ব্যবস্থাপনার আওতা বা পরিধি

ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ২য় পত্র - ব্যবস্থাপনার আওতা বা পরিধি

সাধারণ অর্থে, ব্যবস্থাপনার কাজ হলো অন্যের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করা । প্রাচীনকালে মানুষ যখন নিজের অভাব নিজেই পূরণ করত তখন ব্যবস্থাপনার বিষয় চিন্তায় আসেনি। যখন মানুষ সমাজবদ্ধ হলো, উৎপাদন বাড়তে লাগলো কার্যত সভ্যতা যতই এগুলো মানুষের কর্মপ্রচেষ্টাও তত সম্প্রসারিত হলো এবং সেই সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবস্থাপনাও গুরুত্ব লাভ করলো । এই গুরুত্বের সাথে ব্যবস্থাপনার আওতা বা পরিধি বেড়ে গেলো । বর্তমানে ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যেই কেন্দ্রীভূত নয়; সরকারি-বেসরকারি, বাণিজ্যিক- অবাণিজ্যিক সকল প্রতিষ্ঠানেই এটি একটি প্রধান কার্য হিসেবেই বিবেচিত । বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে ব্যবস্থাপনার আওতা নিম্নে তুলে ধরা হলো :

১. প্রতিষ্ঠানভেদে ব্যবস্থাপনার আওতা (Scope of management from institutional point of view) : গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে বলেছিলেন, “ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন” (Management is universal)। যেখানেই একের অধিক মানুষ একত্রে বাস করে সেখানেই কোনো না কোনোভাবে একটা ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব লাভ ঘটে । তাই পরিবারে যেমনি একটি ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব বিরাজমান তেমন সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্রই ব্যবস্থাপনা ক্রিয়াশীল । পরিবারে পিতা বা মাতা যেমনি একজন ব্যবস্থাপক তেমনি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীও একজন ব্যবস্থাপক । তাই যেখানে যে উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় সেখানেই ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব লক্ষণীয় । নিম্নে প্রতিষ্ঠানভেদে ব্যবস্থাপনার আওতা তুলে ধরা হলো :

ক) সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান : এর আওতাভুক্ত হলো পরিবার, সমাজ, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, ক্লাব, লাইব্রেরি, সামাজিক সংস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এনজিও প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা ।

খ) রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান : এর অধীন হলো ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও জেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন, পুলিশ প্রশাসন, শিক্ষা প্রশাসন, ডাক, টেলিযোগাযোগ, সড়ক যোগাযোগ, রেল, বিমান, বাংলাদেশ ব্যাংক, ওয়াসা, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক সংস্থা, মন্ত্রণালয় ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা ।

গ) ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান : বিভিন্ন ধরনের বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, খুচরা, পাইকারি, আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমা, পরিবহন, গুদামজাতকরণ, বিজ্ঞাপনি সংস্থা, হোটেল, হাসপাতাল, ক্লিনিক ইত্যাদি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা এর অধীন । ঘ) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান : জাতিসংঘ ও এর অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক আদালত, শ্রম সংস্থা, এডিবি, আইডিবি, সার্ক, আসিয়ান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা এর মধ্যে পড়ে ।

২. কাজের দৃষ্টিকোণ হতে ব্যবস্থাপনার আওতা (Scope of management from functional point of view) : একজন ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কাজ সম্পাদন করেন। স্বনামধন্য ব্যবস্থাপনাবিদ পিটার এফ. ড্রাকারের মতে, ব্যবস্থাপনা নিম্নোক্ত তিন ধরনের কাজ সম্পাদন করে যা ব্যবস্থাপনার আওতাধীন :

ক) প্রতিষ্ঠান পরিচালনা : প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বলতে একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপায়-উপাদানের সুষ্ঠু পরিচালনা বা নেতৃত্ব প্রদানকে বুঝায় । তাই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে অধিক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত সকল কার্যই ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত ।

খ) ব্যবস্থাপকদের ব্যবস্থাপনা : প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্তরের নির্বাহী বা ব্যবস্থাপকগণ কর্মরত থাকেন। তাই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ স্তর হতে একেবারে নিচের স্তরে নিয়োজিত ফোরম্যান বা সুপারভাইজার পর্যায়ের সব লোকেরাই ব্যবস্থাপনার আওতাধীন । যাদের ব্যবস্থাপনাও এর অধিনে গড়ে ।

গ) শ্রমিক-কর্মী পরিচালনা : শ্রমিক-কর্মীরাই হলো প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষভাবে কার্য সম্পাদনে নিয়োজিত পক্ষ । তাই তাদের নিকট হতে যথাযথ কাজ আদায়ের নিমিত্তে পরিকল্পনা গ্রহণ, সংগঠন, কর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি, কর্মী পরিচালনা, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণের মতো সর্ববিধ কার্যাবলি গ্রহণ করতে হয় । এগুলো ব্যবস্থাপনা কার্যের অধীন।

৩. কৌশল প্রয়োগের ভিত্তিতে আওতা (Scope of management from strategic point of view) : একজন ব্যবস্থাপককে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে হয় । প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে সফলতার সাথে টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের রণকৌশল গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে। এরূপ কৌশল গ্রহণের জন্য তথ্য সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়। তাও ব্যবস্থাপনা কাজের আওতাধীন ।

৪. কার্যবিভাগের দৃষ্টিকোণ হতে ব্যবস্থাপনার আওতা (Scope of manangement from the view point of division of work) : প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠুভাবে কার্য পরিচালনার জন্য একে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করা হয় । এ সকল বিভাগ পরিচালনা সংক্রান্ত কার্যাদিও ব্যবস্থাপনার আওতাধীন। কার্য বিভাগের দৃষ্টিকোণ হতে উৎপাদনধর্মী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাকে নানান ভাগে ভাগ করা হয়; যথা-উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, ক্রয় ব্যবস্থাপনা, বিক্রয় বা বিপণন ব্যবস্থাপনা, শ্রমিক-কর্মী ব্যবস্থাপনা, অর্থ ব্যবস্থাপনা, অফিস ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ।

৫. স্তরভেদে ব্যবস্থাপনার আওতা (Scope of manangement from the view point of levels) : ব্যবস্থাপনা, প্রতিষ্ঠানের উচ্চস্তর হতে শ্রমিক-কর্মী তত্ত্বাবধানের স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত । স্তরভেদে ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ স্তর, মধ্যস্তর ও নিম্নস্তর এ সকল ভাগে ভাগ করা হয় । একটা বড় উৎপাদনধর্মী প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনার উপরিস্তরে থাকেন পরিচালকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সাধারণ ব্যবস্থাপক প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ । মধ্যস্তরে বিভাগীয় ব্যবস্থাপক, জোনাল ব্যবস্থাপক, কারখানা ব্যবস্থাপক পদবির ব্যক্তিবর্গ কাজ করেন। নিম্নস্তরে, সুপারভাইজার, মাঠ কর্মকর্তা, ফোরম্যান ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ সরাসরি কাজ তত্ত্বাবধান করেন। যাদের প্রত্যেকের কাজ ব্যবস্থাপনার আওতাধীন।

Content added By
Promotion