মানুষ পরিবেশের দাস। অনুকূল পরিবেশে মানুষের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটে। সমাজ, অর্থনীতি, ব্যবসা- বাণিজ্যসহ সর্বত্রই তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে তার বৈপরিত্য লক্ষ করা যায় । মানুষ তার উৎসাহ-উদ্যম হারায়। নেতিবাচক চিন্তা ও হতাশা মানুষকে আচ্ছন্ন করে। ব্যবসায় উদ্যোগের সাথে যেহেতু ঝুঁকির প্রশ্ন জড়িত তাই ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণে একজন ব্যক্তি স্বভাবতই অনুকূল পরিবেশের প্রত্যাশা করে। এরূপ পরিবেশ বলতে নিম্নোক্ত উপাদানসমূহের উপস্থিতিকে বুঝানো হয়ে থাকে:
১. উন্নত অবকাঠামোগত সুবিধা (Advantages of developed infrastructure): ব্যবসায় উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে অবকাঠামোগত সুবিধা; যেমন- বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। এরূপ সুবিধাদি উন্নত হলে উদ্যোক্তারা নতুন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত হয়। বাংলাদেশে অনুন্নত অবকাঠামোর কারণে ব্যবসায় উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে ।
২. সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা (Govt. patronization): ব্যবসায় উদ্যোগকে সফল করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও গুরুত্বপূর্ণ । উন্নত দেশের সরকারসমূহ এরূপ উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ব্যবসায় বান্ধব নীতি প্রণয়ন, জামানতবিহীন ঋণদান, স্বল্পসুদে বা বিনাসুদে ঋণপ্রদান, কর অবকাশ, সহজে লাইসেন্সসহ ইউটিলিটি সুবিধা প্রদান ইত্যাদির ব্যবস্থা করে থাকে । এতে নতুন উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হয় ।
৩. আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা ( Socio-economic stability) : ব্যবসায় উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দেশের আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পৃথিবীর যে সকল দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান সেখানে সামাজিক অস্থিরতার মাত্রা কম থাকে। ফলে ব্যবসায়ীরা পরিকল্পিতভাবে স্বল্পমাত্রার ঝুঁকির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে । কিন্তু আমাদের মতো দেশে আর্থ-সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসায় উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করে।
৪. অনুকূল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি (Favourable law & order situation) : আইন শৃঙ্খলার সাথেও ব্যবসায় উদ্যোগ বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। যেখানে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য লক্ষণীয়, বিচার ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর মানুষের আস্থা নেই, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবসময় পথ চলতে হয়- সেখানে ব্যবসায় উদ্যোগ কখনই উৎসাহিত হতে পারে না। তাই এরূপ উদ্যোগ গড়ে উঠতে অনুকূল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিকল্প নেই ।
৫. পর্যাপ্ত পুঁজির প্রাপ্যতা (Availability of sufficient capital) : ব্যবসায় উদ্যোগের ক্ষেত্রে পুঁজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । নতুন উদ্যোক্তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুঁজির সংকটে ভোগে। তাই পর্যাপ্ত পুঁজির যোগান দিতে না পারায় একসময় ভালো উদ্যোগও সফল হতে পারে না। যে সমাজে মানুষের আয় ও সঞ্চয় বেশি, সেখানে সঞ্চয় থেকেই পুঁজির অংশবিশেষ আসতে পারে। এছাড়া ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে এ ধরনের উদ্যোক্তাদের সহজে ঋণ দেয়, সরকারও নানানভাবে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়- সেখানে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় উদ্যোগ উৎসাহিত হয়।
৬. উপকরণাদির সহজ প্রাপ্যতা (Availability of means of production) : পুঁজির প্রাপ্যতার সাথে উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ; যেমন- ভূমি শ্রম, কাঁচামাল, ইত্যাদির প্রাপ্যতাও ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ । উর্বর জমি কৃষি শিল্প গড়তে উৎসাহ দেয়। সস্তা শ্রমিকের কারণে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠছে। বাঁশ, বেত ইত্যাদি পর্যাপ্ত থাকায় সিলেট বা চট্টগ্রামে এরূপ হস্ত শিল্প গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ রয়েছে।
৭. বাজার সুবিধা (Market facilities) : ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার ক্ষেত্রে বাজার সুবিধা গুরুত্বপূর্ণ বাজার বলতে নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো পণ্য বা সেবার চাহিদাকে বুঝানো হয়। বাংলাদেশ প্রায় ষোল কোটি লোকের দেশ হওয়ায় এখানে স্বাভাবিকভাবেই পণ্য ও সেবার একটা বড় বাজার রয়েছে। তাই এখানে ব্যবসায়। উদ্যোগ উৎসাহিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের বিদেশে বড় বাজার থাকায় এখানে অনেক উদ্যোক্তা নানান প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও এ ব্যবসায় উদ্যোগকে সফল করতে সমর্থ হয়েছে।
৮. প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের সুযোগ (Opportunity of training & development) : নতুন উদ্যোক্তাদেরকে উৎসাহ দান ও তথ্য প্রদানের জন্য প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ কেন্দ্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় । এখানে থেকে সম্ভাব্য উদ্যোক্তারা নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে ও তার বাস্তবায়নের কৌশল সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় উদ্যোগ উৎসাহিত হয়। উল্লেখ্য অনেক দেশ এক্ষেত্রে যথেষ্ট এগিয়ে। ফলে সে সকল দেশে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণির বিকাশ লক্ষণীয় ।