তাপ হচ্ছে এক ধরনের শক্তি। শান্তির ধারণা থেকে আমাদের মনে হতে পারে বেশি তাপশক্তি থেকে বুঝি সব সময়েই তাপ কম তাপশক্তির দিকে যায়, কিন্তু সেটি সত্যি নয়। তাপশক্তি কোন দিকে যাবে সেটি নির্ভর করে তাপমাত্রার উপর। এই অধ্যায়ে আমরা তাপ কিংবা তাপমাত্রা কীভাবে পরিমাণ করতে পারি এবং দুইয়ের মাঝে কী সম্পর্ক সেটি দেখব।
তাপশক্তিটুকু আসলে বস্তুর অণু-পরমাণুর গতি বা কম্পন থেকে এসেছে। তাপ দিয়ে কোনো কঠিন বস্তুর অণুগুলোর কম্পন যদি অনেক বাড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে একটি অণু অন্য অণু থেকে সরে যেতে পারে, অর্থাৎ অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। এই অধ্যায়ে আমরা কঠিন, তরল এবং গ্যাসের উপর তাপের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
0 K
4 K
273 K
100 °C
0 K
4 K
273 K
100 °C
পানি ও কেরোসিনে অদ্রবণীয় একটি কঠিন বস্তুর ভর 68 gm এবং আয়তন ৪০ ঘন সে.মি.। তাপমাত্রা 30°C বাড়ালে বস্তুটির আয়তন 80.015 ঘন সে.মি. হয়। পানির ঘনত্ব 1000 kg m-3 এবং কেরোসিনের ঘনত্ব 810 kg m-3।
2 kg ভরের বরফ খণ্ডকে 30 °C তাপমাত্রার 4 kg পানিতে ছেড়ে বদওয়া হলো। বরফ গলনের আপেক্ষিক সুপ্ত তাপ 334 kJ kg-1 বরফের ঘনত্ব 920 kg m-3।
5 kg বরফ এবং 5 kg পানির তাপমাত্রা পৃথকভাবে 1 K বৃদ্ধি করা হলো।
একটি টেস্ট টিউবে কিছু মোম নিয়ে তার মধ্যে থার্মোমিটার রেখে ধীরে ধীরে সুষমভাবে তাপ দেওয়া হলো এবং প্রতি 5 মিনিট অন্তর অন্তর পাঠ লিপিবদ্ধ করা হলো। এভাবে প্রাপ্ত তথ্য থেকে নিম্নের লেখচিত্রটি পাওয়া গেল।
মোমের ক্রমশীতলীকরণ গ্রাফটি নিম্নরূপ :
একই ভরের বরফ এবং ফুটন্ত পানি একত্রে মিশ্রিত করা হল। এতে সম্পূর্ণ বরফ পানিতে পরিণত হল এবং মিশ্রণের তাপমাত্রা হল 10°C
একটি ইস্পাত তারের দৈর্ঘ্য 100m এবং তাপমাত্রা 20°C। তারটির তাপমাত্রা 50°C হলে এর দৈর্ঘ্য 0.033 m বৃদ্ধি পায়।
20°C তাপমাত্রার 0.1 kg টিনকে গলাতে চূড়ান্ত তাপমাত্রা 332°C 1
5°C তাপমাত্রার 5 kg পানিতে একখণ্ড গরম ধাতব তামা ডুবানো হলো। এতে পানির তাপমাত্রা বেড়ে 10°C হলো।
ভিন্ন তাপমাত্রায় দুটি বস্তুকে তাপীয় সংস্পর্শে আনলে তাদের মধ্যে তাপের আদান-প্রদান ঘটে। বেশি তাপমাত্রার বস্তু তাপ বর্জন করে এবং কম তাপমাত্রার বস্তু তাপ গ্রহণ করে।
তাপ এক ধরনের শক্তি। আমরা দেখেছি শক্তি কাজ করতে পারে অর্থাৎ বল প্রয়োগ করে বস্তুকে বলের দিকে সরাতে পারে, যেমন ট্রেন বা গাড়িতে আসলে জ্বালানি তেল জ্বালিয়ে তাপ তৈরি করা হয় যেটা ট্রেন বা গাড়িকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। সেজন্য আলো, বিদ্যুৎ বা গতিশক্তির মতো আমরা নতুন ধরনের এই শক্তির নাম দিয়েছি তাপশক্তি ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যদি আণবিক পর্যায়ে দেখতে পেতাম অর্থাৎ যেকোনো পদার্থের দিকে তাকালেই তার অণুগুলোকে দেখতে পেতাম তাহলে সম্ভবত তাপশক্তি নামে একটা নতুন নাম না দিয়ে এটাকে “গতিশক্তি” নামেই রেখে দিতাম। তার কারণ তাপশক্তি বলতে আমরা যেটা বোঝাই সেটা আসলে পদার্থের অণুগুলোর সম্মিলিত গতিশক্তি ছাড়া কিছু নয়। একটা কঠিন পদার্থে অণুগুলো যখন উত্তপ্ত হয় তখন অণুগুলো নিজের নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে কাঁপতে থাকে। যত বেশি উত্তপ্ত হবে অণুগুলোর কাঁপুনি তত বেড়ে যাবে। যদি অনেক বেশি উত্তপ্ত হয় তাহলে অণুগুলোর নিজেদের ভেতরে যে আন্তঃআণবিক বল রয়েছে অণুগুলো সেই বলকে ছাড়িয়ে মুক্ত হয়ে যাবে। তখন আমরা সেটাকে বলি তরল। তখন অণুগুলো এলোমেলোভাবে একে অন্যের ভেতর দিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। তাদের একটা গতি থাকে, কাজেই এটা গতিশক্তি। যত উত্তপ্ত করা হয় অণুগুলো তত জোরে ছোটাছুটি করে। যদি আরো উত্তপ্ত করা হয় তখন অণুগুলো আণবিক বন্ধন থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যেতে পারে। আমরা তখন সেটাকে বলি গ্যাস। একটা গ্যাসকে যত উত্তপ্ত করা হবে অণুগুলো তত জোরে ছোটাছুটি করবে। গতি যত বেশি হবে গতিশক্তি তত বেশি হবে।
যেহেতু খালি চোখে আমরা অণুগুলোকে দেখি না, তাদের ছোটাছুটি দেখি না, তাই আমরা পরোক্ষভাবে পুরো জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করি, আমরা সেটাকে তাপশক্তি নাম দিই এবং তাপমাত্রা বলে পদার্থের অবস্থা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। কাজেই আমরা বলতে পারি পদার্থের অণুগুলোর কম্পন বা গতির কারণে যে শক্তি পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে তাপ। যেহেতু এটা শক্তি তাই স্বাভাবিকভাবে অন্য শক্তির মতোই তার একক হচ্ছে জুল (j). তাপের আরো একটি একক আছে, তার নাম ক্যালরি (cal)। 1 gm পানির তাপমাত্রা 1°C বাড়াতে হলে যে পরিমাণ তাপের দরকার সেটা হচ্ছে 1 ক্যালরি। 1 ক্যালরি হচ্ছে 4.2 J এর সমান।
তোমরা হয়তো খাবারের জন্য ক্যালরি শব্দটি ব্যবহার করতে শুনেছ। ফুড ক্যালরি বলতে আসলে বোঝানো হয় মানুষ নির্দিষ্ট খাবার থেকে কী পরিমাণ শক্তি পায় এবং এটার জন্য একক আসলে k cal বা 1000 ক্যালরি। তবে সেটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব না। এখানে আমরা খাবার থেকে পাওয়া শক্তি নয় তাপশক্তি নিয়েই আলোচনা করব।
আমরা যদি তাপকে একটা শক্তি হিসেবে মেনে নিই, তাহলে সাথে সাথে এরপরের যে বিষয়টা আমাদের জানতে হবে সেটা হচ্ছে কীভাবে তাপশক্তি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। সাধারণভাবে আমাদের ধারণা সব সময়ই শক্তির প্রবাহ হয় বুঝি বেশি শক্তি থেকে কম শক্তিতে। ছোট একটা গরম আলপিনে যে পরিমাণ তাপশক্তি রয়েছে তার থেকে অনেক বেশি তাপশক্তি রয়েছে এক গ্লাস পানিতে। কিন্তু গরম আলপিনটা আমরা যদি পানিতে ডুবিয়ে দিই তাহলে কিন্তু আলপিনের অম্ল তাপশক্তি থেকেই খানিকটা চলে যাবে গ্লাসের পানিতে। তার কারণ তাপশক্তির প্রবাহটা তাপের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে তাপমাত্রার উপরে। দুটো ভিন্ন তাপমাত্রার জিনিস যদি একে অন্যের সংস্পর্শে আসে তাহলে সব সময়ই বেশি তাপমাত্রা থেকে তাপ কম তাপমাত্রার জিনিসে যেতে থাকবে যতক্ষণ না দুটোর তাপমাত্রা সমান হচ্ছে।
আমরা এখনো কিন্তু “তাপমাত্রা" নামের রাশিটি সংজ্ঞায়িত করিনি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এটি এত ব্যবহার হয় যে বিষয়টি কী বুঝতে কারোই সমস্যা হয় না। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে পারি এটা হচ্ছে পদার্থের ভেতরকার অণুগুলোর গড় গতিশক্তির একটা পরিমাপ। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি, তাপমাত্রা হচ্ছে সেই তাপীয় অবস্থা যেটি ঠিক করে একটা বস্তু অন্য বস্তুর সংস্পর্শে এলে সেটি কি তাপ দেবে নাকি ভাপ নেবে। বিষয়টা বোঝানোর জন্য আমরা পানির পৃষ্ঠদেশের উচ্চতার সাথে তুলনা করতে পারি। যদি পানির দুটি পাত্রে পানির পৃষ্ঠদেশের উচ্চতা ভিন্ন হয় তাহলে পাত্র দুটিকে একটি নল দিয়ে একত্র করার পর কোন পাত্রে পানি বেশি কোন পাত্রে পানি কম সেটি পানির প্রবাহ ঠিক করবে না। কোন পাত্র থেকে কোন পাত্রে পানি যাবে সেটা নির্ভর করবে কোন পাত্রের পানির পৃষ্ঠদেশের উচ্চতা কত তার ওপর। সব সময়ই বেশি উচ্চতা থেকে পানি কম উচ্চতায় প্রবাহিত হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না দুটি উচ্চতা সমান হয়ে যাচ্ছে। এখানে পানির পরিমাণটাকে তাপশক্তির সাথে তুলনা করতে পারি, পানির পৃষ্ঠদেশের উচ্চতাকে তুলনা করতে পারি তাপমাত্রার সাথে। তাপমাত্রার বেলাতেও এটা সত্যি যে যতক্ষণ পর্যন্ত না দুটি বস্তুর তাপমাত্রা সমান হচ্ছে ততক্ষণ তাপ প্রবাহিত হতে থাকবে।
তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য বিশেষ পদার্থের বিশেষ ধর্মকে কাজে লাগাতে হয়। তাপমাত্রা পরিবর্তন হলে পদার্থের যে ধর্মের পরিবর্তন হয় এবং যে পরিবর্তন সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করে তাপমাত্রা মাপা যায় সেটাই হচ্ছে তাপমাত্রিক ধর্ম। তাপমাত্রা মাপার জন্য পদার্থের যে ধর্মটি ব্যবহার করা হয় সেটি হচ্ছে তাপমাত্রিক ধর্ম। তোমরা জ্বর মাপার পারদের থার্মোমিটার দেখে থাকবে, সেটি শরীরের তাপমাত্রা মাপে। এখানে পারদ হচ্ছে তাপমাত্রিক পদার্থ এবং পারদের আয়তনের প্রসারণ হচ্ছে তার তাপমাত্রিক ধর্ম।
পারদ ছাড়াও অ্যালকোহলের থার্মোমিটার আছে, সেখানে অ্যালকোহল হচ্ছে তাপমাত্রিক পদার্থ এবং তরলের প্রসারণ হচ্ছে তাপমাত্রিক ধর্ম।
গ্যাস থার্মোমিটারে গ্যাস হচ্ছে তাপমাত্রিক পদার্থ এবং নির্দিষ্ট আয়তনে রক্ষিত গ্যাসের চাপ হচ্ছে তাপমাত্রিক ধর্ম। তাপমাত্রার সাথে ধাতুর রোধ বা রেজিস্ট্যান্সের পরিবর্তন হয়, তাই রোধকেও তাপমাত্রিক ধর্ম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। একেকটি তাপমাত্রিক পদার্থ একেক তাপমাত্রার জন্য কার্যকর, তাই খুব বেশি বা কম তাপমাত্রা মাপার জন্য বিশেষ তাপমাত্রিক পদার্থের বিশেষ তাপমাত্রিক ধর্ম ব্যবহার করতে হয়। তামা এবং কনস্টান্টেন ধাতুকে তাপমাত্রিক পদার্থ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দুটি ভিন্ন ভিন্ন ধাতুর সংযোগস্থলে তাপমাত্রার পরিবর্তন হলে এটি একটি ইএমএফ (emf: electromotive force) তৈরি করে, সেটি মেপে তাপমাত্রা বের করা যায়। এই থার্মোকাপল - 200°C থেকে 1000°C পর্যন্ত তাপমাত্রা মাপতে পারে বলে ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়।
আমরা যদি তাপমাত্রার ধারণাটুকু ঠিক করে পেয়ে যাই তাহলে এর পরেই আমাদের জানতে হবে এর একক কী কিংবা তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, আমরা কেমন করে তাপমাত্রা মাপব। তাপমাত্রার প্রচলিত একক হচ্ছে সেলসিয়াস ( °C)। সাধারণভাবে বলা যায় এই স্কেলে এক এটমস্ফিয়ার বাতাসের চাপের যে তাপমাত্রায় বরফ গলে পানিতে পরিণত হয় সেটাকে 0°C এবং যে তাপমাত্রায় পানি ফুটতে থাকে সেটাকে 100°C ধরা হয়েছে। তবে মজার ব্যাপার হলো বিজ্ঞানী সেলসিয়াস যখন তাপমাত্রার স্কেল তৈরি করেছিলেন তখন শূন্য ডিগ্রি ধরেছিলেন ফুটন্ত পানির তাপমাত্রা, 100 ডিগ্রি ধরেছিলেন বরফ গলনের তাপমাত্রা। বর্তমান স্কেলের ঠিক উল্টো!
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা সাধারণত সেলসিয়াস স্কেল ব্যবহার করলেও আন্তর্জাতিক এককটির নাম হচ্ছে কেলভিন (K)। সেলসিয়াস স্কেলের সাথে 273.15°C যোগ করলেই কেলভিন স্কেল পাওয়া যায়। যদি শুধু তাপমাত্রার পার্থক্য নিয়ে মাথা ঘামাই তাহলে সেলসিয়াস স্কেল আর কেলভিন স্কেলে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ তাপমাত্রা 10°C বেড়েছে বলা যে কথা, তাপমাত্রা 10K বেড়েছে বলা সেই একই কথা। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয় এই ঘরের তাপমাত্রা কত, তাহলে যদি সেটা হয় 30°C তাহলে কেলভিন স্কেলে সেটা হবে (30+ 273.15 = 303.15 K)। তোমাদের মনে হতে পারে দুটো স্কেল হুবহু একই রকম শুধু 273.15°C পার্থক্য এর পেছনে কারণটি কী?
এটি করার পেছনের কারণটি খুবই চমকপ্রদ। সাধারণভাবে আমাদের মনে হতে পারে আমরা বুঝি যত বেশি বা যত কম তাপমাত্রা কল্পনা করতে পারব, কিন্তু আসলে সেটি সত্যি নয় । তাপমাত্রা যত ইচ্ছে বেশি কল্পনা করতে সমস্যা নেই কিন্তু যত ইচ্ছে কম কল্পনা করা সম্ভব নয়, সবচেয়ে কম একটা তাপমাত্রা আছে এবং তাপমাত্রা এর থেকে কম হওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, আমরা এই তাপমাত্রার কাছাকাছি যেতে পারি কিন্তু কখনোই এই তাপমাত্রায় পৌঁছাতে পারব না। এই তাপমাত্রাকে পরম শূন্য বা Absolute Zero বলা হয়। সেলসিয়াস স্কেলে এই তাপমাত্রার মান – 273.15°C কাজেই কেলভিন স্কেলে এর মান হচ্ছে শূন্য ডিগ্রি। অন্যভাবে বলা যায় কেলভিন স্কেলটি তৈরি হয়েছে চরম শূন্য তাপমাত্রাকে শূন্য ডিগ্রি ধরে।
তাপমাত্রার যেকোনো স্কেল তৈরি করতে হলে দুটো নির্দিষ্ট তাপমাত্রা (ৰা স্থিরাঙ্ক) দরকার। কেলভিন স্কেলে একটি হচ্ছে পরম শূন্য। যেটাকে শূন্য ডিগ্রি ধরা হয়েছে। অন্যটি হচ্ছে পানির ত্রৈধ বিন্দু বা Triple Point এই তাপমাত্রায় একটা নির্দিষ্ট চাপে (0.0060373 atm ) বরফ, পানি এবং জলীয় বাষ্প এক সাথে থাকতে পারে বলে তাপমাত্রাকে অনেক বেশি সুক্ষ্মভাবে নির্দিষ্ট করা যায়। সেলসিয়াস স্কেলে এর মান 0.01°C, এবং এই স্কেলের সাথে মিল রাখার জন্য কেলভিন স্কেলে এর মান 273.16°কেলভিন এবং সেলসিয়াস স্কেলের পাশাপাশি ফারেনহাইট স্কেল বলেও একটা স্কেল আছে যেখানে বরফ গলন এবং পানির বাষ্পীভবনের তাপমাত্রা যথাক্রমে 32°F এবং 212°F। কেলভিন স্কেলে 0°C তাপমাত্রা 273.15K হলেও আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক সময়েই এটাকে 273 K ধরে নিই। দৈনন্দিন হিসাবে সেটা কোনো গুরুতর সমস্যা করে না।
Thermal expansion is the tendency of matter to change its shape, area, volume, and density in response to a change in temperature, usually not including phase transition.
তাপ দিলে প্রায় সব পদার্থের আয়তনই একটু বেড়ে যায়। তাপ তাপমাত্রা এই বিষয়গুলো যদি আমরা আমাদের আণবিক মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করি তাহলে এর কারণটা বোঝা কঠিন নয়। একটা কঠিন পদার্থকে আমরা অনেকগুলো অণু হিসেবে কল্পনা করতে পারি। তাদের ভেতর যে আণবিক বল সেটাকে আমরা স্প্রিংয়ের সাথে তুলনা করতে পারি। কঠিন পদার্থে অণুগুলো কীভাবে থাকে সেটা দেখানোর জন্য আমরা অণুগুলোর মাঝে একটা স্প্রিং কল্পনা করেছি । কঠিন পদার্থটিকে উত্তপ্ত করলে অণুগুলো কাঁপতে থাকবে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে অণুগুলো তত বেশি কাঁপবে। সত্যিকারের কঠিন পদার্থের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদের এই স্প্রিং মডেলটাকে একটুখানি উন্নত করতে হবে। স্প্রিংয়ের বেলায় আমরা দেখেছি একটা স্প্রিংকে কোনো নির্দিষ্ট দূরত্বে প্রসারিত করলে সেটি যে পরিমাণ বলে টানতে থাকে সেই একই দূরত্বে সংকুচিত করলে এটি ঠিক একই বলে ঠেলতে থাকে। কঠিন পদার্থের অণুগুলোর জন্য এটি পুরোপুরি সত্যি নয়। অণুগুলোকে একটি বেশি দূরত্বে সরিয়ে নিলে এটা যে পরিমাণ বলে টানতে থাকে সেই একই দূরত্বে কাছাকাছি আনলে অনেক বেশি বলে ঠেলতে থাকে। অর্থাৎ স্প্রিংটি যেন একটি বিশেষ ধরনের স্প্রিং। এটা প্রসারিত করতে কম বল প্রয়োগ করতে হয় কিন্তু সংকুচিত করতে বেশি বল প্রয়োগ করতে হয়।
এখন তুমি কল্পনা করে নাও একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় থাকার কারণে অণুগুলো কাঁপছে। বিশেষ ধরনের স্প্রিং হওয়ার কারণে কাঁপার সময় অপুগুলো কাছাকাছি যায় কম কিন্তু দূরে সরে যায় বেশি। এবারে কঠিন পদার্থটিকে আরো উত্তপ্ত করা হলো, অণুগুলো আরো বেশি কাঁপতে থাকবে এবং তোমরা বুঝতেই পারছ অণুগুলো এই বিশেষ ধরনের স্প্রিংয়ের জন্য যেহেতু বেশি কাছে যেতে পারে না কিন্তু সহজেই বেশি দূরে যেতে পারে তাই অণুগুলো একে অন্যের থেকে একটু দূরে সরে নতুন একটা সাম্য অবস্থা তৈরি করবে। সব অণু যখন একে অন্য থেকে দূরে সরে যাবে তখন আমাদের কাছে পুরো কঠিন বস্তুটাই একটু প্রসারিত হয়ে গেছে বলে মনে হবে।
তাপ প্রয়োগ করলে কঠিন কস্তুর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা তিন দিকেই সমানভাবে প্রসারিত হয়। পদার্থের এই প্রসারণকে বিশ্লেষণ করার জন্য দৈর্ঘ্য, ক্ষেত্রফল আর আয়তন প্রসারণ সহগ নামে তিনটি রাশি তৈরি করা হয়েছে।
তাপমাত্রার কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য যদি হয় এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে সেটি করার পর যদি দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়ে সেটি হয় তাহলে দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ হচ্ছে:
কাজেই
একইভাবে তাপমাত্রায় কোনো বস্তুর ক্ষেত্রফল যদি হয় এবং ভাপমাত্রা বৃদ্ধি করে করার পর ক্ষেত্রফলও যদি বেড়ে হয় তাহলে ক্ষেত্রফল প্রসারণ সহগ β হচ্ছে:
কাজেই
ঠিক একইভাবে তাপমাত্রায় যদি আয়তন হয় এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে করার পর যদি আয়তন বেড়ে হয় তাহলে আয়তন প্রসারণ সহগ হচ্ছে:
কাজেই
তোমরা দেখতেই পাচ্ছ α,β এবং𝛾 তিনটি রাশির এককই হচ্ছে
মাত্রা [α] = [β] = []=
কঠিন পদার্থের প্রসারণ সহগের মান আসলে খুবই কম। সে কারণে , এবং এই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সহগের কিন্তু প্রয়োজন ছিল না। আমরা কাজ চালানোর জন্য শুধু দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগটি ব্যাখ্যা করে নিলেই পারতাম। যেমন ধরা যাক ক্ষেত্রফল প্রসারণের ব্যাপারটি। আমরা দেখেছি:
কিন্তু ক্ষেত্রফল A1 আসলে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থের গুণফল যদি এবং আমরা বর্গাকৃতির ক্ষেত্রফল ধরে নিই যার বাহুর দৈর্ঘ্য L1 তাহলে তাপমাত্রা বাড়ালে তার ক্ষেত্রফল হবে
কিংবা
কিন্তু
কাজেই
আমরা দেখেছি . এর মান খুবই ছোট, কাজেই α2 এর মান আরও ছোট, সত্যি কথা বলতে কি এটি এত ছোট যে উপরের সমীকরণে α2 সহ পুরো অংশটুকু আমরা যদি পুরোপুরি বাদ দিই আমাদের বিশ্লেষণ বা হিসাবে এমন কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। তাই আমরা লিখতে পারি:
কিন্তু আমরা জানি
কাজেই নিশ্চয়ই:
ঠিক একইভাবে আমরা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা নিয়ে একটা কিউব কল্পনা করতে পারি তাপমাত্রায় যার আয়তন এবং তাপমাত্রা বাড়িয়ে করার পর যার আয়তন হয়েছে কাজেই
একই যুক্তিতে এখানেও যদি এবং সহ অংশগুলোকে বাদ দিই আমাদের বিশ্লেষণ বা হিসাবের এমন কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। কাজেই শুধু প্রথম দুটি অংশ থাকবে অর্থাৎ
কিন্তু আমরা জানি
অর্থাৎ
কাজেই
কাজেই নিশ্চয়ই:
বাস্তব জীবনে আমাদের কঠিন পদার্থের প্রসারণের বিষয়টা সব সময়ই মনে রাখতে হয়। তোমরা নিশ্চয়ই রেললাইনের মাঝে ফাঁকাটি দেখেছ। তাপমাত্রার প্রসারণকে মনে রেখে এটা করা হয়েছে। প্রসারণের এই সুযোগটি না দিলে উত্তপ্ত দিনে রেললাইন আঁকাবাঁকা হয়ে যেতে পারত। বেশি মিষ্টি খেয়ে এবং নিয়মিত দাঁত ব্রাশ না করে তোমাদের যাদের দাঁতে কেভিটি হয়েছে তারা যখন ডেন্টিস্টের কাছে গিয়েছ তারা হয়তো লক্ষ করেছ একটা বিশেষ পদার্থ দিয়ে দাঁতের গর্তটি বুজে দেওয়া হয়েছে। এই পদার্থটির প্রসারণ সহগ অনেক যত্ন করে দাঁতের প্রসারণ সহগের সমান করা হয়েছে। যদি প্রসারণ সহগ দাঁত থেকে কম হতো তাহলে গরম কিছু খাওয়ার সময় এটা দাঁতের সমান প্রসারিত না হয়ে খুলে আসত। আবার প্রসারণ সহগ বেশি হলে ঠাণ্ডা কিছু খাওয়ার সময় বেশি ছোট হয়ে দাঁত থেকে খুলে আসত। পদার্থবিজ্ঞান না পড়েও অনেক সাধারণ মানুষও তাপমাত্রায় প্রসারণের বিষয়টা জানে। তোমরা লক্ষ করে দেখবে কোনো কৌটার মুখ আটকে গেলে সেটাতে গরম পানি ঢালা হয়। যেন এটা প্রসারিত হয়ে সহজে খুলে আসে।
তরল পদার্থের দৈর্ঘ্য বা ক্ষেত্রফল বলে কিছু নেই। তরল পদার্থের শুধু আয়তন আছে। কাজেই তরল পদার্থের প্রসারণ বলতে তার আয়তন প্রসারণকেই বোঝার। তরল পদার্থের প্রসারণ মাপার সময় একটু সতর্ক থাকতে হয় কারণ তরল পদার্থকে সব সময়ই কোনো পাত্রে রাখতে হয়, কাজেই প্রসারণ সহল মাপতে চাইলে যখন তরলটিকে উদ্ধৃত করার চেষ্টা করা হয় তখন স্বাভাবিকভাবে পাত্রটিও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং পাত্রটিরও একটি প্রসারণ হয়। কাজেই পাত্রে তরল যে প্রসারণ দেখা যায় সেটা সত্যিকারের প্রসারণ না, সেটা হচ্ছে আপাত প্রসারণ। কাজেই প্রকৃত প্রসারণ বের করতে হলে পাত্রের প্রসারণের ব্যাপারটা সব সময়ই মনে রাখতে হবে। সাধারণত তরলের প্রসারণ কঠিন পদার্থের প্রসারণ থেকে বেশি হয়। যদি তা না হতো তাহলে আমরা আপাত প্রসারণটি হয়তো দেখতেই পেতাম না। মনে হতো আপাত সংকোচন।
তরল পদার্থের প্রসারণের সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হচ্ছে থার্মোমিটার। নানা রকম থার্মোমিটার রয়েছে, তার মধ্যে জ্বর মাপার থার্মোমিটার সম্ভবত তোমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত। থার্মোমিটারের গোড়ায় একটা কাচের টিউবে পারদ থাকে। তাপ দেওয়া হলে পারদের আয়তন বেড়ে যার এবং একটা খুব সরু নল বেয়ে উঠতে থাকে, কতদূর উঠেছে সেটা হচ্ছে তাপমাত্রার পরিমাপ। জ্বর মাপার সময় যেহেতু থার্মোমিটারকে বগল থেকে কিংবা মুখ থেকে বের করে তাপমাত্রা দেখতে হয় তখন যেন পারদের কলামটুকু কমে না যায় সেজন্য সরু নলটির গোড়ায় নলটিকে একটা খুব স বক্রতা রাখা হয়। এ কারণে একবার প্রসারিত হয়ে উপরে উঠে গেলে তাপমাত্রা কমে যাবার পরও নেমে আসতে পারে না বাঁকিয়ে নামাতে হয়|
আগেই বলা হয়েছে তরলকে সব সময় কোনো পাত্রে রেখে উত্তক্ত করতে হয়। তাপ দেওয়া হলে তরলটির সাথে সাথে পাত্রটিরও প্রসারণ হয়, তাই সত্যি সত্যি তরলের কতটুকু প্রসারণ হয়েছে সেটি বের করতে হলে পাত্রের প্রসারণটুকু বিবেচনায় রাখতে হয়। এটি বিবেচনায় না রেখে তরলের প্রসারণ বের করা হলে আমরা সেটাকে বলি আপাত প্রসারণ। পাত্রের প্রসারণটি বিবেচনায় রেখে তরলের প্রসারণ বের করা হলে সেটি হবে সত্যিকার প্রসারণ বা প্রকৃত প্রসারণ।
একটা সরু নলবিশিষ্ট কাচের বারে A দাগ পর্যন্ত ভরলে ভর্তি করে যদি বাল্বটিকে গরম করা হয় তাহলে আমরা দেখব প্রথমে তরলের উচ্চতা B তে নেমে এসেছে। এটি ঘটবে কারণ তাপ দেওয়ার পর তরলটির তাপমাত্রা বাড়ার আগে বাল্বটির তাপমাত্রা বেড়ে যাবে এবং তার প্রসারণ হবে, অর্থাৎ বাল্বটি একটুখানি বড় হয়ে যাবে।
যদি আমরা তারপরও তাপ দিতে থাকি তাহলে তরলটির উচ্চতা বাড়তে থাকবে। যেহেতু ভরলের প্রসারণ বেশি তাই আমরা দেখব তরলটি A থেকে অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত C উচ্চতায় পৌঁছেছে।
নলটির প্রস্থচ্ছেদকে দিয়ে যদি AB উচ্চতাকে গুণ দিই তাহলে আমরা পাত্রটির প্রসারণ () পাৰ। যদি BC উচ্চতাকে পুণ দিই তাহলে তরলের প্রকৃত প্রসারণ () পাব। এখানে আপাত প্রসারণ () হচ্ছে
কঠিন পদার্থের আকার আর আয়তন দুটিই আছে তাই তার প্রসারণ বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। তরলের নির্দিষ্ট আকার না থাকলেও তার আয়তন আছে, ভাই তার প্রসারণও আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি কিংবা মাপতে পারি । গ্যাসের বেলায় বিষয়টা বেশ মজার। তার কারণ তার নির্দিষ্ট আকার তো নেই-ই, তার নির্দিষ্ট আয়তনও নেই, গ্যাসকে যে পাত্রে ঢোকানো হবে গ্যাসটি সাথে সাথে সেই পাত্রের আয়তন নিয়ে নেবো একই পরিমাণ গ্যাস ভিন্ন ভিন্ন আয়তনের পাত্রে ঢোকানো হলে তার চাপ হয় ভিন্ন। কাজেই আমরা ঠিক করে নিতে পারি, যদি প্যালের আয়তন বৃদ্ধি মাপতে চাই তাহলে লক্ষ রাখতে হবে তার চাপের যেন পরিবর্তন না হয়।যেমন একটা সিলিন্ডারের পিস্টনের ওপর নির্দিষ্ট ওজনের কিছু একটা রাখা হয়, যেন এটা সব সময়ই সিলিন্ডারের আবদ্ধ গ্যাসকে সমান চাপ দেয়।
তরল কিংবা কঠিন পদার্থকে চাপ দিয়ে খুব বেশি সংকুচিত করা যায় না। কিন্তু গ্যাসকে খুব সহজে সংকুচিত করা যায়। তাই প্রথমেই আমাদের গ্যাসের চাপ আর আয়তনের মাঝে সম্পর্কটা জানা দরকার। এটাকে বলে আদর্শ গ্যাসের সূত্র এবং এটা হচ্ছে
এখানে P হচ্ছে চাপ, V হচ্ছে আয়তন, n হচ্ছে গ্যাসের পরিমাণ (মোলে মাপা) R একটি ধ্রুবক (8.314JK-1mol-1) এবং T হচ্ছে কেলভিন স্কেলে তাপমাত্রা।
এখন আমরা গ্যাসের জন্য প্রসারণ সহগ বের করতে পারি। একটা নির্দিষ্ট চাপে যদি T1 তাপমাত্রায় গ্যাসের আয়তন হয় V1 এবং T2 তাপমাত্রায় গ্যাসের আয়তন হয় V2 তাহলে গ্যাসের আয়তন প্রসারণ সহগ Ap হচ্ছে:
আমরা জানি
কাজেই
বাম পাশে এবং ডান পাশে দিয়ে ভাগ দিয়ে:
কাজেই
অর্থাৎ
কাজেই দেখতেই পাচ্ছ গ্যাসের প্রসারণের সহগ মোটেই কোনো ধ্রুব সংখ্যা নয়। এটা তাপমাত্রার বিপরীত () অর্থাৎ তাপমাত্রা যত কম হবে গ্যাসের প্রসারণ হবে তত বেশি। অন্যভাবে বলা যায় একটি নির্দিষ্ট চাপে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গ্যাসের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়ালে তার যেটুকু প্রসারণ হবে একই চাপে কিন্তু কম তাপমাত্রায় গ্যাসের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়ালে প্রসারণ হবে তার থেকে বেশি।
তোমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছ সব পদার্থ অণু দিয়ে তৈরি এবং কঠিন পদার্থে অণুগুলো নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে একে অন্যকে আটকে রাখে। তাপ দেওয়া হলে এগুলোর কম্পন বেড়ে যায় এবং আণবিক বন্ধন শিথিল হয়ে একে অন্যের ওপরট গড়াগড়ি খেয়ে নড়তে শুরু করে এবং এটাকে আমরা ৰলি তৱল। তাপমাত্রা যদি আরো বেড়ে যায় তখন অণুগুলো মুক্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে, তাকে আমরা বলি গ্যাস। এই ব্যাপারটি আমরা এখন আরেকটু গভীরভাবে দেখব এবং পদার্থের অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সম্পর্ক আছে এ রকম বিভিন্ন রাশির সাথে পরিচিত হব।
একটা কঠিন পদার্থকে যখন তাপ দেওয়া হয় তখন তার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। (কী হারে তাপমাত্রা বাড়বে এবং সেটা কিসের ওপর নির্ভর করে সেটা আমরা একটু পরেই জেনে যাব।) তাপমাত্রা (একটা নির্দিষ্ট চাপে) একটা নির্দিষ্ট মানে পৌঁছালে কঠিন পদার্থটি পলতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটার নাম গলন এবং যে তাপমাত্রায় গলন শুরু হয় সেটাকে বলে গলনাঙ্ক । আমরা যদি কঠিন পদার্থের তাপমাত্রা মাপতে থাকি তাহলে একটু অবাক হয়ে লক্ষ করব যখন পলন শুরু হয়েছে তখন তাপ দেওয়া সত্ত্বেও খানিকটা কঠিন খানিকটা তরলের এই মিশ্রণের তাপমাত্রা আর বাড়ছে না,এই সময়টিতে তাপ কঠিন পদার্থের অণুগুলোর ভেতরকার আন্তঃআণবিক বন্ধনকে শিথিল করতে ব্যয় হয়। তাই অণুগুলোকে আরো গতিশীল করতে পারে না বলে তাপমাত্রা বাড়তে পারে না। গলন চলাকালীন নির্দিষ্ট গলনাঙ্কে যে পরিমাণ তাপ দিয়ে পুরো কঠিন পদার্থকে তরলে রূপান্তর করতে হয় সেই ভাগকে বলা হয় গলনের সুপ্ততাপ।
একবার পুরো কঠিন পদার্থটি তরলে রূপান্তরিত হওয়ার পর তাপমাত্রা আবার বাড়তে শুরু করে তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে এক সময় তরল পদার্থটি গ্যাসে পরিবর্তন হতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটির নাম বাষ্পীভবন এবং যে তাপমাত্রায় বাষ্পীভবন ঘটে সেটাকে বলে স্ফুটনাঙ্ক। আবার সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই স্ফুটনাঙ্ক চাপের ওপর নির্ভর করে।
যখন বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন তরলের অণুগুলো তাপশক্তি নিয়ে পরস্পরের সাথে যে আণবিক বন্ধন আছে সেটা থেকে যুক্ত হতে শুরু করে। গলনের মতো এখানেও যদিও তাপ দেওয়া হয়, তাতে তরলের তাপমাত্রা কিন্তু বাড়ে না। তরলকে বাষ্পীভূত করার সময় যে পরিমাণ তাপ দিয়ে পুরো তরল পদার্থকে গ্যাসে পরিণত করা হয় সেই তাপকে বলা হয় বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ। পুরো তরলটা প্যাসে রূপান্তর করার পর তাপ দিতে থাকলে গ্যাসের তাপমাত্রা আবার বাড়তে থাকে। তাপমাত্রা মোটামুটি অচিন্তনীয় পর্যায়ে নিতে পারলে অণুগুলো আয়নিত হতে শুরু করবে এবং প্লাজমা নামে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা শুরু হবে, কিন্তু সেটি অন্য ব্যাপার।
তাপ দিয়ে কঠিন থেকে তরল এবং তরল থেকে প্যাসে রূপান্তরের এই প্রক্রিয়ার অন্তত একটি উদাহরণ আমরা সবাই দেখেছি, সেটি হচ্ছে বরফ, পানি এবং বাষ্প। আমরা যদিও সরাসরি গলনের সুপ্ততাপ কিংবা বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ দেখি না। কিন্তু তার একটা প্রভাব অনেক সময় অনুভব করেছি। অনেক ভিড়ে কিংবা আবদ্ধ জায়গায় গরমে ছটফট করে আমরা যদি হঠাৎ খোলা জায়গায় কিংবা বাতাসে আসি তখন শরীর শীতল হয়ে জুড়িয়ে যায়। তার কারণ খোলা জায়গায় আসার পর শরীর থেকে ঘাম বাষ্পীভূত হওয়ার সময় বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপটুকু শরীর থেকে নিয়ে নেয়। এবং শরীরটাকে শীতল করে দেয়।
তাপ দিয়ে কঠিন থেকে তরল, তরল থেকে গ্যাসে যে রকম রূপান্তর করা হয় তার উল্টো প্রক্রিয়াটিও কিন্তু ঘটে। ভাগ সরিয়ে নিলে একটা গ্যাস প্রথমে তরল, তারপর কঠিন হতে পারে। বায়বীয় অবস্থা থেকে তরল অবস্থায় রূপান্তরিত হওয়াকে ঘনীভবন (Liquification) বলে। তরল অবস্থা থেকে কঠিন অবস্থায় রূপান্তরিত হওয়াকে কঠিনীভবন (Solidification) বলে।
আমরা পদার্থের অবস্থানের পরিবর্তনের সময় বলেছি কঠিন থেকে তরল কিংবা তরল থেকে গ্যাসে রূপান্তরের জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পৌঁছাতে হয়। কিন্তু সেই তাপমাত্রায় না পৌঁছেও কিন্তু কঠিন থেকে তরল, তরল থেকে গ্যাস কিংবা সরাসরি কঠিন থেকে গ্যাসে রূপান্তর হতে পারে। আমরা যদি পদার্থের আণবিক মডেলে ফিরে যাই তাহলে বিষয়টা বোঝা মোটেও কঠিন নয়। একটা অণু যদি কোনোভাবে যথেষ্ট শক্তি পেয়ে যায় এবং তার কারণে যদি তার গতিশক্তি যথেষ্ট বেড়ে যায় যে সেটি কঠিন পদার্থ কিংবা তরল পদার্থের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের হয়ে আসতে পারে। কঠিন কিংবা তরলের পৃষ্ঠদেশে যেহেতু বাইরের বাতাস থেকে অসংখ্য অণু ক্রমাগত আঘাত করছে তাই তাদের আঘাতে কখনো কখনো কঠিন কিংবা তরলের কোনো কোনো অণু মুক্ত হয়ে যাবার মতো শক্তি পেয়ে যেতে পারে। তাই পৃষ্ঠদেশ যত বিস্তৃত হবে এই প্রক্রিয়াটি তত বেশি কাজ করবে। আমরা সবাই এই প্রক্রিয়াটি দেখেছি একটা ভেজা জিনিস এমনিতেই শুকিয়ে যায় এর জন্য এটাকে স্ফুটনাঙ্কের তাপমাত্রায় নিতে হয় না। শুকিয়ে যাওয়া মানেই তরল পদার্থের অণুর বাষ্পায়িত হয়ে যাওয়া। যেকোনো তাপমাত্রায় এই প্রক্রিয়া ঘটতে পারে এবং এই প্রক্রিয়াটার নাম বাষ্পায়ন (Evaporation)।
পানির বাষ্পায়নের সময় পানি যে রকম তার বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপটুকু নিয়ে নেয়, এর উল্টোটাও সত্যি। যদি কোনো প্রক্রিয়ায় বাষ্প পানিতে রূপান্তরিত হয় তখন সেটি তাপ সরবরাহ করে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রের জলীয় বাষ্পে ভরা বাতাস উপরে উঠে যখন জলকণায় রূপান্তরিত হয় তখন বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপটা শক্তি হিসেবে বের হয়ে আসে। এই শক্তিটা ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ড শক্তি হিসেবে কাজ করে।
তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ বর্ষাকালের বৃষ্টিভেজা দিনগুলোতে ভেজা কাপড় কিছুতেই শুকাতে চায় না। আবার শীতকালে ঘরের ভেতর ছায়াতেও একটা কাপড় ধুয়ে শুকাতে দিলে সেটি শুকিয়ে যায়। কাপড় ধুয়ে শুকাতে দিলে সব সময় কাপড়টি ভালো করে মেলে দিতে হয়, ভেজা কাপড় ভাঁজ হয়ে থাকলে সেই জায়গাটুকু ভেজা থেকে যায়। ভেজা কাপড় শুকানোর বিষয়টি পানির বাষ্পায়ন ছাড়া আর কিছু না, কাজেই তোমরা দেখতেই পাচ্ছ পানির বাষ্পায়ন বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সত্যি কথা বলতে কি পানির জন্য যেটা সত্যি অন্যান্য তরলের বেলাতেও সেটা সত্যি, তাই আমরা সাধারণভাবেই একটা তরলের বাষ্পায়ন কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে তার একটা তালিকা করতে পারি:
বাতাসের প্রবাহ: বাতাসের প্রবাহ বেশি হলে বাষ্পায়ন বেশি হয়।
তরলের উপরিভাগের ক্ষেত্রফল: তরলের উপরিভাগের ক্ষেত্রফল যত বেশি হবে বাষ্পায়ন তত বেশি হবে। এক গ্লাস পানি বাষ্পীভূত হতে অনেক সময় নেবে কিন্তু সেই পানিটা বড় থালায় ঢেলে দিলে অনেক তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে।
তরলের প্রকৃতি: তরলের স্ফুটনাঙ্ক কম হলে বাষ্পায়ন বেশি। উদ্বায়ী তরলের বাষ্পায়ন সবচেয়ে বেশি।
বাতাসের চাপ: বাতাসের চাপ যত কম হবে বাষ্পায়নের হার তত বেশি। শূন্যস্থানে বাষ্পায়ন সবচেয়ে বেশি, তাই খাদ্য সংরক্ষণের জন্য খাবারকে শুকাতে পাম্প দিয়ে বাতাস বের করে নেওয়া হয়।
উষ্ণতা: তরল এবং তরলের কাছাকাছি বাতাসের উষ্ণতা বেশি হলে বাষ্পায়ন বেশি হয়।
বায়ুর শুষ্কতা: বাতাস যত শুষ্ক হবে তরল তত তাড়াতাড়ি বাষ্পায়ন হবে।
তাপ, তাপমাত্রা এবং এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে এ রকম অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলেও, একটা বস্তুর তাপমাত্রা কতটুকু বাড়াতে হলে সেখানে কতটুকু তাপ দিতে হবে সেটি এখানো আলোচনা করা হয়নি। তোমরা হয়তো লক্ষ করে থাকবে খানিকটা পানিকে উত্তপ্ত করতে বেশ অনেকক্ষণ চুলার ওপর রেখে সেটাতে তাপ দিতে হয়। প্রায় সমপরিমাণ ধাতব কোনো বস্তুকে সেই একই তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করতে কিন্তু মোটেও বেশি সময় উত্তপ্ত করতে হয় না। এর কারণ পানির আপেক্ষিক তাপ বেশি সেই তুলনায় ধাতব পদার্থের আপেক্ষিক তাপ অনেক কম। 1 kg পদার্থের তাপমাত্রা 1 K বাড়াতে যে পরিমাণ তাপের প্রয়োজন সেটি হচ্ছে ঐ পদার্থের আপেক্ষিক তাপ। অর্থাৎ যদি m ভরের কোনো পদার্থকে T1 থেকে T2 তাপমাত্রায় নিতে Q তাপের প্রয়োজন হয় তাহলে আপেক্ষিক তাপ s হচ্ছে :
আপেক্ষিক তাপের একক
তাপ ধারণক্ষমতা C বলতে বোঝানো হয় একটা বস্তুর তাপমাত্রা 1K বাড়াতে কত তাপের প্রয়োজন। আপেক্ষিক তাপ হচ্ছে 1 kg ভরের তাপমাত্রা 1 K বাড়াতে কত তাপের প্রয়োজন। তাই বস্তুর আপেক্ষিক তাপ জেনে নিলে আমরা খুব সহজেই যেকোনো বস্তুর তাপ ধারণক্ষমতা C বের করতে পারব। কারণ বস্তুর ভর যদি m হয়, আপেক্ষিক তাপ s হয় তাহলে
10 kg সোনার তাপ ধারণক্ষমতা হচ্ছে
সে তুলনায় 10 kg পানির তাপ ধারণক্ষমতা
প্রায় 20 গুণ বেশি।
তার অর্থ সোনা কিংবা অন্য কোনো ধাতুকে চট করে উত্তপ্ত করা যায় কিন্তু পানিকে এত সহজে উত্তপ্ত করা যায় না।
শীতকালে গোসল করার সময় অনেক সময়ই আমরা বালভির ঠান্ডা পানিতে খানিকটা প্রায় ফুটন্ড পরম পানি ঢেলে দিই। ফুটন্ত গরম পানি বালতির শীতল পানিকে তাপ দিতে দিতে ঠান্ডা হতে থাকে। বালতির শীতল পানিও গরম ফুটন্ত পানি থেকে তাপ নিতে নিতে উত্তপ্ত হতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝে দেখা যায় উত্তপ্ত পানির তাপমাত্রা কমে এবং শীতল পানির তাপমাত্রা বেড়ে পুরো পানিটুকুই একটা আরামদায়ক উষ্ণতায় চলে এসেছে।
আমরা ইচ্ছে করলেই কোন পদার্থের কোন তাপমাত্রার কস্তুর সাথে অন্য কোন তাপমাত্রার কোন বস্তু মেশালে কে কতটুকু ভাগ দেবে বা নেবে এবং শেষ পর্যন্ত কত তাপমাত্রায় পৌঁছাবে এই বিষয়গুলো বের করে ফেলতে পারব। তা করতে হলে আমাদের শুধু কয়েকটা নিয়ম মনে রাখতে হবে:
(i) বেশি তাপমাত্রার বস্তু কম তাপমাত্রার বস্তুর কাছে তাপ দিতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না দুটো তাপমাত্রাই সমান হয়।
(ii) উত্তপ্ত বস্তু যতটুকু তাপ পরিত্যাগ করবে, শীতল বস্তু ঠিক ততটুকু তাপ গ্রহণ করবে। (আমরা ধরে নিয়েছি এই প্রক্রিয়াতে অন্য কোনোভাবে কোনো তাপ নষ্ট হচ্ছে না।)
চাপ দেওয়া হলে পদার্থের গলনাঙ্ক কমে যায়, তাই দুই টুকরা বরফকে চাপ দিয়ে এক টুকরো বরফে পরিণত করে ফেলা যায়। বরফের যেখানে চাপ পড়েছে সেখানে গলনাঙ্ক কমে যায় বলে বরফের তাপমাত্রাতেই সেখানকার বরফ গলে যায়, চাপ সরিয়ে নিলে গলনাঙ্ক আগের মান ফিরে পায় তখন গলে যাওয়া পানি আবার বরফে পাল্টে গিয়ে একটা বরফ খণ্ড হয়ে যায়। একটা বরফের ওপর একটা তার এবং তারের দুই পাশে দুটি ওজন ঝুলিয়ে দিলে মনে হবে তারটি বরফকে কেটে দুই টুকরো করে ফেলেছে, কিন্তু বরফটি পরীক্ষা করলে দেখা যাবে সেটি অখণ্ড এক টুকরো বরফই আছে I
চাপের কারণে স্ফুটনাঙ্কের পরিবর্তন হয়। চাপ কম হলে স্ফুটনাঙ্ক কমে যায়, চাপ বেশি হলে স্ফুটনাঙ্ক বেড়ে যায়। এজন্য যারা পর্বতারোহণ করে অনেক উচ্চতায় যায় তাদের রান্না করতে সময় বেশি নেয়। বাতাসের চাপ কম বলে সেখানে পানি তুলনামূলকভাবে কম তাপমাত্রায় ফুটতে থাকে। তাই তাপমাত্রা বাড়ানো যায় না, সেজন্য রান্না করতে সময় বেশি লাগে। একই কারণে প্রেশার কুকার তৈরি হয়েছে, এটি আসলে একটি নিশ্ছিদ্র পাত্র, তাই রান্না করার সময় বাষ্প আবদ্ধ হয়ে চাপ বাড়িয়ে দেয় এবং সে কারণে পানির স্ফুটনাঙ্ক বেড়ে যায় বলে বেশি তাপমাত্রায় পানি ফুটতে থাকে। তাপমাত্রা বেশি বলে রান্নাও করা যায় তাড়াতাড়ি ।
গ্যাসকে চাপ দিলে তার গলনাঙ্ক বেড়ে যায় তাই খুব বেশি শীতল না করেই চাপ বাড়িয়ে গ্যাসকে তরল করা যায়। তখন অবশ্য অনেক তাপের সৃষ্টি হয়, সেই তাপকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।
Read more