একটি গাছ থেকে অনুরূপ গাছের জন্ম লাভই গাছের বংশ বিস্তার অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছ যৌন কোষের সাহায্য নিয়ে বা সাহায্য ব্যতিরেকে স্বতন্ত্র গাছ উৎপন্ন করে তাকে বংশ বিস্তার বলে । ফলে বংশ বিস্তার দু'ভাবে হয়ে থাকে--যৌন পদ্ধতিতে ও অযৌন বা অঙ্গজ পদ্ধতিতে। যৌন বংশ বিস্তার হলো ফুলের পুংকেশরের পরাগরেণুর সাথে ডিম্বাশয়ের ডিম্বানুর যৌন উপায়ে মিলনের ফলে উৎপাদিত বীজ থেকে চারা উৎপাদন পদ্ধতি । যৌন পদ্ধতিতে বংশবিস্তারের সাধারণ কারণগুলো হচ্ছে (ক) বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চারা উৎপাদন (খ) নতুন জাত উদ্ভাবন (গ) কলম করার জন্য স্টক গাছ তৈরি । কিছু কিছু গাছপালা আছে যেগুলো বীজ ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করা যায় না, যেমন-তাল, নারিকেল, সুপারি। যৌন পদ্ধতিতে উৎপন্ন গাছ কষ্ট সহিষ্ণু হয় ও অনেক দিন বেঁচে থাকে কিন্তু এ পদ্ধতি থেকে উৎপাদিত গাছের ফলে মাতৃগুণ বজায় থাকেনা দেরিতে ফুল ও ফল ধরে । যৌন কোষ ছাড়া মাতৃগাছের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন গাছের জন্ম হয় তাকে অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার বলে। অযৌন বংশ বিস্তার বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে, কর্তন বা ছেদ কলমের মাধ্যমে দাবা, জোড় ও চোখ কলমের মাধ্যমে করা যায়। অযৌন বংশ বিস্তারের সুবিধা হচ্ছে মাতৃ গাছের অনুরূপ গুণাগুণ সম্পন্ন গাছ উৎপাদন করা যায় ও খুব তাড়াতড়ি ফল পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে নতুন কোন জাত উদ্ভাবন করা যায় না।
ফল গাছের বংশ বিস্তার
যৌন বংশ বিস্তার পদ্ধতি অনুশীলন
প্রাসঙ্গিক তথ্য
বীজের সাহায্যে যে বংশ বিস্তার সাধিত হয় তাকে যৌন বংশ বিস্তার বলা হয়। যেমন নারিকেল, সুপারি, পেঁপে, আমড়া, তরমুজ, ফুটি, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি ফলের বীজ থেকে বংশ বিস্তার করা হয়ে থাকে ।
যৌন পদ্ধতিতে ফলের বংশ বিস্তারে দুটি ধারায় বা ব্যবস্থায় চারা উৎপাদন করা হয়ে থাকে- ক) বীজতলা তৈরি করে বীজ সরাসরি বপনের মাধ্যমে চারা উৎপাদন খ) পলি ব্যাগে চারা উৎপাদন ।
ক) বীজ তলায় চারা উৎপাদন পদ্ধতি অনুশীলন প্রয়োগ
জনীয় উপকরণ
১। বীজ (বিভিন্ন ফলের) ২। বীজ পাত্র ৩। খড়কুটা ৪। খুঁটি ৫। রশি ৬। চাটাই ৭ । ঝাঝরি ৮ । খুরপি ৯। বাঁশের কাঠি ১০। পানি ১১। সার (জৈব রাসায়নিক) ১২। মাপার টেপ ১৩। কোদাল
কাজের ধাপ
- উপরে বর্ণিত প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো সংগ্রহ করে নিতে হবে ।
- বীজ তলার জায়গাটি ভালোভাবে লাঙ্গল দিয়ে চাষ ও মই দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে সমতল করতে হবে ।
- এবার বীজ তলার, বেড, ড্রেন ও নালা ইত্যাদি টেপ দিয়ে মেপে নিতে হবে । প্রতিটি বীজ তলা প্রস্থে ১১.৫ মিটার ও দৈর্ঘ্য ৩ মিটার বা ততোধিক হতে পারে। পাশাপাশি ২টি বীজ তলার মাঝে ৬০ সে:মি: জায়গা নালার জন্য এবং বীজ তলার চারদিকে ২৫ সে:মি: নিকাশ নালার জায়গা মেপে বাদ রাখতে হবে।
- এবার খুঁটি পুতে রশি টানিয়ে বীজতলার, নালা সাইজ করে নিতে হবে এবং ২ বেডের মাঝের নালা ও চারাপাশের নালা থেকে কোদাল দিয়ে মাটি তুলে বেড় উঁচু করে নিতে হবে ।
- প্রতিটি বেডের জন্য ১০-১৫ কেজি জৈব সার ও ৩০ গ্রাম হারে ইউরিয়া, টি,এস,পি এম পি সার এবং অম্ল মাটির জন্য আরও ১২০ গ্রাম হারে চুন প্রয়োগ করে মাটি কুপিয়ে সার ভালোভাবে বেডের মাটির মাথে মিশিয়ে দিতে হবে ।
- রশি, খুঁটি সরিয়ে বীজ তলা সমতল করে, বীজপাত্র হতে বীজ নিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে সারি করে বীজ বপন করতে হবে । প্রজাতি ভেদে বীজের চাহিদা অনুযায়ী হাতে নড়াচাড়া করে বীজ মাটির নির্দিষ্ট গভীরতায় (২-৩ সে:মি:) বসিয়ে দিতে হবে। রস রক্ষার জন্য খড়কুটা দিয়ে বীজতলা ঢেকে দিতে হবে ।
- বীজতলার উপর খুটি পুঁতে রশি ও চাটাই দিয়ে ছায়া প্রদান করতে হবে ।
- বীজতলায় রস কমে গেলে ঝাঁঝরি দিয়ে বিকেলে হালকা সেচ দিতে হবে। চারা একটু বড় হলে দুপুরে ছায়া দিতে হবে । আগাছা সাবধানে হাত দিয়ে তুলে ফেলতে হবে ।
- চারা দুর্বল ও লিকলিকে দেখালে বা কম বাড়ন্ত হলে প্রতি ঝাঝরি পানিতে ১-২ চা চামচ ইউরিয়া গুলে সেচ দিতে হবে । এভাবে যত্ন করে ফলের চারা উৎপাদন করতে হবে ।
- মাঝে মাঝে সেচ বন্ধ রেখে চারার কষ্ট সহিষ্ণুতা বাড়াতে হবে ।
- যে সমস্ত ফলের বীজ দেরিতে গজায় যেমন-নারিকেল, সুপারি, পেয়ারা, তালো, খেজুর ইত্যাদির ক্ষেত্রে চারা গজানোর পূর্বেই সেচ দিতে হবে ।
সতর্কতা
- উই পোকার উপদ্রব থাকলে খড়কুটা ব্যবহার করা যাবে না ।
- জমিতে জো থাকা অবস্থায় বীজ বপন করতে হবে।
- বীজ বপনের পরপরই সেচ দেয়া যাবে না ।
- নিড়ানোর সময় শেকড় যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে
খ) পলিব্যাগে ফলের চারা উৎপাদন পদ্ধতি অনুশীলন
প্রাসঙ্গিক তথ্য
পলিব্যাগে চারা উৎপাদন একটি আধুনিক প্রযুক্তি বা তুলনামূলকভাবে সহজ ও সুবিধাজনক এতে চারার যত্ন ভালোভাবে নেয়া যায় । তাছাড়া চারা সহজে মরে না, চারা পরিবহণ এবং রোপণ করাও বেশ সহজ।
১। প্রয়োজনীয় উপকরণ
- পলিথিন ব্যাগ
- পঁচা গোবর
- দো-আঁশ মাটি
- টিএসপি/এমপি সার
- আবর্জনা পচা সার
- বীজ
- ঝুড়ি
- কোদাল
- ঝাঁঝরি
- মাটি চালুনি
- মাটি শোধনের ঔষধ
- পলিথিন সিট ইত্যাদি
২। কাজের ধাপ
- প্রথমে দো-আঁশ মাটি, পঁচা গোবর, আবর্জনা পচা সার, টি, এসপি ও এমপি সার একত্রে ভালভাবে মিশিয়ে দেড় থেকে দুই মাস রেখে দিতে হবে ।
- সার মেশানোর পূর্বে মাটিকে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এর জন্য ২ ঘন্টা মাটিকে তাপ দিয়ে অথবা ১ লিটার ফরমালডিহাইডের সাথে ৫০ লিটার পানি মিশিয়ে তা মাটির উপর ছিটিয়ে দিয়ে পলিথিন সিট দ্বারা ২ দিন ঢেকে রেখে দিতে হবে।
- এরপর মিশ্রণযুক্ত মাটি চালুন দিয়ে চেলে পলিব্যাগ ভর্তি করতে হবে । পলি ব্যাগের নিচের অংশে পার্শ্বের দিকে ২টি ছিদ্র রাখতে হবে। ব্যাগের উপরে কিছু ফাঁকা রাখতে হবে যাতে পানি সেচ ও আন্তঃপরিচর্যায় সুবিধা হয় ।
- প্রতি ব্যাগে 'জো' থাকা অবস্থায় নির্বাচিত গাছের ২টি করে বীজ বপন করতে হবে।
- নির্বাচিত নার্সারির স্থানে ৩ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১ মিটার প্রস্থের কয়েকটি বেড তৈরি করতে হবে ।
- তারপর প্রতিটি বেড়ে উঁচু স্থানে লাইন করে পলিব্যাগগুলো সাজিয়ে রাখতে হবে ।
- সাজানো পলিব্যাগের উপর চালা দিতে হবে যাতে বৃষ্টি বা রোদ অঙ্কুরিত চারার ক্ষতি না হয় ।
- পলিব্যাগের উৎপাদিত চারায় প্রয়োজন মত ঝাঝরি দ্বারা পানি দিতে হবে ও আনতঃপরিচর্যা করতে হবে ।
- পলিব্যাগে একাধিক চারা গজালে সুস্থ সবল চারাটি রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে ।
- পলিব্যাগ থেকে চারার শেকড় বের হয়ে আসলে কাছি দ্বারা ছেটে দিতে হবে ।
- চারায় রোগ বালাই দেখা গেলে দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে ।
- সবশেষে কাজের ধাপসমূহ ব্যবহারিক খাতায় লিখতে হবে।
সতর্কতা
- পলিব্যাগের অতিরিক্ত পানি বের করার জন্য নিচের দিকে কয়েকটা ছিদ্র করে দিতে হবে ।
- পলিব্যাগ থেকে বের হয়ে আসা শেকড় ও অতিরিক্ত ডালপালা কেটে দিতে হবে ।
- রোপণ উপযাগী হলে চারা গুলো যথাযথসময়ে বিক্রির রোপণের ব্যবস্থা করতে হবে ।
- গবাদি পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য চারপাশে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে ।
অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার অনুশীলন
প্রাসঙ্গিক তথ্য
গাছের প্রতিটি কোষই নতুন গাছ সৃষ্টির কৌলতাত্ত্বিক উপাদান সমূহ ধারন করে । এজন্য একটি একক কোষ থেকেই নতুন একটি গাছের জন্ম হতে পারে । যৌন কোষ ছাড়া মাতৃগাছের অন্যান্য কোষ যেমন-কুঁড়ি, পাতা, ডাল, শিকড়, বাকল ইত্যাদি থেকে যে প্রক্রিয়ায় মাতৃগাছের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন গাছের জন্ম হয় তাকে অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার বলে। অযৌন বংশ বিস্তার বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে, কর্তন বা ছেদ কলমের মাধ্যমে, দাবা, জোড় ও চোখ কলমের মাধ্যমে করা যায় ।
শাখা কলাম ও গুটি কলম পদ্ধতি অনুশীলন
শাখা কলম পদ্ধতি অনুশীলন
১। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
- উন্নত জাতের মাতৃ গাছ
- ধারালো চাকু
- সিকেচার
- নার্সারি বেড়
- খুরপী
- কোদাল
- ছায়াযুক্ত স্থান
২। কাজের ধাপ
- শাখার অগ্রভাগ থেকে ১৫ সে:মি: বাদ দিয়ে নির্বাচিত মাতৃগাছ থেকে ৩টি পর্বসহ এক বছর বয়সের ২০-২৫ । সে:মি: দীর্ঘ একটি শাখা সিকেচারের সাহায্যে কেটে নিতে হবে ।
- শাখার উপরের প্রান্ত পর্ব সন্ধির ২.০ সেমি উপরে গালে করে কর্তিত শাখার নিচের প্রান্ত পর্ব সন্ধির ঠিক নিচে ৩-৪ সে:মি: দীর্ঘ করে তির্যকভাবে কাটতে হবে ।
- এক তৃতীয়াংশ মাটির উপরে ও দুই তৃতীয়াংশ মাটির নিচে রেখে মাটির সাথে ৪৫° কোন করে নার্সারি বেডে ছায়াযুক্ত স্থানে শাখা কলমটি রোপণ করতে হবে। অনুরূপ প্রয়োজনীয় সংখ্যক শাখা কলম তৈরি করে নার্সারি বেডে রোপণ করতে হবে ।
সতর্কতা
- শাখা কলম রোপণের সময় অগ্রভাগ উপরে রেখে নিম্নাংশ মাটিতে পুঁতে দিতে হবে।
- নার্সারি বেড় অর্ধ ছায়াযুক্ত স্থানে হওয়া উচিত ।
- নার্সারি বেডের মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকা আবশ্যক কিন্তু সুনিষ্কাশিত হওয়া প্রয়োজন ।
গুটি কলম পদ্ধতি অনুশীলন
১। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
- উন্নত জাতের মাতৃগাছ
- ধারালো চাকু
- গোবর মিশ্রিত মাটি
- সিকেচার
- নার্সারি বেড়
- পলিথিন ব্যাগ
- পানি
- রশি
২। কাজের ধাপ
- নির্বাচিত মাতৃগাছের ঝুলন্ত শাখার অগ্রভাগ থেকে ৩০-৩৫ সে:মি: দূরে পর্বসন্ধির ঠিক নিচে ৫-৭.৫ সে:মি: জায়গায় চাকু দিয়ে ক্যাম্বিয়াম সহ বাকল তুলে ফেলতে হবে ।
- গোবর মিশ্রিত মাটি ও পানির সাহায্যে একটি গুটি তৈরি করতে হবে। কর্তিত অংশের উপরের পর্ব সন্ধি সহ চতুর্দিকে গুটি লাগিয়ে পলিথিন কাগজ দ্বারা পেঁচিয়ে গুটির উপরে, নিচে ও মাঝে রশি দ্বারা বেঁধে দিতে হবে।
- অনুরুপ ভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গুটি কলম করতে হবে। কলম করার ৩ মাসের মধ্যেই গুটি কাটার উপযুক্ত হবে । গুটি থেকে নিচের দিকে ৫ সে:মি: দূরে শাখাটি চক্রাকারে দুই থেকে তিন ধাপে কাটতে হবে । কাটার পর গুটি কলমটি ছায়াযুক্ত স্থানে নার্সারিতে খড় দ্বারা ঢেকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে সপ্তাহ খানেক মাটির উপরে রেখে দিতে হবে । অতপর নার্সারি বেডে রোপণ করতে হবে ।
৩। সতর্কতা
- কর্তিত অংশের বাকলের নিচে সবুজাভ ক্যাম্বিয়াম লেয়ার ভালোভাবে তুলে ফেলতে হবে। অন্যথায় গুটি কলম সফল হবে না ।
- গুটি সব সময় আর্দ্র রাখতে হবে।