সিদ্ধার্থ গৌতমের গৃহত্যাগ ও বুদ্ধত্ব লাভ
এই অধ্যায়ে যা আছে-
কিছু কিছু ঘটনা বা দৃশ্য আছে যা মানুষকে ভাবিয়ে তুলে বা মানুষের মনে দাগ কাটে। চলো দলে আলোচনা করে আমাদের দেখা এরূপ ঘটনাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করি।
তালিকা |
১. ২. ৩. 8. ৫.
|
সিদ্ধার্থ গৌতম নগর ভ্রমণে গিয়ে চারটি ঘটনা (দৃশ্য বা নিমিত্ত) দেখেছিলেন, যা তাঁকে খুবই ভাবিয়ে তুলেছিল। সেই ঘটনাগুলো দেখে তিনি দুঃখমুক্তির পথ অনুসন্ধানের জন্য গৃহত্যাগ করেছিলেন।
গৃহত্যাগের পর কঠোর সাধনা করে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। এই অধ্যায়ে আমরা সিদ্ধার্থ গৌতমের চারি নিমিত্ত দর্শন, গৃহত্যাগ এবং বুদ্ধত্ব লাভ সম্পর্কে জানব।
সিদ্ধার্থ গৌতমের চারি নিমিত্ত দর্শন
জন্মের পর রাজকুমার সিদ্ধার্থকে দেখে ঋষি অসিত ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন, 'এই শিশু সংসারধর্ম পালন করলে চক্রবর্তী রাজা হবেন। যদি গৃহত্যাগ করেন তাহলে জগৎপূজ্য বুদ্ধ হবেন এবং মানুষকে দুঃখ মুক্তির পথ দেখাবেন।' ঋষির মুখে একমাত্র পুত্র গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হবে শুনে রাজা শুদ্ধোদন খুবই কষ্ট পেলেন। পুত্র যেন সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী না হয় সে জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। তিনি কুমার সিদ্ধার্থকে রাজকীয় ভোগ-বিলাসে এবং আনন্দময় পরিবেশে লালন পালন করতে লাগলেন। ক্রমে সিদ্ধার্থ শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবকে পরিণত হলেন। রাজপ্রাসাদে পরম যত্নে লালিত-পালিত হলেও ভোগ বিলাসের প্রতি ছিল তাঁর অনীহা। যুব বয়সে পুত্রের উদাসীন আচরণ দেখে রাজা শুদ্ধোদন ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বারবার মনে পড়তে লাগল ঋষি অসিতের ভবিষ্যৎ বাণী। একদিন রাজা মন্ত্রীদের ডেকে পুত্রের উদাসীনতার কথা জানালেন। মন্ত্রীগণ কুমারকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার পরামর্শ দিলেন।
চিত্র-১: সিদ্ধার্থ গৌতম ও যশোধরার বিবাহ
পরামর্শক্রমে রাজা দেবদহের রাজকন্যা যশোধরার সঙ্গে সিদ্ধার্থ গৌতমের বিবাহ সম্পন্ন করেন। রাজা -শুদ্ধোদন পুত্রকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করাতে পেরে খুবই খুশি হলেন। ভাবলেন কুমারের বৈরাগ্যভাব - দূর হবে এবং কুমার গৃহত্যাগ করে আর সন্ন্যাসী হবে না। বিবাহের পর সিদ্ধার্থ ও যশোধরা রাজপ্রাসাদে সুখে দিন কাটাতে লাগলেন হঠাৎ একদিন কুমার সিদ্ধার্থের মনে নগর ভ্রমণের ইচ্ছা জাগ্রত হলো। পিতা শুদ্ধোদন নগর ভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন।
মন্ত্রীদের আদেশ দিলেন, 'বৈরাগ্যভাব উদয় করতে পারে এমন কোনো দৃশ্য যেন কুমারের চোখে না পড়ে।' কুমার রথচালক ছন্দককে নিয়ে নগর ভ্রমণে বের হয়ে চারদিনে চারটি নিমিত্ত দর্শন করলেন। 'নিমিত্ত' শব্দের অর্থ হলো ঘটনা, চিহ্ন, সংকেত, ইঙ্গিত, শুভ-অশুভ লক্ষণ ইত্যাদি। আর 'দর্শন' শব্দের অর্থ হলো দেখা। প্রথম দিন তিনি দেখলেন, এক জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে অতি কষ্টে এগিয়ে চলছে। দ্বিতীয় দিন দেখলেন এক রোগগ্রন্থ লোক দুঃখে বিলাপ করছে। তৃতীয় দিন দেখলেন একটি মৃতদেহ লোকজন কাঁদতে কাঁদতে শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছে। চতুর্থ দিন দেখলেন গেরুয়া বসনধারী এক তরুণ সন্ন্যাসী। তাঁর মুখে ছিল হাসি। ভাবনার লেশমাত্র ছিল না। সন্ন্যাসীকে দেখে কুমার খুব প্রীত হলেন। সিদ্ধার্থ গৌতমের দেখা এই চারটি ঘটনাকে 'চারি নিমিত্ত দর্শন' বলা হয়।
অংশগ্রহণমূলক কাজ-১: একক কাজ
ধারণা চিত্র: সঠিক শব্দ দিয়ে খালিঘর পুরণ করি
অংশগ্রহণমূলক কাজ-২: একক কাজ
শূন্যস্থান পূরণ: সঠিক শব্দ দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করি
ক) কুমার সিদ্ধার্থ সংসারধর্ম পালন করলে . . . . . . . . . . . . . . . . . . রাজা হবেন।
খ) গৃহত্যাগ করে জগৎপূজ্য . . . . . . . . . . . . . . . . . . হবেন।
গ) দেবদহের রাজকন্যা . . . . . . . . . . . . . . . . . . সঙ্গে সিদ্ধার্থ গৌতমের বিবাহ হয়।
ঘ) . . . . . . . . . . . . . . . . . .দেখে কুমার খুব প্রীত হলেন।
ঙ) সিদ্ধার্থ গৌতমের চারটি ঘটনা দর্শনকে' . . . . . . . . . . . . . . . . . .বলা হয়।
সিদ্ধার্থ গৌতমের গৃহত্যাগ
চারি নিমিত্ত দেখে সিদ্ধার্থ বুঝতে পারলেন রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ দুঃখ পায়। জরাগ্রস্ত বা বৃদ্ধ হলে দুঃখ পায়। মৃত্যুবরণে দুঃখ পায়। প্রিয় বিচ্ছেদে মানুষের দুঃখ হয়। অপ্রিয় সংযোগে দুঃখ হয়। ইচ্ছিত বা ইপ্সিত বস্তু না পেলে দুঃখ হয়। এগুলো মানব জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম। ধনী, গরিব, রাজা, প্রজা, নারী, পুরুষ সকলে নানাভাবে এসব দুঃখ ভোগ করে। তিনি ভাবতে লাগলেন এসব দুঃখ থেকে মুক্তির কী কোনো উপায় নেই? ভাবতে ভাবতে তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন। গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর কথা গভীরভাবে চিন্তা করলেন। অবশেষে, তিনি দুঃখ মুক্তির পথ বা উপায় খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করার দৃঢ় সংকল্প করলেন।
চিত্র-৩: গৃহত্যাগের পূর্বে সিদ্ধার্থ গৌতম পূত্র রাহুল এবং স্ত্রী যশোধরাকে এক পলক দেখছেন
ঠিক এমন সময় তিনি পুত্র রাহুলের জন্ম সংবাদ পেলেন। পুত্রের স্নেহ মমতায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় কুমার সিদ্ধার্থ আরো চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সেদিন আষাঢ়ী পূর্ণিমার গভীর রাত। প্রিয়পুত্র এবং প্রিয়তমা স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সিদ্ধার্থ স্ত্রী পুত্রকে এক পলক দেখে গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন।
অতঃপর তিনি রথ চালক ছন্দককে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। সিদ্ধার্থের প্রিয় ঘোড়ার নাম ছিল কন্থক। কুমার সিদ্ধার্থের আদেশে ছন্দক ঘোড়া কন্তুককে নিয়ে উপস্থিত হলেন। কন্থকের পিঠে চড়ে গভীর রাতে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করে উপস্থিত হলেন অনোমা নদীর তীরে। সেখানে ছন্দক এবং কন্থককে বিদায় দিলেন। ছন্দক অনেক অনুনয় বিনয় করেও তাঁকে ফেরাতে পারল না। ছন্দক অশ্রুসজল নয়নে বিদায় নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসে। তার মুখে সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের কথা শুনে রাজপ্রাসাদে হাহাকার পড়ে গেল। গৃহত্যাগের সময় সিদ্ধার্থ গৌতমের বয়স ছিল ২৯ বছর।
অনুশীলনমূলক কাজ-৩: দলগত কাজ (মাথা খাটানো)
তালিকা তৈরি: 'যেসব কারণে মানুষ দুঃখ পায়' দলে আলোচনা করে তার একটি - সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করি
তালিকা |
১. রোগে আক্রান্ত হলে দুঃখ পায়। ২. ৩. 8. |
অনুশীলনমূলক কাজ-৪: জোড়ায় কাজ শুদ্ধ-অশুদ্ধ নির্ণয়: টিক (✔) চিহ্ন দিয়ে শুদ্ধ-অশুদ্ধ বাক্য চিহ্নিত করি
ক) জরাগ্রস্থ বা বৃদ্ধ হলে দুঃখ হয়। শুদ্ধ/অশুদ্ধ
খ) প্রিয় বিচ্ছেদে দুঃখ হয় না। শুদ্ধ/অশুদ্ধ
গ) অপ্রিয় সংযোগে দুঃখ হয়। শুদ্ধ/অশুদ্ধ
ঘ) ইচ্ছিত বা ইপ্সিত বস্তু না পেলে দুঃখ হয় না। শুদ্ধ/অশুদ্ধ
ঙ) সিদ্ধার্থ স্ত্রী পুত্রকে এক পলক দেখে গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। শুদ্ধ/অশুদ্ধ
সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভ
সারথী ছন্দককে বিদায় দেয়ার পূর্বে তাঁর হাতে রাজকীয় পোশাক, মুকুট, অলংকার প্রভৃতি দিয়ে সিদ্ধার্থ গেরুয়া পোশাক পরিধান করলেন। তলোয়ারের সাহায্যে মাথার চুল কাটলেন। ছন্দককে বিদায় দিয়ে সন্ন্যাসী বেশে প্রবেশ করলেন ঋষি ভার্গবের আশ্রমে। সেখানে কিছুদিন সাধনা করলেন। কিন্তু সেখানে তিনি দুঃখ মুক্তির পথ খুঁজে পেলেন না। সেখান থেকে চলে গেলেন রাজগৃহে। রাজগৃহের রাজা বিম্বিসারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রাজা তাঁর সৌম্য চেহারা দেখে অভিভূত হলেন। পরিচয় পেয়ে তিনি তাঁকে সেনাপতির পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ঋষি আড়ার কালামের আশ্রমে চলে যান। তাঁর আশ্রমেও কাটালেন বেশ কিছুদিন। তিনিও দুঃখ মুক্তির পথের সন্ধান দিতে পারলেন না। নতুন গুরুর সন্ধানে বিচরণ করলেন নানা তীর্থে। দেখা করলেন নানা ঋষির সাথে। এই পথচলায় তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন কৌগুণ্য, অশ্বজিত, বঙ্গ, মহানাম ও ভদ্দিয়। এঁরা ঋষি আড়ার কালাম ও রামপুত্র রুদ্রকের শিষ্য ছিলেন। পরবর্তীকালে এঁরা 'পঞ্চবর্গীয় শিষ্য' নামে পরিচিতি লাভ করেন। পরিশেষে এসে পৌঁছলেন নৈরঞ্জনা নদীর তীরে অবস্থিত উরুবেলা গ্রামে। স্থানটির পরিবেশ ছিল শান্ত এবং নির্জন। শুরু করলেন কঠোর ধ্যান সাধনা। কেটে গেল বেশ কিছুদিন। ক্ষুধা তৃষ্ণায় সিদ্ধার্থের দেহ শীর্ণ ও দুর্বল হয়ে পড়ল। বুঝতে পারলেন ধ্যান সাধনার জন্য দেহ সুস্থ রাখা দরকার। তাই তিনি মধ্যমপথ অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিলেন।
উরুবেলার পাশেই ছিল সেনানী গ্রাম। তিনি ভিক্ষান্ন সংগ্রহের জন্য সেনানী গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হলেন। দুর্বল দেহে বেশি দূর যেতে না পেরে এক নিগ্রোধ বৃক্ষ মূলে বসে ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। এ সময় সেনানী পরিবারের কন্যা সুজাতা এসে তাঁকে পায়সান্ন দান করলেন। সেই পায়সান্ন গ্রহণ করে সিদ্ধার্থ নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করলেন। অতঃপর নতুন উদ্যমে গয়ার নিগ্রোধ বৃক্ষ তলে ধ্যানে নিমগ্ন হলেন এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলেন, "আমার হাড়, চর্ম, ত্বক, মাংস সব শুকিয়ে যাক। আমি বুদ্ধত্ব লাভ না করে এ আসন থেকে উঠব না।" এই প্রতিজ্ঞা করে তিনি গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলেন।
ঠিক তখন মার (মন্দ দেবতা বা মানসিক অশুভ প্রবৃত্তি) এসে নানা ছলে-বলে কৌশলে তাঁর ধ্যান ভঙ্গের চেষ্টা করতে লাগলেন। তারা কিছুতেই সিদ্ধার্থের ধ্যান ভঙ্গ করতে পারল না। মার পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল। মারকে পরাজিত করে সিদ্ধার্থ গৌতম বোধিজ্ঞান বা বুদ্ধত্ব লাভ করেন। জগতে 'বুদ্ধ' নামে খ্যাত হন। তখন তাঁর বয়স ছিল পঁয়ত্রিশ। তাঁর বুদ্ধত্ব লাভের স্থানটি বর্তমানে 'বুদ্ধগয়া' নামে পরিচিত।
অনুশীলনমূলক কাজ-৫: জোড়ায় কাজ (বাক্য গঠন)
জোড়ায় আলোচনা করে নিচের শব্দগুলো দিয়ে একটি করে বাক্য গঠন করি
ছন্দক | |
পঞ্চবর্গীয় শিষ্য | |
বিম্বিসার | |
বোধিজ্ঞান | |
বুদ্ধগয়া |
অংশগ্রহণমূলক কাজ-৬: একক কাজ
কুইজ: টিক (✔) চিহ্ন দিয়ে সঠিক উত্তর বাছাই করি
ক) সিদ্ধার্থ গৌতম প্রথম কোন ঋষির আশ্রমে গিয়েছিলেন? ঋষিভার্গব/আড়ার কালাম/রামপুত্র রুদ্রক
খ) রাজগৃহে কোন রাজার সঙ্গে সিদ্ধার্থ গৌতমের সাক্ষাৎ ঘটেছিল? অজাতশত্র/বিম্বিসার/প্রসেনজিত
গ) কত বছর বয়সে সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহত্যাগ করেছিলেন? ১৫ বছর/২৫ বছর/২৯ বছর
ঘ) 'পঞ্চবর্গীয় শিষ্য' বলতে কয়জন শিষ্য বোঝায়? ৫ জন/১৫ জন/২৫ জন
ঙ) কে সিদ্ধার্থ গৌতমকে পায়সান্ন দান করেছিলেন? কৃশা গৌতমী/ গোপা/সুজাতা -
চ) কোন বৃক্ষ তলে সিদ্ধার্থ ধ্যানে সমাসীন হয়েছিলেন? অর্জুন বৃক্ষ/ নিগ্রোধ বৃক্ষ /শালবৃক্ষ
ছ) সিদ্ধার্থ গৌতম কত বছর বয়সে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন? ২৫ বছর/৩৫ বছর/৪৫ বছর
আরও দেখুন...