পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে খামারে পোনা ছাড়ার পর পরই ব্যাপকভাবে পোনা মারা যায়। সাধারণত পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাবেই এ ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক উৎস থেকে চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা হয় এবং দুর-দুরান্ত থেকে এসব পোনা পরিবহণ করে এনে খামারে মজুদ করা হয়। ফলে পরিবেশের পরিবর্তন ক্লেশ, পোনার ক্লেশ ও খামারে পানিতে খাপ খাওয়ানো বা অভ্যস্তকরণ ঠিকমত না হওয়ার ফলে পোনা মারা যায়। তাই পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনার মূল বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিলে মজুদকালে পোনার মৃত্যুহার যথেষ্ট পরিমাণে কমানো সম্ভব। মজুদ ব্যবস্থাপনার মুল বিষয়গুলো হলো-
ক. পোনা শনাক্তকরণ
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, সাগর এলাকা, নদ-নদী ও খাল বিলে বিভিন্ন প্রকার চিংড়ি পোনার উৎসস্থল। চাষের জন্য বিশেষ করে লোনাপানির বাগদা চিংড়ির পোনা এবং মিঠাপানির গলদা চিংড়ির পোনা প্রাকৃতিক উৎস নির্ভর। প্রাকৃতিক উৎস থেকেই মুলত এসব চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা হয়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে এসব পোনা সংগ্রহের সময় অন্যান্য বিভিন্ন প্রজাতির পোনা ধরা পড়ে। বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ির পোনা থেকে বাগদা ও গলদা চিংড়ির পোনা শনাক্ত করে আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়। এজন্য বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি পোনার শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্যের ওপর সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। নিম্নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চিংড়ি পোনার শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো:
১. বাগদা চিংড়ি: বাগদা চিংড়ির পোষ্ট লাভা বা পিএল অন্যান্য চিংড়ির পোস্ট লার্ভার চেয়ে আকারে বড় হয়। দেহের গঠন সরু ও লম্বাটে হয়ে থাকে। চক্ষু তুলনামুলকভাবে বড়। পিএল এর দেহের দৈর্ঘ্য বরাবর লেজ পর্যন্ত বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। জুভেনাইল অবস্থায় এই দাগ সবুজ বর্ণ ধারণ করে এবং পেটের দিকে তখন এটি একটি কাঠির মত দেখায়। খড়গ বা শুড় সোজা এবং ডগাটি সামান্য উপর দিকে বাঁকানো থাকে। খড়গের উপর তলে ৫টি দাঁত দেখা যায়। ১ম তিন জোড়া পায়ের শেষ প্রান্তে ছোট চিমটা আছে। ২য় পা ১ম পায়ের চেয়ে সামান্য লম্বা এবং ৩য় পায়ের চাইতে ছোট বা সমান ।
২. ঢাকা চিংড়ি: এই চিংড়ির পোনা বাগদা চিংড়ির পোনার চেয়ে আকারে অনেক ছোট। এদের দেহের রং স্বচ্ছ সাদা এবং রোস্টামের অগ্রভাগ গোলাপী রঙের হয়ে থাকে। পুচ্ছ পাখনা ও টেলসনে অস্পষ্ট লালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। চক্ষু দন্ড হালকা হলুদ বর্ণের এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ উদর খন্ডে মধ্যবর্তী পৃষ্ঠ কাঁটা থাকে। রোষ্ট্রামের উপরিভাগে ১টি মাত্র দাঁত দেখা যায় এবং এই রোস্টাম চক্ষু ছাড়িয়ে সম্মুখের দিকে প্রসারিত। এরা পাত্রের গা ঘেসে দ্রুত সাঁতার কাটে এবং নড়াচড়া অনুভব করলে লাফাতে চেষ্টা করে, সাধারণত এরা সাঁতারের সময়ে ধড়ের মাঝামাঝি সামান্য উঁচু করে সাঁতার কাটে।
৩. বাগতারা চিংড়ি: এই পোনা দেখতে অনেকটা বাগদা চিংড়ির পোনার মত, তবে তুলনামূলকভাবে বাগদা পোনার চেয়ে আকারে ছোট। রোস্ট্রামের উপরিভাগে ৪-৫টি দাঁত আছে। পোনার উদরের তলদেশে ৪-৫টি লালচে বাদামি রঙের ফোঁটা ফোঁটা দাগ থাকে। ষষ্ঠ উদর খন্ডকের পিঠের দিকে একটি কাঁটা থাকে। এদের তলপেটে পিছন দিকে ইংরেজি 'এম' অক্ষরের মত নীলাভ কালো দাগ দেখা যায়।
৪. হন্নি চিংড়ি: এরা দেখতে অনেকটা হরিণা চিংড়ির মত এবং দেহের রং অনেকটা বাদামি বা খয়েরি রঙের। শুঙ্গের বৃত্তে লালছে ধরনের রঞ্জন কণা থাকে। এদের রোস্ট্রাম ক্রিকোণাকৃতির এবং এর উপরিভাগে ৪-৭টি দাঁত থাকে। চক্ষু বৃত্তের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত। উদর খন্ডকের পাশের নিচের দিকে লাল ইটের মত ডোরা এবং ইউরোপড ও লেজে দাগ থাকে।
৫. কেরাণী চিংড়ি: এদের রোস্টাম ছোট, অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ ও ক্রিকোণাকৃতির। রোহামের উপরিভাগে ৩-৪টি দাঁত থাকে তবে নিচের দিকে কোনো দাঁত থাকে না। ক্যারোপেসে ২-৩টি এপিগ্যাস্ট্রিক কাঁটা থাকে। ইউরোপডের ডানায় একটি বাদামি ফোঁটা দাগ থাকে। এদের শরীরে এ্যান্টিনাল ও হেপাটিক কাঁটা দেখা যায়। এন্টিনিউলার পেডাংকেলের অগ্রভাগ রঙিন এবং এদের লেজে ছোপ ছোপ দাগ থাকে।
৬. গলদা চিংড়ি: গলদা চিংড়ির পিএল দেখতে স্বচ্ছ এবং পিএল এর মাথার খোলস এর উপর ২-৫টি লম্বালম্বি কাল বর্ণের বন্ধন থাকে। ক্রমান্বয়ে গলদা বড় হতে থাকলে উক্ত বন্ধন বিলুপ্ত হয়ে পেটের প্রতিটি খন্ডের সংযোগস্থলে বলয় দেখা যায়। পিএল পর্যায়ের বয়স ৩০-৩৫ দিন এবং দৈর্ঘ্য ১-১.৫ সেমি হয়। গলদা চিংড়ির রোস্ট্রাম বাঁকানো এবং উপরে নিচে খাঁজ কাটা থাকে। পাগুলো বেশ লম্বা হয় এবং ১ম ও ২য় জোড়া পা চিমটাযুক্ত।
৭. ছটকা চিংড়ি: এদের শিরোবক্ষ অংশে লম্বালম্বি অস্পষ্ট দাগ থাকে। উদর অঞ্চলের পার্শ্বীয় অংশে ক্ষুদ্র বিন্দুর সমন্বয়ে গঠিত দাগ পরিলক্ষিত হয়। এই দাগগুলো সারিবদ্ধ ও নিয়মিতভাবে বিন্যস্ত। এই চিংড়ির পোনার রোস্ট্রামটির দৈর্ঘ্য অপেক্ষকৃত ছোট।
খ. পোনার উৎস ও সংগ্রহ পদ্ধতি
দু'টি উৎস থেকে বাগদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা যেতে পারে। উৎস দু'টি হচ্ছে- প্রাকৃতিক উৎস ও হ্যাচারি বা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র।
প্রাকৃতিক উৎস: সাধারণত 'জো' বা 'গোণ' কালীন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বাগদা চিংড়ির পোনা পাওয়া যায়। ডিসেম্বর-এপ্রিল মাসের মধ্যে অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার ২য় থেকে ৫ম দিনের জোয়ার-ভাটার সময় পানির ওঠা-নামা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এই জোয়ার-ভাটায় পানির সর্বোচ্চ ওঠা- নামাকে খুলনা অঞ্চলে গোণ এবং কক্সবাজার অঞ্চলে জো (tidal fluctuation) বলা হয়। এই জোয়ার আরম্ভ হওয়ার পর ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম ঘন্টাই পোনা আহরণের সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশের কক্সবাজার, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বাগদার পোনা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় সারা বছরই বাগদার পোনা পাওয়া যায়। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সবচেয়ে বেশি পোনা ধরা পড়ে। তবে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করে চাষের ক্ষেত্রে উদ্ভূত অসুবিধাসমূহ হলো :
১) প্রাকৃতিক উৎসের পোনার সাথে অন্যান্য চিংড়ির পোনা ও রাক্ষুসে মাছের পোনা থাকে।
২) একই বয়সের ও একই আকারের পানা পাওয়া যায় না।
৩) সময়মত পর্যাপ্ত পরিমাণে পোনা পাওয়া যায় না।
৪) আহরণ ও পরিবহণজনিত পীড়নের ফলে অনেক সময় পোনা মারা যায়।
৫) পোনা শনাক্তকরণ, গণনা ও পরিবহণের সময় অসতর্কতার ফলে অনেক পোনার অঙ্গহানি হয়ে থাকে এবং এর ফলে এসব অসুস্থ পোনা থেকে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন পাওয়া যায় না।
৬) অত্যন্ত দুর্গম এলাকায় এই পোনা আহরণ করা হয়ে থাকে, ফলে এসব পোনা সংগ্রহ করা বেশ কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ।
৭) নির্বিচারে চিংড়ি পোনা আহরণের ফলে উপকূলীয় নদীসমূহের জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা আহরণ ও গণনা: প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে চিংড়ি পোনা আহরণ করা হয় এবং আহরণ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত উপকুলীয় এলাকায় বেহুন্দী জাল, ছাঁকনি জাল, ঠেলা জাল ও টানা জাল দ্বারা চিংড়ির পোনা ধরা হয়। বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণের সময় পোনার মৃত্যুহার ও পোনার পীড়ন যাতে কম হয় এবং অন্যান্য চিংড়ি ও মাছের পোনার মৃত্যুহার কমানো তথা উপকূলীয় নদীসমূহের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য কতকগুলো বিষয়ের ওপর লক্ষ্য রাখা দরকার। পোনা ধরার সময় লক্ষ্যণীয় বিষয়সমূহ হলো-
ক) পোনা ধরার জাল থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর পোনা সরিয়ে ফেলতে হবে।
খ) পোনা শনাক্তকরণ ও বাছাই এর কমপক্ষে ১ ঘন্টা পর পোনা গণনা করা উচিত যাতে পোনা পাত্রের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
গ) পোনা মজুদের পাত্র ঠান্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থানে সযত্নে রাখতে হবে এবং পাত্রের মুখ ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে কারণ অন্ধকারময় পরিবেশ পোনার জন্য কম পীড়াদায়ক।
ঘ) পোনা মজুদ পাত্রের পানি ঘন ঘন বদলানো এবং বেশি ঘনত্বে পোনা রাখা ঠিক নয়।
ঙ) আহরিত পোনা থেকে বাগদা পোনা আলাদা করে অন্যান্য মাছ ও চিংড়ির পোনা যত্ন সহকারে পানিতে ছেড়ে দিতে হবে।
সাধারণত প্রাকৃতিক উৎসের পোনা ঝিনুক দিয়ে একটি একটি করে গণনা করা হয়। এতে পোনা গণনা করতে বেশি সময় লাগে এবং অধিক পীড়ন পড়ে। ফলে পোনা পরিবহণকালে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং মৃত্যুহার বেশি হয়। অল্প সময়ে বেশি পোনা গণনার জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়:
ক) ৩০০ অথবা ৫০০ লিটারের গোলাকার ট্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি দ্বারা পূর্ণ করে তাতে গণনার জন্য প্রয়োজনীয় পোনা ছাড়তে হবে।
খ) তারপর ট্যাংকের পানি প্যাডেল দ্বারা ওপর নিচে ঘুরাতে হবে।
গ) দ্রুত ১ লিটার পানি নিয়ে তাতে কতটা পোনা আছে তা ভালোভাবে গণনা করতে হবে। এভাবে কয়েকবার এক লিটার করে পানি দিয়ে পোনা গণনা করতে হবে এবং গড়ে এক লিটার পানিতে কি পরিমাণ পোনা আছে তা হিসাব করে বের করে নিতে হবে।
এছাড়া আমাদের দেশে বিশেষ করে কক্সবাজার এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক বাগদার পোনার নার্সারি গড়ে উঠেছে। এসব নার্সারিতে প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত পোনা সংগ্রহ করে মজুদ করা হয় এবং ৩-৪ দিন নার্সারিতে বিশেষ যত্নে বা ব্যবস্থাধীনে রাখা হয়। তারপর এসব পোনা বিক্রি করে দেওয়া হয়।
সারণি: প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত বাগদা চিংড়ির ভালো ও খারাপ পিএল-এর বৈশিষ্ট্য
ক্রম | পর্যবেক্ষণ বিষয় | ভালো পিএল | খারাপ পিএল |
---|---|---|---|
০১ | দেহের রং | হালকা বাদামি বা স্বচ্ছ | লালচে বা নীল |
০২ | খোলস | পরিষ্কার | নোংরা |
০৩ | আচরণ (সমপরিমাণ লবণাক্ত ও মিঠাপানির মিশ্রণে) | ৩০-৪৫ মিনিট বেঁচে থাকে | মারা যাবে |
০৪ | আচরণ (গোলাকার পাত্রে স্রোত সৃষ্টি করলে) | স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটে | পাত্রের মাঝখানে জমা হয় |
হ্যাচারি বা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র: আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের পূর্বশর্ত হচ্ছে সময়মত পর্যাপ্ত পরিমাণে নির্ভেজাল পোনার প্রাপ্তি। সময়মত উন্নতমানের পোনা কেবল কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র থেকেই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে হ্যাচারিতে বাপদার পোনা উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও চাষি পর্যায়ে গুণগত মানসম্পন্ন পোনার পর্যাপ্ততা এখনও চাহিদার তুলনায় একেবারেই নগণ্য। হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা চাষের ক্ষেত্রে সুবিধাসমূহ নিম্নরূপ-
ক) সময়মত ও চাহিদামত পর্যাপ্ত পরিমাণে পোনা পাওয়া যায়।
খ) একই আকারের ও বয়সের পোনা পাওয়া যায়।
গ) সুস্থ-সবল পোনা পাওয়া যায়।
ঘ) নির্ভেজাল বাগদার পোনা পাওয়া যায়।
ঙ) এতে অন্য কোনো চিংড়ি বা রাক্ষুসে মাছের পোনা থাকে না।
চ) হ্যাচারি থেকে সহজেই পোনা অন্যত্র পরিবহণ করা যায়।
ছ) বাগদার পোনা শনাক্তকরণে কোনো সমস্যা হয় না।
উন্নত মানের পিএল শনাক্তকরণঃ হ্যাচারিতে উৎপাদিত পিএল প্রাপ্তির উৎস প্রধানত দু'টি-
১. প্রাকৃতিক উৎসের মাদার চিংড়ি থেকে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পিএল; এবং
২. নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রতিপালিত মাদার চিংড়ি থেকে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পিএল।
তবে উন্নতমানের পিএল নির্বাচনের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনায় রাখতে হবে-
১. পিএল-এর বয়স: পিএল-এর বয়স কমপক্ষে ১৪/১৫ দিন না হলে এদেরকে খামারের উন্মুক্ত পরিবেশে খাতস্থ হওয়ার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়না। পিএল-এর বয়স ১৪/১৫ দিন হলে এর ন্যূনতম দৈর্ঘ্য ১৩/১৪ মিলিমিটার এবং রোম্মামের উর্ধাংশে ৫-৭ টি দাঁতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
চিত্র-২.১৪: বাগদা চিংড়ির ভালো ও খারাপ পিএল
২. পিএল-এর বর্ণ: বাদামী, খয়েরি, সবুজাভ বা কালচে সবুজাভ বর্ণের ঈবনহু শরীরের পিএল উৎকৃষ্ট মানের বলে বিবেচনা করা হয়। তবে লাল, নীল বা কালো বর্ণের পিএল অসুস্থ পরিবেশে প্রতিপালিত হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
চিত্র-২.১৫ : ৰাগদা চিংড়ির পিএল-এর বর্ণ
৩. আলোর প্রতি আকর্ষণ: আলোর প্রতি সহজাত আকর্ষণ প্রবণতা (photo-taxis) পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পিএল-এর প্রতিটি পর্যায়ে আলোর প্রতি আকর্ষণের সহজাত প্রবণতা দেখা যায়। এ প্রবণতা নগ্নি পর্যায়ে সর্বাধিক, জুইয়া ও মাইসিস পর্যায়ে কিছুটা কম এবং পিএল পর্যায়ে আরো কম থাকে।
৪. পিএল-এর নড়াচড়া: পোনার স্বাভাবিক নড়াচড়া, সাঁতার কাটা, চঞ্চলতা, ছটফটে ভাব ও চলাফেরা করার প্রবণতা (movement) পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
৫. পিএল-এর আকৃতি: খামারে ছাড়ার উপযোগী পিএল ১৪ বা ১৫-এর আকৃতি কমপক্ষে ১৩-১৪ মিলিমিটার হওয়া উচিৎ। এর চেয়ে ছোট আকারের পোনা খামারে ছাড়ার জন্য বাছাই করা ঠিক নয়।
৬. পিএল-এর আকৃতির সমতা: একই মজুদে বিভিন্ন আকৃতির পোনা থাকলে এদের মধ্যে স্বজাতি ভক্ষণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ভালো ফলনের জন্য খামারে সম-আকৃতির পোনা মজুদের কোন বিকল্প নেই। হ্যাচারিতে একই ট্যাংকের পোনা সর্বদা সম-আকৃতি সম্পন্ন হওয়া সমীচীন।
৭. পিএল-এর বিভিন্ন শারিরিক বৈশিষ্ট্য:
গ. পোনা বা পিএল পরিবহণ পদ্ধতি
আমাদের দেশে বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে পলিথিন ব্যাগে চিংড়ির পিএল এবং ড্রাম বা অ্যালুমিনিয়ামের হাড়িতে চিংড়ির জুভেনাইল পরিবহণ করা হয়ে থাকে। কখনও কখনও স্বল্প দূরত্বে হাড়িতে করে রেণু বা পিএল আবার পলিথিন ব্যাগে জুভেনাইল ও ধানী বা চারা পোনা পরিবহণ করতে দেখা যায়। তবে সব সময়ই আধুনিক পদ্ধতিতে পিএল ও জুভেনাইল পরিবহণ অধিক নিরাপদ। পোনা পরিবহণের প্রচলিত নিয়মসমূহ নিচে বর্ণনা করা হলো:
সনাতন পদ্ধতি
ক) সাধারণভাবে হাড়ি বা ব্যারেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ টিউবওয়েলের পানি নিয়ে তাতে পুকুরের কিছু পরিষ্কার পানি মেশাতে হবে।
খ) নদী বা খাল পথে পোনা পরিবহণের সুযোগ থাকলে নৌকায় পোনা পরিবহণ করা যায়।
গ) পোনা বা জুভেনাইল ভর্তি করে পাত্রের মুখ যন ফ্রঁসের জাল দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
ঘ) পরিবহণকালে প্রতি ২-৩ ঘন্টা অন্তর পাত্রের ২/৩ ভাগ পানি পরিবর্তন করলে ভালো হয়।
ঙ) পরিবহণের সময় হাত দিয়ে ব্যারেলের পানি ঝাঁকাতে হবে।
চ) হাড়িতে পোনা পরিবহণের সময় মাঝে মধ্যে হাত নিয়ে পানি বাঁকাতে/ আন্দোলিত করতে হবে।
আধুনিক পদ্ধতি
ক) পরিবহণের কমপক্ষে ২ ঘন্টা পূর্বে খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। তবে অনেক দুরে পিএল পরিবহণের ক্ষেত্রে জীবিত খাদ্য হিসেবে আর্টিমিয়া বা প্রতি ৫০০ পিএল-এর জন্য একটি সিদ্ধ ডিমের কুসুমের ১/৮ অংশ খেতে দিতে হবে।
খ) পলিদিন ব্যাগে ছিদ্র আছে কিনা তা ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে। একটি ব্যাগের ভেতর আরেকটি ব্যাগ ঢুকিয়ে কোণাগুলো শক্তভাবে বাঁধতে হবে, যেন সব স্থানে কোনো ক্রমেই রেণু বা পিএল আটকে না যায়। অতঃপর ব্যাগের ১/৩ অংশ পানি দিয়ে পূর্ণ করতে হবে।
গ) শুধুমাত্র পিএল পরিবহণের ক্ষেত্রে প্যাকিংয়ের পূর্বে আশ্রয়স্থল হিসেবে কিছু জলজ আগাছা ব্যাগের ভিতর দিতে হবে। এবার পিএল বা পোনা ব্যাগের ভিতর দিয়ে ২/৩ অংশ অক্সিজেন দিয়ে পূর্ণ করতে হবে এবং পলিখিন ব্যাগের মুখ শক্ত করে বাঁধন দিতে হবে। এক সাথে অনেক ব্যাপ পরিবহণ করা হলে ব্যাগগুলো তাপ অপরিবাহী কার্টুনে নিয়ে পরিবহণ করা অধিক নিরাপদ।
চিত্র ২.১৬: পিএল পরিবহণ
গোনা টেকসইকরণ ও পরিবহণ
তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, পিএইচ প্রভৃতির স্বল্পতা বা আধিক্য চিংড়ির মধ্যে পীড়ন সৃষ্টি করে যা রোপ সংক্রমণের কারণ/মৃত্যুর কারণ হতে পারে। হ্যাচারি বা নার্সারির নিয়ন্ত্রিত একটি পরিবেশ থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোনাগুলো নতুন পরিবেশে ছাড়া হয় যা সহনীয় হওয়া অতীব জরুরি। নতুন পরিবেশে খুবই প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় বিধার পোনাকে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে। যাতে পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতাকে ধীরে ধীরে অতিক্রম করে চাপমুক্তভাবে অভ্যস্থ হতে পারে। যথেষ্ট সতর্কতার সাথে এই কাজটি সম্পাদন করা পেলে- মজুদের সময় পোনা শারীরিকভাবে চাপের সম্মুখীন হবে না। ফলে বেশিরভাগ পোনা সুস্থ থাকবে এবং মজুদকালীন মৃত্যুর হার কম হবে। অপরদিকে পোনা জীবিতের হার বৃদ্ধি পাবে যা বছর শেষে উৎপাদনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পরিবহণের সময় পোনার মলমূত্র ত্যাগের ফলে পরিবহণ পাত্রে যাতে কোনো গ্যাস (অ্যামোনিয়া) সৃষ্টি না হয় সেজন্য পোনাকে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে না খাইয়ে রেখে পেট খালি করা হয় এবং পোনা যাতে প্রতিকূল অবস্থার সাথে সহনশীল হতে পারে সে জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এটাই পোনা টেকসইকরণ। এক কথায় প্রতিকূল অবস্থার সাথে সহনশীল করে পোনাকে টেকসই করে নেয়াটাই হলো টেকসইকরণ। টেকসই করে পোনা পরিবহণ করলে অধিক দূরত্বে পরিবহণ করা যায় এবং গোনার মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে যায়।
চিত্র-২.১৭: পোনা টেকসইকরণ
টেকসইকরণ পদ্ধতিসমূহ
ক) পুকুরে হাপার মধ্যে বেড় জাল দিয়ে পোনা ধরার পর জালের মধ্যে রেখে ১০-১৫ মিনিট পোনাকে ঝাপটা দিয়ে পুনরায় পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। পোনা পরিবহণের অন্তত ৫-৭ দিন পূর্ব থেকে ২-৩ দিন অন্তর দিনে একবার এই কাজটি কতে হবে। পরিবহণের কমপক্ষে ৮ ঘন্টা পূর্বে পোনা ধরে হাপার মধ্যে রাখতে হবে। এই সময় কোনো ধরনের খাবার হাপায় দেয়া যাবে না।
খ) গোলাকার ট্যাংক বা সিস্টার্ন পোনা বিক্রির আগের দিন জাল দিয়ে পোনা ধরে ট্যাংক বা সিস্টার্নে রেখে পানির ফোয়ারা দিতে হবে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা। এই সময় সিস্টার্নে কোনো ধরনের খাবার দেয়া যাবে না ।
গ) পুকুরে পোনা টেকসই পোনা বিক্রির আগে যে পুকুরে পোনা টেকসই করা হয় তাকে পাকাই পুকুর বলে। পাকাই পুকুরের আয়তন ১০-৩০ শতাংশ এবং গভীরতা ৩-৪ ফুট হয়। পাকাই পুকুরে পোনা টেকসই করতে ৩-৪ দিন সময় লাগে ।
পিএল অভ্যস্থকরণের নিয়ামকসমূহ
পানিতে বিদ্যমান প্রায় সব ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণই (যেমন- তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, পিএইচ, অ্যালকালিনিটি, দ্রবীভূত অক্সিজেন ইত্যাদি) পোনা মজুদের সময় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। তার মধ্যে মাঠ পর্যায়ে পোনা ছাড়ার সময় যে ফ্যাক্টরগুলো অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় তাহলো- লবণাক্ততা ও তাপমাত্রা। এছাড়া উপস্থিত ক্ষেত্রে বা জরুরি প্রয়োজনে চাষিরা হাত-মুখ দিয়েও এই দু'টি প্যারামিটারকে অনুভব করতে পারে। প্যারামিটারগুলোকে বাড়ানো বা কমানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় নেয়া উচিৎ। যেমন-তাপমাত্রা বাড়ানো কমানোর মাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ১.৫ সে. এর বেশি হওয়া অনুচিত। লবণাক্ততা কমানোর মাত্রা প্রতি ঘন্টায় ৩ পিপিটি এবং বাড়ানোর মাত্রা প্রতি ঘন্টায় ১ পিপিটি এর বেশি হওয়া অনুচিত। এবং পিএইচ পরিবর্তনের মাত্রা প্রতি ঘন্টায় ০.৫ এর বেশি হওয়া অনুচিত।
চিংড়ি ঘেরের অন্যান্য কাজগুলোর মতো পোনা মজুদের কাজটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেসাথে অধিকতর স্পর্শকাতর বিধায় কাজটি অসাবধানতা বা হালকাভাবে সম্পাদন করার কোন সুযোগ নেই। আর এক্ষেত্রে ভুল করা হলে অবশ্যই মজুদকালীন পোনা মৃত্যুর হার ব্যাপকহারে বেড়ে যাবে, যা বছর শেষে উৎপাদনকেও ব্যাহত করবে। সুতরাং ঘেরের সকল কাজের পাশাপাশি মজুদ ব্যবস্থাপনার কাজটি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সম্পাদন করতে হবে যা চাষির সফল ও লাভজনক উৎপাদনে সহায়ক হবে।
পিএল অভ্যস্থকরণ: পোনা ছাড়ার পূর্বে ঘেরের পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা এবং পলিথিনের ভেতরের পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা পরীক্ষাপূর্বক পার্থক্য নির্ণয় করা অত্যন্ত জরুরি। তারপর পলিথিন ব্যাগগুলো মুখ আটকানো অবস্থায় পানিতে ভাসিয়ে দিতে হবে এবং উপর থেকে দু'হাত দিয়ে বৃষ্টির মতো করে অন্তত ১০ মিনিট পানি ছিটাতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন দুই পানির তাপমাত্রার ব্যবধান ১ থেকে ২ ডিগ্রি সে.-এর বেশি না হয়। পলিথিনের মুখ খুলে, ভাঁজ খুলে এবং মুখ খোলা অবস্থায় উপর থেকে পলিথিনগুলোর মুখে দু'হাত দিয়ে বৃষ্টির মতো করে অন্তত ৩০ মিনিট পানি ছিটাতে হবে। ধীরে ধীরে পলির ভেতরের ও বাইরের পানির অবস্থা (লবণাক্ততা, তাপমাত্রা ইত্যাদি) সমপর্যায়ে চলে আসবে এবং পোনাগুলো নতুন পানির সাথে অভ্যস্থ হয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিধায় খুবই সতর্কতার সাথে এবং একটু বেশি সময় নিয়ে করা উচিৎ।
চিত্র-২.১৮: পিএল অভ্যস্থকরণ
পানি ছিটানোর ফাঁকে ফাঁকে দু'একটি পলিথিন ব্যাগের পোনা ও পানিসহ দু'হাত দিয়ে কিছুটা উপরে উঠিয়ে পোনাগুলোর চলাচল দেখতে হবে। বেশিরভাগ পোনা পলিখিন ব্যাগের মাঝে ও উপরের স্তরে ভেসে বেড়াবে। পলির তলায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং মৃত পোনাগুলো জটলা পাকানো অবস্থার থাকবে। উন্মুক্ত পলিখিন কাজ করে তার মধ্যে কৃত্রিম স্রোতধারা দিলে স্রোতের বিপরীত দিকে পোনা বেরিয়ে আসবে। নার্সারি পুকুর আয়তনে বড় অর্থাৎ মোটামুটি ১০ শতাংশের অধিক হলে কয়েকটি স্থানে পোনা ছাড়তে হবে।
পিঞ্জল অবমুক্ত পূর্ব বিবেচ্য বিষয়: পোনার বাক্সগুলো অপেক্ষাকৃত অধিক ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হয়। সকাল থেকে দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। প্রখর রোদের মধ্যে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘেরে শোনা মজুদ না করাই ভাল। কারণ এসময়ে সাধারণত পানির তাপমাত্রা বেশি থাকে। তাছাড়া মেঘলা দিন, নিম্নচাপ বা ভ্যাপসা আবহওয়ায় পোনা ছাড়া উচিত নয়। জরুরি প্রয়োজনে এ সময়েও পোনা ছাড়া যেতে পারে যদি-
সুস্থ ও সবল পোনা চেনার উপায়
পিসিআর পরীক্ষিত পোনা বা বিশ্বস্থ হ্যাচারি থেকে ভাল পোনা মজুদ করা উচিত। কারণ বাহ্যিক দৃষ্টি দিয়ে পোনার গুণগত মান সম্পূর্ণভাবে যাচাই করা যায় না। মজুদের পূর্বে পোনার কিছু আচরণ/অবস্থা নিরীক্ষণ করুন। এই দেখার কাজে অনেকে আঁতশ কাঁচ বা ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করে। নিম্নে সবল ও দুর্বল পোনার কিছু বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা হলো-
ক্রম | সবল পোনা | দুর্বল পোনা |
---|---|---|
১ | খোলসের রং উজ্জ্বল, স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক | খোলসের রং অনুজ্জল, অস্বচ্ছ ও অস্বাভাবিক ঘোলাটে |
২ | উপাংগসমূহ দৃঢ় এবং স্বাভাবিক | উপাংগসমূহ অস্বাভাবিক, ভাংগা, অসম্পূর্ণ |
৩ | খাদ্যনালী পূর্ণ | খাদ্যনালী অপূর্ণ |
৪ | স্রোতের বিপরীতে সাতার কাটে | স্রোতের পক্ষে সাতার কাটে |
৫ | বিরক্ত করলে দ্রুত লাফ দিয়ে সরে যায় | বিরক্ত করলেও দ্রুত সরে যায় না এবং খুবই দুর্বল চলাচল |
৬ | পলিথিনের নীচে তলানীর মতো জমে থাকে না | পলিথিনের নীচে তলানীর মতো জমে থাকে |
নিম্নলিখিত কারণে পোনা শোধন করার প্রয়োজন হয় তা হলো-
ক) পোনাকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য,
খ) পোনার পরিবহণকালীন আঘাতজনিত অবস্থার উন্নতির জন্য,
গ) মজুদের পর যাতে সহজে রোগবালাইয়ে আক্রান্ত না হয়।
পোনা শোধনের উপায়সমূহ
ক. প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১ চা চামচ পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা পটাশ গুলে নিয়ে তাতে পোনাগুলোকে ৩০ সেকেন্ড ডুবিয়ে গোসল করানোর মাধ্যমে। অথবা
খ. প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০০ গ্রাম খাবার লবণ গুলে নিয়ে তাতে পোনাগুলোকে ৩০ সেকেন্ড ডুবিয়ে গোসল করানোর মাধ্যমে।
চিংড়ি পোনার পরিবহণ ঘনত্ব মূলত জাত, আকার, ওজন, তাপমাত্রা, শারীরতাত্ত্বিক অবস্থা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। সাধারণতভাবে ৩৬×২০ ইঞ্চি আকারের পলিথিন ব্যাগ, ২০-৪০ লিটার ধারণক্ষমতার হাড়ি এবং ২০০ লিটার ধারণক্ষমতার ড্রাম চিংড়ি পোনা পরিবহণে ব্যবহৃত হয়। চিংড়ি পিএল-এর (গলদা ও বাগদা) পরিবহণ ঘনত্ব সারণিতে উল্লেখ করা হলো:
সারণি : চিংড়ি পিএল-এর পরিবহণ ঘনত্ব
পরিবহণ পদ্ধতি | পরিবহণ দুরত্ব | বয়স | পরিবহণ সময় | মন্তব্য |
---|---|---|---|---|
অক্সিজেন ভর্তি পলিথিন ব্যাগ | ১০০০-১২০০টি / ব্যাগ ১৫০০-২০০০টি / ব্যাগ ২৫০০-৩০০০টি/ ব্যাগ | ১০-১৫ দিন | ১৮-২৪ ঘন্টা ১২-১৬ ঘন্টা ৫-৬ ঘন্টা | ব্যাগের ১/৩ অংশ পানি এবং ২/৩ অংশ অক্সিজেন থাকতে হবে |
সনাতন পদ্ধতি | ২৫০-৫০০টি / লিটার পানিতে | ১০-১৫ দিন | ১-১৫ ঘন্টা |
পরিবহণকালে পোনা মৃত্যুর কারণ: একাধিক কারণে পরিবহণকালে চিংড়ির পিএল মারা যেতে পারে। সাধারণত যেসব কারণে পোনার মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ নিচে বর্ণনা করা হলো :
ক) অক্সিজেন ঘাটতি: যদি অধিক ঘনত্বে পোনা পরিবহণ করা হয় তবে খুব দ্রুত পাত্রে অক্সিজেন ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ার ফলে পোনা/পিএল মারা যেতে পারে।
খ) শারীরিক ক্ষত: জাল টানা, ওজন ও গণনা করার সময় অথবা এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে স্থানান্তরের সময় চিংড়ির পিএল-এর শরীরে আঘাত লাগতে পারে, এন্টেনা ও উপাঙ্গসমূহ ভেঙে যেতে পারে। দুর্বল ও শারীরিকভাবে ক্ষত এই সমস্ত পোনা পরিবহণকালে এবং পুকুরে মজুদের পরপরই মারা যেতে পারে।
গ) অ্যামোনিয়া সৃষ্টি: পরিবহণকালে চিংড়ির পিএল বা জুভেনাইলের নিঃসৃত মলমূত্র পচনের ফলে পাত্রে অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়। যার ফলে পানি বিষাক্ত হয়ে পোনা মারা যেতে পারে।
ঘ) তাপমাত্রা: পানির তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে পোনার অক্সিজেন চাহিদা বাড়ে। কিন্তু পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে। পরিবহণকালে পাত্রের পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পোনা মারা যেতে পারে।
ঙ) পরিবহণ দুরত্ব: পরিবহণ দুরত্ব যত বেশি হবে পোনা বা পিএল-এর উপর তত বেশি চাপ পড়ে। এভাবে পোনা বা পিএল যদি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়, তবে পরিবহণকালে মৃত্যুহার স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি হয়।
চ) টেকসই না করে পোনা পরিবহণ: ধানী বা চারা পোনা টেকসই না করে পরিবহণ করলে এরা নাজুক থাকে। ফলে পরিবহণকালীন ধকল সহ্য করতে পারে না এবং অনেক পোনা মারা যায়।
ছ) রোগাক্রান্ত ও দুর্বল পোনা পরিবহণ: রোগাক্রান্ত ও দুর্বল পোনা পরিবহণ করলে মৃত্যুহার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়।
পরিবহণকালীন বিবেচ্য বিষয়সমূহ:
ক) পানির তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে চিংড়ি পোনার অক্সিজেন চাহিদা বাড়ে। তাই পরিবহণকালে পানির তাপমাত্রা কম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পাত্রের পানি ঠান্ডা রাখার জন্য প্রতি ঘন্টা পরিবহণ সময়কালে প্রতি লিটার পানিতে ১০ গ্রাম হারে বরফ মিশানোর ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।
খ) পিএল-এর আকার যত বড় হবে পরিবহণ ঘনত্ব তত কম হবে। সেই সাথে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
গ) পেটে খাবার থাকলে চিংড়ি পোনার অক্সিজেন চাহিদা বেড়ে যায়। তাছাড়া পেটে খাবার ভর্তি পোনা পরিবহণ করলে পরিবহণের সময় পোনা মলমূত্র ত্যাগ করে। ফলে বিষাক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়। সে জন্য পরিবহণের আগে টেকসইকরণ পদ্ধতিতে পোনার পেট খালি করে নিতে হবে।
ঘ) পরিবহণকালে পোনার অবস্থা খারাপ হতে পারে তা বিবেচনা করে প্রতিরোধকল্পে প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম হারে খাবার লবণ ব্যবহার করতে হবে।
ঙ) ব্যাগে যাতে কোনো প্রকার চাপ না লাগে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
চ) পরিবাহণ পাত্র ভেজা কাপড় বা চটদ্বারা ঢেকে রাখতে হবে এবং পরিবহণকালে ব্যাগ / পাতিল ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
ছ) পানি পরিবর্তনের সময় মিশ্রিত পানি এবং পাত্রের পানির তাপমাত্রা সমতায় নিয়ে আসতে হবে।
জ) একই ব্যাগ বা পাত্রে সমান আকারের পিএল পরিবহণ করতে হবে এবং পাত্রের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত পোনা পরিবহণ করা যাবে না।
ঝ) ব্যাগে যাতে কোনো শক্ত বস্তু যেমন- ধারালো টিনের টুকরা, পেরেক ইত্যাদির আঘাত না লাগে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিড়ি/ সিগারেটের আগুন থেকেও ব্যাগকে সাবধানে রাখতে হবে।
ঞ) পরিবহণের জন্য সঠিক সময় হিসেবে পরিবহণ করতে হবে যাতে করে মৃত্যুহার কোনোভাবেই বেশি না হয়।
ট) পরিবহণকালে পরিষ্কার পানি সাথে রাখা এবং বারবার পাত্রের কিনারা ধুয়ে দিতে হবে, যাতে পোনা পাত্রের গায়ে লেগে না যায়।
ঘ. পোনার মজুদোত্তর ব্যবস্থাপনা
পোনা মজুদের পর পুকুরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা চিংড়ি উৎপাদনের পূর্বশর্ত। পোনা মজুদোত্তর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া চিংড়ির কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন সম্ভব নয়। পোনা মজুদের পর উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমগুলো হলো-
১. পোনা/ পিএল-এর বাচাঁর হার পর্যবেক্ষণ
পুকুরে মজুদের পর বিভিন্ন কারণে আংশিক বা সম্পূর্ণ মজুদকৃত পোনা বা পিএল মারা যেতে পারে। সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- পরিবহণজনিত ত্রুটি, শারীরিক আঘাত, পানির বিষক্রিয়া এবং হঠাৎ করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। এসব কারণে পোনা/ পিএল ছাড়ার পর মজুদকৃত পোনা বা পিএল এর বাঁচার হার পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
পোনা বাঁচার হার পর্যবেক্ষণ করার উপায়: মরা পোনা পানির উপর ভেসে উঠে। তাই মরা পোনা পাড়ের কাছাকাছি দেখা যায় কিনা তা খুব ভালভাবে লক্ষ্য করতে হবে। মরা পোনা পানি থেকে উঠিয়ে গণনার পর আবার সমপরিমাণ পোনা ছাড়তে হবে।
২. চিংড়ি চাষে পানি ব্যবস্থাপনা
যে কোনো জলজ উদ্ভিদ কিংবা প্রাণী সার্থকভাবে চাষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পানির কোনো বিকল্প নেই। অথচ সেই পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই চিংড়ি চাষের প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশে বর্তমানে উন্নত প্রচলিত পদ্ধতিতে বেশিরভাগ ঘেরে চিংড়ি চাষের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এই পদ্ধতিতে খুব কম ঘেরেই খাদ্য ব্যবহার করা হয়। বেশিরভাগ ঘেরেই প্রাকৃতিক উৎপাদন/উৎপাদনশীলতার উপরই চিংড়ির উৎপাদন নির্ভর করে। ঘেরের প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চিংড়ি চাষের জন্য অবশ্যই ঘেরের পানি ব্যবস্থাপনার ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
চিংড়ির চলাফেরার জন্য, চিংড়ির নিঃশ্বাস গ্রহণের জন্য, চিংড়ির প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য এবং চিংড়িকে রোগবালাই হতে মুক্ত রাখার জন্য পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। নিচে বিভিন্ন বিষয়ে পানি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তাসমূহ হলো-
ক. চলাচলের জন্য পানি ব্যবস্থপনা
বেশিরভাগ উপকূলীয় ঘেরের তলদেশ অসমতল হওয়ায় ঘেরের সর্বত্র সমানভাবে পানি থাকে না। এমনকি কোনো কোনো ঘেরে দুই পাড়ের মাঝামাঝি ঘেরের প্রায় ৩০-৪০ ভাগ এলাকায় কোনো পানিই থাকে না। পানির গভীরতা কম ও স্বচ্ছতা বেশি থাকার ফলে ঘেরের তলদেশ পর্যন্ত সূর্যালাকে পৌছায়। ফলে, নানা ধরনের উচ্চতর জলজ উদ্ভিদ (নাজাজ, কারা ইত্যাদি) জন্মে চিংড়ির চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। এসব বিষয়সমূহ বিবেচনা করলে অনেক সময় দেখা যায় যে, ঘেরের অধিকাংশ এলাকা চাষের আওতার বাইরে থাকে। ফলে, চিংড়ির উৎপাদনের হারও অনেক কম হয়। এতএব ঘেরের সম্পূর্ণ এলাকা চাষযোগ্য করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হয়-
ক) ঘেরের সর্বত্র যাতে সমান গভীরতায় পানি রাখা যায় সেভাবে ঘের প্রস্তুত করতে হবে।
খ) ঘেরের পানির গভীরতা প্রায় এক মিটার এবং পানির স্বচ্ছতা ২৫-৩৫ সেমি এর মধ্যে রাখতে হবে, যেন ঘেরের তলায় সূর্যালাকে না পৌঁছায়।
গ) ঘেরে জন্মানো যে কোনো উচ্চতর উদ্ভিদ পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
খ. নিঃশ্বাস গ্রহণের জন্য পানি ব্যবস্থাপনা
চিংড়ির স্বাভাবিক শ্বাস গ্রহণের জন্য পানিতে ৪ পিপিএম এর বেশি দ্রবীভূত অক্সিজেনের প্রয়োজন। অক্সিজেন এক ধরনের গ্যাস। পানিতে অক্সিজেন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় গ্যাস, যথা: কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি দ্রবীভূত থাকে। অপ্রয়োজনীয় গ্যাসমূহের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে মজুদকৃত চিংড়ি মারা যেতে পারে। পানির গ্যাস ধারণের একটি নির্দিষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। যদি কোন কারণে অপ্রয়োজনীয় গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনীয় গ্যাসের পরিমাণ কমে যাবে। চিংড়ি চাষের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় গ্যাসের সহনীয় মাত্রা নিচের সারণিতে দেয়া হলো:
সারণি: পানিতে দ্রবীভুত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় গ্যাসের সহনীয় মাত্রা
ক্রমিক | গ্যাসের নাম | সহনীয় মাত্রা | মন্তব্য |
---|---|---|---|
০১ | দ্রবীভূত অক্সিজেন | ৫-১০ পিপিএম | ৪ পিপিএম-এর কম নয় |
০২ | কার্বন-ডাই-অক্সাইড | <৬.০ পিপিএম | পিএইচ কম হলে পরিমাণ বেড়ে যায় |
০৩ | হাইড্রোজেন সালফাইড | <০.০৩ পিপিএম | কম পিএইচ এ অধিক ক্ষতিকর |
০৪ | অ্যামোনিয়া | <০.০১ পিপিএম | উচ্চ পিএইচ এবং তাপমাত্রা অধিক ক্ষতিকর |
পানিতে অপ্রয়োজনীয় গ্যাস-এর মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণসমূহ হলো-
ক) পানিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে,
খ) পানিতে অক্সিজেন এর উৎপাদন / পরিমাণ কমে গেলে,
গ) চিংড়ির অতিরিক্ত খোসা পাল্টানোর কারণে, এবং
ঘ) ঘেরের তলায় কাদার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে ।
জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণসমূহ হলো-
ক) অতিরিক্ত জৈব সার ব্যবহারের ফলে,
খ) চিংড়িকে অপরিমিত সম্পুরক খাবার সরবরাহ করলে, এবং
গ) কোনো কারণে পানির সব প্লাংকটন হঠাৎ মরে গেলে।
পানিতে অপ্রয়োজনীয় গ্যাস ও জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে করণীয়-
ক) চিংড়ি ঘেরের পানিতে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে জৈব সার প্রয়োগ না করা;
খ) ঘেরে খাবারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দেয়া। কারণ অপরিমিত সম্পূরক খাবার ব্যবহারে যেমন আর্থিক ক্ষতি হয় তেমনি ঘেরের পানি দূষিত হয়;
গ) ঘেরে প্লাংকটন উৎপাদনের সহনশীল মাত্রা বজায় রাখা;
ঘ) পানিতে প্যাডেল হুইল অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা; এবং
ঙ) অমাবশ্যা ও পূর্ণিমায় যথারীতি পানি পরিবর্তন করা।
গ. প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পানি ব্যবস্থাপনা
জলাশয়ের প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বলতে পানিতে সাধারণত ফাইটোপ্লাংকটন-এর উৎপাদনের হারকে বুঝায়। ফাইটোপ্লাংকটন শুধু পানিতে প্রাথমিক খাদ্যের যোগান দেয় না, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চিংড়ির শ্বাস গ্রহণ ও অন্যান্য প্রয়োজনে পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং ক্ষতিকর গ্যাসসমূহের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। পার্যপ্ত ফাইটোপ্লাংকটনের উপস্থিতি মাটির তলায় জন্মানো ক্ষতিকর উদ্ভিদ জন্মাতে বাধা সৃষ্টি করে এবং পানিতে দ্রবীভূত অতিরিক্ত নাইট্রোজেন ও ফসফরাস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে পানিকে দূষণমুক্ত রাখে। এক কথায় চিংড়ির সঠিক উৎপাদনের জন্য পানির প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা সহনশীল পর্যায়ে থাকা বিশেষ প্রয়োজন। প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলি প্রয়োজনীয় মাত্রায় থাকা প্রয়োজন। এছাড়া পানিতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশসহ বিভিন্ন খাদ্যোপাদানের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। চিংড়ি খামারের পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলি ও তার সহনীয় মাত্রা নিচের সারণিতে উল্লেখ করা হলোঃ
সারণি: পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলি ও তার সহনীয় মাত্রা
ক্রম | গুণাবলী | সহনীয় মাত্ৰা |
---|---|---|
০১ | তাপমাত্রা | ২৮-৩২ ডিগ্রী সে., |
০২ | লবণাক্ততা | ১০-৩০ পিপিটি |
০৩ | রং | সবুজ, হলদে সবুজ অথবা বাদামি |
০৪ | গভীরতা | > ১০০ সে.মি. |
০৫ | স্বচ্ছতা | ৩০-৪০ সে.মি. |
০৬ | পিএইচ | ৭.৫-৮.৫ |
০৭ | অ্যালকালিনিটি | ৮০-২০০ পিপিএম |
০৮ | নাইট্রেট | ৮০-২০০ পিপিএম |
০৯ | ফসফেট | ০.১০ ০.২০ পিপিএম |
তাপমাত্রা ও লবণাক্ততাঃ পানির তাপমাত্রার হঠাৎ হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে চিংড়ির বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত হতে পারে, এমনকি চিংড়ি মারাও যেতে পারে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘেরসমূহে পানির গভীরতা কম থাকার ফলে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে অতিরিক্ত সূর্যতাপ কিংবা হঠাৎ বৃষ্টিপাতের ফলে পানির তাপমাত্রা অস্বাভাবিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তাপমাত্রার পরিবর্তনের ন্যায় লবণাক্ততার পরিবর্তনের ফলে চিংড়ির তেমন কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। তবে হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে লবণাক্ততা এবং তাপমাত্রা উভয়েরই অস্বাভাবিক হ্রাস চিংড়ির ক্ষতির কারণ হতে পারে। পানির গভীরতা প্রায় ১ মিটার রাখা সম্ভব হলে এ ধরনের পরিবর্তনে চিংড়ির তেমন কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না ।
রং ও স্বচ্ছতা: সাধারণত পানিতে ফাইটোপ্লাংকটনের রঙের উপর পানির রং নির্ভর করে। ফাইটোপ্লাংকটনের রং কম লবণাক্ত পানিতে সবুজ অথবা হলদে সবুজ থাকে এবং অধিক লবণাক্ত পানিতে বাদামি হয়। ফাইটোপ্লাংকটনের ঘনত্ব যত বেশি হবে পানির স্বচ্ছতাও সেই হারে কমে যাবে। কাজেই পানির স্বাভাবিক গুণাগুণ ধরে রাখার জন্য পানির রং ও স্বচ্ছতার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
পিএইচ ও অ্যালকালিনিটি: পানিতে পিএইচ-এর গুরুত্ব এত বেশি যে এক কথায় পিএইচ কে পানির পালস হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। আর পানিতে প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতার যে সুপ্ত ক্ষমতা বিদ্যমান তা নির্ভর করে পানির অ্যালকালিনিটির উপর। চিংড়ির ভালো উৎপাদনের জন্য পানির এই দু'টি গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি সঠিক মাত্রায় রাখার জন্য সর্বদা সচেষ্ট দৃষ্টি দিতে হবে। কোনো কারণে পিএইচ ও অ্যালকালিনিটি কমে গেলে চুন ব্যবহারের মাধ্যমে তা বাড়ানো যেতে পারে। ঘেরে চিংড়ি থাকা অবস্থায় কৃষিজ চুন বা ডলো চুন ব্যবহার করা নিরাপদ।
পাথুরে কিংবা কলি চুন ব্যবহারের প্রয়োজন হলে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। পিএইচ-এর মান যদি ৭.৫ এর নিচে নেমে আসে কিংবা সকাল ও বিকালের পিএইচ-এর তারতম্য ০.৫ এর বেশি হয়, তাহলে অবশ্যই পানিতে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। এমতাবস্থায় একর প্রতি ৪০- ৫ কেজি (শতকে ০.৪-০.৫ কেজি) ডলো চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। চুন প্রয়োগের ফলে পিএইচ-এর সাথে সাথে অ্যালকালিনিটিও বৃদ্ধি পাবে। যদি কোনো কারণে পিএইচ বেড়ে ৯.০ এর অধিক হয়ে যায় তাহলে পানি পরিবর্তন করে পিএইচ কমাতে হবে। বৃষ্টির পানি অল্প, তাই অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ফলে পানির পিএইচ কমে যেতে পারে। সেজন্য বৃষ্টির পর পরই ঘেরে ডলো চুন প্রয়োগ করতে হবে।
খাদ্যোপাদান: পানির প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা তথা ফাইটোপ্লাংকটনের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পানিতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশসহ বিভিন্ন খাদ্যোপাদানের উপস্তিতি নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। এসব উপাদান সরবরাহের জন্য পানিতে সার প্রয়োগ অপরিহার্য। চিংড়ি চাষের জন্য ঘের প্রস্তুত করার সময় পানিতে একর প্রতি ২০-২৫ কেজি (শতকে ২০০-২৫০ গ্রাম) ইউরিয়া ও একর প্রতি ৩০-৩৫ কেজি (শতকে ৩০০-৩৫০ গ্রাম) টিএসপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। চিংড়ি পোনা মুজদ পরবর্তী প্রত্যেক মাসে একর প্রতি ১০-১২ কেজি (শতকে ২০০-৩০০ গ্রাম) পটাশ সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। যদি চিংড়িকে সম্পুরক খাবার সরবরাহ করা হয়, তাহলে প্রথম দুই মাস পর সাধারণত সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না।
ঘ. প্লাংকটন মৃত্যু ও তার প্রতিকার
পানিতে কোনো খাদ্যোপাদান কিংবা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের অভাব হলে বেশিরভাগ প্লাংকটন মারা যেতে পারে। প্লাংকটনের এই অস্বাভাবিক মারা যাওয়াকে প্লাংকটন ক্রাসও বলা হয়। এমতাবস্থায় পানি একেবারে স্বচ্ছ হয়ে যায়, পানিতে ফোম হয় এবং দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ দ্রুত কমে গিয়ে চিংড়ির জন্য সংকটময় অবস্থার সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় দ্রুত পানি পরিবর্তন এবং পানিতে কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। প্লাংকটন ক্রাস প্রতিরোধকল্পে পানিতে নিয়মানুযায়ী চুন ও সার ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে।
ঙ. রোগ প্রতিরোধে পানি ব্যবস্থাপনা
যেকোনো পানিতেই চিংড়ির রোগের জীবাণু বিদ্যমান থাকে। উপযুক্ত পরিবেশ এবং চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেই কেবলমাত্র রোগ জীবাণু চিংড়িকে আক্রমণ করতে সক্ষম হয়। যে পরিবেশ চিংড়ির বসবাসের জন্য অসহনশীল, সেই পরিবেশেই রোগ জীবাণুর বংশ বৃদ্ধি বেশি হয় এবং চিংড়িকে আক্রমণ করতে সহায়ক হয়। চিংড়ির চলাফেরা কোনো কারণে অস্বাভাবিক কিংবা চিংড়িকে রোগাক্রান্ত মনে হলে তাৎক্ষণিকভাবে পানির পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন ও অ্যালকালিনিটি পরীক্ষা করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। পানি পরিবর্তনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রবেশকৃত পানির গুণগতমান সহনীয় পর্যায়ে থাকে। উন্নত পদ্ধতির চিংড়ি চাষে জলাধারে পানি পরিশোধনপূর্বক ঘেরে সরবরাহ করা যেতে পারে। পানি পরিশোধনের জন্য ২০-২৫ পিপিএম হারে ব্লিচিং পাউডার ট্রিটমেন্ট করা যেতে পারে। রোগ প্রতিরোধের জন্য পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলি সহনশীল মাত্রায় বজায় রাখতে হবে।
চ. পানির গুণাগুণ সংরক্ষণে পানি ব্যবস্থাপনা
পানির গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় বজায় রাখা চিংড়ি চাষের সফলতার ক্ষেত্রে অন্যতম মূল চাবিকাঠি। সাধারণত পানি ব্যবস্থাপনা তথা পানির গুণাগুণ বজায় রাখার প্রধান কারণ হচ্ছে চিংড়ির বেঁচে থাকার হার বাড়ানো এবং স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি। পুকুরের পানির ভালো অবস্থা বলতে সাধারণত পানিতে পরিমিত অক্সিজেন ও অত্যন্ত কম বর্জ্যের উপস্থিতিকে বুঝায়। এই বর্জ্যের উৎস হচ্ছে চিংড়ির মল, অভুক্ত খাদ্য, শেওলা এবং অন্যান্য অনুবীক্ষণিক জীব। চিংড়ি চাষকালে প্রথম তৃতীয় মাস পর্যন্ত খাদ্যের প্রায় ৩০% এবং চতুর্থ মাস বা শেষ পর্যায়ে প্রায় ৫০% বর্জ্য হিসেবে পুকুরের তলায় জমা হয়। এর ফলে ক্ষতিকর শেওলার উৎপাদন ত্বরান্বিত হয় এবং একটা পর্যায়ে এসব ক্ষতিকর শেওলা মারা গিয়ে পানি দূষিত করে। ফলে চিংড়ির স্বাভাবিক জীবনযাপন এবং দৈহিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই পানির গুণগতমান বজায় রাখার উত্তম পদ্ধতি হলো নিয়মিতভাবে পুকুরের পানি পরিবর্তন করা। এর ফলে পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ বজায় থাকে, বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ, অতিরিক্ত শেওলা ইত্যাদি দূরীভূত হয় এবং নতুন পানির সাথে নতুন পুষ্টিকর পদার্থসমূহ পুকুরে সঞ্চালিত হয়। চিংড়ির পোনা মজুদের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত কোনো পানি পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয় না। তবে প্রথম মাসে অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার সময় একবার বা দুবার পানি পরিবর্তন করা ভাল। চিংড়ি চাষের পুরো সময়ে পোনা মজুদের ঘনত্ব, পানির গুণগতমান, লবণাক্ততা, প্লাংকটনের ঘনত্ব, দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, রোগের প্রাদুর্ভাব, খাদ্য প্রয়োগের পদ্ধতি ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে পানি পরিবর্তনের মোট পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত প্রত্যেকবার পানি পরিবর্তনের সময় মোট পানির ২০-৫০% পরিমাণ পরিবর্তন করা হয়। অনেক সময় প্রয়োজনানুসারে প্রতিদিন ১০% পানি পরিবর্তন করা হয় এবং নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে সাধারণত প্রতিদিনই ৩০% পানি পরিবর্তন করা হয়। পুকুরে চিংড়ির দেহের ওজন অনুসারে কী পরিমাণ পানি পরিবর্তন করা উচিত তার তালিকা নিচের সারণিতে দেয়া হল-
সারণি: চিংড়ির মোট ওজন অনুসারে পানি পরিবর্তন হার
প্রচলিত চাষ পদ্ধতিতে ভাটার সময় প্রয়োজনে পুকুরের অর্ধেক পানি বের করে দিয়ে জোয়ারের সময় পানি ঢুকানো হয়। সাধারণত জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে মাত্র ৫-৬ দিনে ৫০-১০০% পানি পরিবর্তন করা সম্ভব। আধা-নিবিড় বা নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে পানি পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন রকমের পাম্প ব্যবহার করা হয় এবং জোয়ারের পানির ওপর কম নির্ভর করা হয়। আধা নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে জোয়ারের সময় স্বাভাবিকভাবে পানি পরিবর্তন করা হয় তবে ভাটার সময় প্রয়োজনে পাম্প ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে পানি দুভাবে পরিবর্তন করা যায়। প্রথম পদ্ধতিতে প্রয়োজন মত কিছুটা পানি বের করে দেয়া হয়। এবং পরে সেই পরিমাণ পানি ঢুকানো হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে পুকুর/ ঘেরের একদিক দিয়ে পানি প্রবেশ করানো হয় এবং অপরদিক দিয়ে পানি নিষ্কাশন করা হয়। অধিক বৃষ্টিপাতের সময় পানি পরিবর্তন না করে পানি নিষ্কাশন গেটের মুখে ফল বোর্ড স্থাপন করে পুকুরের ওপরের স্তরের পানি বের করে দেয়া উত্তম। এতে লবণাক্ততা হ্রাসের ঝুঁকি কমে যায়। সাধারণত পুকুর/ ঘেরে নিম্নবর্ণিত অবস্থাদি পরিলক্ষিত হলে পানি পরিবর্তন করার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
ক) সকাল (৬-৭টা) ও বিকাল (৩-৪টা) এই দুই সময়ে পর্যবেক্ষণকৃত পিএইচের পার্থক্য ০.৫ থেকে অধিক বা পিএইচের মান ৮.৫ এর বেশি অথবা ৭.৫ এর কম হলে।
খ) পানির স্বচ্ছতা ৮০ সেমি (৩২ ইঞ্চি) এর বেশি অথবা ৩ সেমি এর কম হলে।
গ) পানি অত্যধিক ভারী ও গাঢ় হয়ে গেলে
ঘ) পানিতে অজৈব কণার পরিমাণ অধিক প্রতীয়মান হলে।
ঙ) পানির উপরিভাগে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী বুদবুদ দেখা গেলে।
চ) পানিতে জ-আয়োনিত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গেলে
ছ) এ্যারেটর চালানো অবস্থায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কম হলে।
চিত্র-৩.১৯: চিংড়ি ঘেরের পানির উৎস
ছ. পানির গুণাগুন সংরক্ষ
পানির গুণাগুণ রক্ষার জন্য প্রধানত তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেন, পানির লবণাক্ততা, অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট, নাইট্রেট, খরতা ও ক্ষারত্ব, পিএইচ, হাইড্রোজেন সালফাইড প্রভৃতির ওপর বিশেষ নজর রাখা হয়। পানিতে এসব প্রয়োজনীয় গুণাগুণ না থাকলে চিংড়ির বৃদ্ধি ও বাঁচার হার কমে যায়।
তাপমাত্রা: সাধারণত তাপমাত্রা সমস্ত প্রাণীর জৈব-বিপাকক্রিয়ায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ১৭ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে চিংড়ির বিপাকীয় কার্যক্রম প্রায় ১০% বৃদ্ধি হয়। একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জৈব ও রাসায়নিক ক্রিয়া যেমন বাড়ে ঠিক তেমনি তাপমাত্রা কম হলে সমস্ত ক্রিয়া কমে যায়। এই জন্য দেখা যার ২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার চেয়ে ৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় জলজ প্রাণীসমূহের অক্সিজেন চাহিদা, খাদ্যের চাহিদা, দৈহিক বৃদ্ধির হার ইত্যাদি প্রায় দ্বিগুণ দ্রুততার সাথে বেড়ে যায়। বাগদা চিংড়ির উৎপাদনদের জন্য ২৫-৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা উত্তম। ২৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার নিচে চিংড়ির বৃদ্ধির হার কমতে থাকে এবং ২০ ডিগ্রি সে. এর নিচে প্রায় থেমে যায়। পানির তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সে. এর নিচে এবং ৩৪ ডিগ্রি সে. এর উপরে হলে চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা দিতে পারে।
তাপমাত্রা অত্যধিক হলে খাদ্য ও সার প্রয়োগ প্রয়োজন মত কম বা বেশি অথবা বন্ধ করে দিতে হবে এবং প্রয়োজন অনুসারে পানি পরিবর্তন করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সনাতন ও হালকা উন্নত পদ্ধতির চিংড়ি চাষের পুকুরে পানির গভীরতা ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। ফলে এ সমস্ত খামারে গরমের সময় পানির তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় চিংড়ির আশ্রয়ের জন্য খামারের ভিতরের পার্শ্বে চারদিকে বা কোণাকুণিভাবে নালা থাকা প্রয়োজন। এছাড়া প্রয়োজনমত পানি পরিবর্তন করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। নার্সারিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ৪-৬% এলাকাতে কচুরিপানা দেয়া যেতে পারে।
দ্রবীভূত অক্সিজেন: চিংড়ি চাষের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাগদা চিংড়ির অক্সিজেন চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি। চিংড়ি চাষের পুকুরে ৫-৭ পিপিএম অক্সিজেন থাকা উত্তম। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ২.৫ পিপিএম এর নিচে নামলে চিংড়ি মারা যেতে শুরু করে এবং ১ পিপিএম এর কম হলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সমস্ত চিংড়ি মারা যাবে। পানিতে অক্সিজেন দ্রবীভূত হওয়ার পরিমাণ নির্ভর করে পানির তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও বায়ুচাপের ওপর। সাধারণত তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে পানিতে অক্সিজেন ঘাটতি তিন ভাবে হয়ে থাকে, যথা- রাত্রিকালে উদ্ভিদের শ্বাস গ্রহণ, প্রাণিকুলের শ্বাস গ্রহণ এবং পচনশীল জৈব পদার্থের পচন। অক্সিজেন হ্রাসের কারণে চিংড়ির দৈহিক ক্লেশ, ক্ষুদামন্দা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস এবং দৈহিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে থাকে। পুকুরে অক্সিজেন হ্রাসের লক্ষণসমূহ হলো:
১) পানির উপর সরের মত বুদবুদ জমা হয়।
২) পুকুরের তলা থেকে বুদবুদের আকারে গ্যাস ভেসে উঠে।
৩) অধিকাংশ শামুক ও ঝিনুক পুকুরের কিনারায় চলে আসে।
৪) সমস্ত চিংড়ি সাঁতার কাটতে থাকে।
৫) মিশ্রচাষের পুকুর হলে মরা মাছের মুখ হা করা থাকবে ও ফুলকা ফেটে যাবে।
৬) সাধারণত মেঘলা দিনে, খুব গরম পড়লে এবং মধ্যরাত থেকে ভোরবেলা পর্যন্ত পুকুরে অক্সিজেনের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়।
পানিতে সবুজ উদ্ভিদ কণার (ফাইটোপ্লাংকটন) উপস্থিতিতে সূর্যালোকের প্রভাবে সালোকসংশ্লেষণ ঘটে থাকে। এই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার সময় ফাইটোপ্লাংকটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে থাকে। রাতের বেলায় যখন সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে তখন এরা অক্সিজেন গ্রহণ করে ও কার্বন-ডাই-অক্সসাইড ত্যাগ করে থাকে। তাই যেসব পুকুরে ফাইটোপ্লাংকটনের আধিক্য বেশি থাকে সে সব পুকুরে সাধারণত বিকেল বেলায় অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে এবং ভোর বেলায় অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। ফাইটোপ্লাংকটন সমৃদ্ধ পকুরের উপরিভাগে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে এবং তলদেশে কম থাকে। তবে নিম্নোক্ত উপায়ে পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে -
ক) পানিতে ঢেউ এর সৃষ্টি করে, যেমন- সাঁতার কাটা, বাঁশ পেটানো ইত্যাদি।
খ) পুকুরে নতুন পানি সরবরাহ করে অর্থাৎ পানি পরিবর্তন করে।
গ) কৃত্রিমভাবে বায়ু সঞ্চালন করে। যেমন- এ্যারেটর বা প্যাডেল হুইল স্থাপন করে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়। পানিতে স্তর সৃষ্টি রোধে, বর্জ্য পদার্থ বের করা এবং অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে এ্যারেটর অত্যন্ত কার্যকর ভুমিকা পালন করে থাকে। পুকুরের চারদিকে ৪টি এ্যারেটর ব্যবহার করলে বর্জ্য পদার্থ ঠিকভাবে এক জায়গায় জমা হতে পারে। সবগুলো এ্যারেটর এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে সব এ্যারেটর একই দিকে ঘুরে। পুকুর পাড় থেকে এ্যারেটর ৫-১০ মিটার দূরে এবং একটি থেকে অন্যটি ৩০-৩৫ মিটার দূরে স্থাপন করতে হবে।
পানির লবণাক্ততা: বাগদা চিংড়ি প্রায় শূন্য থেকে ৭০ পিপিটি লবণাক্ততায় বেঁচে থাকতে পারে। তবে ১০-২৫ পিপিটি লবণাক্ততায় এদের দৈহিক বৃদ্ধি ভালো হয়। পানির লবণাক্ততা ২৫ পিপিটির বেশি হলে মিঠা পানি সরবরাহ করে পানির লবণাক্ততা কমাতে হবে। রিফ্লাক্টোমিটার বা স্যালাইনোমিটারের সাহায্যে পানির লবণাক্ততা পরিমাপ করা যায়।
অ্যামোনিয়া: সাধারণত পুকুরের তলদেশে পুঞ্জিভূত জৈব পদার্থের পচন ও জলজ প্রাণীর বিপাকীয় ক্রিয়ায় অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে। আধা-নিবিড় ও নিবিড় চাষের পুকুরে সাধারণত হঠাৎ করে ব্যাপক হারে ফাইটোপ্লাংকটনের মড়ক ও অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা পচনের কারণে অ-আয়নিত অ্যামোনিয়া উৎপাদিত হয়। আয়োনিত (NH4) ও অনায়নিত (NH) অবস্থায় অ্যামোনিয়া পানিতে বিদ্যমান থাকে। অনায়নি অ্যামোনিয়া চিংড়ির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পুকুরের পানিতে অনায়নিত অ্যামোনিয়ার মাত্র ০.০২৫ মিগ্রা/ লিটার এর কম থাকতে হবে যা চিংড়ির জন্য সহনীয়। এতে উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। পানিতে অনায়নিত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ০.১ পিপিএম এর বেশি হলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ০.৪৫ পিপিএম এর বেশি হলে বৃদ্ধির হার অর্ধেকে নেমে আসে।
সাধারণত পানির পিএইচ বৃদ্ধির সাথে সাথে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এজন্য পানির পিএইচ ৮.৫ এর বেশি হওয়া উচিত নয়। অ্যামোনিয়ার বৃদ্ধি পিএইচ-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ফলে বিকাল বেলা পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেশি থাকে এবং ভোর বেলায় কম থাকে। পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের জন্য চিংড়ির মজুদ ঘনত্ব হ্রাস এবং অত্যধিক সার ও খাদ্য প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ করতে হবে।
নাইট্রাইট (NO2): নাইট্রাইট হচ্ছে অ্যামোনিয়া ও নাইট্রেটের মধ্যবর্তী যৌগ। অনেক সময় এই যৌগ চিংড়ির ব্যাপক মড়ক ও দৈহিক হার হ্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নাইট্রাইটজনিত কারণে চিংড়ি খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। নাইট্রাইটের মাত্র ০.১ পিপিএম এর নিচে থাকা চিংড়ির জন্য নিরাপদ। তবে সাগরের পানিতে নাইট্রাইট কম বিষাক্ত। চিংড়ির ঘনত্ব হ্রাস ও পানি পরিবর্তন করে জিওলাইট এবং চরম বিপর্যয়ের সময় ৩.৩ কেজি/ শতাংশ/৩০ সেমি পানির গভীরতায় লবণ প্রয়োগ করে নাইট্রাইটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।।
নাইট্রেট (NO3): পানিতে নাইট্রেটের মাত্রা ২০ পিপিএম এর নিচে রাখা চিংড়ির জন্য উত্তম। নাইট্রেট চিংড়ির জন্য তেমন একটা বিষাক্ত নয়, বরং শেওলার জন্য একটি পুষ্টিকর উপাদান।
খরতা ও ক্ষারত্ব: পানিতে দ্রবীভূত বাইকার্বনেট ও কার্বনেট এর ঘনত্বই হলো ক্ষারত্ব। বাই-কার্বনেট ও কার্বনেট অন্য কতকগুলো উপাদানের সাথে একত্রে মিলিত আকারে থাকে। উপাদানগুলোর মধ্যে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম অন্যতম। ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম-এর ঘনত্বকে খরতা বলে। খরতা ও ক্ষারত্বের মান হ্রাস-বৃদ্ধি হলে পানির বাফারিং ক্ষমতা কমে যায় এবং পানির পিএইচ দ্রুত উঠানামা করে। এর হ্রাস বৃদ্ধির ফলে পুকুরে সার দিলে তা কার্যকর হয় না এবং চিংড়ির খোলস বদলানো বাধাপ্রাপ্ত হয়। খরতা ও ক্ষারত্বের মান ৪০-২০০ মিগ্রা/ লিটার হলে চিংড়ির জন্য ভালো। পুকুরের পানি পরিবর্তন করে এবং চুন বা জিপসাম প্রয়োগ করে পানির খরতা ও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
পিএইচ: চিংড়ির জন্য পানির পিএইচ ৭.৫-৮.৫ হওয়াই উত্তম। পানির পিএইচ মান ৫. পিপিএম এর কম হলে এবং ৯.৫ পিপিএম এর বেশি হলে চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর। সাধারণত খামারে পানির পিএইচ-এর উপস্থিতির মাত্রা ফাইটোপ্লাংকটন, অব্যবহৃত খাদ্যের চর্বি ও ময়লা-আবর্জনা দ্বারা প্রভাবিত হয়। দিনের বেলায় ফাইটোপ্লাংকটন আলোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করার ফলে ভোর বেলা পিএইচ কমে যায়। পিএইচ এর দ্রুত উঠানামা চিংড়ির জন্য মোটেও ভালো নয়। পানির পিএইচ কমে গেলে চিংড়ির উপর নিম্নোক্ত প্রভাবগুলো পরিলক্ষিত হয়-
ক) চিংড়ির দেহ থেকে সোডিয়াম ও ক্লোরাইড বেরিয়ে যায়, ফলে চিংড়ি দুর্বল হয়ে মারা যায়
খ) চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং খাবারে অরুচি ভাব দেখা দেয়।
গ) পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
পানির পিএইচ বেড়ে গেল চিংড়ির উপর নিম্নোক্ত প্রভাব পরিলক্ষিত হয়-
ক) চিংড়ির দেহ থেকে সোডিয়াম ও ক্লোরাইড বেরিয়ে যায়, ফলে চিংড়ি দুর্বল হয়ে মারা যায়।
খ) চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং খাবারে অরুচি ভাব দেখা দেয়।
গ) পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
ঘ) চিংড়ির ফুলকা ও চোখ নষ্ট হয়ে যায়।
ঙ) অভিস্রবণ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
চ) চিংড়ি খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়।
চুন ও জিপসাম প্রয়োগ করে পানির পিএইচ বাড়ানো যায় এবং অ্যামোনিয়াম সালফেট (১ কেজি/ শতাংশ) অথবা তুঁতে (৬-১২ গ্রাম/ শতাংশ/ ৩০ সেমি গভীরতা) প্রয়োগ করে পানির পিএইচ কমানো যায়।
হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S): সাধারণত পচনশীল জৈব পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়া ও অক্সিজেনের ঘাটতির ফলে পুকুরের তলদেশের মাটিতে পচা ডিমের গন্ধের অনুরপ গন্ধ পাওয়া যায় এবং মাটির উপরিভাগে কালো আবরণের সৃষ্টি হয়। পানিতে হাইড্রোজেন সালফাইডের মাত্রা ০.১-০.২ পিপিএম হলে চিংড়ি শরীরের ভারসাম্য হারায় ও খাদ্য গ্রহণে অনীহাভাব দেখায়, ফলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে। হাইড্রোজেন সালফাইডের মাত্রা ১ পিপিএম-এর বেশি হলে চিংড়ির মড়ক আরম্ভ হয়। পুকুরে অক্সিজেন বৃদ্ধি, সার ও খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা হ্রাস ও পিএইচ এর মাত্রা বৃদ্ধি করে হাইড্রোজেন সালফাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পুকুরের পানি পরিবর্তনের মাধ্যমেও হাইড্রোজেন সালফাইডজনিত সমস্যা সমাধান করা যায়।
জ. সার প্রয়োগ পদ্ধতি
সেক্কি ডিস্ক রিডিং নিয়ে সারের প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় করতে হবে। সেক্কি ডিস্ক ১২ ইঞ্চি পানিতে রাখার পর যদি সেক্কি ডিস্ক এর সাদা-কালো অংশ পরিষ্কার দেখা যায়, তবে শতাংশ প্রতি ৮০-১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০-৩০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। এ মাত্রায় সার প্রয়োগের ৫-৬ দিনের মধ্যে সেরি ডিস্ক-এর দৃশ্যমানতা না কমলে উপরোক্ত মাত্রার অর্ধেক পরিমাণ সার আবার প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত এই পদ্ধতিতে চাষের ক্ষেত্রে প্রতি ২ সপ্তাহ অন্তর অন্তর অর্থাৎ প্রতি পুর্ণিমা ও অমাবশ্যার সময় পানি পরিবর্তনের পর সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। অজৈব সার ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হয়। জৈব সার পানিতে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হয়। তাছাড়া জৈব ও অজৈব সার একসাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায়।
৫. চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা
চিংড়ির নিয়মিত নমুনায়ন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সর্বোপরি পর্যবেক্ষণ খুব জরুরি। প্রতি ১৫ দিন অন্তর চিংড়ি ধরে নমুনায়ন ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সে সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সারণি : চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা পদ্ধতি এবং করণীয়
ক্রম | পর্যবেক্ষণ | করণীয় |
---|---|---|
০১ | শিরায়/ পেটে খাবার আছে কি না | খাবার না থাকলে, কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং প্রয়োজনে খাবার প্রদান বৃদ্ধি করতে হবে। |
০২ | খোলসের উপর সাদা চাকা চাকা দাগ আছে কিনা | চিংড়ির ভাইরাস হলো কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে এবং প্রয়োজনে চিংড়ি আহরণের উদ্যোগ নিতে হবে। |
০৩ | ফুলকা কালো হয়ে গেছে কিনা | চিংড়ি আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলে, ঘেরে হররা / পালা টেনে দিতে হবে এবং স্বল্প মাত্রায় চুন প্রয়োগে করতে হবে। |
০৪ | লেজ ফোলা এবং তাতে পানি জমা হয়েছে কিনা | চিংড়ি আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলে, বিঘা প্রতি ১.৫ কেজি হিসেবে পটাসিয়াম-পার-ম্যাঙ্গানেট পানিতে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। |
০৫ | চিংড়ি দুর্বল/ সতেজ কিনা | দুর্বল চিংড়ি বেশি হলে কারণ নির্ণয় করতে হবে এবং স্বল্প পরিমাণে চিংড়ি আহরণের উদ্যোগ নিতে হবে। |
০৬ | খোলস নরম/ শক্ত কিনা | নরম চিংড়ির সংখ্যা বেশি হলে কারণ নির্ণয় করতে হবে এবং চুন প্রয়োগে করতে হবে। |
০৭ | দেহের মাংশ এবং খোলসের মধ্যে কোনো ফাঁকা আছে কিনা | ফাঁকা থাকলে খাবার প্রদানের তালিকা পরীক্ষা করতে হবে এবং প্রয়োজনে পরিমাণ বাড়াতে হবে |
ঝ. খামারে চিংড়ির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
সাধারণত অস্বাস্থ্যকর জলীয় পরিবেশ, মজুদ ঘনত্ব বেশি, খাদ্যাভাব ইত্যাদি কারণে চিংড়ির শরীরে নানা রকম রোগের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়। এজন্য চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। চিংড়ির ঘনত্ব বেশি হলে খাদ্যাভাবও প্রকট হয়। ফলে কিছু কিছু চিংড়ি দ্রুত বড় হয়ে যায় এবং দুর্বল ছোট চিংড়িগুলো খাদ্য প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। এর ফলে দুর্বল চিংড়িগুলো ধীরে ধীরে আরও দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া অধিক ঘনত্বের কারণে জলীয় পরিবেশও দূষিত হয়ে পড়ে। চিংড়ির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিম্নরূপ:
১) পানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন।
২) নির্ধারিত মজুদ ঘনত্ব বজায় রাখা।
৩) খামারের সুষম ও পরিমিত খাদ্য ব্যবহার।
৪) অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণীর অনুপ্রবেশ রোধ।
৫) খামারে ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ও আহরণ সরঞ্জামাদি জীবাণুমুক্ত রাখা।
৬) স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে পুকুরে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার না করা। তবে একান্তভাবেই যদি রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার করতে হয় সে ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের মাত্রা সহনশীল পর্যায়ে রাখার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। পুকুরে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারের মাত্রা নিচের সারণিতে দেয়া হলো।
ঞ. অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ
সঠিকভাবে পানি ব্যবস্থাপনা চিংড়ি উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই পানি সরবরাহ ও নির্গমন ব্যবস্থা যাতে ঠিকমত থাকে সেজন্য পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন গেট নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করতে হবে। এসব গেটে কোনো প্রকার ত্রুটি দেখা দিলে তা সাথে সাথে অপসারণ করতে হবে। তাছাড়া গেটের পার্শ্বে বা তলা দিয়ে পানি চলাচল করলে তা সাথে সাথে বন্ধ করতে হবে। অবাঞ্ছিত প্রাণী নিয়ন্ত্রণের জন্য নিষ্কাশন গেটে স্থাপিত নেট নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। এগুলো ত্রুটিপূর্ণ হলে চিংড়ি খামার থেকে বের হয়ে যেতে পারে কিংবা অবাঞ্ছিত প্রাণী খামারে প্রবেশ করার সম্ভাবনা থাকে। বেষ্টনী বাঁধ ও পুকুরের বাঁধ নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। বাঁধে কোনো প্রকার ত্রুটি থাকলে তা সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করতে হবে। খামারে অবকাঠামোসমূহ নিয়মিত ও সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়েও খামার / চিংড়ির ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকে।
আরও দেখুন...