আমাদের প্রত্যেকের বিশেষ জীবন আহ্বান কোনটি?
দ্বিতীয় অধ্যায়
স্বাধীনতা ও আমি
বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিই একক ও অনন্য সৌন্দর্যে মহিমান্বিত । প্রতিটি সৃষ্টিই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ সৌন্দর্য বিলিয়ে দিতে দিতে নিজেরা ধন্য হচ্ছে এবং বিশ্বের সেবা করে চলছে । মানুষ সকল সৃষ্টির মধ্যে আরো বেশি একক ও অনন্য । পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা কোটি কোটি । কিন্তু একজন মানুষ অন্য আর একজন মানুষের মতো নয়, সম্পূর্ণ আলাদা । এটি মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য যা তাকে দান করে আলাদা গৌরব ও মর্যাদা । একক ও অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে মানুষ যদি বৃদ্ধিলাভ করতে পারে তবেই সে হয়ে ওঠে স্বাধীন । মানুষ তার অনন্য বৈশিষ্ট্য ও স্বাধীনতার কারণে নিজেকে আবিষ্কার করতে চায় বা নিজেকে সে আরো গভীরভাবে জানতে চায় । নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে সে নিজের শক্তির সীমাবদ্ধতা, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হয় । এতে সে তার নিজের জীবন অর্থপূর্ণভাবে যাপন করতে পারে এবং অন্যের সাথেও তার সুসম্পর্ক বজায় থাকে । এভাবেই মানুষ পরিপূর্ণ আত্মদান করে তার মানবজীবন সার্থক করে তোলে ।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
নিজেকে জানার উপায়সমূহ বর্ণনা করতে পারব;
• প্রতিটি ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের কারণ উপমার সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারব; অন্যদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে পারব;
আমাদের জন্য খ্রিষ্টের আত্মদানের অর্থ বিশ্লেষণ করতে পারব এবং
সমাজ সেবায় উদ্বুদ্ধ হবো ।
নিজেকে জানা
আত্মজ্ঞান বা নিজেকে জানা হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান । আমরা আগেই জ্ঞানী দার্শনিক সক্রেটিসের বিষয়ে জেনেছি, তিনি বলেছেন, 'নিজেকে জানো।' যীশু বলেছেন, “সারা জগতকে পেয়ে কেউ যদি তার ফলে নিজেরই সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলে, তাতে তার কীই-বা লাভ হতে পারে? মানুষ তখন কোনো মূল্যেই বা নিজেকে আবার ফিরে পেতে পারে?” (মথি ১৬:২৬)। নিজেকে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । পৃথিবীর সব জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান মানুষেরা আত্মজ্ঞান সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন । অর্থাৎ জ্ঞানীরা নিজের সম্পর্কে জানতে আগ্রহী । আমরা পূর্বেই জেনেছি যে, প্রত্যেক মানুষ একজন থেকে আর একজন আলাদা বা ভিন্ন, একক ও অনন্য । প্রত্যেক মানুষের রয়েছে তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রকাশভঙ্গি, ধরন ও মূল্যবোধ। সে তার নিজস্ব ধারায় আচরণ করে, কিংবা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করে । তার রয়েছে একান্ত নিজস্ব গুণ, প্রতিভা, দক্ষতা, ক্ষমতা ও শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা । বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন অবস্থায় আমরা কিরূপ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করি সে বিষয়ে ধারণা থাকা নিজেকে জানার একটি অংশ । নিজেকে জানার বিষয়টি একটি প্রক্রিয়া। এটি আজীবনের জন্য একটি চলমান প্রক্রিয়া।
স্বাধীনতা ও আমি
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই জানার সমাপ্তি ঘটে । নিজেকে জানার বেশ কিছু উপায় রয়েছে । এখানে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
নিজেকে জানার উপায়
১. আত্ম সচেতনতা: নিজেকে জানার প্রথম ধাপটি হলো নিজের সম্পর্কে সচেতন হওয়া । নিজের আচার-আচরণ, কথাবার্তা, শক্তি ও সীমাবদ্ধতা, দোষ-গুণ ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন হলে নিজের সম্পর্কে একটি ধারণা জন্মে । তাছাড়াও বিভিন্ন অবস্থা, পরিবেশে নিজের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন থাকলেও নিজের সম্পর্কে জানা যায় ।
২. প্রার্থনা এবং ধ্যান: মনোবিজ্ঞানী যোসেফ এবং হ্যারী নিজেকে জানার বিষয়ে চার ভাগে বিভক্ত একটি জানালার কথা বলেছেন । আবিষ্কারক হিসেবে তাদের নামানুসারে এটিকে বলা হয় যো-হ্যারী উইনডো । এই জানালায় চারটি ভাগ রয়েছে ।
১. আমার সম্পর্কিত কিছু কিছু বিষয় আমি জানি । যা ২. অন্য কেউ জানে না । তবে ঈশ্বর জানেন ।
৩. আমার কিছু কিছু বিষয় যা আমি জানি, অন্যেরা সবাই জানে । ঈশ্বরও জানেন ।
৪. আমার কিছু কিছু বিষয় আমি বা অন্যেরা কেউ জানে না । এ বিষয় শুধু ঈশ্বর জানেন ।
আমার সম্পর্কিত কিছু কিছু বিষয় অন্যেরা জানে যা আমি জানি না। তবে ঈশ্বর জানেন ।
এখান থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, নিজেকে জানার জন্য ঈশ্বরের সহায়তা ও ধ্যান প্রার্থনা বিশেষভাবে সহায়তা করে । ঈশ্বর আমাকে সবচেয়ে ভালোভাবে জানেন । এ বিষয়ে সাম ১৩৯: ১এর মধ্যে দেখতে পাই:
তুমি তো আমায় জানো, ওগো ঈশ্বর;
তলিয়ে দেখেছ তুমি আমার অন্তর ।
৩. গঠনমূলক সমালোচনা : নিজেকে জানার জন্য অন্যদের গঠনমূলক সমালোচনা খুবই সহায়ক । কারণ এর মাধ্যমে আমরা নিজের ভালো-মন্দ দিকগুলো আরও সুস্পষ্টভাবে দেখতে পারি । অনেক সময় কারো সমালোচনা বা দোষ দেখিয়ে দেওয়াটা গ্রহণ করতে আমাদের খুব কষ্ট হয় । কিন্তু এর মধ্য দিয়েও আমরা নিজের সম্পর্কে অনেকটা জানতে পারি। সমালোচক বা নিন্দুক অনেক সময় সত্য কথাটি আমাদের সামনে তুলে ধরে। নিরেপেক্ষভাবে ও আত্মগঠনের মনোভাব নিয়ে তা গ্রহণ করলে আমরা অনেক উপকৃত হতে পারি ।
৪. মূল্যায়ন: যেকোনো কাজ করার পর বা যেকোনো কথা শোনা বা বলা বা কোন বিশেষ বিষয়ে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করার পর যখন আমরা আত্মমূল্যায়ন করতে পারি বা অন্যকে মূল্যায়নের সুযোগ দেই তখন
আমরা সে বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করি। এতে করে নিজের সম্পর্কে আমরা আরো ভালো করে জানতে পারি । লোকেরা যখন ব্যভিচারে লিপ্ত মারীয়া মাগ্দালিনীকে যীশুর কাছে ধরে এনেছিল তখন তারা তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল । তখন যীশু উপস্থিত জনতাকে বলেছিলেন তোমাদের মধ্যে যার কোনো পাপ নেই সেই আগে পাথর ছুঁডুক । তখন সেখান থেকে একে একে সবাই সরে পড়েছিল । যীশু তখন তাদের আত্মমূল্যায়নের সুযোগ দিয়েছিলেন ।
৫. বিভিন্ন মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা: বর্তমানে বিভিন্ন মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা বা অনুশীলনীর মাধ্যমেও আমরা নিজের সম্পর্কে অনেক ধারণা পেতে পারি। এ ধরনের পরীক্ষায় বিভিন্নরকম প্রশ্নের উত্তর দানের মাধ্যমে মানুষের স্বভাব ও ব্যক্তিত্বের নানা দিক যাচাই করা হয় ।
৬. বিভিন্ন ঘটনা: বাস্তব জীবনের নানা ঘটনা আত্মজ্ঞানের সহায়ক। বিভিন্ন ঘটনার আলোকে আমরা নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করতে পারি। যেমন কোনো চ্যালেঞ্জিং বা ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনায় আমরা কিরূপ আচরণ করি তা থেকে নিজের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি । শুধুমাত্র ঘটনা নয়, জীবনের নানারকম চাপের সময় আমি কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করি তা থেকেও আমার আত্মজ্ঞান হয় ।
এ প্রসঙ্গে একটা ছোট গল্প আমাদের সাহায্য করতে পারে । একজন মায়ের তিনজন ছেলেমেয়ে ছিল । সেই মা তার সন্তানদের নানা বিষয়ে সাহায্য করতেন । জীবনের নানা চাপে পড়ে তারা খুব অভিযোগ করছিল। তাই একদিন ঐ মা তার সন্তানদেরকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন । তিনটি চুলার উপরে তিনটি পাত্রে পানি ফুটছিল । মা ফুটন্ত পানির একটি পাত্রে একটি ডিম, একটিতে গাজর এবং শেষটিতে কিছূ কফি দিলেন । কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ডিমটি শক্ত হয়ে গেছে, গাজরটি নরম হয়ে গেছে এবং কফি পানির সাথে মিশে সুগন্ধি ছড়াচ্ছে ও অপূর্ব এক পানীয়তে পরিণত হয়েছে । মা তখন তার সন্তানদের বুঝিয়ে বললেন: একই পরিমাণ তাপে তিনিটি জিনিস তিনরকম হয়ে গেল । তাই আমাদেরও দেখতে হয় জীবনের চাপে আমাদের অবস্থা কী হয় । তবে ডিমের মতো শক্ত বা গাজরের মতো নরম হয়ে গেলে চলবে না । কফির মতো ঘটনার মোকাবেলা করতে হবে এবং ঘটনার সাথে একাত্ম হয়ে চলতে শিখতে হবে ।
৭. শিক্ষা: শিক্ষা মানুষের আচরণকে বদলে দেয় । শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের আত্মজ্ঞান অনেক বেড়ে যায় । তাই নিজেকে জানার জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই । প্রকৃত শিক্ষা জীবনের দর্পণস্বরূপ । শিক্ষার মাধ্যমে আমরা সচেতন হই । সচেতনতা নিজেকে জানার প্রথম ধাপ । তবে শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা নয় বরং জীবনকেন্দ্রিক শিক্ষা আত্মজ্ঞানের সহায়ক ।
৮. গঠন প্রশিক্ষণ: শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ও পাঠ্যক্রমের শিক্ষাই নয়; নিজেকে জানার প্রয়োজনে বিশেষ ধরনের গঠন প্রশিক্ষণও গ্রহণ করতে হয় । আজকাল এ ধরনের গঠন প্রশিক্ষণের নানা সুযোগসুবিধা, সেমিনার এবং কর্মশালারও ব্যবস্থা রয়েছে। তাই উপযুক্ত গঠন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা সহজেই নিজেকে আরো গভীরভাবে জানতে ও চিনতে পারি । আমরা নিজেকে যত গভীর ও ভালোভাবে চিনব আমরা তত পরিপক্ক মানুষ হতে পারব ।
৯. জীবন পর্যালোচনা: জীবন পর্যালোচনা বলতে আমরা বুঝি মূল্যবোধের আলোকে নিজ জীবন ব্যাখ্যা করা । জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার ভালোমন্দ বুঝতে শেখা । ভালোমন্দের পর্যালোচনা করে পরবর্তী দিনগুলোর জন্য সিন্ধান্ত গ্রহণ করা ।
১০. ডায়েরি বা জার্নাল লেখা : অনেকের একটি ভালো অভ্যাস রয়েছে দিনশেষে বা সময় বুঝে নিজ জীবনের কথা লিখে রাখা । এটি একটি সহায়ক পন্থা যার মধ্য দিয়ে বিগত দিনের লেখা পড়ে অতীত ও বর্তমানের আমিকে আমরা দেখতে পারি । এভাবেও আমরা নিজেদেরকে জানতে পারি ।
১১. নিজের দোষ গুণের তালিকা করা: নিজের ও অন্যদের সহায়তায় নিজের দোষ-গুণের একটি
তালিকা করতে পারলে নিজের সম্পর্কে বেশ ভালো একটি ধারণা পওয়া যেতে পারে ।
| কাজ: একটি কাগজের একদিকে তোমার পাঁচটি বিশেষ গুণ বা প্রতিভা লেখ এবং অন্যদিকে তিনটি দুর্বল দিক লেখ । এবার তা তোমার পাশের বন্ধুর সাথে সহভাগিতা কর । তোমার সম্পর্কে তার মন্তব্য শোন
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলতে আমরা বুঝি, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির ভিন্নতা। সাধারণভাবে পৃথিবীর সব মানুষ একই রকম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে গঠিত হলেও প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিত্ব আলাদা বা ভিন্ন । মানুষের এই ভিন্নতা তার চেহারা, আকৃতি, আচার-আচরণ, ব্যবহার, চিন্তাধারা, ধ্যান-ধারণা, গুণ, প্রতিভা, বুদ্ধিশক্তি, প্রকাশভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদির মধ্যে প্রকাশ পায়। একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের এই মৌলিক পার্থক্যগুলোকেই আমরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলে থাকি । ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কারণেই মানুষ হয়ে ওঠে একক ও অনন্য। মানুষ তার এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণেই হয়ে উঠেছে শ্রেষ্ঠ। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য না থাকলে পৃথিবীর সব মানুষ কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মতো হয়ে উঠত । আমরা ঈশ্বরের একক ও অনন্য সৃষ্টি; ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের মাধ্যমেই তা প্রমাণিত হয় । বিষয়টি সম্পর্কে আমরা আরো বিস্তারিতভাবে জানব ।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্য
শারীরিক গঠন ও আকৃতিগত পার্থক্য: পৃথিবীর একটি বিস্ময়কর বিষয় হলো মানুষের মধ্যে কেউ কারো মতো নয় । একই মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এমনকি জমজ ভাইবোন হলেও একজন অন্য আরেকজনের মতো নয় । দেখতে প্রায় একইরকম হলেও কিংবা উচ্চতার মিল থাকলেও কোনো না কোনো দিকে কিছুটা ভিন্নতা থাকে । মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের প্রথম বৈশিষ্ট্যই হলো শারীরিক গঠন ও আকৃতিগত দিক থেকে ।
আত্মপরিচয়: প্রত্যেক মানুষের রয়েছে তার নিজস্ব আত্মপরিচয়। তার নিজের নাম, ঠিকানা, পেশা, পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন ও বংশ পরিচয়। এগুলোর মধ্য দিয়েও তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দিক প্রকাশিত হয় । অনেক সময় একই প্রতিষ্ঠানে দুইজন শিক্ষার্থীর একই নাম হলেও তাদের রোল নম্বর দিয়ে তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয় । তবে যে করেই হোক আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে মানুষ কোনো না কোনোভাবে তার আলাদা অস্তিত্ব প্রকাশ করে থাকে ।
ভিন্ন ব্যক্তিত্ব: ব্যক্তিত্বের দিক থেকেও মানুষে মানুষে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। মনোবিজ্ঞানীগণ মানুষের কতগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ব্যক্তিত্বের শ্রেণিবিভাগ করলেও সত্যিকারে পৃথিবীতে যত মানুষ আছে, তত রকম ব্যক্তিত্বও আছে। তার নিজস্ব পরিবেশ, পটভূমি ও জীবন অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করেই তার ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। স্বভাব গুণে মানুষের কিছুটা মিল থাকলেও মূলত একজন মানুষ আরেকজন মানুষ থেকে আলাদা ।
নিজস্ব গুণাবলি: প্রত্যেক মানুষ আলাদা আলাদা মানবিক গুণ, বুদ্ধি, প্রতিভা ও দক্ষতার অধিকারী । কতগুলো সাধারণ প্রতিভা অনেকের মধ্যে থাকলেও প্রত্যেক মানুষের মানবিক গুণ আলাদা । যেমন: একটা শ্রেণিকক্ষে পাঁচজন মেয়ে গান করতে পারে, দশজন ছেলে ভালো ক্রিকেট খেলতে পারে কিন্তু তাদের মানবিক গুণগুলো আলাদা । দেখা যাবে পাঁচজন মেয়ের মধ্যে একজন দয়ালু, অন্যজন উদার কিংবা একজন ছেলে সৎ অন্যজন খুব সহানুভূতিশীল । অর্থাৎ কোনো না কোনো দিকে ভিন্নতা অবশ্যই থাকছে । মানুষ তার নিজের গুণাবলির জন্য অনন্য হয়ে উঠেছে।
ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ ও রুচিবোধ: মানুষে মানুষে পছন্দ, অপছন্দ ও রুচিবোধের মধ্যেও ভিন্নতা রয়েছে । এর কারণেও মানুষ আলাদা। নানা বিষয়ে এই ভিন্নতা লক্ষণীয়। যেমন: পোশাক পরিচ্ছদ, খাবার-দাবার, জীবন সঙ্গী বা বন্ধু নির্বাচন, পরিবেশ, রং ইত্যাদি । বিষয় নির্বাচনেও মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে ।
মূল্যবোধের পার্থক্য: মূল্যবোধের পার্থক্যের কারণে মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্যে অনেক বড় পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় । প্রত্যেক মানুষের রয়েছে নিজস্ব মূল্যবোধ বা বিশ্বাসের ধারা, যে অনুসারে সে আচরণ করে । এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তার স্বাধীন ব্যক্তিত্ব। যীশু খ্রিষ্ট, মহাত্মা গান্ধী, মাদার তেরেজা, আর্চবিশপ গঙ্গুলী, এককথায় পৃথিবীর সব মহামানবেরা নিজ নিজ পৃথক মূল্যবোধের কারণেই হয়ে উঠেছেন একক ও অনন্য ।
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা: মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক মানুষ তার সত্তা নিয়ে এক স্বাধীন মানুষ হয়ে ওঠে । মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে সে হয় একক । তখন থেকেই তার মধ্যে গড়ে ওঠে আলাদাভাব । ঈশ্বর প্রতিটি মানুষকে তাঁর শ্রেষ্ঠ উপহার স্বাধীনতা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন । এই স্বাধীনতাই মানুষকে অনন্য করে তোলে । স্বাধীনতা ব্যবহার করেই মানুষ নিজ নিজ সিন্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ভালোমন্দ কাজ করে থাকে ।
একান্ত নিজস্ব অবদান : পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ একটি বিশেষ অবদান রাখার জন্য জন্মগ্রহণ করেছে। এটি প্রত্যেক মানুষের একক অবদান । এক ব্যক্তির অবদান অন্য কোন ব্যক্তিই রাখতে পারে না । নিজের অবদান মানুষ শুধু নিজেই রাখতে পারে--হোক সে ছোট কিংবা বড়--আমার অবদান আমারই । ক্ষুদ্র পুষ্প সাধ্বী তেরেজা তাঁর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজের মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদান রেখে অনেক
বড় সাধ্বী হয়েছেন । আবার মাদার তেরেজা জগৎ- জোড়া সেবা করে বিখ্যাত হয়েছেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন । আমরাও কিন্তু এই বিশেষ অবদান রাখতে আহুত এবং এর মধ্য দিয়েই আমরা হয়ে উঠব অনন্য । সাধারণ থেকে আমরা হয়ে উঠব অসাধারণ ।
পেশা নির্বাচন: জীবন ও জীবিকা নির্বাচনের জন্য আমাদের প্রত্যেককে কোনো না কোনো পেশা বেছে নিতে হয় । পেশা নির্বাচন ও পেশাগত জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে আমরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ প্রকাশ করে থাকি । শ্রমিক, কৃষক, গাড়িচালক, ডাক্তার, নার্স, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, নেতা, পরিচালক, শিক্ষক সবাই তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে আলাদা ব্যক্তিত্বের মানুষ হয়ে ওঠে ।
ধর্মীয় বিশ্বাস: ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেও আমরা একক ও অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী হই । প্রত্যেক ধর্মেই কোনো না কোনো মহামানব আছেন যাঁরা তাঁদের আপন বিশ্বাসের জন্য তাঁদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন । আমরা প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী মানুষ এই সকল মহামানবদের অনুসরণ করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করে থাকি । তবে এইকথা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কারণেই মানবজীবনের এতো সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য। মানুষে মানুষে যদি এই ভিন্নতা না থাকত অর্থাৎ আমরা যদি সবাই একরকম হতে যেতাম, তাহলে পৃথিবীটা কেমন হতো! ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের কারণেই আমরা পরস্পরের কাছে এতটা আকষর্ণীয় ।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফলাফল
ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা যেমন মানব জীবনকে দিয়েছে বৈচিত্র্য তেমনি এটি আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জও বটে । ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ইতিবাচক ও নেতিবাচক--দুই ধরনের ফলাফলও রয়েছে ।
ইতিবাচক ফলাফল- নেতিবাচক ফলাফল
• ভিন্নতার কারণে পৃথিবীতে বৈচিত্র্য এসেছে । মানুষের ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যের দিকটিও প্রকাশিত হয় এই
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মাধ্যমে ।
• বৈচিত্র্য ও ভিন্নতার কারণে চাহিদার পরিপূরণ হয়েছে । পেশাগত ও কর্মজীবনে বৈচিত্র্য আছে বলেই আমরা একে অপরের কাছ থেকে সব ধরনের সেবা পাচ্ছি ।
• আমরা যে পরস্পরের পরিপূরক সে উপলব্ধি হয়েছে । যেমন, আমি একা সব পারি না বা আমার সব কিছু করার ক্ষমতাও নেই । এই বৈচিত্র্যের মাধ্যমেই আমরা সমাজে পরস্পরের কাছে প্রয়োজনীয় ও পরিপূরক হয়ে উঠি ।
• ভিন্নতায় ঐক্য আসে এবং তাতে আমরা সমৃদ্ধ হই । তাতে সমন্বয় সাধনের সুযোগ থাকে ।
অনেক সময় মানুষের ভিন্নতা গ্রহণ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে ।
• বৈচিত্র্য ও ভিন্নতার কারণে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। ভিন্নতার কারণে ভুলবুঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে ।
• ভিন্নতা স্বীকার না করে নিজের চিন্তার আলোকে অন্যকে বিচার করে অনেক বেশি আশা বা প্রত্যাশা করি । এতে হতাশা বাড়ে । অনেক সময় আমাদের আশা ভঙ্গ হতে পারে ।
সচেতনতা নিয়ে ভিন্নতাগুলোকে সমন্বয় করতে না পারলে বিচ্ছিন্নতা আসতে পারে । ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে ঠিকভাবে শনাক্ত করতে না পারলে আমরা ব্যক্তিকে অবমূল্যায়নও করতে পারি ।
মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সৌন্দর্যকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যায় রঙধনুর মাধ্যমে। রঙধনুর সাতটি রঙের মধ্যে কোনো মিল নেই । কিন্তু রঙধনু তৈরি করতে গেলে অবশ্যই সাতটি রঙই প্রয়োজন । একটি রং দিয়ে কখনো রঙধনু হবে না। আমাদের সমাজ প্রগতিশীল ও ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে যখন সেই সমাজে নানা ধরনের মানুষ থাকবে। বর্তমান বিশ্বে যে মানুষের এই মৌলিক পার্থক্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে শুধু তা-ই নয় বরং জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম ও বর্ণ বৈচিত্র্যকেও প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। পৃথিবী এখন গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে, বৈচিত্র্যের মাঝেই রয়েছে ঐক্য। তাই মানুষের এই স্বাতন্ত্র্যকে আমরা শ্রদ্ধা সহকারে গ্রহণ করব । স্বাতন্ত্র্যের দিকটিকে সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতা হিসেবে দেখব না বরং শক্তি হিসেবেই দেখব । তাহলেই জগতজুড়ে আমরা হয়ে উঠব বর্ণে, গন্ধে ও বিচিত্র ফুলের সমারোহে অপরূপ সুন্দর এক ফুলের বাগান ।
কাজ : কোন কোন বিষয়ে তুমি নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা মনে কর । কেন? দলে সহভাগিতা কর ।
সমাজের মানুষের সাথে সম্পর্ক
একক ও অনন্য হলেও আমরা কিন্তু একাকী বাস করি না--বাস করি পরিবারে ও সমাজে । অনেক মানুষের সাথে মিলে মিশেই আমরা বাস করি । মানুষের সাথে আমাদের ভাবের আদান প্রদান হয়, আমরা সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করি এবং পরস্পরের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি । সমাজের মানুষদের সাথে মিলেমিশে আনন্দ উৎসব করি । বিপদে আপদে আমরা একে অন্যের পাশে দাঁড়াই। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের এই তাগিদ ও প্রবণতা লক্ষণীয় । তবে সমাজের মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রথম ধারণাই এসেছে ঈশ্বরের কাছ থেকে । আমাদের বিশ্বাসের জীবনে আমরা দেখি পবিত্র ত্রিত্বের উপস্থিতি । এক ঈশ্বরের মধ্যে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা--এই তিন ব্যক্তির সমাজ রয়েছে । এই তিন ব্যক্তি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ত্রিব্যক্তির এই আদর্শ অনুসরণ করেই আমরা সমাজে মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি । খ্রিষ্টমণ্ডলীও হলো ভক্তজনের সমাজ । মানুষের এই সমাজবদ্ধতায় খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের একটি বিশেষ দিক প্ৰকাশ পায় ।
মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তা
ক. সমাজের মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখা একটি মৌলিক প্রয়োজন । কারণ আমরা কোনোভাবেই একাকী বাস করতে পারি না। আমাদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। আমি একা কখনো পূর্ণ নই । আমার পূর্ণতার জন্য সমাজের মানুষের দরকার। আবার আমিও সমাজের অন্যদের জীবন পুর্ণ করি ।
খ. আমাদের জীবন আবর্তিত হয় সমাজকে কেন্দ্র করে । আমরা আমাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উৎসব সমাজের মানুষের সাথে সহভাগিতা করি । আমাদের যেকোনো দুঃখ-শোক ও বিপদ-আপদে সমাজের মানুষই আমাদের পাশে দাঁড়ায় ।
গ. সমাজেকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সামাজিক প্রতিষ্ঠান । যেমন: হাসপাতাল, ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার ইত্যাদি । এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা সেবা পেয়ে থাকি। সমাজের মানুষের সুসম্পর্কের কারণেই এসব প্রতিষ্ঠান কার্যকরী হয় । আমরা সুন্দরভাবে সমাজে বাস করতে পারি । আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে পারি ।
ঘ. আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, গুণ, প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয় সমাজকে ঘিরে । আমরা আমাদের গুণ, যোগ্যতা, দক্ষতা, শিক্ষা, অর্জিত সব কিছু দিয়েই সমাজের সকল স্তরের মানুষের সেবা করি এবং সেবা গ্রহণ করি । তাই সামাজিক সম্পর্ক অপরিহার্য ।
ঙ. সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাস করার মধ্য দিয়ে আমাদের ব্যক্তিত্বের পরিপক্বতা প্রকাশ পায় । সত্যিকার অর্থে আমাদের অর্জিত শিক্ষাদীক্ষা ও দক্ষতার সার্থকতা প্রকাশ পায় সমাজের মানুষের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা ও সমঝোতাপূর্ণ জীবন যাপন করার মধ্যে
চ. খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের জীবনে সমাজ তথা খ্রিষ্টমণ্ডলী খ্রিষ্টের উপস্থিতির প্রতীক । খ্রিষ্ট নিজেই সেই সমাজের মস্তক বা প্রধান । তাই এই সমাজের সাথে আমাদের যুক্ত থাকতেই হবে। সমাজের সাথে সম্পর্কিত থাকা মানে আমরা খ্রিষ্টেরই সাথে যুক্ত আছি। তাতে আমরা জীবন্ত থাকি ও ফলশালী হই ।
সম্পর্ক নষ্ট হবার কারণ
আমরা সবাই সম্পর্ক গড়তে চাই ও রক্ষা করতে চাই । কিন্তু অনেক সময় নানা কারণে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয় । কী কারণে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে আমরা সে বিষয়গুলো দেখব:
ক. ভুলঝুঝাবুঝি;
খ. সামাজিক চাপ ও অন্যায়; গ. দলাদলি ও কোন্দল;
ঘ. মূল্যবোধের অবক্ষয়;
ঙ. ক্ষমতার অপব্যবহার;
চ. শোষণ ও নির্যাতন;
ছ. মানুষে মানুষে, নারী পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি;
জ. ব্যক্তিস্বার্থের জন্য সমাজকে ব্যবহার করা;
ঝ. সহনশীলতা ও ক্ষমার মনোভাব না থাকা;
ঞ. সহযোগিতা ও সহভাগিতার মনোভাব না থাকা ।
সম্পর্ক রক্ষার উপায়
ক. সমাজকে খ্রিষ্টমণ্ডলীর প্রতিচ্ছবি মনে করা এবং সেখানে খ্রিষ্টের উপস্থিতি উপলব্ধি করা ।
খ. খ্রিষ্ট নিজেই আমাদের পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত করেন তা মনে রেখে মন খোলা রাখা । ঈশ্বরকে আমাদের জীবনে কাজ করতে দেওয়া ।
গ, সমাজের মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করে তাদের গ্রহণ করা । নারী পুরুষ, ধনী গরিব সবার প্রতি সমান মনোভাব পোষণ করা ।
ঘ. সমাজের মানুষকে সব পরিস্থিতিতে সহযোগিতা করা ও তাদের প্রতি সহমর্মিতার মনোভাব প্রকাশ করা ।
ঙ. সমাজকে বা সমাজের প্রতিষ্ঠানকে নিজের স্বার্থের উপায় বলে মনে না করে বরং সমাজের স্বার্থকে বড় করে দেখা ।
চ. সম্পর্ক রক্ষার জন্য পরস্পরের প্রতি শহনশীল থাকা ।
ছ. প্রয়োজনে ত্যাগস্বীকার করার মনোভাব থাকা ।
জ. কোন কারণে সম্পর্ক নষ্ট হলে ক্ষমা ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে তা পুনঃস্থাপন করা । ঝ. সম্পর্কের জন্য ন্যায্যাতা একান্ত দরকার । সামাজিক সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে সম্পর্ক রক্ষা করা ।
ঞ. সম্পর্ক রক্ষার সবচেয়ে বড় বিষয় হলো নিজের ও অন্যের স্বাধীনতা স্বীকার করা ।
সম্পর্ককে জীবনের একটি মূল্যবোধ বলে মনে করা । মূল্যবোধের কারণে সম্পর্ককে লালন করা ।
মোটকথা আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা উভয়ই সমাজে । সমাজবিহীন জীবন আমাদের জন্য অকল্পনীয় । যীশু খ্রিষ্ট ঈশ্বর হয়েও এই পৃথিবীতে যখন মানুষ হিসেবে জন্ম নিলেন তখন তিনি সমাজেই তাঁর জীবন কাটিয়েছেন । ইহুদি সমাজে তিনি জন্ম-মৃত্যু ও কর্মময় জীবন যাপন করেছেন। সমাজের রীতিনীতি মেনে চলেই সেখানে পরিবর্তন এনেছেন ও সেবাকাজ করেছেন । সামাজিক সুসম্পর্ক স্থাপনে তিনি আমাদের গুরু । তিনি সব ধরনের মানুষের সাথে মেলামেশা করেছেন ও সবাইকে নিজ নিজ যোগ্য শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়েছেন । তাঁর জীবনে বারোজন শিষ্য বেছে নিয়ে তিনি সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা আমাদের বুঝিয়েছেন । শত্রুকে ক্ষমা করার মাধ্যমে সুসম্পর্ক রক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন ।
কাজ: মানুষের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করার জন্য তুমি কী কর? সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য কী দক্ষতা থাকা দরকার বলে তুমি মনে কর? ছোট দলে সহভাগিতা কর ।
সেবাকাজে আত্মনিবেদন
আমাদের জন্ম ও জীবন পরার্থে, নিজের জন্য নয় । বাংলার কবি বলেছেন : “পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না, পরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফূটিত করিও।” বিশ্বপ্রকৃতি এবং প্রতিটি সৃষ্টির দিকে তাকালে আমরা খুব সহজেই এই সত্য উপলব্ধি করতে পারি । ফুল তার আপন সৌন্দর্য ও গন্ধ বিলিয়ে সবাইকে আনন্দ দেয় । পশুপাখি, ফলফলাদি, ফসলও খাদ্যরূপে নিজেকে বিলিয়ে দেয় অন্যের জন্য। বায়ু সেবন করে আমরা বেঁচে থাকি ।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে জানতে গিয়ে আমরা আমাদের গুণ, শক্তি ও সীমাবদ্ধতার কথা জেনেছি । আমাদের সব গুণাবলি, শক্তি, প্রতিভা সবই হলো ঈশ্বরের গৌরব প্রকাশ ও মানুষের সেবার জন্য । আমাদের প্রতিটি গুণ সেবা কাজে ব্যবহার করার জন্য । সেবাকাজের মাধ্যমে আমরা নিজেকে দান করি । প্ৰদীপ ও ধুপ যেমন নিজে পুড়ে আলো ও গন্ধ বিলায় তেমনি পরার্থে আত্মনিবেদন করে আমরাও আমাদের জীবন
সার্থক করি । সেবা কাজে আত্মনিবেদন করা আমাদের প্রত্যেকের একটি বিশেষ জীবন-আহ্বান । এটি আমাদের একটি স্বাধীন সিদ্ধান্তও বটে । শিষ্যদের পা ধুয়ে দিয়ে যীশু সেবার মহান দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রেখেছেন । তিনি যেমন আমাদের ভালোবেসেছেন তেমনি পরস্পরকে ভালোবাসতে আমাদের আদেশও দিয়েছেন।
কীভাবে আমরা সেবাকাজে আত্মনিয়োগ করতে পারি
আমাদের একটি মাত্র জীবন । এই জীবন আমরা ঈশ্বরের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছি । ঈশ্বর চান তাঁর কাছ থেকে বিনামূল্যে যে দান আমরা লাভ করেছি আমরাও যেন তা বিনামূল্যে অন্য মানুষের জন্য বিলিয়ে দেই । আমাদের জীবনটা যেন হয়ে ওঠে ভালোবাসা ও সেবাকাজে নিবেদিত । নিজেকে দান করার জন্য আমাদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলো স্মরণ রাখতে হবে :
S. সরল ও নম্র চিত্তে সর্বদা মনে রাখা যে আমার জীবন প্রভুর দান; আমি স্বাধীনভাবে তা অন্যের জন্য উদারভাবে বিলিয়ে দেব ।
নিজের গুণ, প্রতিভা ও শক্তির দিকগুলো স্বীকার করে সেগুলো ব্যবহার করে কী করা যায় তা খুঁজে বের করা ।
৩. আমি যেখানে যে অবস্থায় থাকি না কেন সেখানেই সেবার সুযোগ করে নেওয়া ।
৪. নিজের জীবন আহ্বান নির্ণয় করা এবং সর্বান্তকরণে তাতে সাড়া দেওয়া ।
৫. নিজের জীবনকে ঘিরে ঈশ্বরের ইচ্ছা বোঝা । আমাকে ঘিরে ঈশ্বরের যে পরিকল্পনা আছে তা বুঝে জীবনকে সেইভাবে নিবেদন করা ।
৬. সবসময় নিজের স্বার্থ বা অর্থনৈতিক লাভ না খুঁজে কাজ করা ।
৭. নিজের জীবনে সেবার দিকটি উজ্জ্বল রাখা ।
৮. সেবা করা আমার মানবিক, সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় তথা খ্রিষ্টীয় দায়িত্ব । সেবা করতে আমি দায়বদ্ধ । মানুষকে সেবা করার মধ্য দিয়ে আমি ঈশ্বরকে সেবা করে থাকি ।
সেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
পৃথিবীর ইতিহাস থেকে আমরা খুব সহজেই অনেক মানুষের নাম স্মরণ করতে পারি যাঁরা নিজের সবটুকু
বিলিয়ে দিয়ে মানুষের সেবা করছেন । এইরকম কয়েকজন মানুষ হলেন: যীশু খ্রিষ্ট. মাদার তেরেজা, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিভিন্ন দিকে তাঁরা মানুষের কল্যাণে তাঁদের জীবন নিবেদন করেছেন ।
সেবাকাজের ক্ষেত্র
পরিবারঃ পরিবারে আমাদের জীবন শুরু হয় । আমাদের প্রথম সেবাকেন্দ্র হলো পরিবার । তাই পরিবারে আত্মনিবেদনের অনুশীলন করতে হয় । পিতামাতা, ভাইবোন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সেবা করার মধ্য দিয়ে আমরা সেবাকাজে অনুপ্রাণিত হই । পরিবার থেকেই আমরা সেবা করতে শিখি ।
সমাজঃ পরিবার হলো সমাজের অংশ । প্রতিবেশী ও সমাজের সেবা করতে করতে আমরা আত্মনিবেদন করতে শিখি । পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা আমরা সমাজে প্রয়োগ করে থাকি । সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান: ধীরে ধীরে আমরা আমাদের আশেপাশে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে আমরা সেবা দিতে পারি । যেমন, কোন কল্যাণমূলক সংগঠন, সংঘ, সমিতি ইত্যাদি ।
হাসপাতাল ও দাতব্য চিকিৎসালয়: ডাক্তার, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী হয়ে আমরা মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারি । অনেক সময় হাসপাতাল বা বাড়িতে অসুস্থ ব্যক্তি বা রোগী অথবা বয়স্কদের দেখতে যেতে পারি, তাদের সাথে সময় কাটাতে পারি বা তাদের সান্ত্বনা দিতে পারি; আমরা নিরাশাগ্রস্ত মানুষদের আশার বাণী শোনাতে পারি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: শিক্ষাদান বা জ্ঞানদান একটি উত্তম সেবাকাজ । কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের অজ্ঞতা ঘুচে যায় । মানুষ পরিশীলিত হয় । শিক্ষাদান করে আমরা সমাজে এক বিশেষ ধরনের সেবা করতে পারি । সেলাই ও হস্তশিল্প কেন্দ্র: দারিদ্র্য বিমোচন ও মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য সেলাই ও হস্তশিল্প শিক্ষা দিয়েও আমরা মানুষের সেবা করে যেতে পারি । বৃহত্তর পর্যায়ে বড় শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেও সমাজের মানুষের সেবা করা যায় ।
নিজস্ব কর্মক্ষেত্র: আমাদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্র রয়েছে । বিশ্বস্তভাবে কাজ করে আমরা যে ধরনের কাজই করি না কেন, তার মাধ্যমে আমরা উত্তম সেবা করতে পারি। হতে পারি আমি একজন অফিস কর্মচারী, ব্যাংকার, গৃহিণী, কৃষক, শ্রমিক কিংবা শিক্ষার্থী । আমার অবস্থানে থেকেই আমি শ্রেষ্ঠ সেবা দিতে পারি । মণ্ডলী: আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ সেবা করতে পারি মণ্ডলীর কাজে অবদান রেখে। আমরা দেখতে পাই মণ্ডলীর সেবায় অনেকেই তাদের জীবন নিবেদন করেছেন । তাঁরা যাজকীয় ও ব্রতীয় জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে মণ্ডলীর সেবায় আত্মনিবেদন করেছেন । ঈশ্বরকে ভালোবেসে মঙ্গলবাণী প্রচার ও আর্তমানবতার সেবায় এসব নিবেদিত প্রাণ মানুষ সেবা দান করে যাচ্ছেন । তাঁদের সেবায় মণ্ডলী প্রাণবন্ত । বর্তমানে মানুষ অনেক বেশি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে । নিজের বিষয় বা লাভ ক্ষতির প্রশ্ন তার কাছে প্রধান বিষয় । যে কারণে মানুষ শুধু নিজের কথা ভাবে ও নিজের জন্যই বাঁচতে চায় । অন্যের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করার মনোভাব অনেক কমে যাচ্ছে । এটি আমাদের নিঃস্বার্থ আত্মদানের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এইভাবে চলতে থাকলে আমরা খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধবিহীন হয়ে পড়ব। আমাদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব ক্ষুণ্ন হবে । তাই আমরা কীভাবে সেবাকোজে নিজের জীবন নিবেদন করব, এখন থেকেই তা চিন্তা করব, যেন ঈশ্বরের অমূল্য দান আমার জীবন দিয়ে অর্থপূর্ণ সেবা দান করতে পারি ।
কাজ : ১. তোমাদের আশেপাশে বা তোমার জানা মতে কী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার একটি তালিকা কর । সেখানে কারা সেবা করছেন; কী ধরনের সেবা করছেন তারা? দলে আলোচনা করে তার উপর একটি পোস্টার তৈরি কর ।
কাজ : ২. তোমাদের আশেপাশের কোনো সেবা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি ও শ্রেণিতে উপস্থাপন কর ।
খ্রিষ্টের আত্মদান
যীশু খ্রিষ্ট এই পৃথিবীতে এসেছিলেন যেন মানুষ জীবন পায় এবং তা যেন পরিপূর্ণভাবেই পায়। তিনি অগণিত মানুষকে সেবা করেছেন । তাদেরকে রোগমুক্ত করেছেন, দরিদ্র ও ক্ষমতাহীনদের পক্ষ নিয়েছেন । নিঃশর্তভাবে মানুষকে ভালোবেসেছেন । মানুষের কাছে পিতার সীমাহীন ভালোবাসার কথা বলেছেন। মানুষকে শিখিয়েছেন ঈশ্বরকে পিতা বলে ডাকতে । মানুষকে পাপ থেকে রক্ষা করার জন্য শেষ পর্যন্ত বিশ্বস্ত থেকে তিনি ক্রুশের উপর আত্মদান করেছেন। সব মানুষকে দিয়েেেছন ঐশ সন্তান হবার অধিকার । নিম্নে যীশুর আত্মদানের কয়েকটি বিশেষ দিক আলোচনা করা হলো ।
১. মন্দিরে নিবেদিত শিশু যীশু: ইহুদি রীতি অনুসারে জন্মের চল্লিশ দিন পর পুরুষ শিশুকে মন্দিরে নিবেদন করা হতো । সেই রীতি অনুসারে মা মারীয়া ও সাধু যোসেফ শিশু যীশুকে মন্দিরে নিবেদন করলেন । জীবনের শুরু থেকেই যীশু ছিলেন নিবেদিত । শিশুকালেই তাঁর পিতামাতা তাঁকে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছেন ।
২. মন্দিরে পিতার কাজে' বালক যীশু: বারো বৎসর বয়সে যীশুর পিতামাতা যীশুকে নিয়ে নিস্তার পর্ব পালন করার জন্য যেরুসালেম মন্দিরে গিয়েছিলেন । তখনই যীশু জানতেন তাঁকে পিতার কাজে ব্যাপৃত থাকতে হবে । তাই তিনি পিতামাতার অজান্তে মন্দিরেই থেকে গিয়েছিলেন। তাঁর পিতামাতা ভেবেছিলেন তিনি হারিয়ে গেছেন । খুঁজতে খুঁজতে তিন দিন পর তাঁরা তাঁকে মন্দিরে পণ্ডিতদের মধ্যে ধর্ম বিষয়ক আলোচনায় রত দেখতে পান । পিতামাতা তাঁকে খুঁজে পাওয়ার পর তিনি আবার তাঁদের সাথে নাজারেথে ফিরে যান ও তাঁদের সাথে বসবাস করতে থাকেন ।
৩. শয়তানের দ্বারা প্রলোভিত হওয়া: যীশু তাঁর প্রকাশ্য জীবন ও কাজ আরম্ভ করার আগে মরুপ্রান্তরে গেলেন এবং চল্লিশ দিন যাবৎ উপবাস ও ধ্যান-প্রার্থনা করলেন । এই সময় শয়তান তাঁকে নানাভাবে পরীক্ষা করে প্রলোভনে ফেলতে চেয়েছিল । সে সময়ও যীশু বার বার ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন এবং ঈশ্বরের শক্তিতে সমস্ত পরীক্ষা প্রলোভন জয় করেছেন । সম্পূর্ণ আত্মদানের মাধ্যমেই তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন এবং মানুষের জন্য কাজ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন ।
৪. যীশুর প্রকাশ্য কর্মজীবনঃ নির্ধারিত সময় পূর্ণ হওয়ার পর যীশু তাঁর কর্মজীবন আরম্ভ করলেন। তিনি সর্বান্তকরণে মানুষকে ভালোবেসেছেন । নিজের সব ক্ষমতা ও শক্তি দিয়ে মানুষের সেবা করেছেন । মানুষকে রোগ থেকে সুস্থ করেছেন, পাপের হাত থেকে বন্দীকে মুক্ত করেছেন, দরিদ্র ও ক্ষমতাহীনদের পক্ষ নিয়েছেন, আশাহীনকে শুনিয়েছেন আশার বাণী ।
৫. শেষ ভোজের সময় নিজেকে খাদ্য ও পানীয়রূপে দানঃ মৃত্যুর পূর্বে শেষ ভোজে বসে তিনি তাঁর দেহ ও রক্ত পরিত্রাণদায়ী খাদ্যরূপে দান করেছেন । জীবনদায়ী খাদ্য পবিত্র খ্রিষ্টপ্রসাদ/সাক্রামেন্ত স্থাপন করছেন । পরিপূর্ণভাবে তিনি নিজেকে দান করলেন চিরকালের জন্য । ইতিহাসে আত্মদানের এমন উদাহরণ আর নেই ।
৬. সেবার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা : শেষ ভোজে বসে যীশু তাঁর বিনম্র সেবার আর একটি স্মরণযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন । তিনি নিজ হাতে শিষ্যদের পা ধুয়ে দিলেন । এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি বোঝাতে চাইলেন তিনি সেবা পেতে নয় বরং সেবা করতে এসেছেন । তিনি মানুষ হয়ে এই পৃথিবীতে এসেছেন মানুষের জন্য নিজেকে দান করতে । সেই সাথে তিনি আমাদের এই শিক্ষাও দিতে চান আমরাও যেন পরস্পরের সেবা করি । অন্যদের জন্য জীবন দান করি ।
৭. সাক্রামেন্ত প্রতিষ্ঠা: সাতটি সংস্কার (প্রোটেস্টান্ট মতে দুইটি) স্থাপনের মধ্য দিয়ে যীশু নিজেকে আমাদের জন্য দান করেছেন। আমরা যেন পরিপূর্ণভাবে জীবন পাই । আমরা যেন সব অবস্থায় ঐশ আশীর্বাদ লাভ করতে পারি । সাক্রামেন্তগুলো আমাদের জন্য বিশেষ উপায় যার মধ্য দিয়ে যীশু আমাদের জন্য প্রতিনিয়ত নিজেকে দান করছেন ।
৮. গেৎসিমানি বাগানে শত্রুদের হাতে সমর্পিত হওয়া: যীশু ইচ্ছা করলে যন্ত্রণাভোগ ও ক্রুশমৃত্যু এড়িয়ে যেতে পারতেন । পিতার কাছে তিনি প্রার্থনাও করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “হে পিতা, তুমি যদি চাও, তাহলে এই পানপাত্রটি আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও! তবে আমার ইচ্ছা নয়, তোমারই ইচ্ছা পূর্ণ হোক!” জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পিতার ইচ্ছাই পালন করার পথ বেছে নিলেন । মানুষকে পাপ মুক্ত করার জন্য তিনি সমস্ত যন্ত্রণা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলেন ।
৯. পিলাতের বাড়িতে বিচারে দণ্ডিত হওয়া: পিলাতের বাড়িতে মিথ্যা বিচার ও বিচারের নামে প্রহসনকে তিনি মাথা পেতে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন । তাঁকে দেওয়া হলো সবচেয়ে লজ্জাজনক শাস্তি, ক্রুশীয় মৃত্যু । মানুষের জন্য তিনি তাও গ্রহণ করলেন ।
১০. ক্রুশীয় মৃত্যুবরণ: সবকিছুর পর চূড়ান্তভাবে তিনি অসহনীয় কষ্ট ভোগ করে ক্রুশের উপর প্রাণত্যাগ করলেন । মানুষের পরিত্রাণের জন্য তিনি এই মৃত্যুবরণ করলেন । নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দান করলেন মানুষের জন্য । তিনি নিজেকে নত করলেন এবং ক্রুশের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাধ্য থাকলেন । তিনি নিজেই বলেছেন বন্ধুর জন্য জীবন দান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দান আর কী হতে পারে ?
১১. পুনরুত্থানের পর শিষ্যদের দর্শন ও পবিত্র আত্মাকে প্রেরণ করার প্রতিশ্রুতিঃ তিনি ক্রুশীয় মৃত্যুবরণ করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি মৃত্যুকে জয় করলেন । তিনি পুনরুত্থিত হলেন । এইভাবেই তিনি তাঁর পরিপূর্ণ আত্মদানের মধ্য দিয়ে আমাদের পরিপূর্ণ জীবন দিলেন । পুনরুত্থানের পর স্বর্গারোহণের পূর্বে তিনি তাঁর আত্মাকে আমাদের জন্য পাঠিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। পঞ্চাশত্তমী পর্বের দিনে পবিত্র আত্মাকে দানের মধ্য দিয়ে যীশু তাঁর আত্মদানের পূর্ণতা ঘটালেন ।
মণ্ডলীর মস্তক হিসেবে যীশু সব সময় আমাদের সাথে রয়েছেন । প্রতিবার পবিত্র খ্রিষ্টপ্রসাদ বা প্রভুর ভোজ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা যীশুকে গ্রহণ করি । তিনি আমাদের মধ্যে আসেন এবং তাঁর জীবন আমাদের দান করেন । পবিত্র বাণীর মধ্য দিয়েও যীশু নিজেকে দান করেন ।
কাজ : খ্রিষ্টের আত্মদান কীভাবে তোমার আত্মদানকে অনুপ্রাণিত করে? দলে সহভাগিতা কর ।
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. শিক্ষাদান বা জ্ঞানদান কী?
ক.দয়ার কাজ
খ. মানবতার কাজ
গ. সেবা কাজ
ঘ. ভালো কাজ
2. আমরা কীভাবে যীশুকে গ্রহণ করি?
ক. বাণীর মাধ্যমে
খ. জীবন যাপনের মাধ্যমে
গ. সাক্রামেন্তের মাধ্যমে
ঘ. খ্রিষ্টপ্রসাদের মাধ্যমে
নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
মনি অনেক পরিশ্রম করে একটি নার্সারি প্রতিষ্ঠা করেন । সেখানে তিনি কয়েক জন গরিব লোক নিয়োগ দিয়ে
স্বনির্ভর হতে সাহায্য করেন ।
৩. মনির সেবার ক্ষেত্র কী ছিল ?
ক. ব্যক্তি
গ. সমাজ
খ. পরিবার
ঘ. মণ্ডলী
৪. মনি তার সেবার মাধ্যমে -
i. দারিদ্র্য বিমোচন করেন
ii. অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেন
iii. মানুষের সেবা করেন
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii
গ. i ও iii
খ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. ব্যক্তিস্বতন্ত্র্যের দুইটি বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর ।
তোমার জানা একজন সাধুর বা সাধ্বীর জীবনী সংক্ষেপে বর্ণনা কর ।
৩. ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের তিনটি ইতিবাচক ফলাফল উল্লেখ কর ।
৪. মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর ।
৫. সেবা কাজে আত্মনিবেদন বলতে কী বোঝায় ?
সৃজনশীল প্রশ্ন
১. প্রদীপ তাদের পরিবারের শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে । একদিন সে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একজন বৃদ্ধকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় । প্রদীপ একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও কীভাবে এত খারাপ আচরণ করতে পারে । এক সময় প্রদীপের এমন আচরণের কথা শুনে তার প্রতিবেশী প্রণয় চিন্তা করল এ বিষয়টি প্রদীপকে বলা দরকার । তাই প্রণয় সুযোগ বুঝে প্রদীপকে তার মন্দ আচরণের কথা বুঝিয়ে বলে । প্রণয়ের কথা শুনে প্রদীপ বুঝতে পারে এ ধরনের আচরণ শোভনীয় নয় ।
ক. নিজেকে জানার প্রথম ধাপ কোনটি ?
খ. একজন মানুষ থেকে অন্য আর একজন মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা কেন ?
গ. প্রণয়ের কোন দিকটি প্রদীপকে পরিবর্তিত হতে সাহায্য করেছে- ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. স্বাধীন মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রদীপের আত্মমূল্যায়নেরও দরকার বলে কি তুমি মনে কর ? বিশ্লেষণ কর ।
২. তৃণা ও তৃষা যমজ বোন । বাহ্যিক চেহারা, গায়ের রং, উচ্চতা, কথা বলার ধরন সবই এক রকম । বুদ্ধির দিক থেকে প্রায় কাছাকাছি । তৃষা গরিব সহপাঠীদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে । পিতামাতার বাধ্য এবং লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে । অপরদিকে তৃণা অলস, অন্যের প্রতি অমনোযোগী, নিজের সুযোগ সুবিধার প্রতি নজর বেশি ।
ক. প্রকৃত শিক্ষা কী ?
খ. মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তা কী ? ব্যাখ্যা কর ।
গ. তৃণা ও তৃষার মধ্যে যে পার্থক্য তাকে কী বলা হয় ? ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. “তৃণা ও তৃষার যে পার্থক্য তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের ফলাফলই রয়েছে’– মূল্যায়ন কর।