'পাখি' গল্পের আলোকে নিচে কয়েকটি প্রশ্ন দেওয়া হলো। ১০০-১৫০ শব্দের মধ্যে প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রস্তুত করো এবং পরে সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে নিজের উত্তর সংশোধন করো।
১। 'পাখি' গল্পে পাখির প্রতি কুমুর কী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে?
২। কুমু ও পাখির মধ্যে লেখক কী মিল দেখিয়েছেন?
৩। শীতকালে বিভিন্ন ধরনের অতিথি পাখি বাংলাদেশে আসে। এসব পাখি শিকার করাকে কি তুমি সমর্থন করো? কেন করো অথবা কেন করো না?
জহির রায়হান (১৯৩৫-১৯৭২) একজন কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র-নির্মাতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম 'হাজার বছর ধরে', 'বরফ গলা নদী', 'আরেক ফাল্গুন', 'কয়েকটি সংলাপ' ইত্যাদি। 'জীবন থেকে নেয়া' তাঁর একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র। নিচের গল্পটি জহির রায়হানের 'সময়ের প্রয়োজনে' গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
জহির রায়হান (১৯৩৫-১৯৭২) একজন কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র-নির্মাতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম 'হাজার বছর ধরে', 'বরফ গলা নদী', 'আরেক ফাল্গুন', 'কয়েকটি সংলাপ' ইত্যাদি। 'জীবন থেকে নেয়া' তাঁর একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র। নিচের গল্পটি জহির রায়হানের 'সময়ের প্রয়োজনে' গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
কিছুদিন আগে সংবাদ সংগ্রহের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে গিয়েছিলাম। ক্যাম্প-কমান্ডার ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। সেই ব্যস্ততার মুহূর্তে আমার দিকে একটা খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি বসুন। এই খাতাটা পড়ুন বসে বসে। আমি কয়েকটা কাজ সেরে নিই। এরপর আপনার সঙ্গে আলাপ করব।
খাতাটা হাত বাড়িয়ে নিলাম।
লাল মলাটে বাঁধানো একটা খাতা। ধুলো, কালি আর তেলের কালচে দাগে ময়লা হয়ে গেছে এখানে ওখানে।
খাতাটা খুললাম।
গোটা গোটা হাতে লেখা। মাঝেমধ্যে একটু এলোমেলো।
আমি পড়তে শুরু করলাম।
প্রথম প্রথম কাউকে মরতে দেখলে ব্যথা পেতাম। কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনো চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রু হয়তো জন্ম নিত। এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। কী জানি, হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে, তাই। মৃত্যুর খবর আসে। মরা মানুষ দেখি। মৃতদেহ কবরে নামাই। পরক্ষণে ভুলে যাই।
রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিয়ে ছোট্ট টিলাটার ওপরে এসে দাঁড়াই। সামনে তাকাই। বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা। কচি লাউ ঝুলছে। বাতাসে মৃদু দুলছে। কয়েকটা ধানখেত। দুটো তালগাছ। দূরে আরেকটা গ্রাম। খবর এসেছে ওখানে ঘাঁটি পেতেছে ওরা। একদিন যারা আমাদের অংশ ছিল। একসঙ্গে থেকেছি। শুয়েছি। খেয়েছি। ঘুমিয়েছি। এক টেবিলে বসে গল্প করেছি। প্রয়োজনবোধে ঝগড়া করেছি। ভালোবেসেছি। আজ তাদের দেখলে শরীরের রক্ত গরম হয়ে যায়। চোখ জ্বালা করে ওঠে। হাত নিশপিশ করে। পাগলের মতো গুলি ছুড়ি। মারার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠি। একজনকে মারতে পারলে উল্লাসে ফেটে পড়ি। ঘৃণার থুতু ছিটাই মৃতদেহের মুখে।
সামনে ধানখেত। আলের উপরে কয়েকটা গরু। একটা ছাগল। একটানা ডাকছে। একঝাঁক পাখি উড়ে চলে গেল দূরে গ্রামের দিকে। কী যেন নড়েচড়ে উঠল সেখানে। মুহূর্তে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। ক্যাম্প-কমান্ডারকে খবর দিলাম।
স্যার, মনে হচ্ছে ওরা এগোতে পারে।
তিনি একটা ম্যাপের ওপরে ঝুঁকে পড়ে হিসাব কষছিলেন। মুখ তুলে তাকালেন। একজোড়া লাল চোখ। গত দু-রাত ঘুমোননি। অবকাশ পাননি বলে। তিনি তাকালেন। বললেন, কী দেখেছ?
বললাম, মনে হলো একটা মুভমেন্ট।
ভুল দেখেছ। আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন তিনি। ওদের দু-একদিনের মধ্যে এগোবার কথা নয়। যাও ভালো করে দেখো।
চলে এলাম নিজের জায়গায়। একটানা তাকিয়ে থাকি। মাঝেমধ্যে তন্দ্রা এসে যায়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। হয়তো তাই ভুল দেখি।
কিন্তু বুড়িগঙ্গার পাশে লঞ্চঘাটের অপরিসর বিশ্রামাগারে যে দৃশ্য দেখেছিলাম, সেটা ভুল হওয়ার নয়। শুনেছিলাম, বহু লোক আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে। যখন গেলাম, দেখলাম কেউ নেই।
দেখলাম।
মেঝেতে পুডিংয়ের মতো জমাট রক্ত।
বুটের দাগ।
অনেক খালি পায়ের ছাপ।
ছোটো পা। বড়ো পা। কচি পা।
কতগুলো মেয়ের চুল।
দুটো হাতের আঙুল।
একটা আংটি। চাপ চাপ রক্ত।
কালো রক্ত। লাল রক্ত।
মানুষের হাত। পা। পায়ের গোড়ালি।
পুডিংয়ের মতো রক্ত।
খুলির একটা টুকরো অংশ।
এক খাবলা মগজ।
রক্তের ওপরে পিছলে-যাওয়া পায়ের ছাপ।
অনেক ছোটো-বড়ো ধারা। রক্তের ধারা।
একটা চিঠি।
মানিব্যাগ।
গামছা।
একপাটি চটি।
কয়েকটি বিস্কুট।
জমে থাকা রক্ত।
একটা নাকের নোলক।
একটি চিরুনি।
বুটের দাগ।
লাল হয়ে যাওয়া একটা সাদা ফিতে।
চুলের কাঁটা।
দেশলাইয়ের কাঠি।
একটা মানুষকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ছাপ।
রক্তের মাঝখানে এখানে ওখানে অনেকগুলো ছড়ানো।
প্রথম উনিশ জন ছিলাম। আট জন মারা গেল মর্টারের গুলিতে। ওদের নামিয়ে দিয়ে যখন ক্যাম্পে ফিরলাম, তখন আমরা এগারো জন।
একজন পালিয়ে গেল সে রাতে। গেল, আর এল না। আর একজন মারা গেল হঠাৎ অসুখ করে। কী অসুখ বুঝে ওঠার আগেই হাত-পা টান টান করে শুয়ে পড়ল সে। আর উঠল না। তার বুকপকেটে একটা চিঠি পেয়েছিলাম। মায়ের কাছে লেখা। মা। আমার জন্য তুমি একটুও চিন্তা কোরো না, মা। আমি ভালো আছি।
চিঠিটা ওর কবরে দিয়ে দিয়েছি। থাকো। ওখানেই থাকো। তখন ছিলাম ন জন। এখন আবার বেড়ে সাতাশে পৌঁছেছি।
সাতাশ জন মানুষ।
নানা বয়সের। ধর্মের। মতের।
আগে কারো সঙ্গে আলাপ ছিল না। পরিচয় ছিল না। চেহারাও দেখিনি কোনো দিন।
কেউ ছাত্র ছিল। কেউ দিনমজুর। কৃষক। কিংবা মধ্যবিত্ত কেরানি। পাটের দালাল। অথবা পদ্মাপারের জেলে।
এখন সবাই সৈনিক।
একসঙ্গে থাকি। খাই। ঘুমোই।
রাইফেলগুলো কাঁধে তুলে নিয়ে যখন কোনো শত্রুর সন্ধানে বেরোই তখন মনে হয় পরস্পরকে যেন বহুদিন ধরে চিনি। জানি। অতি আপনজনের মতো অনুভব করি।
মনে হয় দীর্ঘদিনের আত্মীয়তার এক অবিচ্ছেদ্য বাঁধনে আবদ্ধ আমরা। আমাদের অস্তিত্ব ও লক্ষ্য দুই-ই এক। মাঝেমধ্যে বিশ্রামের মুহূর্তে গোল হয়ে বসে গল্প করি আমরা।
অতীতের গল্প।
বর্তমানের গল্প।
ভবিষ্যতের গল্প।
টুকিটাকি নানা আলোচনা।
ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। আনতে হবে। কদিন ধরে শুধু ডাল-ভাত চলছে। একটু মাছ আর মাংস পেলে মন্দ হতো না। সাতাশ জন মানুষ আমরা। মাত্র নটা রাইফেল। আরো যদি অস্ত্র পেতাম। সবার হাতে যদি একটা করে রাইফেল থাকত, তাহলে সেদিন ওদের একজন সৈন্যও পালিয়ে যেতে দিতাম না।
মোট দুশো জনের মতো এসেছিল ওরা। ৪৫টা লাশ পেছনে ফেলে পালিয়েছে। তাড়া করেছিলাম আমরা। খেয়াপার পর্যন্ত। গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে ফিরে চলে এসেছি।
এসে দেখি আশপাশের গ্রাম থেকে অসংখ্য ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-গেরস্তবাড়ির বউ ছুটে এসেছে সেখানে।
কারো হাতে ঝাঁটা। দা। কুড়াল। খুন্তি।
মৃতদেহগুলোর মুখে ঝাঁটা মারছে ওরা।
ঘৃণা। ক্রোধ। যন্ত্রণা।
এত সব বুকে নিয়ে ওরা বাঁচবে কেমন করে। একটা বিস্ফোরণে যদি সব কিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যেত তাহলে হয়তো বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে পারত ওরা।
ওরা একা নয়। অনেকগুলো মানুষ। সাড়ে সাত কোটি। এক কোটি লোক ঘর-বাড়ি-মাটি ছেড়ে পালিয়েছে, তিন কোটি লোক সারাক্ষণ পালাচ্ছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে।
ভয়। ত্রাস। আতঙ্ক।
জ্ঞান ফিরে এলে আমিও পালিয়েছিলাম। পোড়ামাটির ঘ্রাণ নিতে নিতে। অনেক মৃতদেহ ডিঙিয়ে। কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী ভেদ করে।
একটা গয়নার নৌকায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-বাচ্চাতে গিজগিজ করছিল সেটা। দুই পাশের গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলছে।
কিছুক্ষণ আগে কয়েকটা প্লেন এসে একটানা বোমাবর্ষণ করেছে সেখানে।
কাছেই একটা মফস্বল শহর। এখনো পুড়ছে। কালো জমাট ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে আকাশের দিকে। একটা মানুষ নেই। কুকুর নেই। জন্তু-জানোয়ার নেই। শূন্য বাড়িগুলো প্রেতপুরীর মতো দাঁড়িয়ে।
মায়ের কথা মনে পড়তে বুকটা ব্যথা করে উঠল।
ছোটো ভাই। বোন ইতুদি। ওরা কেমন আছে?
বেঁচে আছে, না মরে গেছে?
জানি না। হয়তো বহুদিন জানব না।
তবু একটা কথা বারবার মনের মধ্যে উকি দেয় আমার।
আবার কি ওদের সঙ্গে একসঙ্গে নাস্তার টেবিলে বসতে পারব আমি?
আবার কি রোজ সকালে মা আমার বন্ধ দুয়ারে এসে কড়া নেড়ে ডাকবে? কিরে, এখনো ঘুমোচ্ছিস? অনেক বেলা হয়ে গেল যে।
ওঠ। চা খাবি না?
কিংবা।
দল বেঁধে সবাই বাড়ির ছাদের উপর কেরাম খেলা। পারব কি আবার?
সামনে তাকাই। বিরাট আকাশ। কয়েকটা লাউয়ের মাচা। কচি লাউ ঝুলছে। কয়েকটা ধানখেত। দুটো তালগাছ। দূরে আর একটা গ্রাম।
প্রতিদিন দেখি।
পেছনে কয়েকটা বাঁশবন। আড়ালে চার-পাঁচটা তাঁবু। একটা পুরনো দালান। সে দালানের গায়ে কাঠকয়লা দিয়ে অনেক ছোটো ছোটো রেখা এঁকেছি আমরা। ওগুলো মৃতের হিসাব।
আমাদের নয়।
ওদের।
যখনই কোনো শত্রুকে বধ করেছি, তখনই একটা নতুন রেখা টেনে দিয়েছি দেয়ালে। হিসাব রাখতে সুবিধে হয় তাই। প্রায়ই দেখি। গুনি। তিনশো বাহাত্তর, তিহাত্তর, চুয়াত্তর। পুরো দেয়ালটা কবে ভরে যাবে সে প্রতীক্ষায় আছি।
আমাদের যারা মরেছে। তাদের হিসাবও রাখি। কিন্তু সেটা মনে মনে। মনের মধ্যে অনেকগুলো দাগ। সেটাও মাঝে মাঝে গুনি।
একদিন।
বেশ কিছুদিন আগে। সেক্টর কমান্ডার এসেছিলেন আমাদের ক্যাম্পে, দেখতে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। অভিবাদন করেছিলাম তাঁকে।
তিনি আমাদের একটি প্রশ্ন করেছিলেন।
প্রায় এক ধরনের উত্তর দিয়েছিলাম আমরা।
বলেছিলাম, দেশের জন্য। মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করছি। যুদ্ধ করছি দেশকে মুক্ত করার জন্য।
বাংলাদেশ।
না, পরে মনে হয়েছিল উত্তরটা বোধ হয় ঠিক হয়নি। নিজেরা অনেকক্ষণ আলাপ করেছি। উত্তরটা ঠিক হলো কি? দেশ তো হলো ভূগোলের ব্যাপার। হাজার বছরে যার হাজার বার সীমারেখা পাল্টায়। পাল্টেছে। ভবিষ্যতেও পাল্টাবে।
তাহলে কীসের জন্য লড়ছি আমরা?
বন্ধুরা নানা জনে নানা রকম উক্তি করেছিল।
কেউ বলেছিল, আমরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে লড়ছি। ওরা আমাদের মা-বোনদের কুকুর-বেড়ালের মতো মেরেছে, তাই। তার প্রতিশোধ নিতে চাই।
কেউ বলেছিল, আমরা আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছি। ওরা বহু অত্যাচার করেছে আমাদের ওপর। শোষণ করেছে। তাই ওদের তাড়ানোর জন্য লড়ছি।
কেউ বলেছিল, আমি অতশত বুঝি না মিয়ারা। আমি শেখ সাহেবের জন্য লড়ছি।
আমি ওদের কথাগুলো শুনছিলাম। ভাবছিলাম। মাঝেমধ্যে আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে তর্ক করছিলাম।
কিন্তু মন ভরছিল না।
কীসের জন্য লড়ছি আমরা? এত প্রাণ দিচ্ছি, এত রক্তক্ষয় করছি?
হয়তো সুখের জন্য। শান্তির জন্য। নিজের কামনা-বাসনাগুলোকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার জন্য।
কিংবা শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। অথবা সময়ের প্রয়োজনে। সময়ের প্রয়োজন মেটানোর জন্য লড়ছি আমরা।
অতশত ভাবতে পারি না। আমার ছোটো মাথায় অত ভাবনা এখন আর ধরে না। ব্যথা করে। যেটা বুঝি সেটা সোজা। আমাদের মাটি থেকে ওদের তাড়াতে হবে। এটাই এখনকার প্রয়োজন।
দেয়ালের রেখাগুলো বাড়ছে। মনের দাগও বাড়ছে প্রতিদিন।
হাতের কবজিতে এসে একটা গুলি লেগেছিল কাল। সেটা হাতে না লেগে বুকে লাগতে পারত। মাত্র দু আঙুলের ব্যবধান।
এখন কদিন বিশ্রাম।
মা কাছে থাকলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। কাঁদত। বকুনি দিয়ে বলত, বাহাদুর। অত সামনে এগিয়ে গিয়েছিলি কেন? সবার পেছনে থাকতে পারলি না? আর অত বাহাদুরির দরকার নেই বাবা। ঘরের ছেলে এখন ঘরে ফিরে চল।
ঘর?
সত্যি, মানুষের কল্পনা বড়ো অদ্ভুত।
ঘরবাড়ি কবে ওরা পুড়ে ছাই করে দিয়েছে। তবু ঘরের কথা ভাবতে মন চায়।
খবর পেয়েছি মা, বাবা, ভাই, বোন ওরা সবাই কোথায় যেন চলে গেছে। হয়তো কোনো গ্রাম, কোনো গঞ্জে। কোনো উদ্বাস্তু শিবিরে। কিংবা না। ওটা আমি ভাবতে চাই না।
জয়ার কোনো খবর নেই। কোথায় গেল মেয়েটা?
জানি না। জানতে গেলে ভয় হয়।
শুধু জানি, এ যুদ্ধে আমরা জিতব আজ, নয় কাল। নয়তো পরশু।
একদিন আমি আবার ফিরে যাব। আমার শহরে, আমার গ্রামে। তখন হয়তো পরিচিত অনেক মুখ সেখানে থাকবে না। তাদের আর দেখতে পাব না আমি। যাদের পাব তাদের প্রাণভরে ভালোবাসব।
যারা নেই কিন্তু একদিন ছিল, তাদের গল্প আমি শোনাব ওদের।
সেই ছেলেটির গল্প। বুকে মাইন বেঁধে যে ট্যাংকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
কিংবা সেই বুড়ো কৃষক। রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়ে যে মৃদু হেসে বলেছিল, চললাম। আর ফিরে আসেনি। অথবা উদ্বাস্তু শিবিরের পাঁচ লাখ মৃত শিশু।
দশ হাজার গ্রামের আনাচে কানাচে এক কোটি মৃতদেহ।
না এক কোটি নয়, হয়তো হিসাবের অঙ্ক তখন তিন কোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
এক হাজার এক রাত কেটে যাবে হয়তো। আমার গল্প তবু ফুরাবে না।
সামনে ধানখেত। বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা, কচি লাউ ঝুলছে। দুটো তালগাছ। দূরে আরেকটা গ্রাম। গ্রামের নাম রোহনপুর। ওখানে এসে ঘাঁটি পেতেছে ওরা, একদিন যারা আমাদের অংশ ছিল।
ডায়েরিতে আর কিছু লেখা নেই।
খাতাটা ক্যাম্প-কমান্ডারের দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, কার লেখা, আপনার?
না। আমাদের সঙ্গের একজন মুক্তিযোদ্ধার। তাঁর সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারি কি? আবার প্রশ্ন করলাম। উত্তর দিতে গিয়ে মুহূর্ত কয়েক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, দিন কয়েক আগে একটা অপারেশনে গিয়ে ওদের হাতে ধরা পড়েছে সে।
তারপর?
তারপরের খবর ঠিক বলতে পারছি না। হয়তো মেরে ফেলেছে। বেঁচেও থাকতে পারে হয়তো।
চোখজোড়া অজান্তে আবার খাতাটার উপরে নেমে এলো। অনেকক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখলাম সেটা। তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম বাইরের দিকে।
বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা, কচি লাউ ঝুলছে। কয়েকটা ধানখেত। দুটো তালগাছ। দূরে আরেকটা গ্রাম। সেখানে আগুন জ্বলছে।
(সংক্ষেপিত)
অপরিসর: অপ্রশস্ত।
প্রেতপুরী: ভীতিকর জায়গা।
উদ্বাস্তু: বাসভূমি থেকে বিতাড়িত।
বাহাদুর: বীর।
ঊর্ধ্বশ্বাসে পালানো: দ্রুত পলায়ন করা।
বিশ্রামাগার: বিশ্রামের জায়গা।
কাতরোক্তি: কাকুতি-মিনতি।
বিস্ফোরণ: বিকট শব্দে ফেটে যাওয়া।
ক্যাম্প-কমান্ডার: ক্যাম্পের প্রধান।
শব্দের তান্ডব: প্রচন্ড শব্দ।
গয়নার নৌকা: যাত্রীবাহী নৌকা বিশেষ।
হতবিহ্বল: কী করতে হবে বুঝতে না পারা।
ঘাঁটি: আস্তানা।
ট্যাংক: কামান-সজ্জিত সাঁজোয়া গাড়ি।
আরও দেখুন...