলিখিত তিনটি গুণ থাকা চাই। যেমন –
(১) আকাঙ্ক্ষা
(২) আসত্তি এবং
(৩) যোগ্যতা
১. আকাঙ্ক্ষা : বাক্যের অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এক পদের পর অন্য পদ শোনার যে ইচ্ছা তা-ই আকাঙ্ক্ষা। যেমন – ‘চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে’– এটুকু বললে বাক্যটি সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে না, আরও কিছু ইচ্ছা থাকে। বাক্যটি এভাবে পূর্ণাঙ্গ করা যায় : চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। এখানে আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি হয়েছে বলে এটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য ৷
২. আসত্তি : মনোভাব প্রকাশের জন্য বাক্যে শব্দগুলো এমনভাবে পর পর সাজাতে হবে যাতে মনোভাব প্রকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়। বাক্যের অর্থসঙ্গতি রক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল পদবিন্যাসই আসত্তি। যেমন –
কাল বিতরণী হবে উৎসব স্কুলে আমাদের পুরস্কার অনুষ্ঠিত। লেখা হওয়াতে পদ সন্নিবেশ ঠিকভাবে না হওয়ায় শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবটি যথাযথ প্রকাশিত হয়নি। তাই এটি একটি বাক্য হয়নি। মনোভাব পূর্ণ ভাবে প্রকাশ করার জন্য পদগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে। যেমন –
কাল আমাদের স্কুলে পুরস্কার বিতরণী উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। বাক্যটি আসত্তিসম্পন্ন।
৩. যোগ্যতা : বাক্যস্থিত পদসমূহের অন্তর্গত এবং ভাবগত মিলবন্ধনের নাম যোগ্যতা। যেমন – বর্ষার বৃষ্টিতে - প্লাবনের সৃষ্টি হয়। এটি একটি যোগ্যতাসম্পন্ন বাক্য। কারণ, বাক্যটিতে পদসমূহের অর্থগত এবং ভাবগত সমন্বয় রয়েছে।
কিন্তু ‘বর্ষার রৌদ্র প্লাবনের সৃষ্টি করে।' – বললে বাক্যটি ভাবপ্রকাশের যোগ্যতা হারাবে। কারণ, রৌদ্র প্লাবন সৃষ্টি করে না ।
শব্দের যোগ্যতার সঙ্গে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জড়িত থাকে
(ক) রীতিসিদ্ধ অর্থবাচকতা : প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থে শব্দ সর্বদা ব্যবহৃত হয়। যোগ্যতার দিক থেকে রীতিসিদ্ধ অর্থের প্রতি লক্ষ রেখে কতগুলো শব্দ ব্যবহার করতে হয়। যেমন –
শব্দ রীতিসিদ্ধ প্রকৃতি + প্রত্যয় প্রকৃতি + প্রত্যয়জাত অর্থ
১. বাধিত অনুগৃহীত বা কৃতজ্ঞ বাধ + ইত বাধাপ্রাপ্ত
২.তৈল তিল জাতীয় বিশেষ কোনো শস্যের রস তিল + ষ্ণ তিলজাত স্নেহ পদার্থ
(খ) দুর্বোধ্যতা : অপ্রচলিত, দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করলে বাক্যের যোগ্যতা বিনষ্ট হয়। যেমন – তুমি আমার - সঙ্গে প্রপঞ্চ করেছো। (চাতুরী বা মায়া অর্থে, কিন্তু বাংলা ‘প্রপঞ্চ' শব্দটি অপ্রচলিত)।
(গ) উপমার ভুল প্রয়োগ : ঠিকভাবে উপমা অলংকার ব্যবহার না করলে যোগ্যতার হানি ঘটে। যেমন – আমার হৃদয়-মন্দিরে আশার বীজ উপ্ত হলো। বীজ ক্ষেতে বপন করা হয়, মন্দিরে নয়। কাজেই বাক্যটি হওয়া উচিত : আমার হৃদয়-ক্ষেত্রে আশার বীজ উপ্ত হলো ৷
(ঘ) বাহুল্য-দোষ : প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহারে বাহুল্য দোষ ঘটে এবং এর ফলে শব্দ তার যোগ্যতাগুণ হারিয়ে থাকে। যেমন –
দেশের সব আলেমগণই এ ব্যাপারে আমাদের সমর্থন দান করেন। ‘আলেমগণ’ বহু বচনবাচক শব্দ। এর সঙ্গে ‘সব' শব্দটির অতিরিক্ত ব্যবহার বাহুল্য দোষ সৃষ্টি করেছে।
(ঙ) বাগধারার শব্দ পরিবর্তন : বাগ্ধারা ভাষাবিশেষের ঐতিহ্য। এর যথেচ্ছ পরিবর্তন করলে শব্দ তার যোগ্যতা
হারায়। যেমন ‘অরণ্যে রোদন' (অর্থ : নিষ্ফল আবেদন)-এর পরিবর্তে যদি বলা হয়।, ‘বনে ক্রন্দন' তবে
বাগধারাটি তার যোগ্যতা হারাবে।
(চ) গুরুচণ্ডালী দোষ : তৎসম শব্দের সঙ্গে দেশীয় শব্দের প্রয়োগ কখনো কখনো গুরুচন্ডালী দোষ সৃষ্টি করে। এ দোষে দুষ্ট শব্দ তার যোগ্যতা হারায়। ‘গরুর গাড়ি’, ‘শবদাহ’, ‘মড়াপোড়া' প্রভৃতি স্থলে যথাক্রমে ‘গরুর শকট’, ‘শবপোড়া’, ‘মড়াদাহ' প্রভৃতির ব্যবহার গুরুচণ্ডালী দোষ সৃষ্টি করে।
উদ্দেশ্য ও বিধেয়
প্রতিটি বাক্যে দুটি অংশ থাকে : উদ্দেশ্য ও বিধেয়
বাক্যের যে অংশে কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হয়, তাকে উদ্দেশ্য এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যা বলা হয়, তাকে বিধেয় বলে। যেমন –
খোকা এখন বই পড়ছে
(উদ্দেশ্য) ( বিধেয়)
বিশেষ্য বা বিশেষ্যস্থানীয় অন্যান্য পদ বা পদসমষ্টিযোগে গঠিত বাক্যাংশও বাক্যের উদ্দেশ্য হতে পারে। যেমন –
সৎ লোকেরাই প্রকৃত সুখী - বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত বিশেষণ ।
মিথ্যা কথা বলা খুবই অন্যায় - ক্রিয়াজাত বাক্যাংশ ।
উদ্দেশ্যের প্রকারভেদ
• একটিমাত্র পদবিশিষ্ট কর্তৃপদকে সরল উদ্দেশ্য বলে ।
• উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিশেষণাদি যুক্ত থাকলে তাকে সম্প্রসারিত উদ্দেশ্য বলে।
উদ্দেশ্যের সম্প্রসারণ : সম্প্রসারণ উদ্দেশ্য বিধেয়
১. বিশেষণ যোগে- কুখ্যাত দস্যুদল ধরা পড়েছে।
২. সম্বন্ধ পদযোগে- হাসিমের ভাই এসেছে।
৩. সমার্থক বাক্যাংশ যোগে- যারা অত্যন্ত পরিশ্রমী, তারাই উন্নতি করে ৷
৪. অসমাপিকা ক্রিয়াবিশেষণ যোগে— চাটুকার পরিবৃত হয়েই বড় সাহেব থাকেন ৷
৫. বিশেষণ স্থানীয় বাক্যাংশ যোগে— যার কথা তোমরা বলে থাক, তিনি এসেছেন।
বিধেয়ের সম্প্রসারণ : উদ্দেশ্য সম্প্রসারণ বিধেয়
১. ক্রিয়া বিশেষণ যোগে ঘোড়া দ্রুত চলে।
২. ক্রিয়া বিশেষণীয় যোগে জেট বিমান অতিশয় দ্রুত চলে।
৩. কারকাদি যোগে- ভুবনের ঘাটে ঘাটে ভাসিছে।
৪. ক্রিয়া বিশেষণ স্থানীয় বাক্যাংশ যোগে- তিনি যে ভাবেই হোক আসবেন।
৫. বিধেয় বিশেষণ যোগে- ইনি আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু (হন)।
গঠন অনুযায়ী বাক্যের প্রকারভেদ
বাক্য তিন প্রকার : (১) সরল বাক্য, (২) মিশ্র বা জটিল বাক্য, (৩) যৌগিক বাক্য ।
১. সরল বাক্য : যে বাক্যে একটিমাত্র কর্তা (উদ্দেশ্য) এবং একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া (বিধেয়) থাকে, তাকে
সরল বাক্য বলে। যথা – পুকুরে পদ্মফুল জন্মে। এখানে ‘পদ্মফুল' উদ্দেশ্য এবং ‘জন্মে’ বিধেয় ।
এ রকম : বৃষ্টি হচ্ছে। তোমরা বাড়ি যাও। খোকা আজ সকালে স্কুলে গিয়েছে। স্নেহময়ী জননী (উদ্দেশ্য ) স্বীয় সন্তানকে প্রাণাপেক্ষা ভালোবাসেন (বিধেয়)। বিশ্ববিখ্যাত মহাকবিরা (উদ্দেশ্য) ঐন্দ্রজালিক শক্তিসম্পন্ন লেখনী দ্বারা অমরতার সঙ্গীত রচনা করেন ( বিধেয়) । :
২. মিশ্র বা জটিল বাক্য : যে বাক্যে একটি প্রধান খণ্ডবাক্যের এক বা একাধিক আশ্রিত বাক্য পরস্পর সাপেক্ষ ভাবে ব্যবহৃত হয়, তাকে মিশ্র বা জটিল বাক্য বলে। যথা—
আশ্রিত বাক্য প্রধান খণ্ডবাক্য
১. যে পরিশ্রম করে, সে-ই সুখ লাভ করে।
২. সে যে অপরাধ করেছে, তা মুখ দেখেই বুঝেছি।
আশ্রিত খণ্ডবাক্য তিন প্রকার : (ক) বিশেষ্য স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য, (খ) বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য, (গ) ক্রিয়া বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য ।
ক. বিশেষ্য স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য (Noun clause ) : যে আশ্রিত খণ্ডবাক্য (Subordinate clause) প্রধান খণ্ডবাক্যের যে কোনো পদের আশ্রিত থেকে বিশেষ্যের কাজ করে, তাকে বিশেষ্যস্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে। যথা : —আমি মাঠে গিয়ে দেখলাম, খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। (বিশেষ্য স্থানীয় খণ্ডবাক্য ক্রিয়ার কর্মরূপে ব্যবহৃত
তদ্রুপ : তিনি বাড়ি আছেন কি না, আমি জানি না। ব্যাপারটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে ফল ভালো হবে না ৷
(খ) বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য (Adjective clause ) : যে আশ্রিত খণ্ডবাক্য প্রধান খণ্ডবাক্যের অন্তর্গত কোনো বিশেষ্য বা সর্বনামের দোষ, গুণ এবং অবস্থা প্রকাশ করে, তাকে বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে। যথা :
—লেখাপড়া করে যেই, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই। (আশ্রিত বাক্যটি ‘সেই’ সর্বনামের অবস্থা প্রকাশ করছে)।
তদ্রুপ : ‘খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি, আমার দেশের মাটি' ।
‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা।’ যে এ সভায় অনুপস্থিত, সে বড় দুর্ভাগা
গ) ক্রিয়া-বিশেষণ স্থানীয় খণ্ডবাক্য (Adverbial clause ) : যে আশ্রিত খণ্ডবাক্য ক্রিয়াপদের স্থান, কাল ও কারণ নির্দেশক অর্থে ব্যবহৃত হয় তাকে ক্রিয়া-বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে। যেমন -
‘যতই করিবে দান, তত যাবে বেড়ে। ’
তুমি আসবে বলে আমি অপেক্ষা করছি।
যেখানে আকাশ আর সমুদ্র একাকার হয়ে গেছে, সেখানেই দিকচক্রবাল।
৩. যৌগিক বাক্য : পরস্পর নিরপেক্ষ দুই বা ততোধিক সরল বা মিশ্র বাক্য মিলিত হয়ে একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করলে তাকে যৌগিক বাক্য বলে।
জ্ঞাতব্য : যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত নিরপেক্ষ বাক্যগুলো এবং, ও, কিন্তু, অথবা, অথচ, কিংবা, বরং, তথাপি প্রভৃতি অব্যয় যোগে সংযুক্ত বা সমন্বিত থাকে। যেমন –
নেতা জনগণকে উৎসাহিত করলেন বটে, কিন্তু, কোনো পথ দেখাতে পারলেন না। বসত্ৰ মলিন কেন, কেহ জিজ্ঞাসা করিলে সে ধোপাকে গালি পাড়ে, অথচ ধৌত বস্ত্রে তাহার গৃহ পরিপূর্ণ। উদয়াস্ত পরিশ্রম করব, তথাপি অন্যের দ্বারস্থ হব না।
বাক্য রূপান্তর
অর্থের কোনোরূপ রূপান্তর না করে এক প্রকারের বাক্যকে অন্য প্রকার বাক্যে রূপান্তর করার নামই বাক্য রূপান্তর।
ক. সরল বাক্যকে মিশ্র বাক্যে রূপান্তর
সরল বাক্যকে মিশ্র বাক্যে পরিণত করতে হলে সরল বাক্যের কোনো অংশকে খণ্ডবাক্যে পরিণত করতে হয় এবং উভয়ের সংযোগ বিধানে সম্বন্ধসূচক (যদি, তবে, যে, সে প্রভৃতি) পদের সাহায্যে উক্ত খণ্ডবাক্য ও প্রধান বাক্যটিকে পরস্পর সাপেক্ষ করতে হয়। যথা :
১. সরল বাক্য : ভালো ছেলেরা শিক্ষকের আদেশ পালন করে ৷
মিশ্র বাক্য :যারা ভালো ছেলে, তারা শিক্ষকের আদেশ পালন করে।
২. সরল বাক্য :তার দর্শনমাত্রই আমরা প্রস্থান করলাম।
মিশ্র বাক্য : যে-ই তার দর্শন পেলাম, সে-ই আমরা প্রস্থান করলাম।
৩. সরল বাক্য : ভিক্ষুককে দান কর।
মিশ্র বাক্য :যে ভিক্ষা চায়, তাকে দান কর।
খ. মিশ্র বাক্যকে সরল বাক্যে রূপান্তর : মিশ্র বাক্যকে সরল বাক্যে রূপান্তর করতে হলে মিশ্র বাক্যের অপ্রধান খণ্ডবাক্যটিকে সংকুচিত করে একটি পদ বা একটি বাক্যাংশে পরিণত করতে হয়। যথা :
১. মিশ্র বাক্য যাদের বুদ্ধি নেই, তারাই এ কথা বিশ্বাস করবে।
সরল বাক্য নির্বোধরা/বুদ্ধিহীনরা এ কথা বিশ্বাস করবে।
২. মিশ্র বাক্য : যতদিন জীবিত থাকব, ততদিন এ ঋণ স্বীকার করব।
সরল বাক্য: আজীবন এ ঋণ স্বীকার করব।
৩. মিশ্র বাক্য :যে সকল পশু মাংস ভোজন করে, তারা অত্যন্ত বলবান।
সরল বাক্য :মাংসভোজী পশু অত্যন্ত বলবান ৷
গ. সরল বাক্যকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তর
সরল বাক্যকে যৌগিক বাক্যে পরিণত করতে হলে সরল বাক্যের কোনো অংশকে নিরপেক্ষ বাক্যে রূপান্তর করতে হয়। এবং যথাসম্ভব সংযোজক বা বিয়োজক অব্যয়ের প্রয়োগ করতে হয়। যেমন –
১. সরল বাক্য : তিনি আমাকে পাঁচ টাকা দিয়ে বাড়ি যেতে বললেন।
যৌগিক বাক্য : তিনি আমাকে পাঁচটি টাকা দিলেন এবং বাড়ি যেতে বললেন।
২. সরল বাক্য : পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য এখন থেকেই তোমার পড়া উচিত।
যৌগিক বাক্য :এখন থেকেই তোমার পড়া উচিত, তবেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে।
৩. সরল বাক্য : আমি বহু কষ্টে শিক্ষা লাভ করেছি।
যৌগিক বাক্য: আমি বহু কষ্ট করেছি, ফলে শিক্ষা লাভ করেছি।
ঘ. যৌগিক বাক্যকে সরল বাক্যে রূপান্তর করতে হলে
(১) বাক্যসমূহের একটি সমাপিকা ক্রিয়াকে অপরিবর্তিত রাখতে হয়।
(২) অন্যান্য সমাপিকা ক্রিয়াকে অসমাপিকা ক্রিয়ায় পরিণত করতে হয়।
(৩) অব্যয় পদ থাকলে তা বর্জন করতে হয় ।
(৪) কোনো কোনো স্থলে একটি বাক্যকে হেতুবোধক বাক্যাংশে পরিণত করতে হয়। যথা :
(১) যৌগিক বাক্য সত্য কথা বলিনি, তাই বিপদে পড়েছি।
সরল বাক্য : সত্য কথা না বলে বিপদে পড়েছি।
(২) যৌগিক বাক্য : তার বয়স হয়েছে, কিন্তু বুদ্ধি হয়নি।
সরল বাক্য : তার বয়স হলেও বুদ্ধি হয়নি ।
(৩) যৌগিক বাক্য :মেঘ গর্জন করে, তবে ময়ূর নৃত্য করে।
সরল বাক্য : মেঘ গর্জন করলে ময়ূর নৃত্য করে।
ঙ. যৌগিক বাক্যকে মিশ্র বাক্যে রূপান্তর
যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত পরস্পর নিরপেক্ষ বাক্য দুটির প্রথমটির পূর্বে ‘যদি’ কিংবা ‘যদিও’ এবং দ্বিতীয়টির পূর্বে ‘তাহলে’ (তাহা হইলে) কিংবা ‘তথাপি’ অব্যয়গুলো ব্যবহার করতে হয়। যেমন –
(১) যৌগিক বাক্য : দোষ স্বীকার কর, তোমাকে কোনো শাস্তি দেব না ৷
মিশ্র বাক্য :যদি দোষ স্বীকার কর, তাহলে তোমাকে কোনো শাস্তি দেব না ৷
(২) যৌগিক বাক্য : তিনি অত্যন্ত দরিদ্র কিন্তু তাঁর অন্তঃকরণ অতিশয় উচ্চ।
মিশ্র বাক্য :যদিও তিনি অত্যন্ত দরিদ্র, তথাপি তাঁর অন্তঃকরণ অতিশয় উচ্চ।
সাপেক্ষ অব্যয়ের সাহায্যেও যৌগিক বাক্যকে মিশ্র বাক্যে পরিবর্তন করা যায়। যথা :
যৌগিক বাক্য :এ গ্রামে একটি দরগাহ আছে, সেটি পাঠানযুগে নির্মিত হয়েছে।
মিশ্র বাক্য :এ গ্রামে যে দরগাহ আছে, সেটি পাঠানযুগে নির্মিত হয়েছে।
চ. মিশ্রবাক্যকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তর
মিশ্র বাক্যকে যৌগিক বাক্যে পরিবর্তন করতে হলে খণ্ডবাক্যগুলোকে এক একটি স্বাধীন বাক্যে পরিবর্তন করে তাদের মধ্যে সংযোজক অব্যয়ের ব্যবহার করতে হয়। যেমন (১) মিশ্র বাক্য : যদি সে কাল আসে, তাহলে আমি যাব।
যৌগিক বাক্য : সে কাল আসবে এবং আমি যাব ।
(২) মিশ্র বাক্য :যখন বিপদ আসে, তখন দুঃখও আসে।
যৌগিক বাক্য : বিপদ এবং দুঃখ এক সময়ে আসে ৷
(৩) মিশ্র বাক্য : যদিও তাঁর টাকা আছে, তথাপি তিনি দান করেন না।
যৌগিক বাক্য: তাঁর টাকা আছে, কিন্তু তিনি দান করেন না।
বাক্য বিশ্লেষণ
সংজ্ঞা : বাক্যের বিভিন্ন অংশ পৃথক করে তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয় প্রণালীকে বাক্য বিশ্লেষণ বলে।
ক. সরল বাক্যের বিশ্লেষণ
১. মহারাজ শুদ্ধোদনের পুত্র শাক্যসিংহ যৌবনে সংসার ত্যাগ করেন।
২. ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা) দীন ইসলামের জন্য তাঁর যথাসর্বস্ব দান করেছিলেন।
ওপরে লিখিত বাক্য দুটিকে (১) উদ্দেশ্য, (২) উদ্দেশ্যের সম্প্রসারক, (৩) বিধেয়, (৪) বিধেয়ের সম্প্রসারক - এ চারটি অংশে বিশ্লেষণ করতে হবে।
খ. মিশ্র বাক্যের বিশ্লেষণ
মিশ্র বাক্যের বিশ্লেষণ করতে হলে
১. প্রথমে প্রধান বাক্যটি প্রদর্শন করতে হয়।
২. খণ্ডবাক্য (গুলো) প্রদর্শন করে তাদের সঙ্গে প্রধান বাক্যের সম্বন্ধ উল্লেখ করতে হয়।
৩. প্রধান এবং অপ্রধান খণ্ডবাক্যের মধ্যে কোনো সংযোজক পদ থাকলে তাও দেখাতে হয়। যেমন-আমি স্থির করলাম যে, এরূপ অল্প বয়স্ক বালককে পাঠাব না। এখানে প্রধান বাক্য-(১) আমি স্থির করলাম; সংযোজক পদ-যে; বিশেষ্য-স্থানীয় খণ্ডবাক্য – (২) অল্প বয়স্ক বালককে পাঠাব না।
গ. যৌগিক বাক্যের বিশ্লেষণ
যৌগিক বাক্যের বিশ্লেষণ করতে হলে
১. প্রত্যেকটি স্বাধীন বা নিরপেক্ষ বাক্যকে সরল বাক্যের ন্যায় বিশ্লেষণ করতে হবে।
২. কোনো সংযোজক অব্যয় থাকলে তা প্রদর্শন করতে হবে। যেমন পরিচালিত করে। এখানে দুটি বাক্য আছে। যেমন ত্যাগ এবং জ্ঞান মানুষকে মুক্তির পথে
(১) ত্যাগ মানুষকে মুক্তির পথে পরিচালিত করে।
(২) জ্ঞান মানুষকে মুক্তির পথে পরিচালিত করে। বাক্য দুটির সংযোজক অব্যয় ‘এবং’।
বাক্য সংক্ষেপণ
একাধিক পদ বা উপবাক্যকে একটি শব্দে প্রকাশ করা হলে, তাকে বাক্য সংক্ষেপণ বলে। এটি বাক্য সংকোচন বা এক কথায় প্রকাশেরই নামান্তর । এখানে বাক্য সংকোচনের উদাহরণ দেওয়া গেল।
বাক্য সংক্ষেপণের বা বাক্য সংকোচনের উদাহরণ
অকালে পক্ক হয়েছে যা – অকালপক্ক
অক্ষির সমক্ষে বর্তমান – প্রত্যক্ষ।
অভিজ্ঞতার অভাব আছে যার – অনভিজ্ঞ।
অহংকার নেই যার - নিরহংকার।
অনেকের মধ্যে একজন – অন্যতম ।
অনুতে (বা পশ্চাতে) জন্মেছে যে – অনুজ । -
আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত – আদ্যন্ত, আদ্যোপান্ত । -
আকাশে বেড়ায় যে – আকাশচারী, খেচর।
আচারে নিষ্ঠা আছে যার – আচারনিষ্ঠ। -
আপনাকে কেন্দ্র করে যার চিন্তা – আত্মকেন্দ্রিক। আপনাকে যে পণ্ডিত মনে করে—পণ্ডিতম্মন্য।
আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস আছে যার – আস্তিক।
আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস নেই যার - নাস্তিক।
ইতিহাস রচনা করেন যিনি – ঐতিহাসিক
ইতিহাস বিষয়ে অভিজ্ঞ যিনি – ইতিহাসবেত্তা ৷
ইন্দ্রিয়কে জয় করেছে যে – জিতেন্দ্রিয়।
ঈষৎ আমিষ (আঁষ) গন্ধ যার – আঁষটে।
উপকারীর উপকার যে স্বীকার করে – কৃতজ্ঞ।
উপকারীর উপকার যে স্বীকার করে না - অকৃতজ্ঞ ।
উপকারীর অপকার করে যে – কৃতঘ্ন।
একই মাতার উদরে জাত যে -সহোদর।
এক থেকে শুরু করে ক্রমাগত – একাদিক্রমে ।
কর্ম সম্পাদনে পরিশ্রমী – কর্মঠ। -
কোনো ভাবেই যা নিবারণ করা যায় না – অনিবার্য।
চক্ষুর সম্মুখে সংঘটিত —চাক্ষুষ।
জীবিত থেকেও যে মৃত – জীবস্মৃত।
তল স্পর্শ করা যায় না যার অতলস্পর্শী।
দিনে যে একবার আহার করে – একাহারী।
নষ্ট হওয়াই স্বভাব যার – নশ্বর ।
নদী মেখলা যে দেশের – নদীমেখলা ।
নৌকা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে যে – নাবিক ।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত – আপাদমস্তক।
ফল পাকলে যে গাছ মরে যায় – ওষধি।
বিদেশে থাকে যে – প্রবাসী ।
বিশ্বজনের হিতকর – বিশ্বজনীন । -
মৃতের মতো অবস্থা যার – মুমূর্ষু।
যা দমন করা যায় না - অদম্য।
যা দমন করা কষ্টকর – দুর্দমনীয় । -
যা নিবারণ করা কষ্টকর - দুর্নিবার। যা পূর্বে ছিল এখন নেই – ভূতপূর্ব।
যার উপস্থিত বুদ্ধি আছে – প্রত্যুৎপন্নমতি।
যার সর্বস্ব হারিয়ে গেছে – সর্বহারা, হৃতসর্বস্ব। যার কোনো কিছু থেকেই ভয় নেই – অকুতোভয়
যার আকার কুৎসিত – কদাকার ৷
যা বিনা যত্নে লাভ করা গিয়েছে – অযত্নলব্ধ । -
যা বার বার দুলছে - দোদুল্যমান।
যা দীপ্তি পাচ্ছে – দেদীপ্যমান ৷
যা সাধারণের মধ্যে দেখা যায় না এমন-অনন্যসাধারণ।
যা পূর্বে দেখা যায়নি এমন – অদৃষ্টপূর্ব। যা কষ্টে জয় করা যায় – দুর্জয়।
যা কষ্টে লাভ করা যায় – দুর্লভ।
যা অধ্যয়ন করা হয়েছে - . অধীত
যা জলে চরে – জলচর।
যা স্থলে চরে- স্থলচর।
যা জলে ও স্থলে চরে - উভচর।
যা বলা হয়নি -অনুক্ত।
যা কখনো নষ্ট হয় না – অবিনশ্বর । -
যা মর্ম স্পর্শ করে – মর্মস্পর্শী।
যা বলার যোগ্য নয় – অকথ্য।
যা অতি দীর্ঘ নয় – নাতিদীর্ঘ।
যার বংশ পরিচয় এবং স্বভাব কেউই জানে না – অজ্ঞাতকুলশীল।
যার প্রকৃত বর্ণ ধরা যায় না – বর্ণচোরা।
যা চিন্তা করা যায় না অচিন্তনীয়, অচিন্ত্য।
যা কোথাও উঁচু কোথাও নিচু-বন্ধুর
যা সম্পন্ন করতে বহু ব্যয় হয়-ব্যয়বহুল ।
যা খুব শীতল বা উষ্ণ নয় – নাতিশীতোষ্ণ। -
যার বিশেষ খ্যাতি আছে – বিখ্যাত।
যা আঘাত পায়নি-অনাহত।
যা উদিত হচ্ছে – উদীয়মান।
যার অন্য উপায় নেই - অনন্যোপায়।
যার কোনো উপায় নেই – নিরুপায় ৷
যা ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছে- বর্ধিষ্ণু।
যা পূর্বে শোনা যায়নি – অশ্রুতপূর্ব।
যে শুনেই মনে রাখতে পারে – শ্রুতিধর। যে বাস্তু থেকে উৎখাত হয়েছে – উদ্বাস্তু।
যে নারী নিজে বর বরণ করে নেয় – স্বয়ংবরা। -
যে গাছে ফল ধরে, কিন্তু ফুল ধরে না - বনস্পতি ।
যে রোগ নির্ণয় করতে হাতড়ে মরে – হাতুড়ে।
যে নারীর সন্তান বাঁচে না – মৃতবৎসা ।
যে গাছ কোনো কাজে লাগে না – আগাছা ৷
যে গাছ অন্য গাছকে আশ্রয় করে বাঁচে-পরগাছা ৷
যে পুরুষ বিয়ে করেছে – কৃতদার।
যে মেয়ের বিয়ে হয়নি – অনূঢ়া ৷
যে ক্রমাগত রোদন করছে – রোরুদ্যমান ।
যে ভবিষ্যতের চিন্তা করে না বা দেখে না- অপরিণামদর্শী।
যে ভবিষ্যৎ না ভেবেই কাজ করে – অবিমৃষ্যকারী।
যে বিষয়ে কোনো বিতর্ক (বা বিসংবাদ) নেই – অবিসংবাদিত।
যে বন হিংস্র জন্তুতে পরিপূর্ণ – শ্বাপদসংকুল।
যিনি বক্তৃতা দানে পটু – বাগ্মী।
যে সকল অত্যাচারই সয়ে যায় – সর্বংসহা।
যে নারী বীর সন্তান প্রসব করে – বীরপ্রসূ।
যে নারীর কোনো সন্তান হয় না - বন্ধ্যা।
যে নারী জীবনে একমাত্র সন্তান প্রসব করেছে – কাকবন্ধ্যা। যে পুরুষের চেহারা দেখতে সুন্দর - সুদর্শন।
যে রব শুনে এসেছে – রবাহুত।
লাভ করার ইচ্ছা – লিপ্সা ।
শুভ ক্ষণে জন্ম যার - ক্ষণজন্মা ।
সম্মুখে অগ্রসর হয়ে অভ্যর্থনা – প্রত্যুদ্গমন ।
সকলের জন্য প্রযোজ্য – সর্বজনীন।
হনন করার ইচ্ছা – জিঘাংসা। -