কহিলা হবু, ‘শুন গো গোবুরায়,
কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র-
মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়
ধরণী -মাঝে চরণ-ফেলা মাত্র !
তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি,
রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি ।
আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি,
রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি!
শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার,
নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর ।'
শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হলো খুন,
দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে ।
পণ্ডিতের হইল মুখ চুন,
পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে।
রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি,
কান্নাকাটি পড়িল বাড়ি—মধ্যে,
অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি
কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে,
'যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে,
পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে!'
শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি,
কহিল শেষে, ‘কথাটা বটে সত্য-
কিন্তু আগে বিদায় করো ধূলি,
ভাবিয়ো পরে পদধুলির তত্ত্ব।
ধুলা-অভাবে না পেলে পদধুলা
তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে,
কেন-বা তবে পুষিনু এতগুলা
উপাধি-ধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে?
আগের কাজ আগে তো তুমি সারো,
পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরো।'
আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি,
যতনভরে আনিল তবে মন্ত্ৰী
যেখানে যত আছিল জ্ঞানী গুণী
দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী ।
বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,
ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য,
অনেক ভেবে কহিল, ‘গেলে মাটি
ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য?'
কহিল রাজা, ‘তাই যদি না হবে,
পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?'
সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে
কিনিল ঝাঁটা সাড়ে-সতেরো লক্ষ,
ঝাঁটের চোটে পথের ধুলা এসে
ভরিয়া দিল রাজার মুখ বক্ষ ৷
ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ,
ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূৰ্য,
ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক,
ধুলার মাঝে নগর হলো উহ্য।
কহিল রাজা, “করিতে ধুলা দূর,
জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর!”
তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে-ঝাঁক
মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি ।
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক,
নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি ।
জলের জীব মরিল জল বিনা,
ডাঙার প্রাণী সাঁতার করে চেষ্টা।
পাঁকের তলে মজিল বেচা-কিনা,
সর্দিজ্বরে উজাড় হলো দেশটা ।
কহিল রাজা, ‘এমনি সব গাধা
ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!”
আবার সবে ডাকিল পরামর্শে,
বসিল পুনঃ যতেক গুণবন্ত-
ঘুরিয়া মাথা হেরিল চোখে সর্ষে,
ধুলার হায় নাহিক পায় অন্ত ।
কহিল, “মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো,
ফরাস পাতি করিব ধুলা বন্ধ ।
' কহিল কেহ, ‘রাজারে ঘরে রাখো,
কোথাও যেন থাকে না কোনো রন্ধ্র !
ধুলার মাঝে না যদি দেন পা
তা হলে পায়ে ধুলা তো লাগে না ।’
কহিল রাজা, ‘সে কথা বড়ো খাঁটি -
কিন্তু মোর হতেছে মনে সন্ধ,
মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
দিবস-রাতি রহিলে আমি বন্ধ।'
কহিল সবে, ‘চামারে তবে ডাকি
চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী ।
ধূলির মহী ঝুলির মাঝে ঢাকি
মহীপতির রহিবে মহাকীর্তি ।’
কহিল সবে, ‘হবে সে অবহেলে,
যোগ্যমতো চামার যদি মেলে।'
রাজার চর ধাইল হেথা-হোথা,
ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম ।
যোগ্যমতো চামার নাহি কোথা,
না মিলে এত উচিত-মতো চর্ম ।
তখন ধীরে চামার-কুলপতি
কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
“বলিতে পারি করিলে অনুমতি,
সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ ।
নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।'
কহিল রাজা, ‘এত কি হবে সিধে !
ভাবিয়া ম'ল সকল দেশসুদ্ধ !”
মন্ত্রী কহে,'বেটারে শূল বিঁধে
কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।'
রাজার পদ চরম- আবরণে
ঢাকিল বুড়া বসিয়া পদোপান্তে।
মন্ত্রী কহে,'আমারো ছিল মনে
কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।'
সেদিন হতে চলিল জুতা পরা-
বাঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে (৭ই মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার জন্য পাঠানো হলেও তিনি বেশিদিন স্কুলের শাসনে থাকতে পারেননি । এমনকি সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানো হলেও দেড় বছর পরে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে তিনি দেশে ফিরে আসেন। বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি লাভ করেননি, কিন্তু সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা এক বিস্ময়ের বস্তু । তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অসামান্য প্রতিভাধর । বাল্যেই তাঁর কবিপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁর বনফুল কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বস্তুত তাঁর একক সাধনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সকল শাখায় দ্রুত উন্নতি লাভ করে এবং বিশ্বদরবারে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্য প্রযোজক ও অভিনেতা । কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখাই তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ । তাঁর অজস্র রচনার মধ্যে মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, বলাকা, পুনশ্চ, চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, বিসর্জন, ডাকঘর, রক্তকরবী, গল্পগুচ্ছ, বিচিত্র প্রবন্ধ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে (৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
চরণ – পা। প্রতিকার – প্রতিবিধান, সমাধান। মাহিনা - পারিশ্রমিক, বেতন। পুষি- পোষণ করি, লালন-পালন করি। পিপে— ঢাক বা ঢোলের আকৃতিবিশিষ্ট কাঠের তৈরি পাত্র। ভিত্তি - পানি বহনের জন্য চামড়ার তৈরি এক প্রকার থলি। পাঁক – কাদা, কদম৷ কিস্তি – নৌকা বা জাহাজ, জলযান। গুণবস্তু – গুণবান, গুণী। মহী – পৃথিবী, ধরণী। ফরাশ – মেঝে বা তক্তপোশে বিছানোর জন্য কার্পেট বা বিছানা, মাদুর। রন্ধ্র - ছিদ্র, ফুটো। চামার – চর্মকার, মুচি। যোগ্যমতো – উপযুক্ত। - কুলপতি – বংশের প্রধান, কুলশ্রেষ্ঠ ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্পনা কাব্য থেকে ‘জুতা আবিষ্কার' কবিতাটি সংকলন করা হয়েছে। ধুলাবালি থেকে রাজার পা দুটিকে মুক্ত রাখার নানা প্রসঙ্গই কবিতাটির মূল উপজীব্য । রাজা তাঁর মন্ত্রীদের রাজ্য থেকে ধুলাবালি দূর করার নির্দেশ দেন। মন্ত্রীরা রাজ্যের ধুলাবালি ঝাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং এতে রাজ্য ধুলোয় পরিপূর্ণ হয়ে যায় । রাজার আদেশ মানতে গিয়ে রাজ্যের সভাসদ কোনো উপায় যেন খুঁজে আর পান না। অবশেষে রাজ্যেরই এক বয়স্ক চর্মকার নিজ বুদ্ধিতে রাজার পদযুগল চামড়া দিয়ে ঢেকে দেয়। এভাবে রাজার পা ধুলার স্পর্শ থেকে মুক্তি পায়। সাধারণ সমস্যার সমাধান সাধারণ বুদ্ধিতেই করতে হয়। জটিলভাবে করতে গেলে বিড়ম্বনাই বাড়ে। সমস্যা সমাধানে পদস্থ জনই যে অনিবার্য তাও নয়। সাধারণের দ্বারাও অসাধারণ কৃত্য সম্পাদিত হতে পারে । কবিতায় তাই মূর্ত হয়ে উঠেছে।
আরও দেখুন...