সেমিকন্ডাক্টর (Semiconductor)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - পদার্থবিজ্ঞান - আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিকস(Modern Physics and Electronics) | NCTB BOOK

আধুনিক জগৎ এবং আধুনিক সভ্যতা পুরোটাই ইলেকট্রনিকসের উপরে গড়ে উঠেছে এবং এই ইলেকট্রনিকসের জন্য আমরা যদি কোনো এক ধরনের পদার্থের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই তাহলে সেই পদার্থটি হবে অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টর। আমরা এর আগেও পরিবাহী এবং অপরিবাহী এবং অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টরের নাম উচ্চারণ করেছি, এখন ব্যাপারটার একটুখানি গভীরে যেতে পারি। 

                

      চিত্র 13.1:সিলিকন ক্রিস্টাল । ডান দিকে সিলিকন ক্রিস্টালের ত্রিমাত্রিক রূপ

চিত্রে সেমিকন্ডাক্টরের অনেকগুলো পরমাণুকে পাশাপাশি দেখানো হয়েছে। পরমাণুর গঠনের কারণে তাদের শেষ কক্ষপথে যদি আটটি ইলেকট্রন থাকে তাহলে সেটি কোনো এক অর্থে পরিপূর্ণ হয় এবং অনেক স্থিতিশীল হয়। পরমাণুগুলো সব সময়ই চেষ্টা করে তাদের শেষ কক্ষপথে আটটি ইলেকট্রন রাখতে। সিলিকন হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সেমিকন্ডাক্টর, তার শেষ কক্ষপথে ইলেকট্রনের সংখ্যা চার, কিন্তু যখন আমরা সিলিকন ক্রিস্টালের দিকে তাকাই তখন অবাক হয়ে আবিষ্কার করি প্রত্যেকটি পরমাণুই ভাবছে তার শেষ কক্ষপথে আটটা ইলেকট্রন! এটা ঘটেছে কারণ প্রত্যেকটা পরমাণুই চারদিকে ভিন্ন চারটা পরমাণুর সাথে যুক্ত এবং সবাই নিজের ইলেকট্রনগুলো পাশের পরমাণুর সাথে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করছে। (আমরা চিত্রটি এঁকেছি এক সমতলে, সত্যিকার সিলিকন পরমাণুগুলো ত্রিমাত্রিক, চিত্রের ডানপাশে যে রকম দেখানো হয়েছে। প্রত্যেকটা পরমাণুই আসলে অন্য চারটি পরমাণুকে স্পর্শ করে থাকে।) 

এমনিতে সেমিকন্ডাক্টরে ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর সাথে আটকে থাকে, তাপমাত্রা বাড়ালে হয়তো একটা দুটো ইলেকট্রন মুক্ত হতে পারে। পরিবাহক মুক্ত ইলেকট্রন থাকে তাই তখন সেমিকন্ডাক্টরটা খানিকটা পরিবাহকের মতো কাজ করতে পারে। পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা চমৎকার একটা ব্যাপার, কিন্তু ব্যবহারের জন্য এটা ততটা উপযোগী না। এটাকে সত্যিকার অর্থে ব্যবহার করার জন্য খুবই মজার একটা কাজ করা হয়। সিলিকন ক্রিস্টালের সাথে এমন একটা পরমাণু (যেমন ফসফরাস) মিশিয়ে দেওয়া হয় যার শেষ কক্ষপথে থাকে পাঁচটি ইলেকট্রন। তখন আমরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করি যেহেতু প্রত্যেকটা পরমাণু অন্য পরমাণুর সাথে নিজের ইলেকট্রন ভাগাভাগি করে একটা শৃঙ্খলার মাঝে আছে এবং ফসফরাসের এই পঞ্চম ইলেকট্রনটি বাড়তি একটা ইলেকট্রন, কোনো পরমাণুরই তার প্রয়োজন নেই, তাই সেসব পরমাণুর মাঝেই প্রায় মুক্তভাবে ঘোরাঘুরি করতে পারে। এটাকে ফসফরাসের পরমাণুর মাঝে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ফসফরাসকে পজিটিভ আয়ন বানিয়ে এই ইলেকট্রনটি মুক্ত ইলেকট্রনের মতো ব্যবহার করে। বলা যেতে পারে ফসফরাস মেশানো এ রকম সেমিকন্ডাক্টর অনেকটাই পরিবাহী, কারণ চার্জ পরিবহনের জন্য এখানে কিছু মুক্ত ইলেকট্রন থাকে। ফসফরাসের মতো শেষ কক্ষপথে পঞ্চম ইলেকট্রনসহ পরমাণুর যোগ করে সেমিকন্ডাক্টরকে মোটামুটি পরিবাহক তৈরি করে ফেলা এই সেমিকন্ডাক্টরকে বলে n ধরনের সেমিকন্ডাক্টর। 

এবারে তোমরা আরো চমকপ্রদ একটা বিষয় শোনার জন্য প্রস্তুত হও। শেষ কক্ষপথে বাড়তি পঞ্চম ইলেকট্রন এমন পরমাণু না দিয়ে যদি আমরা উল্টো কাজটি করি, শেষ কক্ষপথে একটি কম অর্থাৎ তিনটি ইলেকট্রন (বোরন) দেওয়া কিছু পরমাণু মিশিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কী হবে? অবশ্যই বোঝা যাচ্ছে বোরনের পরমাণুর কক্ষপথে একটা জায়গায় ইলেকট্রনের জন্য একটা ফাঁকা জায়গা থাকবে এবং পরমাণুটি সেই ফাঁকা জায়গাটা পাশের একটা ইলেকট্রন এসে ভরাট করে ফেলতে পারে৷ তখন পাশের পরমাণুতে একটা ফাঁকা জায়গা হয়ে যাবে, সেই ফাঁকা জায়গাটি আবার তার পাশের পরমাণুর একটা ইলেকট্রন এসে ভরাট করে ফেলতে পারে, তখন সেখানে একটা ফাঁকা জায়গা হবে। অন্যভাবে বলা যায় আমাদের কাছে মনে হবে একটা ইলেকট্রনের অভাবযুক্ত একটা ফাঁকা জায়গা বুঝি পরমাণু থেকে পরমাণুতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হতে পারে এটা বুঝি আসলে এক ধরনের কণা এবং তার চার্জ বুঝি পজিটিভ। এটাকে বলা হয় হোল (Hole)। অর্থাৎ আমরা বলতেই পারি বোরন পরমাণুকে নেগেটিভ আয়ন হিসেবে রেখে তার হোলটি সিলিকন ক্রিস্টালের ভেতর ঘুরে বেড়াতে পারে। অর্থাৎ এই সেমিকন্ডাক্টরটি প্রায় পরিবাহক হিসেবে কাজ করে এবং তার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবহন করে পজিটিভ চার্জযুক্ত হোল! শেষ কক্ষপথে তিনটি ইলেকট্রন যুক্ত পরমাণু মিশিয়ে একটা সেমিকন্ডাক্টরকে যখন পরিবাহক করে ফেলা হয় তখন তাকে বলে p ধরনের সেমিকন্ডাক্টর। 

এমনিতে আলাদাভাবে n ধরনের এবং p ধরনের সেমিকন্ডাক্টরের তেমন ব্যবহার ছিল না কিন্তু যখন n এবং p ধরনের সেমিকন্ডাক্টর একটার সাথে আরেকটা যুক্ত করা হলো তখন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ভাগতের সবচেয়ে বড় অগ্রগতির সূচনা হয়েছিল। 

Content added || updated By

13.02 চিত্রে দেখানো হয়েছে একটা p ধরনের সেমিকন্ডাক্টর এ ধরনের সেমিকন্ডাক্টরের সাথে যুক্ত করে তার সাথে একটা ব্যাটারি এমনভাবে যুক্ত করা হয়েছে, যেন ব্যাটারির পজিটিভ অংশটি যুদ্ধহয়েছে n এর সাথে এবং নেগেটিভ অংশটি যুক্ত হয়েছে p এর সাথে।

চিত্র 13.02 :n এবং p যুক্ত করে তৈরি করা ডায়োড। ব্যাটারি সেলের এক সংযোগে কন বিদ্যুৎ প্রবাহ হই না, অন্য সংযোগে বিদ্যুৎ প্রবাহ হয় 

চিত্র 13.02 :n এবং p যুক্ত করে তৈরি করা ডায়োড। ব্যাটারি সেলের এক সংযোগে কন বিদ্যুৎ প্রবাহ হই না, অন্য সংযোগে বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়

 

আমরা জেনেছি n ধরনের সেমিকন্ডাক্টরে বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য ইলেকট্রন থাকে, কাজেই ব্যাটারি সেলের পজিটিভ প্রান্ত খুব দ্রুত এই ইলেকট্রনগুলোকে নিজের কাছে টেনে নেবে। কাজেই n টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য কোনো ইলেকট্রন থাকবে না। এটা হয়ে যাবে বিদ্যুৎ অপরিবাহী। ঠিক একইভাবে ব্যাটারির নেগেটিভ প্রান্ত থেকে ইলেকট্রন হাজির হবে p টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে এবং সবগুলো হোল একটা একটা ইলেকট্রন নিয়ে ভরাট হয়ে যাবে, কাজেই খুব দ্রুত দেখা যাবে বিদ্যুৎ প্রবাহ করার জন্য একটি হোলও অবশিষ্ট নেই, অর্থাৎ এই p সেমিকন্ডাক্টরটিও বিদ্যুৎ অপরিবাহী হয়ে যাবে। কাজেই ব্যাটারির সাথে এই np সেমিকন্ডাক্টরটি যুক্ত করা হলে এর ভেতর দিয়ে কোনো বিদ্যুৎই পরিবাহিত হবে না। 

এবারে যদি np সেমিকন্ডাক্টরটিতে ব্যাটারি সেলের উল্টো সংযোগ দেওয়া হয় তাহলে কী হবে? অর্থাৎ ব্যাটারির পজিটিভ অংশ লাগানো হলো p ধরনের সেমিকন্ডাক্টরে এবং নেগেটিভ প্রান্ত লাগানো হলো এ ধরনের সেমিকন্ডাক্টরে। এবারে ব্যাটারির নেগেটিভ প্রান্ত থেকে ইলেকট্রন ঢুকে যাবে n টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে এবং ইলেকট্রনগুলোকে np জাংশনের দিকে ঠেলে দেবে। ঠিক তেমনিভাবে ব্যাটারির পজিটিভ প্রান্ড p টাইপ সেমিকন্ডাক্টর থেকে ইলেকট্রন টেনে নিয়ে নতুন হোল তৈরি করতে থাকবে এবং সেই হোলগুলো ছুটে যাবে pa জাংশনের দিকে। সেখানে ইলেট্রনগুলো হোলগুলোকে ভরাট করতে থাকবে। ব্যাপারটা চলতেই থাকবে এবং কেউ যদি ব্যাটারির তারগুলোর দিকে তাকায় তাহলে দেখবে ব্যাটারির নেগেটিভ প্রান্ত থেকে ইলেকট্রন যাচ্ছে n এর দিকে এবং p থেকে ইলেকট্রন বের হয়ে ফিরে আসছে ব্যাটারির পজিটিভ প্রান্তে। সেটা চলতেই থাকবে এবং আমরা দেখব এই জাংশনের ভেতর দিয়ে চমৎকারভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহ হচ্ছে। p এবং n ধরনের সেমিকন্ডাক্টর তৈরি এই জাংশনকে বলে ডায়োড। ডায়োড এমন একটি ইলেকট্রনিকস ডিভাইস, যেখানে ব্যাটারির এক ধরনের সংযোগে বিদ্যুৎ প্রবাহ হয় উল্টো সংযোগে হয় না। 

ডায়োডের ব্যবহারের কোনো শেষ নেই। সাধারণ ডায়োড তো আছেই, সত্যি বলতে কি তোমরা সব সময় যে লাল নীল সবুজ হলুদ ছোট ছোট আলো দেখো সেগুলো সব LED বা Light Emitting Dlode। ডায়োডের আরো একটা মজার ব্যবহার হচ্ছে AC থেকে DC তৈরি করা। ডায়োড ব্যবহার করে এসি সিগন্যালের নেগেটিভ অংশ অপসারণ করে ফেলা যায়। 13.07 চিত্র দেখানো উপায়ে আমরা যদি ডায়োডের ভেতর AC ভোল্টেজ দিই অন্য পাশে নেগেটিভ অংশটুকু কেটে শুধু পজিটিভ অংশটুকু বের হয়ে আসবে। 

Content added || updated By

যারা বিজ্ঞানের ইতিহাস জানে তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় আবিষ্কার কী, সম্ভবত তারা ট্রানজিস্টরের কথা বলবে। ট্রানজিস্টর p এবং n ধরনের সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে তৈরি এক ধরনের ডিভাইস, যেটি তার ভেতর দিয়ে বিদ্যুতের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। npn এবং pnp দুই ধরনের ট্রানজিস্টর আছে। ছবিতে তোমাদের npn ধরনের ট্রানজিস্টর দেখানো হয়েছে। এটাকে অনেকটা পানির ট্যাপের সাথে তুলনা করা যায়, পানির ট্যাপ খুললে পানির প্রবাহ শুরু হয় আবার ট্যাপটি বন্ধ করলে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। npn ট্রানজিস্টরের যে দিক দিয়ে কারেন্ট ঢোকে তার নাম কালেক্টর এবং যেদিক দিয়ে কারেন্ট বের হয় তার নাম অ্যামিটার (Emitter)। মাঝখানে রয়েছে বেস, এই বেসটি পানির ট্যাপের মতো। এই বেসে অল্প একটু কারেন্ট দিলেই যেন ট্যাপটি খুলে যায় অর্থাৎ অনেক বিদ্যুতের প্রবাহ হতে থাকে। আবার এই অল্প কারেন্ট বন্ধ করে দিলেই বিদ্যুতের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। 

         

               চিত্র 13.03:ট্রানজিস্টর এর গঠণ ও প্রতীক

এই ট্রানজিস্টর দিয়ে অসংখ্য ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়। ছোট সিগন্যালকে বড় করার জন্য ট্রানজিস্টর ব্যবহার করা হয়, যেটাকে আমরা বলি অ্যামপ্লিফায়ার। নানা ধরনের সিগন্যালকে প্রক্রিয়া করার জন্যও ট্রানজিস্টর ব্যবহার করা হয়। 

ট্রানজিস্টর রেজিস্টর, ক্যাপাসিটর, ডায়োড ইত্যাদি ব্যবহার করে অনেক প্রয়োজনীয় সার্কিট তৈরি করা হয়। ধীরে ধীরে প্রযুক্তির উন্নতি হতে থাকে এবং এই ধরনের নানা কিছু ব্যবহার করে তৈরি করা আস্ত একটি সার্কিট ছোট একটা জারগার মাঝে ঢুকিয়ে দেওয়া শুরু হলো এবং তার নাম দেওয়া হলো ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট। একটা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট হয়তো একটা নখের সমান। তার ভেতরে প্রথমে হাজার হাজার ট্রানজিস্টর দিয়ে তৈরি সার্কিট ঢোকানো শুরু হয় এবং দেখতে দেখতে একটা আইসির ভেতর বিলিয়ন ট্রানজিস্টর পর্যন্ত বসানো সম্ভব হয়ে উঠতে থাকে। তোমরা এর মাঝে জেনে গেছো যে একটি ছোট চিপের ভেতর বিলিয়ন ট্রানজিস্টর ঢোকানোর এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় VLSI বা Very Large Scale Integration এই প্রক্রিয়াটি এখনো থেমে নেই এবং চিপের ভেতর আরো ট্রানজিস্টর ঢুকিরে আরো জটিল সার্কিট তৈরি করার প্রক্রিয়া এখনো চলছে। একটি ছোট চিপের ভেতর বিলিয়ন ট্রানজিস্টর ঢুকিয়ে অত্যন্ত জটিল সার্কিট তৈরি করার কারণে আমরা কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্যালকুলেটর, চমকপ্রদ মোবাইল টেলিফোন ইত্যাদি অসংখ্য নতুন নতুন ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারছি। একসময় ইলেকট্রনিকসের যে কাজটি করতে কয়েকটি ঘর কিংবা একটা আস্ত বিল্ডিংয়ের প্রয়োজন হতো এখন সেটা একটা ছোট চিপের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে এবং সেগুলো দিয়ে তৈরি নানা ধরনের যন্ত্র আমরা এখন পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি। 

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion