মি. মজুমদার একটা ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ব্যবস্থাপক বা মুখ্য নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন বিশ বছর আগে । তখন তার অধীনে উৎপাদন ও বিক্রয় বিভাগের দু'জন ব্যবস্থাপক অধীনস্থ নির্বাহী হিসেবে কাজ করতেন । উৎপাদন ব্যবস্থাপকের অধীনে ছিল দু'জন কর্মী তত্ত্বাবধায়ক ও তাদের অধীনে মোট বিশ জন শ্রমিক । বিক্রয় ব্যবস্থাপকের অধীনে তিনজন বিক্রয় তত্ত্বাবধায়ক এবং তাদের অধীনে মোট ত্রিশ জন বিক্রয়কর্মী । ছোট প্রতিষ্ঠান তাই সহজ সংগঠন কাঠামো ছিল । পরে উৎপাদন ও বিক্রয় বাড়লো । উৎপাদন বিভাগে নতুন নতুন প্লান্ট বসায় প্রতিটা প্লান্টে আলাদা ম্যানেজার নিয়োগ করা হলো । সেভাবে নিচের স্তরগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক ও শ্রমিক- কর্মীর সংখ্যা বাড়লো। বিক্রয় বিভাগে এরিয়া সেলস ম্যানেজার, সেলস সুপারভাইজার ও বিক্রয় কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো । তাই উৎপাদন ব্যবস্থাপক ও বিক্রয় ব্যবস্থাপককে সহযোগিতার জন্য প্রত্যেককে একজন করে সহকারী দেয়া হলো। তিনি নিজের অধীনেও একজন সহকারী জেনারেল ম্যানেজার নিয়োগ দিয়েছেন। পরবর্তীতে কাজের চাপ ও জটিলতা বাড়ায় এবং ক্ষেত্রেবিশেষে উৎপাদন ব্যবস্থাপক ও সহকারী উৎপাদন ব্যবস্থাপকের মধ্যে দ্বন্দ্ব লক্ষ করে মি. মজুমদার উৎপাদন বিভাগের কাজকে প্রকৃতি অনুযায়ী ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে সীমিত কর্তৃত্ব সহযোগে সেখানে আলাদা আলাদা ব্যবস্থাপক নিয়োগ করেন । উৎপাদন ব্যবস্থাপককে সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (উৎপাদন) হিসেবে পদোন্নতি দেন । উৎপাদিত পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়ে সমান গুরুত্ব না পাওয়ায় ব্যবসায় দু-একটা পণ্য নির্ভর হয়ে পড়েছিল । তাই তিনি প্রতিটা পণ্যকে আলাদা প্রজেক্ট ধরে নিয়ে প্রতিটা পণ্যের জন্য প্রজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগ দিয়েছেন । অন্যান্য ব্যবস্থাপকগণ কার্যিক ব্যবস্থাপক হিসেবে প্রজেক্ট ম্যানেজারকে সহায়তা করেন । এতে প্রতিটা পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় নিয়ে মি. মজুমদারকে ভাবতে হয় না। তিনি কোনো সমস্যা হলে সেখানেই শুধু হস্তক্ষেপ করেন। প্রয়োজনে সমস্যা সমাধানের জন্য অথবা সমন্বয়ের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ঊর্ধ্বতনকে দায়িত্ব দেন । যারা সামষ্টিকভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন । ফলে প্রতিষ্ঠান বড় হলেও মি. মজুমদার অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে তার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন । আর এটা সম্ভব হয়েছে প্রয়োজনের সাথে মিল রেখে প্রতিষ্ঠানের সংগঠন কাঠামোতে পরিবর্তন আনার কারণেই । তিনি যদি শুরুতে যে সংগঠন কাঠামো পেয়েছিলেন তার ওপর নির্ভর করতেন তবে কোনোভাবেই এত বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না ।
সংগঠন কাঠামো হলো প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগের পারস্পরিক সম্পর্কের কাঠামো । এরূপ সম্পর্ক সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে নিয়োজিত ব্যক্তি ও বিভাগের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সাংগঠনিক অবস্থান ও পদমর্যাদা থেকে সৃষ্ট হলে তাকে আনুষ্ঠানিক সংগঠন বলে । এর বাইরে কর্মরত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মিল- মহব্বত, পছন্দ-অপছন্দ সামাজিক, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বিভিন্ন কারণে সম্পর্কের সৃষ্টি হলে তাকে অনানুষ্ঠানিক সংগঠন বলা হয়ে থাকে। ছোট হতে বড় বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান সমাজে কর্মরত রয়েছে। এদের প্রত্যেকের কাজের প্রকৃতিও নানান রকমের। কর্তৃত্ব এবং কর্তৃত্ব প্রবাহের ধারণাও এক নয় । তাই প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রেখে নানান ধরনের সংগঠন কাঠামো আমরা দেখতে পাই । নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১. সরলরৈখিক সংগঠন (Line organization) : যে সংগঠন কাঠামোতে কর্তৃত্ব রেখা ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ স্তর হতে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে সরলরেখার আকারে নেমে আসে তাকে সরলরৈখিক সংগঠন বলে। সামরিক সংগঠনে আদেশদানের সরলরৈখিক গতিরেখার প্রতি যে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয় এবং ঊর্ধ্বতনের আদেশ অধস্তনরা যেভাবে বিনা দ্বিধায় মানতে বাধ্য থাকে, এক্ষেত্রে অনুরূপ নীতিমালা অনুসরণ করা হয় বলে একে সামরিক সংগঠনও বলা হয়ে থাকে ।
২. সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠন (Line and staff organization) : যে সংগঠন কাঠামোতে সরলরৈখিক নির্বাহীকে সহযোগিতা করার জন্য উপদেষ্টা বা বিশেষজ্ঞ কর্মীর ব্যবহার করা হয় তাকে সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠন বলে । এরূপ সংগঠন কাঠামোতে দু'ধরনের কর্মী থাকে - একদল সরলরৈখিক নির্বাহী ও অন্যদল উপদেষ্টা কৰ্মী । এক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা সরলরৈখিক নির্বাহী ভোগ করেন । অপরপক্ষে উপদেষ্টা কর্মীর কাজ হলো সরলরৈখিক নির্বাহীর কাজে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করা ।
৩. কার্যভিত্তিক সংগঠন (Functional organization) : কার্যভিত্তিক সংগঠন বলতে এমন এক ধরনের সংগঠনকে বুঝায় যেখানে ব্যবস্থাপনার কার্যাবলিকে কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে এদের এক একটিকে এক একজন বিশেষজ্ঞের ওপর ন্যস্ত করা হয় । এরূপ সংগঠনে বিশেষজ্ঞদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ না করে সরাসরি নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ করা হয়ে থাকে । বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক এফ. ডব্লিউ. টেইলর এ ধরনের সংগঠন কাঠামোর উদ্ভাবক ।
৪. মেট্রিক্স সংগঠন (Matrix Organization) : ব্যবস্থাপনা সংগঠনের আধুনিক রূপ হলো মেট্রিক্স সংগঠন । এটি হলো মূলত বিভাগীয়করণের একাধিক পদ্ধতির মিশ্র রূপ । দ্রব্য ও কার্যভিত্তিক বিভাগীয়করণ ও ক্ষেত্রেবিশেষে অঞ্চলভিত্তিক বিভাগীয়করণের সমন্বয়ে দ্বৈত কর্তৃত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক সম্বলিত যে সংগঠন কাঠামো বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানগুলোতে গড়ে তোলা হয় তাকেই মেট্রিক্স সংগঠন বলে । এ ধরনের সংগঠনের বৈশিষ্ট্য হলো-এক্ষেত্রে কার্যিক ব্যবস্থাপক ও প্রজেক্ট ব্যবস্থাপক- দু'ধরনের কর্তৃপক্ষ একই সঙ্গে কাজ করে ।
৫. কমিটি সংগঠন (Committee organization) : কমিটি হলো একদল লোকের সমষ্টি যাদের ওপর বিশেষভাবে কোনো নির্দিষ্ট প্রশাসনিক কার্য সমাধা করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সাধারণত সরলরৈখিক বা সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠনে বিশেষ ক্ষেত্রে বা বিশেষ প্রয়োজনে এ ধরনের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে কাজ সম্পাদনের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কমিটি, পরীক্ষা কমিটি ইত্যাদি এরূপ সংগঠনের উদাহরণ ।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান বৃহদায়তন ব্যবসায় জগতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন পূরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সংগঠন কাঠামো ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানে বা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে কোন ধরনের সংগঠন কাঠামো ব্যবহৃত হবে তা বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে ।