জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ বেঁচে থাকার জন্য অবিরাম অর্থনৈতিক সংগ্রাম করে। মানুষ আজীবন নানাবিধ বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলে। মানুষের চলার পথের অর্থনৈতিক সমস্যা বা বাধা অতিক্রম করতে অর্থনীতি বিষয় নানাভাবে সহায়তা করে। মানুষ, সমাজ বা দেশের সমৃদ্ধি অর্জনে অর্থনীতি বিষয় বিশেষ ভূমিকা পালন করে । অর্থনীতি বিষয় সম্পর্কে জানা বা শেখা সে জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এ অধ্যায়ে অর্থনীতির উৎপত্তি ও বিকাশ; প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক সমস্যা; অর্থনীতির সংজ্ঞা ও নীতি; আয়ের বৃত্তাকার প্রবাহ এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।
এই অধ্যায় পাঠশেষে আমরা-
• অর্থনীতির উৎপত্তি ও এর বিকাশ ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করতে পারব
• দুষ্প্রাপ্যতা ও অসীম অভাবের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারব
• অর্থনীতির ধারণা বর্ণনা করতে পারব
• অর্থনীতির প্রধান দশটি নীতি বর্ণনা করতে পারব
• বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচয় বর্ণনা করতে পারব
• বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক সুবিধা ও অসুবিধা মূল্যায়ন করতে পারব।
আজকের যে অর্থনীতি আমরা পড়ি, তা পূর্বে এতটা জটিল ছিল না। সনাতন বা আদিম সমাজে মানুষের জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সহজ সরল । খাবার দাবার, কাপড় চোপড় এবং বাড়িঘর— এসবই ছিল মানুষের মৌলিক চাহিদা । দ্রব্য সামগ্রী বিনিময়ের রীতি ছিল খুব সীমিত। মূলত মানুষের কায়িক পরিশ্রম ছিল উৎপাদনের একমাত্র উপকরণ । সমাজে কোনো শ্রেণিভেদ ছিল না। ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ'- এই ছিল আদিম সমাজের মূলমন্ত্র। উৎপাদন ও ভোগ ছিল ঐ সমাজের প্রধান বিষয় । হযরত মুসা (আঃ) এর সময়ে অর্থাৎ ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব হিব্রু (Hebrew) সভ্যতার যুগে ধর্মগ্রন্থে বা দর্শনের বইয়ে অর্থনীতি বিষয়ে সরলভাবে কিছু আলোচনা হতো। আইন, ধর্ম, নৈতিকতা, দর্শন এবং অর্থনীতি তখন একসঙ্গে আলোচিত হতো । অর্থনীতি বিষয়ের আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না । উৎপাদন, ভোগ ও দৈনন্দিন সংসার পরিচালনার বিদ্যাকেই তখন অর্থনীতি বলা হতো।
অর্থনীতির ইংরেজি শব্দ Economics গ্রিক শব্দ Oikonomia থেকে এসেছে । Oikonomia অর্থ গৃহস্থালির ব্যবস্থাপনা (Management of the Household)। প্লেটো (৪২৭ - ৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্ব) এবং এরিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিষ্টপূর্ব) ছিলেন গ্রিক সভ্যতার বিখ্যাত দুই চিন্তাবিদ । এ দুজন চিন্তাবিদ ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রমিকের মজুরি, দাসপ্রথা ও সুদসহ অর্থনীতির অনেক মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন ।
প্রাচীন ভারতে চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্বে কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্রে’ বৃহত্তর পরিসরে সারা দেশের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও সামরিক বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয় । ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত (১৫৯০-১৭৮০) ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যে প্রসার ঘটে, তাকে ‘বাণিজ্যবাদ’ (Mercantilism) বলা হয় । দেশের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাণিজ্য উদ্বৃত্তকরণের লক্ষ্যে ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা বেশি রপ্তানি করত এবং খুব সামান্যই আমদানি করত । ইংল্যান্ডের উৎপাদিত পণ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করে মূল্যবান ধাতু (সোনা, রুপা, হীরা ইত্যাদি) আমদানি করা হতো । অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফরাসিরা সে দেশের ধনী মানুষের বিলাসী জীবনযাপন, অতিরিক্ত করারোপ এবং ইংল্যান্ডের বাণিজ্যবাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভূমিবাদ (Physiocracy) মতবাদ প্রচার করেন । ভূমিবাদীদের মতে, কৃষিই (খনি ও মৎসক্ষেত্রসহ) হলো উৎপাদনশীল খাত । অন্যদিকে শিল্প ও বাণিজ্য উভয়ই অনুৎপাদনশীল খাত হিসেবে মনে করা হতো ।
এভাবেই প্রাচীন এবং মধ্যযুগে অর্থনীতিবিষয়ক আলোচনা ক্রমশ নানা বিষয়ের সমন্বয়ে জটিল হতে থাকে। রাজনৈতিক অর্থনীতি একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যখন ইংরেজ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ১৭৭৬ সালে তার বিখ্যাত বই “An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations” রচনা করেন । আধুনিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো অ্যাডাম স্মিথের এ বইটি।
মানুষ যা চায় তার সবকিছু পায় না । মানুষের এই না পাওয়া-চাওয়ার নাম অভাব। মানুষের জীবনে অভাবের শেষ নেই । উদাহরণ দিয়ে বলি, তুমি একজন শিক্ষার্থী । ধরো, তোমার কাছে এক হাজার টাকা আছে । তোমার শার্ট, প্যান্ট এবং ভালো জুতা দরকার । এভাবে দেখা যাবে তোমার অনেক কিছু দরকার । কিন্তু তোমার আছে মাত্র এক হাজার টাকা । তোমার প্রয়োজনের তুলনায় এই টাকার পরিমাণ অনেক কম । অর্থনীতিতে এটাকে ‘সম্পদের দুষ্প্রাপ্যতা' বলে । দুষ্প্রাপ্যতার জন্য মানুষ গুরুত্ব অনুযায়ী পছন্দ বা নির্বাচন করে । পছন্দ করার প্রয়োজন না হলে অর্থনীতি বিষয়েরও প্রয়োজন থাকত না । অর্থনীতি শেখায় কীভাবে সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে ।
দুষ্প্রাপ্যতা ও অসীম অভাব (Scarcity and Unlimited Wants) চাওয়া অনুযায়ী সবকিছু না পাওয়াই মানুষের মূল সমস্যা। যেকোনো দ্রব্য (যেমন: বই) বা সেবাসামগ্রী (চিকিৎসা সেবা) উৎপাদন করতে সম্পদ দরকার হয় । কিন্তু “সম্পদ সীমিত” । সীমিত সম্পদ দিয়ে সীমিত দ্রব্য বা সেবা পাওয়া সম্ভব। সে জন্যই সীমিত সম্পদ দিয়ে মানুষের সব অভাব পূরণ হয় না । দুষ্প্রাপ্যতার কারণ এটাই । সম্পদ অসীম হলে দুষ্প্রাপ্যতার সৃষ্টি হতো না । বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এল. রবিন্স বলেন,“অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান, যা অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য দুষ্প্রাপ্য সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধনসংক্রান্ত মানবীয় আচরণ বিশ্লেষণ করে।” অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসনের মতে, সম্পদ সীমিত বলেই সমাজে সম্পদের সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহারের প্রশ্নটি গুরুত্ব পায় । সূর্যের আলো, বাতাস ইত্যাদি প্রকৃতি থেকে পাওয়া জিনিসগুলোর চাহিদা অনেক । কিন্তু এগুলো পেতে আমাদের তেমন কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না । এসব দ্রব্যের ক্ষেত্রে সাধারণত অভাব দেখা দেয় না। যেহেতু মানুষের অভাব অনেক এবং সম্পদ সীমিত, তাই সীমিত সম্পদ দিয়ে মানুষের সকল অভাব পূরণ হয় না । মানুষ অনেক অভাবের মধ্য থেকে কয়েকটি অভাব পূরণ করে । অভাবের গুরুত্ব বিবেচনা করে মানুষ এ অভাবগুলো পূরণ করে । অতিপ্রয়োজনীয় অভাবগুলো মানুষ অগ্রাধিকারভিত্তিতে পূরণ করে। এটাই হলো অভাব নির্বাচন বা বাছাই ।
বিষয়ের সমন্বয়ে অর্থনীতি বিষয় এখন অনেক উন্নত বা সমৃদ্ধ । প্রথমে যারা অর্থনীতি বিষয়ে উপস্থাপন করেছেন এদের মধ্যে অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং জন স্টুয়ার্ট মিল অর্থনীতিকে সম্পদের উৎপাদন ও বণ্টনের বিজ্ঞান বলে মনে করেন। এদের মধ্যে অ্যাডাম স্মিথকে অর্থনীতির জনক বলা হয় । অর্থনীতির এই ধারা ক্লাসিক্যাল অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত । তখন অর্থনীতি বা Economics -এর নাম ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতি বা Political Economy।
অ্যাডাম স্মিথের প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞা : “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান, যা জাতিসমূহের সম্পদের ধরণ ও কারণ অনুসন্ধান করে ।” ‘সম্পদকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি গড়ে ওঠে । তাই সম্পদ আহরণ ও উৎপাদনই মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলির মূল উদ্দেশ্য। স্মিথের সংজ্ঞার দুর্বলতা হলো : ১. অর্থনীতি মানুষের অসীম অভাবকে কীভাবে সীমিত সম্পদ দিয়ে মেটাবে, এই সংজ্ঞায় তার উল্লেখ নেই । ২. এই সংজ্ঞায় জাতীয় সম্পদের উপর অধিক জোর দেওয়া হলেও ব্যক্তি মানুষ ও তার কাজ-কর্মকে অবহেলা করা হয়েছে । ৩. সম্পদ আহরণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও কী উপায়ে সম্পদ যোগাড় করা হবে তা বলা হয়নি । ৪. এই সংজ্ঞায় সম্পদ বলতে দ্রব্যকেই বোঝানো হয়েছে কিন্তু সেবা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি ।
অধ্যাপক মার্শাল কর্তৃক প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞা
অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শাল সম্পদের চেয়ে মানবকল্যাণের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন । তিনি বলেন, “অর্থনীতি মানবজীবনের সাধারণ কার্যাবলি আলোচনা করে ।” অর্থনীতির মূল আলোচ্য বিষয় মানুষের অর্থ উপার্জন এবং অভাব মোচনের জন্য সেই অর্থের ব্যয় । অর্থাৎ অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের কল্যাণ সাধন ।
মার্শাল শুধু মানুষের বাস্তব কল্যাণ সাধন করা নিয়েই আলোচনা করেছেন । বর্তমানে সম্পদের স্বল্পতার সমস্যাই অর্থনীতির মূল সমস্যা । মার্শালের সংজ্ঞায় মানুষের এ মৌলিক সমস্যাটি বিবেচনা করা হয়নি ।
অধ্যাপক এল. রবিন্স প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞা
অধ্যাপক এল. রবিন্স অর্থনীতির অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন । তাঁর মতে, “অর্থনীতি হলো এমন একটি বিজ্ঞান, যা মানুষের অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য দুষ্প্রাপ্য উপকরণসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনকারী কার্যাবলি আলোচনা করে ।” এ সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
১. মানুষের অভাব অসীম এবং অভাবের প্রকৃতি ও পরিমাণ বিভিন্ন রকমের । ২. অভাব পূরণকারী সম্পদ ও সময় খুবই সীমিত । ৩. অসীম অভাবকে কীভাবে সীমিত সম্পদ দ্বারা সমন্বয় সাধন করা যায়, তা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় । ৪. সম্পদের যোগান সীমিত বলে একই সম্পদ দ্বারা আমাদের বিভিন্ন অভাব পূরণের চেষ্টা করতে হয়। ৫. অভাবের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তা পূরণ করতে হয় । এসব কারণে এ সংজ্ঞাটিকে অধিকতর সুনির্দিষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয় ।
রবিন্সের সংজ্ঞাটির সমালোচনা : ১. রবিন্স অর্থনীতির বিষয়বস্তুকে বেশি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন । ২. মানুষ তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এমন কিছু পছন্দ করে, যা অর্থনীতিতে আলোচনা হয় না । 9. অর্থনৈতিক কাজকর্মের মূল উদ্দেশ্য যে মানবকল্যাণ তার উল্লেখ নেই । ৪. রবিন্সের সংজ্ঞায় অর্থনীতির সামাজিক পছন্দকে আলোচনা করা হয়নি । ৫. আধুনিক বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার সংজ্ঞায় আসেনি । ৬. রবিন্স অর্থনীতিতে শুধু মূল্য নিয়ে আলোচনা করেছেন কিন্তু জাতীয় আয়, নিয়োগব্যবস্থা, বিনিয়োগ, বণ্টন ইত্যাদি আলোচনা করেননি। সবশেষে বলা যায় রবিন্সের সংজ্ঞা অপেক্ষাকৃত বিমূর্ত । অর্থনীতিতে কোনো তত্ত্বই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাই ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকার পরেও রবিন্সের সংজ্ঞাটি অধিক গ্রহণযোগ্য। কারণ এটি অর্থনীতির প্রধান সমস্যাটিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছে।
আমাদের সমাজে সম্পদ স্বল্পতার পরিপ্রেক্ষিতে অসীম অভাব মোকাবেলা করতে হয়। অর্থনীতিবিদ গ্রেগরি ম্যানকিউয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তকে অর্থনীতির দশটি মৌলিক নীতির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো-
১। মানুষকে পেতে হলে ছাড়তে হয় ( People Face Trade - Offs)
পছন্দমতো কোনো কিছু পেতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই পছন্দের অপর একটি জিনিস ত্যাগ করতে হয় । উদাহরণ দিয়ে বলি, তুমি যদি অর্থনীতি বিষয় পড়তে মোট সময় ব্যয় কর,তবে বাংলা বা ইংরেজি বিষয়ে পড়া থেকে তোমাকে বিরত থাকতে হবে । এরূপ তুমি যদি টিভি দেখ,তবে খেলাধুলার পেছনে সময় ব্যয় করতে পারবে না । সরকার যদি বাজেটে সামরিক খাতে বেশি ব্যয় করে, তবে শিক্ষাখাতসহ অন্যান্য বেসামরিক খাতে ব্যয় কমাতে হবে। অর্থাৎ সমাজে মানুষ সর্বদা একটি দেওয়া-নেওয়ার (Trade offs) নীতি মেনে চলেন ।
২। সুযোগ ব্যয় (Opportunity Cost )
তুমি যদি স্কুলে লেখা পড়ার জন্য সময় ব্যয় কর, তবে তুমি তোমার বাড়িতে তোমার বাবার কাজে সাহায্য করতে পারবে না । অথচ তুমি বাড়িতে কোনো একটি অর্থনৈতিক কাজ করলে তা থেকে তোমাদের পরিবার আর্থিকভাবে উপকৃত হতে পারত । কিন্তু সে সময় তুমি স্কুলে লেখাপড়া করছ। এখানে লেখাপড়া করার জন্য বাড়িতে কাজ করতে না পারা লেখাপড়ার সুযোগ ব্যয়। সাধারণত যেসব সুযোগ থেকে তুমি বঞ্চিত হচ্ছো। তার মধ্যে সবচেয়ে দামি সুযোগটিকেই সুযোগ ব্যয় বলা হয় ৷
৩। যুক্তিবাদী মানুষ প্রান্তিক পর্যায় নিয়ে চিন্তা করে ( Rational People Think at the Margin)
মানুষ প্রান্তিক পর্যায়ে চিন্তা করে । বিয়েবাড়িতে খাওয়া শেষে তোমরা কেউ কেউ ভাবো আরও একটু খেতে পারতাম, আবার কেউ কেউ ভাবো আর একটু কম খেলে ভালো হতো । এই অল্প একটু বেশি বা অল্প একটু কম খাওয়া হচ্ছে প্রান্তিক খাওয়া । ধরো, তুমি একটি বিষয়ে A পেলে, তোমার মনে হবে আরেকটু পড়লেই A+ পেতাম । মানুষ প্রান্তিক সুবিধা-অসুবিধার কথাও ভাবে। ধরো, তুমি পর পর তিনটি কলা খেলে। তিন নম্বর কলাটি হলো প্রান্তিক কলা । প্রান্তিক কলা খেয়ে তুমি যে তৃপ্তি পেলে, তার নাম প্রান্তিক উপযোগ। প্রান্তিক বা তিন নম্বর কলাটি পেতে তুমি যত টাকা ব্যয় করলে, তার নাম প্রান্তিক ব্যয় । যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে তুমি তখনই প্রান্তিক কলাটি খাবে, যখন প্রান্তিক উপযোগ প্রান্তিক ব্যয়ের চেয়ে বেশি হবে ।
৪ । মানুষ প্রণোদনায় সাড়া দেয় (People Respond to Incentives)
প্রতিটি কাজের জন্য উৎসাহ বা প্রণোদনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । মানুষ প্রণোদনা পায় বলে কাজটি অধিকতর যত্নের সাথে করে । তোমার বাবা যদি বলেন তুমি পরীক্ষায় জি.পি.এ ৫ পেলে তিনি তোমাকে একটি সাইকেল কিনে দেবেন । নিশ্চয়ই তোমার ভেতরে পড়াশোনা করার উৎসাহ আরও বেড়ে যাবে । তেমনি অর্থনীতিতে শ্রমিক প্রণোদনা পেলে বেশি উৎপাদন করে ।
৫। বাণিজ্যে সবাই উপকৃত হয় (Trade can Make Everyone Better-Off) যুক্তরাষ্ট্র সস্তায় গাড়ি তৈরি করে, তবে আমাদের রয়েছে সস্তায় পোশাক তৈরির সামর্থ । এখন আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সস্তা পোশাকের বিনিময়ে সস্তা গাড়ির বাণিজ্য করি তাহলে আমাদের উভয়েরই লাভ হবে।
৬। অর্থনৈতিক কার্যক্রম সংগঠিত করার জন্য সচরাচর বাজার একটি উত্তম পন্থা (Markets are Usually a Good Way to Organize Economic Activities) অর্থনৈতিক কাজকর্ম সচরাচর সংগঠিত হয়ে থাকে বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে। ফার্ম ও পরিবারসমূহের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলেই কোনো দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয় । ফার্মের মালিকরা বাজারের চাহিদা দেখে দ্রব্য সরবরাহ করে এবং অসংখ্য পরিবার তাদের আয় ও প্রয়োজন অনুসারে এ সমস্ত দ্রব্য ও সেবাসামগ্রী ক্রয় করে । চাহিদা ও সরবরাহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দ্বারা বাজারে দাম নির্ধারিত হয় ।
৭। সরকার কখনো কখনো বাজার নির্ধারিত ফলাফলের উৎকর্ষ সাধন করতে পারে (Governments Can Sometimes Improve Market Outcomes )
বাজার ব্যবস্থা সাধারণত নানাধরণের স্বতঃস্ফূর্ত চাহিদা ও সরবরাহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। বাজার ব্যবস্থা নির্দিষ্ট একজনের বদলে বহুজনের সম্মিলিত ‘অদৃশ্য হাতের ইশারার চলে। কিন্তু সব সময় ব্যাপারটি সঠিকভাবে হয় না। নানা কারণে অদৃশ্য হাত সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এমন অবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়ে। গণদ্রব্য সরবরাহ যেমন : শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে অপারগতা, একচেটিয়া সম্পদের কেন্দ্রীভবন, পরিবেশদূষণ এবং দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য সরকারি হস্তক্ষেপের দরকার হয়। বাজারের হাত অদৃশ্য হলেও, সরকারের হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান থাকে ।
৮। একটি দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান নির্ভর করে সে দেশের দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষমতার উপর (A Country's Standard of Living Depends on Its Ability to Produce Goods and Services)
যেসব দেশের মানুষের দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করার ক্ষমতা বেশি, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় । উন্নত দেশসমূহের মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি বলে তাদের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি । ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু আয় ৫৬১১৬ মার্কিন ডলার এবং জাপানের মাথাপিছু আয় ৪০৭৬৩ মার্কিন ডলার (উৎস বিশ্বব্যাংক) । ফলে গড় পড়তা তারা উন্নত খাবার গ্রহণ, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, উন্নত নাগরিক সুবিধা লাভ করে । শ্রমিকদের কর্মক্ষমতাও বাড়ে। অল্প সময়ে, অল্প শ্রমে তারা অনেক বেশি দ্রব্য ও সেবা তৈরি করতে পারে।
৯। যখন সরকার অতি মাত্রায় মুদ্রা ছাপায়, তখন দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায় (Prices Rise When the Government Prints Too Much Money)
মুদ্রা ছাপানোর ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি অধিক মাত্রায় মুদ্রা ছাপায়, তাহলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে অর্থাৎ দ্রব্যের মূল্যস্তর বাড়ে । মুদ্রাস্ফীতি ঘটলে অর্থের মান বা মূল্য কমে যায় । ধরো, তুমি ৫০০/- টাকা খরচ করলে লেখাপড়ার প্রয়োজনীয় সামগ্রী পেয়ে যাও। কিন্তু টাকার মান কমে যাওয়ায় ঐ সামগ্রী পেতে তোমাকে ৬৫০/- টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে; যা পূর্বের ৫০০/- টাকার চেয়ে (৬৫০/- - ৫০০/- ) ১৫০/- টাকা বেশি । জিনিসের দাম বাড়ায় একই জিনিস কিনতে এখন বেশি মুদ্রা = লাগবে।
১০। সমাজে মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্বের মধ্যে স্বল্পকালীন বিপরীত সম্পর্ক বিরাজ করে (Society Faces a Short-Run Trade-Off between Inflation and Unemployment)
দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যস্তর বেড়ে যাওয়ার অবস্থাকে মুদ্রাস্ফীতি বলে । আর কোনো শ্রমিক বাজার মজুরিতে কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজ পায় না- এরা হলো বেকার । সাধারণত অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি কমলে বেকারত্ব বাড়ে । আবার মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে বেকারত্ব কমে ।
একটি সরল অর্থনীতিতে দুই ধরনের প্রতিনিধি (Agent) থাকে । ভোক্তা বা পরিবার এবং উৎপাদক বা ফার্ম । এই দুই ধরনের প্রতিনিধির মধ্যে আয়-ব্যয় কীভাবে চক্রাকারে প্রবাহিত হয়,তা চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হলো ।
উপরোক্ত চিত্রে দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতিতে দু-ধরনের প্রতিনিধি (Agent) থাকে। যথা- ফার্মসমূহ ও পরিবারসমূহ । ফার্ম বা ফার্মের মালিকরা উৎপাদনের উপাদানগুলো ক্রয় করেন। পরবর্তীতে সেগুলো সংগঠিত করে দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করেন এবং সেগুলোই বাজারে সরবরাহ বা বিক্রয় করেন। অন্য দিকে “পরিবারসমূহ” তাদের মালিকানাধীন উৎপাদানের বিভিন্ন উপাদান যেমন:- শ্রম, ভূমি ও মূলধন বিক্রি করে আয় বা উপার্জন করেন ( শ্রমিক আয় করেন মজুরি, ভূমির মালিক উপার্জন করেন খাজনা এবং মূলধনের মালিক লাভ করেন সুদ, আর এদের সকলের খরচ মিটিয়ে উদ্যোক্তা নিজেদের জন্য বাড়তি লাভ রেখে বাজারে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার বিষয়টি বিক্রয় করেন। সে জন উদ্যোক্তার অবশিষ্ট আয়টিকে বলা হয় মুনাফা)। পরিবারসমূহ তাদের আয়-উপার্জনের সাহায্যে ফার্মের কাছ থেকে ক্রয় করেন দ্রব্য বা সেবা। এ ভাবে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবা এবং আয়ের বৃত্তাকার প্রবাহের মাধ্যমে সমগ্র অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। একেই আমরা নাম দিয়েছি “আয়ের বৃত্তাকার প্রবাহ”।
আমরা জানি, অর্থনীতি হচ্ছে চয়ন বা নির্বাচনের (Choice) বিজ্ঞান। এটাও আমরা শিখেছি যে অর্থনীতি সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে সর্বোচ্চ উৎপাদন, সর্বোচ্চ ভোগ এবং সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধনের জন্য সঠিক পথটি বাছাই করার নিরন্তর চেষ্টা চালায়, সে জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সর্বদা তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে-
ক) আমরা কী উৎপাদন করব এবং কী উৎপাদন করব না? যেমন: আমরা কি বন্দুক উৎপাদন
করব, না কি কাপড় উৎপাদন করব ?
খ) আমারা যা উৎপাদন করতে চাই,তা উৎপাদন করার জন্য কী ধরনের প্রযুক্তি বা যন্ত্র ব্যবহার করব? কাপড় কি আমরা শ্রম নিবিড় প্রযুক্তি তাঁত দিয়ে তৈরি করব, না কি পুঁজি নিবিড় মেশিনে তৈরি করব ?
গ) আমরা যা উৎপাদন করব তা আমরা কাদের জন্য করব ? কারা এটা ভোগ করবেন?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদানই হচ্ছে একেক দেশের একেক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান কাজ । এ ক্ষেত্রে আমরা প্রধানত তিনটি পন্থার সন্ধান পাই এবং সেই হিসাবে পৃথিবীর সমস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলোকে প্রধানত: তিনটি মূল পদ্ধতিতে বিভক্ত করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে, এসব পদ্ধতির কোনোটিই নিখাদভাবে বিরাজ করে না। সর্বদাই বাস্তবে তারা মিশ্র অবস্থায় বিরাজ করে। নিচে তাদের নিখাদ অবস্থায় পৃথক বৈশিষ্ট্যগুলো আলাদা আলাদাভাবে তুলে ধরা হলো-
১। বাজার পদ্ধতি বা ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি (Market System or Capitalist System)
ক) এই পদ্ধতিতে সমস্ত সিদ্ধান্তই বাজারের যুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। যেমন- যে পণ্যের চাহিদা বাজারে বেশি হবে এবং যার দাম বেশি হবে, সেটাই বেশি বেশি করে উৎপাদিত হবে। বাজারের আপেক্ষিক চাহিদাই নির্ধারণ করে দেবে উৎপাদনের বিন্যাস ।
খ) যে প্রযুক্তিতে একটি পণ্য তৈরি করার বাজার নির্ধারিত খরচ সর্বনিম্ন, সে প্রযুক্তি ব্যবহার করেই ঐ
পণ্য তৈরি হবে।
গ) বাজারে যে উৎপাদন উপকরণের দাম যেরকম নির্ধারিত হবে, তার মালিকরা ঠিক সেরকম আয় ও ভোগ করবেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে এ ব্যবস্থায় বাজার দ্বারাই উপকরণের মালিকদের এবং ক্রেতা-বিক্রেতার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে কী উৎপাদিত হবে, কীভাবে উৎপাদিত হবে এবং উৎপাদনের বণ্টন কি রকম হবে। ক্রেতা-বিক্রেতা হচ্ছেন ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত সম্পদের তথা উৎপাদন উপকরণের ব্যক্তি মালিক এবং বাজারে তাদের আন্তক্রিয়ার মাধ্যমেই এসবের দাম ও অন্য সবকিছু নির্ধারিত হয়।পড়া থেকে তোমাকে বিরত থাকতে হবে । এরূপ তুমি যদি টিভি দেখ,তবে খেলাধুলার পেছনে সময় ব্যয় করতে পারবে না । সরকার যদি বাজেটে সামরিক খাতে বেশি ব্যয় করে, তবে শিক্ষাখাতসহ অন্যান্য বেসামরিক খাতে ব্যয় কমাতে হবে। অর্থাৎ সমাজে মানুষ সর্বদা একটি দেওয়া-নেওয়ার (Trade offs) নীতি মেনে চলেন ।
২। সুযোগ ব্যয় (Opportunity Cost )
তুমি যদি স্কুলে লেখা পড়ার জন্য সময় ব্যয় কর, তবে তুমি তোমার বাড়িতে তোমার বাবার কাজে সাহায্য করতে পারবে না । অথচ তুমি বাড়িতে কোনো একটি অর্থনৈতিক কাজ করলে তা থেকে তোমাদের পরিবার আর্থিকভাবে উপকৃত হতে পারত । কিন্তু সে সময় তুমি স্কুলে লেখাপড়া করছ। এখানে লেখাপড়া করার জন্য বাড়িতে কাজ করতে না পারা লেখাপড়ার সুযোগ ব্যয়। সাধারণত যেসব সুযোগ থেকে তুমি বঞ্চিত হচ্ছো। তার মধ্যে সবচেয়ে দামি সুযোগটিকেই সুযোগ ব্যয় বলা হয় ৷
৩। যুক্তিবাদী মানুষ প্রান্তিক পর্যায় নিয়ে চিন্তা করে ( Rational People Think at the Margin)
মানুষ প্রান্তিক পর্যায়ে চিন্তা করে । বিয়েবাড়িতে খাওয়া শেষে তোমরা কেউ কেউ ভাবো আরও একটু খেতে পারতাম, আবার কেউ কেউ ভাবো আর একটু কম খেলে ভালো হতো । এই অল্প একটু বেশি বা অল্প একটু কম খাওয়া হচ্ছে প্রান্তিক খাওয়া । ধরো, তুমি একটি বিষয়ে A পেলে, তোমার মনে হবে আরেকটু পড়লেই A+ পেতাম । মানুষ প্রান্তিক সুবিধা-অসুবিধার কথাও ভাবে। ধরো, তুমি পর পর তিনটি কলা খেলে। তিন নম্বর কলাটি হলো প্রান্তিক কলা । প্রান্তিক কলা খেয়ে তুমি যে তৃপ্তি পেলে, তার নাম প্রান্তিক উপযোগ। প্রান্তিক বা তিন নম্বর কলাটি পেতে তুমি যত টাকা ব্যয় করলে, তার নাম প্রান্তিক ব্যয় । যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে তুমি তখনই প্রান্তিক কলাটি খাবে, যখন প্রান্তিক উপযোগ প্রান্তিক ব্যয়ের চেয়ে বেশি হবে ।
৪ । মানুষ প্রণোদনায় সাড়া দেয় (People Respond to Incentives)
প্রতিটি কাজের জন্য উৎসাহ বা প্রণোদনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । মানুষ প্রণোদনা পায় বলে কাজটি অধিকতর যত্নের সাথে করে । তোমার বাবা যদি বলেন তুমি পরীক্ষায় জি.পি.এ ৫ পেলে তিনি তোমাকে একটি সাইকেল কিনে দেবেন । নিশ্চয়ই তোমার ভেতরে পড়াশোনা করার উৎসাহ আরও বেড়ে যাবে । তেমনি অর্থনীতিতে শ্রমিক প্রণোদনা পেলে বেশি উৎপাদন করে ।
৫। বাণিজ্যে সবাই উপকৃত হয় (Trade can Make Everyone Better-Off) যুক্তরাষ্ট্র সস্তায় গাড়ি তৈরি করে, তবে আমাদের রয়েছে সস্তায় পোশাক তৈরির সামর্থ । এখন আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সস্তা পোশাকের বিনিময়ে সস্তা গাড়ির বাণিজ্য করি তাহলে আমাদের উভয়েরই লাভ হবে।
৬। অর্থনৈতিক কার্যক্রম সংগঠিত করার জন্য সচরাচর বাজার একটি উত্তম পন্থা (Markets are Usually a Good Way to Organize Economic Activities) অর্থনৈতিক কাজকর্ম সচরাচর সংগঠিত হয়ে থাকে বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে। ফার্ম ও পরিবারসমূহের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলেই কোনো দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয় । ফার্মের মালিকরা বাজারের চাহিদা দেখে দ্রব্য সরবরাহ করে এবং অসংখ্য পরিবার তাদের আয় ও প্রয়োজন অনুসারে এ সমস্ত দ্রব্য ও সেবাসামগ্রী ক্রয় করে । চাহিদা ও সরবরাহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দ্বারা বাজারে দাম নির্ধারিত হয় ।
৭। সরকার কখনো কখনো বাজার নির্ধারিত ফলাফলের উৎকর্ষ সাধন করতে পারে (Governments Can Sometimes Improve Market Outcomes )
বাজার ব্যবস্থা সাধারণত নানাধরণের স্বতঃস্ফূর্ত চাহিদা ও সরবরাহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। বাজার ব্যবস্থা নির্দিষ্ট একজনের বদলে বহুজনের সম্মিলিত ‘অদৃশ্য হাতের ইশারার চলে। কিন্তু সব সময় ব্যাপারটি সঠিকভাবে হয় না। নানা কারণে অদৃশ্য হাত সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এমন অবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়ে। গণদ্রব্য সরবরাহ যেমন : শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে অপারগতা, একচেটিয়া সম্পদের কেন্দ্রীভবন, পরিবেশদূষণ এবং দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য সরকারি হস্তক্ষেপের দরকার হয়। বাজারের হাত অদৃশ্য হলেও, সরকারের হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান থাকে ।
৮। একটি দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান নির্ভর করে সে দেশের দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষমতার উপর (A Country's Standard of Living Depends on Its Ability to Produce Goods and Services)
যেসব দেশের মানুষের দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করার ক্ষমতা বেশি, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় । উন্নত দেশসমূহের মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি বলে তাদের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি । ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু আয় ৫৬১১৬ মার্কিন ডলার এবং জাপানের মাথাপিছু আয় ৪০৭৬৩ মার্কিন ডলার (উৎস বিশ্বব্যাংক) । ফলে গড় পড়তা তারা উন্নত খাবার গ্রহণ, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, উন্নত নাগরিক সুবিধা লাভ করে । শ্রমিকদের কর্মক্ষমতাও বাড়ে। অল্প সময়ে, অল্প শ্রমে তারা অনেক বেশি দ্রব্য ও সেবা তৈরি করতে পারে।
৯। যখন সরকার অতি মাত্রায় মুদ্রা ছাপায়, তখন দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায় (Prices Rise When the Government Prints Too Much Money)
মুদ্রা ছাপানোর ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি অধিক মাত্রায় মুদ্রা ছাপায়, তাহলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে অর্থাৎ দ্রব্যের মূল্যস্তর বাড়ে । মুদ্রাস্ফীতি ঘটলে অর্থের মান বা মূল্য কমে যায় । ধরো, তুমি ৫০০/- টাকা খরচ করলে লেখাপড়ার প্রয়োজনীয় সামগ্রী পেয়ে যাও। কিন্তু টাকার মান কমে যাওয়ায় ঐ সামগ্রী পেতে তোমাকে ৬৫০/- টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে; যা পূর্বের ৫০০/- টাকার চেয়ে (৬৫০/- - ৫০০/- ) ১৫০/- টাকা বেশি । জিনিসের দাম বাড়ায় একই জিনিস কিনতে এখন বেশি মুদ্রা = লাগবে।মধ্য দিয়ে সমগ্র ইউরোপে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির সূত্রপাত ঘটে । ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ও তাঁর অনুসারীগণ এ ব্যবস্থা সমর্থন করেন ।
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Capitalistic Economy) ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো :
১। সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা : ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সমাজের অধিকাংশ সম্পদ বা উৎপাদনের উপকরণগুলো ব্যক্তিমালিকানায় থাকে । ব্যক্তি এগুলো হস্তান্তর ও ভোগ করে থাকে । ২। ব্যক্তিগত উদ্যোগ : ধনতন্ত্রে অধিকাংশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন: উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন, ভোগ
প্রভৃতি ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত হয় । এসব উদ্যোগে সরকারের হস্তক্ষেপ কাম্য নয় ।
৩। অবাধ প্রতিযোগিতা : এ ব্যবস্থায় দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনে প্রথমে অনেক ফার্ম অবাধে প্রতিযোগিতা করে । ফলে তখন দ্রব্যের দাম কম থাকে এবং নতুন নতুন আবিষ্কার সম্ভব হয় ।
৪। স্বয়ংক্রিয় দামব্যবস্থা : বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার দরকষাকষির মাধ্যমে দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয় ।
৫। মুনাফা অর্জন : ধনতন্ত্রে উৎপাদক সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য উৎপাদন করে ।
৬। ভোক্তার স্বাধীনতা : প্রত্যেক ভোক্তা তার নিজস্ব পছন্দ, ইচ্ছা ও রুচি অনুযায়ী অবাধে দ্রব্য ক্রয় ও ভোগ করতে পারে । ভোক্তার চাহিদা ও মুনাফার সুযোগ অনুযায়ী উৎপাদনকারী দ্রব্য সরবরাহ করে ।
৭। আয় বৈষম্য : ধনতান্ত্রিক সমাজে বিত্তবান ও সাধারণ জনগণের আয়ের মধ্যে বৈষম্য বেশি থাকে ।
ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে কিছুটা বেকারত্ব অনিবার্য।
৮। সরকারের ভূমিকা : এ ব্যবস্থায় সরকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, দেশরক্ষা, সম্পত্তির অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত থাকে ।
অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির কার্যক্রম পরিচালিত হয় । কেউ নিঃস্বার্থভাবে নয়, বরং প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বার্থে অর্থনৈতিক কার্যাবলি সম্পাদন করে ।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বা নির্দেশমূলক অর্থনীতি (Socialistic or Command Economy)
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সমাজের অধিকাংশ সম্পদ ও উৎপাদনের উপাদানের উপর রাষ্ট্রের বা সমাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত থাকে । অধিকাংশ শিল্প-কারখানা ও উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের মালিক সরকার বা সমাজ এবং সেগুলো সরকারি বা সামাজিক নির্দেশে পরিচালিত হয়ে থাকে । কোন কোন দ্রব্য, , কী পরিমাণে, কীভাবে এবং কার জন্য উৎপাদিত হবে তা সরকার বা রাষ্ট্র নির্ধারণ করে ।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Socialistic Economy)
১। সম্পদের রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক মালিকানা : সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে অধিকাংশ সম্পদ (জমি, কলকারখানা, খনি ইত্যাদি) ও উৎপাদনের উপাদানগুলোর মালিক হলো সরকার, সমবায় প্রতিষ্ঠান, যৌথ সামাজিক দল ইত্যাদি রাষ্ট্রের অধীনে কাজ করে থাকে ।
২। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা : রাষ্ট্র বা সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে সকল পরিকল্পনা করে থাকে । ঐ পরিকল্পনা অনুসারে দেশের উৎপাদন ও বণ্টন পরিচালিত হয় ।
৩। ভোক্তার স্বাধীনতার অভাব : সমাজতন্ত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোক্তারা সরকার ও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা নির্ধারিত উৎপাদিত দ্রব্যাদি ভোগ করে থাকে । কোনো ভোক্তা ইচ্ছাকৃত অর্থ ব্যয় করে বাজারকে প্রভাবিত করে কোনো কিছু উৎপাদন ও ভোগ করতে পারে না ।
৪। অবাধ প্রতিযোগিতার অভাব : অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে উৎপাদন পরিচালিত হওয়ায় সেখানে বহুসংখ্যক বেসরকারি উদ্যোক্তার অবাধ প্রতিযোগিতা থাকে না ।
৫। ব্যক্তিগত মুনাফার অনুপস্থিতি : সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত মুনাফার পরিবর্তে জাতীয় চাহিদা ও সামগ্রিক
কল্যাণের জন্য উৎপাদন পরিচালিত হয়ে থাকে। ফলে এখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো শিল্প
প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে না । কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবই সরকারের এবং সামাজিক মালিকানার
অধীনে থাকে বলে ব্যক্তিগত মুনাফা থাকে না ।
মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Mixed Economic System)
যে অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানা ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বিরাজ করে তাকে মিশ্র অর্থব্যবস্থা বলে । অর্থাৎ এ অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিগত ও সরকারি উদ্যোগ সম্মিলিত ভূমিকা পালন করে । পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে মিশ্র অর্থব্যবস্থা বিদ্যমান । যথা- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, বাংলাদেশ, ভারত ইত্যাদি ।
মিশ্র অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Mixed Economy)
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মিশ্র অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য আলাদা হয়ে থাকে। সাধারণত মিশ্র অর্থনীতির নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ করা যায়:
১। সম্পদের ব্যক্তিগত, সমবায় ও সরকারি মালিকানা : মিশ্র অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি অবাধে ভোগ করতে পারে ও ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে । পাশাপাশি গণদ্রব্য (মহাসড়ক) ও সেবা (স্বাস্থ্যসেবা) উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রধানত সরকার পরিচালনা করে ।
২। ব্যক্তিগত উদ্যোগ : মিশ্র অর্থনীতিতে উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বণ্টন ও ভোগসহ অধিকাংশ অর্থনৈতিক কার্যাবলি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগঠিত ও পরিচালিত হয় ।
৩। সরকারি উদ্যোগ : মিশ্র অর্থনীতিতে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় । দেশের মৌলিক ও ভারী শিল্প, জাতীয় নিরাপত্তা ও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকার পরিচালনা করে থাকে ।
৪। মুনাফা অর্জন : মিশ্র অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয় । তবে তা অতিরিক্ত একচেটিয়া মুনাফা নয় ৷
৫। ভোক্তার স্বাধীনতা : এ ব্যবস্থায় ভোক্তা সাধারণ দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় ও ভোগের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে। তবে সরকার প্রয়োজন মনে করলে দ্রব্যের দামের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং প্রয়োজন অনুসারে কোনো দ্রব্যের উৎপাদন কিংবা ভোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন— ধূমপান, মাদকদ্রব্য উৎপাদন ও ভোগ ইত্যাদি ।
বিশ্বে কোথাও বিশুদ্ধ ধনতন্ত্র বা বিশুদ্ধ সমাজতন্ত্র না থাকায় অনেকে মিশ্র অর্থব্যবস্থাকে একটি উন্নত অর্থব্যবস্থা বলে মনে করেন ।
ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Islamic Economic System)
ইসলামের মৌলিক নিয়ম-কানুনের উপর বিশ্বাসকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অর্থব্যবস্থাকে ইসলামি অর্থব্যবস্থা বলা হয় ।
ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Islamic Economy) ইসলামী অর্থব্যবস্থায় পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এ ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য প্রচলিত বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ :
১। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস : ইসলামি অর্থনীতির মূলনীতিমালা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের ধর্মীয় দর্শন, ধর্মগ্রন্থের বিধান ও ধর্মীয় প্রচলিত প্রথা ও বিধি-বিধান অনুযায়ী প্রণীত ও পরিচালিত হয় ।
২। সুদমুক্ত আমানত : ইসলামি অর্থনীতিতে সুদ গ্রহণের স্বীকৃতি নেই । এখানে ব্যাংক-ব্যবস্থায় সুদমুক্ত
আমানতের ব্যবস্থা করা হয় ।
৩। যাকাত ও ফিতরা : এ ব্যবস্থায় যাকাতভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে । এ লক্ষ্যে যাকাত ও ফিতরার মাধ্যমে ধনীদের নিকট থেকে অর্থ গ্রহণ করে তা দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হয় ।