চিংড়ির বিপণন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এখনও উপযুক্ত কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। চিংড়ি রপ্তানিযোগ্য পণ্য হওয়ায় মুলত চিংড়ি চাষ সমৃদ্ধ উপকুলবর্তী এলাকায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট বা শিল্প গড়ে উঠেছে। চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়ায় প্রধান প্রধান সমস্যা ও তা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য উপায়সমূহ নিচে বর্ণনা করা হলো-
ক. চিংড়ি উৎপাদন সংক্রান্ত সমস্যা
বাংলাদেশে রপ্তানিকৃত চিংড়ির মধ্যে বাগদা ও গলদা চিংড়িই প্রধান। উপকুলীয় এলাকায় চিংড়ি চাষের খামার বৃদ্ধি পেলেও হেক্টর প্রতি চিংড়ি উৎপাদন খুবই কম। ফলে চিংড়ি চাষের অভীষ্ট এলাকায় এখনও চিংড়ি দ্রুত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর পর্যাপ্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা গড়ে উঠেনি। এছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে খামার স্থাপনের কারণেও চিংড়ি উৎপাদনকারীরা উপযুক্ত মূল্যে বাজারে বিক্রয় করতে পারে না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে চিংড়ি চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, যা ভবিষ্যতে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণের অন্তরায় স্বরুপ।
খ. পরিবহণ সমস্যা
বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় ঘেরে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হলেও আধুনিক চিংড়ি খামারের সংখ্যা খুবই নগণ্য এবং চিংড়ি উৎপাদন এলাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভাল নয়। ফলে ক্রেতা বা ভোক্তাদের অবস্থান অনেকটা এলাকাভিত্তিক হিসেবেই গড়ে উঠেছে। অপরদিকে চিংড়ি দ্রুত পচনশীল পণ্য হওয়া সত্ত্বেও বিপণন প্রক্রিয়াকে সুসংগঠিত করার জন্য পর্যাপ্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কোন পরিবহণ ব্যবস্থাও গড়ে উঠেনি।
গ. দীর্ঘ বিপণন প্রক্রিয়াগত সমস্যা
আমাদের দেশে মৎস্যসম্পদ বিপণনের ক্ষেত্রে ফড়িয়া, বেপারী, দালাল ও আড়তদারগণ মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এদের মাধ্যমেই তা পুনরায় পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে ক্রেতা বা ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে। ফলে পচনশীল চিংড়িসম্পদ দীর্ঘসময় ধরে হাত বদলের কারণে বিভিন্ন উপায়ে পণ্যের গুণগতমান বিনষ্ট হয়। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রক্রিয়ায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি বিপণন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে।
ঘ. প্রক্রিয়াজাতকরণ সমস্যা
চিংড়ি সম্পদের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অভ্যন্তরীণ বাজারে চিংড়ি বিপণনের ক্ষেত্রে শুধু বরফ ব্যবহার করে হিমায়িতকরণের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পৌঁছানো হয়। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে দেখা গেছে, প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় সরবরাহকৃত চিংড়ির প্রায় ২৫ শতাংশেরও অধিক চিংড়ি বিবর্ণ, অপরিষ্কার এবং কালো দাগযুক্ত। সংশ্লিষ্ট চিংড়ি সরবরাহকারীদের অনভিজ্ঞতা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার কারণেই চিংড়ির গুণগতমান নষ্ট হয় এবং বাজারমূল্য কম হয়ে থাকে। ফলে একদিকে সরবরাহকারীরা যেমন ব্যবসায়িক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অপরদিকে দেশও প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সাধারণত আমাদের দেশে এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের ঘের এবং মুক্ত জলাশয় থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজারজাতকরণের উপযুক্ত চিংড়ি আহরণ করা হয়। এ সময়ে আমাদের দেশের আবহাওয়া উষ্ণ থাকার কারণে এবং চিংড়ি দ্রুত প্রক্রিয়াজাত কারখানায় সরবরাহ না করার ফলে অধিকাংশ চিংড়ির গুণগতমান নষ্ট হয়ে যায়। অনুরুপভাবে ট্রলারে আহরিত চিংড়ি অনেক সময় অসচেতনতার কারণে দিনের সুর্যালোকে উত্তপ্ত ডেকে ফেলে রাখা হয়। ফলে চিংড়ির দেহে কালো দাগ দেখা দেয়, যা চিংড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে দাঁড়ায়। চিংড়ি বিপণনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত সমস্যাসমূহ ছাড়াও চিংড়ি হিমায়িতকরণ ও চিংড়ি উৎপাদন এলাকায় প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগত সমস্যা, প্রযুক্তিগত সমস্যা, বিশ্ববাজারে চিংড়ির অস্থিতিশীল মূল্য, বিপণন প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় অর্থসংস্থানগত সমস্যা, চিংড়ির সংরক্ষণের উপযুক্ত স্থানগত সমস্যা প্রভৃতি অন্যতম। দক্ষ বিপণন প্রক্রিয়া পরিচালনার ক্ষেত্রে উপরোক্ত সমস্যাসমূহকে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আরও দেখুন...