জীবন বৃত্তান্ত (Bio-data) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে ফ্রেডারিক উইন্সলো টেলর ১৮৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনে আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও খারাপ দৃষ্টিশক্তির কারণে। তার পক্ষে লেখাপড়া চালানো সম্ভব হয়নি। ১৮৭৫ সালে তিনি একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্যাটার্ন প্রস্তুতকারী মেকানিকের কাজ শেখার জন্য শিক্ষানবীস হিসেবে যোগ দেন। ১৮৭৮ সালে টেলর মিডডেল স্টীল কোম্পানিতে মেকানিক হিসেবে কাজে যোগদান করেন। কার্যক্ষেত্রে স্বীয় দক্ষতা, প্রতিভা ও প্রজ্ঞার বলে ১৮৮৪ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে মিডভেল কোম্পানিতে প্রধান প্রকৌশলী পদে উন্নীত হন। উল্লেখ্য বৈকালিন সময়ে লেখাপড়া করে ইতোমধ্যে তিনি ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৯০ সালে তিনি মিডভেল কোম্পানি থেকে ইস্তফা দেন এবং ১৯০০ সাল পর্যন্ত Consulting Engineer হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন । জীবনের বাকি সময়টা তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের উদ্ভাবন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁর নতুন চিন্তাধারার প্রয়োগে অবৈতনিক পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন ও নতুন ধারণার প্রবক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। যা পরিণামে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা (Scientific Management) নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে অনেক গবেষক ও ব্যবস্থাপনা বিশারদ তার প্রদত্ত ধারণা নিয়ে বিশ্লেষণ ও এর উন্নয়ন সাধন করলেও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক (Father of Scientific Management) হিসেবে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন । ১৯১৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।
অবদান (Contributions) : ফ্রেডারিক উইন্সলো টেলর সাধারণ শিক্ষানবীস থেকে প্রধান প্রকৌশলী পর্যন্ত বিভিন্ন পদে দীর্ঘ দু'যুগ দায়িত্ব পালন করেছেন। এতে তাঁর কাছে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমস্যা ধরা পড়ে। তিনি এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পর তা সমাধানের পন্থা কী হতে পারে এ নিয়ে দীর্ঘ দুই দশক বিভিন্ন গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন। এভাবেই তিনি তাঁর গবেষণাকর্মের ফলাফলকে একটা দর্শনে রূপ দেন । যা বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা (Scientific Management) নামে পরিচিত। এরূপ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে তাঁর অবদানসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
ক) গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা (Writing books and articles): টেলর গবেষণাকর্ম পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ভাবনাকে সাধারণ্যে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেন। যার মধ্যে The Principles of Scientific Management অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এ ছাড়াও Shop Management, A Piece Rate System. The Gospel of Efficiency ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । যা তাঁর দর্শনকে পরবর্তী গবেষণার বিষয়বস্তু হতে ও স্থায়ী রূপ পরিগ্রহে সহায়তা করেছে। তিনি তাঁর চিন্তাধারায় বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপকে একটা মানসিক বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যা গতানুগতিক ব্যবস্থাপনা ধারণা থেকে ব্যবস্থাপনাকে বেরিয়ে আসতে সুযোগ করে। দিয়েছে।
খ) বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার আদর্শ উপস্থাপন (Introducing scientific management principle) : টেলর তাঁর গবেষণাকর্মের মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার দু'টি দিক; মানবীয় দিক (উত্তম কর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি) ও বস্তুগত দিক (পরিকল্পনা, কারখানা পরিবেশ ইত্যাদি) নির্দেশ করেন ও তার উন্নয়নের উপায় নির্দেশ করেন । সেই সাথে তিনি এরূপ ব্যবস্থাপনার কতিপয় আদর্শ তুলে ধরেন; যা নিম্নরূপঃ
১. টিপসহির পদ্ধতি (গতানুগতিক হাতুড়ে পদ্ধতি) পরিহারপূর্বক মানুষের প্রতিটা কাজে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার করা;
২. বৈজ্ঞানিক উপায়ে কর্মী নির্বাচন, প্রশিক্ষণদান ও তাদের উন্নয়ন সাধন করা;
৩. সৌহার্দ্যপূর্ণ শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা; ও
৪. ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিক-কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুষ্ঠু বণ্টন ।
গ) গবেষণা ও কর্ম পদ্ধতির উন্নয়ন (Research and developing working procedure) : টেলর তাঁর বাস্তব উপলব্ধি ও গবেষণাকর্মের মধ্য দিয়ে ব্যবস্থাপনা কর্ম সম্পাদনের অনেকগুলো সহায়ক উপাদান (Elements) বা পদ্ধতি (Mechanism)-এর উদ্ভাবন করেছেন। যা ব্যবস্থাপনা কাজকে অধিক কর্মক্ষম ও ফলদায়ক করতে সমর্থ হয়েছে। এর মধ্যে নিম্নোক্ত উপাদানসমূহ উল্লেখযোগ্য :
১. সময় নিরীক্ষা;
২. গতি নিরীক্ষা;
৩. শ্রান্তি নিরীক্ষা;
৪. কার্যভিত্তিক ফোরম্যানশীপ বা সংগঠন;
৫. পরিকল্পনার জন্য পৃথক কক্ষ বা বিভাগ;
৬. ব্যবস্থাপনায় ব্যতিক্রম আদর্শের অনুসরণ;
৭. কলকব্জা ও যন্ত্রপাতির বিনির্দিষ্ট মান প্রতিষ্ঠা;
৮. স্লাইড রুল এবং সমজাতীয় শ্রম-সংক্ষেপ যন্ত্রপাতির ব্যবহার;
৯. শ্রমিকদের জন্য নির্দেশ কার্ড প্রণয়ন;
১০. পার্থক্যমূলক ঠিকা মজুরি হার ব্যবস্থার প্রবর্তন;
১১. সকল কার্যের জন্য বোনাস পদ্ধতির প্রবর্তন এবং
১২. উৎপাদনে ব্যবহৃত কলকব্জা ও উৎপাদিত পণ্যের শ্রেণিবিন্যাসে নিমোনিক (Mnemonic) পদ্ধতির উদ্ভাবন ।
ঘ) মানব সম্পদের উপর গুরুত্বারোপ (Providing importance on human resources) : টেলর যদিও তাঁর গবেষণার মধ্য দিয়ে কার্যক্ষেত্রে পদ্ধতিগত উন্নয়ন সাধন করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কথা বলেছেন তবে তিনি কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানে মানবশক্তির গুরুত্বকে ছোট করে দেখেননি । তিনি অকপটে বিশ্বাস করতেন বস্তুগত সম্পদের সদ্ব্যবহারের মূলেই রয়েছে মানুষের মানবিক প্রচেষ্টার প্রয়োগ । তিনি আরো লক্ষ করেন যে, মানুষের প্রচেষ্টা যতো বাড়ে সম্পদও ততোই বৃদ্ধি পায়। এ জন্যই তিনি সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, “বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মানসিক বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত । আর এটি হলো কাজের প্রতি, সহকর্মীদের প্রতি এবং কর্মকর্তাদের প্রতি তাদের মনোভঙ্গির আমূল পরিবর্তন।" আর এভাবেই নতুন চিন্তাগত ও পদ্ধতিগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে টেলর ব্যবস্থপনার জগতে নতুন এক দিগন্তের সৃষ্টি করেছেন । যা তৎকালীন সময়েই শুধু নয় বর্তমানকাল অবধি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে রয়েছে।