প্রথম সঙ্গীতি কোথায় অনুষ্ঠিত হয়?
অষ্টম অধ্যায়
সঙ্গীতি
বৌদ্ধ সঙ্গীতির সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সঙ্গীতি সম্পর্কে জ্ঞান ব্যতীত বৌদ্ধধর্মের প্রকৃত ইতিহাস জানা সম্ভব নয়। বুদ্ধ লিখিত আকারে কোনো ধর্মোপদেশ দেননি। তিনি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উপলক্ষে যেসব ধর্মোপদেশ করতেন তা তাঁর শিষ্যগণ স্মৃতিতে নিখুঁতভাবে ধারণ করে রাখতেন এবং মৌখিকভাবে প্রচার করতেন। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তাঁর শিষ্যগণ সেসব ধর্মোপদেশ সঙ্গীতি আহ্বানের মাধ্যমে প্রথমে সংকলন করেন। তারপর স্বধর্মের অনুসারী মহাকারুণিক ভিক্ষুগণ বিভিন্ন সময় সঙ্গীতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংকলিত বুদ্ধবাণীর বিশুদ্ধতা রক্ষা, গ্রন্থাকারে ও নানা উপায়ে সংরক্ষণ এবং প্রচারের ব্যবস্থা করেন। তাই বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে সঙ্গীতির ভূমিকা অনন্যসাধারণ। এ অধ্যায়ে আমরা বৌদ্ধ সঙ্গীতি সম্পর্কে অধ্যয়ন করব।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
* সঙ্গীতির ধারণা ও পটভূমি বর্ণনা করতে পারব;
* সঙ্গীতির মাধ্যমে বুদ্ধবাণী কীভাবে সংকলিত হয়েছিল তার ধারণা দিতে পারব;
* প্রথম, , দ্বিতীয় ও তৃতীয় সঙ্গীতি আহ্বানের কারণ ও ফলাফল বর্ণনা করতে পারব;
* বুদ্ধবাণী গ্রন্থাকারে সংকলিত হওয়ার ক্ষেত্রে সঙ্গীতির ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে পারব।
পাঠ : ১
সঙ্গীতির ধারণা
অভিধানে ‘সঙ্গীতি' শব্দের বিভিন্নরকম অর্থ পাওয়া যায়। যেমন : সঙ্গীত, গান, পাখির কূজন, প্রচার, ঘোষণা, পূর্বাভিনয় বা মহড়া, সভা বা সম্মেলন এবং সমবেতভাবে উচ্চারণ, আবৃত্তি, গীত, পুনরায় শ্রবণ বা বিবেচনা করা ইত্যাদি । বিভিন্ন রকম অর্থ পাওয়া গেলেও বৌদ্ধসাহিত্যে সঙ্গীতি শব্দটি সভা বা সম্মেলন বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। বুদ্ধের জীবিতকালে তাঁর ধর্ম-দর্শন এবং সঙ্ঘের বিধিবিধানসহ যে-কোনো বিষয়ে বিতর্ক বা সমস্যা দেখা দিলে তা বুদ্ধ নিজে বা তাঁর নির্দেশনায় নেতৃস্থানীয় শিষ্যগণ সমাধান করতেন। কিন্তু বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর এরূপ সকল সমস্যা পণ্ডিত ভিক্ষুসঙ্ঘ সমবেত হয়ে সভা বা সম্মেলন আহ্বানের মাধ্যমে সমাধান করতেন। জানা যায় যে, বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর বৌদ্ধ ধর্ম-সম্বন্ধীয় প্রশ্ন মীমাংসা, প্রকৃত বুদ্ধবাণী নির্ধারণ, সংকলন, সংরক্ষণ, বিশুদ্ধতা রক্ষা এবং প্রচার-প্রসারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে সঙ্গীতি নামে পরিচিত। অতএব সংক্ষেপে বলা যায়, সঙ্গীতি হলো ভিক্ষুসঙ্ঘের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী সভা বা সম্মেলন। এসব সভায় শত শত প্রবীণ, জ্ঞানী এবং অর্থৎ ভিক্ষু উপস্থিত থাকতেন। আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্ব অনুসারে এসব সম্মেলন কয়েকমাস ব্যাপী চলতো।
বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের তিনমাস পর বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা বুদ্ধবাণী পণ্ডিত বুদ্ধশিষ্যগণ এক সঙ্গীতি আহ্বান করে একত্রে সংকলন করেন। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে তা প্রথম সঙ্গীতি নামে পরিচিত। প্রথম সঙ্গীতিতে সংকলিত বুদ্ধবাণী ভিক্ষুগণ স্মৃতিতে ধারণ করে মৌখিকভাবে প্রচার করতেন। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক পর্যন্ত বুদ্ধবাণী এভাবে প্রচার করা হতো। মুখে-মুখে প্রচারিত হওয়ায় বা গ্রন্থাকারে সংরক্ষণ বা লিপিবদ্ধ না হওয়ায় বুদ্ধবাণী নিয়ে মাঝে মাঝে বিতর্ক দেখা দিত। এ ছাড়া, নানা কারণে বুদ্ধবাণী বিকৃতি ও পরিহানির সম্মুখীন হতো এবং সঙ্ঘের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি হতো। ভিক্ষুসঙ্ঘ সঙ্গীতি আহ্বানের মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধান করে বুদ্ধবাণী যথাযথভাবে রক্ষা করতেন। তাই বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে সঙ্গীতির গুরুত্ব অপরিসীম। কিংবদন্তি অনুসারে নয়টি সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানা যায় । তবে সঙ্গীতির সংখ্যা, অনুষ্ঠানের সময়কাল ও স্থান সম্পর্কে বিতর্ক লক্ষ করা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধগণ বিশ্বাস করেন যে, সর্বমোট ছয়টি সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তন্মধ্যে প্রথম তিনটি সঙ্গীতি ভারতবর্ষে, চতুর্থটি সিংহলে এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠটি মিয়ানমারে (বার্মায়) অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো কোনো সিংহলি (শ্রীলঙ্কার) তথ্য মতে, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিংহলে। তা ছাড়া, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সঙ্গীতি নিয়েও বিতর্ক আছে। যেমন, দ্বিতীয় সঙ্গীতির পর মহাসাঙ্খিকদের তত্ত্বাবধানে এক সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানা যায়। কিন্তু তা থেরবাদী গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায় না। আবার সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় যে তৃতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা মহাযান সূত্রে উল্লেখ নেই। মহাযান মতে, তৃতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয় সম্রাট কণিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীরের জলন্ধরে। থাইল্যান্ডের কিংবদন্তি মতে, প্রথম তিনটি সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতে, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তমটি সিংহলে এবং অষ্টম ও নবম সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল থাইল্যান্ডে। মহাবংস মতে, প্রথম তিনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতে, চতুর্থ ও পঞ্চম সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিংহলে। নানা বিতর্ক থাকলেও থেরবাদী বৌদ্ধগণ বিশ্বাস করেন, প্রথম তিনটি সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতে, চতুর্থটি সিংহলে, পঞ্চম এবং ষষ্ঠটি মিয়ানমারে (বার্মায়)। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এই ছয়টি সঙ্গীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বুদ্ধবাণী সংকলন এবং অদ্যাবধি বিশুদ্ধভাবে তা সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে এ ছয়টি সঙ্গীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এগুলোকে মহাসঙ্গীতিও বলা হয় ।
অনুশীলনমূলক কাজ সঙ্গীতি বলতে কী বোঝ ?
কিংবদন্তি অনুসারে মোট কয়টি সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল?
পাঠ : ২ সঙ্গীতির উদ্দেশ্য ও পটভূমি
ছয়টি সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। বুদ্ধবাণী সংকলন এবং বিশুদ্ধভাবে সংরক্ষণ করাই সঙ্গীতিসমূহের প্রধান উদ্দেশ্য হলেও এক এক সঙ্গীতির পটভূমি এক এক রকম। প্রথম সঙ্গীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর সুভদ্র নামক এক দুর্বিনীত ভিক্ষুর আচরণে সকলে শঙ্কিত হন। হিউয়েন-সাং-এর ভ্রমণ-বিবরণী এবং তিব্বতি গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, অধিকাংশ দুর্বিনীত ভিক্ষুর অভিপ্রায় ছিল সুভদ্রের মতো। ফলে মহাকশ্যপ স্থবির এবং অন্যান্য
নেতৃস্থানীয় বিনয়ী ভিক্ষুরা বুদ্ধশাসনের পরিহানির কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তাঁদের ধারণা, বুদ্ধের মৃতদেহ বর্তমান থাকতেই যদি এরূপ চিন্তা-চেতনার সূত্রপাত হয় তাহলে অচিরেই ভিক্ষুসঙ্ঘ বিনয়চ্যুত হয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে। বুদ্ধবাণী কলুষিত হবে। বিস্মৃত হয়ে হারিয়ে যাবে । ফলে বুদ্ধশাসন পরিহানির সম্মুখীন হবে। এরূপ চিন্তা করে ধর্ম-বিনয়ে শ্রদ্ধাশীল ভিক্ষুগণ বিভিন্ন বুদ্ধশিষ্য কৃতক স্মৃতিতে ধারণকৃত বুদ্ধবাণীসমূহ একত্রে সংকলন করে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন । অতপর, বুদ্ধবাণী সংকলন ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহায় প্রথম সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় সঙ্গীতির ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের একশত বছর পর বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুগণ সঙ্ঘে বিনয় বহির্ভূত দশটি বিধিবিধান চালু করেন। এ দশটি বিধি-বিধানকে 'দসবখুনী' বলা হয়। দ্বিতীয় সঙ্গীতি অধ্যায়ে আমরা দশবথুনী সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ব। বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুদের প্রবর্তিত দসবখুণী বিনয় সম্মত কিনা তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্দেশ্যে বৈশালীর বালুকারামে দ্বিতীয় সঙ্গীতি আহ্বান করা হয়েছিল।
তৃতীয় সঙ্গীতির ইতিহাস সমীক্ষায় দেখা যায়, সম্রাট অশোকের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে ব্যাপক প্রচার-প্রসার লাভ করে। তখন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লাভ-সৎকার বেড়ে যায় এবং তাঁরা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হন। ফলে অন্যান্য ধর্মের বহু তীর্থিক বা সন্ন্যাসী লাভ-সৎকারের আশায় মস্তক মুণ্ডন এবং পাত্র-চীবর ধারণ করে ভিক্ষু বলে পরিচয় দিতে থাকেন। তাঁরা অসদুপায় অবলম্বনপূর্বক বিহার ও মন্দির দখল করে বসবাস করতে থাকেন। তাঁরা ধর্মকে অধর্ম, অধর্মকে ধর্ম বলে প্রচার করতে থাকেন। এতে সঙ্ঘে যেমন অরাজকতা দেখা দেয় তেমনি প্রকৃত বুদ্ধবাণী নিয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়। প্রকৃত বুদ্ধবাণী নির্ধারণ এবং সঙ্ঘে বিরাজমান অরাজকতা বিদূরিত করার উদ্দেশ্যে পাটলীপুত্রের অশোকারাম বিহারে তৃতীয় সঙ্গীতি আহ্বান করা হয়েছিল ।
চতুর্থ সঙ্গীতির ইতিহাসপাঠে জানা যায় যে, সম্রাট অশোক-পুত্র মহেন্দ্র থের ও কন্যা সঙ্ঘমিত্রার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় বুদ্ধশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ভারতীয় তামিলরা শ্রীলঙ্কা দখল করে শাসন করতে থাকে। তারা বৌদ্ধ বিহার ও সংস্কৃতি ধ্বংস করতে থাকে। তাদের সঙ্গে সিংহলিদের সবসময় যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। অবশেষে সিংহলিদের সহায়তায় রাজা বট্টগামণী তামিলদের বিতাড়িত করে শ্রীলঙ্কার রাজ্যভার গ্রহণ করেন । রাজা বট্টগামণীর সুশাসনে শান্তি ফিরে আসতে থাকে এবং বৌদ্ধধর্ম নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হতে থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিন যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকার কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যুদ্ধবিগ্রহ ও দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষের মধ্যে ভোগবাদী মনোভাব সৃষ্টি হতে থাকে এবং মানুষ নীতিজ্ঞান হারাতে থাকে । বারবার বিদেশী আক্রমণে বৌদ্ধধর্ম পরিহানির সম্মুখীন হতে থাকে। তাছাড়া, মহাবিহার ও অভয়গিরি নিকায়ের দ্বন্দ্বের কারণে সঙ্ঘে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। সঙ্ঘে দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অধার্মিক ভিক্ষুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বহু অর্হৎ ভিক্ষু থাকলেও স্মৃতিতে ত্রিপিটক ধারণ করে রাখা ভিক্ষু সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে। এসব কারণে মৌখিকভাবে প্রচলিত বুদ্ধবাণীর বিকৃতি ও পরিহানির আশঙ্কা দেখা দেয়। অতপর রাজা বট্টগামণীর পৃষ্ঠপোষকতায় অট্ঠকথাসহ সমস্ত বুদ্ধবাণী তথা ত্রিপিটক লিপিবদ্ধ করে চিরস্থায়িত্ব দানের উদ্দেশ্যে সিংহলের আলু বিহারে (মতান্তরে আলোক বিহার) চতুর্থ সঙ্গীতি আহ্বান করা হয়েছিল। আলু বিহারে এই সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে এ সঙ্গীতিকে আলুবিহার সঙ্গীতিও বলে ।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে অনুষ্ঠিত এ সঙ্গীতিতে অট্ঠকথা সহ সমগ্র ত্রিপিটক তালপত্র বা ভূর্জপত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে মিয়ানমারের রাজা মিওনমিনের রাজত্বকালে মান্দালয়ে পঞ্চম সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয় ।
ত্রিপিটক তথা বুদ্ধবাণী মার্বেল পাথরে খোদাই করে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রেঙ্গুনের অনতিদূরে ‘কাবা আযে বিশ্বশান্তি প্যাগোডায়' পঞ্চম সঙ্গীতি আহ্বান করা হয়েছিল। উক্ত সঙ্গীতিতে মান্দালয় পর্বতে ত্রিপিটক ৭২৯ খানা মার্বেল পাথরে খোদিত করা হয়।
ত্রিপিটক বিভিন স্থানে বিভিন্ন লোকের দ্বারা লিখিত ও খোদিত হতে থাকে। এতে লেখক ও খোদাইকারীর প্রমাদবশত বুদ্ধবাণী ভুলভাবে উপস্থাপিত হতে থাকে। তাছাড়া বিদেশী শাসনের কারণে সমাজে দলাদলি ও ধর্মীয় ব্যাপারে শৈথিল্য দেখা দেয়। বুদ্ধবাণী যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য বুদ্ধশাসনের উন্নতি এবং দেশবিদেশে প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৯৫৪-১৯৫৬ সালে মিয়ানমারে ষষ্ঠ সঙ্গীতি আহ্বান করা হয় । উক্ত সঙ্গীতিতে সমগ্র ত্রিপিটক আবৃত্তি ও টেপ রেকর্ডে ধারণ করা হয়। এই সঙ্গীতিতে বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত ত্রিপিটকের গ্রন্থসমূহ তুলনামূলক আলোচনা করে পুনর্মুদ্রণের জন্য খসড়া তৈরি করা হয়।
উপরে বর্ণিত ছয়টি মহাসঙ্গীতির প্রেক্ষাপট বা পটভূমি ভিন্ন ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য প্রায়ই অভিন্ন। পরিশুদ্ধভাবে বুদ্ধবাণী সংকলন, সংকলনের ও প্রচার করাই সঙ্গীতিসমূহের অন্যতম উদ্দেশ্য।
অনুশীলনমূলক কাজ সঙ্গীতির প্রধান উদ্দেশ্য কী ? চতুর্থ সঙ্গীতির পটভূমি বর্ণনা কর পঞ্চম ও ষষ্ঠ সঙ্গীতি কোথায় এবং কী কারণে আহ্বান করা হয়েছিল? |
পাঠ : প্রথম সঙ্গীতি
প্রথম সঙ্গীতি আহ্বানের কারণ : প্রথম সঙ্গীতি আহ্বানের কারণ সম্পর্কে কোনো মতানৈক্য নেই। কথিত আছে, বুদ্ধের পরিনির্বাণের সময় মহাকশ্যপ স্থবির কুশীনগরে ছিলেন না। তিনি পাবা থেকে কুশীনগর যাওয়ার পথে বুদ্ধের পরিনির্বাণের কথা জানতে পারেন। তিনি আরও শুনলেন যে, সুভদ্র নামক এক অবিনীত বৌদ্ধ ভিক্ষুর উক্তিতে পণ্ডিত ও বিনয়ী ভিক্ষুরা বুদ্ধশাসনের পরিহানি আশঙ্কা করে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। অনেক দুর্বিনীত ভিক্ষু বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণে খুশি হন। কারণ বুদ্ধের অবর্তমানে তাঁরা যথেচ্ছভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন। মহাকশ্যপ স্থবির কুশীনগরে পৌঁছে দুর্বিনীত ভিক্ষুদের অভিপ্রায় শুনে বিস্মিত এবং শঙ্কিত হন। কারণ বুদ্ধ লিখিতভাবে কোনো ধর্মোপদেশ দান করেননি। তাঁর ধর্মোপদেশসমূহ শিষ্যগণ কণ্ঠস্থ করে প্রচার করতেন। মহাকশ্যপ স্থবির এবং অন্যান্য নেতৃস্থানীয় বিনয়ী ভিক্ষুগণ চিন্তা করলেন, বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকলে বা বিভিন্ন জন কর্তৃক কণ্ঠস্থ থাকলে বুদ্ধবাণী কলুষিত ও বিকৃত হতে পারে।
বিস্মৃত হয়ে হারিয়ে যেতে পারে। অন্যজনের বাণীও বুদ্ধবাণী হিসেবে প্রচারিত হতে পারে। এরূপ হলে বুদ্ধশাসনের পরিহানি ঘটবে। এসব চিন্তা করে মহাকশ্যপ স্থবির এবং ধর্ম-বিনয়ে শ্রদ্ধাশীল ভিক্ষুগণ বুদ্ধবাণী সংকলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তাই প্রথম সঙ্গীতি আহ্বান করা হয়েছিল।
প্রথম সঙ্গীতির সময়কাল, স্থান ও পৃষ্ঠপোষকতা : প্রথম সঙ্গীতির সময় ও স্থান নিয়ে কিছুটা মতভেদ লক্ষ করা যায়। তবে অধিকাংশ বৌদ্ধ ঐতিহ্য মতে, বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের তিনমাস পর রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহায় প্রথম সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল । রাজা অজাতশত্রু এ-সঙ্গীতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন । রাজা অজাতশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় গুহার সামনে বিশাল মণ্ডপ তৈরি করা হয় । এতে দক্ষিণমুখী ও উত্তরমুখী করে পাঁচশো স্থবিরের আসন সজ্জিত করা হয়। মণ্ডপের মধ্যভাগে পূর্বমুখী করে ধর্মাসন নির্মাণ করা হয় ।
সঙ্গীতিকারক নির্বাচন : মহাকশ্যপ স্থবির সর্বসম্মতিক্রমে প্রথম সঙ্গীতির সভাপতি নির্বাচিত হন। এতে স্থির হয় যে সঙ্ঘায়নে অংশগ্রহণকারী সকল ভিক্ষু অর্থৎ হবেন। অতঃপর, বৌদ্ধধর্মে পণ্ডিত পাঁচশো জন অর্থৎ ভিক্ষু নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আনন্দ স্থবিরকে প্রথমে নির্বাচন করা হয় নি। কারণ তিনি তখনও অর্থত্বে উন্নীত হন নি। ফলে তাঁকে বাদ দিয়ে চারশো নিরানব্বই জন ভিক্ষু নির্বাচন করা হয়। কিন্তু তার জন্য একটি আসন খালি রাখা হয়। কারণ তিনি বুদ্ধের সেবক এবং শ্রুতিধর ছিলেন। বুদ্ধের সকল ধর্মোপদেশ তিনি ধারণ করে রাখতেন। তাঁর গুণাবলি সম্পর্কে বুদ্ধশিষ্যগণ অবহিত ছিলেন এবং সকলে তাঁর উপস্থিতি কামনা করছিলেন। সঙ্গীতি আরম্ভের ঠিক আগে আনন্দ স্থবির অর্হত্ব প্রাপ্ত হন। অতপর, তিনি ঋদ্ধিবলে সঙ্গীতি মণ্ডপে প্রবেশ করে নিজ আসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁকে নিয়ে পাঁচশো জন পূর্ণ হলে সঙ্গীতির কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়।
প্রথম সঙ্গীতির কার্যক্রম : মহাকশ্যপ নিজেই প্রশ্নকর্তা নিযুক্ত হন। প্রথমে বিনয় সঙ্ঘায়ন করা হবে বলে স্থির করা হলো। উপালি ধর্মাসন অলঙ্কৃত করেন। মহাকশ্যপ স্থবির সঙ্ঘের সম্মতি অনুসারে উপালি স্থবিরকে বিনয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। প্রথমে, চারি পারাজিকা কখন প্রজ্ঞাপ্ত হয়, কাকে উপলক্ষ করে প্রজ্ঞাপ্ত হয়, কোথায় প্রজ্ঞাপ্ত হয়, মূল প্রজ্ঞপ্তি ও অনুপ্রজ্ঞপ্তি প্রভৃতি সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। উপালি স্থবির সব প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। এভাবে তেরোটি সঙ্ঘাদিসেস, দু'টি অনিয়ত, চারি পটিদেসনীয়া ধর্ম, ত্রিশটি নিস্সগিয়, বিরানব্বইটি পাচিত্তিয় প্রভৃতি একে একে আবৃত্তি করে স্থির করা হয়। তৎপর উভয় বিভঙ্গ, মহাবগ্গ, চূল্লবগ্গ ও পরিবার পাঠো আবৃত্তি করা হয়। উপস্থিত সঙ্গীতিকারক ভিক্ষুগণ উপালি স্থবিরের বিনয় আবৃত্তি গভীর মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তাঁরা সর্বসম্মতি ক্রমে উপালি কর্তৃক দেশিত বিনয় অনুমোদন করেন । এছাড়া ‘ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র’ শিক্ষাপদ নিয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ বুদ্ধ জীবিত থাকতে এসব বিষয়ে ভিক্ষুরা ইচ্ছা করলে পরিবর্তন করতে পারবেন বলেছিলেন । পাঁচশো অর্থৎ ভিক্ষুর অনুমোদন লাভের পর বিনয় সঙ্ঘায়ন শেষ হয় । বিনয় বুদ্ধশাসনের আয়ুস্বরূপ। তাই ধর্ম ও বিনয়ের মধ্যে বিনয় আগে সংগৃহীত হয় ।
তারপর বিনয়ের মতো ধর্ম (বা সুত্ত) আবৃত্তির জন্য আনন্দ স্থবিরকে আহ্বান করা হয়। আনন্দ স্থবির ধর্মাসনে বসেন। মহাকশ্যপ স্থবির প্রশ্নকর্তার আসনে বসে শ্রুতিধর আনন্দ স্থবিরকে ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। প্রথমে 'ব্রহ্মজাল সূত্র' কোথায় দেশিত হয়েছিল, কাকে উপলক্ষ করে দেশিত হয়েছিল প্রশ্ন করা হয়। তারপর, ব্রহ্মজাল সূত্রের নিদান, পুগ্গল প্রভৃতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। তারপর শ্রামণ্যফল সূত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। আনন্দ স্থবির প্রতিটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করেন। এভাবে দীর্ঘনিকায়, মজ্জিম নিকায়, সংযুক্ত নিকায়, অঙ্গুত্তর নিকায় এবং খুদ্দকনিকায় আবৃত্তি করা হয়। পাঁচশো অর্থৎ ভিক্ষুর অনুমোদন লাভের পর সূত্র বা ধর্ম সঙ্ঘায়ন শেষ হয়। প্রথম মহাসঙ্গীতি সম্পন্ন হতে চার মাস সময় লেগেছিল । পাঁচশো অর্থৎ দ্বারা প্রথম সঙ্গীতি সম্পন্ন হয়েছিল বলে একে পঞ্চশতিকা সঙ্গীতিও বলা হয় ।
প্রথম সঙ্গীতির ফলাফল : পাঁচশো অর্থৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে মহাকশ্যপ স্থবিরে সভাপতিত্বে এবং উপালি
ও আনন্দ স্থবিরের দেশনায় বুদ্ধবাণী ধর্ম-বিনয় হিসেবে সংকলিত বা সংগৃহীত হয়।
অনুশীলনমূলক কাজ প্রথম সঙ্গীতি আহ্বানের কারণ কী? আনন্দ স্থবিরকে প্রথমে কেন সঙ্গীতিকারক হিসেবে নির্বাচন করা হয়নি? প্রথম সঙ্গীতিতে উপালি থের কী আবৃত্তি করেন? |
পাঠ : ৪ দ্বিতীয় সঙ্গীতি
দ্বিতীয় সঙ্গীতি আহ্বানের কারণ : বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের একশো বছর পর বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুগণ সঙ্ঘে বিনয়-বহির্ভূত দশটি বিধিবিধান বা দশবথুনী প্রচলন করেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা উপোসথ দিবসে ভিক্ষুসঙ্ঘের মধ্যখানে পানি ভর্তি তাম্রপাত্র রেখে উপাসক-উপাসিকাদের কহাপণ (স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা) প্রদানের জন্য অনুরোধ করতেন। তাঁরা অন্যান্য বিনয়ধর ভিক্ষুদের এ দশটি বিনয় বহির্ভূত বিধানকে সমর্থন জানানোর জন্য অনুরোধ করেন। তাঁরা যশ স্থবিরকে উপঢৌকন দিয়ে বশে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু যশ স্থবির বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুদের বিনয় বহির্ভূত ও সঙ্ঘ পরিপন্থী গর্হিত আচরণ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানান । বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুগণ তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। তখন তিনি বজ্জি ভিক্ষুদের বিনয় বহির্ভূত কর্ম হতে নিবৃত্ত করার জন্য বিনয়ী ভিক্ষু ও ধার্মিক লোকদের অনুরোধ করেন। এতে বজ্জিপুত্ৰীয় ভিক্ষুগণ ক্ষুব্ধ হয়ে যশ স্থবিরকে ‘পটিসারণীয কম্ম' প্রদান করেন। অর্থাৎ পুনরায় মিলনের বা বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্য আহ্বান জানান। যশ স্থবির দুর্বিনয়ী ভিক্ষুদের কথায় কর্ণপাত না করে ধর্মকে রক্ষা করার জন্য বৈশালীবাসীদের অনুরোধ জানান। এতে বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ‘উখেপনী দণ্ড’ প্রদানপূর্বক তাঁকে সঙ্ঘ হতে বহিষ্কার করেন। যশ স্থবির এ সমস্যা সমাধানের জন্য ক্রমান্বয়ে বিনয়ী ভিক্ষুদের আহ্বান করেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিনয়ী ভিক্ষুগণ বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুদের প্রচলিত দসবথুনী বা দশটি বিধিবিধান বিনয়সংগত কি না এ-সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় সঙ্গীতি আহ্বান করেন। দশটি বিধিবিধান বা দশবথুনী হলো নিম্নরূপ :
১. ভিক্ষুগণ ইচ্ছা করলে সিং-এর মধ্যে লবণ জমা রেখে প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু
পাতিমোক্ষের পঁয়ত্রিশ নং পাচিত্তিয়া অনুসারে ভিক্ষুগণ তা করতে পারেন না। মধ্যাহ্নের পর সূর্যের ছায়া দুই আঙুল হেলে পড়লেও ভিক্ষুগণ খাদ্য গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু
২. পাতিমোক্ষের নিয়ম অনুসারে ভিক্ষুগণ মধ্যাহ্নের পর ভোজন করতে পারেন না।
৩. ভিক্ষুগণ একবার ভোজন করে পুনরায় অন্য গ্রামে গিয়ে ভোজন করতে পারবেন। কিন্তু পাতিমোক্ষের পঁয়ত্রিশ নং পাচিত্তিয়া অনুসারে ভিক্ষুগণ তা করতে পারেন না । এক সীমাভুক্ত ভিন্ন ভিন্ন আবাসের ভিক্ষুগণ পৃথক পৃথকভাবে উপোসথ পালন করতে পারবেন । কিন্তু
8. এটি সীমা ও আবাস-সম্পর্কীয় বিধির পরিপন্থী ।
৫. অনুপস্থিত ভিক্ষুর অনুমতি পরে নেওয়া হবে এরূপ চিন্তা করে ভিক্ষুগণ বিনয়কর্ম সম্পাদন করতে পারবেন। কিন্তু এটি সঙ্ঘবিধির পরিপন্থী।
৬. বিধিবিধানের আলোকে বিচার না করে পরম্পরা প্রচলিত আচার বা প্রথাকে ভিক্ষুগণ মান্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু বৌদ্ধমতে, কোনো বিষয় সঠিক এবং বিনয়সম্মত না হলে পরম্পরা প্রচলিত হয়ে আসলেও গ্রহণ করা যায় না ।
৭. ভিক্ষুগণ বিকালে দুধ ও দধির মধ্যবর্তী অবস্থার পানীয় বা ঘোল জাতীয় তরল পদার্থ পান করতে পারবেন। কিন্তু এটি পাতিমোক্ষের পঁয়ত্রিশ নং পাচিত্তিয়া বিধির পরিপন্থী ।
৮. ভিক্ষুগণ ইচ্ছা করলে তাড়ি জাতীয় পানীয় পান করতে পারবেন। কিন্তু এটি পাতিমোক্ষের একান্ন নং পাচিত্তিয়া বিধির পরিপন্থী।
৯. ভিক্ষুগণ ইচ্ছা করলে ঝালরযুক্ত কম্বল ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু এটি পাতিমোক্ষের উননব্বই নং পাচিত্তিয়া বিধির পরিপন্থী ।
১০. ভিক্ষুগণ ইচ্ছা করলে সোনা, রুপা বা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত দ্রব্য গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু এটি পাতিমোক্ষের আঠার নং নিসীয় বিধির পরিপন্থী ।
দ্বিতীয় সঙ্গীতির সময়কাল, স্থান ও পৃষ্ঠপোষকতা :
বুদ্ধের পরিনির্বাণের একশো বছর পরে দ্বিতীয় সঙ্গীতি আহ্বান করা হয়। তখন ছিল রাজা কালাশোকের রাজত্বকাল। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বৈশালীর বালুকারামে দ্বিতীয় মহাসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ।
সঙ্গীতিকারক নির্বাচন ও কার্যক্রম : বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুগণ যশ স্থবিরকে দণ্ডপ্রদান করে সঙ্ঘ হতে বহিষ্কার করলে তিনি তাঁর জন্মভূমি কোশাম্বীতে অবস্থান নেন। সেখান থেকে তিনি বিনয়ী ভিক্ষুদের খবর প্রদান করে একত্রিত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি পশ্চিম ভারতের অবন্তি ও পাঠেয়া অঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের ভিক্ষুদের নিকট খবর প্রেরণ করেন এবং নিজে অহোগঙ্গ পর্বতে অবস্থানকারী মহামান্য সম্ভূত সানবাসী ভিক্ষুর নিকট গমন করেন। স্থবির সম্ভূত সানবাসী মহাতার্কিক এবং পণ্ডিত ছিলেন। তিনি দসবথুনী সম্পর্কে
যশ স্থবিরের অভিমত সমর্থন করেন। এ-সময় খবর পেয়ে পশ্চিম ভারত হতে ষাটজন এবং দক্ষিণ
ভারত হতে আটাশি (৮৮) জন অর্থৎ ভিক্ষু অহোগঙ্গ পর্বতে পৌঁছে সম্ভূত সানবাসীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা সকলে উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, দসবথুনী সম্পর্কে মীমাংসা না হলে ভবিষ্যতে বুদ্ধশাসনের ক্ষতি হতে পারে। তাঁরা সম্ভূত সানবাসীর পরামর্শে রেবত স্থবিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে দসবথুনী সম্পর্কে অবহিত করেন। রেবত স্থবির সমস্ত দসবথুনী বিচার বিশ্লেষণ করে বিনয় বহির্ভূত বলে রায় দেন এবং বলেন বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুদের তা পরিত্যাগ করা উচিত।
এ সময় বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুগণও নিজেদের পক্ষে লোক সংগ্রহের চেষ্টা চালাতে থাকেন। তাঁরাও রেবত স্থবিরকে স্বপক্ষে আনবার জন্য মহামূল্যবান উপঢৌকন প্রেরণ করেন। রেবত স্থবির তা প্রত্যাখ্যান করে তাঁদের দসবথুনী তথা বিনয়ের পরিপন্থী আচরণ ত্যাগ করতে উপদেশ প্রদান করেন। তখন তাঁরা রেবত স্থবিরের শিষ্য উত্তরের সহযোগিতা লাভের চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু তাতেও তাঁরা ব্যর্থ হন। অতঃপর উপস্থিত ভিক্ষুগণ রেবত স্থবিরের পরামর্শে বৈশালীতে গিয়ে বিবাদ মীমাংসা করার জন্য সঙ্গায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সঙ্গায়ন করার উদ্দেশ্যে ত্রিপিটকধর প্রতিসম্ভিদাপ্রাপ্ত সাতশো অর্থৎ ভিক্ষু নির্বাচন করে বৈশালীর বালুকারামে সমবেত হন। সেখানে দুই পক্ষের ভিক্ষুদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়। অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে আটজন ভিক্ষুর সমন্বয়ে একটি কার্যকারক সভা গঠন করা হয়। এ সভায় পূর্ব ভারত হতে চারজন এবং পশ্চিম ভারত হতে চারজন ভিক্ষু অংশগ্রহণ করেন। কার্যকারক সভার আটজন ভিক্ষু হলেন : সব্বকামী, খুজ্জশোভিত, সাস্হ, বস্ভ, রেবত, সম্ভূত সানবাসী, যশ এবং সুমন স্থবির। এই আটজন মহাপণ্ডিত ভিক্ষুর দ্বারা গঠিত কারক সভায় 'দসবথুনী' পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করা হয় এবং দসবথুনী বিনয় সম্মত নয় বলে ঘোষণা করা হয়। চূল্লবগ্গ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, উক্ত সভায় রেবত থের সভাপতিত্ব করেন এবং সব্বকামী থের ধর্মাসন অলংকৃত করেন। প্রথম সঙ্গীতির অনুকরণে সমস্ত কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়। এই সঙ্গীতি আট মাস চলেছিল। প্রথম সঙ্গীতিতে সংগৃহীত বুদ্ধবাণী পুনরায় আবৃত্তি করে এ সঙ্গীতিতে ধর্ম-বিনয় হিসেবে সংগৃহীত হয়। সাতশো অর্থৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে এ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে এর নাম সপ্তশতিকা মহাসঙ্গীতি। ভিক্ষুদের প্রতিপালনীয় বিনয় প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়ায় এ সঙ্গীতিকে বিনয় সঙ্গীতিও বলা হয়।
দ্বিতীয় সঙ্গীতির ফলাফল : এই সঙ্গীতিতে বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুদের প্রবর্তিত দসবথুনী বিনয়সম্মত নয় বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রথম সঙ্গীতিতে সংগৃহীত বুদ্ধবাণী প্রকৃত বুদ্ধবাণী হিসেবে অনুমোদিত হয় এবং তা পুনরায় আবৃত্তি করে ধর্ম-বিনয় হিসেবে সংগৃহীত হয়। দ্বিতীয় মহাসঙ্গীতির এই সিদ্ধান্ত এক দল মেনে নিতে পারেননি। তাঁদেরকে সঙ্ঘ হতে বহিষ্কার করা হয়। তাঁদের সংখ্যাও অনেক। তাঁরা নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে থাকেন। ফলস্বরূপ তাঁরা আর একটি সঙ্গীতির আয়োজন করেন। কথিত আছে যে, সে সঙ্গীতিতে দশ হাজার ভিক্ষু উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গীতি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। দ্বিতীয় সঙ্গীতির পর ভিক্ষুসঙ্ঘ ‘স্থবিরবাদী' ও 'মহাসাঙ্গিক' এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
অনুশীলনমূলক কাজ “দসবথুনী' কী? দ্বিতীয় সঙ্গীতির কার্যকারক সভার সদস্যদের নাম লেখ দ্বিতীয় সঙ্গীতিকে কেন সপ্তশতিকা সঙ্গীতি বলা হয়? |
পাঠ : ৫ তৃতীয় সঙ্গীতি
তৃতীয় সঙ্গীতি আহ্বানের কারণ : সম্রাট অশোকের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে ব্যাপক প্রচার-প্রসার লাভ করে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লাভ-সৎকার বেড়ে যায় এবং তাঁরা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হন। ফলে অন্যান্য ধর্মের বহু তীর্থিক বা সন্ন্যাসীগণ লাভ-সৎকারের আশায় মস্তক মুণ্ডন এবং পাত্র-চীবর ধারণ করে ভিক্ষু বলে পরিচয় দিতে থাকেন। তাঁরা অসদুপায় অবলম্বনপূর্বক বিহার ও মন্দির দখল করে বসবাস করতে থাকেন এবং ধর্মকে অধর্ম, অধর্মকে ধর্ম বলে প্রচার করতে থাকেন। যেখানে-সেখানে ছদ্মবেশী ভিক্ষুরা গিয়ে উৎপাত করতে থাকেন। তাঁদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। তাঁদের বিনয় বহির্ভূত আচরণে বিনয়ী ভিক্ষুরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ফলে সঙ্ঘে অরাজকতা দেখা দেয়। এ ছাড়াও সে সময় বৌদ্ধসঙ্ঘ প্রায় আঠারোটি নিকায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তারা প্রত্যেকে নিজেদের বুদ্ধের মতবাদের প্রকৃত অনুসারী বলে দাবি করতে থাকেন। ফলে কোনটি বুদ্ধের প্রকৃত মতবাদ তা নির্ণয় করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া, এক নিকায়ের ভিক্ষু অন্য নিকায়ের ভিক্ষুর সঙ্গে বসবাস ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন, বিনয়ী ভিক্ষুগণ ছন্দবেশী অবিনয়ী ভিক্ষুদের সঙ্গে উপোসথ, প্রবারণা প্রভৃতি বিনয়কর্ম সম্পাদন করতে অস্বীকৃতি জানান। এসব অরাজক পরিস্থিতিই তৃতীয় সঙ্গীতি আহ্বানের অন্যতম কারণ ।
তৃতীয় সঙ্গীতির সময়কাল, স্থান ও পৃষ্ঠপোষকতা :
সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে মগধের রাজধানী পাটলীপুত্রের অশোকারামে তৃতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। সম্রাট অশোক এ সঙ্গীতিতে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাছাড়া সঙ্গীতি সমাপ্ত হলে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য তিনি বিভিন্ন দেশে ধর্মদূত প্রেরণ করেন ।
সঙ্গীতিকারক নির্বাচন ও কার্যক্রম : প্রকৃত বিনয়ী ভিক্ষুরা ছদ্মবেশী অবিনয়ী ভিক্ষুদের সঙ্গে উপোসথ, প্রবারণা ও পাতিমোক্ষ আবৃত্তি প্রভৃতি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে অস্বীকৃতি জানালে পাটলীপুত্র নগরের উপরে বর্ণিত ধর্মানুষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকে। তখন অধার্মিক ভিক্ষুরা চক্রান্ত করে সম্রাট অশোকের নিকট হতে উপোসথ করবার জন্য আদেশ জারি করালেন। তাতেও ধার্মিক ভিক্ষুরা উপোসথ পালন করতে রাজি হলেন না । ফলে অনভিজ্ঞ মন্ত্রীর আদেশে বহু ধার্মিক ভিক্ষুকে হত্যা করা হয় । সম্রাট অশোক এ-খবর জ্ঞাত হয়ে খুবই মর্মাহত হন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, তাঁর উদাসীনতার কারণে অনেক ভিক্ষুর প্রাণ সংহার হলো। এ পাপ কার্যের জন্য তিনি দায়ী কি না তা জানার জন্য মন্ত্রীকে প্রেরণ করে অহোগঙ্গ পর্বত হতে বৌদ্ধধর্মে পারঙ্গম মহাপণ্ডিত মোগলীপুত্র তিষ্য স্থবিরকে আনয়ন করেন। মোগলীপুত্র তিষ্য স্থবির সম্রাট অশোককে জানালেন যে, পাপ চেতনা না থাকলে সেই কার্যে কোনো অপরাধ হয় না। অতঃপর, সম্রাট অশোক তাঁর নিকট সপ্তাহব্যাপী বুদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে পাঠ গ্রহণ করেন । তিনি মোগলীপুত্র তিষ্য স্থবিরের পরামর্শে এক এক জন ভিক্ষুকে পর্দার অন্তরালে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি “কোন মতবাদী।” ছদ্মবেশী অবিনয়ী ভিক্ষুরা কেহই এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। কেবল বিনয়ী ভিক্ষুরা এক বাক্যে বললেন যে, তাঁরা “বিভাজ্যবাদী”। তখন সম্রাট অশোক বুঝতে পারলেন, কারা প্রকৃত ভিক্ষু। তিনি অবিনয়ী ছদ্মবেশী ভিক্ষুদের শ্বেতবস্ত্র পরিধানপূর্বক সঙ্ঘ হতে বহিষ্কার করেন।
জানা যায় যে, তাঁদের সংখ্যা ষাট হাজারের অধিক। অতঃপর, সম্রাট অশোক বিনয়ী ভিক্ষুদের বলেন, “ভন্তে ! এখন সঙ্ঘ বিশুদ্ধ হয়েছে। ভিক্ষুসঙ্ঘ উপোসথ কর্ম সম্পাদন করুন।” তৎপর বিশুদ্ধ সঙ্ঘ একত্রিত হয়ে অশোকারাম বিহারে উপোসথ কর্ম সম্পাদন করেন।
সঙ্ঘ বিশুদ্ধ হওয়ার পর মোগ্গলীপুত্র তিষ্য স্থবির প্রকৃত বুদ্ধবাণী সংকলনের জন্য তৃতীয় সঙ্গীতি আহ্বান করেন। তিনি সঙ্গীতির জন্য ধর্ম-বিনয়ে পরদর্শী ত্রিবিদ্যাসম্পন্ন এক হাজার অর্থৎ ভিক্ষু নির্বাচন করেন। এ সঙ্গীতিতে মোগলীপুত্র তিষ্য স্থবিরের সভাপতিত্বে প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতির অনুকরণে ধর্ম-বিনয় সংগৃহীত হয়। এই সঙ্গীতিতে মোগলীপুত্র তিষ্য স্থবির ‘কথাবন্ধু' নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটিতে অন্যান্য মতবাদীদের মতামত খণ্ডন করে বিভাজ্যবাদীদের মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। বুদ্ধবাণীর সারমর্ম প্রতিফলিত হওয়ায় গ্রন্থটি অভিধর্ম পিটকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নয় মাস ব্যাপী চলে এ সঙ্গীতি। স্মৃতিধর অর্হৎ ভিক্ষুগণ শুদ্ধ বুদ্ধবাণী পুনরায় স্মৃতিতে ধারণ করে নেন। এই সঙ্গীতিতে সর্বপ্রথম অভিধর্ম পিটকের উল্লেখ করা হয় এবং বুদ্ধবচনকে 'ত্রিপিটক' আখ্যা দেওয়া হয়।
ধর্মপ্রচারক প্রেরণ : এই সঙ্গীতির পরেই মহামতি অশোক ভিক্ষুসঙ্ঘকে দেশবিদেশে ধর্ম প্রচারের জন্য প্রেরণ করেন। তিনি ধর্মপ্রচারের জন্য ‘ধর্ম মহাপাত্র' নামে বিশেষ শ্রেণির রাজকর্মচারীও নিযুক্ত করেন। তাঁরা নগরে প্রান্তরে সর্বত্র ধর্মনীতি প্রচার করতেন। তিনি স্বীয় পুত্র ও কন্যা যথাক্রমে মহেন্দ্র স্থবির ও ভিক্ষুণী সঙ্ঘমিত্রাকেও ধর্মপ্রচারের জন্য প্রেরণ করেন। তৃতীয় সঙ্গীতির পর সম্রাট অশোক যেসব দেশে ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করেন তা তুলে ধরা হলো :
সঙ্গীতিকারক সব ভিক্ষু এক বাক্যে স্বীকার করে নেন যে, প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতিতে গৃহীত ধর্ম
বিনয়সমূহ তথাগত বুদ্ধের মুখনিঃসৃত বাণী ও উপদেশ । প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতিতে যে ধর্ম-বিনয় আবৃত্তি ও গৃহীত হয়েছিল সেগুলো তৃতীয় সঙ্গীতিতে আবার অনুমোদিত হয়। ৩.
8. তৃতীয় সঙ্গীতিতে প্রথম সঙ্গীতিতে আবৃত্তিকৃত বিনয়কে ঠিক রেখে ধর্মকে দুভাগে ভাগ করে সূত্র ও অভিধর্ম নামে আখ্যায়িত করা হয়। ফলে বুদ্ধবাণী মোট তিন ভাগে বিভক্ত হয়। যথা-বিনয়, সুত্ত ও অভিধর্ম। এ তিনটি সংকলনের পর নামকরণ করা হয় ত্রিপিটক ।
অনুশীলনমূলক কাজ
কতজন অর্হৎ ভিক্ষু তৃতীয় সঙ্গীতিতে অংশগ্রহণ করেন? তৃতীয় সঙ্গীতিতে কোন কোন স্থানে ধর্মপ্রচারক প্রেরিত হয়েছিল? তার একটি তালিকা প্রস্তুত কর।
পাঠ : ৬
বুদ্ধবাণী গ্রন্থাকারে সংকলনে সঙ্গীতির ভূমিকা
বুদ্ধ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উপলক্ষে যেসব ধর্মোপদেশ দিতেন বুদ্ধশিষ্যগণ তা স্মৃতিতে ধারণ করে রাখতেন এবং মুখে-মুখে প্রচার করতেন। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের তিনমাস পর প্রথম সঙ্গীতিতে বিভিন্ন ভিক্ষু কর্তৃক স্মৃতিতে ধারণকৃত বুদ্ধের উপদেশসমূহ প্রথম সংকলন করে একত্র করা হয়। কালক্রমে এগুলোই বর্তমানকালের ত্রিপিটকের রূপ পরিগ্রহ করে গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়। নানা কারণে মুখে-মুখে প্রচারিত যে-কোনো বিষয় বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তন্মধ্যে অন্যতম কারণসমূহ হচ্ছে : ১. অন্যভাষার প্রভাব ২. একাধিক ভাষাভাষী লোকের সহাবস্থান ৩. উচ্চারণের দুর্বলতা ৪. বোঝার দুর্বলতা এবং ৫. ব্যাখ্যা করার দুর্বলতা। কণ্ঠস্থ বা স্মৃতিতে ধারণ করে মুখে-মুখে প্রচারিত হওয়ার কারণে বুদ্ধবাণীর ক্ষেত্রেও বিকৃতি বা অর্থান্তর হওয়ার আশঙ্কা ছিল । দ্বিতীয় সঙ্গীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বুদ্ধের পরিনির্বাণের একশো বছরের মধ্যে বিনয়ের কতিপয় বিধিবিধানের ব্যাখ্যা নিয়ে প্রথম সঙ্ঘে বিবাদ সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ সঙ্ঘ প্রথম দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। তখন দ্বিতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুনরায় প্রথম সঙ্গীতিতে সংকলিত বুদ্ধবাণী আবৃত্তি ও সংকলিত করে বিশুদ্ধতা রক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠানের একশো বছরের মধ্যে বৌদ্ধসঙ্ঘ আঠারো নিকায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রতিটি নিকায়ের ভিক্ষুগণ নিজেদেরকে প্রকৃত বুদ্ধবাণীর ধারক-বাহক হিসেবে প্রচার করতেন। তা ছাড়া, সম্রাট অশোকের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লাভ-সৎকার বেড়ে গেলে অন্যান্য সম্প্রদায়ের অনেক তীর্থিক বা সন্ন্যাসী মস্তক মুণ্ডণ ও পাত্র চীবর ধারণ করে ভিক্ষু হিসেবে পরিচয় দিতে থাকেন। তাঁরা ধর্মকে অধর্ম এবং অধর্মকে ধর্ম বলে প্রচার করতেন। ফলে কোনটি প্রকৃত বুদ্ধবাণী তা নির্ধারণ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। এরূপ পরিস্থিতিতে তৃতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুনরায় প্রকৃত বুদ্ধবাণী সংকলন করা হয় ।
এরপর সম্রাট অশোক-পুত্র মহেন্দ্র থের তা সিংহলে নিয়ে যান। সেখানেও বুদ্ধবাণী কণ্ঠস্থ করে দীর্ঘদিন
মুখে-মুখে প্রচার করা হয়। সেখানে যুদ্ধবিগ্রহ, দুর্ভিক্ষ এবং ভোগবাদী মানসিকতার কারণে বুদ্ধবাণী বিকৃত ও বিস্মৃত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তখন রাজা বট্টগামণী সিংহলে রাজত্ব করতেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় চতুর্থ সঙ্গীতি আয়োজন করে তালপত্রে বা ভূর্জপত্রে প্রথম বুদ্ধবাণী লিপিবদ্ধ করা হয়, যা বর্তমানকালের ত্রিপিটকের ভিত্তি তৈরি করে। তখন থেকে তালপত্রে লিখিত বুদ্ধবাণীর পাণ্ডুলিপি নকল করে, শিলালিপিতে খোদাই করে এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে বুদ্ধবাণী সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু খোদাইকার বা লিপিকারের প্রমাদবশত ক্ষেত্রবিশেষে বুদ্ধবাণী অশুদ্ধভাবে উপস্থাপন হতে থাকে। ফলে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়। তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুনরায় পঞ্চম ও ষষ্ঠ সঙ্গীতির আয়োজন করা হয়। সেসব সঙ্গীতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ তুলনামূলক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে শুদ্ধভাবে বুদ্ধবাণী গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয়, যা আমরা বর্তমানে সহজে লাভ করতে এবং শিক্ষা করতে পাচ্ছি। অতএব বলা যায়, বুদ্ধবাণী গ্রন্থাকারে সংকলনের ক্ষেত্রে সঙ্গীতির ভূমিকা অপরিসীম।
অনুশীলনমূলক কাজ কোথায় এবং কখন প্রথম বুদ্ধবাণী লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল? কী কী কারণে মুখে-মুখে প্রচারিত বিষয় বিকৃত হতে পারে? |
অনুশীলনী
শূণ্যস্থান পূরণ কর
১. সঙ্গীতি হলো ভিক্ষু---------সঙ্ঘের সর্বোচ্চ সভা বা সম্মেলন ।
ধর্ম বিনয়ে শ্রদ্ধাশীল ভিক্ষুগণ বুদ্ধবাণীসমূহ---------- প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন ।
৩. সঙ্গীতি আরম্ভের ঠিক আগে আনন্দ স্থবির---------- প্রাপ্ত হন।
8. প্রথম মহা সঙ্গীতি সম্পন্ন হতে---------- মাস সময় লেগেছিল ।
৫. তাঁরা ধর্মকে---------- এবং অধর্মকে ধর্ম বলে প্রচার করতেন ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. প্রথম সঙ্গীতি কার পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল ?
২. বজ্জিপুত্রীয় ভিক্ষুরা কেন অধর্মবাদী?
৩. কেন এবং কার কাছে সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন ?
৪. সঙ্গীতির মাধ্যমে কীভাবে বুদ্ধবাণী সংকলিত হয় ?
বর্ণনামূলক প্রশ্ন
১. প্রথম সঙ্গীতির ফলাফল বর্ণনা কর।
২.“দশ বথুনী ” কাকে বলে এবং কী কী ? উল্লেখ কর ।
৩. তৃতীয় সঙ্গীতির পটভূমি ও ফলাফল আলোচনা কর ।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১। কে বুদ্ধের সর্বশেষ শিষ্য ছিলেন ?
ক. ধর্মরক্ষিত
খ. মহাদেব
ঘ. আনন্দ
গ. সুভদ্র
২। দ্বিতীয় সঙ্গীতি আহ্বানের প্রধান কারণ কোনটি ?
ক. যশ স্থবিরকে সংঘ থেকে বহিষ্কার করা
খ. দুর্বিনীত ভিক্ষুদেরকে স্বীকৃতি দেয়া
গ. সভা আয়োজনের ব্যবস্থা করা
ঘ. দসখুনীকে বিনয়-বহির্ভূত ঘোষণা করা।
নিচের ছবিটি লক্ষ কর এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
ছবি মডেল : (বাম থেকে) রাজা অজাতশত্রু, সম্রাট কালাশোক, সম্রাট অশোক, সম্রাট কণিষ্ক
৩. বুদ্ধবাণী সংকলন ও সংরক্ষণে মডেলে উল্লিখিত শাসকগণ কী অবদান রাখেন ?
ক. সঙ্গীতি আহ্বানের
গ. জাতকের উপদেশ প্রচারে
খ. সূত্র ও নীতিগাথা প্রচারে
ঘ. অকথার প্রসারে
৪. উক্ত ব্যক্তিবর্গের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রধানত কোন উদ্দেশ্য নিহিত ছিল ?
ক. কর্মযজ্ঞ নিয়ন্ত্রণ করা
খ. সম্পদ বৃদ্ধি করা
গ. রাজ্যের সম্প্রসারণ করা
ঘ. ধর্মপ্রচার করা ।
সৃজনশীল প্রশ্ন
ক. দ্বিতীয় সঙ্গীতির পর ভিক্ষুসঙ্ঘ কয়ভাগে বিভক্ত হয় ?
খ. বৌদ্ধধর্মে সঙ্গীতি আহ্বানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা কর।
গ. চার্ট-১ এ বর্ণিত তথ্যটি কোন সঙ্গীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. সঙ্গীতি আয়োজনে চাট-২ -এ উল্লিখিত ব্যক্তিদ্বয়ের ভূমিকা পাঠ্যবইয়ের আলোকে বিশ্লেষণ কর ।
২. বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মাননীয় স্পীকার। জনগণের কল্যাণে ও এলাকার উন্নয়নে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে বিভিন্ন সমস্যা উত্থাপন করেন এবং তা যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত, বাতিল ও সংশোধন করেন। পরিশেষে তা আইনে পরিণত হয় ।
ক. “কথাবন্ধু” গ্রন্থটি কে রচনা করেন ?
খ. ধর্ম মহাপাত্র বলতে কী বোঝায় ? ব্যাখ্যা কর ।
গ. উদ্দীপকে বর্ণিত জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের বিষয়টি পাঠ্যবইয়ের কোন কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত বহন করে ? ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. উক্ত কর্মকাণ্ডের ধর্মীয় গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর ।