প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্সকে বর্তমান অবস্থা থেকে ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত হিউম্যান রিসোর্সে পরিণত করার পরিকল্পনাকে বলে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব মূলনীতি মেনে চলতে হয়, তা হলো-
▪️প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া (Emphasis on organizational interest) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। এ পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে সহজে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জিত হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বার্থ বা কর্মীদের স্বার্থকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।
▪️দক্ষতার অগ্রাধিকার (Priority of efficiency) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় কর্মীদের দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দক্ষ কর্মীদের মূল্যায়ন করা হলে কর্মীরা আরও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায়, কর্মী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দক্ষ ব্যক্তিরা সুযোগ পায় এমনভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। অন্যথায় প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না।
▪️দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ তৈরি (Creating long term assets ) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কর্মীদেরকে দীর্ঘদিন ধরে রাখার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্থাৎ, দক্ষ কর্মী বাছাই, দক্ষতা বাড়ানো এবং তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এতে তারা প্রতিষ্ঠান বা কাজের প্রতি সন্তুষ্ট থেকে পুরো কর্মী জীবন একই প্রতিষ্ঠানে শ্রম দেওয়ার চেষ্টা করবে।
▪️ব্যয় নিয়ন্ত্রণ (Cost control) : প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স সংক্রান্ত ব্যয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রণয়ন, হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ, নির্বাচন, নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের সবক্ষেত্রে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্যথায় প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা ও কর্মীদের সুবিধা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
▪️প্রযুক্তিগত উপযুক্ততা (Technological suitable ) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় কর্মীদের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী নিয়োগ দিতে হবে বা কর্মীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অনুযায়ী প্রযুক্তি নির্বাচন করতে হবে কিংবা কর্মীদেরকে আধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দিয়ে উপযুক্ত করে তুলতে হবে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
▪️প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি (Culture of the organization) : প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব নিয়ম, আচরণবিধি ও সংস্কৃতি থাকে। এই সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারে এমন কর্মী বাছাই ও নিয়োগের চেষ্টা করতে হবে । অর্থাৎ, কর্মী সংক্রান্ত কাজে প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতিকে বিবেচনায় রাখতে হবে।
▪️মানবিকতা (Humanity) : হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদের সাথে মানবিক আচরণ হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কর্মীদেরকে শুধু উৎপাদনের উপকরণ মনে করলেই হবে না। তাদের সাথে যন্ত্রের মতো আচরণ করলে চলবে না। তাদের মানবীয় দিক বিবেচনায় নিয়ে, তাদের আবেগ-অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। তাহলে কর্মীরা কাজে পূর্ণ আন্তরিক থাকবে এবং প্রতিষ্ঠানে নিবেদিত প্রাণ হয়ে শ্রম দিয়ে যাবে।
▪️আইন বিবেচনা (Considering the law) : হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ, নির্বাচন, কর্মী পরিচালনা, অবসর প্রদানসহ সবক্ষেত্রেই আইনি বিধি-বিধান রয়েছে। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে আইনি জটিলতা তৈরি হবে এবং প্রতিষ্ঠানকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে।
▪️দূরদর্শিতা (Foresight) : দেশের অবস্থা ও বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমও। এজন্য আগামীতে এক্ষেত্রে দেশের পরিস্থিতি ও বিশ্বের অবস্থা কী হতে পারে তা বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। অন্যথায় কর্মীবাহিনী সম্পদের পরিবর্তে দায়ে পরিণত হবে।
▪️কর্মীদের মানসিকতা (Mentality of the employees) : একেক এলাকার লোকের মানসিকতা একেক রকম। আবার প্রতিষ্ঠানভেদেও কর্মীদের আচরণে পার্থক্য তৈরি হয়। এজন্য দেখা যায় রাষ্ট্রীয় স্বায়ত্তশাসিত ও ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মানসিকতায় ভিন্নতা নিয়ে উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
▪️যোগ্যতার সর্বোচ্চ ব্যবহার (Maximum utilization of quality ) : প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স খাতে সর্বোচ মাত্রায় ব্যবহার করা যায় তা হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষায়ণের মাধ্যমে যে কাজের জন্য যে যোগ্য তাকে সে কাজেই নিয়োগ করার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যোগ্যতা যেন কাজে লাগানোর সুযোগ কর্মীরা পায় তার সুযোগ রাখতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, হিউম্যান রিসোর্সের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে একজন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজারকে তার হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত পরিকল্পনায় কর্মী চাহিদা উল্লেখ করা হয়। সেই চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ কর্মী প্রাপ্তির জন্য হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকগণ নিয়োগ পরিকল্পনা করেন। আবার কর্মীদেরকে প্রযুক্তিগত ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়া, সম্পদের অপচয় হ্রাস, উৎপাদন বৃদ্ধি প্রভৃতি উদ্দেশ্যে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। নিচে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হলো-
▪️দক্ষতার সাথে কাজ সম্পাদন (To perform the job efficiently) : দক্ষ ও যোগ্য কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নই মূলত হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উৎপাদনকে গতিশীল রাখার জন্যও প্রয়োজন বিভিন্ন কৌশলগত পরিকল্পনা। তাই বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের কাজ দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা খুবই জরুরি।
▪️কর্মী প্রতিস্থাপন (Replacement of employee) : কর্মীরা কাজ করতে করতে বৃদ্ধ হয়ে গেলে অবসরে যেতে বাধ্য হন। আবার অনেকে চাকরির যেকোনো মুহূর্তে অবসরে যান বা অন্যত্র যোগদান করেন। এভাবে প্রতিষ্ঠানে পদ খালি হওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। উৎপাদন যেন বাধাগ্রস্ত না হয় তার জন্য কর্মী প্রতিস্থাপনের আগাম চিন্তা করে রাখতে হয়। এতে প্রয়োজনের সময় কর্মী নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়।
▪️খরচ কমানো (To reduce cost) : প্রতিষ্ঠানে কখনো হিউম্যান রিসোর্সের ঘাটতি দেখা দেয়, কখনো হিউম্যান রিসোর্স প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি হয়। আবার খরচ যখন অতিরিক্ত বা ভারসাম্যহীন হয় তখন তা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়। সঠিক হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার দ্বারা এ কাজগুলো সহজেই করা যায়।
▪️ দক্ষতাসম্পন্ন হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ (Recruiting skilled human resource) : নির্দিষ্ট ধরনের কাজের জন্য বিশেষ ধরনের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। কাজের স্তরভেদে যোগ্যতা ও দক্ষতার স্তরও আলাদা হয়। এসব দক্ষতা ও যোগ্যতা নির্ণয়ে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
▪️ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন (Technological change) : ব্যবসায়কে প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে প্রযুক্তি। কিন্তু এই প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানকে গতিশীল রাখতে হলে প্রযুক্তির সাথে ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে খাপ খাওয়ানো প্রয়োজন। যেমন: বর্তমানে শিল্প বাণিজ্য অনেকটাই কম্পিউটার নির্ভর। এর সুবাদে উন্নত বিশ্বে এমনকি বাংলাদেশেও অনলাইন ব্যবসায়ের প্রসার ঘটছে। তাই কীভাবে ই-বিজনেসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় তা হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা বিভাগের হাতে থাকতে হবে এবং সে ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের প্রস্তুতিও নিতে হবে।
▪️ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো (To cope with change) : বিশ্বায়নের প্রভাব আর প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে শিল্প বাণিজ্যের ধাঁচই পাল্টে গেছে। তাই টিকে থাকার প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিয়ত কৌশল বদলাতে হয়। কর্মীরা যাতে সহজেই এসব পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সেজন্য হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনার সাহায্যে কর্মীরা পরিবর্তনের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নেয়।
▪️ হিউম্যান রিসোর্সের অবস্থান ও চাহিদা নির্ধারণ (Determining the present condition and future demand of human resource) : বর্তমানে কতজন কর্মী কর্মরত আছে, কীভাবে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে তাদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো যায় এবং ধরে রাখা যায় তার জন্য দরকার হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা । আবার ভবিষ্যতের জন্য কী পরিমাণ কর্মী প্রয়োজন তারও সঠিক ধারণা পাওয়া যায় কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, পরিকল্পনাই হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের ভিত্তি। আবার হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। তাই প্রতিষ্ঠানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
আরও দেখুন...